» » সপ্তম পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

সপ্তম পরিচ্ছেদ

অভিজ্ঞান

অরুণা হাঁ করে স্কুপ টিভি দেখছেন। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। ঘাড় বাঁকা, টিভির রিমোট মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরা। শ্বাস পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। অভির মনে হল, শ্বাস নেওয়ার কাজটা কর্মাশিয়াল ব্রেকের সময় করবে। সারা শরীর টেলিভিশনের পর্দার দিকে এগিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, একটু বাদেই বোকাবাক্সের মধ্যে ঢুকে যাবেন।

অরুণা এত মনোযোগ দিয়ে দেখছেন একটি বাংলা মেগা সিরিয়াল। নাম ‘যদিদং হৃদয়ং মম’। আজ মেগা সিরিয়ালটির হাজারতম পর্ব টেলিকাস্ট হচ্ছে। বাংলার সেলিব্রিটি গেস্টদের নিয়ে এক ঘণ্টার স্পেশাল এপিসোড। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট শঙ্করনাথ রায়চৌধুরীর আজ পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী। সেই উপলক্ষ্যে রায়চৌধুরী ম্যানসনের বাগানে বিশাল পার্টি অর্গানাইজ করা হয়েছে। আয়োজক দুই ছেলে অমরনাথ ও কমলনাথ এবং এক মেয়ে শালিনী। পুত্রবধূ অন্তরা, বিজয়া ও জামাতা অলোকেন্দু মজুত। শঙ্করনাথের স্ত্রী অবলাবালা নাতি-নাতনিদের নিয়ে ব্যস্ত। রায়চৌধুরী ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানির বোর্ড মেম্বার এবং কর্মচারীরা পানভোজন করছেন, এমন সময় নাটকীয়ভাবে প্রবেশ এক কিশোরীর। পরনে গাছকোমর করে বাঁধা গোলাপি রঙের শাড়ি ও রানি রঙের ব্লাউজ। মাথায় দুই বিনুনি। পায়ে রুপোর মল ঝমঝম করছে। হাত ভরতি চুড়ি, বালা, রিস্টলেট, আর্মলেট। কপালে অদ্ভুত দেখতে টিপ। চোখে কাজল, ঘাড়ে ট্যাটু। তার দাবি, সে শঙ্করনাথের নাতনি। শঙ্করনাথের আগের পক্ষের স্ত্রী এখনও জীবিত। উত্তরবঙ্গের এক গির্জায় একান্তে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর পুত্র ড্রাগ অ্যাডিক্ট। পুত্রবধূ গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে গত দশ বছর ধরে কোমায় রয়েছে। বাবা-মায়ের চিকিৎসার জন্য মেয়েটি ঠাকুরদার কাছে টাকা চাইতে এসেছে।

বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে গান গাইছে বাংলা ব্যান্ড ‘মাটি’। মাটির ফ্রন্টম্যান হৃষিকেশ পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার পরে ব্যান্ডের বাজারদর তুঙ্গে। এখন লিড সিঙ্গার টিটো নামের একটা ছেলে। সে গাইছিল, ‘আমরা হাঁটি যেথায় মাটি, সঙ্গে থাকুক হাতপাখাটি।’ টিটো নাটকীয়ভাবে গান থামিয়ে দিল। অভিনেত্রী চন্দ্রিমা সেন কবি সুদিন চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। দু’জনে অবাক হয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালেন। চিত্রপরিচালক মনোতোষ ঘোষ ঔপন্যাসিক বিপিন দত্তর সঙ্গে গল্প করছিলেন। তাঁরাও অবাক হয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালেন। ছোট ছোট কাটে সব্বার রিঅ্যাকশান দেখাতে দেখাতে আস্ত একটা সেগমেন্ট শেষ হল। এখন বিজ্ঞাপনের বিরতি। অরুণা হাঁফ ছেড়ে বললেন, ‘শেষে ওই বুড়োটাও! আমি এতদিন ওকে ভালো ভাবতাম। নাঃ! জগতে একজনও সৎ পুরুষ মানুষ নেই।’

হাসতে হাসতে অভি বলল, ‘টিভি দেখে মাথা খারাপ কোরো না। এক কাপ চা খাওয়াও।’

‘এখন পারব না।’ হাত নাড়েন অরুণা, ‘তোর বাবা আসুক।’

মনোজের অফিস থেকে ফেরাটা অজুহাত। মেগা-সিরিয়ালের মেগা-ধামাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অরুণা টেলিভিশনের সামনে থেকে উঠবেন না। মনোজ জীবন সংগ্রামের নাটক করতে গিয়ে পরিবারের পিছনে সময় দিতে পারছেন না। আর অরুণা টিভি দেখতে গিয়ে। তাহলে অরুণা কোন সাহসে মনোজকে দোষারোপ করেন?

