» » চতুর্থ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

অভিজ্ঞান

গ্রের অ্যানাটমি কোল থেকে নামাল অভি। বাপরে! কী ওজন বইটার! কয়েকদিন বইটা তাক থেকে পাড়লে আর ওঠালে বাইসেপস, ট্রাইসেপস, ডেল্টয়ড, ল্যাটিসিমাস ডরসাই—সব আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগারের মতো হয়ে যাবে।

এ বই পড়া যাবে না। আপন মনে বিড়বিড় করে অভি। যেমন মোটা বই, তেমন বোরিং সাবজেক্ট। দু’কলম জুড়ে থাক থাক লেখা। বই খুলতে ভয় করে। একটা চ্যাপ্টার পড়তে শুরু করলে শেষ হতে চায় না। উফ! কী কষ্ট!

গ্রে সরিয়ে ডক্টর মিত্রর অ্যানাটমি বইয়ের রোগাপাতলা দ্বিতীয় খণ্ড হাতে নেয় অভি। এই বইটা চার খণ্ডে ভাগ করা বলে বই হাতে নিলে টেনশান কম হয়। তবে বইটার ইলাসট্রেশান ভালো নয়। জ্যাবড়া জ্যাবড়া কালির দাগওয়ালা ছবি।। পড়তে গেলে বিরক্ত লাগে।

আগামিকাল অভির প্রথম আইটেম। অনেক কিছু এই কদিনে পড়ানো হয়ে গেছে। প্রথম আইটেম হবে ‘ডরসাম অব ফুট’ বা পায়ের পাতার সামনের দিক। হাড়, মাংসপেশি, শিরা, ধমনি, স্নায়ুর নাম মুখস্থ করতে গিয়ে নাকানি চোবানি খাচ্ছে অভি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডক্টর মিত্রর বই রাখল সে। বই হাতে নিয়ে আজ পর্যন্ত কখনও টেনশান হয়নি। আঠারো বছরের জীবনে যাবতীয় টেনশান কেটে গেছে যে কোনও বই হাতে নিলে। সেই বিশল্যকরণীই এখন গরল হয়ে দেখা দিচ্ছে।

রাত আটটা বাজে। কলেজ থেকে ফিরে একঘণ্টা ঘুমিয়েছে অভি। রাত তিনটে অবধি পড়ে ‘ডরসাম অব ফুট শেষ’ করে দেবে, এইরকম মনোবাসনা। এখনও পর্যন্ত পড়া শুরুই করে উঠতে পারেনি। পড়া শুরু তো দূরস্থান, কী বই পড়বে এটাই বুঝতে পারেনি। বিরক্ত হয়ে চন্দনকে এসএমএস করল। ‘ডরসাম অফ ফুট কোন বই থেকে পড়ব? গ্রে না ডক্টর মিত্র?’

উত্তর এল তৎক্ষণাৎ। ‘কোনওটাই না। ট্রাই চৌরাসিয়া।’

চন্দন কি হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনতে বলছে? উত্তেজিত স্নায়ু ঠান্ডা করার দাওয়াই দিচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয়? না। মুচকি হেসে ঘাড় নাড়ে অভি। চন্দন যত বড় পড়ুয়াই হোক না কেন, চৌরাসিয়ার বাঁশি শোনার মতো অ্যান্টেনা নেই। ও চৌরাসিয়ার লেখা অ্যানাটমি বই পড়তে বলছে। গ্রে আর ডক্টর মিত্রর সঙ্গে চার খণ্ড বি ডি চৌরাসিয়ার অ্যানাটমি বই বিলুর রুম থেকে গত সপ্তাহেই অভি বাড়ি নিয়ে এসেছে। এনেছে ফিজিয়োলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রির বই। আগামী বছরগুলোতেও তাকে কোনও বই কিনতে হবে না। দুই ভাই এক স্ট্রিমে পড়ার এই এক সুবিধে। এডিশান চেঞ্জ হলে অন্য ব্যাপার।

বুক শেলফ থেকে চৌরাশিয়ার ভলিউম টু পাড়তে গিয়ে অভির মনে হল, গ্রে বা ডক্টর মিত্রর অ্যানাটমি বইতে কোনও আন্ডারলাইন বা হাইলাইটিং দেখেনি। অভি জানে, বিলুর স্বভাব হল বইতে দাগ দেওয়া, মার্জিনে নোট নেওয়া, লুজ কাগজে অতিরিক্ত তথ্য লিখে বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখা। সেগুলো নেই মানে, গ্রে বা মিত্রর বই বিলু পড়েনি।

