প্রথম পরিচ্ছেদ
অভিজ্ঞান
লালগঞ্জ। উত্তরপ্রদেশের এক ছোট্ট গ্রাম। ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামে থাকে পান্ডে পরিবার। পরিবারের কর্তা প্রজাপতি পান্ডে, বউ নয়না দেবী, এবং তাদের দুই ছেলে। ছোট ছেলের নাম মাখনচাঁদ ওরফে মাখখি। মাখখির দাদার নাম চুলবুল পান্ডে।
বড় হয়ে চুলবুল পান্ডে লালগঞ্জের পুলিশ অফিসার হল। ভয়ডরহীন, ফিয়ারলেস, দাবাং পুলিশ অফিসার। ব্যাঙ্কে ডাকাত পড়লে ঠেঙিয়ে পাট করে দেয়। কিন্তু ডাকাতির টাকা ব্যাঙ্কে ফেরত না দিয়ে নিজের পকেটে রাখে। আধুনিক রবিন হুড।
নির্মলা নামের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে ছোট ছেলে মাখখি। নির্মলার বাবা মাস্টারজির এই প্রেমে তীব্র আপত্তি। ওদিকে পুলিশি এনকাউন্টার করতে গিয়ে চুলবুল পান্ডের মোলাকাত হয়েছে রাজজো নামের একটি মেয়ের সঙ্গে। আপেলের মতো লালচে গাল, বড়বড় চোখ, রেশমের মতো একঢাল চুল, ঘাগরা চোলি পরা ‘গাঁও কি গোরি’ রাজজোকে দেখে চুলবুল পান্ডে গেয়ে উঠল, ‘তেরে মস্ত মস্ত দো নয়ন, মেরে দিল কা উড় গ্যায়া চ্যয়েন!’
‘উফ! সোনাক্ষী সিনহাকে কী দেখতে মাইরি! বিশ্বাসই হয় না যে শত্রুঘ্ন সিনহার মেয়ে এত সুন্দর হতে পারে।’ উত্তেজিত হয়ে বলল বিলু ওরফে অনাবিল লাহিড়ী।
বিলুর বয়স একুশ। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। গায়ের রং শ্যামলা। গড়ন রোগার দিকে। এক মাথা না-আঁচড়ানো চুল। গালে না কামানো দাড়ি। পরে আছে টি-শার্ট আর নোংরা জিনস, পায়ে ফ্লোটার্স। টি-শার্টে চে গেভারার ছবি। বসা গাল, উঁচু হনু, সিগারেট খাওয়া কালো ঠোঁট আর জ্বলজ্বলে চোখের কারণে তাকে সত্তর দশকের বিপ্লবীদের মতো দেখতে লাগে। পড়াশুনোয় ভালো যে সব ছেলেরা কম বয়সে পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গিয়েছিল।
‘সোনাক্ষীর মধ্যে ওর মায়ের ফিচার্স রয়েছে। শত্রুঘ্ন সিনহার জিন নেই বললেই চলে।’ তিন বছরের বড় দাদার দিকে ফিরে বলল অভিজ্ঞান লাহিড়ী ওরফে অভি।
আঠেরো বছরের অভি সদ্য টুয়েলভ পাস করেছে। বিলুর থেকে সে এক ইঞ্চি খাটো হলেও গায়ের রঙে চার পোঁচ এগিয়ে আছে। বিলুর মতোই অভির গড়ন রোগার দিকে। তবে সে ক্লিন শেভড। বিলুই তাকে দাড়ি কামানো শিখিয়েছে। বিলুর মতো সেও পরে আছে জিনস আর টি-শার্ট। পায়ে স্নিকার্স।
অভি বিলুকে দাদা হিসেবে দেখে না। দুজনের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তবে বিলু ছোড়নেওয়ালা নয়। অভির ওপরে নিয়মিত দাদাগিরি ফলিয়ে থাকে। সে শিয়ালদার ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল ওরফে আইএমসিএইচ-এর থার্ড ইয়ারের ছাত্র। বেলুড়ের মফসসলি কুয়ো থেকে বেরিয়ে কলকাতার সমুদ্রে সাঁতার কাটছে গত তিন বছর। ভাইয়ের শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় তার প্রাপ্য। ভাইকে ধমক দিয়ে সে বলে, ‘এখনও কলেজ শুরু হল না, এর মধ্যে জেনেটিক্স বুঝে গেলি? খামোশ!’
