বৃন্দা
শান্তিধাম। এস আর দাস রোডে, রবীন্দ্র সরোবরের গায়ে সাদা রঙের চারতলা প্রাসাদ। রাত নটার সময়ে পাঁচিলঘেরা, লোহার গেট লাগানো প্রাসাদের সামনে জনাপঞ্চাশ মানুষের ভিড়। এস আর দাস রোডে দাঁড়িয়ে একাধিক দেশি-বিদেশি গাড়ি। ফুটপাথে সিগারেট ফুঁকছে চিন্তিত মানুষজন।
লোহার গেটটি খোলা। শান্তিধামের ভিতরে ‘ধূমপান নিষেধ’ বলে ধূমপায়ীরা বাইরে পায়চারি করছেন। যাঁদের এই বদভ্যাস নেই, তাঁরা গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অথবা রিসেপশনের সোফায় বসে রয়েছেন ডক্টর সমীরণ ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করার জন্য।
স্যামি ব্যানার্জি। এমবিবিএস (ক্যাল), এমএস (ক্যাল) এফআরসিএস (এডিনবরা), গোল্ড মেডালিস্ট। শান্তিধাম নার্সিং হোমের প্রাণপুরুষ স্যামির নেমপ্লেটে এত কথা লেখা রয়েছে। যা লেখা নেই তা হল, বিদেশি ডিগ্রি অর্জন করার জন্য তিনি অগ্ন্যাশয়ের কর্কট রোগে শল্য চিকিৎসার ভূমিকা নিয়ে যে থিসিস পেপার লিখেছিলেন, তা নতুন শতকের দ্বিতীয় দশকেও আদর্শ থিসিস পেপার হিসেবে ওই দেশে পড়ানো হয়।
স্যামি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের সার্জারির বিভাগীয় প্রধান। চাকরির দায়বদ্ধতার পরে শান্তিধামের প্রধান। পঞ্চাশ শয্যা বিশিষ্ট নার্সিং হোমটিতে শুধু শল্য চিকিৎসার রোগীরা ভরতি হয়। কিছুদিন আগে স্যামি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন ক্যান্সার সেন্টার থেকে খাদ্যনালির ক্যান্সারের শল্য চিকিৎসার বিশেষ কোর্স করে এসেছেন। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ক্যানসার সার্জারি নিয়মিত করলেও শান্তিধামে শুরু করেননি।
শান্তিধাম অর্থবানদের জন্য। এখন এখানে ভরতি আছে টালিগঞ্জের নামকরা অভিনেত্রী চন্দ্রিমা সেন। অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বাইশ বছরের চন্দ্রিমা ওটিতে ঢোকার আগে পঞ্চাশ বছর বয়সি স্যামিকে অনুরোধ করেছিল, ‘পেটে যেন সেলাইয়ের দাগ না থাকে। পরের ছবিতে বিকিনি পরতে হবে।’
চন্দ্রিমা আজ বাড়ি ফিরবে। তার তলপেটের ডানদিকে একটা ছোট সেলাইয়ের দাগ আছে। বিকিনি পরলে সেই দাগ ঢাকা পড়ে যাবে। কেতাবি ভাষায় একে বলা হয় ‘বিকিনি ইনসিশন’ বা ‘বিকিনি ক্ষত’।
স্যামির আর একটা বড় পরিচয় তাঁর বন্ধুগোষ্ঠী। শল্য চিকিৎসক হওয়ার ফলে ডাক্তার সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অফুরন্ত। শল্য চিকিৎসকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘অ্যাসিকন’-এর তিনি প্রেসিডেন্ট, সর্বভারতীয় জার্নালের সম্পাদক। কিন্তু ওগুলো কেজো পদ, কেজো সম্পর্ক। কলকাতার নামকরা কবি, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালকরা তাঁর আসল বন্ধু। ঔপন্যাসিক বিপিন দত্ত, কবি সুদিন চক্রবর্তী, ফিল্ম মেকার মনোতোষ ঘোষ রাত ন’টার পরে গুটিগুটি জড়ো হন শান্তিধামে। সমীরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারটি বদলে যায় স্যামিজ বারে। উপনিষদ থেকে ফ্রয়েড, মার্কস থেকে ফেলিনি, জেমস জয়েস থেকে শাকিরাকে নিয়ে আলোচনা করতে করতে এখানে মদ্যপান হয়।
