সদরঘাটের মোড়ে কবি রসুলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো লেখক বজলে হোসেনের। পরনে একটা ট্রপিক্যাল প্যান্ট, গায়ে লিলেনের সার্ট পায়ে একজোড়া সদ্য পালিশ করা চকচকে জুতো। লেখক বজলে হোসেন যান্ত্রিক প্রর্সি ছড়িয়ে বললো, আরে রসুল যে, কি খবর, কোথায় যাচ্ছো?

রসুল বললো, এখানে এক দর্জির দোকানে কিছু কালো কাপড় সেলাই করতে দিয়েছিলাম। নিতে এসেছি। তুমি কোথায় চলছে?

আমি? আমার ঠিকানা আছে নাকি। বেরিয়েছি, কোথাও একটু আড্ডা মারা যায় কিনা সেই খোজে। এসোনা রিভারভিউতে বসে এক কাপ চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে।

চা আমি পাব না, রোজা রেখেছি। গভীর গলায় জবাব দিলো রসুল।

তারপর ওর জুতো জোড়ার দিকে টমট করে তাকালে সে।

বজলে ভ্রূ কুঁচকে বললো, রোজা আবার কেন? যতদূর জানি এটা তো রোজার মাস নয়। পরক্ষণে বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। ও হ্যা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে, তাই না? বলে শব্দ করে হেসে উঠলো সে। কিন্তু পর মুহূর্তে কবি রসুলের রক্তলাল চোখ জোড়ার দিকে দৃষ্টি পড়তে মুখটা পাশুটে হয়ে গেলো তার। ভয়ে ভয়ে বললো, কি ব্যাপার, অমন করে তাকিয়ে রয়েছে কেন, কি ভাবছে?

তোমার ধৃষ্টতারও একটা সীমা থাকা উচিত।

ওর কথা শুনে মুখটা কালো হয়ে গেলো বজলে হোসেনের।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো, দেখ রসুল, আমরা হলাম সাহিত্যিক। সমাজের আর দশটা লোক, মিছিল কি শোভাযাত্রা বের করে, পুলিশের লাঠি গুলি খেয়ে প্রাণ দিলে কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমাদের মৃত্যু মানে দেশের এক একটা প্রতিভার মৃত্যু। নিজের জ্ঞানগর্ভ ভাষণে অশেষ তৃপ্তি বোধ করলো বজলে হোসেন।

ওর কথাটা শুনে সমস্ত দেহটা জ্বালা করে উঠলো কবি রসুলের। আশ্চর্যভাবে রাগটা সামলে নিয়ে বললো, রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে এ নিয়ে তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই নে বজলে। আমার এখন কাজ আছে।

আমারও অনেক কাজ, বলে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না বজলে, চায়ের নেশা পেয়েছে ওর। রিভারভিউতে যাবে।

রিভারভিউতে বসে এক কাপ চা আর একটা চপ খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লে সে। ডলির সঙ্গে এনগেজমেন্ট আছে। ভাবতে এখনো অবাক লাগে বজলের, কাল হঠাৎ এমন অপ্রত্যাশিতভাবে ডলি ওর কাছে ধরা দিলো কেন? একি ওর ক্ষণিক দুর্বলতা না বজলেকে সে অনেক আগে থেকে ভালবাসতো? হয়তো কোনটা সত্য নয়। হয়তো প্রথমটা সত্য। কাল রাতে সিনেমা দেখে ফেরার পথে ডলি যেন বড় বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। ঈষৎ কাত হয়ে মাথাটা রেখেছিলো ওর কাঁধের ওপর।

বজলে ওকে আলিঙ্গন করতে চাইলে ডলি বাধা দিয়ে বলেছিলো, না।

এখন আমায় এমনি থাকতে দাও বজলে।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলো, কাল যদি তোমাকে ডাকি। বেড়াতে বেরুবে তো আমার সঙ্গে?

