» » পাঁচ

বর্ণাকার

পরদিন বিদ্যালয়ের গেটে যেখানে নোটিশ বোর্ডগুলো টাঙ্গানো ছিলো, তার পাশে সাঁটানো, লাল কালিতে লেখা একটি দেয়াল পত্রিকার উপর দল বেঁধে ঝুঁকে পড়লো ছেলেমেয়েরা। কারো পরনে শাড়ি, কারো সেলওয়ার। দেয়াল পত্রিকাটা পড়ছিলো আর গম গম স্বরে কথা বলছিলো ওরা।

নীলা আর বেনু অদূরে দাঁড়িয়ে।

সারা রাত জেগে ওই দেয়াল পত্রিকা লিখেছে ওরা।

কাল রাতে কেউ ঘুমোয় নি।

কালো বার্নিশ দেয়া কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে পা টিপে টিপে যখন নিচে নেমে আসছিলো নীলা তখন হাত ঘড়িটায় বারটা বাজে। চারপাশে ঘুঘুটে অন্ধকার আর চাপা গলার ফিসফিসানি। করিডোর পেরিয়ে ডাম কোণে বেনুর ঘরে এসে জমায়েত হয়েছিল ওরা।

বাতি কি জ্বালবো?

না।

মোম আছে?

আছে।

জানালাগুলো বন্ধ করে দাও। সুপার কি ঘুমিয়েছে।

হ্যাঁ।

দরজায় খিল দিয়ে দাও। ম্যাচেশটা কোথায়। আহ্ শব্দ করো না, সুপার জেগে যাবে।

টেবিল চেয়ারগুলো একপাশে সরিয়ে নিয়ে, মসৃণ মেঝের ওপরে গোল হয়ে বসলো ওরা।

বাইরে রাত বাড়ছে।

মোমবাতির মৃদু আলোয় বসে দেয়াল পত্রিকাগুলো লিখছে ওরা। তাই আজ বিদ্যালয়ের সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে ওরা কান পেতে শোনার চেষ্টা করছিলো কে কি মন্তব্য করে।

আমতলায় জটলা করে দাঁড়িয়েছিলো তিনটি ছেলে আর দুটি মেয়ে।

একটি ছেলে সহানুভূতি জানিয়ে একটি মেয়েকে বললো, খালি পায়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে নাতো আপনাদের

কষ্ট? কি যে বলেন। মেয়েটি ঈষৎ ঘাড় নেড়ে বললো, খালি পায়ে হাঁটার অভ্যাস আছে আমাদের।

অদূরে বেলতলায় বসে একদল নতুন ছেলেকে একুশে ফেব্রুয়ারির গল্প শোনাচ্ছিলো কবি রসুল।

সত্যি বরকতের কথা ভাবতে গেলে আজো কেমন লাগে আমার। মাঝে মাঝে মনে হয় সে মরে নি। মধুর রেস্তোরাঁয় গেলে এখনো তার দেখা পাবো। বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো তার। সে আমার অতন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। কালো রঙের লম্বা লিকলিকে ছেলে।

সেদিন এক সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলাম আমরা। রাইফেলধারী পুলিশগুলো তখন সার বেঁধে দাঁড়িয়েছিল গেটের সামনে। ইউনিফর্ম পরা অফিসাররা ঘোরাফেরা করছিলো এদিক সেদিক আর মাঝে মাঝে উত্তেজিতভাবে টেলিফোনে কি যেন আলাপ করছিলো কর্তাদের সঙ্গে। বলতে গিয়ে সেদিনের সম্পূর্ণ ছবিটা ভেসে উঠলো কবি রসুলের চোখে। সকাল থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্কুল কলেজ থেকে ছাত্ররা এসে জমায়েত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে। শহরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি হয়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ। দল বেঁধে কেউ আসতে পারছে না তাই। তবু এলো।

বেলা এগারোটায় আম গাছতলায় সভা বসলে ওদের।

দশ হাজার ছাত্রছাত্রীর সভা।

একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করার চিন্তা করছিলো ওরা।

একজন বললো, ওসব হুজ্জত হাঙ্গামা না করে আসুন আমরা প্রদেশব্যাপী স্বাক্ষর সগ্রহ অভিযান চালাই।

ওসব স্বাক্ষর অভিযান বহুবার করেছি। ওতে কিছু হয় না। কে একজন চিৎকার করে উঠলো সভার এক প্রান্ত থেকে।