চৌরাশিয়ার বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড খুলে অভি নিশ্চিন্ত হল। হ্যাঁ, এই বইটাকেই বিলু টেক্সট হিসেবে পড়েছিল। পাতায় পাতায় লাল-নীল-হলুদ-সবুজের হাইলাইট, গুঁজে রাখা কাগজের তাড়া তাই বলছে।

নিজের ওপরে বিরক্ত হল অভি। কলেজে ঢোকার পর থেকে বিলুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। দু’সপ্তাহ আগেও রোজ কথা হতো। এখন তিনদিনে একবার হয় কিনা সন্দেহ। বিলুকে জিজ্ঞাসা করলেই আইটেম সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। চৌরাসিয়ার বইয়ের ডরসাম অফ দ্য ফুট চ্যাপ্টারটা খুলল অভি। চমৎকার ডায়াগ্রাম, ছোট্ট ছোট্ট প্যারাগ্রাফ, পয়েন্ট করে লেখা রয়েছে পা—বৃত্তান্ত। ছবি ও লেখা মিলে দশপাতা। ঘড়ির দিকে তাকাল অভি। সাড়ে আটটা বাজে। দেখা যাক, কতক্ষণে এই নরক যন্ত্রণা শেষ হয়।

অভির ধারণা ছিল, কোনও কিছু মুখস্থ করার জন্য প্রথমবার পড়াটা সব থেকে শক্ত কাজ। প্রথমবার পড়া শেষ করে, রাতের খাওয়া খেয়ে রাত সাড়ে দশটার সময় দ্বিতীয় বারের জন্য পড়তে বসে অভির মনে হল, ধারণাটা ভুল। দ্বিতীয় পাঠ সবচেয়ে শক্ত। কেননা, প্রথম পাঠে সবটাই অজানা। ভুলে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দ্বিতীয় পাঠে স্মৃতিকে পরীক্ষা দিতে হয়। অবাক হয়ে অভি দেখল, প্রথমবার পড়ার সময় সে যা যা পড়েছিল তার সবকিছু সম্পূর্ণ ভুলে মেরেছে! কী হতাশাজনক ঘটনা! আর একটু হলেই অভি কেঁদে ফেলছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে অ্যানাটমির নিমোনিক্স আওড়ায় অভি। ‘টল হিমালয়াস আর নেভার ড্রাই প্লেসেস।’

কোনও জিনিস মুখস্থ করার জন্য নিমোনিক্স খুব ভালো অস্ত্র। রামধনুর সাত রঙ মুখস্থ করার জন্য বলা হয় ‘বেনীআসহকলা’। অর্থাৎ, বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল—এই সাত রঙের আদ্যক্ষর সাজিয়ে তৈরি হয়েছে শব্দটি। অ্যানাটমিতেও নানান তালিকা মুখস্থ করতে হয়। ক্রম বজায় রেখে একগাদা নাম মুখস্থ করার জন্য আদ্যক্ষর পরপর সাজিয়ে, অদ্ভুতুড়ে এবং মজাদার বাক্য তৈরি করা হয়। হাস্যকর এবং ‘ক্যাচি’ বলে বাক্যগুলো মনে থেকে যায়। অ্যানাটমিতে এত বেশি নিমোনিক্স আছে যে শুধু নিমোনিক্স-এর জন্য একটা পকেট বই কিনতে পাওয়া যায়।

নিমোনিক্স নিয়ে ভয়ের কারণ হল, অনেক সময় শুধু মজার বাক্যটা মনে থাকে। মূল লিস্টটা মনে পড়ে না। এখন যেমন অভির হচ্ছে। গোড়ালির এক্সটেনসর রেটিনাকুলামের ভিতর দিয়ে কোন কোন শিরা-ধমনি, স্নায়ু-পেশি গেছে, তার নিমোনিক্স হল, ‘টল হিমালয়াস আর নেভার ড্রাই প্লেসেস।’

অভি নিজের মনে আওড়াচ্ছে। ‘ ”টল” মানে ”টিবিয়ালিস অ্যান্টিরিয়র” মাসল। ”হিমালয়াস” মানে ”এক্সটেনসর হ্যালুসিস লঙ্গাস” মাসল। ”আর” মানে ”অ্যান্টিরিয়ার টিবিয়াল আর্টারি”। ”নেভার”…মনে পড়ছে না। ”ড্রাই”…মনে পড়ছে না। ”প্লেসেস” মানে ”পেরোনিয়াল টার্শিয়াস মাসল”।’ স্বগতোক্তি শেষ করে যে দুটো জিনিস ভুলে গেছে, সেগুলো আবার দেখে নেয় অভি।

