» » একুশ থেকে ত্রিশ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

দূরবীন

একুশ

রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীন ল পাস করে ওকালতি শুরু করেছে সবে। শোনা যাচ্ছে কাছারিতে সে আরগুমেন্ট ভালই করে। হেমকান্তর পুরোনো উকিল গগন তালুকদার বড়ই বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কোর্ট কাছারি বড় একটা যান না। নতুন একজন উকিল নিয়োগের কথা বহুদিন ধরেই ভাবছেন হেমকান্ত। কিন্তু অলস লোকের যা স্বভাব। ভাবেন তো কাজে আর হয়ে ওঠে না। কাকে রাখবেন সেটাও ভেবে দেখা দরকার।

শচীনের কথা তাঁকে বলল রঙ্গময়ী, এসব খবর রঙ্গময়ীর খুব ভাল রাখার কথা নয়। কিন্তু একদিন সে সকালে এসে সোজা বলল, গগন বাবুর তো নখদন্ত বলে আর কিছু নেই। কথা বলতে গেলে নালে-ঝোলে একাকার হয়। এই বুড়োকে দিয়ে তোমার মামলা টামলা চলবে?

হেমকান্ত অবাক হয়ে বলে মামলা কিসের?

মামলা লাগতে কতক্ষণ? রামকান্ত দারোগা যে তোমাকে কী একটা লিখে দিতে বলেছিল, লিখেছো?

না, হয়ে ওঠেনি।

তোমার তো আজকাল কিছুই হয়ে উঠছে না। শুধু ছেলে নিয়ে নৌকো চালালেই হবে? ওটাও তো গোল্লায় যাচ্ছে। বইপত্র ছোঁয় না।

হেমকান্ত মৃদু হেসে বলেন, অন্য প্রসঙ্গে যাওয়ার দরকার কী? উকিলের কথাটা হঠাৎ তুললে কেন?

রামকান্ত দারোগা রোজ লোক পাঠাচ্ছে তোমাকে কী সব লিখে দেওয়ার জন্য।

কেন?

বাঃ, পুলিস এখন শশিভূষণের নামে মামলা আনবে না? তুমি তাদের সাক্ষী যে!

ওঃ, এই কথা! কিন্তু স্টেটমেন্ট লেখাও ঝকমারি, কাকে উকিল রাখা যায় বলো তোঁ!

আমি তো শচীনের কথা বলি, অল্প বয়স, বুদ্ধি-সুদ্ধি খুব।

শচীনকে ভালই চেনেন হেমকান্ত, রাজেনবাবুর বাড়ির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও অনেক দিনের। রাজেনবাবু ঢাকার লোক। ময়মনসিংহে আসেন ফৌজদারি মামলার ছড়াছড়ি দেখে। খুবই সামান্য আয়ে আইনের ব্যবসা শুরু করেন। মুক্তাগাছার এক জমিদার নলিনীরঞ্জন। তাঁর ছেলেকে পড়াতেন। সেই সূত্রে শহরে একটু বসতের জমি পান। আস্তে আস্তে অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছেন এখন। দুর্গাবাড়িতে একখানা বাড়ি করেছেন। সেখানে দুর্গোৎসব পর্যন্ত হয়। শচীন তাঁর ছোটো ছেলে। বেশ সুপুরুষ, লম্বা ছিপছিপে চেহারা, গানটানও গায়।

শচীনের নিয়োগে আপত্তির কিছু নেই। হেমকান্ত বললেন, তাহলে ওকে একটু ডেকে পাঠাও।

রঙ্গময়ী একটু কুটিল চোখে হেমকান্তর দিকে চেয়ে ছিল। তারপর বলল, একটু বুঝেসুঝে কথাবার্তা বোলো, আর ছেলেটিকে ভাল করে লক্ষও কোরো।

হেমকান্ত অবাক হয়ে বলেন, শচীনকে আর লক্ষ করার কী আছে? ছোটো থেকে দেখছি।

তোমার মতো ক্যাবলা দুটি নেই। শচীন শুধু উকিলই নয়, একজন সৎ পাত্রও বটে। তোমাদের পাল্টি ঘর।

হেমকান্ত থতমত খেয়ে বলেন, ও বাবা, তুমি অনেকদূর ভেবে ফেলেছে দেখছি।

ভাবতেই হয়। মেয়ে বড় হচ্ছে, কিন্তু বাপের কোনো দুশ্চিন্তা নেই, কাজেই পাড়া পড়শীকেই ভাবতে হয়।

হেমকান্ত খুব হাসলেন, তারপর বললেন, আচ্ছা দেখা যাবে।

আর একটা কথা।

বলো।

শশীর হয়ে মামলা লড়ার কেউ নেই।

বরিশালে ওর বাবা আছে।

তা আছে। কিন্তু ভদ্রলোক খুব গা করছেন না বলে শুনেছি।

কেন, গা করছে না কেন?

