» » দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

অভিজ্ঞান

‘ঢুকতে কষ্ট, ঢুকে কষ্ট, বেরোতে কষ্ট, বেরিয়ে কষ্ট। বল তো কী?’ অভিকে প্রশ্ন করল সাড়ে ছ’ফুট লম্বা একটা ছেলে। মানানসই রকমের চওড়া। একটু আগে যখন হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়েছিল, অভির মনে হয়েছিল ছেলেটার কবজি তার থাইয়ের মতো চওড়া।

‘জানি না।’ ঘাড় নাড়ল অভি। প্রথম দিন কলেজে ঢুকে এ কী বিড়ম্বনা! একেই কি ইন্ট্রো অথবা র‌্যাগিং বলে?

‘বলতে না পারলে আর এগোনো যাবে না গুরু। অ্যাট লিস্ট ইউ শুড ট্রাই।’ বলল সাড়ে ছফুট।

ইংরিজি? মনে মনে খাবি খেল অভি। ক্লাস ওয়ান থেকে বাংলা মিডিয়ামে পড়াশুনা করেছে। গড়গড়িয়ে ইংরিজি পড়তে আর লিখতে পারে। বুঝতে পারাটাও সমস্যা নয়। কিন্তু ইংরিজি বলা? অসম্ভব ব্যাপার। এখন কী ভাবে উদ্ধার পাবে এই দানবের হাত থেকে?

‘আমাদের জীবন স্যার। আই মিন লাইফ।’ মিনমিন করে বলে অভি।

‘তুই আমাকে স্যার বললি?’ সরু চোখে তাকায় দানব। ‘নির্ঘাত বাংলা মিডিয়াম? লেখাপড়াই শুধু শিখেছিস। দুনিয়াদারি শিখিসনি। চল তোকে মুরগি করি।’

এক ঝটকায় অভিকে কোলে তুলে নেয় দানব। ‘বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম রিপুদমন কর। লোকে রিপুদা বলে ডাকে। তুই আমায় কী বলে ডাকবি?’

‘রিপুদা, আমায় নামিয়ে দাও। প্লিজ।’

অভিকে কাঁধে নিয়ে কলেজ ক্যান্টিনে ঢোকে রিপু। একটা লম্বা টেবিলের চারদিকে অনেক ছেলেমেয়ে বসে। পাঁজাকোলা করে অভিকে টেবিলের মাঝখানে শুইয়ে দেয়। অভি ধড়মড় করে উঠতে যাচ্ছিল। রিপু প্রকান্ড ঘুষি পাকিয়ে বলল, ‘উঠলে থোবড়া বিলা করে দেব। শুয়ে থাক। তোর এখন ডিসেকশান হবে।’ অভি চোখ বুঁজে শুয়ে রইল।

‘বাড়ি কোথায়?’ পায়ের কাছ থেকে প্রশ্ন করল মোটা একটা মেয়ে।

‘বেলুড়।’

‘কোন স্কুল?’

‘উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট স্কুল।’

‘ইঞ্জিনিয়ারিং-এ র‌্যাঙ্ক কত?’

‘তিনশো চার।’

‘মেডিক্যাল?’

‘দুশো পঞ্চাশ।’

‘বাবা-মা কী করে?’

‘বাবা চাকরি। মা কিছু না।’

‘তার মানে ফার্স্ট জেনারেশন ডাক্তার। বল তো, ‘ঢুকতে কষ্ট, ঢুকে কষ্ট, বেরোতে কষ্ট, বেরিয়ে কষ্ট’। এটা কী? বাই দ্য ওয়ে আমার নাম আপ্পু। সবাই আমায় আপ্পুদি বলে ডাকে। তুইও তাই বলবি।’

অনেককাল আগে, এশিয়াডের ম্যাসকট ছিল নৃত্যরত হাতি। নাম আপ্পু। এই আপ্পুর নাম যে-ই দিয়ে থাকুক, ঠিক দিয়েছে।

অভির মাথায় আপ্পুর বলা ধাঁধাঁ ঘুরপাক খাচ্ছে। একই ধাঁধাঁ একটু আগে রিপু জিজ্ঞাসা করেছিল। তখন উত্তর দিতে পারেনি। এবার পারবে। কেন না ক্লু হিসেবে চলে এসেছে আপ্পুর ফার্স্ট জেনারেশান ডাক্তার সংক্রান্ত উক্তি।

‘ডাক্তারি।’ জবাব দেয় অভি। ‘মেডিক্যাল প্রফেশন। এখানে ঢুকতে যে খুব কষ্ট সেটা বোঝা হয়ে গেছে।’

টেবিলের চারদিকে চটরপটর হাততালি, হর্ষধ্বনি, শিস ইত্যাদি শোনা যায়। রিপু চিৎকার করে বলে, ‘জীবনদা, একে একটা ডবল ডিমের মামলেট খাওয়াও।’

অভি চোখ খুলে শবাসন থেকে উঠে বসে। এবার আপ্পু তাকে কোলে নেয়। এক ঝটকায় টেবিল থেকে মেঝেতে নামিয়ে বলে, ‘ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ। বল তো, বর্ষাকালে ছাতা না থাকলে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে কেন বেরোনো উচিৎ?’