‘আমাদের বারো ক্লাসে জেনেটিক্স পড়তে হয়েছে। তুই বাজে না বকে সিনেমাটা দেখতে দে।’ বিরক্ত হয়ে বলে অভি। বিলু ভুলে যাচ্ছে যে ছোট ভাইটিও এই বছর জয়েন্ট এনট্রান্সের মেডিক্যালে একশো সত্তর র্যাঙ্ক করেছে। সেও ভরতি হয়েছে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে।
আজ ১০ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার। আজ থেকে ফার্স্ট সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল। ইদের ছুটি বলে আগামিকাল থেকে শুরু হবে।
দাবাং সিনেমাটা নিয়ে দুই ভাইয়ের প্রবল উৎসাহ ছিল। সোনাক্ষী সিনহা এই ছবিটার মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেছে। সলমন খান অভিনয় করেছে চুলবুল পান্ডে ওরফে রবিন হুড পান্ডের ভূমিকায়। মালাইকা অরোরা ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ আইটেম সং-এর সঙ্গে নেচেছে। তার ঠুমকা দেখে পুরো ইন্ডিয়া দিওয়ানা।
বেদম ঝাড়পিটের একটা সিন হল। লিলুয়ার চন্দন সিনেমা হলের অডিয়েন্স হাততালি দিয়ে হল ফাটিয়ে দিচ্ছে। চেয়ারের ওপরে উঠে নাচা, জামা খুলে শূন্যে ওড়ানো, পয়সা ফেলা, সলমনের নামে জয়ধ্বনি—এটা সিনেমা হল না কুম্ভীপাক নরক, বোঝা দায়। এই গন্ডগোলের মধ্যে হাফটাইম হল।
হলের বাইরে বেরিয়ে পান-বিড়ির দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনল বিলু। জ্বলন্ত দড়ি থেকে সিগারেট ধরিয়ে অভিকে বলল, ‘মাকে বলবি না কিন্তু!’
চোখ গোলগোল করে অভি বিলুর দিকে তাকাল। দাদা সিগারেট খায়? কই বাড়িতে কখনও দেখেনি তো! তার মানে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে গিয়ে নেশা ধরেছে! অভি মনে মনে ঠিক করে নেয়, বাড়ি গিয়েই মা অরুণার কানে তুলতে হবে। বাবা মনোজের কানে তুললে তো মার খেয়ে মরে যাবে!
অভি-বিলুর বাবা মনোজ লাহিড়ী রাইটার্স বিল্ডিং-এর ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের আপার ডিভিশন ক্লার্ক। অভি অনেকবার মনোজের সঙ্গে মহাকরণে গেছে। সাহেবদের তৈরি বাড়ির ব্যাপারই আলাদা। উঁচু উঁচু সিলিং, মোটা মোটা থাম, লম্বা চওড়া জানলা-দরজা, রান্নাঘরের মতো বড় লিফট। তার সঙ্গে রয়েছে বোলতার চাকের মতো ঝুল, কার্পেটের মতো পুরু ধুলো, মাহুতের মতো উঁচু ফাইলের স্তুপ।
মনোজ লাহিড়ী জনমোর্চা পার্টির সক্রিয় কর্মী। জনমোর্চা গত সাতাশ বছর ধরে সরকার চালাচ্ছে। অন্যান্য সব দফতরের মতো ফিনান্স ডিপার্টমেন্টেও জনমোর্চার ইউনিয়ন। মনোজ তার কালচারাল সেক্রেটারি। ডিপার্টমেন্টে একটা নাটকের দল আছে। নাম, ‘জীবন সংগ্রাম’। রিহার্সাল আর কল শো নিয়ে মনোজ সারা বছর ব্যস্ত থাকেন।
বিলুর সিগারেট ফোঁকা শেষ। হাফটাইমও খতম। দুই ভাই দুদ্দাড়িয়ে সিনেমা হলে ঢুকল। ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ গানটা এইবার আছে।
