অষ্টম পরিচ্ছেদ
অভিজ্ঞান
হইহই করে চলে এল হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির ইলেকশান। পুরো হোস্টেল টগবগ করে ফুটছে। খোলায় ভুট্টার দানা ভাজলে তারা যেমন টপাটপ লাফিয়ে উঠে সবাইকে চমকে দেয়, তেমনই নিত্যনতুন কোনও না কোনও ঘটনা চমকে দিচ্ছে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজকে। চমকে দিচ্ছে অভিকে।
পুজোর সময়ে বাড়ি ছিল অভি। কোনও ঠাকুর দেখেনি। পাড়ার ঠাকুরটাও নয়। চিলেকোঠার ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে অ্যানাটমির প্রিপারেশান নিয়েছে। সেই থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়। সেই ডক্টর মিত্র,গ্রে, চৌরাসিয়া। কী অসহ্য পরিস্থিতি!
বাড়ির পরিবেশ থমথমে। মনোজ আর অরুণা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না। জগদ্দল থেকে ট্রেনে ফেরার গপপোটা যেদিন মনোজ শুনিয়েছিলেন, তার পরদিন আজ সকাল খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ‘রেল অবরোধে বিপর্যস্ত শিয়ালদা’ হেডলাইন দেখিয়ে অরুণা বলেছিলেন, ‘তুমি কাল মিথ্যে কথা বললে কেন?’
মনোজ বলেছিলেন, ‘আমার ফেরা নিয়ে তুমি রোজ টেনশান করো। গতকাল যখন সত্যিই গন্ডগোলে পড়লাম, তখন সত্যি কথা বলে তোমার পাগলামি বাড়াতে চাইনি।’ তারপর জগদ্দল থেকে বাসে, ট্যাক্সিতে, অটোয়, ভ্যান রিক্সায়, হেঁটে হাওড়া ফেরার একটা লম্বা গপপো ফেঁদেছিলেন। অরুণা কতটা কনভিন্সড হলেন, কে জানে! তিনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে পাগল প্রমাণ করতে চাও? আমাকে পাগলা গারদে ঢুকিয়ে কোন মেয়েছেলেকে বাড়িতে ঢোকাবে? ওই ঋষিতা?’
‘ঋষিতা?’ শান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন মনোজ। ‘সে আবার কে? কোনও সিরিয়ালের চরিত্র?’
মনোজের প্রতিক্রিয়াহীনতায় দমে গিয়েছিলেন অরুণা। আর তাঁকে ঘাঁটাননি। দু’জনের মধ্যে সেই থেকে কথাবার্তা বন্ধ। অভি বুঝতে পারে বাড়ির পরিবেশে অস্বাভাবিক শৈত্য। আস্ত একটা পুজো চলে গেল, নতুন কাপড়জামা কেনা হল না, কোথাও বেড়াতে যাওয়া হল না, কোনও ঠাকুর দেখা হল না। গত বছরও অরুণা শ্যামবাজার থেকে মনোজ-বিলু-অভির জন্য জামাপ্যান্ট কিনে এনেছিলেন। রাধা আর মানদার জন্য শাড়ি। বিছানার চাদর, নতুন পর্দা—এসবও কিনেছিলেন।
বিজয়া দশমীর আগে অরুণা নিমকি আর নারকেল নাড়ু বানান। দশমীর দিন লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে পাড়ার মণ্ডপে সিঁদুর খেলতে যান। অষ্টমী আর নবমীর দিন রিকশা নিয়ে মনোজ আর অরুণা ঠাকুর দেখে আসেন। একদিন যান ডানলপ-উত্তরপাড়ার দিকে, একদিন শালকিয়া-ঘুসুড়ির দিকে। অষ্টমীর সকালে বেলুড় মঠের কুমারীপুজো দেখা তো রুটিন। এ বছর দুজনের কেউই ঠাকুর দেখতে যাননি। অরুণা ভূতগ্রস্তের মতো টিভি দেখেছেন। মনোজ পাড়ার নাটকের রিহার্সাল দিয়েছেন। অভি বাড়ি থাকলেও বিলু হোস্টেলে ছিল।
পুজোর পরই হোস্টেলে চলে এসেছে অভি। বাড়িতে থাকলে বেফালতু টেনশান হয়। হোস্টেলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থাকলে নেগেটিভ মেন্টালিটি থাকে না। পড়াশুনোটা মন দিয়ে করা যায়।
হোস্টেলে এখন পড়াশুনোর পরিস্থিতি নয়। চারটে ছাত্র সংগঠন তাদের বক্তব্য পেশ করার জন্য প্রতিটি রুমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাপ্লি পাওয়া স্টুডেন্টদের কোনও দলই বিরক্ত করছে না। কিন্তু ক্রমাগত চিৎকার চেঁচামেচিতে কার লেখাপড়া হয়?