এই রে! এ আবার কীরকম প্যাঁচালো প্রশ্ন? মাথা-টাথা চুলকে অভি বলল, ‘জানি না।’

‘কেন না, ‘ইয়ে ঘন্টো তক গিলেপন কা অ্যাহেসাস ভি না হোনে দে।’ বুঝলি?’ চোখ পাকিয়ে দাবড়ানি দেয় আপ্পু।

‘হ্যাঁ।’ লজ্জা লজ্জা মুখে বলে অভি।

‘ক্যান ইউ সি ইয়োরেনাস উইথ ইয়োর নেকেড আই?’ পাশ থেকে প্রশ্ন করে আর একজন। এ আবার কে রে বাবা? অবিকল টিনটিনের মতো দেখতে। গোল মুখ, পুঁটলির মতো নাক, গুল্লি গুল্লি চোখ, মাথার চুল জেল দিয়ে ওপরে তোলা। প্রশ্ন করছে ইংরিজিতে। অভি মনে মনে এর নাম দিল টিনটিন। সে টিনটিনকে স্মার্টলি বলল, ‘নো।’

‘আই সে ইয়েস।’ বলে টিনটিন।

অভি বলে, ‘হাউ?’

অভির প্রশ্ন শুনে টেবিলের চারপাশে বসে থাকা সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে। অভি বুঝতে পারে না কেন। সে আবার বলে, ‘হাউ?’

‘ইউ রিয়্যালি ওয়ান্ট টু নো?’ ফচকে হেসে টিনটিন বলে, ‘ওকে, স্টেপ ওয়ান। বেন্ড ইয়োর ওয়েস্ট অ্যাট নাইন্টি ডিগ্রি।’

নব্বই ডিগ্রিতে কোমর বাঁকাতে হবে? এটার মধ্যে কোনও একটা ফাঁদ আছে। এতক্ষণে বুঝতে পারে অভি। সে বলে, ‘আমি ক্লাসে যাচ্ছি। পরে হবে।’

‘শাটাপ ইউ অ্যাস হোল। যা বলছি কর। না করলে ক্যালাব।’ টিনটিনের ধমক শুনে অভি সামনের দিকে নব্বই ডিগ্রি ঝোঁকে। ভয়ের চোটে তার বুক দুরদুর করছে।

‘স্টেপ টু। বেন্ড ইয়োর নি-জ বাই ফর্টি ফাইভ ডিগ্রি।’

এই অবস্থায় হাঁটু পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি বাঁকাতে হবে। সে তো অসম্ভব ব্যাপার! তাও চেষ্টা করে অভি। পেরেও যায়। এখন সে নিজের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে বাকিদের দেখতে পাচ্ছে।

টিনটিন আপ্পুর কানে কী একটা বলল। আপ্পু নিজের ঝোলা থেকে গোল মতো একটা জিনিস বার করে টিনটিনের হাতে দিল। টিনটিন সেটা অভির হাতে ধরিয়ে বলল, ‘পুট দিস মিরর বিটুইন ইয়োর লেগস।’

আপ্পুর আয়না নিজের পায়ের ফাঁকে ধরে অভি। টিনটিন বলে, ‘ক্যান ইউ সি ‘ইয়োর অ্যানাস’? না প্যান্ট খুলতে হবে?’

তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় অভি। আপ্পুকে আয়না ফেরত দিয়ে চোখ মোছে। আপ্পু বলে, ‘তুই কাঁদছিস? পাগল নাকি? এরপরে তো সুপারকে রিপোর্ট করবি যে র‌্যাগিং করা হয়েছে। অ্যাই টিনটিন, মাফ চা।’

এর নাম সত্যিই টিনটিন? হেসে ফেলে অভি। জীবনদা ওমলেট নিয়ে এসে বলে, ‘একইসঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে? আজব চিড়িয়া! একে পেলে কোথা থেকে?’

