দময়ন্তী
ড্যানিয়েল সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে যাবেন। শক্তিরূপা স্কুপ চ্যানেলের ডিজাইনার আড্ডায় যাবেন। একত্রিশে ডিসেম্বরের রাতে দময়ন্তী গোলমহলের গোলঘরে একা বসে ভ্যারেন্ডা ভাজবে? অসম্ভব! বিকেলবেলা এই নিয়ে ড্যানিয়েল-শক্তিরূপার সঙ্গে দময়ন্তীর ঝগড়া হয়ে গেল।
ড্যানিয়েল বললেন, ‘আমি তো সাড়ে বারোটার মধ্যে চলে আসব।’
শক্তিরূপা বললেন, ‘আমিও তাই।’
দময়ন্তী কী করে দুজনকে বোঝায় যে, ওঁরা রাত আটটার মধ্যে বেরিয়ে যাবেন। রাত আটটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত একা বাড়িতে কাটানো যায়? তাও বর্ষশেষের রাতে? এবং ওপিয়ামের তৃতীয় এবং অন্তিম রাতে। যখন সেন্ট্রাল হলে কালচারাল এক্সট্রাভ্যাগানজাতে ‘মাটি’ পারফর্ম করছে?
ড্যানিয়েল সাজেশন দিয়েছিলেন, ‘সিনেমা দেখে আয়!’
খারাপ সাজেশান নয়। বছরের শেষদিন শুক্রবার পড়েছে। কিন্তু আজকে কুচ্ছিত দুটো সিনেমা রিলিজ করেছে। একটার নাম ‘আদা…এ ওয়ে অব লাইফ।’ অন্যটার নাম ‘ভূত অ্যান্ড ফ্রেন্ডস।’
প্রথমটায় আছে নওহিদ সাইরুশি, আয়েষা ঝুলকা আর রাহুল রায়। দ্বিতীয়টা জ্যাকি শ্রফ আর অশ্বিন মুশরান। এসব ছবি দেখা যায়? রাহুল রায় দময়ন্তীর জন্মের কাছাকাছি সময়ে ‘আশিকি’ নামে একটা সিনেমা করেছিলেন। অনু আগরওয়াল হিরোইন ছিলেন। গানের জন্য সিনেমাটা হিট করে। ইউটিউবে গানগুলো দেখেছে দময়ন্তী। সিনেমাটা জাস্ট নিতে পারেনি। সেই রাহুল রায়ের আর একটা সিনেমা? ইইইকস!
আয়েষা ঝুলকাও অতীতের ফ্লপ হিরোইন। নওহিদ মেয়েটা টিভির ভিডিয়ো জকি। জ্যাকি শ্রফের চোখের নীচে অ্যালকোহলের পাউচ ব্যাঙের মতো ফোলা। এত বড় একটা বিয়ার বেলি। ছ্যা ছ্যা! এদের ছবি দেখার কথা ভাবা মানেও পাপ।
‘টুনপুর কা সুপারহিরো’ চলছে, ‘তিস মার খান’ চলছে, ‘নো প্রবলেম’ চলছে, ‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ চলছে।
‘ব্যান্ড বাজা বারাত’ নিয়ে দময়ন্তীর আগ্রহ আছে। রণবীর সিংহ নামে একটা নতুন হিরো আর অনুষ্কা শর্মা নামে একটা নতুন হিরোইন আছে। প্লাস যশরাজ প্রোডাকশানের ছবি। খুব ঝোলাবে না। কিন্তু তার মন টানছে ওপিয়াম। মন টানছে ‘মাটি’। বৃন্দাও আজ লেডি আর্চার্স হোস্টেলে থাকবে। ওয়াইন খেয়ে মাটির পারফরম্যান্সের সময় নাচানাচি করে হোস্টেলে থেকে যাওয়ার প্ল্যান আছে। এত কথা বাবা-মাকে বলা যায়?