দ্বিতীয় পাঠ শেষ। দশখানা ছবি আঁকা প্র্যাকটিস করে ঘড়ির দিকে তাকাল অভি। একটা বাজে। এখন এক কাপ কফি বা চা পেলে ভালো হতো। মা-বাবা দুজনেই ঘুমোচ্ছে। রাধা আর মানদাও ঘুমোচ্ছে। দোতলায় নেমে রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাস জ্বালালে মনোজ-অরুণার ঘুম ভেঙে যাবে। তা ছাড়া, অভি চা বানাতে পারে না। ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম খাবে নাকি? আইসক্রিম খেলে কি ঘুম পালায়? কে জানে! অভি ঠিক করে, কাল কলেজে যাওয়ার আগে মাকে বলবে, থার্মোফ্লাস্ক বার করে রাখতে। ফ্লাস্কে দু’কাপ চা বানিয়ে রেখে দিলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

কিন্তু এখন ঘুম-সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? পড়ার টেবিল থেকে উঠে ছাদে পায়চারি করতে যায় অভি। চারদিক শুনশান। আকাশে অনেক তারা। ঘাড় উঁচু করে আকাশ দেখার অভ্যাস নেই অভির। সন্ধে নাগাদ যদি বা কখনও তাকায় ধোঁয়া আর কুয়াশার কারণে নোংরা ন্যাতার মতো লাগে আকাশকে। এখন, এই গভীর রাতে, সলমা-চুমকি বসানো ওড়নার মতো লাগছে আকাশকে।

ওড়নার আড়ালে কারও মুখ দেখা যাচ্ছে কী? টানা টানা চোখ, ফোলা ফোলা গাল, টোল ফেলা গালওয়ালা কোনও মেয়ে?

নিজের মাথায় চাঁটি কষায় অভি। আগামিকাল প্রথম আইটেম। এখন চন্দ্রাহত হওয়ার সময় নয়। এখন ডরসাম অব দ্য ফুট নিয়ে তৃতীয়বার রগড়াবার সময়। এটাই ফাইনাল রিহার্সাল। আগামিকাল সময় পাওয়া যাবে না। ঘরে ফিরে আবার পড়ার টেবিলে বসে অভি। ডরসালিস পেডিস আর্টারির ব্রাঞ্চগুলো কী কী যেন…চৌরাসিয়ার দ্বিতীয় খণ্ড বন্ধ করে সাদা খাতায় লাল স্কেচ পেন দিয়ে ছবি আঁকতে থাকে।

সকাল সাতটায় মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল অভি। অরুণার ডাকাডাকিতে ঘুম ভালো সাড়ে আটটায়। কখন অ্যালার্ম বেজেছে, বুঝতে পারেনি। তৃতীয়বার রগড়ানো শেষ হল রাত তিনটের সময়। তখনও অভি কনফিডেন্ট নয়। চতুর্থ পাঠে মনে হল, এতক্ষণে পায়ের অ্যানাটমির একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। পঞ্চমবার পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন ভোর হচ্ছে।

এক লাফে বাথরুম। নিত্যকর্মপদ্ধতি সেরে, জামাপ্যান্ট গলিয়ে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে দৌড়। মনোজ দাড়ি কামাতে কামাতে বললেন, ‘চান করলি না?’

অভি উত্তর দিল না।

অরুণা চিৎকার করলেন, ‘রুটি-তরকারি করেছি। খেয়ে যা।’

রাস্তায় নেমে দৌড়তে দৌড়তে অভি বলল, ‘ন’টা আঠাশের ট্রেন। এখন ওসব করা যাবে না।’

ডানকুনি লোকালে বাদুড়ঝোলা হয়ে শিয়ালদা পৌঁছল সাড়ে দশটায়। দৌড়তে দৌড়তে যখন কলেজে ঢুকল, পৌনে এগারোটা। দশটা থেকে প্রথম থিয়োরি ক্লাস শুরু হয়েছে এসএলটিতে। সে ক্লাস শেষ হতে চলল। বায়োকেমিস্ট্রি ক্লাসে কাউকে প্রক্সি দিতে বলা ছিল না। তার মানে অ্যাটেনড্যান্স রেজিস্টারে লাল দাগ। ব্যাজার মুখ করে ক্যান্টিনে ঢুকে অভি বলল, ‘জীবনদা, ডিম-টোস্ট আর এক কাপ চা। ফটাফট।’

জীবনদা বলল, ‘ডিমটা তুমি পাড়বে না আমি?’