আর একজন বললো। ওসব মিষ্টি মিষ্টি কথা ছেড়ে দিন কর্তারা।

মিষ্টি কথায় চিড়া ভেজে না। কিছু হবে না ওসব করে।

ওরা তবু বললো। হবে, হবেনা কেন। আমরা স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তারপর মন্ত্রীদের কাছে ডেপুটেশন পাঠাবো।

ওই মন্ত্রীদের কথা রেখে দিন। হঠাৎ ডায়াসের পাশ থেকে কে একজন লাফিয়ে উঠলো।

মন্ত্রীদের আমরা চিনে নিয়েছি।

আরেকজন বললো। দালালের কথা আমরা শুনতে চাই না।

আপনারা বসে পড়ুন।

তারপর বসে পড়ন চিারে ফেটে পড়লো সমস্ত সভা।

তবু ওদের মধ্য থেকে একজন বললো, দেখুন,আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আপনারা দয়া করে আমার কথা শুনুন। আমায় বিশ্বাস করুন। দেখুন। শুনুন।

না, না। আপনার কথা শুনবে না। আপনি বসে পড়ুন।

আরে, এ লোকটা আচ্ছা পাইট তো, আমরা শুনতে চাইছি না তবু জোর করে শোনাবে।

আরে তোমরা করছে কি লোকটাকে ঘাড় ধরে বসিয়ে দিতে পারছে না? সভার মধ্যে ইতস্তত চিল্কার শোনা গেলো। অবশেষে বসে যেতে বাধ্য হলো লোটা।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে বক্তাদের বাকযুদ্ধ চললো।

কেউ বললো, অমান্য করো।

কেউ বললো, অমান্য করো না।

অবশেষে ঠিক হলো, দশজন করে একসঙ্গে একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করবে ওরা। দল বেঁধে সবাই জেলে যাবে তবু তাদের মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেবে না।

তখন বেলা বারটা।

শীতের মরশুম হলেও সে বছর শীত একটু কম পড়েছিলো। রোদ উঠেছিলো প্রখর দীপ্তি নিয়ে। সে রোদ মাথায় নিয়ে প্রথম দলটা তৈরি হলো আইন অমান্য করার জন্য। একটা লম্বা মত ছেলে ওদের নাম ঠিকানাগুলো টুকে নিচ্ছিলো খায়।

আপনার কোন কলেজ?

জগন্নাথ।

আপনার? আমার কলেজ নয় স্কুল। আরমানিটোলা।

আপনি কোন কলেজের?

মেডিকেল।

আপনি?

ইউনিভার্সিটি।

আর আপনি?

ঢাকা কলেজ।

সবার নাম আর ঠিকানাগুলো একটা খাতায় লিখে নিলো সে।

গেটের বাইরে দাঁড়ানো পুলিশের দল ইতিমধ্যে খবর পেয়ে গিয়েছিলো। তাই তারাও তৈরি হয়ে নিলো।

একটু পরে ছাত্রদের প্রথম দলটা বেরুলো বাইরে। দশটা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ওরা শ্লোগান দিলো, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

পুলিশের দল এগিয়ে এসে ওদের ঘিরে দাঁড়ালো। তারপর গ্রেপ্তার করে প্রিজন ভ্যানে তুলে নিলো সবাইকে।

একটু পরে বেরুলো দ্বিতীয় দল।

তারপর তৃতীয় দল।

পুলিশ অফিসাররা হয়ত বুঝতে পেরেছিলো, গ্রেপ্তার করে শেষ করা যাবে না। তাই ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দেবার জন্যে একজন বেঁটে মোটা অফিসার দৌড়ে এসে অকস্মাৎ একটা কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে মারলো ইউনিভারসিটির ভেতরে।

তারপর আরেকটা।

তারপর কাঁদুনে গ্যাসের ধেয়ায় ইউনিভার্সিটি এলাকা নীল হয়ে গেলো। ছেলেমেয়েরা ছিটকে পড়লো চারদিকে ছত্রভঙ্গ হলো। চোখগুলো সব জ্বালা করছে। ঝাঁপসা হয়ে আসছে। চারদিক। পানি ঝরছে। দুহাতে চোখ ঢাকলো। কেউ দুচোখে রুমাল চাপা দিলো। কদুনে গ্যাসের অকৃপণ ধারা তখনো বর্ষিত হয়ে চলেছে। একটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলো বেলতলায়। দুটো মেয়ে ছুটে এসে পাঁজাকোলা করে ভেতরে নিয়ে এলো তাকে।