এবারের ওপিয়ামের সাফল্য চমকপ্রদ। শুধু আইএমসির ছেলেমেয়েরা নয়, অন্য কলেজের ছেলেমেয়েরাও এই কথা বলছে। এবং তার একমাত্র কারণ অজস্র কলেজের ছেলেমেয়েদের পার্টিসিপেশান। কলকাতার প্রধান সবকটা কলেজ তো এসেইছে, মফস্বল এবং জেলার কলেজও যোগ দিয়েছে। শিলচর, জামশেদপুর, বোকারো, পটনা, ভুবনেশ্বরের কয়েকটা কলেজও এসেছে। ছেলেমেয়েরা টিনটিনের পিঠ চাপড়াচ্ছে। কিন্তু গোটা ফার্স্ট ইয়ার জানে, এর পুরো ক্রেডিট চন্দনের। নেট থেকে সমস্ত কলেজের মেল আইডি জোগাড় করে চন্দন আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিল। বয়েজ আর গার্লস হোস্টেলের একটা উইং খালি করে, সেখানে দূর থেকে আসা ছেলেমেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। খাওয়ানোর দায়িত্ব হোস্টেলের ক্যান্টিনকে না দিয়ে, তুলে দিয়েছে শিয়ালদার নামকরা কেটারিং কোম্পানির মালিক উৎপল বারিকের হাতে। অন্য রাজ্য থেকে আসা ছেলেমেয়েরা ভীষণ খুশি। প্রত্যেকে বলেছে সামনের বছর আবার আসবে। অন্য কলেজকেও নিয়ে আসবে।
জমাট কম্পিটিশান হয়েছে। অন্যান্যবার কলকাতার কলেজগুলোই ফার্স্ট সেকেন্ডের প্রাইজ নিয়ে যায়। এবার অসম আর ঝাড়খণ্ডের কলেজ অনেক প্রাইজ পেয়েছে। সেই তুলনায় পশ্চিমবাংলার জেলার কলেজের পারফরম্যান্স বেশ খারাপ।
প্রথমদিন গেস্ট পারফরমার হিসেবে সন্ধেবেলা এসেছিল কলকাতার এক নম্বর ডিজে ‘পয়জন’। লো-রাইজ জিনস আর হাতকাটা লেদার জ্যাকেট, মাথার বেগনি রঙের চুলে মো—হক করা, হাতের দশ আঙুলে কুড়িটা আঙটি, দু’কানে ছ’টা দুল, ভুরুতে দুল, গা ভরতি ট্যাটু—আক্ষরিক অর্থেই ‘বিষ’ জিনিস! তবে নিজের কাজটি ভালো বোঝে। রাত আটটার সময় সেন্ট্রাল হলে কিশোর কুমারের গান দিয়ে শুরু করল। সেন্ট্রাল হলে তখন কেউ নেই। পুরনো দিনের গান শুনতে টুকটুক করে জড়ো হল ছেলেমেয়ের পাল। পয়জন তখন কুমার শানু-অলকা যাগ্নিক জুটির হিট গান চালাচ্ছে। রাত ন’টা থেকে সে আইটেম নাম্বারে শিফট করল। ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে ফ্লেভার্ড ভদকার বোতল। শুরু হল উদ্দাম নাচ। সাইকেডেলিক আলোর খেলার সঙ্গে সঙ্গে গান বদলাল। এল ব্রিটনি, শাকিরা, রিহানা, ম্যাডোনা। রাত বারোটায় পয়জন যখন অনুষ্ঠান শেষ করল তখন সেন্ট্রাল হল জুড়ে নাচতে থাকা ছেলেমেয়েদের শরীরে আর কোনও এনার্জি নেই। রিপু, টিনটিন আর চন্দন পিছনে বসে পুরো অনুষ্ঠানটা দেখেছে। পয়জনের হাতে চল্লিশ হাজার টাকার চেক তুলে দিয়ে টিনটিন বলল, ‘থ্যাংকস।’
দ্বিতীয় রাতে ছিল জমজমাট ‘ফ্যাশান শো ফর কলেজ-গোইং গাইজ অ্যান্ড গার্লস’। আয়োজনে ‘ওম’। রাত আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত রোগা এবং স্বল্পবসনা মেয়ে আর মাসল ফোলানো ছেলেরা একটানা হাঁটাহাঁটি করে দেখিয়েছে ফান টি-শার্ট, জিনস, লেগিংস, সারং, গয়না, ব্যাগ, ন্যাপস্যাক, ব্যাকপ্যাক, সানগ্লাস, চপ্পল, ফ্লোটার্স, ফ্লিপফ্লপ, শু। ফ্যাশন শোয়ের পরে রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে ওমের মেক শিফট স্টল থেকে দেড় লাখ টাকার মাল বিক্রি হয়েছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক টিনটিনের হাতে ধরিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছে ওমের মালিক।