জীবন সংগ্রামের রিহার্সাল চুকিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনোজের রাত নটা বেজে যায়। চান করে, ফ্রেশ হয়ে, পাজামা পাঞ্জাবি পরে দোতলার বসার ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করেন মনোজ। অভির কাজ হল দোতলার ফ্রিজ থেকে হুইস্কির বোতল আর টক-ঝাল-মিষ্টি চানাচুর এনে দেওয়া। হুইস্কিতে চুমুক দিতে দিতে জনমোর্চার দলীয় মুখপত্র ‘জনমত’ পড়েন মনোজ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত, জয়েন্ট এনট্রান্সের জন্য পড়াশুনা করতে করতে বিরক্ত হয়ে গিয়ে বসার ঘরের বুক শেলফ ঘাঁটত অভি। কালো চামড়ায় বাঁধানো ‘কমপ্লিট ওয়র্কস অব স্ট্যালিন’, লাল-সাদা প্রচ্ছদের ‘লেনিন রচনাবলী’, ‘অ্যান্ড কোয়ায়েট ফ্লোজ দ্য ডন’-এর তিন খন্ড, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’, ‘হাউ দ্য স্টিল ওয়াজ টেম্পারড’, রাশিয়ান প্রবন্ধের ইংরিজি অনুবাদের বই ছাড়া অন্য কোনও বই নেই। বইগুলোর মলাটে ধুলোর পাতলা আস্তরণ পড়েছে। জ্ঞানত মনোজকে কখনও বইগুলো পড়তে দেখেনি অভি। এইরকম একটা লোক কালচারাল সেক্রেটারি হয় কী করে?
যদিও, একথা সত্যি যে মনোজের সূত্রেই বইপত্রে আগ্রহ অভির। ছোটবেলায় পুজোর সময়ে মনোজের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে বেরোত সে। প্যান্ডেলের পাশে লালশালু দিয়ে তৈরি জনমোর্চার স্টলে বসে মনোজ কমরেডদের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন। দুয়েকটা ‘সোভিয়েত দেশ’-ও কিনতেন। অভি কিনত ‘পেনসিল আর সর্বকর্মার অ্যাডভেঞ্চার’, ‘উভচর মানুষ’, ‘গল্প আর ছবি’, ‘সাগরতীরে’। ননী ভৌমিকের অনুবাদে সেই সব অসামান্য শিশুসাহিত্য পড়ে গ্রন্থপ্রীতি জন্মায় অভির। এখনও বইগুলো চিলেকোঠার আলমারিতে রাখা আছে। চিলেকোঠায় অভির নিজস্ব লাইব্রেরিতে রাশিয়ান বইয়ের পাশাপাশি অন্য বইয়ের সংখ্যা পরবর্তীকালে বেড়েছে। ইস্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকার সুবাদে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দিনেশ দাস, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই তার স্টকে অনেকদিন ধরে আছে। আছে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন, রূপসী বাংলা, ধূসর পাণ্ডুলিপি। ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইট, নাইন জুড়ে উপহার পাওয়া এইসব বই অভি কখনও উল্টেও দেখেনি। কবিতার বই আলমারিতে সাজিয়ে রাখতে হয়, এইরকম ধারণা ছিল। রাশিয়ান শিশু সাহিত্যের পাট চুকিয়ে অভি তখন গোগ্রাসে গিলত সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা আর পরাশর বর্মা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাধু কালাচাঁদ, শিবরামের হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, ইনিড ব্লাইটনের ফেমাস ফাইভ বা সিক্রেট সেভেন, টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্স, ইন্দ্রজাল কমিকস। মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হওয়ার পরে বিলু অভির কবিতার বই নিয়ে টানাটানি শুরু করে। বিরক্ত হয়ে অভি বলেছিল, ‘মড়া কাটার সময় ছড়াও কাটতে হয় বুঝি?’