একটু ভেবে নিয়ে ডলি জবাব দিয়েছিলো, হ্যাঁ, বেরুবো, বিকেলে যদি পারো বাসায় এসো।

বাসায় এসে বজলে দেখলো ডলি আগে থেকে সেজেওজে বসে আছে।

পরনে একটা মেরুন রঙের শাড়ি। গায়ে একটি সাদা ব্লাউজ। চুলে আজ খোঁপা বাঁধে নি ডলি, বিনুনী করে ছেড়ে দিয়েছে পিঠের উপর।

বজলেকে দেখে মৃদু হাসলো ডলি।

বজলে বললো, তুমি দেখছি তৈরি হয়ে বসে আছ। চলো।

ডলি বললো, চা খাবে না?

ও বজলে বললো, খাবো, তবে ঘরে নয় বাইরে।

রাস্তায় নেমে ডলি জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবে?

হাতের ইশারায় একখানা রিক্সা থামিয়ে জবাব দিলো, একবার রিক্সায় ওঠা যাক তো। তারপর দেখা যাবে।

রিক্সায় উঠে কিছুক্ষণ লক্ষ্যবিহীন ঘুরে বেড়াতে বেশ ভালো লাগলো ওদের। রেস্তোরাঁয় বসে দুকাপ কফি আর কিছু প্যাস্ট্রি খেলো।

বজলে সিনেমা দেখার পক্ষে ছিলো। ডলি নিষেধ করলো, রোজ সিনেমা দেখতে ভাল লাগেনা ওর। তার চেয়ে শহরতলীতে কোথাও বেড়াতে গেলে মন্দ হয় না।

বজলে বললো, দি আইডিয়া। চলে যাওয়া যাক।

ডলি বললো, চলো।

খানিকক্ষণ পর বজলে আবার বললো, সন্ধের পর মাহমুদের ওখানে যাবার কথা আছে।

তুমি যাবে তো?

ডলি বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দিলো, আমি কেন ওর ওখানে যাবো?

বজলে ওর একখানা হাত ধরে নরম গলায় বললো, ওখানে কেউ থাকবে না ডলি।

আমরা নিরিবিলিতে গল্প করবো।

ডলি ঈষৎ লাল হয়ে বললো, না।

 

বিকেলে চা খেতে বসে শাহেদ প্রশ্ন করলো, কাল রাতে আমার বিছানায় যে শুয়েছিলো, লোকটা কে-রে আপা?

আসাদ সাহেব। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।

তোমাদের দলের লোক বুঝি?

না।

ইস, না বললেই হলো। আমি দেখলে চিনি নে যেন।

চিনেছে, ভাল করেছে। এখন চুপ করো।

কেন চুপ করবো? শাহেদ রেগে উঠলো। লোকটার জ্বালায় কাল রাতে একটুও ঘুমোতে পেরেছি নাকি? ঘুমের ভেতর অমন হাত-পা নাড়তে আমি জন্মেও দেখি নি কাউকে। মাঝ রাতে ইচ্ছে করছিলো জানালা গলিয়ে, বাইরে ফেলে দিই লোকটাকে।

ওর কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো সালমা।

শাহেদ বললো, তুই হাসছিস? আমার যা অবস্থা হয়েছিলো তখন, শুধু কি হাত-পা ঘূছিলো লোকটা? ঘুমের ঘোরে কি যেন সব বলছিলো বিড় বিড় করে। আর মাঝে মাঝে চিঙ্কার উঠছিলো, উত্ কেমন করে যে রাতটা কেটেছে আমার।

হাসতে গিয়ে মুখে আঁচল দিলো সালমা। বললো, দাঁড়াও না, আজ রাতেও তোমার ওখানে থাকবে সে।

আজকেও থাকবে বুঝি? চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শাহেদ। তুই কি আমায় ঘর থেকে তাড়াতে চাস আপা।

কেন, তোমার যদি ওখানে ঘুম না আসে তাহলে আলাদা বিছানা করে দেবো সেখানে থেকো।

তাহলে তাই করে দিস। শাহেদ শান্ত হলো।

ওর মাথার চুলগুলোর মধ্যে হাত বুলিয়ে দিয়ে সালমা একটু পরে জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁরে, আমার কোন চিঠিপত্র এসেছে?

