শাহেদ চলে যাবার পর, টেবিলে বসে অনেকক্ষণ ধরে একটা বই নাড়াচাড়া করলো সালমা। বইতে আজ মন বসছে না তার। বড় চাচার শেষের কথাগুলো বারবার কানে বাজছে। আর রওশনের মুখখানা ভেসে উঠছে বইয়ের পাতায়। বসে বসে অনেক অবাস্তব চিন্তার জাল বুনে চললো সে। এখন যদি হঠাৎ রওশন এখানে এসে পড়ে? কে জানে হয়তো এর মধ্যে কিছু একটা ঘটে গেছে দেশে। রওশন ছাড়া পেয়েছে জেল থেকে। তার চোখে মুখে আনন্দের চমক। সে দোরগোড়া থেকে ডাক দিলো, সালমা আমি এসেছি দরজা খোল। না, এই নিঃসঙ্গ জীবন আর ভাল লাগে না। এই ক্ষুদ্র দেহে একবড় ক্লান্তির বোঝ আর বয়ে বেড়াতে পারে না সালমা। পাশের বাড়ির রেডিওটায় কি একটা গান হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে কান পেতে সেটা শুনতে চেষ্টা করছিলো সে। সদরে কড়া নড়ার শব্দ হতে বইটা বন্ধ করে রেখে পরনের কাপড়াটা দুহাতে একটু পরিপাটি করে নিলে সালমা। দরজাটা খুলে দিয়ে ঠিক তাকে চিনতে পারলো সে। আপনি আসাদ ভাই না?

হ্যাঁ। আস্তে জবাব দিলো আসাদ।

আসুন।

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তাকে ভিতরে নিয়ে এলো সালমা। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো, বসুন।

আসাদ বসলো। বসে চারপাশে চোখ বুলিয়ে এটা সেটা দেখতে লাগলো সে। সালমা ভাবলো, এমনি বোবার মত চুপ করে বসে থাকা যায় না। কিছু একটা বলতে হয়। কিন্তু বলার মত কোন কথা খুঁজে পেলে না সে। অবশেষে ইতস্তত করে শুধালো চা খাবেন।

না থাক। আসাদ নড়েচড়ে বসলো।

না কেন। খান না এককাপ। বলে আর উত্তরের অপেক্ষা না করে তাঁটের তলা থেকে স্টোভটা টেনে নিলো সালমা।

আসাদ এবার না করলো না। সেও খুঁজছিলো মনে মনে। কিছু বলতে হবে। এমনি জড়ের মত কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায়। আর একটু পরে একটা প্রশ্ন করলে সে। আপনি বুঝি মেডিকেলে পড়েন?

ইউনিভার্সিটিতে।

ও। সালমা স্টোভে আগুন ধরিয়ে দিলো।

খানিকক্ষণ পর আসাদ আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনার ছোট ভাইকে দেখছি না যে, উনি কোথায়?

শাহেদের প্রসঙ্গ উঠতে মুখখানা কালো হয়ে গেলো সালমার। গলা নামিয়ে সঙ্কোচের সঙ্গে বললো, ও সিনেমায় গেছে।

সিনেমায়? আসাদ রীতিমত অবাক হলো। কিন্তু এর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলো না সে। চায়ের পেয়ালাটা ওর হাতে তুলে দিয়ে আলোচনাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করলো সালমা। আজ ধরপাকর হয়েছে। শুনেছেন কিছু

না।

কাল তো রোজা রাখতে হবে।

হ্যাঁ।

ভোররাতের কিছু বন্দোবস্ত করেছেন।

ভাত বেঁধে রেখেছি। তরকারি নেই, সাদা ভাত। শুধু ডিম দিয়ে যেতে হবে কিন্তু। ঈষৎ হাসলো সালমা।

আসাদ আস্তে করে বললো, আমার অভ্যাস আছে।

রাতে বাসায় ফিরতে বেশ দেরি হলো মুনিমের। সারাদিন ছুটাছুটি করে ভীষণ ক্লান্ত সে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার শক্তি পাচ্ছিলো না। কিন্তু এই অপরিসীম ক্লান্তির মাঝেও কোথায় যেন একটা অফুরন্ত শক্তির উৎস লুকিয়ে ছিলো। যা তাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সামনের দিকে। মনে পড়লো। বাবার কেরানী বন্ধু রসুল সাহেবের সঙ্গে আজ বিকেলে যখন মেডিকেলের সামনে দেখা হয়েছিলো তখন তিনি কাছে এগিয়ে এসে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এবার কি একেবারে চুপ করে থাকবে তোমরা? কিছু করবে না?

