» » তিন

বর্ণাকার

কলতাবাজারে ওদের ছোট বাসা বাড়িটায় যখন ফিরে এল সালমা তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে চারপাশে। স্বচ্ছ নীলাকাশে একটি দুটি করে তারা জ্বলতে শুরু করেছে।

কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুলো সালমা। আলনা থেকে ভোয়ালেটা নামিয়ে মুখ-হাত মুছলো। তারপর জানালার কবাট দুটো খুলে কিছুক্ষণের জন্যে সেখানে দাঁড়ালো সে।

এমনি সময় যখন পুরো শহরটা আবছা অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।

এখানে সেখানে ঝি ঝি পোকার মত টিমটিমে আলো, কোথাও-বা হালকা নীল ধোঁয়া সরীসৃপের মত একে বেঁকে উঠে গেছে আকাশের দিকে।

কোথাও কোন শাশুড়ি তার বউকে গালাগালি দিচ্ছে, বাচ্চা ছেলেরা সুর করে পড়ছে কোন ছড়ার বই কিম্বা কোন ছন্দোবদ্ধ কবিতা, তখন এমনি জানালার রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ লাগে সালমার।

উত্তর থেকে ভেসে আসা হিমেল বাতাসে বসন্তের ঘ্রাণ।

এ মুহূর্তে রওশন যদি থাকতে পাশে।

ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলো সালমা।

আজ কত দিন হয়ে গেছে, দিন নয়, বছর। কত বছর।

বিয়ের মাস খানেক পরে ধরা পড়েছিল রওশন।

দাদাসহ কোথায় যেন বেরিয়েছিলো ওরা, সন্ধ্যার পরে। দুজনের কেউ আর ফিরে আসে নি। ভাত সাজিয়ে সারা রাত জেগেছিলো সালমা। পরদিন সকালে খোঁজ নিয়ে শুনলো লালবাগে পুলিশের হেফাজতে আছে ওরা।

জানালার পাশ থেকে সরে এসে বিছানার নিচে রাখা একটা টিনের সুটকেস টেনে বের করলো সালমা। রওশনের পুরনো চিঠিগুলো একে একে বের করে দেখলো সে।

জানো সালমা, কাল মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো আমার। বাইরে তখন অবিরাম বৃষ্টি ঝরছিলো। আর সেই বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে জানি না কখন মনটা হঠাৎ উন্মনা হয়ে পড়েছিলো। আর সেই মুহূর্তে আকাশ ছোঁয়া চার দেয়ালের বাঁধন ছাড়িয়ে বহুদূরে চলে গিয়েছিলাম আমি।

মনে হলো, আমার সেই গ্রামের বাড়িতে বুড়ো দাদীর কোলে মাথা রেখে রূপকথার গল্প শুনছি।

বাইরে এমনি বৃষ্টি ঝরছে। আর আমি দুচোখে অফুরন্ত কৌতূহল নিয়ে শুনছি, কেমন করে সেই কদাকার রাক্ষসটা ছলনা চাতুরী আর মুক্তির তাণ্ডব মেলিয়ে কুঁচবরণ কন্যার স্নেহমাখা আলিঙ্গন থেকে তার অতি আদরের রাজকুমারকে নিয়ে গিয়ে আটক রাখলো পাথরের নিচে।

তারপর আর চিঠিখানা পড়তে পারলো না সালমা। সেন্সরের নিখুঁত কালো কালির আড়ালে পরের অংশটুকু চাপা পড়ে গেছে।

ওটা রেখে দিয়ে আরেকখানা চিঠি খুললে সালমা।

আরেকখানা।

আরো একখানা।

তারপর দুয়ারে কে যেন বড়া নাড়লো।

টিনের সুটকেসটা বন্ধ করে রেখে এসে দরজাটা খুললো সালমা।

বড় চাচা এসেছেন।

সারা মুখে কাচা পাকা দাড়ি। পরনে পায়জামা আর শার্ট। হাতে একটা ছাতা। সালমা জানতে চাচা আজ আসবেন।

ছাতাটা একপাশে রেখে দিয়ে কোন রকম ভূমিকা না করেই চাচা বললেন, শোনো, আগামী দুতিন দিন রাস্তাঘাটে বেরিয়ো না। আমার শরীর খারাপ, গায়ে জ্বর নিয়ে এসেছি। জানি আমার কথার কোন দাম দিবে না তোমরা। আজকালকার ছেলেপিলে তোমরা বুড়োদের বোকা ভাবো। তবু না এসে থাকতে পারলাম না। শোনো, একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটবে এবার, এই আমি বলে রাখলাম।

আপনাকে এক কাপ চা করে দিই? ওর কথার মাঝখানে হঠাৎ একটা যতি টানার চেষ্টা করলে সালমা।

চাচা থেমে গিয়ে বললেন, ঘরে আদা আছে?

