দময়ন্তী
দিল্লি-কলকাতা ফ্লাইটের দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছনোর সময় সকাল সাড়ে আটটায়। কেন কে জানে, দমদমের আকাশে অকারণে চার-পাঁচবার চক্কর কেটে প্লেন টাচ ডাউন করল সওয়া নটার সময়। দময়ন্তী বসেছিল প্লেনের মাঝ বরাবর, আইল সিটে। প্লেন থামার আগেই সে সিটবেল্ট খুলে লফট থেকে হ্যান্ড লাগেজ পাড়তে শুরু করল। হাঁহাঁ করে দৌড়ে এল বিমানবালা। ‘ম্যাডাম, ইউ আর নট অ্যালাওড টু ওপন দ্য লফট হোয়াইল দ্য প্লেন ইজ রানিং।’
‘আই নো দ্যাট!’ খটাং করে লফটের দরজা নামিয়ে পিছনের দরজার দিকে এগিয়েছে দময়ন্তী।
উইনডো সিটে বসে থাকা দময়ন্তীর মা, শক্তিরূপা সেনগুপ্ত বললেন, ‘দিঠি, বিহেভ ইওরসেলফ।’
‘আই উইল। ইন দ্য ইভনিং।’ কাপড়ের ঝোলা কাঁধে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে দময়ন্তী।
মাঝখানের সিটে ধ্যানস্থ হয়ে বসে রয়েছেন ড্যানিয়েল আর্চার, দময়ন্তীর বাবা। শক্তিরূপা তাঁকে বললেন, ‘তোমার মেয়ে কীরকম অসভ্যতা করছে দেখো।’
চোখ না খুলে ড্যানিয়েল বললেন, ‘সন্ধেবেলা দেখব। ভারতীয় চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় থেকে মেয়ে ফেরার পরে। এখন যা করছে ঠিক করছে। ওর প্রথম পাঠ সকাল দশটায় শুরু হবে। এখন প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
“ক্লাস”-এর বাংলা ”পাঠ”? তোমার বাংলা শুনে আমিই মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না।’ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়েছেন শক্তিরূপা।
‘হয়নি, না?’ লাজুক হেসে চোখ খোলেন ড্যানিয়েল।
প্লেনের সিঁড়ি মাটি স্পর্শ করেছে। মুখে যান্ত্রিক হাসি লেপ্টে দরজার সামনে নমষ্কারের মুদ্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছে বিমানবালা। তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে সবার আগে কলকাতার মাটিতে পা রেখেছে উনিশ বছরের দময়ন্তী সেনগুপ্ত আর্চার ওরফে দিঠি। উঠে পড়েছে বিমান কোম্পানির লোগো লাগানো ছোট্ট বাসে। বাবা-মা আসছে কিনা দেখার প্রয়োজনও বোধ করছে না।
দময়ন্তীর উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। সে ব্রিটিশ বাবার উচ্চতা পেয়েছে। সেই সঙ্গে পেয়েছে ব্রিটিশদের মতো ফ্যাকাশে ত্বকের রং। লম্বায় এবং চওড়ায় তাগড়াই হলেও মুখ মায়ের মতো। উঁচু হনু, সরু চিবুক, টিকোলো নাক। মাথা ভরতি কালো, ঢেউ খেলানো চুল। দময়ন্তী জানে সে সুন্দরী। রূপকে আড়াল করার জন্য সে কালো, মোটা ফ্রেমের কুচ্ছিত চশমা পরেছে। কাঁধে নিয়েছে শান্তিনিকেতনি ঝোলা। পরেছে সালওয়ার কামিজ। যদিও লন্ডন বা নিউ দিল্লিতে জিনস-টি-শার্টেই সে বেশি স্বচ্ছন্দ।
বাস ভরতি হয়ে গেল। দমদম বিমানবন্দরের ডোমেস্টিক লাউঞ্জের চেক আউট পয়েন্টে বাসের প্যাসেঞ্জাররা নামল। সবার প্রথমে দময়ন্তী। কাচের দরজা পেরিয়ে, করিডোর বরাবর দৌড়ে, ছেলে ও মেয়েদের বাথরুম টপকে, কনভেয়র বেল্টের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাগেজসন্ধানী যাত্রীদের কাটিয়ে, কাচের মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সিআইএসএফ-এর জাঠ জওয়ানকে ডজ করে বাইরে বেরোল। এক ট্যাক্সি ড্রাইভার দেঁতো হেসে বলল, ‘আলিপুর ম্যাডাম?’