সাহেদ সংক্ষেপে ঘার নাড়লো না।

শুনে বিমর্ষ হয়ে গেলো সালমা। রওশনের শেষ চিঠি পেয়েছে সে অনেক দিন। এতো দেরি তো কোনবার হয় না। সালমার মনে হলে হয়তো তার অনেক অসুখ করেছে। না হলে চিঠি লিখছে না কেন?

ভাবতে গিয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো ওর।

 

তখন না বলেও মাহমুদের ওখানে যেতে হলো ডলিকে।

সাহানাকে নিয়ে মাহমুদ তখন বাইরে বেরুবার তোড়জোড় করছিলো।

ওদের দেখে খুব খুশি হলো সে। বললো, তোমরা এসেছে বেশ ভাল হলো। চলো এক সঙ্গে বেরোন যাবে।

বজলে শুধালো, কোথায় যাচ্ছ তোমরা

মাহমুদ বললো, সাহানা যাবে ওর এক বান্ধবীর বাসায় আর আমি একটা অফিসিয়াল কাজে।

মাহমুদকে ঈশারায় এক পাশে ডেকে নিয়ে এালো বজলে। তারপর ধমকের সুরে বললো, তুমি একটা আস্ত গবেট। ডলিকে নিয়ে এখানে এসেছি কেন এ সামান্য ব্যাপারটা বোঝ না? বলে মুচকি হাসলো সে।

ক্ষণকাল ওর দিকে তাকিয়ে মাহমুদ কাঁধ ঝাঁকালো। মৃদু হেসে হেসে বললো, বুঝেছি। তারপর ডলির দিকে এগিয়ে গেলো সে। আপনারা এখানে বসে গল্প করুন। আমি সাহানাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি। বলে আড়চোখে বজলের দিকে তাকালে সে।

ডলি ব্যস্ততার সঙ্গে বললো, আপনারা কতক্ষণে ফিরবেন?

মাহমুদ কাঁধ আঁকিয়ে জবাব দিলো, এইতো যাব আর আসবে।

সাহানা অকারণে হাসলো একটু।

ডলি সে হাসির কোন অর্থ খোঁজে পেলো না।

ওরা চলে গেলে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এলো বজলে।

ঘরে এখন ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। এখন ইচ্ছে করলে নির্বিঘ্নে পরস্পরকে আলিঙ্গন করতে পারবে ওরা।

ডলির পাশে এসে বসলো বজলে। তারপর দুহাতে ওকে কাছে টেনে নিলো। ডলি বিরক্তির সঙ্গে বললো, একি হচ্ছে?

বজলে ওর কানের কাছে মুখ এনে বললো, এখন আর আমায় বাধা দিয়ো না ডলি।

ডলি কপট হেসে বললো, এই জন্যে বুঝি আসা হয়েছে এখানে।

বজলে বললো, হ্যাঁ, এই জন্যে। ডলিকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করলো সে। ডলি এবার আর বাধা দিলো না।

 

রাত আটটা বাজবার তখনো কিছু বাকি ছিলো। আকাশের ক্যানভাসে সোনালি তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। কুয়াশা ঝরছে। উত্তরের হিমেল বাতাস বইছে ধীরে ধীরে।

শাহেদের হাত ধরে ছাদে উঠে এলো সালমা।

ছোট্ট ছাদ।

আরো অনেকে তখন আশেপাশের ছাদে উঠে গল্প করছিলো বসে বসে। সালমা শুনলো, রাজ্জাক সাহেব তার গিন্নীকে বলছেন, দেখো আগে থেকে সাবধান করে দিচ্ছি কাল ছেলেমেয়েদের কাউকে বাইরে বেরুতে দিয়ো না। না, না, যেমন করে থোক ওদের আটকে রেখে ঘরের মধ্যে। কে জানে কাল কি হয়। হয়তো সেবারের মত গুলি চালাবে ওরা।

শুধু রাজ্জাক সাহেব নন। সবার মুখে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ। কাল নিশ্চয় কিছু একটা ঘটবে। কি ঘটবে কে জানে। হয়তো রক্তপাত হবে। প্রচুর রক্তপাত। সালমা শুনলো, রাজ্জাক সাহেবের গিন্নী প্রশ্ন করলেন, আর কত এসব চলবে বলতো? রাজ্জাক সাহেব জবাব দিলেন, জানি না।