আমি আর বরকত দেয়াল টপকে মেডিকেল কলেজে গিয়ে ঢুকলাম।

তারপর সেখান থেকে দৌড়ে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে।

ওখানকার ছেলেরা তখন মাইক লাগিয়ে জোর গলায় বক্তৃতা দিচ্ছে। হোস্টেলের ভেতর লাল সুরকি ছড়ান রাস্তার উপর ইতস্তত ছড়িয়ে সবাই। পুলিশ অফিসারও ততক্ষণে ভার্সিটি এলাকা ছেড়ে দলবল নিয়ে মেডিকেলের চারপাশে জড়ো হয়েছে এসে। একটু পরে হোস্টেলের ভেতরে কয়েকটি কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে মারলো ওরা। মেডিকেলের ছেলেরা বোকা নয়। তারা সব জানে। কাঁদুনে গ্যাসগুলো ফাটবার আগে সেগুলো তুলে নিয়ে পরক্ষণে পুলিশের দিকে ছুঁড়ে মারলো তারা। রাস্তার পাশে কতগুলো ছোট ছোট রেস্তোরাঁ আর হোটেল ছিলো। পুলিশের কর্তারা তার পেছনে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় নিলো। মেডিকেলের পশ্চিম পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা এ্যাসেম্বেলি হাউস ছুঁয়ে রেসকোর্সের দিকে চলে গেছে সে রাস্তার মোড়ে, জীপগাড়িসহ জনৈক এম. এল. এ-কে তখন ঘিরে দাঁড়িয়েছে একদল ছেলে। বেচারা এম. এল. এ তাদের হাতে পড়ে জলে ভেজা কাকের মতো ঠকঠক করে কাঁপছিলো আর অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলো এদিক সেদিক। আশেপাশে যদি একটা পুলিশও থাকতো। ছেলেরা জীপ থেকে নামালো তাকে। একটা ছেলে তার আচকানের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে হেঁচকা টানে ছিড়ে ফেললো পকেটটা। আরেকটা ছেলে চিলের মত ছোঁ মেরে তার মাথা থেকে টুপিটা তুলে রাস্তায় ফেলে দিলো। লোকটা মনের ক্ষোভ মনে রেখে বিড়বিড় করে বললো, আহা করছেন কি করছেন কি?

আমি আর বরকত মাইকের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ বরকত বললো, দাঁড়াও আমি একটু আসি। বলে গেটের দিকে যেখানে ছেলেরা জটলা বেঁধে তখনো শ্লোগান দিচ্ছিলো, সেদিকে এগিয়ে গেলো সে। সূর্য তখন হেলে পড়েছিলো পশ্চিমে। মেঘহীন আকাশে দাবানল জ্বলছিলো। গাছে গাছে সবুজের সমারোহ। ডালে ডালে ফাল্গুনের প্রাণবন্যা। অকস্মাৎ সকলকে চমকে দিয়ে গুলির শব্দ হলো।

ফিরে তাকিয়ে দেখলাম। একটা ছেলের মাথার খুলি চরকির মত ঘুরতে ঘুরতে প্রায় ত্রিশ হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো। আরেকটি ছেলে যেখানে দাঁড়িয়েছিলো মুহূর্তে সেখানে লুটিয়ে পড়লো। আরেক প্রস্থ গুলি ছোঁড়ার হলো একটু পরে।

আরেক প্রস্থ।

একটা ছেলে তার পেটটাকে দুহাতে চেপে ধরে হুমড়ি খেয়ে এসে পড়লো বার নম্বর ব্যারাকের বারান্দায়। চোখজোড়া তার ফ্যাকাসে হতবিহবল । আরো তিনটি ছেলে বুকে হেঁটে হেঁটে সে বারান্দার দিকে এগিয়ে এলো। তাদের কারো হাতে লেগেছে গুলি। কারো হাটুতে।

বরকতের গুলি লেগেছিলো উরুর গোড়ায়। রক্তে সাদা পাজামাটা ওর লাল হয়ে গিয়েছিলো। আমরা চারজনে ধরাধরি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। পথে সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছিলো। বলেছিলো, তোমরা ঘাবড়িয়ো না, উরুর গোড়ায় গুলি লেগেছে, ও কিছু না। আমি সেরে যাবো। সে রাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গিয়েছিলো সে।