‘শিয়ালদা।’ পিছনের সিটে বসে, ঝোলা পাশে রেখে পরিষ্কার বাংলায় দময়ন্তী বলল, ‘পৌনে দশটার মধ্যে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছে দিলে মিটারে যা উঠবে তার ডবল দেব।’
‘সক্কাল বেলা মা লকখি!’ ইঞ্জিনে চাবি দিয়ে, ক্লাচ টিপে, নিউট্রাল থেকে ফার্স্ট হয়ে সেকেন্ড গিয়ারে পৌঁছে যায় ড্রাইভার। শুনশান এয়ারপোর্টের রাস্তা দিয়ে শাঁশাঁ করে দৌড়ে, ভিআইপি রোডে পড়ে বিকট এক ট্রাফিক জ্যামে আটকে যায়।
‘ফাঁক!’ দাঁত চিপে কিশকিশ করে বলে দময়ন্তী।
‘এখানে ফাঁক পাওয়া যাবে না লকখি ম্যাডাম। একটু ধৈযযো ধরতে হবে।’ ঘাড় ঘুরিয়ে বলে ড্রাইভার।
প্লেন থেকে টুকটুক করে নামছেন শক্তিরূপা। পিছন পিছন ড্যানিয়েল। দুজন যাত্রী ড্যানিয়েলের দিকে কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অটোগ্রাফ প্লিজ।’
ড্যানিয়েলের বয়স পঞ্চাশ বছর। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতা। থলথলে চেহারা। চোখের মণির রং অ্যাকোয়া মেরিন ব্লু। চুলে পনিটেল। পরনে ঢোলা পাজামা ও পাঞ্জাবি। কাঁধে শান্তিনিকেতনের পাশঝোলা। পায়ে হাওয়াই চপ্পল। বাঁ কানে হিরের ইয়ার স্টাড।
ড্যানিয়েল ইস্ট লন্ডনের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা ছিলেন আর্ট হিস্টোরিয়ান। মা আর্ট রেস্টোরার। দু’জনেই সদবিজে চাকরি করতেন। একদিকে বাড়ি জোড়া আর্ট হিসট্রির বই, অন্যদিকে সারা পৃথিবীর শিল্পীদের ফোটোগ্রাফ রোজ প্রজেক্টরে দেখা হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার পরিবেশে বড় হন ড্যানিয়েল। তাঁর বরাবরের ঝোঁক ছবি আঁকার দিকে।
ছবি আঁকার প্রথাগত চর্চা করতে আর্ট কলেজে ভর্তি হন ড্যানিয়েল। কিন্তু আঁকার বদলে নেশার সঙ্গে ভালোবাসা জন্মায়। মাতাল একদল আর্টিস্টের সঙ্গে নেশা এবং শিল্পচর্চা চলছিল। কবে যেন শিল্পচর্চা বন্ধ হয়ে গেল। এক সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্যানিয়েল আবিষ্কার করলেন গত দুবছরে তিনি কোনও ছবি আঁকেননি। বাবা মারা গেছেন। মা সংসার চালাচ্ছেন। তাঁরও চাকরি থেকে অবসরের সময় এল বলে। পাশাপাশি শরীরে অস্টিওপোরোসিস। যখন তখন হাড়ে চিড় ধরছে।
একদল নেশাখোর মেঝেতে পড়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে সবার আগে ঘুম থেকে উঠে খোঁয়াড়ি কাটাতে ড্যানিয়েল ঢকঢক করে এক বোতল জল খেলেন। শুনতে পেলেন, সাউন্ড সিস্টেম থেকে গান ভেসে আসছে, ‘জয় গুরু দেবা! ওম!’
বিটলসের গান। ভারতবর্ষে এসে মহর্ষি মহেশ যোগীর কাছে ‘ট্রানসেন্ডেন্টাল মেডিটেশান’ শিখেছিলেন জন লেনন। সেতার শিখেছিলেন রবিশঙ্করের কাছে। সেই অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি এই গান।
‘ইর্সান মিস্টিসিজম’ বলে কিছু আছে কি না কে জানে! ড্যানিয়েল ভাবলেন, ‘এই জীবন লইয়া আমি কী করিব?’ এবং আত্মানুসন্ধানের জন্য এক বস্ত্রে, কাঁধে ন্যাপস্যাক ও পকেটে কিছু পাউন্ড নিয়ে ভারতবর্ষের প্লেনে চেপে বসলেন।
এরপর যেমন হয়। কিছুদিন বেনারস, কিছুদিন গোয়া, কিছুদিন রাজস্থান… এইসব চক্কর কাটা। অবশেষে ড্যানিয়েল এসে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতনে। মহেশ যোগী বা রবিশঙ্কর যা পারেননি, রবি ঠাকুর সেটা পারলেন। ড্যানিয়েল থিতু হলেন। আধখ্যাপা সাহেব দেখতে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দারা অভ্যস্ত। আর এ তো নিপাট ভদ্রলোক।
জনৈক আশ্রমিক আদিনাথ সেনগুপ্তের আগ্রহে ড্যানিয়েল মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেন। বিদেশি আঁকার ডিগ্রি ছিল। শিক্ষকতার কাজও জুটে গেল। এমন মজার মাস্টারমশাই ছাত্রছাত্রীরা দেখেনি। অ্যানাটামি জ্ঞান প্রখর, পার্সপেকটিভ নিয়ে নিখুঁত ধারণা, ইউরোপিয়ান মাস্টার্সদের কাজ গুলে খেয়েছেন। কিন্তু ওরিয়েন্টাল আর্ট, ভারতবর্ষের চিত্রকলার ইতিহাস, বেঙ্গল স্কুল অব পেইন্টিং সম্পর্কে জ্ঞান শূন্য। ড্যানিয়েলের ক্লাসগুলো হতো ইন্টারেস্টিং। কে ছাত্র আর কে শিক্ষক বোঝা যেত না। রোজই দেখা যেত ড্যানিয়েল জলরঙে সাঁওতাল রমনীর শরীর আঁকতে গিয়ে হেসে ফেলছেন, আর ছাত্রছাত্রীরা মহানন্দে ইতালিয়ান রেনেসাঁর ছবিতে রং বুলোচ্ছে।