কেউ জানে না কতকাল এমনি উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে ওদের থাকতে হবে। এমনো সময় এসেছে মাঝে মাঝে, যখন মনে হয়েছে, এবার বুঝি তারা শান্তির নাগাল পেলো। কিন্তু পরক্ষণে তাদের সে ভুল ভেঙ্গে গেছে। হিংসার নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ওরা। হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে বলেছে, আর পারি না।

সালমা শুনলো, রাজ্জাক সাহেব বলছেন, কতকাল চলবে সে কথা ভেবে কি হবে। তুমি ছেলেমেয়েগুলোকে কাল একটু সামলে রেখো।

গিন্নী বললেন, রাখবো।

আর এমনি সময় অকস্মাৎ সমস্ত শহর কাঁপিয়ে অজুতকণ্ঠের শ্লোগানের শব্দে চমকে উঠলো সবাই। যারা ঘুমিয়ে পড়েছিলো, তারা ঘুম থেকে জেগে উঠে উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো, কি হলো, ওরা কি গুলি চালালো আবার?

আকাশে মেঘ নেই। তবু ঝড়ের সংকেত।

বাতাসে বেগ নেই। তবু তরঙ্গ সংঘাত।

কণ্ঠে কণ্ঠে এক আওয়াজ, শহীদের খুন ভুলবো না। বরকতের খুন ভুলবো না।

যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। পৃথিবী কাঁপছে। ভূমিকম্পে চৌচির হয়ে ফেটে পড়ছে। দিগ্বিদিক।

শুধু উত্তর নয়। দক্ষিণ নয়। পূর্ব নয়। পশ্চিম নয়। যেন সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছাতে ছাতে, প্রতি ছাতে বিক্ষুব্ধ ছাত্র যুবক ফেটে পড়ছে চিৎকারে, শহীদ স্মৃতি অমর হোক।

সবাই বুঝলো। বুঝতে কারো বেগ পেতে হলো না। রাস্তায় শ্লোগান দেয়া নিষেধ। মিছিল শোভাযাত্রা বেআইনী করেছে সরকার। আর তাই ঘরে ঘরে ছাতের উপরে সমবেত হয়ে শ্লোগান দিচ্ছে ওরা, ছাত্ররা। মুসলিম হল, মেডিকেল হোস্টেল, ঢাকা হল, চামেলী হাউস, ফজলুল হক হল, বান্ধব কুটির, ইডন হোস্টেল, নূরপুর ভিলা। সবাই যেন এককণ্ঠে আশ্বাস দিচ্ছে, দেশ আমার, ভয় নাই।

সালমার হাতে একটা টান দিয়ে শাহেদ বললো, গত ইলেকশনের সময় তোরা শ্লোগান দিয়েছিলি ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে তাই না আপি?

যা। সালমা সংক্ষেপে জবাব দিলো। শাহেদ বললো, কি লাভ হয়েছে তোদর। যাদের ভোট দিয়ে পাঠিয়েছিস তারা তো এখন কিছুই বলছে না।

উত্তরে সালমা কিছু বলবে ভাবছিলো। শুনলো রাজ্জাক সাহেব তাঁর স্ত্রীকে বোঝাচ্ছেন, সবাই তো আর মীরজাফর নয়। ভাল লোকও আছে।

আসল কথা হল, কে ভালো আর কেমন্দ সেটা যাচাই করে নেয়া, বুঝলে?

 

অনেকক্ষণ একঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে ব্যথা করছিলো মাহমুদের। একটা চেয়ার খালি হতে তাড়াহুড়া করে বসে পড়লো সে। হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো নটা বেজে গেছে প্রায়।

এতক্ষণ কিউ. খানের একটানা প্রলাপ শুনতে হয়েছে। বড় কর্তার ধমক খেয়ে লোকটা রেগেছে ভীষণ। এইতো একটু আগে ইন্সপেক্টারদের সবাইকে ডেকে অবস্থা জানালেন। তিনি। আমি জানতাম আপনাদের দিয়ে কিছু হবে না। আপনারা শুধু গায়ে বাতাস দিয়ে বেড়াতে পারেন।

বড় কর্তা বললেন, কি আশ্চর্য। আপনাদের কাজের নমুনা দেখলে আমার গা জ্বালা করে ওঠে। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, অথচ আপনারা কিছুই করতে পারছেন না।

একজন পুলিশ অফিসার হত কচলে বললো, আমরা কি করবো স্যার?

