লালবাগে যখন প্রথম পুলিশ ভ্যানটা এসে পৌঁছলো বেলা তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। শুকনো ধুলো উড়ছে বাতাসে। হলদে রোদ চিকচিক করছে লালবাগের মাঠের ওপর। যেখানে এককালে সেই একশো বছর আগে দেশী সিপাহী বিদ্রোহ করেছিলো। বিদেশী বেনিয়াদের বিরুদ্ধে সেই মাঠে।

পুলিশ ভ্যানটা গেটের সামনে এসে থামতে, কবি রসুলকে দেখতে পেলো আসাদ। পরনে তার একটি লুঙ্গি। গায়ে একটা কম্বল জড়ানন। ওদের দেখতে পেয়ে ছুটে এলো কবি রসুল। কোত্থেকে ধরেছে তোমাদের?

ইউনিভার্সিটি থেকে।

এখানে কজন?

এখানে আমরা আঠারো জন। আরো অনেককে ধরেছে। ওদেরও এখনি নিয়ে আসবে। সকালে যারা ধরা পড়েছিলো, তারা সকলে ঘিরে দাঁড়ালো নতুন অভ্যাগতদের। হাতে হাত মেলালো ওরা। তারপর রাহাতের দিকে চোখ পড়তে অক্ষুট আর্তনাদ করে উঠলো, একি, ওর মাথা ফাটলো কেমন করে?

আসাদ বললো, ইউনিভার্সিটিতে লাঠি চার্জ করছে ওরা।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

পাশে একজন দারোগা দাঁড়িয়েছিলো। কবি রসুল তার দিকে তাকিয়ে রেগে উঠলো। কি সাহেব তামাশা দেখছেন বুঝি? ছেলেটা তো মারা যাবে। একটা ডাক্তার ডাকুন না।

এখানে ডাক্তার ডাকার কোন নিয়ম নেই। দারোগা জবাব দিলো। বলেন তো তাকে হাসপাতালে পাঠাই।

হয়েছে, আপনাকে অত দরদ দেখাতে হবে না। সবুর মাটিতে থু থু ছিটিয়ে বললো। লোকগুলোকে দেখলে ঘেন্নায় বমি আসে আমারু আন খান সাহেব, এখান থেকে দূরে সরে যান।

এমন অপ্রত্যাশিত অপমানের কথা ও রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো লোকটার। কিন্তু কিছু বলতে সে সাহস করলো। চুপচাপ সরে গেলো একপাশে। মেডিকেলের ছেলেরা বললো, আপনারা ঘাবড়াবেন না, জখমটা তেমন মারাত্মক নয়, আমরা ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। বলে ওরা এগিয়ে এসে রাহাতকে ধরাধরি করে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসালো। ওসমান খান বললো, একটু গরম পানি আর কিছু আয়োডিন দরকার।

দাঁড়ান দেখি জোগাড় করতে পারি কিনা। ওকে আশ্বাস দিয়ে থানা ইনচার্জের কাছ থেকে আয়োডিন আর গরম পানি আনার বন্দোবস্ত করতে গেলো কবি রসুল।

পুলিশ ভ্যান থেকে নামবার আগ পর্যন্ত আসাদ ভেবেছিলো সালমার সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে সে কি আগের মত সহজভাবে কথা বলতে পারবে।

গত রাতের কথা বারবার করে মনে পড়ছিলো তার।

থানা অফিসের পাশে লম্বা ব্যারাকটার সামনে আরো সাত-আটটা মেয়ের মাঝখানে বসে ওদের কি যেন বোঝাচ্ছিল সালমা। দেখে আসাদ বুঝলো ওরা মেডিকেলের মেয়ে। সকালের হোস্টেল থেকে ধরা পড়েছে ওরা। কারো পরনে সেলওয়ার, কারো পরনে শাড়ি।

আসাদকে দেখে ফিক করে হেসে দিলো সালমা। তারপর অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, বেশ আপনিও ধরা পড়েছেন তাহলে?