ঔপন্যাসিক বিপিন ও কবি সুদিন মদের পিপে। মনোতোষও কম যান না। কিন্তু এঁরা জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক। দশ পেগ ভদকা চড়াবার পরে পা না টলিয়ে বাড়ি চলে যান। সমস্যা হয় স্যামির। রাত্তিরে শান্তিধামের কলবুক থাকলে ‘রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার’ বা ‘আরএমও’ কুনাল রায় সামলে দেয়। তাও কখনও সখনও উঠতে হয়। ঘুম ভালো না হওয়ার কারণে পরদিন হ্যাংওভার থাকে। হাসপাতালের চেয়ারে সম্প্রতি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন স্যামি।
এই স্যামিই ছাত্রদের সার্জারি পড়ানো শুরু করার আগে বলেন, ‘সার্জারি মিনস ইউজ অব বোথ হ্যান্ডস। শব্দটার এটিমোলজি ঘাঁটলে দেখা যাবে উৎসে অ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ, ল্যাটিন এবং গ্রিক শব্দ। যার মানে ”ডান বাই হ্যান্ড”। বাংলায় ”সব্যসাচী” বলে একটা শব্দ আছে। সব্যসাচীর অর্থ, যার ডান ও বাঁহাত সমান ভাবে চলে। সব্যসাচীর ইংরিজি হল ”অ্যাম্বিডেক্সট্রাস”। সার্জারি তাই। আমার কাছে, একই সঙ্গে ডান এবং বাঁ হাতের খেলা।’
আরএমও কুনাল রায় চন্দ্রিমার ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখে রেখেছিল। মেয়েটা নিজের ব্যাগপত্তর গুছিয়ে দোতলার কেবিনে বসে কুনালের সঙ্গে গল্প করছিল। পাশে দাঁড়িয়ে শান্তিধামের মেট্রন তাপসী নস্কর। স্যামি কেবিনে ঢুকে বললেন, ‘চলো চন্দ্রিমা, তোমায় নিচে ছেড়ে দিয়ে আসি।’
‘চলুন।’ নিজের ব্যাগ স্যামির হাতে গছিয়ে চন্দ্রিমা বলে, ‘আমার ভারী জিনিস বওয়া বারণ। আপনিই বলেছেন।’
মেট্রন তাপসী নস্কর হাঁহাঁ করে ব্যাগ নিতে আসছিল। স্যামি মুচকি হেসে বললেন, ‘নো প্রবলেম।’ লিফটের দরজা খুলে বললেন, ‘লেডিজ ফার্স্ট।’
‘বাববাহ! কী শিভালরাস! আপনার বয়স কুড়ি বছর কম হলে আপনাকে বিয়ে করতাম।’ লিফটের দরজা বন্ধ হতে বলল চন্দ্রিমা।
‘আমি কুড়ি বছর আগে যা যা পারতাম, এখনও সে সব পারি। কয়েকটা জিনিস বেশি ভালো পারি।’ চন্দ্রিমার চোখে চোখ রেখে বলেন স্যামি।
‘দেখুন, আমি আপনার থেকে দশ বছরের সিনিয়ার একজনের সঙ্গে শুয়েছি। ফিফটি প্লাস লোকজন কী পারে আর কী পারে না, এ নিয়ে আমার পরিষ্কার ধারণা আছে। আমি বলতে চেয়েছিলাম, ইউ আর নট মাই কাপ অফ টি।’
‘শুয়েছ মানে? তোমার হাজব্যান্ড বিশাল কপুরই তো ষাটের কাছাকাছি।’ একতলায় লিফট পৌঁছলে দরজা খুলে বলেন স্যামি। বাইরে দুজন প্রেস ফোটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে রয়েছে। একজন বলল, ‘ম্যাডাম, একটা ফোটো।’
‘জাস্ট আ সেক!’ স্যামির হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ড্রাইভারের হাতে ধরিয়ে চন্দ্রিমা শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে স্যামির হাত ধরে হাসিমুখে বলে, ‘আমি বিশালের কথাই বলছি। হি ইজ ফ্যান্টাস্টিক ইন বেড। বম্বেতে ওর বউ-বাচ্চা আছে। ওর ছেলে ভিকি কপুর আমাকে মা বলে ডাকে। কিন্তু হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে দ্বিতীয় বউ মানে ‘কেপ্ট’। ও সব ভাবলে চলে না। আপনাদের ফোটো হল?’ শেষ বাক্যটি ফোটোগ্রাফারের উদ্দেশে বলা।
‘হ্যাঁ ম্যাডাম।’ বিনয়ী হেসে সরে যায় দুই ফোটোগ্রাফার।
‘তা হলে বিয়ে করলে কেন?’ অবাক হয়ে বলেন স্যামি।