বাপ হচ্ছে সেই সৎ মায়ের পোষা ভেড়ার মতো। শশীকে নাকি ত্যাজ্য পুত্রও করেছে। আমার মনে হয় না, শশীর বাপ উকিল-টুকিল লাগাবে।

হেমকান্ত গম্ভীর হয়ে বলেন, লোকটাকে তো চাবকাতে হয়।

সে যখন হাতের কাছে পাবে তখন চাবকিও। কিন্তু এখন তো অবস্থাটা সামাল দেওয়া দরকার।

আমার কী করার আছে?

শচীনকে একটু বোললা।

শচীন!

ছেলেটা ভাল। বুদ্ধি রাখে। পয়সার পিশাচও নয়। তুমি বললে হয়তো শশীর পক্ষে দাঁড়িয়ে। লড়াই করবে। তোমাকে কোনো বিপদের ঝুঁকি নিতে হবে না। ভয় পেও না।

হেমকান্ত রঙ্গময়ীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মুখের হাসি ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে একটা কঠোরতা ফুটল। ধীর স্বরে বললেন, মনু, তোমরা আমাকে সবাই একটু ভুল বুঝলে।

রঙ্গময়ী বুঝি একটু লজ্জা পেল। বলল, আমাদের মেয়েমানুষে বুদ্ধি, ওগো রাগ কোরো না। তুমি গম্ভীর হলে আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়।

হেমকান্ত খুব ম্লান একটু হেসে বললেন, থাক, আর মন রাখা কথা বলতে হবে না মনু। শচীনকে খবর পাঠাও। যা বলবার আমিই বলব।

বিকেলে কাছারির কাজ শেষ করে শচীন এল। রুচিবান ছেলে। বাড়ি গিয়ে উকিলের পোশাক ছেড়ে ধুতি পানজাবি শাল চাপিয়ে এসেছে। ভারী সুন্দর চেহারাটি। কমনীয় মুখশ্রীতে বুদ্ধির দীপ্তি ঝলমল করছে। হেমকান্তকে প্রণাম করে সামনে বসল।

রঙ্গময়ীর পরামর্শমতো ছেলেটিকে ভাল করেই লক্ষ করলেন হেমকান্ত। চমৎকার ছেলে, সন্দেহ নেই। এই ছেলে এ বাজারে এখনো পড়ে আছে সেটাই বিস্ময়ের।

হেমকান্ত বললেন, ঘটনাটা কি শুনেছো? শশিভূষণ নামে একটি ছেলে যে আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল!

আজ্ঞে হ্যাঁ।

সেটা নিয়েই গোলমাল। দারোগা রামকান্তবাবু আমার একটা বিবৃতি চাইছেন। সেটা কি দেওয়া উচিত বলে মনে করো?

শচীন বলল, স্টেটমেন্ট এখনই দেওয়ার দরকার নেই। মামলা উঠুক, তখন দিলেও চলবে।

দারোগা আমার কাছে কিরকম স্টেটমেন্ট চাইছে তা আন্দাজ করতে পারো?

শচীন মৃদু একটু হেসে বলল, তা বোধহয় পারি। উনি সম্ভবত আপনার কাছ থেকে একটা মুচলেকা আদায় করতে চাইছেন।

উদ্দেশ্যটা কী?

উদ্দেশ্য, শশিভূষণকে ফাঁসানো, তার বিনিময়ে আপনি আপনার নিরাপত্তা কিনে নিতে পারবেন।

হেমকান্ত গম্ভীর হয়ে বলেন, আর যদি সেরকম মুচলেকা না দিই?

তাহলে পুলিস আপনাকেও ফাঁসানোর চেষ্টা করবে।

মামলাটা তুমি নেবে?