কি করবো বলুন, আপনাদের ছেড়ে থাকতে পারলাম না।

আসাদের কথায় মুখখানা ঈষৎ রাঙা হয়ে উঠলো সালমার। চোখজোড়া মাটির দিকে নাবিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলো সে। কে জানে হয়তো গত রাতের কথা মনে পড়েছে তার, আসাদ ভাবলো।

একটু পরে সালমা ইতস্তত করে বললো, আমরা ভোর রাতেই এ্যারেস্ট হয়েছি।

হ্যাঁ, আমি তা শুনেছি।

কার কাছ থেকে শুনলেন? ভ্রূজোড়া স্বল্প বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলে সালমা। আসাদ বললো, আপনার সহপাঠীদের কাছ থেকে।

ও, সালমা মৃদু হেসে মুখখানা অন্য দিকে ঘুরিয়ে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। না। গতরাতের কথা এখন আর মনে নেই তার। সব ভুলে গেছে মেয়েটি, আসাদ ভাবলো। ভেবে কেন যেন মনটা ব্যথায় টন টন করে উঠলো তার।

ভার্সিটির মেয়েদের নিয়ে তখন দ্বিতীয় প্রিজন-ড্যানটা এসে পৌঁছেছে লালবাগে। ওদের দেখতে পেয়ে শিশুদের মত আনন্দে হাততালি দিতে দিতে সেদিকে এগিয়ে গেলো মেডিকেলের মেয়েরা। এই যে নীলা যে, এসে এসো। ছুটে এসে ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলে সালমা।

রানু বললো, বাহ সালমা আপা তুমি? বেশ ভালোই হলো একসঙ্গে থাকা যাবে।

সালমা জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কজন?

নীলা জবাব দিলো, পাঁচ।

তাহলে পাচ আর আট মিলে আমরা তেরোজন হলাম।

হ্যাঁ, তেরোজন মেয়ে আমরা। সালমা বললো।

আসাদ কাছে দাঁড়িয়েছিলো। ফোঁড়ন কেটে বললো, আমাদের তুলনায় কিন্তু সমুদ্রে বারিবিন্দু।

হয়েছে, হয়েছে অত বড় বড় কথা বলবেন না। নীলা ঠোঁট বাঁকালো।

দেখেছি আপনাদের সাহস। পুলিশ দেখে সব বেড়ালের মত পালিয়েছেন আবার কথা বলেন। আমরা পালাই নি, হুঁ।

উত্তরে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো সালাদ। এমন সময় আরো একটা পুলিশ ভ্যান এসে থামলো সেখানে।

আরো এক দল ছেলে।

আরো একদল মেয়ে।

তারপর বেলা যত পড়তে লাগলো, গ্রেপ্তার করে অনা ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও তেমনি বাড়তে লাগলো ধীরে ধীরে।

কাঁটা তার আর পুলিশ ঘেরা মাঠটার মধ্যে গোল হয়ে বসলো ছেলেরা মেয়েরা। আর তারা প্রতীক্ষ্ণ করতে লাগলো কথন জেলখানায় নিয়ে যাবে। তাদের সকলের মুখে হাসি, চোখে শপথের কাঠিন্য।

হঠাৎ একসময় সবার মাঝখান থেকে অপূর্ব দরদ নিয়ে নীলা গান গেয়ে উঠলো যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে।

তারপর সে গাইলো, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।

ওর গান শুনে কিছুক্ষণের জন্যে সবাই যেন বোরা হয়ে গেলো। কি এক গভীর মৌনতা চারপাশ থেকে এসে গ্রাস করলো ওদের।

খানিকক্ষণ পরে আবার কলকল করে কথা বলে উঠলো ওরা। কবি রসুল একজন দারোগাকে ডেকে বললো, কি ব্যাপার, আমাদের কি এখানে ফেলে রাখবেন নাকি?

আর একজন জিজ্ঞেস করলো, জেলখানায় কখন নেবেন?

এখানে আর ভালো লাগছে না। জেলে নিতে হয় নিয়ে চলুন। উহ্ এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে কতক্ষণ বসে থাকা যায়। দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি করুন না আপনারা। ওদের হৈ হট্টগোলের একপাশে চুপচাপ বসেছিলো মুনিম। লাঠির আঘাত লেগে বা চোখটা ফুলে গেছে তার। নীলার গান শুনে বারবার ডলির কথা মনে পড়ছে, ডলিও তো নীলার মত আসতে পারতো এখানে। কেন সে এলো না? ভাবতে গিয়ে বুকটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠলো মুনিমের।

ওকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বেনু বললো, কি ভাবছেন মুনিম ভাই?

