» » তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

অভিজ্ঞান

মঞ্চের কেন্দ্রে এখন বৃন্দা। টিনটিন বলল, ‘তেরা নাম কেয়া হ্যায় বৃন্দা?’

বৃন্দা পরে আছে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি। ময়ূরকণ্ঠি রঙের ব্লাউজ। চুলে টপনট করা। স্পটলাইটের চড়া আলোয় ভুরু কুঁচকে অডিয়েন্সের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাই নেম ইজ বন্ড-ওপাধ্যায়। বৃন্দা বন্ডোপাধ্যায়।’

বৃন্দার মুখ গোল। টপনট করার ফলে লম্বাটে ভাব এসেছে। ঠোঁট সত্যি সত্যিই গোলাপি, না শাড়ির ছায়া পড়েছে, কে জানে! অভি কনফিউজড হয়ে যায়। এত সুন্দর কোনও মেয়ে হতে পারে? এত নিখুঁত? এত সরল? এত নিষ্পাপ?

টিনটিন বলল, ‘দ্যাটস মোর লাইক আ বন্ড গার্ল!’

‘দ্যাটস, মোর লাইক বন্ড, আই প্রিজিউম!’ নিষ্পাপ চোখ অডিটরিয়ামে বিছিয়ে বলল বৃন্দা। দর্শকাসনে বসে থাকা অভির হৃদয় একটি স্পন্দন মিস করল। পুলিশ যেভাবে চোর ধরে, ডান হাত দিয়ে সেইভাবে বাঁ হাতের তালু খিমচে ধরে সে। তার জিভ গরমকালের পিচের রাস্তার মতো শুকনো। শীততাপনিয়ন্ত্রিত সেন্ট্রাল হলে বসে গরম লাগছে। ঘাড়ে, কানে, রগে ঘাম হচ্ছে বিনবিন করে।

‘লেটস কাট দ্য ক্র্যাপ। কী পারফর্ম করবি বল।’ টিনটিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে বৃন্দার দিকে।

‘পারফর্ম করব?’ ফ্যাকাশে হাসে বৃন্দা, ‘আমি তো কিছু পারি না। সাবিনা বা শ্রীপর্ণার মতো গান জানি না, জেমসির মতো নাচ জানি না…’

‘জেমসি নাচবে একথা বলার জন্য তোকে মঞ্চে ডাকা হয়নি। ডোন্ট বি আ স্পয়েল স্পোর্ট,’ আলতো ধমক দেয় টিনটিন। ‘কী করবি বল।’

‘আমি বরং একটা কবিতা বলি? কেমন?’ মিনতি করে বৃন্দা।

‘ঠিক হ্যায়। স্টার্ট।’ শ্রাগ করে মঞ্চের এক পাশ সরে যায় টিনটিন। মঞ্চের মাঝখানে এখন বৃন্দা। তার ওপরে পড়েছে স্পটলাইট। আলোকবৃত্তের মাঝে দাঁড়িয়ে সে কাঁপা গলায় বলে—

‘হাত তোলো যদি নৃত্যনাট্য

কথা যদি বলো ছন্দ

ভ্রুকুটিশাসনে অবশ করেছ

শরীরের চতুরঙ্গ…’

শঙ্খ ঘোষ! অসহায় উত্তেজনায় শিউরে ওঠে অভি। তার ধারণা হয়েছিল, যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য না পড়ে, প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরিজিতে অনার্স না পড়ে, কবিতা-গপপো-উপন্যাসের থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে এসেছে সে। এখন তো দেখছে অন্য ব্যাপার। ‘স্বয়ং খোদা’ তাকে ধাওয়া করে ফিরছেন কবিতা থেকে কবিতায়।

বৃন্দা বলছে—

‘শরীরে হঠাৎ ফেরে কৈশোর

মাটিতে ছোঁয়ালে পা

আর কোনওদিন তোমার ঘরের

ত্রিসীমায় যাব না।’