ফক্সভাগেন গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে ড্রাইভার। পিছনের সিটে বসার আগে চন্দ্রিমা বলে, ‘ওটা প্রফেশনাল হ্যাজার্ড। বিশাল কপুর বলিউডের এক্স হিরো। বলিউড কানেকশানের জন্য ওকে পাকড়েছি। আমার যা লাইফস্টাইল, সেটা বাংলা ছবি করে উঠবে না। বিয়ে অথবা হোরশিপটাকে ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ প্রকল্প হিসেবে ধরতে পারেন।’
চন্দ্রিমার কথা শেষ হতেই গাড়ির দরজা বন্ধ করে ড্রাইভার ইঞ্জিনে স্টার্ট দেয়। নিখুঁত চক্কর কেটে গাড়ি শান্তিধাম থেকে বেরিয়ে যায়।
যাঁরা ভিতরে বা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা এতক্ষণ স্যামির কাছে ঘেঁষেননি। এঁরা কলকাতার বিত্তশালী সম্প্রদায়। সিনেমা তারকা দেখে লাফালাফি করা এঁদের স্বভাব নয়। চন্দ্রিমা চলে যাবার পর সবাই একে একে রিসেপশনে জড়ো হল। এখন স্যামি রোগীদের সম্পর্কে বাড়ির লোকদের খোঁজখবর দেবেন। কে ভালো আছে, কার অবস্থা আগের থেকে খারাপ হল। কাকে কাল ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে—এইসব।
বছর চল্লিশের রোগাপাতলা কুনাল রিসেপশানে নেমে এসেছে। সাড়ে পাঁচফুট লম্বা, চোখে বাইফোকাল চশমা, সুস্বাস্থ্য ও একমাথা কোঁকড়া চুলের অধিকারী কুনালের বাড়ি জগদ্দলে। স্ত্রী ও কন্যা সেখানে থাকে। কুনাল সপ্তাহান্তে একবার বাড়ি যায়। সার্জারিতে হাউসস্টাফশিপ করার পরে কুনাল এমএস করে উঠতে পারেনি। শান্তিধামের আরএমও হয়ে এতদিন কাটিয়ে দিল। চল্লিশে এসে আর কোনও রিস্ক নেবে না। এখানেই থেকে যাবে।
কুনালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মেট্রন তাপসী। তার বাড়ি নতুনগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাঁজাপলাশ গ্রামে, হেলথ সেন্টারের পাশে। তাপসী আর স্যামি সমবয়সি। তবে তাপসীকে অনেক বুড়ি লাগে। শান্তিধামের ম্যানেজমেন্ট চালায় কুনাল আর তাপসী। রোগীদের যাবতীয় তথ্য এদের ঠোঁটের ডগায়।
গত দু’দিনে দশটি অপারেশন হয়েছে। বাড়ির লোককে রোগীর সাম্প্রতিক অবস্থা ব্যাখ্যা করতে সময় লাগল একঘণ্টা। দশটা নাগাদ শান্তিধাম ফাঁকা হল। এসআর দাস রোডে আর কোনও গাড়ি দাঁড়িয়ে নেই। রিসেপশন ফাঁকা। স্যামি কুনালকে বললেন, ‘অতঃকিম?’
‘আমি শুতে চললাম। কাল দুপুরে বাড়ি যাব। এখন তোমার কী প্ল্যান?’
‘আমি একটু চেম্বারে বসব,’ সামান্য চিন্তা করে স্যামি বললেন, ‘কাল দুপুরে বাড়ি যাবে? আচ্ছা, যাও।’
‘প্রত্যেক সপ্তাহেই তো যাই। শনিবার হাসপাতালে তোমার কোল্ড ডে। দুটোর মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে।’
তাপসী মাঝখান থেকে বলল, ‘কাল বৃন্দার কলেজের প্রথম দিন। স্যার বোধহয় পুরো সময় কলেজে থাকতে চাইছেন।’
‘ওঃ হো!’ কপাল চাপড়ায় কুনাল, ‘বৃন্দা কি তোমার সঙ্গে কলেজে যাবে? তাহলে আমি তোমার ফেরা অবধি থেকে যাচ্ছি।’
‘এখনও কোনও কথা হয়নি। আজকালকার মেয়েরা কেমন হয়, সে তো জানো!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যামি বলেন, ‘তুমি দেরিতে বাড়ি যাবে এই রকম মেন্টাল প্রিপারেশন নিয়ে রাখো। তেমন হলে সোমবার বাড়িতে কাটিয়ে মঙ্গলবার সকালে এসো। প্ল্যান চেঞ্জ হলে আমি কাল সকালে জানিয়ে দেব।’
‘সোমবার বিকেলে তিনটে গল ব্লাডার অপারেশান আর তিনটে হার্নিয়া অপারেশান রাখা আছে।’ কড়া গলায় বলে তাপসী। ‘কুনাল স্যার না থাকলে অ্যাসিস্ট কে করবে?’