উত্তর না দিয়ে ক্যান্টিনের টেবিলে মাথা রেখে ঝিমোতে লাগল অভি। বারো ঘণ্টা পেটে কিছু পড়েনি। শরীর দুর্বল লাগছে। মাথাটাও কেমন করছে! খেয়ে-দেয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে আর একপ্রস্ত ঝালাতে হবে। কাল যা পড়েছে, তার কিছু মনে আছে কি? কে জানে!

‘অ্যাই শালা!’ কলার ধরে অভিকে শূন্যে তুলে ধরেছে রিপু। ‘ক্লাস না করে ক্যান্টিনে ঠেক মারতে এসেছিস? চল! আমাদের কলেজ ফেস্ট ”ওপিয়াম”-এর মিটিং আছে। তোকে অ্যাড তোলার কাজে লাগাব।’

‘আজ না রিপুদা,’ কাঁইমাই করে ওঠে অভি, ‘আজ আমার আইটেম আছে।’

‘তো?’ অভিকে বেঞ্চিতে বসিয়ে ভুরু নাচায় রিপু। ‘সবার আইটেম থাকে। নাথিং নিউ।’

‘আজ আমার ফার্স্ট আইটেম। ডরসাম অব দ্য ফুট। হেবি ভয় করছে।’

‘ব্যস! হয়ে গেল,’ কপাল চাপড়ায় রিপু। ‘এই জঘন্য আইটেম দিয়ে তোর ভাইভা শুরু হল? প্রথমবারের জন্য সহজ কিছু বাছতে পারলি না?’

‘বাছাবাছি কি আমার হাতে?’ জীবনদার দেওয়া ডিম-টোস্টে কামড় বসিয়ে অভি বলে, ‘আমাদের কলেজ ফেস্টের নাম ”ওপিয়াম” কেন? অন্যান্য কলেজ ফেস্টের নাম কত সুন্দর হয়। জাভোৎসব, মিতালি, ফেস্টাম…’

‘ওপিয়াম থেকে পেনকিলার মেডিসিন তৈরি হয়। ডাক্তারি-শাস্ত্রের সঙ্গে যোগসূত্র আছে। প্লাস আফিম মানে নেশাভাং, আনন্দ-ফুর্তি… এনিওয়ে তোকে এখন ঘাঁটাব না। আইটেম দিয়ে ক্যান্টিনে আসিস। মিটিং-এ থাকতে হবে।’ অভির প্লেট থেকে সিকি খাওয়া ডিম-টোস্ট মুখে পুরে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল রিপু।

দূর বাবা! খেতেও দিল না। বিরক্ত হয়ে অভি ভাবল, আর একটা ডিম-টোস্ট অর্ডার দেবে। না থাক। বারোটার সময় এনজির সামনে বসতে হবে। তার আগে একবার অ্যানাটমির জাবর কাটা প্রয়োজন। এক চুমুকে ঠান্ডা চা শেষ করে লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ায় সে।

‘নাম?’

‘অভিজ্ঞান লাহিড়ী।’

‘গ্রুপ?’

‘এ।’

‘কার্ডে লেখোনি কেন?’ অভির দিকে দু’ভাঁজ করা গোলাপি কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বলেন এনজি। গ্রিটিং কার্ডের মতো দেখতে চার পৃষ্ঠার কার্ডের প্রথম পাতার ওপর দিকে নামধাম লেখার জায়গা। তার নীচে পর পর পার্ট আর আইটেমের নাম। প্রথম পৃষ্ঠায় নাম, রোল নম্বর, গ্রুপ লিখে এনজিকে কার্ড ফেরত দিল অভি।

‘নেম দ্য বোনস দ্যাট ফর্ম অ্যাঙ্কল জয়েন্ট।’ অভির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন এনজি। এই রে! হাড়গোড়ের লিস্ট তো অস্টিওলজি সেকশানে আছে। সেটা পড়েনি অভি। চৌরাসিয়ার বইতে ‘ডরসাম অফ দ্য ফুট’ চ্যাপ্টারে হাড়ের নাম ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় আছে। পুরো অধ্যায় থেকে হাড়ের নামগুলো মনে করতে থাকে অভি। ‘ট্যালাস, লোয়ার এন্ড অব টিবিয়া অ্যান্ড ফিবুলা…’