অনেকক্ষণ পর কবি রসুল থামলো। কি গভীর বিষাদে ছেয়ে গেছে তার মুখ। একটু পরে বিষাদ দূর হয়ে সে মুখ কঠিন হয়ে এলো।

এনাটমির ক্লাশটা শেষ হতে নার্সেস কোয়ার্টারে মালতীর সঙ্গে দেখা করতে গেলো সালমা। মালতী তখন স্নান সেরে মাথায় চিরুনি বুলোচ্ছিলো বসে বসে। আসতে দেখে মৃদু হেসে একখানা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো, বোসো।

সালমা বসলো।

মালতী বললো, ক্লাস থেকে এলে বুঝি?

সালমা সায় দিলো, হ্যাঁ। তারপর বললো, এ মাসের টাকাটা নিতে এলাম। মালতী বললো, বোসস দিচ্ছি। চিরুনিটা নামিয়ে রেখে সুটকেসটা খুলে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করলে মালতী। তারপর নোটটা সালমার হাতে তুলে দিয়ে মালতী চাপা গলায় আবার বললো, আজকে তোমরা রোজা রাখ নি?

রেখেছি।

সবাই?

হ্যাঁ সবাই।

তুমি রেখেছে?

হ্যাঁ। চিরুনিটা আবার তুলে নিয়ে বিছানায় এসে বসলো মালতী। আস্তে করে বললে, তোমরা তো তবু ভোর রাতে খেয়েছে। এখানে আমরা যে ক’জনে রেখেছি, ভোর রাতে খেতে পারিনি। জানতো ভাই, চাকরি করি। রোজা রেখেছি শুনলে অমনি চাকরি নট হয়ে যাবে।

বলতে গিয়ে স্নান হাসলো সে। রওশনের কোন চিঠি পেয়েছো?

পেয়েছি।

কেমন আছে সে?

ভালো।

তোমার দাদা?

গ্যাস্ট্রিক আলসারে ভুগছে।

এখন কোন্ জেলে আছেন তিনি।

রংপুর।

একটু পরে মালতীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নার্সেস কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এলো সালমা।

মেডিকেলের গেটে ওর জন্য অপেক্ষা করছে আসাদ। দূর থেকে ওকে দেখলে সে । ওর সঙ্গে একদিনের মেলামেশায় অনেক কিছু জানতে পেরেছে সালমা। ঘরে মা নেই, বাবা আছেন। তিনি খুব ভালো চোখে দেখেন না তাকে। রাজনীতি করা নিয়ে সব সময় গালাগালি দেন। একবার তাকে সাজা দেবার জন্য ইউনিভার্সিটির খরচপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন। একদিনে তার কাছে অনেক কিছু জানতে পেরেছে সালমা। ছেলেটি জানেশোনে বেশ। কাল ভোর রাতে ভাত খেতে বসে অনেকক্ষণ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলো ওর সঙ্গে। ওর কথা বলার ভঙ্গিটা অনেকটা রওশনের মত। তবে বড় লাজুক। চোখজোড়া সব সময় মাটির দিকে নামিয়ে রেখে কথা বলে।

কাছাকাছি এসে সালমা বললো, আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো, কিছু মনে করবেন না।

না, মনে করার কি আছে। পরক্ষণে জবাব দিলো আসাদ।

সালমা বললো, সেই ইস্তেহারগুলো মুনিম ভাইকে পৌঁছে দিয়েছেন তো?

আসাদ বললো, দিয়েছি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সালমা আবার বললো, কাল রাতে পেট ভরে খান নি। এখন খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয় ।

খাই নি কে বললো? পেট ভরেই তো খেয়েছি। শুধু শুধু আপনি চোখজোড়া তখনো মাটিতে নামানো। কথা বলতে গেলে হঠাৎ রওশনের মত মনে হয়, বিশেষ করে ঠোঁট আর চিবুকের অংশটুকু। সালমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।

পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে হাতে তুলে দিলো আসাদ। নিন। যে জন্যে এসেছিলাম। প্রায় গোটা পঞ্চাশেক কালো ব্যাজ আছে এর ভেতরে। এতে হবে তো?