‘ওফ! তুমি ঠাকুরমার ঝুলি এবার বন্ধ করো।’ হাত জোড় করে কুনাল।
‘তা হলে কী খুলব? ঠানদিদির হলে?’ মুচকি হেসে বলে তাপসী।
‘বাপরে! ইনকরিজিবল!’ কুনাল লিফটের দিকে দৌড়োয়। সে দিকে একপলক দেখে তাপসী স্যামিকে বলে, ‘আপনার বন্ধুরা অনেকক্ষণ বসে আছেন। ওঁদের এবার যেতে বলুন।’
‘কেন?’ গম্ভীর গলায় বলেন স্যামি।
‘সেটা আপনি ভালো করে জানেন। আমি ভালো করে জানি। মন্দিরাও ভালো করে জানে। জ্ঞানপাপী সেজে কোনও লাভ আছে?’ তড়বড় করে সিঁড়ির দিকে এগোয় তাপসী।
মন্দিরা মানে স্যামির স্ত্রী। বৃন্দার মা। আটের দশকের ডাকসাইটে অভিনেত্রী। সমীরণকে বিয়ে করে অভিনয় জগৎ থেকে পুরোপুরি সরে আসেন। নব্বই দশকের পরে তাঁর কোনও ছবি মুক্তি পায়নি।
রিসেপশানের বিশাল বেলজিয়ান গ্লাসে নিজেকে মেপে নেন স্যামি। ছ’ফুট লম্বা, অ্যাথলেটিক চেহারা। পঞ্চাশ পেরিয়েও ভুঁড়ি হয়নি। কেন না স্যামি লেকে নিয়মিত রোয়িং করেন। ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের তিনি পুরনো মেম্বার। এ ছাড়া সপ্তাহে তিনদিন জিম করেন। আরমানির স্যুটে ব্যক্তিত্ব ঠিকরে বেরোচ্ছে। মাথা ভরতি চুল সঠিক মাত্রায় নুন মরিচ, পুরু গোঁফেও তাই। পড়াশুনার সময় ছাড়া স্যামি চশমা ব্যবহার করেন না। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে খুশিই হলেন। কপিবুক চিকিৎসকের চেহারা। এই চেহারা দেখেই মজেছিলেন মন্দিরা।
মন্দিরা আদতে নবদ্বীপের মেয়ে। ফরসা, ডল পুতুলের মতো দেখতে। চিত্রপরিচালক মনোতোষ ঘোষের ‘বেপাড়ার মেয়ে’ ছবিতে বারবণিতার চরিত্রে অভিনয় করে বিরাশি সালে তাঁর আত্মপ্রকাশ। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের একাধিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি প্রচুর পুরস্কার জিতে নেয়। সেরা ছবি হিসেবে ভারতেও ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পায়। জনগণ ছবিটি খুব পছন্দ করেছিল। ‘বেপাড়ার মেয়ে’ পঞ্চাশ সপ্তাহ পার করেছিল। পরবর্তী ছ’বছরে মন্দিরা ন’টি ছবিতে অভিনয় করেন। শেষ ছবি ‘অচেনার ডাক’-এর পরিচালকও মনোতোষ।
মন্দিরার সঙ্গে স্যামির আলাপ মনোতোষের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। আলাপ এবং প্রেম। বাংলা গানের লিরিক উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘কিছুতেই পাই না ভেবে, কে প্রথম ভালোবেসেছিল। তুমি না আমি।’
স্যামি সদ্য বিলেত ফেরত। যৌবন গমগম করছে শরীরে। মন্দিরা ডগমগ করছেন সাফল্যের ঔজ্জ্বল্যে। আগুন ও ঘি পরস্পরকে জ্বালিয়ে দিল। মন্দিরা নিজের কেরিয়ার ছেড়ে, আর কোনও ছবি না করে গৃহবধূ হয়ে গেলেন।
বৃন্দার জন্ম উনিশশো বিরানব্বই সালে। বাবা ও মায়ের যাবতীয় গুণ তার মধ্যে বর্তেছে। সে লম্বা, ফরসা, সুন্দরী। একমাথা রেশমের মতো চুল। ঈষৎ ফোলা গালে এখনও বেবি ফ্যাট। ঠোঁট দুটো কমলালেবুর কোয়ার মতো। হাসলে গালে মিষ্টি টোল পড়ে। পড়াশুনায় বৃন্দা আগাগোড়া ব্রিলিয়্যান্ট। মডার্ন হাই স্কুল থেকে বারো ক্লাস পাস করে, মেডিক্যাল এনট্রান্সে চান্স পেয়ে কলকাতার এক নম্বর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি না হয়ে ইন্ডিয়ান মেডিকাল কলেজ বেছে নিয়েছে, কেন না তার বাবা এই কলেজের সার্জারির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। আগামিকাল বৃন্দার কলেজ জীবনের প্রথম