অভি মাথা নিচু করে ওমলেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। সব্বাই তাকে মুরগি করছে। ক্যান্টিনের ওয়েটারও।

আপ্পু অভির মনের অবস্থা ধরতে পেরেছে। সে বলল, ‘মামলেট খেয়ে দৌড় দে। এলএলটিতে তোদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। প্রথম দিন দেরি করলে এনজি ঝাড় দেবে।’

‘এলএলটি মানে?’ ওমলেট খেতে খেতে প্রশ্ন করে অভি।

‘এলএলটি মানে লার্জ লেকচার থিয়েটার। এখান থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ইটের তৈরি যে লাল বাড়িটা দেখতে পাবি, সেটাই এলএলটি। আর মাঠের ওপারে ওই যে সাদা রঙের একতলা বাড়িটা দেখছিস, ওটার নাম এসএলটি। মানে স্মল লেকচার থিয়েটার। এখন এলএলটিতে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রির এইচওডিরা তোদের জ্ঞান দেবেন। শেষ হলে সবাই মিলে এসএলটিতে আসবি। ওখানে আমরা তোদের জ্ঞান দেব। বুঝলি?’

‘বুঝলাম,’ ওমলেট শেষ করে অভি বলে, ‘ওমলেটের দাম কত?’

‘মামলেট না বলে ওমলেট বললি? তাহলে ওমলেট বানান বল।’ হুঙ্কার ছাড়ে রিপু, ‘ভুল বললে দশজনের মামলেটের দাম দিতে হবে।’

‘ও-এম-এল-ই-টি-টি-ই,’ জবাব দেয় ইংরিজিতে অল্পের জন্য লেটার মিস করা অভি।

‘ফোট।’ মাথায় রামগাঁট্টা লাগায় রিপু। ঝোলা কাঁধে এলএলটির দিকে দৌড় লাগায় অভি। ডাক্তারি পড়তে আসার প্রথম দিনে ক্লাস যেন মিস না হয়।

এলএলটির দরজায় শাড়ি পরে দু’জন সিনিয়র দিদি দাঁড়িয়ে। হাতে গোলাপ ফুল। অভি নিতে যাবে, এমন সময় কোত্থেকে দৌড়ে এল সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে। কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা। ঘাড় পর্যন্ত চুল। গায়ের রং ফ্যাকাশে সাদা। চোখে কালো, মোটা ফ্রেমের চশমা। শাড়ি পরা দিদির হাত থেকে গোলাপ ফুল নিয়ে, অভিকে ডজ মেরে আগে ঢুকে গেল।

গোলাপ ফুল নিতে নিতে অভি বলে ফেলল, ‘আস্তে লেডিস! কোলে বাচ্চা!’ শাড়ি পরা দুই দিদি তার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাল এবং হাসল। ঝোলাওয়ালি ঘুরেও দেখল না। অভি তড়বড় করে এলএলটির ভিতরে ঢুকল।

আলো থেকে অন্ধকার ঘরে ঢুকলে আরও অন্ধকার লাগে। অভিরও তাই হল। আবছা আঁধারে বুঝতে পারল, এটা একটা গ্যালারি। অর্ধগোলাকৃতি বিশাল হলঘর জুড়ে কাঠের গ্যালারির বিস্তৃতি। গ্যালারির সামনে স্টেজ। স্টেজে দুজন মাঝবয়সি মহিলা বসে রয়েছেন।

‘এদিকে আয়।’ অভির হাত ধরেছে কেউ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, ঝোলাওয়ালি। ‘তোত-তোমার নাম কী?’ প্রশ্ন করে অভি।

‘তুমি আবার কী? ক্লাসমেটকে কেউ তুমি বলে? আমার নাম দময়ন্তী সেনগুপ্ত। ডাকনাম দিঠি। তোর কী নাম?’ এক হ্যাঁচকায় অভিকে গ্যালারির প্রথম ধাপে তুলে নেয় দময়ন্তী, ‘চল। একদম পিছনে বসি। ওখান থেকে ভালো দেখা যাবে।’

পিছনের সিটে বসে অভি নিজের নাম বলে। প্রশ্ন করে, ‘তোর বাড়ি কোথায়?’

‘দিল্লি। কলকাতার বাড়িটা কেমন, এখনও দেখা হয়নি। ওসব ছাড়। ওই দ্যাখ কে আসছে।’ আঙুল নাড়ে দময়ন্তী।

মূল গেট দিয়ে ঢুকছে মিলিটারির মতো গোঁফওয়ালা, কালো, মোটা একটা লোক। পরনে প্যান্ট-শার্ট। কাঁধে ঝুলছে আস্ত কঙ্কাল। হাড়গুলো তার দিয়ে জোড়া। লোকটা প্যান্টশার্টের বদলে চোগা-চাপকান পরে থাকলে তাকে এবং তার কাঁধের প্রপকে বিক্রম আর বেতালের দৃশ্য বলে চালানো যেত। স্টেজে একটা কাঠের ফ্রেম রয়েছে। সেখানে আংটার সাহায্যে কঙ্কাল ঝুলিয়ে দেওয়া হল।

ক্লাসশুদ্ধ সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। অভি বলল, ‘ইনিই কি অ্যানাটমির এইচওডি?’