অভি তাই দময়ন্তীর সঙ্গে জোট বেঁধেছে। দময়ন্তীরও অ্যানাটমিতে সাপ্লি। ও অবশ্য হোস্টেলে থাকে না। ভোরবেলা লেডি আর্চার্স হোস্টেলে চলে আসে। সারাদিন হোস্টেলে পড়াশুনা করে রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে যায়। অভি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘রাতে থাকিস না কেন?’
‘বৃন্দা নেই। আমার একা থাকতে বোর লাগে।’ সোজাসাপটা উত্তর দময়ন্তীর।
দময়ন্তীর সঙ্গে পড়ার অ্যাডভান্টেজ হল, গ্রুপ স্টাডিটা হচ্ছে লেডি আর্চার্স হোস্টেলের গেস্টরুমে। বিরক্ত করার কেউ নেই। অভি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে, সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অস্টিওলজি পড়ে। সাড়ে সাতটায় উঠে, ব্যাগে বইপত্তর ঢুকিয়ে, জেনারেল মেসে ব্রেকফাস্ট সেরে লেডি আর্চার্স হোস্টেল চলে যায়। দময়ন্তী সওয়া সাতটার মধ্যে হোস্টেলে ঢুকে যায়। সে-ও পোশাক বদলে, ব্রেকফাস্ট সেরে, বইখাতা নিয়ে গেস্টরুমের কোনার টেবিল আর চেয়ার দখল করে রেডি থাকে। অভি ঢুকলে পড়াশুনো শুরু হয়।
পৌনে আটটা থেকে সওয়া বারোটা। একটানা সাড়ে চার ঘণ্টা অ্যানাটমি চর্চা। সাড়ে বারোটা নাগাদ অভি যখন বয়েজ হোস্টেলে ফেরে, তখন মাথা বনবন করে ঘুরছে। দুপুরের খাওয়া সেরে একঘণ্টা ঘুম। দুটোর সময় আবার লেডি আর্চার্স হোস্টেল। দুটো থেকে ছটা, আবার চার ঘণ্টার সেশন। ছটার সময় লেডি আর্চার্স হোস্টেল থেকে বয়েজ হোস্টেলে ফিরে টিফিন সারে অভি। এর তার সঙ্গে আড্ডা মেরে, ইলেকশানের খবর নিয়ে সাতটার সময় আবার লেডি আর্চার্স হোস্টেলে। সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত আবার একটা সেশন। তারপর দময়ন্তী বাড়ি পালায়। অভি টুকটুক করে একশো চব্বিশে ফেরে। রাতের খাওয়া সেরে কয়েকটা ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস করে এগারোটার সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
দিনের বেশির ভাগ সময় বয়েজ হোস্টেলের বাইরে কাটালেও ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা ডিনারের সময় মেসে গেলে সব খবর জানা হয়ে যায়। মেস হল আড্ডার এক নম্বর ঠেক। হোস্টেলের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময় নানা জিনিস চোখে পড়ে।
এতদিন হোস্টেলে ইলেকশানে পোস্টার সাঁটার প্রথা ছিল না। নবযুগ সেটা চালু করেছে। প্রত্যেক ফ্লোরে, সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ পোস্টার মেরেছে। তাতে বড়বড় করে লেখা, ‘হোস্টেল বোফর্স কমিটি’। বোফর্স কামান নিয়ে রাজীব গাঁধীর জমানায় একটা কেলেঙ্কারি হয়েছিল। সেই রেফারেন্স টেনে হোস্টেলে বোর্ডার্স কমিটির নানান দুর্নীতি ফাঁস করার চেষ্টা করছে সুরজ অ্যান্ড কোং।