অভির শরীরে সত্যিই ফিরে আসছে কৈশোর। যে সাহিত্যের প্রেমে তার কিশোরবেলা কেটেছে, বাবা-মায়ের তাড়নায় তাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল। আজ সাহিত্য সেই অপমানের শোধ তুলছে। শোধ তুলছেন কবি। শোধ তুলছে পুতুল-পুতুল মেয়েটা। গোলাপি সারল্যে সামনের দিকে তাকিয়ে ও কাকে খুঁজছে? অভিজ্ঞানকে? না অন্য কাউকে? অভির মনে পড়ে যায় বিলুর পড়ানো ‘প্রতিহিংসা’ কবিতার লাইনগুলো—

‘যুবতী কিছু জানেনা, শুধু প্রেমের কথা বলে

দেহ আমার সাজিয়েছিল প্রাচীন বল্কলে…’

অভির মনে হয় সে এক প্রত্নগাছ, যে সৃষ্টির আদি থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে নির্জলা, বন্ধ্যা, প্রান্তরে। তার চারিদিকে প্রাগৈতিহাসিক লাভা টগবগ করে ফুটছে। পৃথিবী নিজের অক্ষে নিজের নিয়মে ঘুরে চলেছে। মাথার ওপরে জ্বলছে সূর্য। দিন যাচ্ছে, রাত যাচ্ছে, সপ্তাহ-মাস-বছর যাচ্ছে, দশক ও শতক যাচ্ছে। রেন ফরেস্ট তৈরি হচ্ছে, অ্যামাজন নদী গতিপথ বদলাচ্ছে, মাথা তুলছে হিমালয়, হ্যালির ধূমকেতু উড়ে যাচ্ছে বারবার। আকাশ ভরা সূর্য তারা মাথায় নিয়ে অভি একা ক্লান্তিহীন দাঁড়িয়ে। আর তাকে সন্তর্পণে ঢেকে রাখছে প্রাচীন বল্কল, বৃন্দা ব্যানার্জি।

অভি কিছু শুনতে পাচ্ছে না। চারিদিক আউট অব ফোকাস হয়ে যাচ্ছে। শুধু গোলাপি এক দীপশিখা তার চোখের সামনে তিরতির করে কাঁপছে। অভি বুঝতে পারল, সে ওই গোলাপি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছে। সহায়হীন, অবলম্বনহীন ভাবে প্রেমে পড়ে গেছে।

চোরের মতো সেন্ট্রাল হল থেকে বেরিয়ে এল অভি। কে মিস আইএমসি হল, কে মিস্টার আইএমসির খেতাব জিতল, টিনটিনের লেখা নাটক ‘ফিফটি ফিফটি’ কেমন হল—এইসব জানার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। জানার ইচ্ছে নেই রয়্যালের বিরিয়ানি কেমন খেতে, মদ্যপান করে নাচানাচি করতে কেমন লাগে।

নিজের মধ্যে আকস্মিক জেগে ওঠা এই অনুভূতি তার কাছে নতুন। শরৎকালের শিউলি ফুলের মতো নতুন। গ্রীষ্মের কালবৈশাখীর মতো নতুন। বর্ষার প্রথম কদম ফুলের গন্ধের মতো নতুন। এই বুক ছাপানো নতুন অনুভূতিমালা নিয়ে অভি কী করবে?

ন্যাপস্যাক কাঁধে ভূতগ্রস্থের মতো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে অভি। বিলুকে বলা উচিত ছিল, যে সে বাড়ি চলে যাচ্ছে। সেন্ট্রাল হলে বারদুয়েক বিলুকে দেখেছে। কোনও কথা বলেনি।

অভি ফোন করার প্রয়োজন বোধ করল না। সাড়ে আটটার ডানকুনি লোকাল ধরলে রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাবে। লক্ষ্মী নিবাসে ঢুকে ফোনে জানিয়ে দিলেই হবে যে সে বাড়িতে।

শেয়ালদা স্টেশানের দিকে দৌড়তে দৌড়তে অভি বিড়বিড় করে—

‘আমিও পরিবর্তে তার রেখেছি সব কথা

শরীর ভরে ঢেলে দিয়েছে আগুন, প্রবণতা।’

অরুণা স্কুপ টিভিতে খবর দেখছিলেন। অভিকে ঢুকতে দেখে বললেন, ‘কী হয়েছে রে? মুখ শুকনো লাগছে কেন?’