বিরক্ত বিলু শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতার একটা পাতা খুলে বলেছিল, ‘এটা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়। নিজের মতো করে।’
অভি পড়েছিল। ধীরে ধীরে, ছন্দ ধরতে গেলে যে ভাবে সন্তর্পণে এগোতে হয়, সেই ভাবে।
‘যুবতী কিছু জানেনা, শুধু প্রেমের কথা বলে
দেহ আমার সাজিয়েছিল প্রাচীন বল্কলে।’
‘বল্কলে’ শব্দটিকে ‘বল’ আর ‘কলে’—এই দুই ভাগে ভেঙে দিতে পেরে জিভ যেন কানকে আরাম দিয়েছিল। অভি পড়েছিল,
‘আমিও পরিবর্তে তার রেখেছি সব কথা
শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছি আগুন, প্রবণতা।’
‘যাহ! ফোট!’ ‘শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বগলদাবা করে তরতরিয়ে নেমে গিয়েছিল বিলু। অভি তখন আপন মনে আওড়াচ্ছে, ‘আমিওপরি, বর্তেতার, রেখেছি সব, কথা। শরীরভরে, দিয়েছিঢেলে…নানা…ঢেলেদিয়েছি, আগুনপ্রব, ণতা’। শরীর ভরে ঢেলে দেওয়া আগুনের চিত্রকল্প অভির লিঙ্গোত্থান ঘটিয়েছিল।
সেই থেকে শব্দ আর অক্ষর, যতিচিহ্ন আর স্পেস, অর্থ আর অনর্থ অভিকে সম্মোহিত করে রেখেছে। কবিতা ও গদ্যপাঠ চলছে সমান তালে। নাইন টেন ইলেভেন টুয়েলভের ঘাম ঝরানো লেখাপড়ার বাইরে যাবতীয় পত্রিকার পুজোসংখ্যা বেরনো মাত্র পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে আদি থেকে অন্ত পড়ে ফেলেছে। গপপো, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত চিঠি—কিছুতে অরুচি নেই।
তিনতলার চিলেকোঠার লাইব্রেরিতে বই বাড়ছে। আগামিকাল থেকে আরও বাড়বে। শেয়ালদা থেকে কলেজ স্ট্রিট পনেরো মিনিটের হাঁটা পথ। বই কিনে কলেজ স্ট্রিট ফাঁকা করে দেবে অভি।
‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ শুরু হয়েছে। অডিয়েন্সের তালি, সিটি আর চিৎকারে কিছু শোনা যাচ্ছে না। লিলুয়ার বিজলি কোয়ার্টারের বিহারি ছেলেগুলো চেয়ারের ওপরে উঠে নাচছে, জামা খুলে ওড়াচ্ছে, ঝনঝন করে পয়সা ফেলছে। মালাইকা অরোরার পতলি কোমরের ঠুমকা আর তিরছি নজরের আহ্বানে সবাই প্রচণ্ড উত্তেজিত।
আগামিকাল কলেজ শুরু হওয়া নিয়ে অভির কোনও উত্তেজনা নেই। কারণ ডাক্তারি পড়ার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। যাদবপুর ইউনিভারসিটির কমপ্যারেটিভ লিটারেচার আর প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরিজিতে অনার্সের ফর্ম নেট থেকে ডাউনলোড করেছিল। সেটা দেখে বিলু মাকে খবর দিয়েছে। এ-ফোর সাইজের কাগজ দুটো খ্যাঁসখ্যাঁস করে ছিঁড়ে অরুণা বলেছিলেন, ‘মেডিক্যাল এনট্রান্সে একশো সত্তর র্যাঙ্ক করে ধাষ্টামো হচ্ছে? বড় হয়ে ডাক্তার হবে না মোক্তার, সেটা তোর বাবা-মা ঠিক করবে। তুই না।’
তথাস্তু! অভি মেনে নিয়েছে। মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও অপশন নেই। একসময় শঙ্খ ঘোষ যাদবপুরে পড়াতেন। ওখানকার ছেলেমেয়েরা ‘শঙ্খদা’কে ‘স্বয়ং খোদা’ বলে। সেই ‘স্বয়ং খোদা’ রিটায়ার করেছেন। তা সত্ত্বেও যাদবপুর ইউনিভারসিটি মানে স্বর্গ। প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর থেকে গ্র্যাজুয়েশান করার পরে সেন্ট স্টিফেন্স থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান—এই প্ল্যান কবে থেকে ছকা আছে! কিন্তু, এখন সব শেষ। স্বর্গ হইতে বিদায়।