আজ মাটির পারফরম্যান্স। একলাখ টাকা চেয়েছিল মাটির ফ্রন্টম্যান হৃষিকেশ। এক অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকার সুবাদে রিপু কুড়ি হাজার টাকা কমিয়েছে। সব মিলিয়ে এই বছরে ওপিয়ামের জন্য ইউনিয়নের খরচ বেড়েছে। কিন্তু ইংরিজি খবরের কাগজের পেজ থ্রি থেকে টিন ম্যাগাজিনের ওয়েব পোর্টাল, টিভির চুটকি খবর থেকে ফেসবুক—সব জায়গায় ওপিয়ামকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেকে বলছে, ওপিয়াম এই মুহূর্তে কলকাতার সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস কলেজ ফেস্ট।
এমন অনুষ্ঠানের কার্টেন কল জবরদস্ত হওয়ার কথা। মাটি পারফর্ম করার ফলে হাইপ আরও বেড়ে গেল। এমন অনুষ্ঠানে দময়ন্তী থাকবে না, এ কখনও হতে পারে? দিল্লির স্কুলে সে অনেক ফেস্ট অ্যাটেন্ড করেছে। সেখানে মূলত ইন্ডিপপ বা হিন্দি-রক চলে। বাংলা ফোক-ফিউশন সে কখনও শোনেনি। আজ একটু গাঁজা টানলে মন্দ হয় না।
কলেজ থেকে তিনটের সময় বাড়ি ফিরে এসে গোলঘরে একপ্রস্ত ঘুমিয়ে নিল দময়ন্তী। উঠল সাড়ে পাঁচটার সময়। দোতলার স্টুডিওয় বসে ড্যানিয়েল ‘মায়ার খেলা’ শুনছেন। শক্তিরূপা এখনও অফিস থেকে ফেরেননি। ওঁদের কথা মাথা থেকে উড়িয়ে দময়ন্তী আলমারি খুলে ভাবতে বসল। এটা-ওটা-সেটা নাড়াচাড়া করে কিছুই পছন্দ হল না। ধন্দের সময় গোল্ডেন রুল হল, ‘হোয়েন ইন কনফিউশান, ওয়্যার ব্ল্যাক’। কালো পোশাক গ্রেসফুল, শরীরের হাজারটা খুঁত ঢাকে, শীতকালের পক্ষে আইডিয়াল। ব্ল্যাক টাইটসের সঙ্গে কালো গোলগলা ফুলস্লিভ সোয়েটার পরল। সঙ্গে লাল-টুকটুকে চওড়া বেল্ট আর লাল-কালো কনভার্স শু। ঠোঁট না চোখ—কোনটা হাইলাইট করবে, এটা ভাবতে সময় লাগল। আবশেষে ঠোঁট ন্যুড লিপস্টিক বুলিয়ে, চোখে গাঢ় করে কাজল বোলাল। চুলে পনিটেল করে লাল হেয়ারব্যান্ড বাঁধল। ব্যস! আর কিছুর দরকার নেই। একটা ন্যাপস্যাক নিয়ে, ড্যানিয়েলকে টাটা করে, লাল টুকটুকে হুডি গলিয়ে গোলমহল থেকে বেরোল। আজ জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে।
কলেজে এখন ছন্নছাড়া অবস্থা। সবে সন্ধে সাতটা বাজে। ফেস্ট শেষ হয়েছে ছ’টার সময়। মাটির প্রোগ্রাম শুরু হবে রাত ন’টায়। এই সময় উদ্যোক্তারা বিশ্রাম নিচ্ছে। অন্য প্রদেশ অথবা দূরের জেলা থেকে আসা ছেলেমেয়েরা হোস্টেলে ঘুমোচ্ছে। কলকাতার অন্যান্য কলেজের ছেলেমেয়েরা বাড়ি চলে গেছে। কলেজ চত্বর ফাঁকা। সেন্ট্রাল হলের ভিতরে সাউন্ড-চেক চলছে। দময়ন্তী আপনমনে বলল, ‘লাল বিফোর দ্য স্টর্ম।’ তারপর গার্লস হোস্টেলের দিকে এগোল।
উলটোদিক থেকে বিলু আসছে। দময়ন্তীকে দেখে বলল, ‘আগে চলে এসেছিস।’
ফিক করে হেসে দময়ন্তী বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে। হোস্টেলে পালাই।’
‘সব সময় এত পালাই পালাই ভাব কেন?’ চোখ পাকায় বিলু। ‘চল দাঁড়ে বসে এককাপ চা খাই। বছরের শেষ দিনে স্বাস্থ্যপান করা উচিত।’
‘বিলুদা, একটা রিকোয়েস্ট করব?’ ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বলে দময়ন্তী।
‘কী রিকোয়েস্ট? খুব কোনও খারাপ কথা বলবি বলে মনে হচ্ছে!’
‘হ্যাঁ। আমায় গাঁজা খাওয়াবে?’
দময়ন্তীর প্রস্তাব শুনে বিলুর চোখমুখের চেহারা দেখার মতো হল। প্রথমে টেনসান খেল, তারপর সিনিয়ার দাদার গেরামভারি ভাব দেখাতে গিয়ে হেসে ফেলল, তারপর অসহায়ের মতো বলল, ‘আমি কখনও খাইনি।’
‘যাঃ! সত্যি?’
‘মাইরি বলছি। নেশাভাং করার অভ্যেস নেই। মাঝেমধ্যে সিগারেট খাই শুধু।’ মিনমিন করে বলে বিলু।
‘চলো। আমি তাহলে তোমাকে খাওয়াই। আমার হাতেই তোমার গাঁজাখড়ি হোক।’ খ্যাকখ্যাক করে হাসছে দময়ন্তী।
‘গাঁজাখুরি কথা বলিস না তো।’ পান করার দুর্বল চেষ্টা করে বিলু। ‘আমাদের ক্যাম্পাসে কোথায় গাঁজা পাওয়া যায় তুই জানিস?’