আছে।

তাহলে একটু আদা মিশিয়ে দিও।

আচ্ছা। খাটের নিচের স্টোভটা টেনে নিয়ে চা তৈরি করতে বসলো সালমা। মাঝে মাঝে রওশনকেও এমনি চা বানিয়ে খাওয়াতে সে।

একদিন নিজের হাতে স্টোভ ধরাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছিলো রওশন। সালমা পোড়া জায়গায় মলম লাগিয়ে দিতে শাসনের ভঙ্গীতে বলেছিলো, খবরদার, আর স্টোভের ধারে পাশেও আসতে পারবে না তুমি।

কি করবো বলো, কিছু করার জন্যে হাতজোড়া সব সময় নিসপিস করে।

মুহূর্তের জন্যে সালমার মনে হলো যেন হাতজোড়া আগের মত আছে রওশনের, বলিষ্ঠ একজোড়া হাত।

না, আর কোনদিনও সে আলিঙ্গন করতে পারবে না।

স্টোভের ওপর চায়ের কেতলিটা ধীরে ধীরে তুলে দিলো সালমা।

চাচা জিজ্ঞেস করলেন, রওশনের কোন চিঠি পেয়েছে?

সালমা আস্তে করে বললো, হ্যাঁ।

চাচা সে কথা শুনলেন কিনা বোঝা গেলো না। তিনি নিজের মনেই বলতে লাগলেন, কি হবে এসব করে। এতে করে বলি ছেড়ে দে বাবা, ওসব আমাদের ঘরের ছেলেদের পোষায় না। ও হচ্ছে বড়লোকদের কাজ যাদের কাড়ি কাড়ি টাকা আছে। সারা দুনিয়ার লোকে লুটেপুটে খাচ্ছে। ঘর করছে। বাড়ি করছে। জমিজম করছে। আর ওনারা শুধু জেল খেটেই চলেছেন। দেশ উদ্ধার করবে। বলি, দেশ কি তোমাদের জন্যে বসে রয়েছে। সবাই নিজের নিজেরটা সামলে নিচ্ছে। তোরা কেন বাবা মাঝখানে নিজের জীবনটা শেষ করছিস? না, এসব পাগলামো ছাড়া আর কিছু নয়। তুমি রওশনকে কড়া করে একখানা চিঠি লিখে দাও সে যেন বন্ড দিয়ে চলে আসে নিজের ঘর সংসার উচ্ছনে গেলো, দেশ নিয়ে মরছে। হ্যাঁ, তুমি ওকে চিঠি লিখে দাও ও যদি বন্ড সই করে না আসে তাহলে আমরা কোর্টে গিয়ে তালাকের দরখাস্ত করবো। হ্যাঁ, তোমার বাবা বেঁচে থাকলেও তাই করতেন। বড়চাচা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। গলাটা একেবারে নিচের পর্দায় নামিয়ে এনে বললেন, আমি তোমাদের ভালো চাই বলেই বলছি নইলে বলতাম না।

সালমার দেহটা বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। জ্বলন্ত স্টোভটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে। পাথরে মত নিশ্চল।

আজ নতুন নয় বহুদিন এ কথা বলেছেন চাচা।

রওশনও চিঠি লিখেছে।

আমার জন্যে তুমি নিজেকে শেষ করবে কেন সালমা। আমি কবে বেরুবো জানি না। কখন ছাড়া পাবো জানি না। তুমি আর কতদিন অপেক্ষা করে থাকবে।

পরিষ্কার করে কিছু লেখে নি সে। লিখতে সাহস হয় নি হয়তো। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে সালমা উঠে দাঁড়ালো। চায়ের পেয়ালাটা এগিয়ে দিলো বড় চাচার হাতে।