‘থেমে থেমে বলছ কেন? পড়ে আসোনি? আমি তো ক্লাসে বলে দিয়েছি, আইটেম দেওয়ার কোনও বাঁধাধরা ডেট নেই। কনফিডেন্ট ফিল করলে তবেই আসবে। খারাপ পারফর্ম করলে ফেরত পাঠিয়ে দেব।’

‘না স্যার! আমি পড়েছি।’ এনজিকে থামায় অভি। একবার যদি ফেরত পাঠিয়ে দেয়, তাহলে কাল রাতের নরক যন্ত্রণা আবার সহ্য করতে হবে। বাবা গো!

‘ইংরিজি বলায় সমস্যা থাকলে বাংলায় উত্তর দিতে পারো।’ টুকটুক করে ঘাড় নেড়ে বলেন এনজি। ‘ডরসালিস পেডিস আর্টারির কোর্স বলো। ফাম্বল না করে, স্টেডিলি।’

কোশ্চেন কমন পড়ে গেছে! উল্লসিত অভি গড়গড় করে পায়ের পাতার প্রধান শিরার গতিপথ বর্ণনা করতে থাকে। তাকে থামিয়ে দিয়ে এনজি বলেন, ‘ডিপ পেরোনিয়াল নার্ভের কোর্স বলো।’

যাববাবা! প্রশ্নের উত্তর কনফিডেন্টলি দিলেই থামিয়ে দিচ্ছে! তার মানে, জানা থাকলেও একটু কুঁতোনোর অভিনয় করতে হবে। এই প্রশ্নের উত্তর যেমন অভির জানা। স্নায়ুর শুরু থেকে শেষ সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। তাও থেমে থেমে উত্তর দেয়। হিসেব মতো এনজি পুরো উত্তর শুনলেন। মাঝপথে থামিয়ে পরের প্রশ্নে চলে গেলেন না।

‘মার্চ ফ্র্যাকচার কাকে বলে?’ পরের প্রশ্ন। এবং বাউন্সার। এটা চৌরাসিয়ার বইতে নেই। বিলু দুটো ছোট কাগজ ‘ডরসাম অব দ্য ফুট’ চ্যাপ্টারে গুঁজে রেখেছিল। একটা কাগজে লেখা ছিল ‘মার্চ ফ্র্যাকচার’। অভি পড়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। সেইটাই এনজি জিজ্ঞাসা করলেন? উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে অভি।

‘কী বই পড়েছ?’ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করছেন এনজি। রাগে তাঁর মুখ থমথম করছে।

কী উত্তর দেবে অভি? গ্রে বা মিত্র-র নাম না বলে চৌরাসিয়ার নাম বললে এনজি যদি খচে ফায়ার হয়ে যান? অন্যদিকে মিথ্যে কথা বলার বিপদ অনেক। দুয়েকটা প্রশ্ন করে এনজি বুঝে যাবেন, অভি কোন বই পড়েছে।

অভি সত্যি কথা বলে, ‘চৌরাসিয়া পড়েছি স্যার।’

‘চৌরাসিয়া ভালো বই। কিন্তু ওতে এসব নেই। তুমি ”স্নেল”-এর ক্লিনিকাল অ্যানাটমি কেনোনি?’

অভি যে কোনও বইই কেনেনি এটা এনজিকে বলার প্রয়োজন নেই। সে বলল, ‘না স্যার।’

এনজি কিছু বলার আগে অভি একটা অচেনা গন্ধ পেল। ফুলেল পারফিউমের গন্ধ। এমন মেয়েলি গন্ধ কে মেখেছে? গেস করার আগে শুনতে পেল, তার পাশে দাঁড়িয়ে বৃন্দা বলছে, ‘স্যার। আইটেম।’

‘বসে পড়ো।’ অভির পাশের টুলের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন এনজি

অভির বুকের ওপর দিয়ে এখন রেলগাড়ি যাচ্ছে। তার সমস্ত অনুভূতিকে অবশ করে দিয়েছে অচেনা বুনো ফুলের গন্ধ। সে পড়া ভুলে যাচ্ছে। এনজি প্রশ্ন করলেন ‘বৃন্দা, তোমার কী টপিক?’