‘জীবনদার ক্যান্টিনেই পাওয়া যায়। এসো তুমি আমার সঙ্গে।’ বিলুর হাত ধরে টান মারে দময়ন্তী। দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিলু বলে, ‘আমার পক্ষে ওসব কেনা সম্ভব নয়। আর তুইও ওসব কিনিস না।’
‘পলিটিকাল ইমেজ?’ ভুরু নাচাচ্ছে দময়ন্তী, ‘প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরামের নেতা গাঁজা খেলে পাবলিক ইমেজ খারাপ হবে? আমার ধারণা ছিল, র্যাডিক্যাল লেফটদের মধ্যে ক্যানাবিসের হ্যালু ইন থিং।’
‘ওসব তোদের দিল্লিতে। এখানে নয়।’ পার্স থেকে একশো টাকা বার করে বিলু বলে, ‘জীবনদাকে বলছি ভালো হ্যাশ দিতে।’
‘তুমি এমন লজ্জা পাচ্ছ যে ”গাঁজা” শব্দটা উচ্চারণ না করে ”হ্যাশ” বলছ।’ আবার খ্যাকখ্যাক করে হাসে দময়ন্তী। বিলুর হাত থেকে একশো টাকার নোট নিয়ে জীবনদার ক্যান্টিনে ঢুকে যায়। একটু বাদে ফিরে আসে এক প্যাকেট স্মুদ কাট সিগারেট, একটা দেশলাই আর ছোট দুটো পুরিয়া নিয়ে। সিগারেটের প্যাকেট দেখে বিলু বলল, ‘এই ব্র্যান্ডের এক প্যাকেটের দাম ষাট টাকা। গাঁজার জন্য তোর পকেট থেকে কত গেল?’
‘দ্যাটস নান অব ইয়োর বিজনেস,’ ক্যাজুয়ালি শ্রাগ করে দময়ন্তী। ন্যাপস্যাকের সাইড পকেটে সিগারেটের প্যাকেট আর পুরিয়া ঢুকিয়ে বলে, ‘কোথায় খাওয়া যায় বলো তো? আমি যে কোনও জায়গাতেই বসতে পারি। তবে তোমার ইমেজ খারাপ হয়ে যাবে।’
‘আমি কখনও খাইনি।’ লাজুক মুখে বলে বিলু, ‘নিয়মকানুন জানি না। উলটোপালটা কিছু হয়ে গেলে বিপদে পড়ব।’
‘আমি জানি।’ লেডি আর্চার্স হোস্টেলের দিকে যেতে যেতে বলে দময়ন্তী। ‘আমাদের হোস্টেলের কয়েকজন মেয়ে খায়। চলো আমরা গেস্টরুমে বসি। ওখানে গন্ধ শোঁকার জন্য কেউ থাকবে না। প্লাস আমাদের কোনও অসুবিধে হলে সেফ জোনে থাকব।’
‘কী বলতে চাইছিস?’
‘গাঁজার নেশা আনপ্রেডিক্টেবল। ধুনকির মাথায় তুমি আমাকে মলেস্ট করতে এলে আমি এক ছুটে হোস্টেলের ভেতরে পালিয়ে যাব। আমি তোমাকে মলেস্ট করতে গেলে তুমি এক ছুটে হোস্টেলের বাইরে পালিয়ে যেতে পারবে। দু’জনেই দু’জনকে মলেস্ট করতে গেলে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ফুলমতিয়া ঝাঁটা হাতে তেড়ে আসবে। আর দু’জন কনসেন্টিং অ্যাডাল্ট হিসেবে সেক্স করতে চাইলে কেউ বিরক্ত করবে না।’
‘আমি যাব না। তুই হেবি ভয় দেখাচ্ছিস।’
বকর বকর করতে করতে দু’জনে এসে দাঁড়ায় লেডি আর্চার্স হোস্টেলের সামনে। বছরের শেষ সন্ধেয় জব্বর শীত পড়েছে। কোনও জনপ্রাণীকে বাইরে দেখা যাচ্ছে না। রিনা দত্তর কোয়ার্টার ভিতর থেকে বন্ধ। হোস্টেলের সব ঘরের সব দরজা জানলা ভিতর থেকে বন্ধ। ফুলমতিয়ারও পাত্তা নেই। দময়ন্তী আর বিলু সুট করে গেস্টরুমে ঢুকে পড়ে।
সোফায় জমিয়ে বসে ন্যাপস্যাকের সাইড পকেট থেকে স্মুদ কাট সিগারেটের প্যাকেট বার করে দময়ন্তী। প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বার করে বিলুকে দিয়ে বলে, ‘দুটো সিগারেট থেকেই হাফ টোব্যাকো ফেলে দাও।’
একটা সিগারেট নিয়ে তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ফাঁকে ঘোরাতে ঘোরাতে বিলু বলে, ‘ওই সিগারেটটা রেখে দে। একটাই এনাফ।’
‘সিগারেটের ফিল্টারে লিপস্টিক লেগে গেলে আমাকে কিছু বলতে পারবে না কিন্তু।’ প্যাকেটে সিগারেট ঢুকিয়ে একটা পুরিয়া বিলুর হাতে তুলে দেয় দময়ন্তী। হাতের তালুতে অনেকটা তামাক জমেছে। সেটা ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেলে পুরিয়া খোলে বিলু। শুকনো, খয়েরি, শেকড় বাকড়ের মতো গাঁজা হাতের তালুতে নিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে গুঁড়ো করে। সন্তর্পণে গাঁজার গুঁড়ো সিগারেটের ফাঁপা নলে ঢোকায়। তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে রোল করে ন্যাতপেতে ভাব তাড়ায়। গাঁজা ভরতি সিগারেট দময়ন্তীকে দিয়ে বলে, ‘লেডিজ ফার্স্ট!’