দিন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, চুলে হাত বুলিয়ে স্যামি চেম্বারের দিকে এগোলেন। চারতলা শান্তিধামের একদম ওপরের তলা ব্যানার্জি পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট। মাস্টার বেডরুম, বৃন্দার নিজস্ব ঘর, দুটো বড় গেস্ট রুম, দুটো কিচেন, ফুটবল মাঠের মতো ড্রইং রুম, টেরেস গার্ডেন, মন্দির—সব মিলিয়ে এলাহি ব্যবস্থা। তিনতলায় আরএমও আর সিস্টারদের কোয়ার্টার, নার্সিংহোমের কিচেন ও স্টোর রুম। দোতলায় অপারেশান থিয়েটার, রিকভারি রুম, ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট, পেশেন্টের কেবিন ও ডরমিটারি। একতলায় রয়েছে স্যামি এবং অন্য সার্জেনদের চেম্বার, ফার্মাসি, রেডিওলজি এবং প্যাথলজি ডিপার্টমেন্ট, ওয়েটিং রুম, রিসেপশান। অন্য সার্জনরাও শান্তিধামে রোগী ভরতি রেখে অপারেশন করেন।
স্যামির চেম্বারটি রাজকীয়। বড় ঘরের একপ্রান্তে ঘোড়ার খুরের মতো টেবিলের ওপারে বসেন স্যামি। এপারে বসে রোগী ও তাঁর বাড়ির লোক। রোগী দেখার জন্য এক্সামিনেশন বেড পাতা আছে। একদিকের দেওয়ালে অজস্র সার্টিফিকেট ও মানপত্র ঝুলছে। উল্টোদিকের দেওয়ালে যামিনী রায়ের একটি পেইন্টিং। অন্যান্য সময়ে এই ঘরে চড়া আলো থাকে। আপাতত আলো-আঁধারি। সুদিন, মনোতোষ ও বিপিন বড় এক বোতল হুইস্কির অর্ধেক শেষ করে এনেছেন। মনোতোষ এক্সামিনেশান বেডে চিত হয়ে শুয়ে পায়ের ওপরে পা তুলে গান গাইছেন আর সুদিন টেবিলে তাল ঠুকছেন। স্যামিকে দেখে বিপিন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এটা আসার সময় হল? আমরা কতক্ষণ বসে আছি জানিস?’
টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা গেলাসের অর্ধেক হুইস্কি ভরতি করে, বরফ ঠেসে স্যামি বললেন, ‘আজ চন্দ্রিমা সেনের ছুটি হল।’
‘উফ! গুরু! তোমার হাতটা দাও!’ সুদিন লাফিয়ে উঠে স্যামির হাতে চুমু খেলেন।
‘চন্দ্রিমার জিনিসপত্তর কেমন রে?’ এক চুমুকে গেলাস শেষ করে বোতল থেকে ঢকঢক করে হুইস্কি ঢেলে প্রশ্ন করেন বিপিন।
‘নাথিং স্পেশাল। দে আর অল দ্য সেম আন্ডার ক্লোদ।’ মাছি তাড়ান স্যামি। ‘হ্যাঁ রে বিপিন, নতুন কী লিখছিস?’
‘আবার লেখালেখির কথা কেন?’ এক মুঠো বাদাম মুখে দিয়ে বিপিন বলেন, ‘আমি লেখক নই, টেখক।’
‘মানে?’ জানতে চান মনোতোষ।
‘চাকরি করি ”আজ সকাল” খবরের কাগজের রবিবারের পাতায়। যার বিভাগীয় সম্পাদক আমাদের সুদিন। সাংবাদিকতার কাজ মানে বিজ্ঞাপনের ফাঁক ভরানো। ”সব রাঁধুনির মনের কথা এমপি গুঁড়ো মশলা”-র বিজ্ঞাপন আর ”ঢালাইয়ের গোড়ার কথা মহারাজ সিমেন্ট”-এর বিজ্ঞাপনের ফাঁকে যে স্পেস আছে, সেটার জন্য হাজার শব্দের মেটিরিয়াল লাগবে। বিষয়, ”বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ”। ”দুষ্টুমিতে ভরা বুলবুলি ব্রা” আর ”গুন্ডামিতে ভরা বিশাল জাঙিয়ার” বিজ্ঞাপনের ফাঁকে যে স্পেস আছে সেটার জন্য আটশো শব্দের লেখা লাগবে। বিষয়, ”বাংলার মিষ্টি”। নামিয়ে দিই। একে কি লেখা বলে? এ হল ”টেখা”। আর আমি হলাম ”টেখক”। ওসব বাদ দে।’
‘বাংলার মিষ্টি বলতে বাংলা সিনেমার নতুন হিরো দুটোর কথা মনে পড়ল। দেখেছিস? পুরো রসগোল্লা আর পান্তুয়া।’ টিপ্পনি কাটেন মনোতোষ।
‘তা তুমি বাবা একটা সেন্সিবল সিনেমা বানাও না। শুয়ে শুয়ে বাতেলা করে, মদ খেয়ে আর বড় বড় বুকনি ঝেড়ে কতদিন চলবে?’