না, কিছু না। চোখ তুলে বেনুর দিকে তাকালো মুনিম। দেহের গড়নটা একটু ভারি গোছের। চেহারাখানা সুন্দর আর কমনীয়। সবার সঙ্গে হেসে কথা বলে বে। কোন আবিলতা নেই, কলুষতা নেই আর কাজ পেলে কি খুশিই না হয় মেয়েটা। দুহাতে কাজ করে, ওর দিকে তাকিয়ে মুনিমের আবার মনে হলো, ডলি কেন বেনুর মত হলো না। বেনু ওর পাশে বসলো।

ফোলা চোখটার দিকে দৃষ্টি পরতে বললে লাঠির আঘাত লেগেছিলো, তাই না মুনিম ভাই

মুনিম সংক্ষেপে বললো, হ্যাঁ।

বেনু বললো, মেডিকেলের ছেলেদের বললে ওরা সুন্দরভাবে ব্যান্ডেজ করে দেবে।

বলবো ওদের? বেনুর উৎকণ্ঠা দেখে অবাক হলো মুনিম। বেনু আবার বললো, বলবো? মুনিম সংক্ষেপে ঘাড় নাড়লো। না।

বেনু আর কিছু বললো না। চুপচাপ রোদে চিকচিক করা অসমতল মাঠটার দিকে চেয়ে রইলো।

অদূরে বসা সালমা আসাদকে জিজ্ঞেস করলো, আপনি এর আগে কোনদিন জেলে যান নি?

গেছি।

কবার?

তিনবার।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আসাদ মুদু হাসলো। চেয়ে দেখলো মাটির দিকে চোখ নাবিয়ে কি যন ভাবলে সালমা। কে জানে, হয়তো গত রাতের কথা ভাবছে সে। কিম্বা ভাবছে তার কারারুদ্ধ স্বামীর কথা। কি ভাবছে জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না আসাদের।

 

মাঠের ও পাশটায় এরা বসেছিলো।

ওপাশটায় তখন কবি রসুল একজন পুলিশ অফিসারের ওপর রেগে গিয়ে বলছে, এই রোদের ভিতের কতক্ষণ বসিয়ে রাখবেন এখানে। জেলে কি নেবেন না নাকি?

নেবো, নোবো, এত ধৈর্য হারাচ্ছেন কেন। এখনি নেব। জবাবটা তাড়াতাড়ি সেরে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে গেলো পুলিশ অফিসারটা। সবুর মাটিতে থুথু ছিটিয়ে বললো, লোকগুলোকে দেখলে ঘেন্নায় বমি আসে আমার, তোমরা কেমন করে যে ওদের সঙ্গে কথা বলে। বলে আবার মাটিতে থুথু ছিটালো সে।

কেউ কিছু বললো না।

 

পরপর তিন চারখানা পুলিশ বোঝাই গাড়ি উত্তর থেকে দ্রুত দক্ষিণ দিকে চলে গেলো। এক নজর সেদিকে তাকিয়ে দেখলো বজলে তারপর মৃদুপায়ে আবার হাঁটতে লাগলো।

মিরেন্ডারে বসে এক কাপ চা খাবে।

কাচের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে সাহানাকে একা বসে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো বজলে।

ওকে দেখতে পেয়ে সাহানা ম্লান হাসলো, চা খেতে এলেন বুঝি?

বজলে ওর সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বললো, হ্যাঁ। আপনি খেয়েছেন?

হ্যাঁ।

আরেক কাপ খান আমার সঙ্গে।

সাহানা হা না কিছু বললো না। বয় এসে দাঁড়িয়েছিলো। বজলে দুকাপ চা আনতে বললো তাকে।

বয় চলে গেলে বজলে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো, এখন কোথায় আছেন আপনি?

সাহানা সে কথার কোন জবাব না দিয়ে স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বজলের দিকে। তারপর বললো, মাহমুদের সঙ্গে কি আপনার দেয়া হয়েছিলো, এর মধ্যে।

বজলে বললো, যা সকালে ওর ওখানে গিয়েছিলাম আমি।

সাহানা মাথা নিচু করে কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বললো, আমি এখন সেগুন বাগানে আমার এক বান্ধবীর বাসায় আছি।

ও! বজলে মুদু স্বরে বললো। বয় এসে চা রেখে গেলো টেবিলের উপর।

পটের ভেতর এক চামচ চিনি ঢেলে দিয়ে সাহানা বললো, ও নিশ্চয় আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলেছে আপনাকে।