‘কই! না তো!’ অরুণাকে এড়িয়ে চিলেকোঠার ঘরের দিকে এগোল অভি।

‘ওপরে পরে যাস। আগে আমার কাছে এসে বোস। কলেজে র‌্যাগিং করেছে নাকি? বিলু ছিল না?’ অরুণা নাছোড়বান্দা।

এখন এখান থেকে পালালে পরে নীচে নেমে কৈফিয়ত দিতে দিতে অভির কালঘাম ছুটবে। তার বদলে দু-চারটে মিথ্যে কথা বলে জিজ্ঞাসাবাদ বন্ধ করা যাক।

‘দাদা ছিল। আমার ওইসব ঝাঁই-ঝপাঝপ মিউজিক সহ্য হয় না। তাছাড়া ওরা খেতে দেবে অনুষ্ঠান শেষ হলে। অতক্ষণ থাকা পোষাল না। তাই পালিয়ে এলাম।’হেডফোনের সেরা অফার

‘দুপুর থেকে কিছু খাসনি?’ ছেলের খিদের কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যে অরুণার প্রশ্নমালা গায়েব। ‘এখন খেয়ে নিবি? না বাবা এলে খাবি?’

‘বাবা এখনও ফেরেনি?’ দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় অভি। দশটা পনেরো বাজে। ‘বাবা তো এত রাত কখনও করে না! নাটক-ফাটক আছে নাকি?’

‘জানি না!’ পিড়িং পিড়িং করে রিমোট টিপে চ্যানেল চেঞ্জ করছে অরুণা, ‘ফোন করলে ফোন ধরছে না। মোবাইল বেজে যাচ্ছে।’

‘তুমি একটা অমলেট ভেজে দাও।’ ল্যান্ডফোনের পাশে বসে অভি বলে, ‘বাবার ব্যাপারটা আমি দেখছি।’

অরুণা অনিচ্ছার সঙ্গে উঠে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। অভি প্রথমে ফোন করল বিলুকে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পরে বিলু ফোন ধরে বলল, ‘তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেলি কেন? রিপু তোর খোঁজ করছিল।’

‘আমার বোর লাগছিল।’ ক্যাজুয়ালি বলে অভি। তার বুকের বাঁদিকে আবার গাবগুবাগুব শুরু হয়েছে, ‘প্রোগ্রাম শেষ? কে ক্রাউন পেল?’

‘এদিকে বলছিস বোর লাগছিল। আবার জিজ্ঞাসা করছিস ‘কে ক্রাউন পেল?’ কী ব্যাপার রে? স্টেজে তো তোকে বেশি মুরগি করেনি!’

‘আহ! তুই বল না।’

‘মিস্টার আইএমসি হয়েছে সুরজ। মিস আইএমসি বৃন্দা।’

‘বৃন্দা’ নামটা শোনামাত্র অভির গাবগুবাগুব বেড়ে গেল। কান আর গাল জ্বালা করছে। গলা শুকনো। কোনও রকমে সে বলে, ‘আমি ভেবেছিলাম জেমসি হবে।’

‘মেয়েটার অ্যাটিটিউড প্রবলেম আছে। এত অ্যাগ্রেসিভ উত্তর দিল যে পাবলিক ব্যাপক প্যাঁক দিয়েছে। ‘বাঙালিদের গায়ে দুর্গন্ধ’—এইরকম কমেন্ট করল। তারপর অডিয়েন্স এমন খিস্তি করেছে যে মেয়েটা স্টেজেই কেঁদে ফেলল। উদুম বাওয়াল।’

‘প্রোগ্রাম কি শেষ? কোনও আওয়াজ পাচ্ছি না তো?’