এই সময় ড্যানিয়েলের জীবনে প্রেম এল। আদিনাথের কন্যা শক্তিরূপা ড্যানিয়েলকে বাংলা শেখাতেন। রবীন্দ্রনাথ পড়ে শোনাতেন। শ্লেটে পেনসিল দিয়ে লেখাতেন, ‘আজ মঙ্গলবার। জঙ্গল সাফ করার দিন।’
রবীন্দ্রনাথের ঘটকালিতে প্রেম হল।
বিপত্নীক আদিনাথ সবই দেখছিলেন। কোনও বাধা দেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘পড়াশুনাটা শেষ কর। নিজের পায়ে দাঁড়া। তারপর এইসব নিয়ে ভাবিস।’
কখনও বরিশালে না গেলেও বাঙাল জিন শক্তিরূপার মধ্যে অতি সক্রিয়। ড্যানিয়েলকে ভালোবাসতে গিয়ে পড়াশুনায় কখনও ব্যাঘাত ঘটেনি। শান্তিনিকেতন থেকে বারো ক্লাস পাস করে তিনি চলে এলেন কলকাতায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরিজিতে অনার্স নিয়ে পড়াশুনা করতে। রেজাল্ট, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে কলকাতা শহর নকশাল আন্দোলনে উথাল পাথাল। আদিনাথের পরামর্শ মেনে মাস্টার্স করতে শক্তিরূপা চলে গেলেন দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। কলকাতা, শান্তিনিকেতন বা অশান্ত বাংলা থেকে অনেক দূরে।
শক্তিরূপা নিজেকে একা সামলাতে পারলেও ড্যানিয়েল পারলেন না। শান্তিনিকেতনের চাকরি থেকে প্রথম দিকে ছুটি নিয়ে তিনি প্রতি মাসে দিল্লি যেতে লাগলেন। এত ছুটি নিলে মাইনে পাওয়া যায় না। পরের দিকে অবৈতনিক শিক্ষক হয়ে গেলেন। এবং একদিন চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন দিল্লি।
নেশার দাস যারা হয়ে পড়ে, তাদের ব্যক্তিত্বে কোথাও একটা সংকট থাকে। নেশাহীন জীবন কাটানোর জন্য তাদের একটা ঠেকনা লাগে। নেশার দাসত্ব কাটাতে ড্যানিয়েলের ঠেকনা ছিল দুজন—রবীন্দ্রনাথ আর শক্তিরূপা। ড্যানিয়েলের রবীন্দ্রচর্চা তথা বাংলা-ভাষাচর্চা শক্তিরূপার হাত ধরে। শক্তিরূপা চলে যাওয়া মানে শান্তিনিকেতন ড্যানিয়েলের কাছে রবীন্দ্রশূন্য। থাকা সম্ভব নয়।
এমএ করার আগেই শক্তিরূপা বিয়ে করলেন। উপস্থিত ছিলেন আদিনাথ। ড্যানিয়েলের মা আসতে পারেননি। অস্টিওপোরোসিসের রুগির পক্ষে প্লেনে লন্ডন থেকে ভারতে আসা অসম্ভব ব্যাপার।
পুরনো দিল্লিতে, পরাঠা গলির মধ্যে, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এক কামরার ভাড়াবাড়িতে থাকতে থাকতে ড্যানিয়েল প্রথম তাঁর চিত্রভাষা খুঁজে পেলেন। মুঘল মিনিয়েচার, পুরনো হাভেলির জাফরির ফাঁক দিয়ে আসা আলো আর ছায়ার তৈরি কিয়ারোসকুয়োরো, বোরখার আড়ালে চঞ্চল চোখ, কিমা-ফিরনি-কাবাব-পরটার গন্ধ, গাজর কা হালুয়ার উষ্ণতা, কেসরি ঠান্ডাই এর মিঠাস, রাতের মেহফিলের দমদার ঠুমরির মুখড়া—ভেঙেচুরে নবনির্মিত হয়ে দেখা দিল ড্যানিয়েলের ছবিতে। টানা এক বছর পরিশ্রম করে উনিশশো পঁচানব্বই সালে, অয়েলে আঁকা বিশালাকৃতি চল্লিশটা ছবির সিরিজ শেষ করলেন ড্যানিয়েল। যখন শক্তিরূপা গর্ভবতী। যখন স্বামী-স্ত্রী কেউ কোনও কাজ করেন না। সিরিজটার নাম ছিল, ‘দিল্লি ডিকনস্ট্রাকটেড’।
হজ খাসের ‘বাই দ্য ওয়ে’ আর্ট গ্যালারির মালিক-কাম-কিউরেটর হৈমবতী সান্যাল ছবিগুলো নিয়ে দশ দিনের একটা এক্সিবিশন করলেন। হৈমবতীর স্বামী বিবস্বান সান্যাল ‘মায়া কমিউনিকেশান’ বা ‘মায়াকম’ নামে কনট প্লেসে একটা নন-ব্যাঙ্কিং অর্গানাইজেশান খুলেছেন। একচিলতে অফিস। ছোট, কিন্তু চেহারায় আপমার্কেট এবং পশ। আধুনিক চেয়ার-টেবিল ও আখাম্বা কম্পিউটার দেখে শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় জাগে। নন-ব্যাঙ্কিং অর্গানাইজেশানের মূলধন হল গ্রাহকের বিশ্বাস। তারা দেখতে চায়, যে কোম্পানিতে