বিপিন চেয়ার থেকে উঠে মনোতোষের হাত থেকে খালি গ্লাস নিয়ে বলেন, ‘ ”আমার বিধবাপুকুর” উপন্যাসটা গত পুজোয় শারদীয়া ”আজ সকাল”-এ বেরোনোর দিন বিকেলবেলা ফোন করে বললি, আমি যেন লেখাটা কাউকে না দিই। নয়া পয়সা না ঠেকিয়ে চিত্রসত্ত্ব বগলে পুরে বসে আছিস। সেটা নিয়ে ছবি কর। ওর যে প্রট্যাগনিস্ট, ওই যে, কী যেন নাম, মাঝবয়সি বেধবা মাগিটার…’
‘বোঝো কারবার! ঔপন্যাসিক তার চরিত্রের নাম ভুলে গেছে।’ ফোড়ন কাটেন সুদিন।
‘আমি কি বাংলা ভাষার অধ্যাপক নাকি যে নিজের লেখা সব চরিত্রের নাম মুখস্থ রাখব?’ দাঁত খিঁচিয়ে বিপিন বলেন, ‘মনে পড়েছে। বেদানা দাসি। ওই বেদানার বেদনা নিয়ে ছবি কর। পিরিয়ড পিস। বহুবিবাহের পটভূমি। জমবে ভালো। নে, মাল খা।’
বিপিনের হাত থেকে ভরতি গেলাস নিয়ে উঠে বসে মনোতোষ বলেন, ‘ছবি করতেই পারি। প্রোডিউসারও আছে।’
‘তা হলে আর দেরি কেন?’ নেশাগ্রস্থ গলায় বিপিন বলেন, ‘তুই ছবিটা বানিয়ে ফেল। চন্দ্রিমা সেনকে বেদানা দাসির রোল দে।’
‘মাঝবয়সি বিধবার রোলে চন্দ্রিমাকে মানাবে না।’ অন্যমনস্কভাবে গেলাসে চুমুক দেন মনোতোষ, ‘তা ছাড়া ওর বিউটিটা বড্ড আরবান। ভোলেভালা, গ্রাম্য, ঢলোঢলো সৌন্দর্যওয়ালা মাঝবয়সি নায়িকা একজনই আছে। সে না করলে ওই ছবি আমি করব না।’
‘কের্যা? তোর স্বপ্নে দেখা রাজকন্যাটি কে?’ সুদিনের নেশা হয়ে গেছে।
‘স্যামি, তোর বউকে আবার অ্যাক্টিং করতে দিবি?’ মনোতোষ প্রশ্ন করেন।
‘মন্দিরা?’ গ্লাসের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করেন স্যামি, ‘সেটা আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করছিস? ওকে জিজ্ঞাসা কর। আমি তো কখনও মন্দিরাকে অ্যাক্টিং করতে বারণ করিনি। বিয়ের পর ও নিজে থেকেই সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছে। এখনও নিয়মিত টিভি সিরিয়াল আর যাত্রার অফার আসে। রাজি হয় না।’
‘সেন্সিবল লোকজন ভাঁড়ামো করতে রাজি হবে না এটাই স্বাভাবিক।’ হাতের গ্লাস ঠক করে টেবিলে রেখে মনোতোষ বলেন, ‘তুই একবার কথা বলে দেখ। আমার স্ক্রিপ্ট রেডি আছে। দরকার হলে একদিন এসে মন্দিরাকে শোনাব। রাজি হলে ভালো। রাজি না হলে ”বিধবাপুকুর” আমি করব না। বেদনা দাসীর চোখের যে বর্ণনা বিপিন লিখেছে, আর আমি যেভাবে ভিশুয়ালাইজ করেছি—তাতে মন্দিরা ছাড়া অন্য কারও মুখ মাথায় আসে না।’
সুদিন কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে বললেন, ‘এগারোটা বাজে। আমি যাব সেই বরানগর। এত রাতে কোনও ট্যাক্সি যেতে চায় না।’