‘টিনটিনের নাটকের পরে শুরু হয়েছে ধিঙ্গিনাচন। আমি হোস্টেলে চলে এসেছিলাম। পরে আবার গেলাম। তুই বাড়ি গিয়ে ঠিকই করেছিস। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পুরো কলেজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকাল ছেলেছোকরাগুলো এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। গত বছর একটা মেয়েকে সেন্ট্রাল হলের পিছনে মলেস্ট করেছিল। তাই নিয়ে চূড়ান্ত অশান্তি হয়।’

‘বৃন্দা কোথায়?’ অভির মুখ দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল। ভুল সময়ে, ভুল মানুষের কাছে ভুল প্রশ্ন। প্রশ্নটা করেই জিভ কাটল অভি। কেলো করেছে! বিলু নিশ্চয়ই সব বুঝে গেল।

বিলু কোনও রিঅ্যাকশান দেখাল না। বলল, ‘ডে-স্কলার মেয়েদের আমরা বাসে বা গাড়িতে তুলে দিয়েছি। শ্রীপর্ণা, দময়ন্তী আর বৃন্দা বাড়ি চলে গেছে। জেমসি, সাবিনাদের মতো হোস্টেলাইটদের নিয়েই চিন্তা। আকণ্ঠ ভদকা খেয়ে এখনও নাচানাচি করছে।’

বিলুর চিন্তা শুনে অভির মনে পড়ে গেল মনোজের না ফেরা নিয়ে অরুণার দুশ্চিন্তার কথা। বিলু বলল, ‘বাবা এখনও বাড়ি ফেরেনি।’

‘তো? এই নিয়ে টেনশান খাওয়ার কী আছে? দেখ গিয়ে, হয় তো জীবন সংগ্রামের নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছে। আমি ছাড়লাম।’ বিলু ফোন কেটে দিল।

অভি ঝটপট তিনতলায় উঠে কাপড় জামা ছেড়ে বারমুডা আর টি-শার্ট গলিয়ে নীচে নেমে এল। বাথরুমে থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল, টেবিলে অমলেট রাখা। অরুণা আবার রিমোট হাতে টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছেন। অভিকে দেখে বললেন, ‘বিলু কী বলল?’

‘বলল বাবা হয়তো নাটকের রিহার্সাল নিয়ে ব্যস্ত। চিন্তা করতে বারণ করল।’ এক টুকরো অমলেট মুখে পুরে অভি আবার ল্যান্ডফোনের রিসিভার তোলে। ‘বাবাকে একবার ফোন করে দেখি।’

ফটাফট মোবাইলের দশটা নম্বর ডায়াল করে সে। মনোজের মোবাইলে গান বাজছে, ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে, প্রাণ জাগছে…’ সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে গণসঙ্গীতটি বেজে একসময় থেমে গেল। রিসিভার ক্রেডল রেখে অভি আর একটুকরো অমলেট মুখে পুরল।

‘ধরল না?’ নিউজ চ্যানেল দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক গলায় বলেন অরুণা।

‘না,’ অমলেট শেষ করে সোফা থেকে ওঠে অভি। ‘নীচে গিয়ে একবার মানদা পিসি আর রাধাদির সঙ্গে দেখা করে আসছি।’

‘এক মিনিট শোন,’ বিড়বিড় করে বলে অরুণা, ‘টিভিতে দেখাচ্ছে যে ধর্মতলায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। দুটো সরকারি বাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোর বাবা ওখানে ছিল না তো?’

অরুণার কথা শুনে চমকে ওঠে অভি। মনোজ মাঝে মাঝে ধর্মতলায় যান। মেট্রো চ্যানেলে পথনাটক করেন। এই সম্ভাবনার কথা তার মনে হয়নি। এই জন্যই অরুণাকে এত চিন্তান্বিত লাগছে?