একটু পরে চা খাওয়া শেষ হলে আরো বার কয়েক সালমাকে সাবধান করে দিয়ে আর রওশনকে একখানা ঝাড়া চিঠি লেখার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন বড় চাচা। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তার সঙ্গে হেলান দিয়ে অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো সালমা। বড় ক্লান্তি লাগছে। তেইশ বছরের এই দেহটা তার যেন আজ মনে হলো অনেক বুড়িয়ে গেছে। হয়তো কিছু দিনের মধ্যে একেবারে ভেঙ্গে পড়বে। তখন অনেক অঞ ঝরিয়েও এ জীবনটাকে আর ফিরে পাবে না সে। ভাবতে গিয়ে সহসা কান্না পেলো সালমার। শাহেদের ডাকে চমক ভাঙলো। ভাত দে আপা, ক্ষিধে পেয়েছে। কি ভাবছিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে! দুলাভাইয়ের কথা?

সালমা শিউরে উঠলো। না, কিছু না। চলো ভাত খেতে যাবে। দরজার সামনে থেকে সরে গেলো সালমা।

ভাত খেয়ে উঠে শাহেদ বললো, ইয়ে হয়েছে আপা। আমি একটু বাইরে যাবো। ফিরতে দেরি হবে। তুই কিন্তু ঘুমোস নে।

আমার জেগে থাকতে বয়ে গেছে। সালমা রেগে গেলো। এখন বাইরে যেতে পারবে না তুমি।

কেন?

কেন মানে? এ রাত আটটায় বাইরে কি দরকার তোমার?

দরকার আছে।

কি দরকার?

বলতে পারবো না।

না বলতে পারলে যেতেও পারবে না।

বললাম তো দরকার আছে।

কি দরকার বলতে হবে।

সিনেমায় যাবো।

সিনেমায় যাবে তো রাত নটার শো কেন? দিনে যেতে পারে না? এখন পড়ো গিয়ে। দেখতে হলে কাল দিনে দেখো।

আজ শেষ শো, কাল চলে যাবে।

কি সিনেমা শুনি।

ন্যাকেড কুইন।

ন্যাকে্ড কুইন? সালমা অবাক হলো, ওটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে। তোমার মত বাচ্চা ছেলেদের জন্য নয়।

আমি বুঝি বাচ্চা? শাহেদ ক্ষেপে উঠলো। তোর চোখে তো আমি জীবনভর বাচ্চাই থেকে যাবো।

ছোট ভাইটিকে নিয়ে বড় বিপদ সালমার। একটুতে রাগ করে বসে। অন্যায় কিছু করতে গেলে বাধা দেবে সে উপায় নেই। মাঝে মাঝে বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে সালমা।

ওকে চুপ থাকতে দেখে শাহেদ আবার বললো, আমি চললাম, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যা। বলেই যাবার উদ্যোগ করলে সে।

পেছন থেকে সালমা ডাকলো, যেয়ো না শাহেদ। শোন, বাচ্চা ছেলেদের ঢুকতে দিবে না ওখানে।

ইস দেবে না বললেই হলো। কত ঢুকলাম।

সালমার মুখে যেন একরাশ কালি ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো শাহেদ।

এমনি স্বভাব ওর।

ডলি তার ঘরে বসেছিল।

বজলে হোসেন বায়রনের একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছিলো তাকে।

Let us have wine and the women
Mirth and laughter
Sermens and soda water the day
After……

সম্পর্কে বজলে হোসেন মামাতো ভাই হয় ওর। যেমন লেখে তেমনি ভালো আবৃত্তি করতে পারে বলে। তাই ওকে ভালো লাগে ডলির।

ও এলে বায়রন অথবা শেলীর একখানা কবিতার বই সামনে এগিয়ে দিয়ে ডলি বলে একটা কবিতা পড়ে শোনাবে হাসু ভাই? তোমার আবৃত্তি আমার খুব ভালো লাগে।

তাই নাকি? বজলে হোসেন হাসে আর মিটমিট করে তাকায় ওর দিকে। তারপর বইটা তুলে নিয়ে আবৃত্তি করে শোনায়–

Man being reronable, muts get
Drunk
The bast of life is but intoxiction.