‘সিট ডাউন।’ স্টেজ থেকে চিল চিৎকার করলেন মাঝবয়সি এক মহিলা। আধো অন্ধকারে দেড়শো জন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে পড়ল। মোটা লোকটার বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন মহিলা। তারপর বললেন, ‘শেম অন ইউ। ওর নাম কালুয়া। ও ডোম। তোমরা ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে গ্রিট করলে। আমাদের দেখে একবারও ওঠোনি।’

‘সেটা আপনাদের সমস্যা। আমাদের নয়।’ বলল দময়ন্তী। কথাটা বলেই ডেস্কের নীচে লুকিয়ে পড়ল। ঠিক সামনের সিটে বসে থাকা একটা মেয়ে সেটা শুনে ফিশফিশ করে বলল, ‘আমিও এটাই ভাবছিলাম।’

এলএলটি জুড়ে পিনপতনের স্তব্ধতা। ‘কে বলল? কে বলল কথাটা?’ আবার চ্যাঁচালেন মহিলা। কেউ কোনও উত্তর দিল না।

সাদা জামা এবং সাদা প্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক স্টেজে উঠছেন। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। কাচের ফাঁকে ঝিকমিকোচ্ছে মেধাবী দৃষ্টি। কাউকে কিছু বলতে হল না। দেড়শো ছাত্রছাত্রী এক সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের অ্যানাটমির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট নীলাক্ষ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে এনজিকে।

‘সিট ডাউন প্লিজ।’ পোডিয়ামের মাইক্রোফোনে মুখ রেখে মৃদু গলায় বললেন এনজি। সবাই বসে পড়ল। দময়ন্তীও ডেস্কের তলা থেকে উঠে বসল। সামনের সিটের মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে দময়ন্তীকে বলল, ‘ওয়েল সেড।’

‘ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, প্রিভিয়াসলি নোন অ্যাজ রবিনসন হসপিটাল। দিস কলেজ হ্যাজ গট আ চেকারড হিসট্রি অফ ওয়ান হানড্রেড অ্যান্ড ফিফটি ইয়ার্স…’

এনজির স্বাগত ভাষণের ফাঁকে দময়ন্তী সামনের মেয়েটার কাঁধে টোকা দিল। ‘নাম কী? কোন স্কুল?’

‘বৃন্দা ব্যানার্জি। মডার্ন হাই স্কুল।’ মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিল মেয়েটা। অল্প আলোয় অভি দেখল, বৃন্দা মার্বেল পাথরের মতো ফরসা আর চকচকে। ভুরু দুটো তুলির টানে আঁকা। পাতলা লাল টুকটুকে ঠোঁট। বারবি ডলের মতো দেখতে।

‘এমা, তুই তো সিকনির মতো ফর্সা! লজ্জা করে না?’ বলল দময়ন্তী।

‘তুইও তো আমারই মতো ফ্যাকাশে। তোর লজ্জা করে না?’ জানতে চায় বৃন্দা।

‘আর বলিস না।’ বিরক্তি ঝরে পড়ে দময়ন্তীর গলায়, ‘কলকাতার রোদে যদি কালো হওয়া যায়।’

এনজি-র কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘মিট ডক্টর পার্বতী মুখার্জি, হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট, ফিজিওলজি। অ্যান্ড ডক্টর আরতি মজুমদার, হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট, বায়োকেমিস্ট্রি। এমবিবিএস শব্দটার ফুল ফর্ম ব্যাচেলার অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলার অব সার্জারি। তোমাদের চার বছরের এমবিবিএস কোর্সে তিনবার ইউনিভার্সিটি পরীক্ষা দিতে হবে। ফার্স্ট, সেকেন্ড অ্যান্ড ফাইনাল এমবিবিএস। ফার্স্ট এমবিবিএস এক বছরের কোর্স। এতে তোমাদের তিনটে সাবজেক্ট পড়তে হবে। অ্যানাটমি, ফিজিওলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রি। সুতরাং আগামী এক বছরের জন্য তোমাদের ভাগ্য আমাদের তিনজনের হাতে। কারও কোনও প্রশ্ন আছে?’