অভির মতে ভুল স্ট্র্যাটেজি। বোফর্স কেলেঙ্কারি যখন হয়েছিল তখন অভিরা জন্মায়নি। সেই রেফারেন্স টানলে টার্গেট অডিয়েন্সের মনে কোনও অনুরণন হবে না। দুর্নীতির তালিকা দিতে গিয়ে, নেতাদের দাদাগিরি, বোর্ডারদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ (মানে নীল ছবি দেখতে না দেওয়া), খাবারের নিম্ন মান (মানে, মিনি মেস উঠে যাওয়া), হোস্টেলে এন্টারটেনমেন্টের অভাব (অর্থাৎ গাঁজা চাষ বন্ধ করে ব্যাডমিন্টন কোর্ট চালু করা)—এই সব বলা হয়েছে। অভি জানে এখনকার হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটি সম্পর্কে আবাসিকদের বিশেষ কোনও অভিযোগ নেই। ক্ষমতাসীন দলই আবার ক্ষমতায় আসবে। পড়াশুনো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছেলেরা চায় শান্ত পরিবেশ আর সময়মতো ঠিকঠিক খাবার। নতুন কোনও রাজনৈতিক দলের হাতে কমিটি তুলে দিয়ে তারা এক্সপেরিমেন্ট করবে না।
সেকেন্ড এমবিবিএস-এর ক্লাস শুরু হয়ে গেছে পুজোর পর থেকে। চন্দন নিয়মিত ক্লাস করছে। সন্ধেবেলা ভোটের ক্যাম্পেনও করছে। চন্দনকে যত দেখে, তত অবাক হয়ে অভি। শুধুমাত্র একবগগা জেদ আর গোঁ নিয়ে লড়ে যাচ্ছে ছেলেটা। ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রি—দুটো সাবজেক্টেই গোল্ড মেডেল পেয়েছে। অ্যানাটমিরটা অল্পের জন্য ফসকে গেছে। পড়াশুনা আর পলিটিক্স দুটোই সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছে। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের একটা চালু প্রবাদ হল, তিনটে ‘প’ একসঙ্গে হয় না। পড়াশুনা, পলিটিকস আর প্রেম। প্রথম দুটোয় চন্দন এগিয়ে। তিন নম্বরটায় কি অভি? সেই জন্যই তার পড়াশুনা হচ্ছে না?
বৃন্দার কথা মনে এলে ভীষণ অভিমান হয় অভির। সারা পৃথিবীর ওপরে অকারণে রাগ হয়। অভি বোঝে, অকারণ রাগ আসলে নিজের ব্যর্থতার প্রতিফলন। মানুষ তো নিজের ওপরে রাগতে পারে না! নিজেকে শাস্তিও দিতে পারে না। (সে পারে একমাত্র আত্মহত্যাকামীরা!) তাই অন্তর্গত রাগ অন্যের দিকে চ্যানেলাইজ করে সে নিজেকে সামলায়। বৃন্দা রোজ ঠিক তিনবার ফোন করে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে একবার। দুপুরে খাওয়ার পরে একবার। রাতে খাওয়ার পরে আরও একবার। বেশিক্ষণ কথা বলে না। সামান্য দুএকটা শব্দ।
‘ঘুম ভাঙল?’
‘আজকের রুটিন কী?’
‘দুপুরে কী মেনু ছিল?’
‘একদিন তোদের হোস্টেলের গ্র্যান্ড ফিস্টে যাব।’
‘মনমেজাজ ঠিক আছে তো?’
‘আর তো কদিন! কোনও মতে টেনে দে!’
অভিও অল্প কথায় উত্তর দেয়।
‘হ্যাঁ। এই উঠলাম।’
‘আজ সারাদিন একটানা পড়ে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম শেষ করব।’
‘ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, পোনা মাছের ঝাল।’
‘আচ্ছা। ঠিক আছে।’
‘না, নেই।’
‘হ্যাঁ, সেই তো!’