আমরা আপনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। দেখছেন তো আমাদের হাত পা একেবারে বাঁধা। বলেছিলো আরেকজন। সে লোকটা কাজ করে কোন এক ব্যাঙ্কে।

ওদের কথা ভাবতে গেলে নিজেকে অনেক বড় মনে হয় মুনিমের। আর তখন সমস্ত ক্লান্তি তার কপূরের মতো উড়ে যায়।

বাসায় ফিরে মুনিম দেখলো, টেবিলে ভাত সাজিয়ে মা বসে আছেন। আমেনার সঙ্গে কি নিয়ে আলাপ করছেন তিনি। ওকে আসতে দেখে মা তিরস্কার করে বললেন, এই একটু আসি বলে সকালে বেরিয়ে গিয়ে এই রাত দশটায় ফিরছিস তুই। এদিকে আমি চিন্তা করে মরি। ঘর বাড়ি কি কিছু নেই নাকি তোর

মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো মুনিম। তারপর গম্ভীর গলায় বললো, জানোমা, সেবার যে গুলি করে কতগুলো ছেলেকে মেরেছিলো, তাদের জন্যে আমরা একটু শোক করবো তাও দিচ্ছে না ওরা।

মিনসেদের হয়েছে কি? কাঁদতেও দেবে না নাকি? মা অবাক হলেন। মুনিম সাগ্রহে বললো, তাইতো মা, কাদবার জন্যে আন্দোলন করছি।

কিন্তু বাবা তোমার আন্দোলন করে কাজ নেই। পরক্ষণে জবাব দিলো মা। যে মায়ের পাঁচ-সাতটা ছেলে আছে তারা আন্দোলন করুক। তুমি আমার এক ছেলে, তোমার ওসবে দরকার নেই।

আরো কিছুক্ষণ সেখানে বসে থেকে মা চলে গেলেন তাঁর শোবার ঘরে। হতাশ হয়ে টেবিলের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো মুনিম। মাকে নিয়ে বড় জ্বালা ওর।

মা চলে যেতে আমেনা বললো, মিন্টু এসেছিলো। কি একটা বই দিয়ে গেছে তোমার জন্যে। বলে মায়ের ঘর থেকে বইটা এনে ওর হাতে দিতে গিয়ে ফিক করে হেসে দিলো আমেনা। তারপর চলে গেলে সে।

প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলো মুনিম। পরে, বইটা দেখে বুঝতে পারলে কেন হেসেছে আমেনা। বহুদিন আগে কোন এক জন্মদিনে যে বইটা ডলিকে উপহার দিয়েছিলো সে, সেটা মিন্টুর হাতে ফেরত পাঠিয়েছে ডলি। কি অর্থ হতে পারে এর?

চিরতরে সম্পর্কচ্ছেদ, না ক্ষণিকের অভিমান?

বইটা ওলটাতে গিয়ে মুনিম দেখলে ভেতরে একখানা চিঠি। আগ্রহের সঙ্গে চিঠিটা খুলে পড়লো মুনিম। ডলি লিখেছে–

মুনিম,

তুমি উত্তর মেরুর মানুষ, আমি দক্ষিণ মেরুর।

ভেবে দেখলাম তোমাতে আমাতে মিলন সম্ভব নয়। তাই বজলেকে গ্রহণ করলাম। ওকে আমি ভালবাসি নি কোনদিন। তবু, একই মেরুর মানুষ তো, খাপ খাইয়ে নিতে পারবো। তুমিও পারবে বলে আশা করি।

ইতি। -ডলি

চিঠি পড়ে কিছুক্ষণের জন্যে বিমূঢ় হয়ে গেলো মুনিম ।

একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে তার ওপরে বসলো সে।

হয়তো এমনো হতে পারে যে ডলি যা লিখেছে সেটা ওর মনের কথা নয়।

হয়তো বা মনের কথা। কিন্তু হঠাৎ এমন পরিবর্তনের কি হেতু থাকতে পারে?