‘ইয়েস স্যার!’ ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে একটা হাত উঠল।

‘স্ট্যান্ড আপ অ্যান্ড গিভ ইয়োর ক্রেডেনশিয়াল।’ বললেন এনজি।

ছেলেটি উঠে দাঁড়াল কিন্তু কোনও কথা বলল না। সমস্যা বুঝতে পেরে এনজি বাংলায় বললেন, ‘নাম বলো। কোন স্কুলের ছাত্র সেটা বলো। তারপর প্রশ্ন বলো।’

‘চন্দন সরকার। স্যামিলটন হাইস্কুল। নতুনগ্রাম।’ মিলিটারি অর্ডারের কায়দায় হাঁফ পেড়ে ঘোষণা করল ছেলেটি। ক্লাসরুমে হাস্যরোল উঠল।

‘তোমার প্রশ্নটা কী?’ এনজি বললেন।

‘এমবিবিএস এর ফুল ফর্ম কী করে ‘ব্যাচেলার অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলার অব সার্জারি’ হয়? ‘বি-ও-এম-এ-বি-ও-এস’ নয় কেন?’

“বোমা বস” ‘বলছ?’ হাসলেন এনজি। ‘এমবিবিএস-এর পুরো কথাটা হল, ‘মেডিসিনে বাক্কালরিয়াস বাক্কালরিয়াস চিরারজি।’ এটা ল্যাটিন কথা। যার মানে ব্যাচেলর অব মেডিসিন অ্যান্ড ব্যাচেলর অব সার্জারি। কী ম্যাডাম, আপনি কী বলেন?’

এনজির আমন্ত্রণে উঠে দাঁড়ালেন যে মহিলা, তিনিই কিছুক্ষণ আগে চিল চিৎকার করেছিলেন। তিনি মাইকের সামনে এসে চ্যাঁচালেন, ‘আয়্যাম ডক্টর পার্বতী মুখার্জি, এইচওডি ফিজিওলজি। তোমরা এত হ্যাফাজার্ড ভাবে বসেছ কেন?’

অভি বুঝল মহিলার স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে বাধা। মাইকেও চ্যাঁচাচ্ছেন। হালকা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরেছেন। বাঁহাতে সরু রিস্টওয়াচ। শাঁখা-পলা বা সিঁদুর নেই।

‘বয়েজ অ্যাট দ্য টপ অ্যান্ড গার্লজ অ্যাট দ্য বটম। মেয়েরা সামনের সারিতে চলে এসো। একসঙ্গে বসবে না। হারি আপ।’ চ্যাঁচালেন পার্বতী মুখার্জি বা পিএম। এই কথায় এলএলটিতে বেজায় গন্ডগোলের সৃষ্টি হল। টপ ও বটমের আইডিয়া নিয়ে খানিক হাসাহাসির মধ্যে অভি দেখল দময়ন্তী আর বৃন্দা ফার্স্ট বেঞ্চে চলে গেছে। তার পাশে এসে বসেছে ‘বোমা বস’ ওরফে চন্দন সরকার। অভি ফিসফিস করে বলল, ‘চন্দন সরকার? যে এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়েছে?’

চন্দন লাজুক মুখে ইতিবাচক ঘাড় নাড়ল।

অভির মনে পড়ল খবরের কাগজে দেখা চন্দনের ছবিসহ ইন্টারভিউ। চন্দনের বাবা কোর্টের করণিক এবং কৃষক। মা গৃহবধূ। স্বামীকে চাষের কাজে সাহায্য করেন। খেতের কাজ সেরে দু’বেলা পড়াশুনা করতে হতো চন্দনকে।

অভির প্রাথমিক অনুভূতি হল ঈর্ষার। সবুজ রঙের একটা ছোট্ট সাপ বুকের বাঁদিকে মৃদু ফনা দোলাচ্ছে। সে মফসসলের মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে। জীবনে কোনও ক্রাইসিস নেই, কোনও স্ট্রাগল নেই। পাঁচজন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া, করেসপন্ডেস কোর্স আর মকটেস্টের সাহায্যে সে যতদূর গেছে, এই চাষার ছেলেটা বিনা অস্ত্রে সেই দূরত্ব টপকেছে অনায়াসে। অভির পিছনে দারিদ্রের চালচিত্র নেই বলে সে মহান নয়? নাকি সে চন্দনের মতো যথেষ্ট প্রতিভাবান নয়? নাকি দুটোই?

স্টেজে বক্তব্য রাখছেন আরতী মজুমদার ওরফে এএম। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স। পোশাক-আশাক নজরকাড়া। সাদা কালো কম্বিনেশনের কটকি শাড়ি আর টকটকে লাল রঙের ব্লাউজ। গলায় রূপোর হাঁসুলি। কপালে সিঁদুরের বড় টিপ। ‘বায়োকেমিস্ট্রি সাবজেক্ট হিসেবে তোমাদের ভালো লাগবে না। ফর্মুলা, কেমিক্যালস, ল্যাবরেটরি, রিঅ্যাকশন, ইকুয়েশান—এইসব দেখে ভীষণ বোর লাগবে। বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়টি চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে কতটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তা তোমরা ভবিষ্যতে একদিন বুঝতে পারবে। আজ নয়। ততদিন, কিপ অন ক্র্যামিং। পড়ে যাও!’