শচীন বিনীতভাবে ঘাডহেঁট করে বলে, নিতে পারি।

আমাদের পুরোনো উকিল গগনবাবু বুড়ো হয়েছেন। আমি সেই জায়গাতেও তোমাকে অ্যাপয়েন্ট করতে চাই।

যে আজ্ঞে।

তাহলে কাল থেকেই গগনবাবুর সঙ্গে বসে সব কাগজপত্র বুঝে নাও।

যে আজ্ঞে।

আমার এসটেটের অবস্থা বিশেষ ভাল নয়। খাজনা আসে খুব সামান্য আদায় উসুল করার লোক নেই। প্রজাদের হাতে নাকি নগদ টাকারও খুব অভাব।

শচীন দু স্বরে বলে, একটা ডিপ্রেশন চলছে ঠিকই।

ছেলেরা চায় জমিদারী বেচে দিই, তুমিও কি তাই বলো?

শচীন একটু ভেবে নিয়ে বলল, দেখাশোনার লোক না থাকলে অবশ্য জমিদারীটা একটা লায়াবিলিটি হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু এখনই বেচার কথা ভাবছেন কেন? আমি আগে কাগজপত্র দেখি।

তুমি তো দেখবে আইনের দিকটা, হিসেবপত্র দেখবে কে? আমি নতুন করে গোটা এসটেটের। একটা অ্যাসেসমেন্ট করতে চাই।

শচীন বলে, সেটাও খুব শক্ত হবে না। দলিল-টলিলগুলো আমাকে দেবেন। দেখে দেবো। আপনার ম্যানেজার মশাইয়ের সঙ্গেও একটু বসা দরকার।

বেশ, সে ব্যবস্থাও হবে। তাহলে আমি নিশ্চিন্ত?

আগে সব দেখি।

শশিভূষণের বিরুদ্ধে পুলিস মামলা সাজিয়েছে বলে কিছু জানো?

শচীন মাথা নেড়ে বলে, এখনো দেয়নি। তবে হাসপাতাল থেকে আজই তাকে হাজতে নেওয়া হয়েছে।

হেমকান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তাহলে ছেলেটা ফাঁসিতে মরার জন্যই বেঁচে উঠল!

ফাঁসি যে হবেই তা বলা যায় না।

শশীকে তুমি বাঁচাতে পারবে?

শচীন চিন্তিত মুখে বলে, পুলিসের কাছে সে কী বলেছে তা তো জানি না। পুলিসই বাকী পয়েন্ট দিয়েছে তাও দেখা দরকার। আপনি বললে আমি শশীর সঙ্গে দেখা করতে পারি।

করো।

কিন্তু একটা কথা আছে।

কী কথা?

আমি একা গেলে সে হয়তো আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারবে না।

আমি যদি তোমার সঙ্গে যাই?

শচীন একটু দ্বিধা করল। কী যেন বলি বলি করেও সামলে নিয়ে বলল, তার হয়তো দরকার হবে না। শশীকে আমি কনভিনস করতে পারবো।

আমি যাবো না বলছ?

দরকার হলে বলবখন। তখন যাবেন।

হেমকান্ত উদাস হয়ে গেলেন। বললেন, ছেলেটাকে আমার একটু দেখতেও ইচ্ছে করছে। আমার বাড়িতে কয়েকদিন ছিল, কিন্তু অসুস্থ অবস্থায়। ভাল করে কথাও হয়নি। না, চলো, কাল আমিও তোমার সঙ্গে যাবো।

শচীনের মুখে আবার সেই দ্বিধার ভাবটা দেখা গেল। মৃদুস্বরে বলল, আপনার এখন না যাওয়াই বোধহয় ভাল।।

কেন বলো তো?

শচীন মৃদু একটু হেসে বলল, শহরে একটা গুজব রটেছে। লোকের ধারণা এ বাড়ি থেকে শশীকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

হেমকান্ত চমকে উঠে বলেন, সে কী? কে রটাল?

গুজব রটানোই তো কিছু লোকের কাজ। আমার মনে হয় শশীরও সেরকমই ধারণা।

কেন, শশীর এরকম ধারণা হওয়ার কারণ কি?

কোনো কারণ নেই। তবে শহরের গুজবটা তার কানে পৌঁছানোই সম্ভব।

হেমকান্তকে ভারী ক্লান্ত দেখাল। বললেন, লোকে একথা বিশ্বাস করে?

হয়তো সবাই করে না।

তুমি করো?