শুনতে শুনতে এক সময় আবেশে চোখজোড়া জড়িয়ে এলো ডলির।

নিওনের আলোয় গদি আঁটা বিছানার উপর এলিয়ে পড়লো সে।

কবিতা পাঠ থামিয়ে মৃদু গলায় বজলে হোসেন ডাকলো, ডলি।

ডলি চোখজোড়া মেলে কি যেনো বলতে যাচ্ছিলো। মুনিমকে করিডোর দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে থেমে গেলে সে।

পরনে দুপুরের সেই পোষাক।

পা জোড়া তেমনি জুতোবিহীন।

মুনিমকে এখন এ পোষাকে আশা করেনি ডলি। তাই ঈষৎ অবাক হলো। কিন্তু বজলের সামনে ওকে কিছু বললে না সে। শুধু গম্ভীরকণ্ঠে অভ্যর্থনা জানালো, এসো।

বইটা বন্ধ করে রেখে বজলে বললো, মুনিম যে, কি ব্যাপার আন্দোলন ছেড়ে হঠাৎ জন্মদিনের আসরে?

কেন, যারা আন্দোলন করে তাদের কি জন্মদিনের আসরে আসতে নেই নাকি? পরক্ষণে জবাব দিলো মুনিম।

বজলে একগাল হেসে বললো, না, আসতে নেই তা ঠিক নয়। তবে একটু বেমানান ঠেকে আর কি।

উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো মুনিম।

ডলি বিরক্তির সঙ্গে বললো, তোমরা কি শুরু করলে? বাজে কথা নিয়ে তর্ক করার আর সময় পেলে না। তারপর হাত ঘড়িটার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিলো সে। চলো, ওঘরে সবাই অপেক্ষা করছে।

সোফা ছেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো বজলে। কাপড়ের ওপরে কোত্থেকে একটা পোকা এসে বসেছিলো। হাতের টোকায় সেটাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো, চলো। বলে আর ওদের জন্যে অপেক্ষা না করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে।

বজলে চলে যাবার পরেও কেউ কিছুক্ষণ কথা বললে না ওরা। মুনিমের নগ্ন পা জোড়ার দিকে বারবার ফিরে তাকাচ্ছে ডলি।

অপ্রতিভ হয়ে মুনিম বললো, অমন করে কি দেখছে?

ডলি ঘর নাড়লো। কিছু না। তারপর মুখখানা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বললো, আমায় এমন করে অপমান করতে চাও কেন শুনি?

মুনিম কথাটা বুঝতে না পেরে অবাক হলো। তার মানে?

তিক্ত হেসে ডলি বললো, জন্মদিনের উৎসবে খালি পায়ে না এলেও পারতে।

ও। মুহূর্তে নিজের নগ্ন পা জোড়ার দিকে তাকালো মুনিম। আস্তে করে বললো, জানো তো আমরা তিনদিন খালি পায়ে হাঁটাচলা করছি।

এখানে জুতো পায়ে দিয়ে আসলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না।

পাগল। মুনিম এবার না হেসে পারলো না।

ডলি দাঁতে ঠোঁট চেপে কি যেন চিন্তা করলো। দাঁড়াও, বাবার স্যাণ্ডেল এনে দিই। তোমায়। সহসা যেন একটা সমাধান খুঁজে পেলে ডলি। ভয় নেই, এখানে তোমার বন্ধুরা কেউ দেখতে আসবে না।

হাত ধরে ডলিকে থামালো মুনিম। কি পাগলাম করছে, শোন।

কি! ডলির মুখখানা কঠিন হয়ে এলো।

মুনিম বললো, আমায় তুমি ইমমোরাল হতে বলছে?

ঈষৎ হেসে চমকে ওর দিকে তাকালো ডলি। তারপর হতাশ আর বিরক্তির চাপে ফেটে পড়ে বললো, তোমার যা ইচ্ছা তাই করো গে তুমি। বার কয়েক লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো সে। ঠিক আছে তুমি এ ঘরেই বসে। ও ঘরে যেও না। আমি আসছি। বলে চলে যাচ্ছিলো ডলি।

পেছন থেকে মুনিম সহসা বললো, আমাকে ওঘরে নিয়ে যেতে তোমার লজ্জা হচ্ছে বুঝি?

