» » ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

অভিজ্ঞান

জীবনে এই প্রথম সময়ের অনিবার্যতা সম্পর্কে ধারণা হল অভির। উনিশ কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত আপন মনে ভেসে বেড়িয়েছে। কোনও দায়িত্ব নেয়নি, কারো খিদমত খাটেনি, কখনও টেনশানে ভোগেনি। কুয়োর ব্যাঙের মতো স্বাধীন ও আনন্দময় জীবন ছিল। ডাক্তারি পড়তে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে সব বদলে গেল।

মফসসলের ছেলে কলকাতা শহরে পড়তে এসে দিব্যি গড্ডলিকা স্রোতে গা ভাসিয়ে চলছিল। একটু পড়া-পড়া খেলা, একটু প্রেম-প্রেম নাটক, একটু রাজনীতি-রাজনীতি ছ্যাবলামি—সব মিলিয়ে তোফা কাটছিল দিনগুলো। ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না!’

কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। কেন না, ওই যে, সময়ের অনিবার্যতা! একটা একটা করে পার্ট আর আইটেম চলে যেতে থাকে, অভি নিয়মিত এনজির কাছে ঝাড় খেতে থাকে। ফার্স্ট সেমিস্টার পার হয়ে যায়। ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রিতে টায়েটুয়ে পাস মার্ক থাকলেও অ্যানাটমিতে ঝাড় নামিয়ে দেন এনজি। সেমিস্টারে ঝাড় খাওয়ার কোনও প্রভাব পড়ে না কলেজ লাইফে। কেউ মনেও রাখে না, কিন্তু অভির মাথায় টিকটিক করতে থাকে দুশ্চিন্তার কাঁটা। সেকেন্ড সেমিস্টারেও এইরকম হবে না তো?

এবং সেকেন্ড সেমিস্টার বা প্রি-টেস্ট চলে আসে। রেজাল্টের পুনরাবৃত্তি হয়। অভি জোর করে অ্যানাটমি বই নিয়ে বসে। চৌরাসিয়া আর ডক্টর মিত্রর বই বারবার পড়তে থাকে।

অধ্যয়নই সার। মাথা থেকে সব বেরিয়ে যায়? কেন? নিজেকে হাজার প্রশ্ন করেও উত্তর পায় না। সে সিনেমা যায় না, রাজনীতি করে না, বৃন্দাকে মন থেকে মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তাও কেন এমন হয়?

উত্তরটা একদিন বিলু দিল। ভাইয়ের পাগল-পাগল অবস্থা দেখে বলল, ‘বাড়িতে থেকে অ্যানাটমি পড়া যায় না। হোস্টেলে যা। গ্রুপ-স্টাডি কর। বারবার চেঁচিয়ে না পড়লে ওইসব শক্ত শক্ত নাম স্মৃতিতে থাকে না। ঘুমের মধ্যেও তুই নিজের নাম, আমার নাম বা বাবার নাম ভুলিস না। একে বলে পার্মানেন্ট মেমারি। অ্যানাটমিকে পার্মানেন্ট মেমরির সিন্দুকে ঢোকানোর একমাত্র উপায় ক্রমাগত আওড়ানো। লিখে বা এঁকে এ জিনিস হবে না।’

দাদার কথা মেনে ফার্স্ট এমবিবিএস থিয়োরি পরীক্ষার পনেরো দিন আগে অভি বয়েজ হোস্টেলে শিফট করেছে। বিলু তাকে নিজের রুমে ঢোকায়নি। তার স্থান হয়েছে একশো চব্বিশে, টিনটিনের রুমমেট হিসেবে। হোস্টেলে এসে সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। নতুন জায়গায় অ্যাডজাস্ট করতে সময় লাগে। অভিরও লেগেছে। অ্যাডজাস্টমেন্ট সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরীক্ষার টেনসান। তাছাড়া গ্রুপ স্টাডি করার জন্য গ্রুপ লাগে। হোস্টেলে অলরেডি দুই, তিন বা চারজন ছেলে মিলে গ্রুপ বানিয়ে রেখেছে। এই ক্রুশিয়াল সময়ে তাকে কেউ এন্ট্রি দেয়নি। সবাই পরিষ্কার বলেছে, পরীক্ষার পনেরো দিন আগে একটা চালু সিস্টেমকে তারা ঘাঁটতে পারবে না। ফার্স্ট এমবিবিএস-এর পরে এই নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

হোস্টেলে এসে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় অভি ভেবেছিল বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু দোনামোনা করে যায়নি। হোস্টেলে থাকলে পরীক্ষার দিনগুলোয় বাড়ি থেকে যাতায়াত নিয়ে টেনশান করতে হবে না।

একশো চব্বিশ নম্বরে থাকার সুবিধা হল, এই ঘরে কেউ থাকে না। টিনটিনের বাড়ি ঢাকুরিয়ায়। সে ক্লাস শেষ হলে বিকেলের দিকে আধঘণ্টার জন্য রেস্ট নেয়। তারপর বাড়ি চলে যায়। এটা মোচা-পার্টির মিটিং ঘর। পরীক্ষার চাপে মিটিং এখন বন্ধ। সারাদিন অভি ঘরে একা। পড়াশুনা করার জন্য আদর্শ ব্যবস্থা। কিন্তু পড়াশুনা হচ্ছে কই?