‘আমার গাড়িতে তোকে শেয়ালদা পর্যন্ত ছেড়ে দিতে পারি।’ বিপিন প্রস্তাব দিলেন।
‘উপন্যাসের রয়্যালটির টাকায় রোয়াবি হচ্ছে? জানিস, তুই কবি সুদিন চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলছিস? আজ থেকে তিরিশ বছর বাদে যার লেখা কবিতা বাঙালি পাঠক অল্পবিস্তর বুঝতে পারবে।’
‘তার মানে দু’হাজার চল্লিশ সালে?’ আঙুলের কড় গুণে বিপিন বলেন, ‘শব্দের গতিবেগ আলোর থেকে কম। লিখিত শব্দের গতি কচ্ছপের থেকেও কম দেখছি।’
হাহা করে হাসতে হাসতে বিপিন আর মনোতোষ চেম্বার থেকে বেরোলেন। অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে তাদের ধাওয়া করেছেন সুদিন। গেটের পাশে বেঞ্চিতে বসে দারোয়ান-কাম-ড্রাইভার সুলতান সিং ঝিমোচ্ছিল। মালিকের বন্ধুদের দেখে তড়াক করে উঠে সেলাম ঠুকে দরজা খুলে দিল।
মনোতোষ বেনেপুকুরে থাকেন। তিনি নিজে গাড়ি চালান। বিপিন থাকেন বেলেঘাটার রানি রাসমণি বাজারে। তাঁর ড্রাইভার আছে। সুদিন বিপিনের গাড়িতে উঠলেন। দুটো গাড়ি বেরিয়ে যাবার পরে মুচকি হাসলেন স্যামি। বিপিন সুদিনকে বরানগরে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তবে বেলেঘাটা ফিরবেন। যদি না দুজনে কোনও চুল্লুর ঠেকে আটকে পড়েন। বাইরে যতই ঝগড়া করুক না কেন, দুজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।
সুলতান গেট বন্ধ করে দিয়েছে। রিসেপশান ফাঁকা। লিফট করে স্যামি চারতলায় উঠে এলেন। বসার ঘরে বৃন্দা টিভিতে আমেরিকান সিরিয়ালের রি-রান দেখছে।
‘খাবি না?’ প্রশ্ন করেন স্যামি।
‘খাব।’ সংক্ষিপ্ত জবাব বৃন্দার।
‘মা কোথায়?’
‘খাবার টেবিলে।’ টেলিভিশন থেকে চোখ না সরিয়ে উত্তর দেয় বৃন্দা।
‘আমি পোশাক বদলে আসছি। তুই আয়।’ মেয়ের চুল ঘেঁটে বাথরুমে ঢুকে যান স্যামি। স্নান করে, পাজামা পাঞ্জাবি পরে খাবার টেবিলে বসেন। চেয়ারে বসে গত বছরের পুজো সংখ্যা ‘আজ সকাল’ পড়ছিলেন মন্দিরা। পত্রিকা চেয়ারে রেখে বললেন, ‘লুচি আর পাঁঠার মাংস করেছি।’
পোর্সোলিনের থালায় গরম গরম লুচি আর বাটিতে মাংস এগিয়ে দেন মন্দিরা। একটা বড় থালায় টমেটো, পেঁয়াজ আর শসা কেটে স্যালাড বানানো রয়েছে। সেটাও এগিয়ে দেন। নিজের জন্য একটা লুচি আর এক পিস মাংস নিলেন।
‘আর নেবে না?’ কচকচ করে পেঁয়াজ চিবিয়ে জানতে চাইলেন স্যামি।
‘না।’ খাবার খুঁটতে খুঁটতে শারদীয় হাতে তুলে নিয়েছেন মন্দিরা। বৃন্দা টুকটুক করে এসে স্যামির পাশে বসেছে। নিজেই মাংস আর লুচি নিল। পত্রিকা রেখে মন্দিরা বললেন, ‘বৃন্দা কলেজে যাতায়াত করবে কীভাবে? তোমার গাড়িতে?’