টাকা ইনভেস্ট করছি, তার কলজের জোর কত। এই কলজের জোর দেখাতে গেলে অন্যান্য ইনভেস্টমেট লাগে। যেমন রিয়্যাল এস্টেট, ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি, মিডিয়া, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি—এইসব। উঠতি শিল্পপতি বিবস্বান সান্যাল ‘মায়া কমিউনিকেশান’-এর কোর বিজনেস এরিয়া দেখেন। অর্থাৎ নন-ব্যাঙ্কিং সেক্টর। তাঁর স্ত্রী হৈমবতী দেখেন আনুষঙ্গিক। যার মধ্যে অন্যতম বাই দ্য ওয়ে আর্ট গ্যালারি। দিল্লি ছাড়াও মুম্বইতে এর একটা শাখা আছে। তরুণ শিল্পীদের ছবির জন্য অলটারনেটিভ স্পেস হিসেবে নিজেকে প্রোমোট করে এই আর্ট গ্যালারি।
হৈমবতী ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা ক্যালটেক থেকে ইকনমিক্স নিয়ে পড়াশুনো করেছেন। কিন্তু তাঁর আগ্রহ শিল্পকলায়। সারা ভারতের নবীন শিল্পীদের কাজের খবর রাখেন। তিনি যোগাযোগ করেন ড্যানিয়েলের সঙ্গে। চুক্তিপত্র সই হল। বিক্রি হলে কত শতাংশ ড্যানিয়েলের, কত শতাংশ গ্যালারি মালিকের—এইসব ঠিক হল। এক পয়সার আশা না করে ড্যানিয়েল চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন।
সাতদিনের মধ্যে চল্লিশটা ছবি বিক্রি হয়ে যায়। গ্যালারি মালিক ও মধ্যস্থতাকারীদের কমিশন দিয়ে যে টাকাটা হাতে থাকে তাতে ড্যানিয়েল ও শক্তিরূপা চিত্তরঞ্জন পার্কে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে আসেন।
এমএ-র রেজাল্ট বেরোনোর পরে দেখা গেল শক্তিরূপা আবারও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। তিনি চাকরি পেলেন ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি বিক্রির ইংরিজি সংবাদপত্র ‘ইন্ডিয়ান নিউজ’-এ, দিল্লির সংবাদদাতা হিসেবে। এই সময়ের আশেপাশে ড্যানিয়েলের মা মারা গেলেন।
চাকরিতে যোগদান করার আগে একমাসের জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন শক্তিরূপা। ড্যানিয়েল মায়ের পারলৌকিক ক্রিয়া সারবেন। তাছাড়া ড্যানিয়েল চেয়েছিলেন ইস্ট লন্ডনের বাড়িটা বিক্রি করে দিতে। কিন্তু হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল যে তাঁরা সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন।
শক্তিরূপার প্রি-ম্যাচিয়োর লেবার শুরু হল। লন্ডনের মাটিতে জন্মাল দময়ন্তী। ন্যাচারাল সিটিজেন বাই বার্থ। সেটা বিরানব্বই সালের ডিসেম্বর মাস।
ড্যানিয়েল-শক্তিরূপা ঠিক করলেন, লন্ডনের বাড়ি বেচবেন না। দূর সম্পর্কের এক বোনপোর হাতে বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে তিনজন দিল্লি ফিরে এলেন। মায়ের সূত্রে দময়ন্তী পেল ভারতীয় নাগরিকত্ব। দু-তিন বছর অন্তর সে বাবা-মায়ের সঙ্গে লন্ডন ঘুরে আসে।
দময়ন্তীর জন্মের পরবর্তী আঠারো-উনিশ বছর নিস্তরঙ্গ জীবন। ড্যানিয়েল ক্রমাগত ছবি এঁকে যাচ্ছেন, শক্তিরূপা ইন্ডিয়ান নিউজের চাকরিতে ক্রমাগত উন্নতি করছেন, দময়ন্তী বড় হচ্ছে। চিত্তরঞ্জন পার্কের ভাড়া বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি করা, গাড়ি কেনা, দুবছরে একবার পৃথিবীর কোনও একটা দেশভ্রমণ ও বছরে একবার ভারতের কোনও একটি রাজ্য ভ্রমণ—এইভাবে চলছিল। ড্যানিয়েল মেয়েকে নিয়ে নিয়মিত শান্তিনিকেতন যেতেন আদিনাথের সঙ্গে দেখা করতে। কলকাতাও যেতেন। ইন্ডিয়ান নিউজের চাকরির চাপে শক্তিরূপা অতটা সংসারি হয়ে উঠতে পারেননি। আদিনাথের মৃত্যুর খবর পেয়ে শান্তিনিকেতনের শেষকৃত্যে উপস্থিত হয়েছেন শুধু।
চিত্তরঞ্জন পার্কে বাঙালি আবহাওয়া থাকলেও বাংলায় পঠনপাঠনের চর্চা কমতির দিকে। দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালি সন্তানরা বাংলা চর্চা করে না। দময়ন্তীর বাড়ির পরিবেশ আলাদা। শক্তিরূপা সারাদিন ইংরিজি ভাষা অধ্যুষিত অফিসে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় কথা বলেন না।