না। আপনাকে আমি শিশু বয়স থেকে দেখে আসছি। এই পরিবারের কোনো লোক কখনো ছোটো কাজ করেনি।

হেমকান্ত একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, না, আমরা ছোটো কাজ সহজে করি না। শশীকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

আমি জানি। বরিশাল মারডার কেস নিয়ে খুব তোলপাড় হচ্ছে। শশীর পক্ষে দলছুট হয়ে লুকিয়ে থাকা এমনিতেই সম্ভব ছিল না।।

তুমি অনেক জানো দেখছি।

কিছু খবর রাখি। ওকে যারা প্রোটেকশন দিতে পারত তাদের সঙ্গে ও যোগাযোগ করতে পারেনি। তাছাড়া আর একটা নির্দেশ ছিল ওর ওপর। সেটাও ও মানেনি।

কী সেটা?

কথা ছিল, মারডারের পর সুইসাইড করবে।

হেমকান্ত শিউরে ওঠেন, তাই নাকি?

হ্যাঁ

তুমি কী করে জানলে?

মনুদিদির কাছে ও নিজেই বলেছে।

কই, মনু তো আমাকে বলেনি।

আপনাকে খামোখা বিরক্ত করতে চান নি।

তোমাকে কবে বলল?

পরশু মনুদিদি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখনই বলেন।

শশী সুইসাইড করল না কেন?

সেটা বোঝা মুশকিল। হয়তো শেষ সময়ে দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। পিস্তলের গুলিও ফুরিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। বাচ্চা ছেলে তো।

হেমকান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু আমার সম্পর্কে ওর ভুল ধারণাটা যে ভাঙা দরকার। কী করব বলতে পারো?

এখন কিছু করার দরকার নেই। আগে আমি ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি।

মনু কি ছেলেটার সঙ্গে দেখা করেছে?

না, উনি চেষ্টা করেছিলেন। পুলিস দেখা করতে দেয়নি।

ঠিক আছে। আগে তুমিই দেখা করো।

যে আজ্ঞে।

মামলা কবে নাগাদ উঠবে?

তা বলতে পারি না। তাছাড়া মামলা তো এখানে হবে না। শশীকে বরিশালে চালান দেওয়া হবে। মামলা উঠবে সেখানে।

এখানে হয় না।

সেটা নরমাল প্রসিডিওর নয়।

তুমি কি বরিশালে গিয়ে মামলা লড়তে পারবে?

তা পারা যাবে না কেন? ও নিয়ে আপনি ভাববেন না।

আচ্ছা, তোমার ওপর অনেক দায় দায়িত্ব চাপিয়ে দিলাম।

তাতে কি?

পারবে তো সব সামলাতে?

চেষ্টা করব।

শচীন চলে যাওয়ার পর হেমকান্ত অনেকক্ষণ শচীনের কথাই ভাবলেন। ছেলেটি অতি চমৎকার। এই ছেলেটিকে যদি জামাই করেন তবে সব দিক দিয়েই তাঁর ভাল হয়। বিষয় আশয় এবং মামলা মোকদ্দমা নিয়ে ভাববার মতো একজন লোক পেলে জীবনটা তিনি নিশ্চিন্তে কাটাতে পারেন।

হেমকান্তর ঘরের বাইরেই ওত পেতে ছিল কৃষ্ণকান্ত। শচীন বেরিয়ে আসতেই ধরল, শচীনদা, কী কথা হল?

শচীন একটু হেসে বলে, তা দিয়ে তোর কী দরকার?

আমার দরকার আছে। তুমি শশীদাকে বাঁচাবে?

আমি বাঁচাতে যাবো কোন দুঃখে?

বাবা তোমাকে শশীদার উকিল ঠিক করেনি?

করলেই বা। উকিল কি ভগবান?

সি আর দাশ কিরকম আরগুমেন্ট করেছিল জানো?

খুব পেকেছিস দেখছি।

শচীন নীচে এসে বারবাড়িতে রাখা তার সাইকেলটা টেনে নিয়ে বলে, শশীকে নিয়ে তোকে অত ভাবতে হবে না। লেখাপড়া কর।

করছি। আমি উকিল হবো।

তাই নাকি?

উকিল হয়ে শুধু স্বদেশীদের হয়ে মামলা লড়ব।

বলিস কি? শুধু স্বদেশীদের মামলা লড়লে যে পেট চলবে না।

আমি তোমার সাইকেলের রডে একটু উঠি শচীনদা?

ওঠ। কিন্তু তোর মতলবখানা কী?

চললাই না, বলছি।

শচীন সাইকেলের রড়ে কৃষ্ণকান্তকে নিয়ে বড় রাস্তায় উঠে এল। রাস্তা মোেটই ভাল নয়। ইটের রাস্তায় গর্ত, উচু নীচু।

সাইকেল চালাতে চালাতে শচীন বলল, এবার বল।

ছোড়দিকে তোমার পছন্দ হয়?