মুনিম তো কোন দুর্ব্যবহার করে নি ওর সঙ্গে।

ডলি নিজে রাগ করে যেতে নিষেধ করেছ।

একটু পরে চিঠিটা জামার পকেটে রেখে দিয়ে মুনিম ভাবলো কাল একবার সময় করে। ডলির সঙ্গে দেখা করবে।

রাতে জাহানারাদের বাসায় থাকবে বলে পূর্বাহ্নে জানিয়ে দিয়েছিলো মুনিম। ঘরে থাকা নিরাপদ নয়। যে কোন সময় হামলা হতে পারে।

তাই রাতের খাওয়াটা তাড়াতাড়ি সেরে মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়লে আমেনাকে বাইরের দরজাটা বন্ধ করতে বলে রাস্তায় নেমে এলো মুনিম।

পেছন থেকে আমেনা চাপা স্বরে বললো, সাবধানে থেকে ভাইয়া।

মুনিম অন্ধকারে মৃদু হাসলো।

বাইরের জীবনে যখন গভীর নৈরাশ্য পাথরের মত চেপে বসছে মানুষের মনে, যখন প্রতিটি পদক্ষেপ শঙ্কা ভয় আর ত্ৰাসে জড়িয়ে আসতে চায় আর একটি মুহূর্তের জন্যে মানুষ তাকে বিপন্মুক্ত বলে ভাবতে পারে না, সব সময় মনে হয় ওই বুঝি মৃত্যু নেমে এলো তার ভয়াবহ নীরবতা নিয়ে, তখনো সংসারে স্নেহ প্ৰেম আর ভালবাসা পাশাপাশি বিরাজ করে। বলেই হয়তো মানুষগুলো এখনো বেঁচে আছে। একবার চারপাশে সন্তৰ্পণে তাকিয়ে নিয়ে দ্রুত সামনের রাস্তাটা পেরিয়ে ওপাশের সরু গলিতে গিয়ে ঢুকলো মুনিম।

জাহানারা আর তার অধ্যাপক স্বামী টেবিলে ভাত সাজিয়ে ওর অপেক্ষায় বসেছিল। ওরা ভেবেছিলো হয়তো মুনিম এখানে খাবে। তাই দোকান থেকে কিছু ভাল কবাব এনে রেখেছিলো।

জাহানারা ভাত খাবে না। রুটি খাবে। দু’দিন থেকে ঠাণ্ডা লেগে গায়ে মৃদু জ্বর এসেছে। ওর। তাছাড়া এক বেলা রুটি খাবার চিন্তাটা কিছুদিন থেকে মাথায় ঢুকেছে। ওতে নাকি বাড়তি মেদ কমে যায়। জাহানারার মতে শুধু ওর কেন সবার মতে দিনে দিনে বড় বেশি মোটা হয়ে যাচ্ছে সে। পরিচিত দু’একজন ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করেছে জাহানারা। সব রোগের ওষুধ আছে, আর এই যে বিশ্রী রকমের মোটা হয়ে যাচ্ছি এর কোন ওষুধ নেই আপনাদের কাছে?

ডাক্তার বন্ধুরা কেউ শব্দ করে হেসে দিয়েছে, আছে বইকি। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিন। দেখবেন, যে হারে মোটা হয়েছেন সে হারে শুকিয়ে যাবেন।

কেউ বলেছে, সকালে উঠে কিছু ডন বৈঠক দিন। দেখবেন দু’দিনেই সব বাড়তি মাংস ঝরে যাবে।

আবার কেউ বলেছে, এক কাজ করুন না, দু’বেলা ভাত খাওয়াটা বন্ধ করে একবেলা রুটি খেতে শুরু করুন আর দৈহিক শ্ৰমটা বাড়িয়ে দিন। সব ঠিক হয়ে যাবে।

শেষের প্রস্তাবটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হলো জাহানারার। তাই ক’দিন ধরে একবেলা রুটি খাবার চিন্তা করছিলো সে।