অল্প কথা! কিন্তু কী তীব্র অভিঘাত! সারা শরীর ঝনঝন করতে থাকে। মনে হয়, বৃন্দা এখন পাশে নেই কেন? একবার দেখতেও তো আসতে পারে! গ্রুপ স্টাডির সময়ে একবার লেডি আর্চার্স হোস্টেলের গেস্ট রুমে ঘুরে গেলে কী এমন পড়াশুনোর ক্ষতি হবে অভির? বৃন্দার কি তার জন্য মন কেমন করে না? এই কুচ্ছিত সাপ্লিটা কবে যে শেষ হবে! পরীক্ষার প্রসঙ্গ মাথায় আসা মাত্র প্রেম-প্রেম ভাব একলাফে দিগন্তের ওপারে পালিয়ে যায়।
প্রেম ও পড়াশুনার মধ্যেই চলে এল ইলেকশানের আগের জেনারেল বডি মিটিং। যে মিটিংয়ে বিদায়ী কমিটি হিসেব নিকেশ পেশ করবে। মেসে মিটিং হচ্ছিল। অভি তখন খেতে ঢুকেছিল! বড় হলঘরে শ’খানেক ছেলে এক কোণে বেঞ্চিতে বসে বক্তব্য শুনছে। রিপু আয়-ব্যয়ের হিসেব দিচ্ছে, মোচা পার্টির ছেলেরা শুনছে, ন্যাবা পার্টির ছেলেরা হল্লা করে মিটিং ঘাঁটার চেষ্টা করছে। অভি আপন মনে খাচ্ছিল। হঠাৎ শুনতে পেল সুরজের গলা, ‘কওন হ্যায় বে?’
চিৎকার শুনে অভি দেখল, বাইরে বেরোনোর চারটে দরজা বাইরে থেকে কেউ বা কারা বন্ধ করে দিয়েছে। হলঘরে এখন দুটি আলাদা আলাদা পক্ষের শ’খানেক ছেলে। সংখ্যায় প্রায় সমান সমান।
বাংলায় একটা কথা আছে। ‘গণ-ক্যালাকেলি।’ আশি বা নব্বইয়ের দশকের হিন্দি সিনেমার শেষে এটা দেখা যেত। ক্লাইম্যাক্সে সবাই সবাইকে ধরে মারছে। কে হিরো, কে ভিলেন, কে হিরোর বন্ধু, কে ভিলেনের সাইড-কিক, কে পুলিশ, কে ভ্যাম্প—বোঝার উপায় নেই। যে যাকে পারছে ঘিপ-ঘাপ কেলিয়ে দিচ্ছে।
সেই দৃশ্য চোখের সামনে ঘটতে দেখে অভির ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। মড়ার ওপরে খাঁড়ার ঘা, পালানোর কোনও উপায় নেই। অগত্যা রান্নাঘরে ঢুকে বামুন ঠাকুরদের পিছনে লুকিয়ে পড়ে অভি। সেখান থেকেই দেখতে পেল রিপু আর চন্দন মিলে সুরজকে ধরে বেদম মারছে। চন্দনের মার চড়থাপ্পড়ের বেশি কিছু না। আনাড়ির স্ট্রিট ফাইটিং। মারপিট করতে হচ্ছে বলে বেজায় লজ্জিত সে।
রিপুর মার কিন্তু পেশাদারি। ছ’ফুটিয়া রিপুর নির্ভুল পাঞ্চগুলো জায়গা বেছে পড়ছে। ডান-গাল, বাঁ-গাল, তলপেট। সুরজ প্রাথমিকভাবে রেজিস্ট করার চেষ্টা করল। তার একটা ঘুষি চন্দনের মুখে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে ঠোঁটে সুপুরি গজিয়ে গেল চন্দনের। তাই দেখে রিপু ঘিপিত করে ঘুষি চালাল সুরজের তলপেটে। ঘুষি খেয়ে আঁক করে সে মেঝেয় লটকে পড়ল। বান্টি, লাটু, সুব্রত, টিনটিন, প্রবালরাও ধুমধাড়াক্কা হাত-পা চালাচ্ছে। তবে সেসব চড়, থাপ্পড়, লাথি ধর্তব্যের মধ্যে নয়। যে মারছে আর যে মার খাচ্ছে, দু’জনেরই সমান লাগছে। বিলু আর সব্যসাচী খাবার টেবিলের ওপরে উঠে মারপিট থামানোর চেষ্টা করছে। অভি হঠাৎ খেয়াল করল সুরজের স্যাঙাত সঞ্জয় সুরজকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টাই করছে না। সে টেবিলের ওপরে উঠে মোবাইলের ক্যামেরায় মারামারির ভিডিও রেকর্ডিং করছে। মারামারিতে ব্যস্ত ছেলেরা কেউ এটা খেয়াল করেনি।