ডাক্তারি পড়ার প্রথম বছরটা অভির দাদা বিলু বাড়ি থেকে যাতায়াত করেছিল। শিয়ালদা তেমন কিছু দূর নয়। বেলুড় থেকে বাসে করে বালিঘাট স্টেশনে আসতে সময় লাগে দশ মিনিট। ডানকুনি লোকালে শেয়ালদা পৌছতে লাগে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ শিয়ালদা স্টেশন থেকে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট। সব মিলিয়ে বড় জোর একঘণ্টার মামলা। সমস্যা একটাই। ডানকুনি লাইনে ট্রেনের সংখ্যা ভীষণ কম। প্রতি ঘণ্টায় একটা। কখনও কখনও দেড় ঘণ্টা। যার ফলে ট্রেনে অসহ্য ভিড় হয়। তাছাড়া ট্রেনের টাইম টেবিল মেনে কলেজে ক্লাস হয় না। দেরিতে ক্লাসে পৌঁছনো আর ভিড়ের অজুহাত দিয়ে বিলু হোস্টেলে চলে গিয়েছিল। প্রথম দিকে সপ্তাহে দু’বার বাড়ি আসত। সপ্তাহান্তে আর সপ্তাহের মাঝখানে। এখন শনিবার রাতে এসে সোমবার ভোরবেলা চলে যায়। অরুণা বলেন, ‘প্যাখনা গজিয়েছে।’ মনোজ বলেন, ‘কলকাতার হাওয়া গায়ে লেগেছে।’
সিনেমা শেষ। চুলবুল রবিন হুড পান্ডের সঙ্গে রাজজোর বিয়ে হয়ে গেল। ক্রেডিট টাইটেল রোল করছে। পাবলিক এখনও সিট ছেড়ে উঠছে না। ক্ষীণ আশা, ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ গানটা আবার দেখাবে।
মোবাইলে সময় দেখে অভি। সন্ধে ছটা বাজে। এতদিন তার মোবাইল ছিল না। ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার পরে মনোজ কিনে দিয়েছে। সিনেমা হল থেকে বেরোল দু’জনে। হলের গায়েই লিলুয়া স্টেশন। অভিদের বাড়ি বেলুড়ে। সেটা লিলুয়ার পরের স্টেশন।
স্টেশনে উঠতে না উঠতে ব্যান্ডেল লোকাল চলে এল। বাড়ি ফেরা অফিসযাত্রীর ভিড়ে কামরা থইথই করছে। তাদের মধ্যে কোনওরকমে নিজেকে গুঁজে দিল অভি। বিলুও উঠে পড়েছে। দরজার হাতল ধরে হাওয়া খাচ্ছে আর পাশের যাত্রীর পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করছে।
এক মিনিটের মধ্যে বেলুড় স্টেশন। ট্রেন থেকে নামল প্রচুর যাত্রী। দুই ভাইও নেমে পড়ল। প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার পরে, রেল লাইন টপকে দু’জনে স্টেশন রোডে চলে এল। দোকান থেকে সিগারেট কিনে সেটা ধরিয়ে বিলু আবার বলল, ‘মাকে বলবি না কিন্তু। এবার বলে দিলাম।’
‘বাড়ি ফিরেই বলছি।’ হেস্তনেস্ত করার ভঙ্গিতে বলল অভি।
‘এখন আমি শুধু আর তোর দাদা নই। কলেজের দুব্যাচ সিনিয়র। আগামিকাল সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেরা র্যাগিং করতে এলে বাঁচাব না। তখন বাপের নাম খগেন হয়ে যাবে।’
‘মেডিক্যাল কলেজেও র্যাগিং হয়?’ আঁতকে ওঠে অভি।
‘র্যাগিং বলা হয় না। ইন্ট্রো বলা হয়। কিন্তু কেসটা এক। কালকে বুঝবি।’ দোকানদারকে বিলু বলে, ‘দুটো কোলা দেখি।’
দোকানদার দুটো বোতল এগিয়ে দিল। বোতলে চুমুক দিয়ে, সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বিলু বলে, ‘তা হলে, ফাইনাল ডিসিশন কী হল?’