মুনিম এসে জানালো সে খেয়ে এসেছে। শুনে আহত হলো জাহানারা।

বললো, তোমাকে তখন বলে দিয়েছিলাম, এখানে খাবে।

মুনিম কি জবাব দেবে প্রথমে কিছু ভেবে পেলো না। পাঠ না পারা ছাত্রের মত বার কয়েক ঘাড় চুলকালো সে। একবার অধ্যাপকের দিকে আর একবার জাহানারার দিকে তাকিয়ে বললো, উপায় ছিলো না, বুঝলে বাসায় না খেলে মা ভীষণ রাগ করতেন। আর তুমি তো জান উনি আমাকে নিয়ে সব সময় কেমন বাড়াবাড়ি করেন।

জাহানারা কিছু বলতে যাচ্ছিলো। অধ্যাপক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, খেয়ে এসেছে। ভালো কথা। আমরা অনেকক্ষণ ধরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি, বেশি না পারো আমাদের সঙ্গে অল্প চারটে খাও। অন্তত কবাটা। ওটা তোমার জন্যেই আনা।

না বললে যে ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না তা জানতো মুনিম।

অগত্যা চেয়ার টেনে বসলো সে।

খাওয়ার অবসরে বাইরের অবস্থা জানতে চাইলে অধ্যাপক।

কাল সত্যি সাংঘাতিক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আবার সেই বায়ান্ন সালের পুনরাবৃত্তি হবে না তো, আবার সেই রক্তপাত।

অধ্যাপক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। তার প্রশস্ত কপালের ভাজগুলো স্পষ্ট হয়ে দেখা দিলো। মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকে এলো সামনে। মুনিমের কাছ থেকে কোন জবাব না পেয়ে নিজে থেকে আবার বলতে লাগলো সে, তোমাদের ওই নেতাদের ওপর আমার এতটুকু আস্থা নেই। আমি জানি এবং বেশ ভালো করে জানি, ওদের মধ্যে কোন পৌরুষ নেই। কতগুলো ভীরু কাপুরুষ ওরা! তোমার কি মনে হয় ওরা এ সময়ে তোমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে?

মুনিম এবারও নিরুত্তর রইলো। নেতাদের সে নিজেও যে খুব বিশ্বাসের চোখে দেখে তা নয়। আর বিশ্বাস করবেই বা কেমন করে। নেতাদের কাছে দল বেঁধে দেখা করতে গিয়েছিলো। ওরা ওদের সক্রিয় সাহায্য চেয়েছিলো, ওরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেছে।

বিব্রত গলায় বলছে, দেখো সাংঘাতিক কিছু করে বসো না তোমরা। দেখে যেন শান্তি ভঙ্গ না হয়।

শান্তি বলতে কি মনে করে ওরা।

অন্যায়ের কাছে মাথা নত করার আক্রমণের মুখে আত্মসমর্পণ?

আমি জানি। তোমাদের ওই নেতারা কি চায়। টেবিলের ওপাশ থেকে অধ্যাপক আবার বললো, ওদের আশু লক্ষ্য হলো গদি দখল করা। আর পরবর্তী অভিপ্রায় হলো বাকি জীবনটা যাতে স্বচ্ছন্দে কাটে সে জন্যে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা। তুমি কি মনে করেছে ওরা এ দেশকে ভালবাসে? দেশবাসীর জন্যে দরদে বুক ওদের ফেটে চৌচির হয়ে যায়, তাই না? তুমি কি। আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিলো অধ্যাপক। মুনিম মাঝপথে বাধা দিয়ে বললো, তা আমি জানি। তারপর আবার চুপ করে গেলো, সে। খানিকক্ষণ তিনজনে নীরব রইলো।

ছোট মেয়েটা ঘুম থেকে ওঠে কান্না জুড়ে দিয়েছিলো। উঠে গিয়ে তাকে শান্ত করে এসে আবার টেবিলে বসলো জাহানারা। অধ্যাপক স্ত্রীর দিকে এক পলক তাকালো, তারপর মুনিমের দিকে চোখজোড়া ফিরিয়ে এনে আবার বললো, কিন্তু ওরা যদি এ সময়ে তোমাদের পাশে এসে না দাঁড়ায় তাহলে একা একা কতক্ষণ লড়বে তোমরা

তা জানি না।

মুনিমকে হঠাৎ যেন বড় চিন্তিত মনে হলো। একটু থেমে আস্তে সে বললো, শুধু জানি, ওদের জন্যে আমাদের কাজ থেমে থাকবে না।