ক্লাস টেন পাশ করার পরে ড্যানিয়েল মেয়েকে ভর্তি করেন শান্তিনিকেতনের স্কুলে। দু’বছর ওখানে থেকেই পড়াশুনো করেছে সে। শক্তিরূপা আসতে পারেননি। তবে ড্যানিয়েল আগাগোড়াই মেয়ের সঙ্গে ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রী হিসেবে সর্বভারতীয় ডাক্তারি এন্ট্রান্স এক্সামিনেশান দেয় দময়ন্তী। তারপরে বাপ-মেয়ে দিল্লি ফিরে যায়।
দুহাজার দশ সালের অগাস্ট মাসের এক সকালবেলা শক্তিরূপার মুখে দময়ন্তী কলকাতার ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার খবর শোনে। সাফল্যের খবরে তার হেলদোল হয়নি। কলকাতা শহর তার অচেনা নয়। ড্যানিয়েলের সঙ্গে কয়েকবার গেছে।
দময়ন্তীর হেলদোল না হলেও ড্যানিয়েলের হয়েছে। তিনি মনে মনে ঠিক করেছেন, কলকাতায় শিফট করবেন। শান্তিনিকেতনের বাড়ি এখন তালাবন্ধ। সেটা যেমন আছে থাক। কলকাতায়, শিয়ালদার আশেপাশে একটা পুরনো বাড়ি কেনা যেতে পারে। ড্যানিয়েলের ছবির বাজার অনেকদিন ধরে জাতীয় স্তরে। কিছুটা আন্তর্জাতিকও। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, ছবি বিক্রি হবে। অন্য একটা ইস্যুও আছে। ড্যানিয়েল অনেক শহরকে নিয়ে সিরিজ এঁকেছেন। যেমন ‘দিল্লি ডিকনস্ট্রাকটেড’, ‘বেনারস মনসুন’, ‘কেরালা কালেকশন’, ‘গোয়া নাগেটস’, ‘মুম্বই আনবাউন্ড’। কিন্ত কলকাতা শহর নিয়ে কোনও সিরিজ নেই। অপত্য স্নেহ, না ছবির প্রতি প্যাশন, নাকি দুটোই—সেটা বলা শক্ত। শক্তিরূপা ও দময়ন্তীকে না জানিয়ে ড্যানিয়েল কলকাতা শিফট করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
প্রায় একই সময় শক্তিরূপার কাছে পূর্ব ভারতের মিডিয়া হাউজ ‘মায়া কমিউনিকেশন’ ওরফে ‘মায়াকম’ থেকে একটা অফার এল। মায়া কমিউনিকেশানসের হেড অফিস এখন কলকাতা। পঁচানব্বই সালের ছোট্ট নন-ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান এখন পূর্ব ভারতের এক নম্বর। ‘স্কুপ চ্যানেল’ নামের টিভি চ্যানেল, ‘আজ সকাল’ এবং ‘বেঙ্গল নিউজ’ নামের দুটো খবরের কাগজ, ‘ফিল্মডম’ নামের একটা পাক্ষিক ফিল্ম ম্যাগাজিন বার করে মায়াকম। বাই দ্য ওয়ে আর্ট গ্যালারি কলকাতাতেও শাখা খুলেছে। ভবিষ্যতে অডিও-ভিজুয়াল মিডিয়ায় শিফট করার ইচ্ছে আছে।
মায়াকম ‘উইকেন্ড’ নামে একটা ইংরিজি সংবাদ সাপ্তাহিক লঞ্চ করছে। এই বিষয়ে কথা বলতে বিবস্বান শক্তিরূপার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। টেলিফোনে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, গোলাপ ফুলের ‘বুকে’ নিয়ে চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়িতে আসেন।
বিবস্বান নিপাট ভদ্রলোক। পত্রিকা সম্পর্কিত আলোচনার সময়ে একবারের জন্যও ড্যানিয়েল বা হৈমবতী বা বাই দ্য ওয়ে-র প্রসঙ্গ তুললেন না। যে কাজটা নিয়ে এসেছেন সেটা বর্ণনা করে ইতি বা নেতিবাচক উত্তর চাইলেন। চাকরির ‘টার্মস ও কন্ডিশনস’ লেখা একটি আইনি ডকুমেন্ট এনেছিলেন। সেটা রেখে নমষ্কার জানিয়ে বিদায় নিলেন।
বিবস্বান চলে যাওয়ার পরে শক্তিরূপা ড্যানিয়েলের স্টুডিওয় ঢুকলেন। অর্থাগম হওয়ার পরে দোতলা বাড়িটির তিন নম্বর তলা ঢালাই করা হয়েছে। বিম কলাম স্ট্রাকচার। কোমর অবধি ইটের গাঁথুনি দেওয়ার পরে উপরটা ফাঁকা। ছাদ থেকে পাঁচিল পর্যন্ত ফ্রেঞ্চ উইনডো লাগানো। ন্যাচরাল লাইটে দিনের বেলা ঘর ঝলমল করে। কাচের জানালা খুলে দিলে হাওয়ার দাপটে তিষ্ঠনো দায়।
ড্যানিয়েল আলো পছন্দ করলেও হাওয়া পছন্দ করেন না। জানলা তাই বন্ধ থাকে। মেঝেতে রাখা থাক থাক বই আর সিডি। অজস্র সাদা ক্যানভাস একদিকে পাঁজা করে রাখা। তিনটে মাঝারি ছবি ইজেলে লটকানো। ড্যানিয়েল এখন অবশ্য ছবি আঁকছেন না। আরামকেদারায় বসে গান শুনছেন। হোম থিয়েটারে রবি ঠাকুর গাইছেন,
‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি—
তবু মনে রেখো।’