কাঁপাকাঁপা হাতে সিগারেট নিয়ে দময়ন্তী বলে, ‘ধরাই?’
বিলু ঘাড় নাড়ে। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট রেখে অনভ্যস্ত হাতে দেশলাই জ্বালায় দময়ন্তী। তিনটে কাঠি নষ্ট করে অবশেষে সিগারেট ধরাতে সক্ষম হয়। হালকা টান মেরে খকখক করে কাশতে কাশতে বলে ‘কী কুচ্ছিত টেস্ট! ব্যাব্যা গো!’
‘দে! এসব তোর জন্য নয়।’ ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে সিগারেট চেয়ে নিয়ে লম্বা টান দেয় বিলু। ধোঁয়া কিছুক্ষণ মুখে আর বুকে ধরে রাখে। তারপর নাক দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ে।
‘ওয়াও! প্রিটি কুল!’ বিস্ময় প্রকাশ করে দময়ন্তী। বিলুর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিজে এক টান দেয়। গাঁজার গন্ধে গেস্টরুম ভরে ওঠে।
মিনিট পাঁচেক বাদে যখন সিগারেট শেষ হল, তখন দু’জনে ঢুলুঢুলু চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে আর বোকাবোকা হাসছে।
‘মা-টি! মা-টি!’ বিড়বিড় করে বিলু।
‘নো-শশা হয়ে গেল? নো-শশা?’ জিজ্ঞাসা করে দময়ন্তী।
‘আমার হয়নি। তোর হয়েছে। কথাটা নোশা নয়। নেশা।’
‘হোয়াই ড্রিংক অ্যান্ড ড্রাইভ, হোয়েন ইউ ক্যান স্মোক অ্যান্ড ফ্লাই…’ বিড়বিড় করছে দময়ন্তী। ‘টি-শার্টে এই কথাটা লেখা থাকে। আজ মানে বুঝলাম। আমার মনে হচ্ছে, উড়তে পারব। দেখো তো, ডানা গজাচ্ছে কি না!’ বিলুর দিকে কাঁধ বাড়িয়ে দিয়েছে সে। বিলু প্রথমে কাঁধে চোখ ফোকাস করে। তারপর মাথায় আর পায়ে। বলে, ‘ডানা এখনও গজায়নি। তবে সিং আর খুর গজাচ্ছে।’
‘ল্যাজ?’ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, বিলুর দিকে পিছন করে, সোফার হাতল ধরে সামনের দিকে ঝুঁকে নিজের পশ্চাদদ্দেশ দেখায় দময়ন্তী। সেখানে থাবড়া মেরে বিলু গান ধরে ‘আহা থাকত যদি তোমার ওগো ল্যাজের ওপর ডানা, উড়ে গেলেই আপদ যেত করত না কেউ মানা। আহা…করত না কেউ মানা। আহা… করত না কেউ মানা।’
‘অ্যাডিং ইনসাল্ট টু ইনজুরি?’ সোফায় বসে চোখ পাকায় দময়ন্তী, ‘হামারি মাং পুরি করো। পুরি করো।’
‘তোর আবার কী মাং?’ ভেবলে গিয়ে বলে বিলু, ‘খুন ভরি মাং?’
‘নহি রে বুড়বক! রেখাওয়ালি মাং নহি! মাটি-ওয়ালি মাং! মেরেকো মাটি কা গানা সুনাও! মিট্টি কা খুশবুওয়ালি গানা!’
‘অ! তাই বল!’ দময়ন্তীর ন্যাপস্যাক ঘেঁটে সিগারেটের প্যাকেট বার করেছে বিলু। বার করেছে গাঁজার পুরিয়া। নতুন সিগারেট বানাতে বানাতে বলে, ”মাটিতেই জন্ম নিলাম। মাটি তাই রক্তে মিশেছে।” এই গানটা কার লেখা জানিস?’
‘হাট্টিমাটিম টিম? যারা মাঠে পাড়ে ডিম? যাদের খাড়া দুটো সিং?’ মাথার দু’পাশে হাতের মুঠো রেখে তর্জনী সোজা করে সিং দেখায় দময়ন্তী।
‘না রে পাগলি। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। নামকরা গায়ক। আমাদের ওদিকে বাড়ি। ”চল কোদাল চালাই, ভুলে নামের বালাই, ঝেড়ে অলস মেজাজ, হবে শরীর ঝালাই। যত ব্যাধির বালাই বলবে পালাই পালাই…” এটা কী জানিস?’