এক টুকরো রুটি মুখে তুলতে গিয়ে থেমে মুনিমের দিকে তাকালো জাহানারা।

অধ্যাপকের মুখখানা শিশুর সরল হাসিতে ভরে উঠলো।

বার কয়েক মাথা নেড়ে সে বিড়বিড় করে বললো, হ্যাঁ, এমন কথা শুধু তোমরাই বলতে পারো। যারা নিঃস্বার্থভাবে দেশকে ভালবাসতে শিখেছে শুধু তারাই বলতে পারে। হ্যাঁ, কেবলমাত্র তারাই পারে। আনন্দে দেহটা বার কয়েক কেঁপে উঠলো তার।

কিন্তু মনিম জানে এ কথা ওর নয়।

আরেকজনের।

বাইশে ফেব্রুয়ারি গুলি খেয়ে মরেছে সেই হাইকোর্টের মোড়ে, তিন বছর আগে।

তিন বছর?

হ্যাঁ তিনটে বছর। কিন্তু এখনো তার মুখখানা স্পষ্ট মনে আছে মুনিমের। শুধু তার মুখ কেন, তাদের সকলের মুখ আজো ভেসে ওঠে তার চোখে।

কাক ডাকা ভোর না হতে সেদিন দলে দলে তারা এসে জমায়েত হয়েছিলো মেডিকেল কলেজের পুরোনো হোস্টেলে।

ছেলে। বুড়ো। মেয়ে।

ছাত্র। শ্রমিক। কেরানী।

কত লোক হবে?

কেউ গুনে দেখে নি। আকাশের তারা গুনে বিশেষ করা যায়। যেদিকে তাকাও সমুদ্রের মত ছড়িয়ে আছে জনতা। আর সবার কণ্ঠে বিদ্রোহের সুর।

এর জন্যে বুঝি পাকিস্তান চেয়েছিলাম আমরা?

আমাদের ছেলে-মেয়েদের ধরে ধরে মারবার জন্যে?

হায় খোদা তুমি ইনছাফ করা এর!

গায়েবি জানাযা পড়ার জন্যে সমবেত হয়েছিলো ওরা। আর বুড়ো ইমাম সাহেব মোনাজাত করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, যারা আমাদের কচি ছেলেদের গুলি করে মারলো, খোদা তুমি তাদের ক্ষমা করো না।

সূর্য তখন ধীরে ধীরে উঁকি দিচ্ছিলো পুবের আকাশে।

গায়েবি জানাযা শেষ হলে পর জোয়ারের বেগে মিছিলে বেরিয়ে পড়লে সবাই। নেতারা কেউ ছিলেন না।

তারা কখনই বা ছিলেন?

ফরহাদ বললো, বাদ দাও ওদের কথা। আমাদের কাজ আমরা করে যাবো। মেডিকেল থেকে বেরিয়ে মিছিলটা এগিয়ে চলেছিলো হাইকোর্টের দিকে। ফরহাদ হাত ধরে টানলো ওর। এসো মুনিম।

তারপর জনতার মাঝখানে হারিয়ে গেলো ওরা।

ভাইসব মিছিলে আসুন। কে যেন ডাকলো।

তুমি কি যাবে না, চলে এসো।

খোদার কছম বলছি ওরা জাহান্নামে যাবে। খোদা কি ওদের বিচার করবে না মনে করছো? আলবত করবেন।

ওকি কাঁদছেন কেন। কেঁদে কি হবে।

আওয়াজ তুলুন ভাইসব।

তারপর সাগর কল্লোলের মত চিকারে ফেটে পড়লো বিক্ষুব্ধ জনতা।

ফরহাদের হাতে একটা নাড়া দিয়ে মুনিম বললো, তোমার কি মনে হয় আজকেও ওরা গুলি করবে?