জিনসের হাফপ্যান্ট পরা, খালি গা ড্যানিয়েল হাঁটুতে তাল দিয়ে গেয়ে উঠলেন,
‘এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।’
ড্যানিয়েল চোখ বুঁজে গান গাইছেন। শক্তিরূপা স্বামীকে মন দিয়ে দেখলেন। এক সময় অসম্ভব বলশালী, পেশিবহুল পুরুষমানুষ ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে নেশাভাং করার কারণে শরীরে চর্বি জমেছে। বয়সের তুলনায় বুড়োটে লাগে। রবীন্দ্রসঙ্গীত বা ভারতীয় মার্গসঙ্গীত বা ওয়ের্স্টান ক্লাসিকাল শোনার সময়ে ড্যানিয়েল নিজের মধ্যে এতটাই বুঁদ হয়ে থাকেন যে মনে হয় ট্রান্সে চলে গেছেন।
রবি ঠাকুরের গান শেষ হওয়ার পরে চোখ খোলেন ড্যানিয়েল। রিমোট টিপে সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ করেন। এটা তাঁর অভ্যেস। তিনি কখনও পরপর দুটো গান শোনেন না। মাঝখানে মিনিট পাঁচেকের বিরতি নেন।
বিরতির মুহূর্তে শক্তিরূপা ড্যানিয়েলকে বললেন, ‘বিবস্বান সান্যাল এসেছিলেন।’
‘বিবস্বান মানে হৈমবতীর স্বামী? আমার খোঁজ করতে?’
‘না। তাহলে তো আমি তোমায় ডাকতাম। বিবস্বান আমার খোঁজ করতে এসেছিলেন।’
‘কেন?’
‘মায়াকম একটা উইকলি নিউজ ম্যাগাজিন লঞ্চ করছে। ইংরিজিতে, ফ্রম ক্যালকাটা। আমাকে তার এডিটর হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিলেন।’
‘হুম!’ আবার রিমোট কনট্রোল টেপেন ড্যানিয়েল। শুরু হয় দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে পরের রবীন্দ্রসঙ্গীত।
‘এলেম নতুন দেশে
তলায় গেল ভগ্নতরী কূলে এলেম ভেসে…’
শক্তিরূপার গানের গলা চমৎকার। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন গান শিখেছেন। আর ড্যানিয়েল তাঁর ব্যারিটোন দিয়ে যে কোনও গানকে অকুতোভয়ে আক্রমণ করতে পারেন। লজ্জাশরম নেই বলে গলা কাঁপে না। গান উতরে যায়।
তাসের দেশের গানের অন্তরায় শক্তিরূপা দেবব্রতর সঙ্গে গলা মেলালেন,
‘নাম না জানা প্রিয়া
নাম না জানা ফুলের মালা নিয়া
হিয়ায় দেবে হিয়া…’
চোখ বুঁজে থাকা ড্যানিয়েল স্ত্রীর কণ্ঠ শুনে চোখে খুলে বললেন, ‘অনেকদিন বাদে গান গাইলে। মনটা খুশি খুশি মনে হচ্ছে?’
‘গান শোনার মাঝখানে তুমি কথা বললে? এ তো স্যাক্রিলেজ!’ মুচকি হেসে বলেন শক্তিরূপা। রিমোটের পজ বাটন টিপে রবীন্দ্রসঙ্গীত থামিয়ে ড্যানিয়েল বলেন, ‘তুমি ইন্ডিয়ান নিউজের চাকরিটা ছাড়ছ। তাই তো?’
‘হ্যাঁ।’ কনফিডেন্টলি বলেন শক্তিরূপা।
‘কলকাতায় চলে যেতে চাইছ। মেয়ের কাছাকাছি থাকবে বলে। তাই তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমাকে আমি একটা কথা বলিনি, জানো। কীভাবে যে বোঝাই…আমি একটা কথা তোমার থেকে গোপন করেছিলাম…’ কথা থামিয়ে ড্যানিয়েল শক্তিরূপার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
শক্তিরূপা বলেন, ‘তুমি যদি ভাবো যে আমি তোমাকে বলব, ”হ্যাঁ গো, গোপন কথাটা কী?” তাহলে খুব ভুল ভাবছ। ইউ কিপ দ্য সিক্রেট টু ইয়োরসেলফ। আমার ওতে আগ্রহ নেই।’
‘আমি তা ভাবছিলাম না রূপা। আমি ভাবছিলাম, যে ঈশ্বরের কাছে কোনও জিনিস অন্তর থেকে চাইলে তা সত্যিই পাওয়া যায়। ভারতীয় চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে দিঠি সুযোগ পাওয়ার পর থেকে আমি ভাবছিলাম দিল্লির পাট চুকিয়ে কলকাতায় স্থানান্তরিত হব। কলকাতায় জমিবাড়ির মধ্যস্থতা করে এমন একজন পেশাদারকে শেয়ালদার মৌলালি অঞ্চলে বাড়ি দেখতে বলেছি। তোমাকে কথাটা বলিনি। কেন না আমি জানতাম তুমি দিল্লি ছাড়বে না। তোমার কাগজের কোনও কলকাতা সংস্করণও বেরোয় না যে তুমি বদলির জন্য আবেদন করবে। আমি কলকাতায় মেয়েকে নিয়ে থাকতাম, ছবি আঁকতাম, সপ্তাহান্তে তোমার সঙ্গে দেখা করে যেতাম। ভাবলাম এক, আর হল আর এক।’
ড্যানিয়েলের কথা শুনতে শুনতে শক্তিরূপার ভুরু কুঁচকে গেছে। টুকটুক করে ঘাড় নেড়ে তিনি বললেন, ‘তোমার এই গোপন ইচ্ছার কথা কতজন জানে?’