‘মাটি কাটার গান?’
‘না রে পাগলি। এটা ব্রতচারীর গান।’ সিগারেট ধরিয়ে টান দিয়েছে বিলু। গান ধরেছে, ‘ও মেরে দেশ কি ধরতি সোনা উগলে উগলে হিরে মোতি, ও মেরে দেশ কি ধরতি!’
‘চলো। এখানে বসে বসে গান না গেয়ে, সেন্ট্রাল হলে গিয়ে গান শুনি।’ ঘড়ি দেখে বলে দময়ন্তী, ‘ন’টা বাজে। মাটি-র পারফরম্যান্স শুরু হল বলে।’
‘যাব? এত তাড়াতাড়ি?’ দময়ন্তীর হাতে সিগারেট ধরিয়ে বলে বিলু। ‘আচ্ছা। চল। বাই দ্য ওয়ে, আমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না তো যে গাঁজা টেনেছি?’
‘না।’ মোবাইলে বৃন্দাকে ফোন করতে করতে দময়ন্তী বলে, ‘আমি অন্তত বুঝতে পারছি না। তবে আমার কথা ছাড়ো। আমি নো-শশা করে আছি।’
‘থ্যাংক ইউ!’ গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে বিলু হাসে, ‘তাহলে কোনও চিন্তা নেই। আজ সবাই নো-শশা করে আছে।’
সেন্ট্রাল হলে মাটির প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। হৃষিকেশের উদাত্ত কণ্ঠস্বরে শোনা যাচ্ছে মাটির হিট গান, ‘আমরা হাঁটি, যেথায় মাটি। সঙ্গে আছে শেতলপাটি।’ একতারার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে গিটার রিফ, ডুগডুগির সঙ্গে অক্টাপ্যাড। খঞ্জনির সঙ্গে সিমব্যাল। ছাত্রছাত্রীর তুমুল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ছে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজ।
বৃন্দা সেন্ট্রাল হলের বাইরে দাঁড়িয়েছিল। বিলু আর দময়ন্তীকে দেখে চিৎকার করে বলল, ‘এ কী, দুজনের চোখ ছলছল করছে কেন? গাঁজা খেয়েছিস নাকি?’
‘কী করে বুঝলি?’ সিগারেটে টান দিয়ে বলে দময়ন্তী।
‘দশ মাইল দূর থেকে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।’ দময়ন্তীর হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে লম্বা টান দেয় বৃন্দা। সিগারেট শেষ করে দুজনের হাত ধরে টানতে টানতে সেন্ট্রাল হলের ভেতরে ঢোকায়। ‘স্টেজের ডানদিকে বার কাউন্টার। রিপুদা, টিনটিনদা, সুব্রতদা আর বান্টিদা ছেলেদের সার্ভ করছে। আপ্পুদি মেয়েদের। তাড়াতাড়ি চল।’
‘গাঁজার পরে বুজ?’ মাটির গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চেঁচায় দময়ন্তী। ‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?’
‘তোমরা যাও মালে মালে, আমরা যাই পাতায় পাতায়,’ চিৎকার করে বিলু। দময়ন্তীকে ছেড়ে দিয়ে পিছনের বেঞ্চে বসে। সেখানে সব্যসাচী গম্ভীর মুখে গান শুনছে।
সেন্ট্রাল হলের মাঝখানে এখন কোনও চেয়ার নেই। সাইকেডেলিক আলোর ঝলকানিতে দেখা যাচ্ছে সেখানে শ’তিনেক ছেলেমেয়ে নাচছে। অন্য কলেজের ছেলেমেয়ে নেই। সবাই আইএমসির। শ্রীপর্ণা, জেমসি, সাবিনা, দীপ, প্রবাল আর সঞ্জয়কে চিনতে পারল। তালঢ্যাঙা সুরজকে অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। মাটি নতুন গান ধরেছে। ‘বঁধুয়া আমায় ফেলে চলে গেলে নতুন শহরে। কেয়ার করি না, নতুন বন্ধু পেয়ে গেছি, তোমার মতো আড়ে বহরে।’
‘কী নিবি?’ দময়ন্তীকে জিজ্ঞাসা করল আপ্পু।
‘ওয়াইন নেই?’ ঘোর লাগা গলায় বলে দময়ন্তী।
‘নেকু। ওসব এখানে থাকে না। হুইস্কি, রাম না ভদকা? ফটাফট বল।’
‘ভদকা দাও। ফ্লেভারওয়ালা।’ দাবি করে বৃন্দা।