অভির রুটিন খুব সহজ। ভোর পাঁচটার সময় অ্যালার্ম বাজলে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে স্নান করে পড়তে বসে। সকালে অ্যানাটমি পড়ে না। ভোরবেলা অপছন্দের সাবজেক্ট পড়তে বিবমিষা হয়। ফিজিওলজি নিয়ে বসে। চ্যাপ্টার রিভিশন দিতে আর ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস করতে আটটা বেজে যায়। আটটা থেকে ন’টা টিফিন ব্রেক। প্রাতঃরাশ, খবরের কাগজ পড়া, খুচরো আড্ডা চুকিয়ে আবার ঘরে ঢোকে অভি। এইবার অ্যানাটমি নিয়ে বসে। টিনটিনের সংগ্রহ করা একটা স্কেলিটন আলমারিতে ঢোকানো ছিল। অভি সেটাকে হুকে ঝুলিয়েছে। কাপালিকের মতো হাড় আর নরকঙ্কাল নিয়ে চর্চা করে অস্টিওলজি এখন সড়োগড়ো। মাসলের অরিজিন আর ইনসারশন গোলায় না। বিভিন্ন শিরা, ধমনি ও স্নায়ুতন্ত্রর গতিপথও বাগে এনে ফেলেছে। প্রবলেম করছে ভিসেরা বা মানবদেহের ভাইটাল অর্গ্যানস। যেমন হার্ট, লাং, ব্রেন, স্টম্যাক, কিডনি, লিভার। ভাইভার সময় ফর্মালডিহাইডে চোবানো এইসব ভিসেরা হাতে ধরিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করবেন এনজি। না পারলেই ঝাড়। তার ব্যাচের ছেলেরা কালুয়া ডোমের কাছ থেকে ভিসেরা কিনে বালতিতে ভরে রেখেছে। যখন যেটা পড়ে তখন সেটা বালতি থেকে বার করে নেয়। বালতি ভর্তি হৃদয়, ফুসফুস, যকৃৎ, বৃক্কের প্রদর্শনী দেখলে যে কোনও মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে। অজ্ঞান বোধহয় অভিও হয়ে যাবে। তবে সেটা অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার দিনের কথা ভেবে।

সকাল নটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত অ্যানাটমি নিয়ে দক্ষযজ্ঞ চলে। তারপর জেনারেল মেসে গিয়ে খাওয়া। মিনি মেস উঠে গিয়ে খুব ভালো হয়েছে। জেনারেল মেসের খাওয়াদাওয়া একদম বাড়ির মতো। পেটপুজো ক্যাটারিং এজেন্সির মালিক উৎপল রোজ লাঞ্চের সময় মেসে উপস্থিত থাকে। খাবারের কোয়ালিটি, মেসের স্টাফদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে।

দুপুর দুটোর সময় শুয়ে পড়ে অভি। ঘুম ভাঙে সাড়ে তিনটের সময়, টিনটিন ঢুকলে। টিনটিন নিজের খাটে রেস্ট নেয়। তার মধ্যে অভি বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে বসে যায়। সাড়ে তিনটে থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ফর্মুলা মুখস্থ করে আর সমীকরণ কষে কেটে যায়। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ডিএনএ আর আরএনএ নিয়ে সাড়ে চারঘণ্টা ধস্তাধস্তি চলে। এবার গন্তব্য ক্যান্টিন।

মুড়ি-ঘুগনি বা লুচি-তরকারি, কিছু একটা খেয়ে এককাপ চা নেয় অভি। তারপর একটা সিগারেট। হ্যাঁ, অভিও সিগারেট ধরেছে। যে অভি আজ থেকে এক বছর আগে বিলুকে সিগারেট খেতে দেখে বলেছিল যে অরুণাকে বলে দেবে, সে এখন ধূমপায়ী। নিজেকে সান্ত্বনা দেয় অভি, পরীক্ষার টেনশান কাটাতে এই সাময়িক নেশা। পরীক্ষা হয়ে গেলেই ছেড়ে দেবে। আর সে তো চন্দনের মতো দিনরাত ধোঁয়া ছাড়ে না। বিকেলে টিফিনের সময় একটা আর রাতের খাওয়ার পড়ে আর একটা।