হ্যাঁ, হবে। সালমা ঘাড় নাড়লো।

তাহলে আপনার সঙ্গে কাজ আমার আপাতত শেষ। এখন চলি।

রাতে আবার দেখা হবে।

কালো পতাকার কি হলো? পেছন থেকে প্রশ্ন করলে সালমা।

এখনো দর্জির দোকানে। রাতে আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তখন পাবেন। বলে দ্রুতপায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে গেল আসাদ।

নীলা, বেনু আর ওদের সঙ্গে একটি অপরিচিত মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে, ওদের জন্যে দাঁড়ালো সালমা।

নীলা বললো, কি সালমা, কাল আমাদের হোস্টেলে যাবি বলেছিলে। কই গেলে নাতো? চলো এখন যাবে।

সালমা বললো, যাবার ইচ্ছে ছিলো, সময় করতে পারিনি। ওদের সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে ওর নজরে পড়লো নীলা আর বেনুর পরনে দুটো কুচকুচে কালো শাড়ি। বাতাসে শাড়ির আঁচলগুলো পতাকার মত পতপত করে উড়ছে। বাহ্ চমৎকার।

নীলা অবাক হয়ে তাকালো, কি?

ইশারায় দেখিয়ে সালমা জবাব দিলো, তোমাদের শাড়ি।

হ্যাঁ, নীলা মৃদু হাসলো। কালো ব্যাজ ব্যাণ্ড করেছে। আর তাই আমরা কালো শাড়ি পরেছি। দেখি ওরা আমাদের শাড়ি পরা ব্যান্ড করতে পারে কিনা।

বেনু এতক্ষণ চুপ করে কি যে ভাবছিলো। আসাদ সাহেবকে আপনি কত দিন ধরে চেনেন?

সালমা ঠিক এ ধরনের কোন প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিল না। ইতস্তত করে বললে, মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা তাও পুরো হয় নি। কিন্তু কেন বলুন তো?

না এমনি। বেনু দৃষ্টিটা অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে বললো, আপনার সঙ্গে দেখলাম কিনা, তাই।

কথা বলতে বলতে চামেলী হাউসের কাছে এসে পৌঁছলো ওরা। দূর থেকে দেখলে গেটের সামনে একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে।

সালমা বললো, কেউ এল বোধ হয়।

বে বললে, আসে নি, যাচ্ছে।

নীলা বললো, গতকাল অনেকে চলে গেছে হোস্টেল ছেড়ে। কারা রটিয়ে দিয়েছে একুশের রাতে পুলিশ হোস্টেলে হামলা করবে, সে খবর শুনে।

সালমা অবাক হলো, তাই নাকি?

দুটো সুটকেস আর একটা বেডিং ভোলা হলো ছাদের ওপর।

যে মেয়েটা চলে যাচ্ছিলো তার দিকে এগিয়ে নীলা বললো, তুইও চললি বিলকিস?

মেয়েটার মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো, চোখ তুলে ওদের দিকে তাকাতে পারলো না। সে। শুধু ইশারায়, অদূরে দাঁড়ান ভদ্রলোককে দেখিয়ে আস্তে করে বললো, চাচা এসেছে নিয়ে যেতে। বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠলো তার অসহায়ভাবে।

ইউনিভার্সিটিতে এসে প্রথমে মুনিমের খোঁজ করল আসাদ। ভার্সিটির ভেতরটা কালকের চেয়ে আজকে আরো সরগরম। চারপাশে ছেলেরা জটলা বেঁধে ধর্মঘটের কথা আলোচনা করছে।

এমনি একটা জটলার পাশে এসে দাঁড়ালো আসাদ।

একটা ছেলে বললো, তুমি যা ভাবছে, কিছু হবে না, দেখবে কাল রাস্তায় একটা ছেলেকেও বেরুতে দেবে না ওরা।

আরেকজন বললো, অবাক হবার কিছু নেই। কাল হয়তো কারফিউ দেবে।

তৃতীয়জন বললো, আজকেও কি কম পুলিশ বেরিয়েছে নাকি রাস্তায়।

পল্টনের ওখানে চার-পাঁচ লরী পুলিশ দেখে এলাম।

প্রথম জন ওকে শুধরে দিলো । তুমি যে একটা আস্ত গবেট তাতো জানতাম না মাহেরা আরে, ওগুলো পুলিশ নয়, মিলিটারি। ওখানে তাঁবু ফেলেছে। কাল এতক্ষণে দেখবে পুলিশ আর মিলিটারি দিয়ে পুরো শহরটা ছেয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয় জন গভীরভাবে রায় দিলো এবার।