জানি না। মৃদু গলায় জবাব দিয়েছিলো ফরহাদ। করলে করতে দাও। ক’জন মারবে ওরা।

প্রশস্ত রাস্তা জুড়ে মিছিলটা এগিয়ে চলেছিল হাইকোর্টের পাশ দিয়ে। অকস্মাৎ কয়েকখানা মিলিটারি লরী দ্রুতবেগে এসে রাস্তার তেমাথায় যেখানে লম্বা পলাশ গাছটায় অসংখ্য লালফুল ধরেছিলো, সেখানে এসে থামলো। আর পরক্ষণে ইউনিফর্ম পরা সৈন্যরা সার বেঁধে রাস্তার ওপর শুয়ে পড়ে রাইফেলের নলগুলো তাক করে ধরলে মিছিলের দিকে। কয়েকটি উত্তেজিত মুহূর্ত।

ভাবতে গায়ের লোমগুলো এখননা বর্শার ফলার মত খাড়া হয়ে যায় মুনিমের। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আর্ত চিঙ্কার ভেসে আসে কানে।

খোদা ইনছাফ করবে।

খোদা আমি যে মরে গেলাম।

মাগো। আমাকে বাঁচাও, মরে গেলাম। মুমূর্ষের চিৎকার আর পোড়া বারুদের গন্ধ।

পোনা মাছের মতো মানুষগুলো ছুটে চারপাশে হাইকোর্টের রেলিঙ ডিঙ্গিয়ে ভেতরে আত্মগোপন করতে যাচ্ছিলো যে লোকটা, রেলিঙের উপরেই স্কুলে পড়লো সে। কে জানে হয়তো শেষ মুহূর্তে স্ত্রীর মুখখানা ভেসে উঠেছিলো তার চোখে। বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে পড়েছিলো। হঠাৎ তাইতো জীবনের প্রতি গভীর মমতা জন্মে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো পালিয়ে বাঁচবে। কিন্তু সে জানতো না ইতিমধ্যে তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে। আরেকটা সতেরো আঠারো বছরের ছেলে। পায়ে গুলি লেগেছিলো তার, তবু বুকে হেঁটে পালাতে চেষ্টা করছিলো সে আর ভয়ার্ত স্বরে বারবার বিড়বিড় করে বলছিলো, আমাকে মেরো না।

কিছুদূর এগুতে জন্মের মত বাক রোধ হয়ে গেলো তার।

একটা অফুট আর্তনাদ করে ছেলেটির দিকে ছুটে গিয়েছিলো ফরহাদ।

তার গায়ে যে গুলি লাগতে পারে সে কথা মনে ছিলো না। শুধু মনে ছিলো, আমাদের কাজ আমরা করে যাবে।

কি ভাবছেছা অমন করে? অধ্যাপকের গলার স্বরে চমকে তার দিকে তাকালো মুনিম। খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। জগ থেকে এক গ্রাস পানি ঢেলে নিয়ে সে বললো, আমি বুঝতে পারছি তুমি কি ভাবছ।

কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, দিন এক রকম যায় না। বলে পানির গ্লাস এক নিঃশ্বাসে শেষ করে হাত ধােয়ার জন্যে উঠে দাড়ালো সে। ওদের আলোচনার বিষয়গুলো খুব উপাদেয় লাগছিলো না জাহানারার। তাই বিষয়ান্তরে যাবার জন্যে মুনিমের দিকে একটু ঝুঁকে এসে সে জিজ্ঞেস করলো, ডলির কি খবর?

নিজেকে সহসা বড় অসহায় মনে হলো মুনিমের। কে জানে, জাহানারা হয়তো ইতিমধ্যে শুনেছে সব, কিম্বা শোনে নি। তবু কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে গেলো সে।

জাহানারা আবার প্রশ্ন করলো, ডলি কেমন আছে?

মুনিম বললো, জানি না।

জাহানারার ঠোঁটে মৃদু হাসি জেগে উঠলো। না জানবার তো কথা নয়।

জাহানারার দিকে স্থির চোখে তাকালে সে। মুখখানা বিরক্তি আর অসহিষ্ণুতায় ভরা।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে বললো, তার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। জাহানারা, প্লিজ-1 দৃঢ় গলায় কথাটা বলবে ভেবেছিলো, কিন্ত ফাটা বাঁশের বাঁশির মত শোনাল সবকিছু। এ সময় ডলির কথাটা না তুললে কি ভাল করতো না জাহানারা?