ওরা ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে। আমরা হুকুমের দাস। আমরা কি করবো স্যার?

আপনারা কি করবেন মানে? বড় কর্তা জঁ কুঁচকে বললেন, আপনারাই তো সব কিছু করবেন। আপনারা হচ্ছেন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। দেশ তো আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

বড় কর্তার কথা শুনে মাহমুদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো তাঁর দিকে। আর ভাবছিলো, সত্যি লোকটা একটা জিনিয়াস। মানুষকে কি শ্রদ্ধার চোখেই দেখে। আমাদের প্রতি তাঁর কি গভীর মমতাবোধ। বড় কর্তা আবার বললেন, আপনারা নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছেন, গুটিকয় বিদেশের দালাল আমাদের সোনার দেশটাকে একেবারে উচ্ছনে নিয়ে যাচ্ছে। সর্বনাশ করছে আমাদের।

তাঁর কথায় একজন অফিসার উৎসাহিত হয়ে বললো, ইয়ে হয়েছে স্যার। কি যে বলবো। যেখানে যাই, সেখানে দেখি ছেলে-ছোকরারা সব জটলা বেঁধে কি সব ফুসুফাসুর করছে। জানেন স্যার, লোফার এই খবরের কাগজের হকার বলুন, রিক্সাওয়ালা বলুন, এমন কি সরকারী কর্মচারীদের মধ্যেও কেমন একটা সন্দেহের ভাব দেখলাম। আমাদের বিরুদ্ধে কেমন যেন একটা ষড়যন্ত্র করছে ওরা।

ওহে। দেশটা একেবারে রাষ্ট্রদ্রোহীতে ভরে গেছে। কিউ. খানের চোখে মুখে হতাশার ছাপ।

গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মাহমুদ।

সাহানা এর জন্যে দাঁড়িয়ে থাকবে গুলিস্তানের সামনে। তাকে নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে। বজলে আর ডলি এখনো অপেক্ষা করছে।

স্লোগান দিবার চোঙাগুলো একপাশে এনে জড়ো করে রাখলো ওরা। এতক্ষণ ছাদের ওপরে উঠে একটানা অনেকক্ষণ স্লোগান দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সবাই। এই শীতের মরশুমেও গা বেয়ে ঘাম ঝরছে। গলা ফেটে গেছে। স্বরটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে বেরুচ্ছে গলা দিয়ে।

মুনিম বললো, গরম পানিতে নুন দিয়ে গার্গেল কারো, ভালো হয়ে যাবে। নইলে ব্যথা করবে গলায়। কাল আর কথা বেরুবে না।

কয়েকজন ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো ওর বিছানায় এলিয়ে পড়লো।

কেউ কেউ কাল দিনে কি ঘটতে পারে তাই নিয়ে জোর আলোচনা শুরু করলো করিডোরে। কেউ ডাইনিং হলে খেতে গেলো। খাবার টেবিলেও তর্ক-বিতর্ক আর আলোচনার শেষ নেই।