‘আমার আর ওর এক আইটেম। আমরা এক গ্রুপে।’ অভির দিকে আঙুল দেখায় বৃন্দা, ‘ডরসাম অব দ্য ফুট বড্ডো টাফ স্যার। কিছু মনে থাকছে না।’

গলা খাঁকরে বলেন এনজি, ‘এই আইটেমটায় এত বেশি নাম মনে রাখতে হয় যে আমারই মাঝে মধ্যে গুলিয়ে যায়। ওই জন্যেই এই আইটেমটা ফার্স্টে রেখেছি।’

যে এনজি এতক্ষণ ভুরু কুঁচকে দাঁত খিঁচোচ্ছিলেন, তিনি এখন অপূর্ব মখমলি কণ্ঠে কথা বলছেন! বোঝো কারবার! অভি অবাক। মেয়ে হওয়ার কী সুবিধে রে বাবা! এই রকমটা আগে জানলে সে সেক্স চেঞ্জ অপারেশন করিয়ে ডাক্তারি পড়তে ঢুকত।

‘অভিজ্ঞান তুমি এক কাজ করো। তুমি বৃন্দাকে প্রশ্ন করো।’ অভিকে আদেশ করেন এনজি। তথাস্তু! দীর্ঘশ্বাস ফেলে অভি জানতে চায়, ‘নেম দ্য বোনস দ্যাট কনস্টিটিউট অ্যাঙ্কল জয়েন্ট।’

‘অ্যাঙ্কল জয়েন্ট কন্সটিটিউটস অব…’ গড়গড় করে বলতে শুরু করেছে বৃন্দা। অভি মনে মনে জিভ কাটল। সে এই প্রশ্নের উত্তর বলতে পারেনি।

বৃন্দার জবাব শেষ হতে এনজি বৃন্দাকে বললেন, ‘এবার তুমি ওকে একটা প্রশ্ন করো।’

‘নেম দ্য স্ট্রাকচারস দ্যাট গো আন্ডার এক্সটেনসর রেটিনাকুলাম অফ অ্যাঙ্কল জয়েন্ট।’ মৃদু হেসে প্রশ্ন করে বৃন্দা। এই চ্যাপ্টারের সবচেয়ে কমন প্রশ্নটা করতে পেরে সে খুশি। এই প্রশ্নের উত্তরও গড়গড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তাহলেই এনজি থামিয়ে দিয়ে পরের প্রশ্নে চলে যাবে। সন্তর্পণে এগোয় অভি। টল হিমালয়াস আর নেভার ড্রাই প্লেসেস।

‘নেক্সট কোয়েশ্চেন?’ অভির উত্তরদান পর্ব শেষ হলে তাকে আদেশ করলেন এনজি। অভি সহজ প্রশ্ন করল। ‘ডেসক্রাইব দ্য কোর্স অব ডরসালিস পেডিস আর্টারি।’

বৃন্দা প্রশ্নের উত্তর দিল গড়গড় করে। তারপর প্রশ্ন করল, ‘এক্সটেনসর হ্যালুসিস লঙ্গাস মাসলের অরিজিন আর ইনসারশন কোথায়?’

জানা প্রশ্ন। চেনা উত্তর। গড়গড় করে বলতে গিয়ে হঠাৎ আটকাল অভি। তার মাথাটা হঠাৎ খালি হয়ে গেল। চেতনার ওপরে ঝপাং করে নেমে এল সাদা পর্দা। পায়ের পেশির উৎস ও মোহনা তো দূরস্থান, সে কোথায়, কার সামনে বসে রয়েছে, পাশে কে বসে, এটা কোন কলেজ—কিছু মনে পড়ছে না। তার নিজের নাম মনে পড়ছে না। সে যেন কোনও ট্রান্সে রয়েছে। রাধা পাগলির মতো মুহূর্তের মধ্যে তার-জোড়া থেকে তার-কাটা মেন্টাল স্টেটে চলে গেছে।

‘কী হল? বল!’ এনজিকে লুকিয়ে অভির হাঁটুতে খোঁচা দিল বৃন্দা। অভি ভেবলুর মতো এনজির দিকে তাকিয়ে রইল।

‘রাতে ঘুমোওনি?’ সহৃদয় প্রশ্ন এনজির।

‘না স্যার।’ মিনমিন করে জবাব দেয় অভি।

‘সকালে কিছু খেয়েছ?’