হঠাৎ অভির মাথায় কতগুলো শব্দ খেলা করতে শুরু করল। শব্দগুলো নিজের মর্জি মতো একে অপরের সামনে-পিছনে বসে লাইন হয়ে উঠছে। আচমকা। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া।

‘মাছের কাঁটার মতো ঊর্ধ্বে মেলা কেশ

কুটিল বিভঙ্গে দাও যৌনতা-সন্দেশ।’

যাব্বাবা! এর মানে কী? ঘাবড়ে যায় অভি। অসহায়ভাবে খেয়াল করে, আরও নতুন লাইন ঢুকছে মাথায় মধ্যে। যেভাবে খোলা জানলা দিয়ে ঢোকে হাওয়া। মাথার মধ্যে লাইনগুলো সাজাতে সাজাতে তিনতলার চিলেকোঠার ঘরে ঢোকে অভি। কাগজ পেন টেনে নিয়ে খসখস করে লিখতে থাকে…

‘চোখেতে পড়েছে ছানি। হয়ে গেছে স্ট্রোক

কচি মাথা দেখলেই টেনে মারো চোখ।

স্তনেতে আঁশের গন্ধ, স্বাদ কিছু বাসি

মজেছে মন্ত্রীর পিসে, ক্ষুদ্র ভাগচাষি।’

এটা একটা পদ্য। এইটুকু বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কী নিয়ে? অভি কনফিউজড। বৃদ্ধা বেশ্যার বর্ণনা চলে আসছে পদ্যে। যে রকম মেয়েদের অভি দেখেছে হাড়কাটা গলিতে। কিন্তু তারা পদ্যে কেন আসছে?

এই নিয়ে ভাবা বন্ধ করে অভি। কেন না, পরের লাইনগুলো ফড়ফড় করে মাথার চারিদিকে উড়ছে। খাতায় বন্দী না করলে হারিয়ে যাবে। অভি লেখে,

‘নিতম্বে দাদের বৃত্ত, উকুনের ডিম

স্পর্শে চিত্তে শিহরণ, আনন্দ অসীম।

দামড়া মোচার মতো কোঁচকানো থাই

সর্বস্ব বিলিয়ে দেব, যদি ওটি পাই।

গহনার নৌকাসম সর্বগ্রাসী যোনি

ওতেই মজেছে দিল্লি থেকে বাঁশদ্রোণি।

ভাঁড়ে মা ভবানি হোক। উল্টোক পৃথিবী

রাস্কেল-তন্ত্রের জয়। গেরস্থের টিভি।’

একটানা আট লাইন লিখে থামল অভি। সব মিলিয়ে চোদ্দ লাইনের কবিতা, প্রতি লাইনে চোদ্দটি অক্ষর—তার লেখা প্রথম সনেট। যদিও ক্লাসিকাল সনেটের অন্তমিল এই সনেটে নেই, তবুও। কী করে লিখল সে? যখন শুরু করেছিল তখন জানত না যে এটা চতুর্দশপদী কবিতা হবে। তাহলে কীভাবে তার মন অক্ষর গুনল? এই অবাক কাণ্ডটা কীভাবে ঘটল? অভি কি তবে কবি হয়ে গেল?

একা একা কিছুক্ষণ খ্যাকখ্যাক করে হাসল অভি। ‘অভি কি তবে কবি?’ নিজের মনে বার কয়েক বলল। সবচেয়ে বড় কথা, পদ্যটার উৎস অরুণার টিভি সিরিয়াল গেলা। পদ্যটা লেখার সময় সেটা অভি বুঝতেই পারেনি।

হতভম্ব ভাব কাটিয়ে অভি পদ্য কারেকশান করতে বসল। অবশ্য কারেকশান না করলেও কোনও ক্ষতি নেই। এই পদ্য কেউ পড়তে যাচ্ছে না!