আটটায় আবার পড়তে বসে অভি। আবারও অ্যানাটমি। কিছুতেই মন চায় না। তাও। ব্রেনের অ্যানাটমি, হোয়াইট আর গ্রে ম্যাটার, সেন্ট্রাল আর পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম—এই সবের জটিল গোলকধাঁধায় সাড়ে দশটা অবধি কাটিয়ে রাতের খাবার খেতে ওঠে অভি। নাকে-মুখে খাবার গুঁজে এগারোটার সময় আবার পড়তে বসে। বারোটা পর্যন্ত পেপার সলভ করে। গত দশ বছরের ফার্স্ট এমবিবিএস-এর প্রশ্নপত্রের ফটোকপি জোগাড় করেছে সে। প্রতি রাতে একঘণ্টা লেখালেখি করে। তিন দিনে একটা পেপার শেষ হয়। রাত বারোটার সময় দ্বিতীয় এবং শেষ সিগারেট ধরিয়ে অভি হিসেব করে, আজ ক’ঘণ্টা পড়া হল? মাত্র ষোল ঘণ্টা। কাল থেকেই এটাকে বাড়িয়ে আঠেরো ঘণ্টা করতে হবে। তখন তার দু’চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। আধো-জাগা, আধো-ঘুমের মাঝখানে মাথায় ছবি আঁকছে মনোজের দেরি করে বাড়ি ফেরা, অরুণার অকারণ দুশ্চিন্তা ও শুচিবাই, রাধা পাগলি আর মানদা পিসির ঝগড়া, বিলুর অতি-বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। আর এই সবের মধ্যে গালে টোল ফেলে একটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে…

সারা অগাস্ট মাস জুড়ে অনর্গল বৃষ্টিপাত। আকাশের রং ধূসর। রাত বারোটা নাগাদ হাতির পালের মতো মেঘের দল বেলেঘাটা ব্রিজ পেরোচ্ছে। অ্যানাটমির ভারে ক্লান্ত অভির মাথায় নিঃশব্দে বাংলা হরফ এক্কাদোক্কা খেলতে থাকে। ঘুমের মধ্যে অভি বিড়বিড় করে,

‘কখন আকাশ থেকে মেঘ, কখন মেঘের থেকে জল

কখন জলের মাঝে মেয়ে। মেয়ের দু’গালে টলোমল

স্বেদ, নাকি বৃষ্টি ছিল রাখা। জানি না, হয়নি বলে চাখা।

ধর্মতলাগামী বাসে চাকা, ফেটে গিয়ে এই গন্ডগোল।

স্বাদই অপূর্ণ না শুধু। নামটাও বাকি আছে জানা।

পদবি? তাতেও গরমিল। এছাড়াও জানি না ঠিকানা।

কিছুই জানি না বলে শোক, করার মতন কোনও লোক

নই আমি। তাই আজ থেকে, তার নাম বৃষ্টিদিন হোক।’

হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় অভির। কী হল? এতক্ষণ ঘুমের মধ্যে কী বিড়বিড় করছিল সে? এই কবিতাটা কার লেখা? অন্ধকার ঘরে শুয়ে, সিলিং পাখার দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে থাকতে অভি বুঝতে পারে, কবিতাটা কোনো নামি কবির লেখা নয়। এটা তার নিজের লেখা। এই আট লাইন নিজের থেকে তার মাথায় এসেছে। এখনও লেখা হয়নি।

পদ্য তাকে ছাড়ছে না কেন? সে তো কবেই ও সব পাট চুকিয়ে দিয়েছে। চিলেকোঠার ঘরের লাইব্রেরিতে কবিতার বইতে ধুলো জমে আছে। একটাও কবিতা পড়েনি, সে প্রায় এক বছর হয়ে গেল। তাহলে পদ্য আসে কোথা থেকে? ছন্দ ও অন্ত্যমিল সহযোগে একটা আস্ত পদ্য? সে তো কখনও পদ্য লেখেনি। শুধু পড়েছে।চর্যাপদের যুগ থেকে সাম্প্রতিকতম নবীন কবির প্রথম কবিতার বই নিয়ে সে মাথা ঘামাত। কিন্তু সে সব তো অতীত! আজ হঠাৎ কী এমন ঘটল যে পাঠক অভি হঠাৎ করে পদ্যকার অভি হয়ে গেল? ঘুমিয়ে পড়ার আগে অভির মনে পড়ল, কাল সেই ভয়ানক দিন। কাল অ্যানাটমির থিয়োরি পরীক্ষা। বিকেলবেলা বাড়ি যাবার আগে টিনটিন বলেছে, ডাক্তাররা তাদের জীবনের চারটে রাত কখনও ভোলে না। ফুলশয্যার রাত ছাড়া অ্যানাটমি, প্যাথলজি আর মেডিসিন প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাত।

আজকের রাত সেই চার রাতের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু এই রাত অভির আজীবন মনে থাকবে। ইঙ্গুইনাল ক্যানালের বাউন্ডারি পড়তে গিয়ে ভেগাস নার্ভের কোর্স ভুলে যাচ্ছে। আর্চ অব ফুট পড়তে গিয়ে এমব্রায়োলজি ভুলে যাচ্ছে। গা গুলোচ্ছে, ওয়াক উঠছে, টক-ভাব মুখের ভেতরে। পরপর তিনবার তেতো বমি হল। বাথরুমে ওয়াক শব্দ শুনে চন্দন একশো পঁচিশ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। বলল, ‘রাত একটা বাজে। এখনও শুসনি?’