ডলি থমকে দাঁড়ালো খুব ধীরে ধীরে ফিরে তাকালো ডলি। ওর চোখের মণিজোড়া জ্বলছে। ঠোঁটের প্রান্তটুকু ঈষৎ কাঁপছে। মৃদু গলায় সে বললো, হ্যাঁ। গলায় একটু জড়তা নেই। কথাটা বলে পলকের জন্যেও সেখানে অপেক্ষা করলো না ডলি, চলে গেলো।

আবার যখন ফিরে এলো তখন মুখখানা গম্ভীর। হাতে এক প্লেট মিষ্টি।

টেবিলের ওপরে ছড়ানো বইগুলো সরিয়ে নিয়ে প্লেটটা সেখানে রাখলে সে। মুদু গলায় বললো, নাও খাও।

তুমি খাবে না?

না।

কেন?

আমি পরে খাবো। গলার বরে কোন উত্তাপ নেই।

প্লেট থেকে একটি মিষ্টি তুলে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল মুনিম।

নাও, তুমি আগে খাও নইলে কিন্তু আমি একটাও খাবো না বলে দিলাম। ডলি এবার আর না করলো না।

মুনিম আস্তে করে বললো, আমার ওপরে মিছামিছি রাগ করো না ডলি।

একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো, আমার কোন দোষ নেই।

ডলি মৃদু হাসলো, আমি কি তোমার কাছে কোন কৈফিয়ত চেয়েছি।

উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো মুনিম, টেবিল ঘড়িটার দিকে চোখ পড়তে সে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লো, ইতস্তত করে বললো, সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। এক্ষুণি যেতে হবে আমার ডলি। ছটার সময় আমার একটা মিটিং আছে।

মিটিং? ডলির মুখখানা ম্লান হয়ে এলো। আমার জন্মদিনেও তোমাকে মিটিং-এ যেতে হবে। আমি তোমাকে নিয়ে সিনেমায় যাবো বলে এ্যাডভান্স টিকিট কেটেছিলাম।

না ডলি, তা হয় না। মুনিমের কণ্ঠে অনুনয়ের সুর। আমাকে মিটিং-এ যেতে হবে, না গেলে চলবে না। ডলি ভু বাঁকিয়ে সরে গেলো জানালার পাশে, তারপর চুপচাপ কি যেন ভাবলো অনেকক্ষণ ধরে।

মুনিম পেছন থেকে ডাকলো, ডলি।

ডলি ফিরে তাকিয়ে বললো, তুমি মিনিট কয়েকের জন্যেও কি বসতে পারবে না।

তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরি আলাপ ছিলো।

বলো। মুনিম বসলো।

ডলি কোন রকম ভূমিকা করলো না। ওর মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, তুমি কি সত্যি আমাকে ভালবাস?

মুনিম অবাক হলো। সে ভেবে পেল না কেন আজ হঠাৎ এ প্রশ্ন করছে ডলি। কেন, সন্দেহ আছে নাকি?

আছে।

কারণ?

আমার প্রতি তোমার উদাসীনতা। কি মনে করছো তুমি আমায়। আমি কি তোমার ভালবাসার কাঙাল? না তোমার ভালবাসা না পেলে আমি মরে যাবো? সব সময় তুমি সভাসমিতি আর আন্দোলন নিয়ে থাকবে আর আমার্কে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবে, কি মনে করেছো তুমি? আমি বাচ্চা খুঁকি নই। সব বুঝি, এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে রীতিমত হাঁপাতে লাগলো ডলি।

কি বলবে, কি করবে বুঝে উঠতে জারলো না মুনিম। হতবিহ্বলভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সে। ইতস্তত করে বললো,তোমার এসব প্রশ্নের জবাব দেবার মতো সময় এখন আমার হাতে নেই।

ডলি তীব্র গলায় বললো, যাতো, আর এসো না।

যেতে যেতে হোঁচট খেয়ে ফিরে তাকালো মুনিম। তারপর বললো, আচ্ছা! বলে বেরিয়ে গেলো সে।

মুনিম চলে গেলে খানিকক্ষণ পাথরে গড়া পুতুলের মুর্তির মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো ডলি।

দেহটা উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করলে পর একখানা সোফার উপর বসে পড়লো সে।

পাশের ঘরে ডলিকে খোঁজ করে না পেয়ে এ ঘরে এলো বজলে হোসন।

দেখা পেয়ে ঈষৎ ক্লান্তির ভাব করে বললো, কি ব্যাপার, তোমাকে খুঁজে খুঁজে আমি হয়রান। এখানে একা বসে করছে কি তুমি?