আচ্ছা, এই পদ্যের নাম কী হতে পারে? অভি একবার লিখল, ‘কহানি ঘর ঘর কি’। সেটা কেটে দিল। ওই নামের হিন্দি মেগা-সিরিয়াল খুব জনপ্রিয়, কিন্তু বাংলা কবিতার হিন্দি নাম? নতুন নাম দিল, ‘চতুর্দশপদী খিস্তি।’ এইবার নামটা পছন্দসই হয়েছে।

কবিতায় ছোট একটা ত্রুটি চোখে পড়ল। অতীতে টিভির অ্যান্টেনা লাগানো থাকত বাড়ির ছাদে। অ্যান্টেনাকে মাছের কাঁটার সঙ্গে তুলনা অতীতে ব্যবহৃত হয়েছে। অভি আবার ইউজ না করলেই পারত। এখন ওটা অচল। তা ছাড়া বুড়ি বেশ্যার যৌন আবেদনের সঙ্গে টিভির জনসম্মোহনী ক্ষমতাকে মেলানো ছাড়া এই কবিতায় বিশেষ কিছু নেই।

তাও একটা নতুন কবিতা। খাতাটা বুক র‌্যাকের পিছনে রেখে দিল অভি। বিলু মাঝেমধ্যে বইয়ের খোঁজে এই ঘরে হানা দেয়। কোনওদিন চোখে পড়লে অভি আওয়াজ খেয়ে মরে যাবে।

পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। আজ সোমবার, সেপ্টেম্বর মাসের পাঁচ তারিখ। এখন একটানা পনেরো দিন ছুটি। বাড়িতে বসে কী করবে বুঝতে পারছে না অভি। দীর্ঘদিন হোস্টেলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থেকে, বাঁধনছাড়া জীবনযাপন করে, বাড়িতে এসে প্রচণ্ড একঘেয়ে লাগছে। সান্ত্বনা বলতে বৃন্দার সঙ্গে ফোনালাপ।

বৃন্দার প্রসঙ্গ মাথায় আসতে নিজেকে সামলাল অভি। এক্ষুনি আবেগের সুনামিতে ভেসে যাওয়ার কিস্যু হয়নি। পরীক্ষার মধ্যে হঠাৎ করে হাতে পদ্য গুঁজে দিলাম, আর মেয়েটা ঢক করে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দিল, জীবনে এতটা সরল নয়। কলকাতা শহরের এক নম্বর সার্জেনের মেয়ে। দ্বিতীয় প্রজন্মের চিকিৎসক। স্যামি ব্যানার্জির মতো বৃন্দাও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান করতে বিলেত যাবে। ফিল্ম ম্যাগাজিনের গসিপ কলামের সূত্রে অভি জানে, বৃন্দার মা প্রাক্তন অভিনেত্রী মন্দিরা ব্যানার্জি। এইরকম ঘ্যামা ব্যাকগ্রাউন্ডওয়ালা মেয়ের পাশে তার মতো একটা ছেলে? মফসসলে বাড়ি, মফসসলে স্কুলিং, বাবা সরকারি করণিক, মা গৃহবধূ। যোগ্যতা বলতে দুই ভাই ডাক্তারি পড়ছে। বড় ভাই আবার অতিবাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নাঃ! অভি কিছুতেই বৃন্দার পাশে নিজেকে বসাতে পারছে না। চূড়ান্ত মিসম্যাচ মনে হচ্ছে। তার ওপর ফার্স্ট এমবিবিএস পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি। ঝাড় খেয়ে যেতে পারে অভি। এই বাজারে প্রেম-ফ্রেমের মতো ন্যাকামি পোষায় না। এই প্রেমের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। বৃন্দা ফোন করলে ব্যাপারটা ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। তাছাড়া প্রেম ব্যাপারটা অভির কাছে খুব জটিল এবং রহস্যময় ব্যাপার। ও সব তার মতো ছেলেদের জন্য নয়। ও সবের জন্য ম্যাচিয়োরিটি লাগে। নিজেকে অতটা বড় বলে মনে হয় না অভির।

তাহলে কোন সাহসে অ্যানাটমি থিয়োরি পরীক্ষার সময় সে পদ্য লিখে বৃন্দার হাতে তুলে দিয়েছিল? তখন তো মনে হয়নি, সে যথেষ্ট ম্যাচিয়োর নয়। কী ব্যাপার কে জানে বাবা!