শচীন একটু থতমত খেয়ে হেসে ওঠে। বলে, আমার পছন্দ হলে তোর কী লাভ?

তোমার সঙ্গে ছোড়দির বিয়ের কথা চলছে, জানো?

শচীন একটু গম্ভীর হয়ে বলে, না তো! তোকে কে বলল?

মনুপিসি। বলেনি ঠিক। বাবাকে বলছিল, আমি শুনেছি।

তাই নাকি?

তুমি ছোড়দিকে বিয়ে করবে?

দূর ফাজিল!

ছোড়দি সুন্দর না?

কে জানে!

লোকে বলে, ছোড়দি নাকি খুব সুন্দর।

তা হবে।

কিন্তু ছোড়দির একটা দোষের কথা তোমাকে বলে দিই। রেগে গেলে কিন্তু ছোড়দির নাকের ডগা নড়ে।

শচীন এত জোরে হেসে ফেলল যে, সাইকেল বেসামাল হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ফের সামলে নিয়ে সে বলল, আর কী দোষ আছে রে তোর ছোড়দির?

ভীষণ হিংসুটে। খুব মিথ্যে কথা বলে।

তাই নাকি? তাহলে ওকে তো বিয়ে করা উচিত নয়।

না, না। করো। ছোড়দি এমনিতে ভালই। তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে ছোড়দি তো কাছাকাছিই থাকবে, তাই না?

ও, সেইজন্যই আমাকে বিয়ে করতে বলছিস?

শচীন আবার হাসতে থাকে।

রঙ্গময়ী বিশাখার চুল বেঁধে দিল সেদিন বিকেলে। তারপর বলল, বাপ তো বোম ভোলানাথ, মেয়ের বয়সের দিকে লক্ষ্যই নেই। কিন্তু এই বয়সে কি ঘরে রাখা যায়!

কথাটা শুনল বিশাখা। কোনো মন্তব্য করল না।

রঙ্গময়ী হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, রাজেন মোক্তারের ছেলে শচীনকে তো দেখেছিস!

বিশাখা একটু বিস্ময়ভরে চেয়ে বলে, দেখব না কেন? সুফলার দাদা তো!

তার কথাই বলছি।

তার কথা কেন?

তোর বাবার খুব ইচ্ছে, ওর সঙ্গে তোর সম্বন্ধ করে।

ওর সঙ্গে? বলে বিশাখা যেন আকাশ থেকে পড়ে।

কেন, ছেলেটা খারাপ নাকি? কী চমৎকার রাজপুত্রের মতো চেহারা!

বিশাখা একটা ঝামটা মেরে বলে,হলেই বা! মোক্তারের ছেলেকে বিয়ে করতে যাবো কেন? আর পাত্র জুটল না?

রঙ্গময়ী বলে, মোক্তারের ছেলে তো কী! ও নিজে তো উকিল।

ওরকম উকিল গণ্ডায় গণ্ডায় আছে।

তোর পছন্দ নয়?

দূর! বলে প্রস্তাবটা একদম উড়িয়ে দিল বিশাখা।

রঙ্গময়ী স্তব্ধ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, এমন পাত্র তোর পছন্দ নয়! সত্যিই পছন্দ নয়?

বিশাখা বিরক্ত হয়ে বলে, আমি কি তোমাদের পথের কাঁটা পিসি যে, ধরে বেঁধে জলে ফেলে দিতে চাও!

জলে ফেলে দেওয়া কি একে বলে?

তা ছাড়া আর কী? আমার কোনো দিদির কি এরকম ঘরে বিয়ে হয়েছে?

রাজেন মোক্তারও তো গরীব নয়।

একসময়ে তো ছিল। ওদের বাড়ি থেকে মার কাছে প্রায়ই লোক আসত চাল, টাকা, পুরোনো কাপড় চাইতে।

সে তো কবেকার কথা!

তা হোক। ওদের সংসারে বউ হয়ে আমি যেতে পারব না। বরং তোমাদের অসুবিধে হলে বোলো, পুকুরে ডুবে মরব।

আমাদের অসুবিধে আবার কী? বারবার ওকথা বলছিস কেন?

হচ্ছে বলেই বলছি।

কিসের অসুবিধে? কার অসুবিধে?

অত জানি না। মনে হল, তোমাদের দুজনের একটু অসুবিধে হচ্ছে আমি থাকাতে।

বঙ্গময়ী নিঃশব্দে পালিয়ে গেল।