কিছু না। এমনি বসে আছি। ডলি সোফার ওপরে মাথাটা এলিয়ে দিলো। তোমার শরীর খারাপ করছে নাকি?

না।

মুনিম কি চলে গেছে।

হ্যাঁ।

ওকি, তোমার মাথা ধরেছে নাকি। অমন করছে কেন?

কি করছি। ওর উদ্বেগ দেখে ফিক করে হেসে দিলো ডলি।

তারপর কি মনে হতে আজ এক নতুন দৃষ্টি নিয়ে বজলেকে অনেকক্ষণ চেয়ে দেখলো ডলি। তারপর অকস্মাৎ প্রশ্ন করলো, আহা হামু বাই, রোজ তুমি কেন এখানে আস বলতো?

বজলে ইতস্তত করে বললো, যদি বলি তোমাকে দেখতে।

ওর কথায় হঠাৎ যেন শিউরে উঠলো ডলি। মনে মনে খুশি হলো সে। প্রসন্ন হলো।

কিন্তু সে ভাবটা গোপন রেখে আবার জিজ্ঞেস করলো, কেন দেখতে আসো? দেখবার মতো কি আছে আমার?

তোমার রূপ! তোমার সৌন্দর্য। নরোম গলায় জবাব দিলো বজলে।

ডলি চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে। এক ঝলক সূক্ষ্ম হাসি ঢেউ খেলে গেলো ঠোঁটের এক কোণ ঘেঁষে। সাদা গাল রক্তাভ হলো। ক্ষণকাল চুপ করে থেকে সহসা সে বললো, আমার কাছে একখানা বাড়তি টিকিট আছে, সিনেমায় যাবে?

অফকোর্স। বজলের মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।

ডলি ওর দিকে একখানা হাত বাড়িয়ে বললো, চলো।

পথে ডলি রিকসা নিতে চাইলো।

বজলে বললো, না জন্মদিনে রিকসা নয় ট্যাকসিতে যাব।

ডলি না করতে পারলো না। মৃদুস্বরে বললো, তাই ডাকো।

সিনেমা হলে এসে মাহমুদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো ওদের। শাহানাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে মাহমুদ। কাঁধের উপরে ঈষৎ চাপ দিয়ে বজলে চাপা গলায় শুধালো, শাহানা বুঝি আজকাল তোমার কাছে আছে?

হ্যাঁ। মাহমুদ মৃদু হাসলো। জান তো, ওর স্বামী ওকে ডিভোর্স করেছে। এখন আমার কাছে থাকে।

শাহানার পরনে একটা কমলা রঙের শাড়ি। গায়ে কারু আঁকা ব্লাউজ। পায়ে একজোড়া হাইহিল জুতো। ডলির সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল বজলে। কাঁধটা একদিকে ঈষৎ কাৎ করে পিটপিট চোখে ডলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ধূর্তের মতো হাসলো মাহমুদ। তারপর বজলেকে একপাশে ডেকে এনে বললো, মেয়েটা দেখতে বেশ তো।

জোটালে কোত্থেকে।

বজলে বিস্মিত হলো। তোমাকে ওর কথা আগে একদিন বলেছিলাম, বলিনি?

কই মনে পড়ছে নাতো?

হ্যাঁ বলেছিলাম। তুমি ভুলে গেছে। ও আমার মামাতো বোন।

ওর কাঁধজোড়া ঝাঁকালো মাহমুদ। তারপর অদূরে দাঁড়ানো ডলির দিকে বারকয়েক ফিরে ফিরে তাকালো সে।

বজলে ওর দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলো।

মাহমুদ বললো, চলো এককাপ করে কফি খাওয়া যাক। শো শুরু হবার এখনো বেশ দেরি আছে।

বজলে বললো, চলো।

Leave a Reply