প্রাথমিক সম্বোধনের পর তিনজন হেড ডিপ স্টেজ থেকে নেমে এলএলটি থেকে বিদায় নিলেন। স্টেজে লাফাতে লাফাতে উঠল একদল ছেলেমেয়ে।

‘বস, আমরা সেকেন্ড ইয়ার, তোমাদের ইমিডিয়েট সিনিয়র।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল টিনটিন। ‘বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম টিনটিন রায়। আজ ষোলই অগাস্ট। তোরা ভর্তি হলি। আগামী তিরিশে অগাস্ট তোদের ফ্রেশার্স ওয়েলকাম দেওয়া হবে। তোদের একটা কোয়েশ্চেনেয়ার বিলি করা হচ্ছে। ফিল আপ কর।’

অভির হাতে চলে এল প্রশ্নপত্র। প্রথম দিকে মামুলি প্রশ্ন। নাম, ঠিকানা, বাবার নাম, মায়ের নাম, ইস্কুল-হ্যানাত্যানা। তারপর আস্তে আস্তে প্রিয় খাদ্য, প্রিয় পানীয়, প্রিয় নায়িকা-নায়ক, প্রিয় বই—এইসব। সব শেষে, একপাশে লেখা, আরএসভিপি।আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট ফর্ম ফিল আপ করতে করতে অভি চ্যাঁচাল, ‘আরএসভিপি মানে কী?’

ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে দময়ন্তী চ্যাঁচাল, ‘এটা একটা ফরাসি কথা। ইংরিজি অনুবাদ হল, ”রেসপন্স ইফ ইয়ু প্লিজ”। মানে, আমরা ওই দিন আসব নাকি আসব না—সেটা জানিয়ে দিতে হবে।’

আসার ঘরে টিক মেরে ফর্ম জমা দিল অভি। ইনট্রোডাকশান শেষ। এলএলটি পর্ব শেষ। কাঠের গ্যালারিতে দুমদাম জুতোর আওয়াজ তুলে সবাই দৌড় লাগাল স্মল লেকচার থিয়েটারের দিকে।

স্থাপত্যগত ভাবে এসএলটি একদম আলাদা। সাদা রঙের বাড়িটিকে হঠাৎ দেখলে মেট্রো সিনেমা হলের মিনিয়েচার সংস্করণ ভেবে ভুল হয়। এখানেও গ্যালারি। তবে লোহা ও কাঠের মিশ্রণে তৈরি। লম্বা লম্বা জানলাগুলো খোলা। দিব্বি রোদ আসছে। এলএলটির কাঠের অন্দরসাজের তুলনায় অনেকটাই গেরস্থ পোষা এসএলটি।

অভি ঢুকে দেখল অশ্বক্ষুরাকৃতি টেবিলের পিছনে একদল ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে। এদের মধ্যে দুজন তার চেনা। রিপুদা আর আপ্পুদি।

‘বয়েজ অ্যাট দ্য টপ অ্যান্ড গার্লস অ্যাট দ্য বটম’—এই নিয়ন্ত্রণ এখন নেই বলে সবাই মিলিয়ে মিশিয়ে বসেছে। এদিক ওদিক দেখে অভি বসল বৃন্দা আর চন্দনের মাঝখানে।

‘স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তোদের স্বাগতম জানাই। আমি সেক্রেটারি, রিপুদমন কর। সবাই রিপুদা বলে ডাকে। আর এ হল প্রেসিডেন্ট। অপরাজিতা বক্সি। সবাই আপ্পুদি বলে ডাকে।’ রিপু একে একে আলাপ করাল অ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারি, ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পোর্টস সেক্রেটারি, কালচারাল সেক্রেটারি, কমন রুম সেক্রেটারি এবং তাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট পোর্টফোলিও হোল্ডারদের সঙ্গে। অভি খেয়াল করল সেকেন্ড ইয়ারের টিনটিন এখানেও আছে। সে ইউনিয়নের কালচারাল সেক্রেটারি।

‘এখানে মোচার ইউনিয়ন, না?’ ডান পাশ থেকে প্রশ্ন করল চন্দন।

‘মোচা আবার কী জিনিস?’ প্রতিপ্রশ্ন বৃন্দার।

‘জনমোর্চার ছাত্র সংগঠন। নাম ছাত্রমোর্চা। সরকারপন্থী সংগঠন। আমি স্কুলে মোচার সাপোর্টার ছিলাম।’ চন্দন জানায়।