‘শোবো। এমব্রায়োলজিটা ঝালিয়ে নিই।’

‘এক বছর ধরে ঝালানো হয়নি। আর ঝালিয়ে কাজ নেই। রাত্তিরে না ঘুমিয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে কাল পরীক্ষার সময় কিসসু মনে পড়বে না। যা। ঘুমিয়ে পড়।’

‘এমব্রায়োলজিটা একদম পড়া হল না। কিডনি আর সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যান্ডের ডেভেলপমেন্টটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। এখন ঘুমিয়ে পড়ব?’

‘আমাদের পরীক্ষা এগারোটা থেকে। সিট পড়েছে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে। হাড়কাটা গলির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে আধঘণ্টা লাগবে। আমরা সওয়া দশটা নাগাদ বেরোব। এখন একটা বাজে। তুই সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠলে স্নান-খাওয়া পর্ব বাদ দিয়ে দেড়ঘণ্টা হাতে পাবি এমব্রায়োলজি পড়ার জন্য। এখন চাপ নিস না।’

চন্দনের পরামর্শ শুনে রাত একটার সময় জিভের তলায় একটা অ্যালোপাম নিয়ে শুয়ে পড়েছিল অভি। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়েছিল সকাল সাড়ে সাতটায়। অ্যালার্মের শব্দে যখন ঘুম ভাঙল, মাথা ভার। নাক বন্ধ। গা-হাত-পা ম্যাজম্যাজ করছে। জ্বর আসার পূর্ব লক্ষণ। টলতে টলতে বাথরুমে গিয়ে দাঁত মাজল অভি। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে পুরো দমে শাওয়ার চালিয়ে দিল। মিনিট পনেরো ধরে স্নান করার পরে শরীর হালকা হল। গা-হাত-পা মুছে, নতুন প্যান্ট-শার্ট পরে এক দৌড়ে ক্যান্টিন। আজ ব্রেড পকোড়া হয়েছে। ভারি প্রাতঃরাশ পরীক্ষার জন্য আদর্শ। চারটে ব্রেড পকোড়া আর এক কাপ চা খেয়ে, আর এক কাপ হাতে নিয়ে একশো চব্বিশে ঢোকে অভি। পৌনে ন’টা বাজে। হাতে সওয়া একঘণ্টা সময় আছে। একশো পাতা এমব্রায়োলজি পড়ার জন্য পঁচাত্তর মিনিট! চায়ে চুমুক দেয় সে।

দশটার সময় দরজায় ঠকঠক। চন্দন নতুন প্যান্টশার্ট পড়ে রেডি। কাঁধে ব্যাগপ্যাক। অভির দিকে একপলক দেখে বলল, ‘শরীর খারাপ নাকি?’

‘দেখে মনে হচ্ছে?’

‘চোখটা ছলছল করছে।’ অভির কপালে হাত দিয়ে চন্দন বলে, ‘টেম্পারেচার আছে। একটা প্যারাসিটামল মেরে দে।’ তারপর নিজেই একটা ট্যাবলেট আর জলের জাগ এনে বলে, ‘এক গ্রাম পিসিএম দিলাম। জ্বর বাপবাপ বলে পালাবে।’

ওষুধ খেয়ে দ্রুত ব্যাগ ঘাঁটে অভি। অ্যাডমিট কার্ড, ক্লিপবোর্ড, পেন, পেনসিল, ইরেজার, স্কেল, চোথার মাইক্রোজেরক্স…সব ঠিক আছে। চোথাগুলো টিনটিনের তৈরি। ভালোবেসে জুনিয়রকে দান করেছে। একশো চব্বিশে চাবি মেরে অভি চন্দনকে বলে, ‘চল। এগোই।’

‘এমব্রায়োলজি শেষ হল?’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে চন্দন।

‘পড়তে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি।’

‘চল। রিকশায় যেতে যেতে পড়বি।’

‘রিকশা? এখন রিকশা কোথা পাবি?’

‘কাল রাতে উৎপলদাকে বলে রেখেছিলাম। ও একটা রিকশা হোস্টেলের সামনে এনে রাখবে থিয়োরি পরীক্ষার তিনদিন। মেডিক্যাল কলেজ এমন বিকট জায়গায়, হেঁটে যেতেও প্রবলেম, বাসে যেতেও প্রবলেম।’

হোস্টেলের গেটের বাইরে একটা রিকশা দাঁড়িয়ে। উৎপল বিহারি রিকশাওয়ালার সঙ্গে দরদাম নিয়ে বচসা চলছে। চন্দন বলে, ‘কত নেবে?’