অভির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হল, সঞ্জয়ের মোবাইলটা ভেঙে দিতে হবে। নিদেনপক্ষে কেড়ে নিয়ে ভিডিওটা ডিলিট করতে হবে। ভিডিও ক্লিপের মতো প্রমাণ অনেককে বিপদে ফেলবে। এই ক্লিপ সঞ্জয় নিউজ চ্যানেলকে দিতে পারে, ইউটিউবে আপলোড করতে পারে, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দিতে পারে, পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারে। একঘর ছেলে মারামারি করছে ঠিকই, কিন্তু রিপু আর চন্দন মিলে সুরজকে ব্রুটালি পেটাচ্ছে। কে মারছে আর কে মার খাচ্ছে, ভিডিওয় পরিষ্কার দেখা যাবে।
অভির দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া হল, যা হচ্ছে হোক! চন্দন তার বন্ধু, কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ও ফার্স্ট এমবিবিএস পাস করে গেছে। দুটো সাবজেক্টে গোল্ড মেডেল পেয়েছে। আর সে এখনও অ্যানাটমির সাপ্লি নিয়ে ঘষছে। অভি একাই কেন শাস্তি পাবে? চন্দনও পাক। তাছাড়া বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে, প্ল্যানফুলি কাউকে পেটানোটা আর যাই হোক ছাত্র রাজনীতি নয়। এইভাবে হোস্টেলে বোর্ডার্স কমিটির ইলেকশান যারা জিততে চায়, তাদের জেলে যাওয়া উচিত।
মারামারি হঠাৎ শুরু হয়েছিল। হঠাৎই শেষ হল। কে একটা চ্যাঁচাল, ‘পুলিশ এসেছে।’
স্যাটাস্যাট দরজাগুলো খুলে গেল। হুড়মুড় করে ছেলেরা চারটে দরজা দিয়ে বেরিয়ে নিজের নিজের ঘরের দিকে দৌড়ল। মুহূর্তের মধ্যে মেস ফাঁকা। সবার শেষে মেস থেকে বেরোল সঞ্জয়।
অভি সঞ্জয়কে নজরে রেখেছিল। সে সঞ্জয়ের সঙ্গে বেরোল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার সময় খেয়াল করল, হোস্টেলের কোলাপসিবল গেটের বাইরে পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে। সাদা ড্রেস পরা পুলিশ অফিসার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত সুরজ।
সুরজের ডানহাত সঞ্জয় বিপদের সময় বন্ধুর পাশে না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে থাকে। অভি সঞ্জয়কে বলল, ‘তোকে মারামারিতে দেখলাম না তো?’
‘মেরেকো হাতাপাই করনা নেহি আতা। বঙ্গাল মে পড়নে কে লিয়ে আয়া, পলিটিক্স করনে কে লিয়ে নহি।’ জবাব দেয় সঞ্জয়। অভির কৌতুহল যায় না। বলে, ‘আমি রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলাম। ওখান থেকে সব দেখলাম। তুই কোথায় ছিলি?’
‘থা কঁহি পে। কিঁউ?’ কর্কশভাবে প্রশ্ন করে সঞ্জয়।
‘না। এমনিই।’ উত্তর ভারতীয় অ্যাগ্রেসনের সামনে মিইয়ে যায় অভি। সামান্য হেসে বলে, ‘তুই মোবাইলে কী ছবি তুললি? আমায় দেখাবি?’
অভির নিরীহ প্রশ্নের ফল হল চমকপ্রদ। ডাকাবুকো, রংবাজ উত্তর ভারতীয় ছোকরা আতঙ্কিত হয়ে লম্বা লাফে তিনতলায় পৌঁছল। লম্বা পদক্ষেপে নিজের রুমে ঢুকে দরজা দড়াম করে বন্ধ করে দিল। অভি একবার ভাবল সঞ্জয়ের পিছনে ধাওয়া করে। তারপর সে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পাঁচতলায় উঠল।
একশো চব্বিশ ও পঁচিশের সামনে একগাদা ছেলের ভিড়। প্রবাল বলছে, ‘রিপুদা আর চন্দন হাসপাতাল ভরতি হয়েছে। রিপুদার মাথায় আর চন্দনের মুখে চোট লেগেছে।’ অভি জিজ্ঞাসা করল, ‘আর সুরজ?’