মুনিমের দেখা পেয়ে আসাদ আর দাঁড়ালো না সেখানে।

মধুর রেস্তোরাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আরেক দল ছেলেকে কি কি যেন বোঝাচ্ছে মুনিম ।

তেলবিহীন চুলগুলো দস্যি ছেলের মত নেচে বেড়াচ্ছে কপালে ওপর। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ।

আসাদ বললো, তোমায় খুঁজছিলাম মুনিম।

কেন? কি ব্যাপার? পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলো সে।

আসাদ বললো, শুনলাম কাল রাতে তোমাদের বাসায় পুলিশের হামলা হয়েছিলো।

হ্যাঁ, ঠিক শুনেছ। মুনিম মৃদু হাসলো। অবশ্য ব্যর্থ অভিসার, রাতে বাসায় ছিলাম না আমি।

অদূরে দাঁড়িয়ে ওদের আলাপ শুনছিলো সবুর। বললো, তোমার কপাল ভালো, ধরা পড়লে কি আর এ জন্মে ছাড়া পেতে? জেলখানায় পচে মরতে হতো। রাতে কোথায় ছিলে?

বাইরে অন্য এক বাসায় ছিলাম।

বাসায়, না হলে–সবুর মৃদু হাসলো।

না, বাসাতেই ছিলাম। মুনিম ঘাড় নাড়লো।

সবুর বললো, আমাকেও দেখছি আজ রাতে বাইরে কোথাও থাকতে হবে। বাসার আশেপাশে গত ক’দিন ধরে টিকটিকির উদ্রব বড় বেড়ে গেছে। মুনিম কি যেন বলতে । যাচ্ছিলো। সহসা সামনের লন দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটি মেয়ের দিকে চোখ পড়তে ডলির কথা মনে পড়লো ওর। ডলির সঙ্গে কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও দেখা করা প্রয়োজন।

সবুরের হাত ঘড়িটার দিকে এক পলক তাকালো মুনিম। এর মধ্যে দুটো বেজে গেলো, আমাকে একটু ভিক্টোরিয়া পার্ক যেতে হবে।

পাগল নাকি? আসাদ রীতিমত চমকে উঠলো। এখন তুমি ইউনিভার্সিটি এলাকা ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। বাইরে পা দিলেই ধরবে।

ঠিক বলছে আসাদ। রাহাত সমর্থন জানালে তাকে। এখন এ এলাকার বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না আপনার। তাছাড়া নবকুমার আর নবাবপুর হাইস্কুলের ছেলেরা একটু পরে দেখা করতে আসবে। আপনি না থাকলে চলবে কি করে?

অগত্যা ডলির সঙ্গে দেখা করার চিন্তাটা মূলতবি রাখলো মুনিম। কিন্তু জাহানারাকে একখানা চিঠি না লিখলে নয়। রাতের হাত থেকে খাতাটা আর আমাদের পকেট থেকে কলমটা টেনে নিয়ে মধুর রেস্তোরাঁর এককোণে এসে চিঠি লিখতে বসলো মুনিম। গতকাল রাতে আমাদের বাসা সার্চ হয়েছে। খবরটা হয়তো ইতিমধ্যে পেয়েছে। এখন থেকে কিছুদিনের জন্যে বাসায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। শুনলাম মা খুব কান্নাকাটি করছেন। মাকে সব কিছু বুঝিয়ে সান্ত্বনা দেবার ভার তোমার উপরে রইলো। আশা করি এ চিঠি পেয়ে তুমি একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করবে। আজ রাতে আর তোমাদের ওখানে যাবো না। হোস্টলে থাকবো।

এখানে এসে চিঠিটা শেষ করেছিলো মুনিম।

পুনশ্চ দিয়ে আবার লিখলো। কাল রাতে ডলির খবর জানতে চেয়েছিলে, ডলি ভালো আছে।

চিঠিখানা একটা ছেলের মারফত জাহানারার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে দুহাতে মুখ খুঁজে কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো মুনিম। মধুর রেস্তোরাঁয় এখন ভিড় অনেকটা কমে গেছে। কিছু ছেলে এদিকে সেদিকে বসে।

Leave a Reply