খুকখুক করে হেসে ড্যানিয়েল বললেন, ‘চুপিসাড়ে তো আর কলকাতায় বাড়ি কেনা যায় না। ওই মধ্যস্থতাকারী জানে। আরও দুয়েকজন জানে।’
‘ওফ! তোমার শক্ত বাংলা শুনলে ঘাবড়ে যাই। জমিবাড়ির দালালকে মধ্যস্থতাকারী বললে শুনতে কেমন লাগে।’
‘দালাল? ওটা অপশব্দ।’ আপত্তি জানালেন ড্যানিয়েল।
‘আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি। ওই মধ্যস্থতাকারী আর তার চেলাচামুণ্ডা ছাড়া আর কে জানে? হৈমবতী সান্যাল জানেন?’
‘না,’ আপনমনে ভুঁড়িতে হাত বোলালেন ড্যানিয়েল। ‘তুমি ভাবছ যে আমার আর দময়ন্তীর কলকাতায় স্থানান্তরিত হওয়ার খবর জেনে বিবস্বান তোমার কাছে এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছে? যদি সেটা হয়েও থাকে, তা হলে অসুবিধে কোথায়?’
‘তোমার সন্নিসি মাথায় সাপ্লাই-ডিমান্ড থিয়োরি ঢুকবে না। কোম্পানির মালিকের আমাকে দরকার না আমার কোম্পানির মালিককে দরকার, এই পাওয়ার ইকুয়েশনটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট। বিশেষত এডিটরের মতো ভালনারেবল, ডিসিশন মেকিং পোস্টে। অনুগ্রহপ্রার্থী হয়ে থাকলে মিটিং-এ বডডো ল্যামপুনড হতে হয়। এই কাগজে দেখছি তো। মার্কেটিং হেড আর এডিটোরিয়াল হেডের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। মালিক সবসময় মার্কেটিং হেডের পক্ষ নেন। বিকজ দ্যাট ফেলো ব্রিংস অ্যাডস।’
‘এগুলো আমার পক্ষে বোঝা শক্ত।’ আবার রিমোট টেপেন ড্যানিয়েল, ‘এক্ষুনি সিদ্ধান্ত জানিও না। চাকরির সুযোগটির ওপরে বসে ভাবো। তোমার এই চাকরি তো চলে যাচ্ছে না।’
চোখ গোলগোল করে শক্তিরূপা বললেন, ”চাকরির সুযোগের ওপরে বসে ভাবব?’ এটা কি, ‘সিট অন দ্য অফার অ্যান্ড থিঙ্ক’-এর বাংলা?’
লাজুক হেসে ঘাড় নেড়ে ড্যানিয়েল বললেন, ‘হয়নি, না?’
‘হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে।’ হাসতে হাসতে ড্যানিয়েলের গাল টিপে দেন শক্তিরূপা। আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে ড্যানিয়েল সাউন্ড সিস্টেমের রিমোট টেপেন। ‘এলেম নতুন দেশে’ আবার শুরু হয়।
ড্যানিয়েলকে একা ছেড়ে শোওয়ার ঘরে যান শক্তিরূপা। বিবস্বানের রেখে যাওয়া আইনি ডকুমেন্ট মন দিয়ে পড়তে থাকেন।
মায়াকম! কনট প্লেসের সেই ছোট্ট নন-ব্যাঙ্কিং কিশলয় এখন মহীরুহ। ভারতবর্ষ থেকে প্রকাশিত ইংরিজি দৈনিকের সার্কুলেশানের হিসেবে ‘বেঙ্গল নিউজ’-এর অবস্থান তিন নম্বরে। এক নম্বরে আছে ইন্ডিয়ান নিউজ। ফিল্মডম ভারতবর্ষের এক নম্বর ফিল্ম, গসিপ ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন। আজ সকাল বরং নড়বড়ে। অডিট ব্যুরো অব সার্কুলেশানের হিসেব অনুযায়ী তার অবস্থান পাঁচে।
উইকেন্ড প্রকাশের মাধ্যমে মায়াকম রাজনীতির মাস মার্কেটে ঢুকছে। শক্তিরূপা দিল্লির কাগজে বাংলার রাজনীতি ও তার সর্বভারতীয় প্রভাব নিয়ে লেখালেখি করেন। এবং এই ফিল্ডে তিনি এক নম্বর। কে যেন বলেছিলেন, জার্নালিস্টদের ‘জ্যাক অব অল ট্রেডস অ্যান্ড মাস্টার অব ওয়ান’ হতে হয়। সেই তত্ত্ব মেনে, শক্তিরূপা বাংলার রাজনীতিতে মাস্টার হলেও, ইন্দো-অ্যাংলিয়ান লিটারেচার, রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন, ভারতীয় মার্গসঙ্গীত, আধুনিক চিত্রকলা ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত লিখে থাকেন। বাংলা থেকে যে ম্যাগাজিনই বার করা হোক না কেন, কালচার-এর ছোঁয়া থাকতেই হবে। সেই হিসেবে শক্তিরূপা সেনগুপ্ত উইকেন্ডের সম্পাদক হিসেবে এক নম্বর চয়েস। সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন আছে, প্রবাসী বাঙালি কিন্তু শান্তিনিকেতনের চালচিত্র আছে। তিনি সুন্দরী, তাঁর স্বামী ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান চিত্রশিল্পী ড্যানিয়েল আর্চার। সবক’টি বাক্সয় টিক মেরেই বিবস্বান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবু দ্বিধা যায় না। সন্দেহ যায় না। মায়াকম পেশাদার সংস্থা। যতদিন কাজে লাগবে, খাটাবে। কাজ ফুরোলে নিঃশব্দে সরিয়ে দেবে। মায়াকমের প্রাক্তন কর্মচারীদের কখনও নিজের অফিসকে প্রশংসা করতে শোনেননি শক্তিরূপা। আইনি ডকুমেন্ট পড়তে পড়তে ব্যক্তিগত উকিলকে ফোন করেন তিনি। ইন্ডিয়ান নিউজেও লিগাল সেল আছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না।
অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত ড্যানিয়েলের দিকে তাকিয়ে শক্তিরূপা ভাবছেন, উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরে কত ঘটনা এই কদিনে ঘটে গেল। দু’দিন পরে বিবস্বানের ফোন আসতে তিনি মৌখিক ভাবে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন। চাকরির ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস’ নিয়ে দর কষাকষি হল। ইতিমধ্যে ড্যানিয়েল কলকাতার মৌলালিতে বাড়ি কিনে ফেলেছেন। বাড়ির নাম ‘গোলমহল’। একদিকে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ। অন্যদিকে জোড়া গির্জা পেরিয়েই মায়াকমের সাততলা বিল্ডিং। হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট। নিত্যযাত্রায় কলকাতার ট্রাফিক জ্যামের চক্করে পড়তে হবে না।
পুরনো দিনের তিনতলা বাড়িটি শক্তিরূপার খুব পছন্দ হয়েছে। সার্কুলার রোডের একদম ওপরে নয়। সামান্য ভেতরে। গাড়িঘোড়ার আওয়াজ আসে না। জনৈক রাজস্থানি কাপড় ব্যাবসায়ী গোলমহল তৈরি করেছিলেন। মার্বেল ও স্যান্ডস্টোনের ব্যবহারে দুর্গ ও হাভেলির স্থাপত্য ম-ম করছে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজে দময়ন্তীর কাউন্সেলিং-এর সময় ওই বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চির খুঁটিনাটি বিল্ডিং সুপারভাইজারকে বলে গেছেন শক্তিরূপা। ড্যানিয়েল বলেছেন তার স্টুডিওর স্পেসিফিকেশনস। মিস্ত্রিদের কাজ শেষ। ইনটিরিয়ার ডেকরেশন ড্যানিয়েল নিজের হাতে করেছেন। বাড়িটার একটাই সমস্যা। একতলায় অজস্র দোকান। তাদের তোলা যাবে না। তিনতলা বাড়ির ওপরের দুটি তলা কিনেছেন ড্যানিয়েল।
ইন্ডিয়ান নিউজে ইস্তফা দেওয়া হয়ে গেছে শক্তিরূপার। উইকেন্ডে যোগদানের কাগুজে নিয়মকানুন চুকেবুকে গেছে। আজ শনিবার। সোমবার থেকে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব বুঝে নেবেন।
কনভেয়র বেল্ট থেকে নিজেদের লাগেজ তুলে বাইরে বেরোলেন ড্যানিয়েল আর শক্তিরূপা। সামনেই প্ল্যাকার্ড হাতে এক ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘শক্তিরূপা সেনগুপ্ত আর্চার, ড্যানিয়েল আর্চার অ্যান্ড দময়ন্তী সেনগুপ্ত আর্চার’।
শক্তিরূপা ড্রাইভারকে বললেন, ‘আমাদের লাগেজগুলো নাও।’
এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি বেরোচ্ছে। শক্তিরূপা ঘড়ি দেখে বললেন, ‘পৌনে দশটা বাজল। মেয়েটা এখন কোথায় বল তো?’
‘শিট!’ বেলেঘাটার জ্যামে আটকে পড়ে কপাল চাপড়াচ্ছে দময়ন্তী। ‘এখান থেকে আর কতদূর?’
‘রাস্তা তো একটুখানি লকখি ম্যাডাম। ওইততো, ব্রিজের বাঁ-পাশে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আপনি তো আর কুড়ি ফুট পাঁচিল টপকাতে পারবেন না। শিয়ালদার এই অখাদ্য জ্যাম পেরিয়েই যেতে হবে।’
‘পাঁচিল টপকাতে পারব না?’ ট্যাক্সি থেকে টপ করে নেমে বেলেঘাটা ব্রিজের পাঁচিলে উঠে দাঁড়ায় দময়ন্তী। ড্রাইভার আঁতকে উঠে বলে, ‘লকখি-ম্যাডাম, আমার ভাড়াটা দিয়ে যান। ডবল দিতে হবে না। ন্যাজজো পাওনা ফাঁকি দিয়ে ছুইছাইড করবেন না। পিলিজ!’