‘ও ইমার্জেন্সিতে যাচ্ছে।’ জবাব দেয় প্রবাল, ‘মাইনর ইনজুরি। কিন্তু আমাদের আসল কনসার্ন পুলিশ। ওদের কে ইনফর্ম করল? নির্ঘাৎ ন্যাবারা।’
অভি কিছু না বলে একশো চব্বিশে ঢুকে গেল। হোস্টেলে যত গন্ডগোলই হোক না কেন, ওকে এখন কেউ বিরক্ত করবে না। ঘরের আলো নিবিয়ে অভি প্রথমে ফোন করল বিলুকে।
তুরন্ত ফোন ধরল বিলু, ‘বল।’
‘তুই এখন কোথায়?’
‘পুলিশের সঙ্গে কথা বলছি। তুই কোথায়?’
‘ঘরে। পুলিশ কোথা থেকে এল?’
‘আমিই ফোন করেছিলাম।’
‘তুই মার খাসনি তো?’
‘না। তুই পড়।’ লাইন কেটে দিয়েছে বিলু। অভি পরের ফোনটা করে রিপুকে। তার মোবাইল সুইচ অফ। এবার অভি ফোন করে চন্দনকে। চন্দনের মোবাইলে রিং হচ্ছে। চন্দন ফোন ধরে বলল, ‘বল।’
‘সুরজকে মারলি কেন? মাথাফাথা খারাপ নাকি? ভোটে এমনিই জিততিস। এই সব মারধোরের ফলে কেস ঘেঁটে গেল।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল চন্দন। অবশেষে বলল, ‘এটা শালা রিপুদার প্ল্যান। রিপুদাকে অধীরদা বুঝিয়েছেন যে ন্যাবার ছেলেগুলোকে বেশি বাড়তে দেওয়ার আগেই কেলিয়ে ঠান্ডা করে দিতে হবে। আমি কেন বোকার মতো রাজি হয়ে গেলাম কে জানে! আমি গাধা! আস্ত একটা গাধা!’
‘হাসপাতালে ভরতি হলি কেন? তোর কিসসু হয়নি। আমি সব দেখেছি।’
‘রিপুদা ভরতি হতে বলল। ন্যাবারা যদি এফআইআর করে তাহলে বিপদে পড়ে যাব। সেই জন্য ইমার্জেন্সি থেকে ভরতি হয়ে ইনজুরি রিপোর্ট লিখিয়েছি। সুরজ এফআইআর করতে গেলে, থানা থেকে খবর পেয়ে যাব। তখন আমরা আগে এফআইআর করব।’
‘থানা থেকে কীভাবে খবর পাবি যে সুরজ এফআইআর করতে গেছে? থানার কাউকে হাত করেছিস নাকি?’
‘এসব ট্রেড সিক্রেট। তোর না জানলেও চলবে। তুই অ্যানাটমি নিয়ে রগড়া।’ সাপ্লি পাওয়া নিয়ে অভিকে আওয়াজ দিয়ে চন্দন ফোন কেটে দিল।
অভি চুপচাপ। তার মনে আবার মিশ্র অনুভূতি খেলা করছে। অভি নম্বর ওয়ান বলছে, ‘বন্ধুর কর্তব্য কর। চন্দনকে বলে দে, সঞ্জয় পুরো মারামারির ভিডিও রেকর্ড করে রেখেছে। সঞ্জয়ের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে ক্লিপটা ডিলিট কর।’
অভি নম্বর দুই বলছে, ‘চন্দনকে ভিডিওটার কথা জানিয়ে তোর লাভ? চন্দনের প্রতি তোর ব্যক্তিগত ঈর্ষা যদি বাদও দিই, তাহলেও ও যা করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সবার সামনে বেধড়ক মারার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই। সেটাও করেছে কলেজের বাইরের এক নেতার পরামর্শে। পুলিশ দলদাস বলে ইচ্ছেমতো মাসল পাওয়ার দেখাবে? এইভাবে বিরুদ্ধ স্বরকে গুঁড়িয়ে দেবে?’
মাথার মধ্যে অভি নম্বর ওয়ান আর দুইয়ের মধ্যে ঝগড়ার মধ্যে অভি মোবাইলে সময় দেখল। রাত বারোটা বাজে। আগামিকাল ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে। ভোট নিয়ে মাথা খারাপ করে আবার অ্যানাটমিতে সাপ্লি পেলে ইয়ার লস হবে। ওসব ভুলে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়া যাক। আজ রাতে ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস করা হল না। আলো নিবিয়ে পাশ ফিরে শোয় অভি। ওমনি তার মাথার মধ্যে ঝলমল করে ওঠে কয়েকটা লাইন…
বলা হয়ে গেছে সব কথা।
নানা ভাবে হয়ে গেছে বলা।
দেরিতে পয়দা হলে কেন?