বজলে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে বন্ধুর পক্ষ নিয়ে বললো, না ও কিছু বলে নি আপনার সম্পর্কে।

নিশ্চয় বলেছে, আপনি কোনে আমার কাছ থেকে। অদ্ভুতভাবে হাসলো সাহানা। পেয়ালার চা ঢালতে ঢালতে আবার বললো, জানেন, লোকটা বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিলো আমায়। আর এখন বলে, না আমি ও রকম কোন কথাই দিই নি। ক্ষণকাল থেমে আবার সে, তখন কত অনুনয়, তোমার ভালবাসা পেলে স্বর্গ মর্ত এক করে দেবো, আর এখন জোচ্চোর কোথাকার।

বজলে মাথা নিচু করে ছিলো। চোখ তুলে এবার তাকালো ওর দিকে।

পরনে একখানা কলাপাতা রঙের পাতলা শাড়ি। সাদা ব্লাউজ। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগলো। চুলগুলো গোলাকার খোঁপা করা। ডলির চেয়ে কম সুন্দরী নয় সাহানা। চায়ের কাপটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে সাহানা আবার বললো, ও ভেবেছে চিরকাল আমি করুণার ভিখিরি হয়ে থাকি। উর্বর চিন্তা বটে। বলে অদ্ভুতভাবে হাসলো সাহানা।

তারপর চায়ের পেয়ালায় মৃদু চুমুক দিয়ে বললো, থাক ওসব কথা, আপনার কি খবর বলুন। চা খেয়ে বেরিয়ে কোথায় যাবেন।

বজলে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, কিছু ঠিক নেই, এমনি একটু ঘুরে বেড়াবো।

সাহানা বললো, আমার ওখানে চলুন না।

বজলে শুধালো কোথায়?

সেগুন বাগানে। ওকে অবাক করে দিয়ে অপূর্ব গলায় সাহানা বললো। ওরা সবাই দেশের বাড়িতে গেছে। বাসাটা খালি। রাতের বেলা একা থাকতে বড় ভয় করবে আমার। চলুন না, আপনিও থাকবেন। সাহানার দুচোখে আশ্চর্য আমন্ত্রণ।

চুল থেকে পা পর্যন্ত ওর পুরো দেহটার দিকে এক পলক তাকালো বজলে। ডলিকে মনে পড়লো। ও যদি জানতে পারে? না ও মোটেই জানতে পারবে না। সিগারেটে একটা জোর টান দিলো বজলে। তারপর কঁপা গলায় বললো। আচ্ছা যাবে।

ওর চোখে চোখ রেখে ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ম হাসি ছড়ালো সাহানা।

মিরেন্ডার থেকে বেরিয়ে একখানা রিক্সা নিলো ওরা। ওর কানের কাছে মুখ এনে বজলে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। সাহানা বললো, ডলি গেলো।

ডলি? বজলে আঁতকে উঠলো। কোথায় দেখলেন তাকে?

সাহানা বললো। এইতো রিক্সা করে গেলো ওদিকে।

মুহূর্তে মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেলো বজলের।

ওকি দেখেছে আমাদের?

সাহানা হেসে দিয়ে বললো, তা কেমন করে বলবো। বলে ওর হাতে একটা মৃদু চাপ দিলো সাহানা। ওর হাতখানা মুঠোর মধ্যে নিয়ে নীরবে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলো বজলে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে ফ্যাকাশে দৃষ্টি মেলে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।

হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে ধুকধুক করছে।

আকাশের পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে।

দিনের ক্লান্তি শেষে, রাত আর স্নিগ্ধতা নিয়ে আসছিলো পৃথিবীর বুকে। কর্মচঞ্চল শহর রাত্রির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই বিষণ্ণ বিকেলে হঠাৎ মৌনতার গভীর সমুদ্রে ডুব মেরেছিলো যেন।

 

জেল গেটের সামনে বন্দি ছাত্র-স্বত্রীদের জড়ো করা হলো এনে। একজন নয় দুজন নয়। আড়াইশর ওপর সংখ্যা ওদের।

খবর পেয়ে আত্মীয়-স্বজন খোঁজ নিতে এসেছেন। কার কি প্রয়োজন কাগজে টুকে নিচ্ছেন চটপট।

সালমার বিছানাপত্তর আর কাপড়-চোপড় নিয়ে শাহেদ এসেছিলো।

হোন্ডল আর সুটকেসটা সামনে নাবিয়ে রেখে সে বললো, নে আপা তোর জিনিসপত্রগুলো সব দেখে নে, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে, জলদি কর।

কেন, তুই কোথায় যাবি? সালমা উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো।

শাহেদ বললো। বারে, তাদের যে ধরে এনেছে তার প্রতিবাদ ধর্মঘট করবো না বুঝি?