‘এক কাপ চা আর ডিম টোস্ট।’ মাথা নিচু করে বলল অভি। বলতে বলতেই হঠাৎ তার মাথার থেকে কালো পর্দাটা সরে গেল। মাথা আবার কাজ করছে। সাগরের ঢেউ-এর মতো স্মৃতি ফেরত আসছে। দিব্যি মনে পড়ে যাচ্ছে এক্সটেনসর হ্যালুসিস লঙ্গাসের অরিজিন ও ইনসারশান। তার-কাটা অবস্থা থেকে তার-জোড়া অবস্থায় ফিরে এসে অভি তড়বড় করে বলতে থাকে, ‘এক্সটেনসর হ্যালুসিস লঙ্গাস ইজ অরিজিনেটেড ফ্রম…’

‘থাক!’ হাত তুলেছেন এনজি। ‘তোমার হাইপোগ্লাইসিমিয়া হয়েছে। ব্রেনে গ্লুকোজ কমে গেলে এরকম হয়। বৃন্দা, ওকে এক্ষুনি চিনির জল খাওয়াও। না হলে অজ্ঞান হয়ে যাবে।’ অভির আইটেম কার্ড টেনে তিনি নম্বর দিলেন, ‘চার।’ দশের মধ্যে চার পাওয়া মানে ফেল। তারপর বৃন্দার কার্ড টেনে লিখলেন, ‘আট।’

‘আমাকে আবার এই আইটেমটা দিতে হবে স্যার?’ ঘামতে ঘামতে বলল অভি।

‘হ্যাঁ। সেদিন ভালো করে খেয়ে-দেয়ে এসো।’ এনজি চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

আবার এই বিভীষিকা চ্যাপ্টার পড়তে হবে? আবার সেই রাত জাগা? আবার মোটামোটা বই ওলটানো? আবার ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস? আবার নিমোনিক্স মুখস্থ করা? এর থেকে মরে যাওয়াও ভালো। টেবিলে মাথা রেখে হুহু করে কাঁদতে থাকে অভি। বুঝতে পারে বৃন্দা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বলছে, ‘এত তাড়াতাড়ি ধ্বস খেলে হবে? এই তো সবে শুরু। এমবিবিএস প্র্যাকটিকালের সময় এইরকম একশোটা আইটেমের যে কোনও জায়গা থেকে প্রশ্ন করবে। সেটা কে সামলাবে?’

বিড়বিড় করে অভি নিজেকে বলল, ‘কেন এলাম এখানে? কেন? এসব আমার জন্য নয়।’ সে ঠিক করল এখনই এই কলেজ থেকে বেরোবে। আর কোনওদিন ফেরত আসবে না। টাটা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ। গুডবাই বৃন্দা। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে গটগট করে ডিসেকশান রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে।

‘অ্যাই অভি! হনহন করে কোথায় যাচ্ছিস?’ পিছন থেকে চিৎকার করেছে বৃন্দা। অভি উত্তর না দিয়ে হাঁটা দেয়। বৃন্দা দৌড়ে এসে অভির হাত চেপে ধরে বলে, ‘কোথায় যাচ্ছিস? জবাব দে।’

শার্টের হাতায় চোখ মুছে অভি বলে, ‘ছাড়!’

‘ছাড়ব না। আগে বল কোথায় যাচ্ছিস?’

‘বাড়ি। আমি ডাক্তারি পড়ব না। এসব আমার জন্য নয়। আমার ইনক্লিনেশান অন্য দিকে। এই লাইনে এসে আমি ভুল করেছি।’ কঠিন গলায় বলে অভি।

‘ঠিক আছে। পড়বি না। এই নিয়ে নাটক করছিস কেন? চল, জীবনদার ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চা খাবি। তোর ফেয়ারওয়েল ড্রিঙ্ক।’ অভির হাত ধরে ক্যান্টিনের দিকে এগোয় বৃন্দা। মাথা নিচু করে অভি ভাবে, বৃন্দার কথা শুনে ভুল হয়ে গেল। এক্ষুনি রিপুর পাল্লায় পড়তে হবে। ওকে এইসব কথা বলা যাবে না। বৃন্দা না বলে দেয়। তাহলে আর এক প্রস্ত বেইজ্জত।

ক্যান্টিনের টেবিল চাপড়ে আপ্পু গান গাইছে, ‘মার কাটারি কচি ডাবে। শাঁস পাবে, জলও পাবে।’ রিপু ধুয়ো দিচ্ছে, ‘পাবে পাবে, পাবে পাবে।’ অভি হেসে ফেলে বলল, ‘কোথায় পাও এইসব ফালতু গান? ডাবল মিনিং-এ ভর্তি?’

‘হুঁহুঁ বাওয়া! এসব হল সাবঅল্টার্ন গান। কলকাতার লোকে নাক সিঁটকোবে। গ্রাম বাংলায় সুপারহিট।’

‘গ্রামবাংলার গানের খবর তুমি পেলে কোথা থেকে?’