‘পচাস রুপিয়া বাবু।’ গামছা নেড়ে বলে রিকশাওয়ালা।

‘চল্লিশ দেগা।’ রিকশায় উঠে বসেছে চন্দন। তার দেখাদেখি অভিও। আচার্য জগদীশ্চন্দ্র বসু রোড টপকে, প্রাচী সিনেমা হলের পাশ দিয়ে ডিক্সন লেনে ঢুকল রিকশা। সরু রাস্তা। দু’পাশে পুরনো আমলের বাড়ি। ওপাশ থেকে গাড়ি এলে খুব সমস্যা হবে। গাড়ি এল না, কিন্তু রিকশা এল। তার সঙ্গে একপ্রস্ত ঝগড়া সেরে রিকশাওয়ালা নেবুতলা পার্কে পড়ল। বউবাজার থানার পাশ দিয়ে টুংটুং করতে করতে পৌঁছল বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিট। বউবাজারের রাস্তা দিয়ে রিকশা চালানো শক্ত। অজস্র গাড়িঘোড়া। ক্রমাগত ট্রাম যাতায়াত করছে। সামান্য দূরত্ব পেরোনোর পর ডানদিকের গলিতে ঢুকে পড়ে রিকশা।

এতক্ষণ মন দিয়ে এমব্রায়োলজি পড়ছিল অভি। এবার আড়চোখে রাস্তার দিকে তাকাল। স্থানবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটছে পাত্রপাত্রীর। সরু রাস্তায় কোনও যানবাহন নেই। একটা দুটো রিকশা বা স্কুটার দাঁড়িয়ে। অফিসযাত্রীর বদলে এখানে মেয়েদের প্রাধান্য। সকাল দশটার সময় তারা রঙিন, উজ্জ্বল পোশাক পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। পঞ্চাশোর্ধদের পোশাক শাড়ি। তিরিশ থেকে পঞ্চাশরা সালোয়ার কামিজ পড়েছে। তার নিচে সবাই জিনস বা স্কার্ট। গালে চড়া মেক আপ, চোখে মোটা দাগের কাজল, ঠোঁটে উজ্জ্বল লাল রঙের ঠোঁট রাঙানিয়া। জিনস পরা বছর কুড়ির একটা মেয়ে চার ইঞ্চির হাই হিল খটখটিয়ে রিকশার সামনে এসে অভিকে বলল, ‘তুমি বুঝি বুকওয়র্ম?’ রিকশা দাঁড়িয়ে গেল।

‘অ্যাঁ?’ মিনমিন করে বলল অভি। চন্দন বলল, ‘এখন ঝামেলা কোরো না। আমরা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।’

‘তোমার সঙ্গে কথা কইছি না।’ পিচ করে পানের পিক ফেলে লাল ঠোঁট বেঁকিয়ে মেয়েটা বলে, ‘এত বড় বুক-লাভার আমি কখনও দেখিনি। আমার কাছেও দুটো বুক আছে। দেখবে গো?’

এমব্রায়োলজি মাথায় উঠেছে। লজ্জায় অভির কান লাল। সে কোনওরকমে বলল, ‘আম…আমরা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের ছেলে। পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।’

‘ডাক্তারবাবু?’ তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ায় মেয়েটি। ‘এক্সট্রিমলি সরি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না স্যার। যান যান, আপনারা যান।’ রিকশাওয়ালার পিঠে থাবড়া কষায় সে। রিকশা আবার চলতে শুরু করে। অভি এমব্রায়োলজিতে মনোযোগ দেয়।

মেডিক্যাল কলেজের যে হলঘরে পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছে, সেটা ফুটবল মাঠের মতো বড়। হলঘরের দু’পাশে প্রশস্ত করিডর। করিডরে বড় বড় জানলা। ঘর আলোয় ভেসে যাচ্ছে। হলঘরের দু’পাশে বেঞ্চি পাতা। প্রতি বেঞ্চিতে দু’জনের সিট পড়েছে। অ্যাডমিট কার্ড মিলিয়ে সিট নাম্বার খুঁজতে গিয়ে বৃন্দার সঙ্গে ঠোক্কর লাগল অভির।

‘তুই?’ অভি অবাক।

‘আমার রোল নাম্বার দুই। ফার্স্ট রোয়ে সিট পড়েছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার উপায় নেই। ডাহা ফেল করব।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলে বৃন্দা।