‘এই নে।’ দুটো বোতল দু’জনের হাতে ধরিয়ে আপ্পু বলে, ‘এটা মিক্স করা আছে। আস্তে আস্তে খা। আর দেব না। খেয়েদেয়ে সোজা হোস্টেলে যাবি।’
‘আচ্ছা।’ বোতলের টক-মিষ্টি পানীয় গলায় ঢালতে ঢালতে ডান্স ফ্লোরের দিকে দৌড়ায় দু’জনে। প্রোগ্রাম জমে উঠেছে। দুহাজার এগারো সাল আসতে আরও দেড়ঘণ্টা বাকি। এই সময়টা নেচে ফাটিয়ে দিতে হবে।
দময়ন্তী কতক্ষণ ধরে নেচেছে খেয়াল নেই। একবার চন্দন আর অভিকে দেখল, একবার দেখল লাটুকে। সুরজ, প্রবাল, দীপ, সঞ্জয়—সবাই একবার এসে তার সঙ্গে নেচে গেল। এমনকী রিপুদাও। রাত বারোটা বাজতে ঠিক এক মিনিট বাকি থাকতে অনুষ্ঠান শেষ করল মাটি। তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে হৃষিকেশ বলল, ‘কাউন্টডাউন ফর নিউ ইয়ার বিগিনস নাও। প্লিজ পুট দ্য লাইটস অফ।’
সেন্ট্রাল হল অন্ধকার হয়ে গেল। সমবেত চিৎকার শোনা যাচ্ছে, ‘সিক্সটি, ফিফটি নাইন, ফিফটি এইট…’
দময়ন্তীর মাথা ঘুরছে। বৃন্দা কোথায়? আজ বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।
‘ফিফটি, ফর্টি নাইট, ফর্টি এইট…’
অভি আর একবার এসে তার হাত ধরে বলল, ‘কী কিলার স্টেপস দিচ্ছিস মাইরি!’ বৃন্দা কোথা থেকে এসে অভিকে ধরে নিয়ে চলে গেল। গা গুলোচ্ছে… এবার এখান থেকে বেরোনো যাক।
‘ফর্টি, থার্টি নাইন, থার্টি এইট…’
সুরজ এখন তার সামনে। ‘ফিলিং ড্রাউজি, বেবি?’ সহৃদয় কণ্ঠে জানতে চাইছে।
‘হ্যাঁ।’ ঘাড় নেড়ে উত্তর দেয় দময়ন্তী। সুরজ তাকে জড়িয়ে ধরে।
‘থার্টি, টুয়েন্টি নাইন, টুয়েন্টি এইট…’
সুরজ তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ধরেছে। পাজাঁকোলা করার কায়দাটি অদ্ভুত। এক হাত পিঠের তলা দিয়ে এসে বুকের ওপরে। অন্য হাতটি হাঁটুর তলা দিয়ে এসে পেটের ওপরে। দময়ন্তী চেষ্টা করে সুরজের হাত সরানোর জন্য। পারে না। অন্ধকার সেন্ট্রাল হলের মধ্যে সুরজ সেন্ট্রাল হলের পিছনের দিকে সরে যেতে থাকে। যে দিকে ছোট কিউবিকলগুলো আছে।
‘টুয়েন্টি, নাইন্টিন, এইট্টিন…’
একটা কিউবিকলে দময়ন্তীকে ঢুকিয়ে দিয়েছে সুরজ। এই ঘরটায় সেন্ট্রাল হল সাফ করার মালপত্রে ভরতি। মপ, ঝাঁটা, ঝুলঝাড়া, ফ্লোর-ক্লিনারের বোতলে ঠাসা। এক হাতে দময়ন্তীকে ধরে রেখে অন্য হাতে দরজা বন্ধ করার চেষ্টা করে সুরজ। পারে না। নিজেই দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দময়ন্তীর হুডি খোলার চেষ্টা করে।
দময়ন্তী ভাবে, তার বাধা দেওয়া উচিত। চিৎকার করা উচিৎ। সুরজের পেটে লাথি কষানো উচিত। কিন্তু সে কিছুই করতে পারে না। হাত-পা বশে নেই। কথা বলতে গেলে মুখ দিয়ে ফিশফিশ করে আওয়াজ বেরোচ্ছে। কী ঘটতে চলেছে সেটার আবছা আন্দাজ পেলেও আতঙ্ক বা দুশ্চিন্তা বা ক্রোধ—কিছুই হচ্ছে না। প্রতিরোধের চেষ্টাটুকু আপনা আপনি আসছে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো।
‘সেভেনটিন, সিক্সটিন, ফিফটিন…’
লাল টুকটুকে হুডি মেঝেয় লুটোচ্ছে। কালো, গোলগলা সোয়েটারের ফাঁকে ঢুকে গেছে সুরজের বাঁ-হাত। ডান হাত দিয়ে বেল্ট খোলার চেষ্টা করছে সে। দময়ন্তীর চোখে জল। কাজল ধেবড়ে গেছে। ন্যুড লিপস্টিকের রঙ ছড়িয়ে গেছে গালে। দু’হাত দিয়ে সে সুরজকে দূরে সরাবার চেষ্টা করছে। বিড়বিড় করে কী সব বলতে চাইছে।