মাঝখানের মাঠটায়, যেখানে সুন্দর ফুলগাছের সার থরে থরে সাজানো, ঘাসের উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসলো মুনিম। অনেক চিন্তার অবসরে ডলির কথা মনে পড়লো ওর। ডলির সঙ্গে একবার দেখা হলে ভালো হতো। মুনিম ভাবলো। কিন্তু পরক্ষণে আরেক চিন্তায় ডলি হারিয়ে গেলো মন থেকে। রাত শেষে তোর হবে। আর পুলিশ এসে হয়তো ঘিরে ফেলবে পুরো হলটাকে। এমনি ঘিরেছিলো আরেকবার। বায়ান্ন সালের পঁচিশে ফেব্রুয়ারিতে। তখন এই হলটাই ছিলো আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। সেদিনের কথা ভাবতে অবাক লাগে মুনিমের। রীতিমত একটা সরকার চালাতে হয়েছিল ওদের । বজলুর পঁচিশ নম্বর রুমটা ছিলো অর্থ দপ্তরের অফিস। দোরগোড়ায় লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা ছিলো অর্থ দপ্তর। ছেলেরা টাকা সংগ্রহের জন্যে কৌটা হাতে বেরিয়ে যেতো ভোরে ভোরে। রাস্তায় আর বাসায় বাসায় চাঁদা সংগ্রহ করে বেড়াতে ওরা। দুপুরে কৌটো ভরা আনি দুয়ানি আর টাকা এনে জমা দিতো অফিসে। আন্দোলনের যাবতীয় খরচপত্র সেখান থেকে চালানো হতো। বজলু ছিলো এই দপ্তরের কর্তা। অর্থনীতিতে খুব ঝানু ছিলো বলে ওই পদটা দেয়া হয়েছিলো ওকে। নত ছিলো ওর হেড কেরানী। কেরানীর মতই মনে হতো ওকে।

অর্থ দপ্তরের পাশে ছিলো ইনফরমেশন ব্যুরো। ওদের কাজ ছিলো কোথায় কি ঘটছে। তার খবর সংগ্রহ করা। ভোর হতে সাইকেলে চড়ে এই ক্ষুদে গোয়েন্দার দল বেরিয়ে পড়তে শহরের পথে। কোথায় ক’জন গ্রেপ্তার হলো, কোথায় অধিক সংখ্যক পুলিশ জমায়েত হয়েছে, কোন জায়গায় এখন হামলা চলার সম্ভাবনা আছে এসব খোঁজ নিতে ওরা।

আর কোন খোঁজ পেলে তক্ষুণি হেড অফিসে এসে খবরটা পৌঁছে দিতো। এছাড়া আরো কয়েকটা কাজ ছিলো ওদের। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় খবর আদান-প্রদান করা, সরকারী গোয়েন্দাদের ওপর নজর রাখা, আর নিজেদের মধ্যে কোন স্পাই আছে কিনা, সেখানে দৃষ্টি রাখা। ইনফরমেশন ব্যুরোর কর্মকর্তা ছিলো আরজান ভাই। বড় ধুরন্ধর ছিলো লোকটা। দুজন সরকারী গোয়েন্দাকে হলের মধ্যে ধরে কি মারটাই না দিয়েছিলো সে। ইনফরমেশন ব্যুরোর পাশে ছিলো প্রচার বিভাগের অফিস। তার পাশে খাদ্য দপ্তর। ওদের কাজ ছিলো জেলখানায় আটক বান্দিদের খাবার সরবরাহ করা। কেন্দ্রীয় দপ্তরটা ছিলো মনসুর ভাইয়ের রুমে। যেখানে বসে আন্দোলন সম্পর্কে মূলনীতি নির্ধারণ করা হতো। সেই মতে চলতো সবাই।

বিকেলে অফিস-আদালত থেকে কারখানা আর বস্তি থেকে হাজার হাজার লোক এসে জমায়েত হতো হলের সামনে। প্রচার দপ্তর থেকে মাইকের মাধ্যমে আগামী দিনের কর্মসূচি জানিয়ে দেয়া হতো ওদের।

তারপর তারা চলে যেতো। বসে বসে সে দিনগুলোর কথা ভাবছিলো মুনিম। ভাবতে বেশ ভাল লাগছিলো ওর। একটা ছেলে এগিয়ে এসে বললো, এখানে কুয়াশার মধ্যে বসে আছেন কেন, উঠুন মুনিম ভাই। আপনার জন্যে ভাত নিয়ে এসেছি রুমে। মুনিম উঠে দাঁড়ালো। চলো।

 

সাহানাকে নিয়ে বেশ রাত করে বাসায় ফিরে এলেী মাহমুদ। প্রায় রাতে এমনি দেরি হয় ওর। কোনদিন কাজ থাকে। কোনদিন ক্লাবে যায় আর রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা মারে। জীবনটা হলো একটা সুন্দর করে সাজানো বাগানের মত। যেদিকে খুশি ইচ্ছেমত উড়ে যেতে পারে তুমি। কিম্বা কখনো ভ্রমর হয়ে উড়ে বেড়াতে পারো এক ফুল থেকে অন্য ফুলে।

সাহানার বাহুতে স্পর্শ করে মাহমুদ বললো, সাহানা তুমি আমাকে খুব ভালবাস, তাই না?