‘ওরে, আমরা মানুষের সঙ্গে মিশি। মানুষের পালস বুঝি। আমরা এই গান জানব না তো কি তুই জানবি?’ হাসতে হাসতে হুমকি দেয় আপ্পু। অভি বলে, ‘এটা কার গাওয়া?’

‘জানি না। এই মিউজিক ভিডিয়োটা আমাদের সাপ্লাই করেছে উচ্চ মাধ্যমিকের ফার্স্ট বয়, কুমার চন্দন।’ মোবাইল খুলে ভিডিয়োটা অভির সামনে মেলে ধরে। অ্যামেচার ভিডিয়োতে হিরোর পোশাক আর ডান্স স্টেপ দেখে অভি পেট চেপে ধরে হাসতে লাগল।

বৃন্দা বলল, ‘আমায় দেখা।’ তারপর অভির হাত থেকে মোবাইল কেড়ে ক্লিপিং দেখতে লাগল।

আপ্পু বলল, ‘হিরোইনের মুভমেন্ট খেয়াল করিস।’

পরবর্তী পনেরো মিনিট ক্যান্টিনে আর কিছু হল না। সবাই ব্লু-টুথ ডিভাইস দিয়ে ক্লিপিংটা নিজের নিজের মোবাইলে নিয়ে নিল। রিপু বলল, ‘ ”দয়াল বাবা কলা খাবা” বলে একটা গান আছে। বাড়ি ফিরে ইউটিউবে দেখে নিস। অভি তোর আইটেম কেমন হল?’

অভি কিছু বলার আগে বৃন্দা বলল, ‘অভিকে তোমরা এখন বিরক্ত কোরো না। ও ফাউল মুডে আছে।’

অভি ঘাবড়াল। বৃন্দা মেয়েটা এইরকম বেয়াক্কেলে? সবার সামনে বলে দেবে তার আইটেমে ঝাড়ের কথা? ধুর! ভাল্লাগে না। ক্যান্টিনে এসে মনটা ভালো হয়েছিল। আবার হেজে গেল।

‘কেন?’ প্রশ্ন করে আপ্পু, ‘আইটেমে ঝাড় খেয়েছে নিশ্চয়?’

‘ঝাড় তো খেয়েছে। সেটা কোনও ব্যাপার নয়। বেচারি ঝাড় খেল আমার জন্য। এই ভেবে আমার খারাপ লাগছে।’ করুণ মুখে বলে বৃন্দা। রিপু খচে ফায়ার হয়ে বলে, ‘তুই নির্ঘাৎ ওর আইটেমের সময়ে এনজির কাছে আইটেম দিতে গিয়েছিলি?’

‘হ্যাঁ।’ অবিকল অভির কায়দায় মুখ নিচু করে বলে বৃন্দা। রিপু অভিকে বলে, ‘লেসন নাম্বার ওয়ান। সুন্দরী মেয়ের পাশে বসে কখনো পরীক্ষা দিবি না। ঝাড় অবধারিত। এক্সামিনার ফিমেল হলে এই লেসন খাটবে না। স্পেশালি বায়োকেমিস্ট্রির আরতী ম্যাডাম বা প্যাথলজির রিনা ম্যাডাম হলে ওরা ফেল আমরা পাস। বৃন্দা নিশ্চয় পাস করেছে?’

অভি উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘ওকে আট দিল। আর আমায় চার। আবার ওই ছাইপাঁশ পড়তে হবে।’

‘একদম পড়বি না।’ পরামর্শ দেয় আপ্পু। ‘আগামিকাল এই প্রিপারেশান নিয়েই এনজির সামনে বসবি। দেখবি, ছয় কি সাত দিয়েছে।’

‘আচ্ছা,’ ঘাড় নাড়ে অভি। এবার তাকে উঠতে হবে। জীবনদার ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে মেন গেটের দিকে হাঁটছে অভি, পিছন থেকে বৃন্দা বলল, ‘কাল পপলিটিয়াল ফসার ডিসেকশান আছে। পিএম রেসপিরেটরি সিস্টেম পড়াবেন। ঠিক সময়ে আসিস।’

‘আচ্ছা।’ ঘাড় নাড়ে অভি। শেয়ালদা স্টেশানের দিকে যেতে যেতে মনে হয়, বৃন্দা চা খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে ডেকেছিল। সেটাই খাওয়া হল না।