‘আমার রোল নাম্বার এক,’ প্রথম বেঞ্চিতে বৃন্দার পাশে বসে সামনের দিকে তাকায় অভি। দু’ফুট দূরে প্ল্যাটফর্মের ওপরে একটা টেবিল ও চারটে চেয়ার। ওখানেই বসবেন ইনভিজিলেটররা। ব্যাগে রাখা মাইক্রোজেরক্সের কথা ভুলে যায় অভি। ওই চোথা এখানে কোনও কাজে আসবে না। তারপর কী ভেবে ব্যাগ খুলে ক্লিপবোর্ড এবং পেনসিল বক্স বার করার ফাঁকে মাইক্রোজেরক্সের বান্ডিল মোজার মধ্যে গুঁজে রাখে। সঙ্গে থাকা ভালো। একঘণ্টা পরে বাথরুমে যেতে দেবে। একদম না পড়া কোনও টপিক এলে দেখে নেওয়া যাবে।

বৃন্দা নিজের জায়গায়, দু’হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে রয়েছে। তার পাশে বসে অভি আবার এমব্রায়োলজি বই খুলল। এই এমব্রায়োলজির জন্যই সে ঝাড় খাবে। কিডনি আর সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যান্ডের ডেভেলপমেন্টটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। গত দশ বছরে এমব্রায়োলজি থেকে লং কোয়েশ্চেন আসেনি। এবারও আশা করা যায় যে আসবে না। পঁচিশ নম্বরের লং কোয়েশ্চেনের উত্তর লিখতে না পারা মানে নিশ্চিত ঝাড়।

ঢং করে ঘণ্টা পড়ল। করিডোরে ঠকঠক, মসমস করে জুতোর আওয়াজ। সারিবদ্ধ ভাবে দু’জন পুরুষ ও দু’জন মহিলা একজামিনার হলঘরে ঢুকলেন। প্রথম মহিলা একজামিনার প্ল্যাটফর্মে উঠে বললেন, ‘সাইলেন্স।’

হলঘর জুড়ে নৈঃশব্দ নেমে এল।

‘পরীক্ষা শুরু হতে দশ মিনিট বাকি আছে। তার আগে নিয়মগুলো তোমাদের জানিয়ে দিই। আমি যতক্ষণ নিয়ম বলব, ততক্ষণ তিনজন স্যার ও ম্যাডাম তোমাদের টেবিলে কোয়েশ্চেন পেপার ও আনসার শিট পৌঁছে দেবেন। আমরা আশা করব, দশটা বাজার আগে তোমরা লেখা শুরু করবে না। করলে প্রশ্নপত্র কেড়ে নেওয়ার অধিকার আমাদের আছে।’

উত্তর ও প্রশ্নপত্র বিতরণ শুরু হয়ে গেছে। অভিই প্রথম প্রাপক। কোয়েশ্চেন পেপার বা আনসার শিটের দিকে না তাকিয়ে অভি ম্যাডামের কথা শুনছে। ম্যাডাম বলছেন, ‘বাথরুম যেতে হলে এখন ঘুরে এসো। একঘণ্টার আগে বাথরুমে যাওয়া যাবে না। আর শেষ কথা, কাউকে অসাধু উপায়ে অবলম্বন করতে দেখলে আমরা তার খাতা কেড়ে নেব। ভুলে যেয়ো না, আমরাও একদিন স্টুডেন্ট ছিলাম। সো, ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভারস্মার্ট।’

দশটা বাজার ঘণ্টা পড়ল। প্রশ্নপত্রের প্রথম প্রশ্নের দিকে তাকাল অভি। ‘ডেসক্রাইব এমব্রায়োলজিকাল ডেভেলপমেন্ট অব কিডনি অ্যান্ড সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যাণ্ড ইন ডিটেইল, উইদ ডায়াগ্রামস।’ পঁচিশ নম্বরের প্রথম প্রশ্ন!

চোখ বুঁজে ফেলে অভি। এখন আর কোনও টেনশান হচ্ছে না। এখন আর কোনও শারীরিক অসুবিধে নেই। এখন বলির পাঁঠার মতো হাড়িকাঠে গলা দিয়ে প্রতিক্ষার পালা। কখন পরীক্ষা শেষ হবে। এক বছরের পরিশ্রম এইভাবে বিফলে যাবে, ভাবতে পারেনি অভি। বৃন্দার দিকে তাকায় সে। বৃন্দা মন দিয়ে প্রশ্নপত্র পড়ছে। অভির দিকে তাকিয়েও দেখল না।