‘ভ্যাট! তোমার যত ফালতু চিন্তা!’ এক পর্দা গলা তুলে প্রতিবাদ করে অভি। ধমকটা যত না অরুণাকে, তার চেয়ে বেশি নিজেকে। দুশ্চিন্তা খুব ছোঁয়াচে রোগ। এক্ষুনি অরুণার কাছ থেকে তার কাছে চলে আসবে। অরুণাকে টিভির সামনে বসিয়ে একতলায় নেমে আসে সে।

একতলায়, সিঁড়ির বাঁদিকের ঘরে থাকে মানদা। তার ঘরে একটা সিএফএল আলো জ্বলছে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে মানদা মুখে স্নো মাখছে। দরজার বাইরে থেকে অভি বলল, ‘পিসি, আসব?’ স্নো মাখা বন্ধ রেখে একগাল হেসে মানদা বলে, ‘এসো গো! আজ মড়া কাটলে?’

সরু খাটে বসে অভি বলে, ‘ধুস! ওসব পরের সপ্তাহ থেকে। তোমার কী খবর?’

‘খবর আর কী? খাটতে খাটতে জান কয়লা হয়ে গেল, তবু তোমার মায়ের মন ভরে না। বাড়িতে থাকতে দিয়েছে বলে মাথা কিনে নিয়েছে। আড়িয়াল একটা মরদ পাই, পালাব তার সঙ্গে। তোমরা খুঁজেও পাবে না।’

মানদা পিসি মাঝে মধ্যে এমন শব্দ ব্যবহার করে যেগুলোর মানে অভি জানে না। এই যেমন সে এখন ‘আড়িয়াল’ শব্দটা শুনল। বাংলাদেশে আড়িয়াল খাঁ নামে একটা নদ আছে। নদ আর নদীর তফাত আছে। অজয় বা ব্রহ্মপুত্র হল নদ। গঙ্গা বা যমুনা, নদী।

আড়িয়াল খাঁ হল নদ। বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে ‘আড়িয়াল’ শব্দটা মরদকে একটা বৈশিষ্ট দিচ্ছে। ডাকাবুকো বা ডানপিটে বা ওয়েল বিল্ট—এইরকম কোনও মানে হবে। বিলু একবার অভিকে বলেছিল, মানদার নাকি দু’বার বিয়ে হয়েছিল। প্রথমবার বর তাড়িয়ে দেয়, কেন না মানদা বন্ধ্যা। দ্বিতীয় বিয়ের পরেও সন্তানহীনতার সমস্যা। তবে এই বরটা বেশি শয়তান ছিল। সে মানদাকে তাড়ানোর বদলে মুম্বইতে বেচে দিয়েছিল। বন্ধ্যা যৌনকর্মীর চাহিদা বেশি, কেন না তাকে নিরোধ ব্যবহার করতে হবে না। কামাতিপুরার ঠেক থেকে মানদাকে উদ্ধার করেছিল কলকাতার এক এনজিও। মানদার পুনর্বাসনের জন্য এনজিও থেকে মহাকরণের পাশে ঘুগনির দোকান করে দিয়েছিল।

কামাতিপুরা থেকে দালালরা এসে মানদাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মনোজ সেদিন বাঁচিয়েছিলেন মানদাকে। থানায় গিয়ে সব খবর দিয়ে লক্ষ্মী নিবাসে নিয়ে এসেছিলেন।

‘আড়িয়াল’ বা এই জাতীয় সাংকেতিক ভাষা মানদা আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে শিখেছে। ওর মুখ খুব খারাপ। যাবতীয় অশালীন বিষয়ে তীব্র আগ্রহ। নিয়মিত সাজগোজ করে, ঝকমকে শাড়ি পরে সন্ধে নাগাদ পাড়ায় বেড়াতে বেরোয় আর ফিরে এসে অরুণাকে শোনায়, ‘আজ গঙ্গার ধারে একটা চিসসা মরদ দেখলাম।’

অরুণা রাগ করে বলেন, ‘মুখ-পাতলা মেয়েছেলে!’

‘তুমি মুখে ওটা কী মাখছ?’ প্লাস্টিকের ডিব্বা হাতে নিয়ে বলে অভি। হাত থেকে কৌটা কেড়ে নিয়ে মানদা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘এই সব দিকে নজর কেন?’