সাহানা চোখ তুলে শুধু একবার তাকালো ওর দিকে। তারপর সংক্ষেপে বললো, হ্যাঁ। মাহমুদ জানতো, কি উত্তর দেবে সাহানা। অতীতে এমনি আরো অনেককে প্রশ্ন করে ওই একই জবাব পেয়েছে সে। আগে রোমাঞ্চিত হতো। আজকাল আর তেমন কোন সাড়া জাগে না মনে। তবু, আবার জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ, সত্যি ভালবাস।

সাহানা হেসে জবাব দিলো, জানি না।

আমি জানি, মাহমুদ কেটে কেটে বললো। আমি জানি, একদিন তুমি বাবুই পাখির মত পলকে উড়ে চলে যাবে।

সাহানা রক্তাভ হলো। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললো, তাই যাবো। একজনের কাছে বেশি দিন থাকতে ভালো লাগে না আমার।

গলার স্বরে তার শ্লেষ আর ঘূণা।

মাহমুদের মনে হলো মেয়েটি বড় নির্লজ্জ। ঠোঁটের কোণে কথাটা একটুও বাধলো না ওর। কি নির্বিকার ভাবেই না বলে গেলো।

মাহমুদ নিজেও ওকথা বলেছে অনেককে।

সালেহাকে মনে পড়ে। টালি ক্লার্কের মেয়ে সালেহ্যাঁ। মেয়েটা রীতিমত ভালবেসে ফেলেছিলো ওকে।

বোকা মেয়ে।

ওর কথা ভাবলে দুঃখ হয় মাহমুদের। অমন বিষ খেয়ে আত্মহত্যা না করলেও পারতো সে।

কিন্তু সাহানা ওর মত বিষ খাবে না। খুব স্বাভাবিকভাবে সব কিছু নিতে পারবে সে। তবু মাহমুদের কেন যেন আজ মনে হলো মেয়েটা বড় নির্লজ্জ।

ভেতরে বাতি নেভানো ছিলো। কড়া নাড়তে গিয়ে দুজনের চোখে চোখ পড়লো। মুখ টিপে এক টুকরো অর্থপূর্ণ হাসি ছড়ালো সাহানা। মাহমুদও না হেসে পারলো না। খানিকক্ষণ কোন সাড়া পাওয়া গেলো না। তারপর বাতি জ্বলে উঠলো। শব্দ হলো কপাট খোলার। খোলা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে বজলে। পরিপাটি চুলগুলো এলোমেলো। মুখে ঈষৎ বিরক্তির আমেজ। ওদের দেখে বললো, কি ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?

মাহমুদ হাত ঘড়িটা ওর মুখের কাছে বাড়িয়ে দিয়ে আস্তে করে বললো, খুব তাড়াতাড়ি ফিরি নি কিন্তু।

বজলে লজ্জা পেয়ে বললো, একি, দুঘণ্টা। আমার মনে হচ্ছিলো–।

আমারো তেমনি মনে হলো। ডলির দিকে আড়চোখে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে শব্দ করে হাসলো মাহমুদ।

নীল আলো ছড়ানো ঘরের দেয়ালে একটা টিকটিকি টিক টিক শব্দে ডেকে উঠলো।

কৌচের উপর বসে দেহটা এলিয়ে দিল মাহমুদ।

আলনা থেকে তোয়ালেটা নাবিয়ে নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো সাহানা।

ডলি দাঁড়িয়েছিলো উত্তরমুখখা আলমারিটার পাশে, জানালার ধার ঘেঁষে ওদেরকে পেছন করে।

মাহমুদ বললো, কাল সকালে কি তোমার সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে বজলে?