‘থার্টিন, টুয়েলভ, ইলেভেন…’ লাল বেল্ট খুলে ফেলেছে সুরজ। কালো সোয়েটার দময়ন্তীর মাথার ওপরে তুলে দিয়েছে। দময়ন্তী এখন কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার হাতও অকেজো। তার শরীর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুরজের হাত। টাইটস হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে দময়ন্তীর পা-দুটোও অকেজো করে দিয়েছে সে।
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে, বিবস্ত্র ও প্রতিরোধহীন অবস্থায় দময়ন্তীর নেশা কাটতে শুরু করে। শরীরে শক্তি ফিরে আসে, গলায় আওয়াজ ফিরে আসে, মাথায় ঢুকে পড়ে আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, ক্রোধ। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে তার প্রথম অস্ত্র প্রয়োগ করে। দুই ফুসফুসের সমস্ত ক্ষমতা উজাড় করে চ্যাঁচায়, ‘বাঁচাও, বাঁচাও! সুরজ আমাকে মলেস্ট করছে।’
‘টেন, নাইন, এইট…’
দময়ন্তীর চিৎকারে কাজ হয়। আওয়াজের তীব্রতায় হতচকিত সুরজ একপা পিছিয়ে যায়। পরমুহূর্তে এগিয়ে এসে দময়ন্তীর পেটে চিমটি কেটে বলে, ‘চিল্লানা মত! মজা লে!’
দময়ন্তী সোয়েটার নামিয়ে নিয়েছে। সে আবার সব কিছু দেখতে পাচ্ছে। হাঁটু পর্যন্ত নামানো টাইটস তুলতে গিয়ে সে একটা টেকনিক্যাল ভুল করল। তার দৃষ্টি অন্য দিকে চলে গেল। এই সুযোগে সুরজ লাল বেল্ট দময়ন্তীর কোমর বরাবর জড়িয়ে নিয়ে পিছন দিকে গিঁট পাকিয়ে দিল।
দময়ন্তীর দুই হাত এখন বেল্টের নীচে। আবার সে অসহায়। সুরজ জিনসের জিপার খুলল। বাঁ হাতে দময়ন্তীর চুলের মুঠি ধরে ডান হাত সোয়েটারের তলায় পাঠিয়ে দিল। ‘উহ! মাগো!’ যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে দময়ন্তী।
‘সেভেন, সিক্স, ফাইভ, ফোর…’
‘ওকে ছেড়ে দে।’ করিডোরে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বলছে বিলু।
‘আজা তু ভি আজা… দোনো মিলকে মজা লেতে হ্যায়…’ বিলুকে হাতের ইশারায় ডাকছে সুরজ।
‘ওকে ছেড়ে দে।’ এক পা এগিয়ে বলে বিলু।
‘আবে নকশালিয়া! রংদারি মতো দিখা। তেরে জ্যায়সে চুহাকো হামলোগ রোজ তিনবার ঠোকতে হ্যায়!’ আঙুল নাড়িয়ে বিলুকে সরে যেতে বলছে সুরজ।
বিলু আর একপা এগোতেই দময়ন্তীকে ছেড়ে বিলুর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুরজ। এক ধাক্কায় তাকে কিউবিকল থেকে বার করে আবার দরজার গায়ে ঠেসান দিয়ে দাঁড়ায়। ওইটুকু সময়ের মধ্যে বেল্টের গিঁট খুলে ফেলেছে দময়ন্তী। সুরজ তার দিকে ঘুরে বলে, ‘তু ভি নকশালিয়া হ্যায় কা? দিখা তেরা রেড করিডোর দিখা।’
‘হাঁ হ্যায়!’ চিৎকার করে দময়ন্তী। তারপর সুরজের চোখে আঙুল গুঁজে দেয়। লাল নেলপালিশ লাগানো নখের আঘাতে আর্তনাদ করে ওঠে সুরজ।
‘থ্রি, টু, ওয়ান! হ্যাপি নিউ ইয়ার! বাই বাই টু থাউজ্যান্ড টেন। ওয়েলকাম টু থাউজ্যান্ড ইলেভেন!’ চিৎকার করছে মাটির ফ্রন্টম্যান হৃষিকেশ। সেন্ট্রাল হল জুড়ে আলো জ্বলে উঠেছে। মাটি আবার গান ধরেছে, ‘আমরা হাঁটি যেথায় মাটি। সঙ্গে আছে হাতপাখাটি।’
বিলু সুরজের কলার ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দময়ন্তী কুড়িয়ে নিচ্ছে হুডি। দৌড়ে আসছে রিপু, আপ্পু, টিনটিন, লাটু, বৃন্দা, সাবিনা, জেমসি…
দময়ন্তী বিলুর দিকে তাকায়। দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা। অথবা অন্য কিছু।