কোলায় চুমুক দিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে অভি বলে, ‘ঠিক আছে। বলব না।’
হাঁটতে হাঁটতে দুজনে স্টেশান রোড ধরে জিটি রোডের দিকে এগোচ্ছে। রিকশার প্যাঁকপ্যাঁকানি, চাউমিনের স্টল থেকে চিলি চিকেনের গন্ধ, তেলেভাজার দোকানির ‘পেঁয়াজি শেষ হয়ে গেল’, ‘তেলেভাজা ফুরিয়ে গেল’ চিৎকার, ফুচকাওয়ালার সামনে মেয়েদের লাইন, ওষুধের দোকানের সামনে ব্যাজার মানুষের ভিড়, ম্যাক্সির দাম নিয়ে বউদিদের সঙ্গে হকারের গলাবাজি—সব মিলিয়ে স্টেশন রোড জমজমাট। এই গোলকধাঁধা পেরিয়ে, জিটি রোডের বাস-মিনিবাস, লরি-ট্রাক, টেম্পো-ট্যাক্সির নাছোড়বান্দা ট্র্যাফিক জ্যাম টপকালে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা একটি রাস্তায় পৌঁছনো যায়। সেই রাস্তার নাম পান্নালাল রাস্তা। বিলু বলে, ‘কোনও রাস্তার নামে যে ”রাস্তা” শব্দটা থাকতে পারে, সেটা হাওড়ায় না জন্মালে জানা হতো না। ম্যাপে কত কিছু থাকে। হাইওয়ে, রোড, স্ট্রিট, লেন, অ্যাভিনিউ, সরণি, বীথি, গলি। কিন্তু রাস্তা? বাপের জন্মে শুনিনি।’
জিটি রোড আসার আগে সিগারেট শেষ করে বিলু বলল, ‘আগামিকাল কলেজ যাওয়ার জন্যে আমার সঙ্গে বেরোলেও একসঙ্গে কলেজে ঢুকবি না।’
‘কেন?’ রাস্তা টপকাতে টপকাতে প্রশ্ন করে অভি।
‘শাটাপ,’ পান্নালাল রাস্তা ধরে হাঁটছে বিলু। রাস্তার দুদিকে অজস্র গাছ। রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, কদম, বকুল, জারুল, দেবদারু। এই পাড়ায় ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির হিড়িক এখনও শুরু হয়নি। দোতলা, তিনতলা মধ্যবিত্ত বাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এই রাস্তার ওপরে অভি-বিলুর বাড়ি। নাম লক্ষ্মী নিবাস। সামনে একফালি বাগান। সেখানে দোপাটি, গোলাপ, অপরাজিত, ঝাউ, নাইন ও ক্লকের রংবাজি। গেটের মাথায় বুগেনভেলিয়ার ঝাড়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একশো পা হাঁটলেই গঙ্গা।
লক্ষ্মী নিবাসের গেট খুলে নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে হেঁটে বাড়িতে ঢুকল দু’জনে। লক্ষ্মী নিবাসের দোতলায় বসার ঘর, রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, মনোজ-অরুণার শোওয়ার ঘর, বিলুর শোওয়ার ঘর, গেস্টরুম। তিনতলার চিলেকোঠায় অভি থাকে। একতলায় একগাদা ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। ছোট দুটো ঘরে থাকে রাধা আর মানদা। দুই কাজের লোক।
রাধা অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং চরিত্র। বেঁটে, ফরসা, মাথার কদমছাঁট চুল ধবধবে সাদা। সাদা শাড়ি পরে, ব্লাউজ পরে না। বছর ষাটের মহিলার মাথার ব্যামো আছে। নিজের মনে বিড়বিড় করে। ইংরিজিতে লম্বা লম্বা চিঠি লেখে। মাঝে মধ্যেই মাসখানেকের জন্য বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে যায়।
অরুণার কাছে অভি শুনেছে, রাধার বাড়ি ছিল বরিশালের অশথতলা গ্রামে। দেশভাগের পরে উদ্বাস্তু হয়ে নতুন দেশে আসার সময়ে ওর স্বামী মারা যায়। রাধা ধর্ষিতা হয়। তারপর থেকে ও পাগলাটে ধরনের।
রাধার মেয়ে ছায়ার বিয়ে হয়ে গেছে। সে সোনারপুরের দিকে থাকে। রাধা নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে কেউ চিন্তা করে না। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তখন সে ছায়ার কাছে আছে।
রাধা কীভাবে লক্ষ্মী নিবাসে এসে পৌঁছল, এ বিষয়ে অরুণা কিছু জানেন না। বিয়ের পর থেকেই তিনি রাধাকে এই বাড়িতে দেখছেন। মনোজও মুখ খোলেন না। চারবেলা খাওয়াদাওয়া আর থাকার বিনিময়ে বাড়ির কাজ করে দেয়। বেশি অতীত জেনে লাভ কী?