বজলে প্রশ্ন করলো, কেন বলতো?

মাহমুদ বললো, কিছু আলাপ ছিলো।

বজলে শুধালো, গোপনীয় কিছু?

মাহমুদ ঘাড় নাড়লো না, ঠিক গোপনীয় কিছু নয়।

বজলে এগিয়ে এসে বসলো তার সামনে। কাল কেন, এখন বল না।

মাহমুদ বললো, না, এখন না। কাল সকালে বরং একবার এখানে এসো তুমি, কেমন?

জানালার পাশে দাঁড়ানো ডলি ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছিলো বাইরে।

সার সার বাতি। গাড়ি আর লোকজন। সবকিছু বড় অস্বস্তিকর মনে হলো তার। যেন এমন একটা নিরিবিলি অন্ধকার কোণে গিয়ে লুকোতে পারলে সে বেঁচে যায়। পেছন ফিরে তাকাতে ভয় হচ্ছে ওর। যদি মাহমুদের চোখে চোখ পড়ে তাহলে? সত্যি ওরা কি ভাবছে, কে জানে। ডলি রীতিমত ঘামতে শুরু করলো।

বাইরে বেরিয়ে যখন রিক্সায় উঠলো ওরা, তখন ইলশেগুঁড়ির মত বৃষ্টি ঝরছে। ডলি অনুযোগের সুরে বললো, আজ আমাকে এতবড় একটা লজ্জা না দিলে চলতো না?

বজলে অপ্রস্তুত হয়ে বললো, কোথায় লজ্জা দিলাম তোমায়?

ডলি ঈষৎ রক্তাভ হয়ে বললো, জানি না।

ডলির হাতটা মুঠোর মধ্যে তুলে নিয়ে মৃদু চাপ দিলো বজলে। চোখজোড়া ওর মুখের ওপর থেকে সরিয়ে নিয়ে বাইরে গাড়ি ঘোড়া আর লোকজন দেখতে লাগলো ডলি।

রাস্তায় তেমন ভিড় নেই, যানবাহন চলাচল অনেক কম। পথের দুপাশে দোকানগুলোতে খদ্দিরের আনাগোনা খুব বেশি নয়। সহসা ডলি চমকে উঠলো। মনে হলো ওদের রিক্সার পাশ ঘেঁষে মুনিম সাইকেল নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। কোথায় গেলো সে?

কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে ডলি। এমনো হতে পারে যে, আজ বাসায় ফিরে দেখবে মুনিম তার অপেক্ষায় বসে আছে। ডলিকে কাছে পেয়ে হয়তো বলবে, অনেক ভেবে দেখলাম ডলি, তোমাকে বাদ দিলে জীবনে আর কিছুই থাকে না। তাই সব ছেড়ে দিয়ে তোমার কাছে ফিরে এলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও। বলে কাতর চোখজোড়া তুলে ওর দিকে তাকাবে সে। ডলি তখন কি উত্তর দেবে?

ভাবতে গিয়ে ঘেমে উঠলো ডলি। কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো এ তার উদ্ভট কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। মুনিমকে সে দেখেনি, ওটা চোখের ভুল। এ তিনদিন ওরা খালি পায়ে হাঁটাচলা করছে। সাইকেলে নিশ্চয় চড়বে না মুনিম। ভাবতে গিয়ে কেন যেন বড় হতাশ হলো উলি।

বজলে ওর হাতে একটা নাড়া দিয়ে বললো, কি ব্যাপার চুপচাপ কি ভাবছো?

ডলি আরো একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বললো, না, কিছু না। তারপর অনেকটা পথ চুপ থেকে সহসা প্রশ্ন করলো, ওরা স্বামী-স্ত্রী তাই না?

ওরা কারা? কাদের কথা বলছেঃ বজলে অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে। ডলি বললো, সাহানা আর মাহমুদ।

বজলে কি ভেবে বললো, হ্যাঁ, ওরা স্বামী-স্ত্রী-এই তো মাস কয়েক হলো বিয়ে হয়েছে তাদের। কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

না, এমনি। বজলের একখানা হাত নির্জের হাতের মধ্যে তুলে নিলো ডলি।