হে নতুন! চোষো তবে কলা!
আরেঃ! পদ্য! তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে অভি। সে আদৌ পদ্য নিয়ে ভাবছিল না। নিতান্তই সাধারণ বিষয় নিয়ে মনের মধ্যে ঘোঁট পাকাচ্ছিল। তার মধ্যে পদ্য? আরে বাঃ! চৌরাসিয়ার সেকেন্ড ভলিউম টেনে নেয় অভি। ডায়াগ্রাম আঁকার লাল স্কেচ পেন দিয়ে থার্ড কভারে লিখতে থাকে,
পূজা, প্রেম, দেশ, ঝিঁঝিপোকা…
যোনির মাড়ির খিলে চাপ।
বাস স্টপে তিনমিনিট ধরে
মেঘবালিকার প্রেমালাপ…
আরিব্বাস! চারলাইনের মধ্যে রবি ঠাকুর, শক্তি, সুনীল, এবং জয়। দ্বিগুণ উৎসাহে অভি লিখতে থাকে,
একার বেদনা, হামতুম,
আমি সে ও সখা…সব শেষ!
শিল্প কিংবা রাষ্ট্র বিরোধীতা
বুড়োগুলো করেছে নিকেশ।
বাংলা বাজারে আমি রুকি,
তবে খুব পরিশ্রমী বটে।
আদাজল খেয়ে পড়াশুনো—
গীতা থেকে পেনসিল খুকি।
পদ্য লিখে এ বান্দারও চাই
ফ্ল্যাট, গাড়ি, ডিপোজিট ফিক্সড।
ফর্ম ও কনটেন্টে মারো পোলি!
লিখছি, লিখব-কবিতা রিমিক্সড!
ঘোরের মধ্যে একটানা কবিতাটা লিখে অভি অবাক হয়ে যায়। অনেকদিন বাদে পদ্য লিখল সে। সাপ্লি পাওয়ার পরে পদ্য বা গপপোর বই পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। হোস্টেলের রিডিং রুমে একগাদা খবরের কাগজ আসে। সেগুলোতে চোখ বুলোনোর ফুরসতও পাওয়া যায় না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পনেরো-ষোল ঘণ্টা পড়াশুনো করে, অন্য কিছু ভাবার সময় পাওয়া যায় না। এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পদ্য কোথা থেকে এল?
পদ্যটা আবার পড়ে অভি। খুব ভালো কিছু হয়নি। তবে ইংরিজি ‘রুকি’ শব্দের সংগে খুকি-র মিলটা পছন্দ হয় তার। হাসতে হাসতে বিছানা ছেড়ে উঠে ল্যাপটপ অন করে কবিতাটা টাইপ করে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সারার সময় অভি হোস্টেলে কোনও অস্বাভাবিকত্ব টের পেল না। কেন না কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। টের পেল সাড়ে বারোটা নাগাদ দুপুরে খাওয়ার সময়। হোস্টেলের বাইরে পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে। চন্দন সাদা ইউনিফর্ম পরা এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছে। অভি লোকটাকে চিনতে পারে। গতকাল দুপুরবেলা জেনারেল মেসে মারামারির ঠিক পরে এই লোকটাই হোস্টেলের কোলাপসিবল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিলেন। এর সঙ্গে চন্দনের দোস্তি দেখে আন্দাজ করা যায়, সুরজ থানায় এফআইআর করতে গেলে সে খবর কীভাবে চন্দন আগে পাবে।
দুপুরের খাওয়া চুকিয়ে অভি চুপচাপ ওপরে চলে যাচ্ছিল। চন্দন চেঁচিয়ে বলল, ‘এদিকে আয়।’
অভি গপপো করার মুডে নেই। নেহাত কথা বলতে হয় তাই বলা। বলল, ‘গতকাল রাতে বললি যে হাসপাতালে ভরতি আছিস। আজকের মধ্যে ঠিক হয়ে গেলি?’