মানদা সম্পর্কে বিলু বলে, ‘মেয়েটা কেমন যেন!’ শুনে অরুণা আর মনোজ মুচকি হাসেন।
মানদার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। মাথায় একঢাল কালো চুল, গলার আওয়াজ বাজখাঁই। লম্বাচওড়া চেহারা। সাজতে খুব ভালোবাসে। কালো চেহারায় একগাদা পাউডার মেখে, জবাকুসুম তেল দিয়ে টানটান করে চুল আঁচড়ে, মাথায় লাল-নীল ফিতে বেঁধে, ঝলমলে শাড়ি পরে থাকে। রাধার মতো সেও এই বাড়ির পুরনো বাসিন্দা। কোথা থেকে এসেছে, এই নিয়ে অরুণা বা মনোজ মুখ খোলেন না। বিলু অবশ্য মানদার ব্যাকগ্রাউন্ড জানে। সে অভিকে বলেওছে। সবটা শুনে বিলু বুঝতে পারে, কেন অরুণা আর মনোজ চুপ করে থাকেন।
একতলায় ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। টপাটপ সিঁড়ি টপকে দুই ভাই দোতলায় এল। মনোজ টিভিতে স্কুপ চ্যানেলে খবর শুনছেন। অরুণা রান্না করছেন। দুই ছেলেকে দেখে বললেন, ‘হাত-মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি খেতে বোস। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।’
নতুনগ্রাম নামে এক পঞ্চায়েত এলাকায় আন্তর্জাতিক হেলথ হাব খোলার জন্য সরকার কর্তৃক জমি অধিগ্রহণ নিয়ে চ্যানেলে আলোচনা হচ্ছে। জনমোর্চা পার্টির সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ সামন্ত সাংবাদিক সম্মেলন করে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। নতুন তৈরি হওয়া রাজনৈতিক দল ‘নবযুগ পার্টি’-র প্রধান মৃন্ময় চ্যাটার্জি টিভির আলোচনাচক্রে সেই সিদ্ধান্তকে তুলোধোনা করছেন।
‘যত্তোসব ছেঁদো কথা!’ রিমোট টিপে চ্যানেল বদলান মনোজ, ‘এরা ভুলে গেছে যে খোদ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এইসব ম্লান মুখে দিতে হবে ভাষা’। কিসসু জানবে না, পড়বে না, খালি ছাগলের মতো চ্যাঁচাবে! ভুঁইফোঁড় পার্টিগুলো কীভাবে যে গজায়, কে জানে? এর পেছনে আমেরিকার ফান্ডিং আছে।’
‘রবি ঠাকুর আবার কবে থেকে তোমাদের পছন্দের লোক হল?’ ডাল সাঁতলাতে সাঁতলাতে প্রশ্ন করেন অরুণা, ‘তিনি তো বুর্জোয়া কবি।’
‘যা বোঝো না তাই নিয়ে কথা বোলো না। ডাল রাঁধছ, সেটা মন দিয়ে করো।’ মনোজ স্কুপ চ্যানেলে ফেরত যান।
বিলু দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকে গেছে। তিনতলার খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে অভির মনে হল, কাল কলেজের প্রথম দিন। যাদবপুর ইউনিভারসিটি নয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ নয়, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ।
চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে বইয়ের তাক থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘কোথাকার তরবারি, কোথায় রেখেছে!’ বইটা পাড়তে গিয়ে অভির চোখে পড়ে যায় ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। পাতা উল্টোতে উল্টোতে সে খুঁজে পায় প্রিয়তম কবিতা, ‘আট বছর আগের একদিন’।
বহুবার পড়া কবিতাটি আরও একবার পড়তে পড়তে আপন মনে হেসে ফেলে অভি। শ্লেষের হাসি। পাঠকের মুড অনুযায়ী কবিতার কত রকম মানে যে বেরোয়! গলা খুলে অভি পড়ে, ‘শোনা গেছে লাশকাটা ঘরে, নিয়ে গেছে তারে।’
অ্যানাটমির ডিসেকশন রুমে কালই একবার উঁকি দেবে নাকি? কবিতার এই পংক্তি তো তাকে নিয়ে লেখা!