কাণ্ডজ্ঞানহীন আর কাকে বলে। তার ওপর রাগ করার কোন অর্থ হতে পারে না জেনেও চেয়ারটাতে সশব্দে পেছনের দিকে ঠেলে, পাশের ঘরের যেখানে অধ্যাপক হাত ধুয়ে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো, সেখানে তার পাশে গিয়ে বসলো মুনিম।

জাহানারা বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ।

রাত দুপুরে কিউ খানের বাসা থেকে লোক আসবে তাকে ডাকতে, এ কথা ঘুমোবার এক মুহূর্ত আগেও ভাবেনি মাহমুদ। লেপের ভেতরে কি আরামে ওয়েছিল সে। একটা সুন্দর স্বপ্নও ইতিমধ্যে দেখেছিলো। এখন আবার কাপড় পড়ে যেতে হবে সেই দু মাইল দূরে, কিউ খানের বাসায়। ভাবতে গিয়ে মেজাজটা বিগড়ে গেলে মাহমুদের। দুত্তরি তোর চাকুরির নিকুচি করি। রাত নেই দিন নেই ডেকে পাঠাবে, যেন কেনা গোলাম আর কি। মনে মনে বিড়বিড় করলো সে। তারপর গরম কোটটা গায়ে চড়িয়ে নিয়ে একটু পরে বাইরে বেরিয়ে এলো।

সাহানা ঘুমুচ্ছে।

ঘুমোক।

কিউ খানের বাসায় এসে দেখলো সে একা নয়। আরো অনেকে এসেছে সেখানে। বাইরে বারান্দায় রীতিমত ভিড় জম গেছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় বাতাসটা নীল হয়ে আসছে। ইন্সপেক্টর রশীদকে সামনে পেয়ে একপাশে ডেকে নিয়ে এলো মাহমুদ। ব্যাপারটা কি বলতো, এই রাত দুপুরে?

ইন্সপেক্টর রশীদ বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, রাতে কয়েকটি বাসা সার্চ করতে হবে বোধ হয়, আমি ঠিক জানি না। তারপর গলার স্বরটা আরো একটু নামিয়ে এনে বললো, বড় কর্তারা সবাই ভীষণ ক্ষেপে গেছে। ভেতরে এখন ক্লোজ ডোরে আলাপ-আলোচনা চলছে ওদের।

মাহমুদ বললো, তাহলে এখনো কিছু ঠিক হয় নি।

রশীদ মাথা নাড়লো, না।

মাহমুদ হতাশ গলায় বললো, রাতের ঘুমটা একেবারে মাটি হলো। রশীদ মৃদু হেসে বললো, করাতের হয় দেখো! আবহাওয়া ভীষণ গরম। বড় কর্তা রেগে গিয়ে বলেছে, এত কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে শহরে অথচ কাউকে গ্রেফতার করা হলো না, কেমন কথা?

মাহমুদ বললো, আমারো তাই মত। ধরে সবগুলোকে জেলে পোরা উচিত। রশীদ আবার হাসলো। তেমনি চাপা স্বরে বললো, ধরা উচিত তো বুঝলাম। কিন্তু কজনকে ধরবে।

মাহমুদ পরক্ষণে বললো, কেন যারা এসব করছে তাদের সকলকে। বাইরে আকাশটা কুয়াশায় ছাওয়া ছিলো। সেদিকে তাকিয়ে ইন্সপেক্টর রশীদ জবাব দিলো, ধরে শেষ করতে পারবে বলে তো মনে হয় না বলে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো রশীদ। কেউ শুনলো নাতো?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাহমুদ কাঁধ ঝাঁকালো। যাকগে, আমাদের ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কর্তারা যা করার করবে যদি বলে ধরো, ধরবো। যদি বলে ছাড়ো, ছাড়বো। যদি বলে মারো, মারবো। আমাদের কি ভাই, টাকা পাই চাকরি করি। বলে একটা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লো মাহমুদ। হা তোমার কাছে সিগারেট আছে? তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে আমার প্যাকেটটা ফেলে এসেছি বাসায়। রশীদ কিছু বললো না, পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে নিঃশব্দে এগিয়ে দিলে তার দিকে। বাইরে ঘন কুয়াশা ঝরছে।

ভেতরে কর্তারা বৈঠক করছেন এখনো।

মাঝে মাঝে তাদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে বাইরে। মাঝে মাঝে উগ্র গলার স্বর। এখান থেকে স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছে না কি বলছে তার। মাহমুদ সিগারেটে একটা জোর টান দিলো।

Leave a Reply