‘স্যামি ব্যানার্জি ছুটি করে দিল।’ ফিচেল হাসি হেসে বলে চন্দন। ‘হয় তো এর পিছনে বৃন্দার হাত আছে।’
‘আর রিপুদা?’ চন্দনের ফাঁদে পা না দিয়ে সিনিয়র দাদার প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ে অভি।
‘রিপুদা এখনও ভরতি আছে। স্যামি বললেন, মাথায় কনকাসন আছে। সিটি স্ক্যান করে ছাড়বেন। রিপুদার মাথা সুরজ খাবার টেবিলে ঠুকে দিয়েছিল।’
‘টেবিলের সিটি স্ক্যান করতে বলেননি?’ ফিচেল হাসি চন্দনকে ফেরত দেয় অভি। থানার বড়বাবু জানেন যে এগুলো গটআপ কেস। তবে আম-পাবলিকের কাছ থেকে শুনলে খানিকটা টনক নড়বে।
‘অভি, তুই শালা পুলিশের সামনে আমাদের ইনসাল্ট করছিস।’ হাসতে হাসতে বলে চন্দন। বিরক্ত হয়ে অভি বলল, ‘কালকে ইলেকশান। তার আগে ঝামেলাটা না পাকালেই চলছিল না?’
অভির কথা শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘এটাই আমি তোমাদের নেতাকে এতক্ষণ বলছিলাম। ফালতু ঝামেলা পাকালে। তোমরা মেডিক্যাল স্টুডেন্টস। ক্রিম অব দ্য সোসাইটি। তোমরা যদি জেনারেল লাইনের ছেলেপুলেদের মতো হাতাহাতি করো, সেটা কি ভালো দেখায়? হোস্টেল বোর্ডার্স কমিটির ইলেকশানের সময় পুলিশ পোস্টিং হলে কলেজের জেনারেল ইলেকশানের সময় কী করবে?’
চন্দন বলল, ‘আলাপ করিয়ে দিই। ইনি তপন চৌধুরী। এন্টালি থানার ওসি। আমার পরিচিত।’
হাত জোড় করে অভি বলল, ‘নমষ্কার। আমার নাম অভিজ্ঞান। চন্দনের ক্লাসমেট।’
‘তোমার বুঝি পলিটিক্সে আগ্রহ নেই?’ সিগারেট বাড়িয়ে বলেন তপন।
‘সিগারেটও নেই।’ হাত নেড়ে অভি বলে, ‘চন্দন, কাল ভোট দিয়ে হোস্টেলে থাকব? না, বাড়ি চলে যাব?’
‘বাড়ি চলে যাও ভাই।’ পরামর্শ দেন তপন। ‘এরা হোস্টেল দখল নিয়ে বিচ্ছিরি মারামারি শুরু করেছে। ইউনিয়নের দখল নিয়ে না জানি কী করবে।’
‘বাড়ি কেন যাবি? পড়াশুনোর ক্ষতি হয়ে যাবে।’ তপনকে থামিয়ে তার হাত থেকে সিগারট নেয় চন্দন। আগের সিগারেট থেকে এটা ধরায়। তপন বলেন, ‘একদম চেন স্মোকার হয়ে গেলে যে!’
দু’জনকে টাটা করে অভি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবে, সঞ্জয়ের কোনও খবর নেই কেন? রিপু ন্যাকামো করে হাসপাতালে ভরতি আছে। চন্দন আর সুরজ হোস্টেলেই রয়েছে। ভোটের আগের দিন সমস্ত ক্যাম্পেন বন্ধ। এই বাজারে ভিডিও ক্লিপটা নিয়ে সঞ্জয় করছেটা কী? ভয়ের চোটে চেপে গেল? নাকি ক্যামেরায় কোনও ছবিই ওঠেনি?
নিজের ঘরে ঢুকে ল্যাপটপ অন করে কবিতাটা আবার পড়ে অভি। নাম দেয়, ‘কবিতা জকি’। অন্তহীন পত্রিকার সম্পাদক সুদিন চক্রবর্তীকে লেখা ফরওয়ার্ডিং লেটারের ডেট চেঞ্জ করে প্রিন্ট আউট নেয়। চিঠি আর কবিতার কাগজ দুটো স্টেপল করে খামে ভরে আঠা দিয়ে মুখ সাঁটে। আজ দুপুর দুটোর সময় যখন লেডি আর্চার্স হোস্টেলে যাবে, তখন পোস্টবক্সে ড্রপ করে দেবে। দাঁড়ের ঠিক পাশেই একটা গোব্দা লাল রঙের বাক্স আছে।