‘উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয় মোচা পার্টি করত? দেশের কী হবে রে!’ হেসে ফেলে বৃন্দা।

বৃন্দার কথার মাঝখানে ডায়াসিং শুরু করল রিপু। ‘আলাপ করিয়ে দিই কালুয়াদার সঙ্গে। কালুয়াদা আমাদের হেড ডোম।’

এলএলটিতে দেখা কালো, বেঁটে, মোটা, মোচওয়ালা মানুষটিকে দেখে আর কেউ উঠে দাঁড়াল না।

‘কালুয়াদের কাছ থেকে তোরা বোন সেট কিনতে পাবি। এক সেটের দাম পড়বে বারো হাজার টাকা। বোনসেট মানে মাথার খুলি থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সমস্ত হাড়ের স্টক বিক্রি করে কালুয়াদা।’

সবাইকে নমষ্কার করে কালুয়া বেরিয়ে গেল। রিপু বলল, ‘একটা ইম্পর্ট্যান্ট টিপ দিই। কাজে লাগবে। তোরা যখন কলেজের জন্য ব্যাকপ্যাক বা ন্যাপস্যাক কিনবি তখন তার সাইজ কী হবে?’

সবাই চুপ। এ আবার কী প্রশ্ন?

বৃন্দা হাত তুলল।

‘উঠে দাঁড়া। নাম বল।’

‘বৃন্দা ব্যানার্জি ফ্রম মর্ডান হাই স্কুল।’ তুলতুলে গলায় বৃন্দা জানাল, ‘দ্য ব্যাগ সাইজ শুড বি বিগার দ্যান দ্য সাইজ অফ মাই থাই।’ গ্যালারি থেকে নেমে সবার সামনে এসে নিজের ব্যাগের কোনাকুনি দৈর্ঘ্য নিজের থাইয়ে ফেলে দেখাল সে।

‘হোয়াই?’ মুচকি হেসে প্রশ্ন করে রিপু।

‘আমাদের শরীরের সব থেকে বড় হাড়ের নাম ফিমার। ফিমার হাতে থাকলে কেউ বাসে উঠতে দেবে না। তাই এমন একটা ব্যাগ কিনতে হবে, যার মধ্যে ফিমার ঢুকে যায়।’

‘ইজ ইয়োর ফাদার আ ডক্টর?’ আপ্পু জিজ্ঞাসা করে।

এই প্রশ্নে বৃন্দা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। হুড়মুড় করে গ্যালারিতে ফিরে আসার আগে বলে, ‘আমার এক আঙ্কল ডাক্তার।’

‘মেয়েটাকে কী সুন্দর দেখতে মাইরি। ঠিক যেন সোনাক্ষী সিনহা।’ বৃন্দাকে দেখে বলে চন্দন। অভির বুকের বাঁদিকে সবুজ সাপটা আবার মৃদু ফণা দোলায়। বৃন্দা ভালো দেখতে, তাতে তোর কী রে চাষার ব্যাটা?

‘বৃন্দা ঠিক বলেছে। ব্যাগ কিনবে তোমাদের ফিমারের সাইজের থেকে বড়। আর এবার তোমাদের দেওয়া হচ্ছে বুকলিস্ট।’ দশপাতার প্রিন্ট আউট সবার হাতে ধরাচ্ছে ইউনিয়নের ছেলেমেয়েরা। ‘অ্যানাটমিতে গ্রে, ফিজিওলজিতে গাইটন এবং গ্যানং, বায়োকেমিস্ট্রিতে হার্পার পড়তেই হবে। অ্যানাটমিতে ডিসেকশানের জন্য কানিংহাম পড়তে হবে। স্নেল-এর ক্লিনিকাল অ্যানাটমিও লাগবে।’

‘শুধু ফান্ডা ঝাড়ছে! ঢপবাজ।’ দাঁতের ফাঁকে বলে বৃন্দা। ‘অ্যানাটমিতে দাদু আর বিডি চৌরাসিয়ার নাম বলল না। ফিজিওলজিতে ডিপি বা দেবাশিস প্রামাণিকের নাম বলল না। বায়োকেমিস্ট্রিতে সত্যনারায়ণ বা বাসুদেবনের নাম বলল না। নিজেরা চোথা পড়ে পাস করেছে আর আমাদের কাছে বড়বড় বাতেলা।’

‘দাদুটা কে?’ আবার নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে অভি।

‘দাদু মানে ডক্টর মিত্র। ওনার তিন খণ্ড অ্যানাটমির বই মুখস্থ করতে পারলে, ইউ উইল বি ফার্স্ট ইন ফার্স্ট এমবিবিএস। চৌরাসিয়ার বইটাও খুব লুসিড।’

‘কী করে এত জানলি? তোর আঙ্কলের কাছে?’