যা দেখার অভি দেখে নিয়েছে। স্নোয়ের ঢাকনার ওপরে লেখা, ‘রাজারানি স্নো। নিমেষে অবাঞ্ছিত রোম তোলার সেরা উপায়।’

হেয়ার রিমুভিং ক্রিম নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মানদার ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির ডান দিকের ঘরে ঢোকে অভি। এই ঘরে রাধা থাকে।

রাধার ঘরে ষাট পাওয়ারের বালব জ্বলছে। ময়লা আলোর তলায় চৌকি পাতা। চৌকির ওপরে পাতলা এবং নোংরা গদি, তেলচিটে চাদর, ল্যাতপ্যাতে বালিশ। রাধার যখন মুড ঠিক থাকে তখন সে সোডা আর সাবান দিয়ে বিছানার চাদর আর বালিশের ওয়াড় কাচে, বালিশ আর গদি রোদে শুকোতে দেয়। মুড অফ থাকলে ওসবের দিকে তাকায় না। বিলু বলে ‘তার-কাটা ফেজ’ আর ‘তার-জোড়া ফেজ’। এখন রাধার তার-জোড়া ফেজ চলছে।

চৌকিতে বসে রাধাদি গুনগুন করে কী একটা বলছে। অভি বলল, ‘কী বলছ রাধাদি?’

‘শায়েরি গো শায়েরি। শুনবে নাকি?’ দরাজ গলায় বলে রাধা।

‘শোনাও,’ নোংরা বিছানায় বসে বলে অভি।

গলা খাঁকরে রাধা বলে,

‘বাঁধলে দো-চার বোতল কফন মে

কবর মে বৈঠকে পিয়া করেঙ্গে।’

‘ওয়াহ ওয়াহ!’ রাধাকে সাবাশি দেয় অভি। রাধা বলে—

‘বাঁধলে দো-চার বোতল কফন মে

কবর মে বৈঠকে পিয়া করেঙ্গে।’

‘আগে!’ হাঁক পাড়ে অভি। মুচকি হেসে রাধা বলে—

‘যব মাঙ্গেগে খুদা হিসাব গুনাহ কা

এক দো পেগ উসে ভি দিয়া করেঙ্গে।’

‘কেয়া খুব! কেয়া খুব!’ ওস্তাদের মতো ঘাড় নাড়ে অভি। শায়েরি শেষ করে গান ধরেছে রাধা। গানটা অভির চেনা। কেন না রাধা একটাই গান জানে। গানটা হল—

‘গারো পাহাড়, গারো পাহাড়।

গারো পাহাড়ের কী যে বাহার।

নেই কো তৃষ্ণা নেই আহার।

গারো পাহাড়। গারো পাহাড়।’

এই অদ্ভুত গানটা মাঝে মধ্যেই রাধা গায়। মনোজ বলেন, ‘এই গানের প্রথম লাইনটা রাধা পাগলি ঠিকঠাক গায়। বাকিটা ওর বানানো।’

গান শেষ করে রাধা একটা বড়, রঙিন কাগজ খুব মন দিয়ে কী সব দেখতে লাগল। অভি জিজ্ঞাসা করল, ‘এত মন দিয়ে কী দেখছ রাধাদি?’

‘ম্যাপ!’ হাসল রাধা। সাদা থান পরিহিতা, সাদা কদমছাঁটওয়ালা বৃদ্ধাকে হলদে আলোয় রহস্যময় লাগছে।

‘কীসের ম্যাপ?’

‘আমার শ্বশুরবাড়ির।’ ঝটপট কাগজ ভাঁজ করে রাধা। অভি দেখে ওর হাতে আর্কিওলজিকাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার ছাপা ভারতবর্ষের ম্যাপ।

‘তোমার শ্বশুরবাড়ি গারো পাহাড়ে?’ নিরীহ প্রশ্ন করে অভি।

‘কাছাকাছি বলেছ। মেঘালয়ে। আমার জন্ম বরিশালের অশথতলা গ্রামে। বিয়ে হয়েছিল বার্মায়। আমরা তো বার্মাতে থাকতাম। গন্ডগোলের সময় যখন তোমাদের এখানে চলে আসছি, তখন টুরাতে ওর সঙ্গে দেখা।’ লজ্জালজ্জা মুখে বলে রাধা।

‘টুরা?’