এক টুকরো মাংস মুখে ফেলে স্যামি বললেন, ‘কলেজে নানারকমের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ছেলেমেয়েরা আসে। চাষার ছেলে, মজুরের ছেলে, কেরানির মেয়ে, মন্ত্রীর মেয়ে। প্রথম দিন থেকেই গাড়ি করে কলেজে যাওয়া উচিৎ না। মেলামেশায় অসুবিধে হয়। বৃন্দা আমার সঙ্গে বেরোবে। আমি ওকে মৌলালিতে নামিয়ে দেব। বাকিটা হেঁটে কলেজে ঢুকবে। কয়েকদিন এইরকম চলুক। রুট চেনা হয়ে গেলে বাসে যাতায়াত করবে।’
‘ও কি পারবে? কখনও তো বাস-টাসে চড়েনি…’ কিন্তু কিন্তু করেন মন্দিরা।
‘পারব।’ বৃন্দা বলল।
‘সেকেন্ডলি,’ আর একটা লুচি মুখে পুরে স্যামি বৃন্দাকে বললেন, ‘কলেজে কখনও বলবি না যে তুই সার্জারির এইচওডি-র মেয়ে। বিভিন্ন সাবজেক্টের টিচার বা ইউনিয়নের ছেলেরা প্রথম দিন এসে কী নাম, কোন স্কুল—এই সব জিজ্ঞাসা করবে। তোর র্যাঙ্ক দেখে জানতে চাইবে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে না গিয়ে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে কেন এলি। নিজের মতো উত্তর দিবি। আমাকে টানবি না।’
‘আচ্ছা।’
‘কেন? তোমার নাম বললে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?’ খাওয়া শেষ করে বলেন মন্দিরা। কাজের লোক ঝুনুর মা এসে থালা তুলে নিয়ে যায়।
‘অ্যাডভান্টেজ নেওয়া হবে। সিনিয়র বা ব্যাচমেটরা ওর সঙ্গে সহজভাবে মিশবে না। এনিওয়ে, ওসব বাদ দাও। বৃন্দা, তুই শুতে যা। কাল সাড়ে আটটায় বেরোব।’ বেসিনে মুখ ধুলেন স্যামি। শোওয়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। মন্দিরা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে অ্যান্টি-রিঙ্কল ক্রিম লাগাচ্ছেন। খাটে শারদীয়া ‘আজ সকাল’ পত্রিকা রাখা রয়েছে।
‘এত মন দিয়ে কী পড়ছ?’ গাবদা পত্রিকা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করেন স্যামি।
‘তোমার বন্ধু বিপিন দত্ত একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। নাম ‘বিধবাপুকুর’। সাধুভাষায় লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস দেখে এতদিন হাত দিইনি। আজ পড়তে বসে আটকে গেলাম। অসাধারণ উপন্যাস।’
‘তাই? ইন্টারেস্টিং নাম তো!’ পত্রিকা হাতে নিয়ে বলেন স্যামি। ‘এই কাগজটা মায়া কমিউনিকেশানস থেকে বেরোচ্ছে না? বিবস্বান সান্যাল যার মালিক?’
‘আমি অত জানি না বাবা। লেখকের নাম জানি। মালিকের খবর রাখি না।’ মুখে ক্রিম লাগাতে লাগাতে বলেন মন্দিরা। একটু পরে ফুরফুর আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন বুকের ওপরে পত্রিকা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন স্যামি। পুজোসংখ্যা পড়ার জন্য রিডিং গ্লাস পরেছিলেন। সেটা নাকে আটকে রয়েছে। ঠোঁটদুটো আধখোলা। সেখান দিয়ে বাতাস বেরিয়ে ফুরফুর আওয়াজ করছে।
স্যামির চোখ থেকে চশমা খুলে নিলেন মন্দিরা। বুক থেকে বই সরিয়ে টেবিলে রাখলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘অ্যাই! সোজা হয়ে শোও। আমার শোওয়ার জায়গা দখল করে নিয়েছ।’
স্যামি গভীর কোহলঘুমে আচ্ছন্ন।
‘মা! একবার আসব?’ বাইরে থেকে বৃন্দা বলে।
বন্ধ দরজা খুলে মন্দিরা বলেন, ‘কী হল রে?’
‘বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে?’ ইতস্তত করে বৃন্দা।
‘কেন রে? কলেজের প্রথম দিন বলে টেনশান হচ্ছে?’ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খাটের একপাশে বসালেন মন্দিরা।
‘বাবা সাড়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে যাবে। আমার ক্লাস দশটা থেকে শুরু। অত আগে বেরিয়ে আমি কী করব?’
‘কাল সকালে বাবাকে জিজ্ঞাসা করে নিবি। এখন ঘুমিয়ে পড়।’ মন্দিরা মতামত দিলেন। মায়ের সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বৃন্দা।
দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে বিছানার কাছে এসে মন্দিরা দেখলেন, স্যামি ভব্যিযুক্ত হয়ে খাটের একপাশে শুয়ে। নাক আর ডাকছে না। মশারি গুঁজে স্বামীর পাশে শুয়ে তিনি আলো নিবিয়ে দিলেন। শারদীয়া ‘আজ সকাল’ পত্রিকার কথা তাঁর আর মনে নেই।
পুজো সংখ্যাটি আপাতত স্যামির বালিশের তলায় রাখা রয়েছে।