সালমা মনে মনে খুশি হলো। বললো, দেখো তুমি যেন দুষ্টুমি করো না। তাহলে কিন্তু খুব রাগ করবো।

তুই আমায় কি মনে করি আপি? আমি দুষ্টুমি করি? শাহেদ আহত হলো। এইতো এখন গিয়ে পোস্টার লিখতে বসবো। পাড়ার ছেলেদের সব বলে রেখেছি। আজ রাতের মধ্যে দুশ পোস্টার লাগানো চাই, কি মনে করেছিস তুই? বলে চলে যাচ্ছিলো শাহেদ।

কি মনে পড়তে ফিরে এসে পকেট থেকে একখানা চিঠি বের করে এগিয়ে দিলো সালমার দিকে।

দিতে ভুলেই যাচ্ছিলাম, নে দুলাভাইয়ের চিঠি।

হাত বাড়িয়ে চিঠিখানা নিলো সালমা।

আসাদ বললো, কার চিঠি

সালমা ওর দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলে, ও লিখেছে, রাজশাহী জেল থেকে। আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। নীলা ডাকলো।

সালমা এসে আমাদের নাম ডাকছে।

অস্ফুট কণ্ঠে আসি বলে, চলে গেলো সালমা।

গত রাতের কথা সে একেবারে ভুলে গেছে। স্বামীর চিঠিখানা কত যত্ন করে রেখেছে। হাতের মধ্যে, আসাদ ভাবলো।

আর ভাবতে গিয়ে মনটা কেন যেন ব্যথা করে উঠলো তার।

সাহানাকে দেখে তেমন অবাক হয় নি মুনিম, জানতো সে আসতে পারে।

অবাক হলো ওর সঙ্গে ডলিকে দেখে।

সাহানা বললো, ডলি এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।

প্রথমে কিছুক্ষণ একটা কথাও মুখ দিয়ে সরলো না মুনিমের। অপ্রত্যাশিত আনন্দে বোবা হয়ে গেছে সে।

ডলি এগিয়ে এসে এক মুঠো ফুল গুঁজে দিলো ওর হাতের মধ্যে। কিছু বললো না।

মাটিতে চোখ নাবিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো।

মুনিম মৃদু গলায় বললো, হয়তো দীর্ঘদিন তোমার সঙ্গে দেখা হবে না ডলি।

ডলি চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে।

স্বল্প অন্ধকারেও মুনিম দেখলো ঢলিক চোখজোড়া পানিতে ছলছল করছে। আনন্দে মনটা নেচে উঠছিলো বারবার। আর শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিলো ডলিকে। ডলির এমন রূপ আর কোনদিন চোখে পড়ে নি মুনিমের।

আসাদ এসে ওর কাঁধের উপর একখানা হাত রাখলো। তোমার বাসা থেকে কেউ আসেনি মুনিম?

আমেনা এসেছিলো। মুনিম জবাব দিলো। কাপড়-চোপড়গুলো ওই দিয়ে গেছে। মা নাকি খবর শুনে কাঁদতে শুরু করেছেন। মাকে নিয়ে আমার এক জ্বালা। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলো মুনিম।

আসাদ সরে গেলো অন্য দিকে। ওর কেউ আসেনি। মা যার নেই দুনিয়াতে কেউ বুঝি নেই তার। হঠাৎ মরা মায়ের কথা মনে পড়ায় মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো আসাদের।

নাম ডেকে ডেকে তখন একজন করে ছেলেমেয়েদের ঢোকান হচ্ছিলো জেলখানার ভেতরে।

নাম ডাকতে ডাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। এক সময়ে বিরক্তির সাথে বললেন, উহ্‌ এত ছেলেকে জায়গা দেবো কোথায়। জেলখানাতে এমনিতে ভর্তি হয়ে আছে।

ওর কথা শুনে কবি রসুল চিৎকার করে উঠলো, জেলখানা আরো বাড়ান সাহেব। এত ছোট জেলখানায় হবে না।

আর একজন বললো, এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।