‘হ্যাঁ। উনি দাদুর কাছে প্রাইভেটে পড়তেন।’

‘প্রাইভেট টিউশনি? আমাদের লাইনে হয় নাকি?’

‘সব হয়। দাদুর গোয়ালে নাকি শ’খানেক ছেলেমেয়ে পড়ে। আঙ্কল বলেছেন, দাদু পড়ান ভালো।’

রিপু বলল, ‘তোরা মন দিয়ে পড়াশুনা করবি। আমরা চলে যাওয়ার পর এখানে উল্টোপাল্টা রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তোদের মাথা খাওয়ার জন্য ডায়াসিং করতে আসবে সিনিয়র দাদাদিদিরা। ওদের ভবিষ্যত অন্ধকার। তোরা নিজেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করিস না।’

সারিবদ্ধভাবে বেরিয়ে গেল রিপু, আপ্পু অ্যান্ড কোং। সারা ক্লাস দেখল, এসএলটির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। এদের মধ্যে একটি ছেলেকে অভি চেনে।

‘নমষ্কার বন্ধুরা। আমার নাম সব্যসাচী সেন। আমি থার্ড ইয়ারে পড়ি।’ কথা বলা শুরু করল একগাল দাড়িওয়ালা, মোটা চশমা পরা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগওয়ালা একটা ছেলে। ‘আমার বাড়ি বীরভূমের আমোদপুরে। আমার মতো তোদের অনেকেই জেলা বা মফসসল থেকে জয়েন্ট এনট্রান্সে চান্স পেয়ে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে পড়তে এসেছিস। জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষা যদি কোনও লিটমাস টেস্ট হয়, তা হলে তোরা তাতে পাস। কিন্তু এটাই একমাত্র লিটমাস টেস্ট নয়। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল তোদের ডাক্তার হতে শেখাবে। কিন্তু মানুষ হতে শেখাবে আমাদের চারপাশে বয়ে চলা জীবন। কেন টুইন টাওয়ার আত্মঘাতী বোমার আঘাতে ভেঙে যায়, কেন আমলাশোলের মানুষ না খেতে পেয়ে মরে যায়, কেন গুজরাতে দাঙ্গা বাঁধে, কেন পেট্রল আর ডিজেলের দাম বাড়ে, কেন সরকার বদল হলেও আমাদের কোনও বদল হয় না-এইসব প্রশ্নের উত্তর শেখাবে জীবন। শুধু পড়াশুনো করলে, শুধু বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থাকলে, শুধু ফেসবুক আর টুইটার করলে, শুধু কানে আইপডের তার গুঁজে রাখলে, শুধু মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখলে আমাদের জীবনদর্শন অসম্পূর্ণ থাকে।’ সামান্য দম নেয় সব্যসাচী, ‘আমরা একটা ছোট্ট দল। নাম প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম বা পিএমএফ। পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে রাজনৈতিক বই পড়ি, কলকাতার বস্তিতে আর গ্রামে গিয়ে ফ্রি মেডিক্যাল চেক আপ করি। তোদের আগ্রহ থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিস। কোনও চাপ নিস না। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে আমরা তোদের খেয়ে ফেলব না।’

অভি হাঁ করে সব্যসাচীর কথা গিলছে। সব্যসাচী বলছে, ‘আমার সঙ্গে যারা রয়েছে, তারা তোদের একটা পুস্তিকা দেবে। তাতে আমাদের ফোন নম্বর দেওয়া আছে। ইচ্ছে হলে যোগাযোগ করিস। যদি র‌্যাগিং হয়, অবশ্যই যোগাযোগ করিস। আমরা অ্যাকটিভলি ব্যবস্থা নেব।’

সব্যসাচীর কথা শেষ। দ্বিতীয় ছেলেটি বলল, ‘আমার নাম অনাবিল লাহিড়ী। আমি তোদের হাতে পুস্তিকা পৌঁছে দিচ্ছি।’

অন্য দুজন ছেলে আর একটি মেয়েও নিজের পরিচয় দিচ্ছে। অভি তাদের কথা শুনছে না। সে বিলুর দিকে তাকিয়ে। দাদা যখন তার হাতে পুস্তিকা ধরাল, অভি ফিসফিস করে বলল, ‘বাড়ি গিয়েই মাকে বলছি। তুই পলিটিকস করিস।’

বিলু পাল্টা জবাব দিল, ‘মাকে বললে একটা ক্যালানিও মাটিতে পড়বে না।’ তারপর হাসিহাসি মুখে পুস্তিকা বিলি করতে লাগল।