‘ভূগোলেতে গোল নাকি? গারো পাহাড় মেঘালয়ের তিনটে জেলা জুড়ে। তার মধ্যে একটা টুরা। ভাবছি একবার ঘুরে আসব।’

এই রে! রাধা পাগলি তার-কাটা ফেজে চলে গেছে। এবার ভুলভাল বকবে। কেটে পড়া বেটার। পালানোর জন্য অভি বিছানা থেকে ওঠে। রাধা তার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে বলে, ‘আমি কিন্তু সব জানি।’

‘কী জানো?’ মিনমিন করে বলে অভি। পাগল নাকি এক্সট্রা-সেনসারি পারসেপশান থাকে। ইএসপি বা এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশান দিয়ে রাধা তার মনের অবস্থা জেনে গেল নাকি?

‘ইএসপি’ থেকে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল। বেলুড় থেকে বাসে করে ধর্মতলা বা এসপ্ল্যানেড যেতে ভরসা চুয়ান্ন নম্বর বাস। চুয়ান্ন নম্বর বাসের সামনের কাচে চুন দিয়ে, কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হাতের লেখায় লেখা থাকে ‘ইএসপি’, যেটা আদতে এসপ্ল্যানেড বোঝাতে লেখা আছে। বিলু অনেকদিন পর্যন্ত অভিকে বুঝিয়েছিল, চুয়ান্ন নম্বর রুটের ড্রাইভাররা ‘এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশান’ দিয়ে বাস চালায়।

‘ইএসপি’ থেকে এত কথা মনে পড়ে গেল। শব্দ নিয়ে এই মোহ কবে যে যাবে অভির! নিজের ওপরে বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে সে রাধার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কী জানে রাধা? কেন ও বলল, ‘আমি কিন্ত সব জানি?’

‘উনি আছেন।’ ওপর দিকে তর্জনী নির্দেশ করে রাধা। ‘উনি সব জানেন, সব দেখছেন, সব কিছুর হিসেব রাখছেন। ভুলেও ভেবো না কেউ পার পাবে। এত অনাচার চলছে, এত পাপ চারিদিকে, এত লোভ—এ জিনিস আর বেশি দিন চলবে না। আমার কাছে শুনে নাও, এন্ড ইজ নিয়ার।’

‘ভগবানের কথা বলছ?’ নিরীহ মুখে প্রশ্ন করে অভি।

‘মূর্খ মানবক! ভগবান ছাড়া আর কিছু মাথায় আসে না? অমন মাথা রাখার কী দরকার? হাড়িকাঠে দিয়ে এসো। ভগবান তো মানুষের তৈরি করা কনসেপ্ট। শূন্য থাকলে আঁক কষতে সুবিধে হয় বলে মানুষ শূন্য বানিয়েছে। ভগবান থাকলে পাপপুণ্যের দাঁড়িপাল্লায় ফেলে মানুষকে কুচিকুচি করতে সুবিধে হয়, তাই ভগবানকে বানানো হয়েছে। মোহর, কার্তুজ আর শৃংখলের মতো ভগবানও একটা যন্ত্র। কিন্তু সে কি তোমরা বুঝবে?’

বাপরে! কী কঠিন ভাষণ! অভি বলল, ‘তাহলে তোমার উনিটা কে?’

‘তোমার বোঝার সময় আসেনি। সময় এলে আপনি বুঝবে। সেদিন কেঁদে কূলকিনারা পাবে না।’ বিরক্ত হয়ে বলে রাধা, ‘এখন ওপরে যাও। না হলে তোমার মা চেল্লাবে।’

টুকটুক করে ওপরে আসে অভি। অরুণা এখনও টিভির সামনে বসে স্কুপ চ্যানেলে অ্যাকসিডেন্টের খবর দেখছেন।

‘খেতে দেবে না?’ জানতে চায় অভি। ‘এগারোটা বাজতে যায়।’