আচ্ছা, এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার কী আছে? অন্য প্রশ্নগুলো দেখা যাক! দ্বিতীয় প্রশ্নে চোখ রাখে অভি। আর্চ অব অ্যাওর্টা অ্যান্ড ইটস ব্রাঞ্চেস। পঁচিশ নম্বর! গুড! কিউবিটাল ফসা—ইটস বাউন্ডারি অ্যান্ড কনটেস্ট। গুড! পঞ্চাশ নম্বর কমন পাওয়া গেল। বাকি পঁচিশ নম্বরে পাঁচটা শর্ট নোট আছে। সেগুলো পড়ে অভি। ইঙ্গুইনাল ক্যানাল সহ বাকি চারটে তার জানা। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ায় অভি। পঁচাত্তর নম্বর কমন পড়েছে। প্রথম দু’ঘণ্টায় এগুলো শেষ করা যাক। তারপরে বাথরুমে গিয়ে চোথা দেখে এমব্রায়োয়োলজির উত্তরটা কোনওরকমে মুখস্থ করে খাতায় নামিয়ে দিতে হবে। পঁচিশে যদি পাঁচ-সাত নম্বরও পায়, পাস করা কেউ আটকাতে পারবে না। তাদের পাসমার্ক ফিফটি পার্সেন্ট। অর্থাৎ পঁচাত্তর নম্বরের মধ্যে অন্তত পঁয়তাল্লিশ তাকে তুলতেই হবে। আর্চ অব অ্যাওর্টা দিয়ে উত্তর লেখা শুরু করে অভি। লাল নীল স্কেচ পেন দিয়ে ডায়াগ্রাম এঁকে ভরিয়ে দেয় প্রথম তিনপাতা। এবার বিবরণ।

ঠিক দু’ঘন্টার মাথায় উত্তর লেখা শেষ হল অভির। এতক্ষণ হলঘরে কী ঘটে গেছে তার কোনও ধারণা নেই। খাতা আর প্রশ্নপত্র গুছিয়ে রেখে সে ভেবে নেয় চোথাটা কোন পায়ের মোজার মধ্যে রাখা আছে। সিওর হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, একবার বাথরুম যাব।’ ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক ম্যাডাম বলেন, ‘যাও। তাড়াতাড়ি আসবে।’

বেঞ্চি থেকে উঠে বৃন্দার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অভি খেয়াল করল বৃন্দা স্কেচ পেন দিয়ে কিডনি আর সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যান্ডের ছবি আঁকছে। হিংসেয় গা চিড়বিড় করে ওঠে অভির। মেয়েগুলো কি সাংঘাতিক স্টুডিয়াস হয়!

বাথরুমে ঢুকে অভি দেখে ইউরিনালের সামনে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সুরজ, প্রবাল আর দীপ শর্ট নোট নিয়ে আলোচনা করছে। ওদের পাত্তা না দিয়ে টয়লেটে ঢুকে যায় অভি। দরজা বন্ধ করে অবাক হয়ে দেখে সিস্টার্নের ওপরে পাঁজা করে বই রাখা। ক্যানিংহ্যাম, ডক্টর মিত্র, চৌরাসিয়া, স্নেল… কী নেই? এখন কোনও ইনভিজিলেটর দরজা ধাক্কালে সে চরম বেইজ্জত হবে। পরীক্ষায় না-ও বসতে দিতে পারে। হুড়মুড়িয়ে দরজা খুলে বেরোয় অভি। পাশের টয়লেটের দরজা ঠেলে উঁকি মারে। এই টয়লেটটা নোংরা। তবে কোনও বইপত্র রাখা নেই। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, নিচু হয়ে সে মোজার ভিতর থেকে চোথার তাড়া বের করে আনে। কিডনির এমব্রায়োলজির পাতাটা খুঁজে বার করে বাকি পাতাগুলো কমোডে ফেলে সিস্টার্ন টানে। মুহূর্তের মধ্যে সব কাগজে সাইফনের নলে অদৃশ্য হয়ে যায়। কাগজটা হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিডনির এমব্রায়োলজি মুখস্থ করতে থাকে অভি।

হলঘরে ঢোকার আগে অভি ঘড়ি দেখল। সে বাথরুমে ঠিক দশ মিনিট সময় কাটিয়েছে। ইনভিজিলেটর কোনও সন্দেহ করেনি তো? চোথার পাতাটা এখনও মোজার মধ্যে রাখা আছে। বলা যায় না, দশ মিনিটের মুখস্থ বিদ্যা খাতায় বমি করতে গিয়ে যদি ভুলে যায়, তাহলে আর একবার টয়লেটে যেতে হবে! এখন ইনভিজিলেটররা তার বডি সার্চ করলেই পরীক্ষা থেকে আউট!

ধুস! এত ভয় পেলে চলে না। ভয় পেলে মুখে তার ছাপ পড়ে। ওতে পরীক্ষকদের সন্দেহ বাড়ে। ক্যাজুয়ালি বৃন্দার পাশ দিয়ে হেঁটে নিজের আসনে বসে অভি। ম্যাডাম ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে বললেন, ‘একটু বেশি সময় লাগল মনে হল!’

এর একটা বোম্বাস্টিং উত্তর দিতে হয়। পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত মুছতে মুছতে অভি বলল, ‘পাইখানা গিয়েছিলাম ম্যাডাম।’

‘পাইখানা’ শব্দটি শুনে ম্যাডাম নাক কুঁচকে ম্যাগাজিনে চোখ রাখলেন। পাশে বসে বৃন্দা কুলকুলিয়ে হাসছে। তাকে পাত্তা না দিয়ে পেনসিল বাক্স থেকে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ স্কেচপেন বার করে অভি। একটা পঁচিশ নম্বরের লং কোয়েশ্চেন বাকি। হাতে সময় পঞ্চাশ মিনিট!

পরীক্ষা শেষ হওয়ার আধঘণ্টা আগে অভির উত্তর লেখা শেষ হয়ে গেল। খুব যে ভালো লিখেছে তা নয়। তবে কিডনি আর সুপ্রা-রেনাল গ্ল্যান্ডের অ্যানাটমি আর ফিজিওলজি জোর করে ঢুকিয়ে উত্তরটা সাত পাতা টেনেছে। সঙ্গে গোটা পাঁচেক ডায়াগ্রাম।

লেখালিখির পাট চুকিয়ে রিভিসন করতে বসে অভি। তিনটে লং কোয়েশ্চেন আর পাঁচটা শর্ট নোটের উত্তর পড়তে কুড়ি মিনিট সময় লাগল। এবার খাতা জমা দিতে হবে। হলঘর থেকে দেখা যাচ্ছে আকাশে আবার মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামবে কিছুক্ষণের মধ্যে।

‘শেষ?’ রিভাইস করতে করতে প্রশ্ন করল বৃন্দা।

‘হ্যাঁ’। উত্তরপত্রগুলো সুতো দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে অভি খেয়াল করল, একটা লুজ শিট সে ব্যবহার করেনি। এটা ম্যাডামকে ফেরত দেওয়া উচিত। আনসার শিট নিয়ে উঠতে যাবে, এমন সময় প্রচণ্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকালো! ‘বাবা গো!’ বলে বৃন্দা বাঁদিকে লাফিয়ে অভির ডান হাত চেপে ধরল।

‘ভ্যাট! ভিতু কোথাকার।’ বৃন্দার হাত ছাড়িয়ে লুজ শিটটার দিকে তাকায় অভি। অনেকদিন বাদে তার মাথায় আবার কবিতা আসছে। বিদ্যুতের মতো আচমকা, বৃষ্টিধারার মতো ঝমঝম করে। পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইনভিজিলেটাররা খাতা জমা নিতে ব্যস্ত। তার মধ্যে লুজ শিটে খসখস করে লিখতে থাকে অভি।

‘কখন আকাশ থেকে মেঘ, কখন মেঘের থেকে জল।

কখন জলের মাঝে মেয়ে, মেঘের দু’গালে টলোমল…’

ঘোরের মধ্যে কবিতা লেখা শেষ করে অভি। মেঘ ও বৃষ্টির কারণে হলঘরে আলো অপ্রতুল। ছেলেমেয়েরা খাতা জমা দিতে দিতে গজল্লা করছে। চারজন ইনভিজিলেটার খাতা গোনাগুনিতে ব্যস্ত। এর মধ্যে লুজ শিটটা প্যান্টের পকেটে ঢোকায় অভি। আজ তার বুকে দুঃসাহস ভর করেছে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে টকাটক করে নামতে নামতে বৃন্দার পাশে চলে আসে সে। ক্যাজুয়ালি বলে, ‘হোস্টেলে ফিরবি তো?’

‘না। আগামী দু’দিন ছুটি। আজকের দিনটা বাড়ি থাকব।’ জড়োসড়ো হয়ে জবাব দেয় বৃন্দা। তারা দু’জন এখন গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আশেপাশে অন্য ছেলেমেয়েরা। চন্দন ইশারায় অভিকে ডাকছে।

‘এখন কি মেট্রো ধরবি? ছাতা আছে?’ প্রশ্ন করে অভি। বৃন্দার জড়োসড়ো থাকার কারণ সে বুঝতে পারছে না। পরীক্ষা ভালো হয়নি নাকি?

‘না…মানে…দেখি…’ অসংলগ্ন উত্তর দেয় বৃন্দা। অভি আর দেরি করে না। এইটাই আইডিয়াল টাইম। নিখুঁতভাবে ভাঁজ করা লুজ শিট বৃন্দার হাতে ধরিয়ে বলে, ‘এটা তোর জন্যে।’

বৃন্দা কিছু বলার আগে একটা কালো এসইউভি গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়ায়। জানলার কাচ সেন্ট্রাল লকের কেরামতিতে খুলে যায়। চালকের আসন থেকে স্যামি ব্যানার্জি বলেন, ‘বৃন্দা, উঠে আয়।’

লুজ শিট ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বৃন্দা গাড়িতে উঠে পড়ে। টিন্টেড গ্লাসের জানলা মসৃণভাবে উঠে যায়। গাড়িটা অভি ও তার ক্লাসমেটদের মুখের ওপরে ধোঁয়া ছেড়ে হুস করে চলে যায়।