‘এদিকে আয়!’ হাত নেড়ে ছেলেকে ডাকেন অরুণা। তাঁর আহ্বানে অভি সোফায় বসে টিভির দিকে তাকায়। সঞ্চালকের বক্তব্য অনুযায়ী দুটি বাসের আগুন নিবিয়ে ফেলা হয়েছে। বাসযাত্রীরা বিপন্মুক্ত। যে দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে গন্ডগোলের সূত্রপাত, সেই পথচারী মারা গেছেন। তাঁর শরীর এতটাই থেতলে গেছে যে সনাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছে না।

খবর শুনে বিরক্ত হয়ে অরুণার দিকে তাকায় অভি। ‘বাসযাত্রীদের কারও কোনও ক্ষতি হয়নি। তাহলে তুমি চিন্তা করছ কেন?’

‘আহ! অ্যাঙ্কর কী বলল শুনলি না? মৃত পথচারীকে সনাক্ত করা যায়নি…’ ফিসফিস করে বলেন অরুণা।

‘মা! তুমি পাগলি হয়ে যাচ্ছ নাকি? বেছে বেছে বাবাকেই বাসে চাপা দিয়েছে—এই তোমার ধারণা?’

‘তাই যদি হয়? তাহলে কী হবে অভি?’ রিমোট বদলে অন্য খবরের চ্যানেলে চলে গেছেন অরুণা। এক পেট খিদে নিয়ে বিরক্ত মুখে অভি চেয়ারে বসতে যাচ্ছে, এমন সময় ঝনঝন করে ল্যান্ডফোন বেজে উঠল।

ফোনের আওয়াজ শুনে হাত থেকে রিমোট ছুঁড়ে ফেলে এক লাফে উঠে ফোনের কাছে গেলেন অরুণা। ফোন তুলে বললেন, ‘হ্যালো, হ্যালো, কে বলছেন? পুলিশ?’

ধুত্তেরিকা! বিরক্ত হয়ে মায়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয় অভি। বলে, ‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘আসলে, আমি আপনাদের চিনি না।’ ওপাশ থেকে মেয়ের গলা শোনা যায়। মনোজদা আপনাদের ফোন করতে বললেন।’

‘বাবা কোথায়?’

‘উনি এখন স্টেজে। জীবন সংগ্রামের একটা স্ট্রিট থিয়েটার হচ্ছে আমাদের এখানে। আই মিন, মৌলালিতে। নাটকটা হঠাৎই নামল। উনি আপনাদের খবর দিতে পারেননি। আধঘণ্টা বাদে শেষ হয়ে যাবে। ওঁর বাড়ি ফিরতে রাত বারোটা বাজবে।’

‘থ্যাংক ইউ,’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে অভি। ফোন রাখার মুহূর্তে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কে বলছেন জানতে পারি?’

‘আমার নাম ঋষিতা। আমি মৌলালিতেই থাকি। আমরাই স্ট্রিট থিয়েটারটা অর্গানাইজ করেছি। ফোনটা গ্রিন রুমে রাখা আছে। অনেকবার বাজল। আমি মনোজদাকে বলায় উনি আপনাদের ফোন করে দিতে বললেন।’

‘আচ্ছা। অনেক ধন্যবাদ।’ ফোন কাটে অভি। অরুণাকে বলে, ‘মা, খেতে দাও। বাবার ফিরতে বারোটা বাজবে। অতক্ষণ জেগে থাকতে পারব না।’

অরুণা গজগজ করতে করতে খেতে দিলেন। কী খেল, বুঝতেও পারল না অভি। তিনতলায় এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল, বৃন্দা ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছেছে তো? ও কি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে, না বাবা-মায়ের কাছে মিস আইএমসি ক্রাউন জেতার গল্প করছে? না করো সঙ্গে মোবাইলে ফিশফিশ করে কথা বলছে? কে সেই ছেলেটা? হাতের কাছে পেলে অভি তার দাঁত উপড়ে নেবে।

ফিক করে হেসে চিলেকোঠার ঘরে ঢোকে অভি। এত ফালতু চিন্তা না করে সোমবারই বৃন্দার সঙ্গে আলাপ জমাতে হবে। শুভস্য শীঘ্রম!