বৃন্দার প্রসঙ্গ ভুলে কান খাড়া করে অভি। দোতলা থেকে গোলযোগ শোনা যাচ্ছে। মানদা, রাধা আর অরুণা মিলে কথা কাটাকাটি করছে। ব্যাপারটা কী জানতে অভি নীচে নামে। তাকে দেখে মানদা বলে, ‘কী ঘণ্টার ডাক্তারি পড়ছ? রাধাকে পাগলা গারদে ঢোকাও, এ আমি বলে দিলুম। ও যে কোনওদিন এখান থেকে ভাগলবা হবে। তখন পুলিশ তোমাদের গারদে ঢোকাবে।’

‘আহ! আহ! লুক হুজ টকিং অ্যাবাউট পোলিস। আ হোর হু রেগুলারলি গেটস ফাকড বাই দেম…’ ঘৃণাভরে বলে রাধা।

রাধা পাগলির ইংরিজি শুনে অনেকবার চমকেছে অভি, আজ শিউরে উঠল। ‘হোর’? ‘ফাক’? এই সব শব্দ রাধা জানল কী করে? আর, রাধার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে মানদা তো সাংঘাতিক চিজ!

সৌভাগ্যবশত, মানদা রাধার ইংরিজি বকবকানির মানে বুঝতে পারেনি। সে অভির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইংরিজিতে আমাকে গালাগালি দিল। তাই না?’

‘হ্যাঁ। আমি তোকে গালিগালাজ করেছি।’ ফ্যাঁশফ্যাঁশে গলায় বলে রাধা, ‘কেউ তো তোকে গালি দিল! কেউ তো তোকে নিয়ে মাথা ঘামাল! কেউ তো বুঝিয়ে দিল যে বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ! আমার মতো নির্বান্ধব তো তুই নোস।’

‘নির্বান্ধব?’ অরুণা অবাক, ‘তোমার যে একা লাগে সেটা কখনও বলোনি তো!’

‘কী বলব? গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে ঘুরব? কপাল চাপড়ে চ্যাঁচাব, ‘ওগো! আমার কেউ নেই গো! আমায় দেখো!’ আয়্যাম নট আ ক্রাই-বেবি। আয়্যাম নট দ্যাট কাইন্ড অব লেডি হু হোয়াইনস অ্যাট দ্য ড্রপ অব আ হ্যাট। আমি তোমাদের মতো নই।’

‘তুই পাগল না সেয়ানা পাগল না পুলিশের লোক? তুই এত ইংরেজি জানলি কী করে?’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে মানদা, ‘পঞ্চপাণ্ডব বলে, তোর সঙ্গে আমেরিকার ষড় আছে।’

‘পঞ্চপাণ্ডব? মানে ওই বখাটে ছোঁড়াগুলো? তোর তো ওদের সঙ্গেও আশনাই আছে। সন্ধেবেলা স্নো-পমেটম মেখে গঙ্গার ধারে যা রঙ্গ-তামাশা করিস তা আমি দেখিনি ভেবেছিস? ঢলানি মাগির রং-রলিয়া দেখে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে বৌদি।’

‘অ্যাই পাগলি, চুপ! আমাকে নিয়ে কোনও চুদুরবুদুর নয়! পঞ্চপাণ্ডব ঠিকই বলে, তুই আমেরিকার এজেন্ট!’

‘কোন শালা বলে বে? সিআইএ? কেজিবি? র? আইএসআই? মোসাদ? পেন্টাগন? এফবিআই? কোন মাই কা লাল আছে? ডেকে আন!’ গর্জে ওঠে রাধা পাগলি, ‘একমাত্র তিনিই জানেন আমি কে! আমি অন্য কারও পরোয়া করি না।’

এতক্ষণে অরুণা নড়ে চড়ে বসেছেন। সিরিয়াল দেখা বন্ধ করে বলছেন, ‘কার কথা বলছ? তোমার এইসব কথা শুনে আমার কেমন ভয় ভয় করে।’

‘ভয় তো পবিত্র জিনিস। শ্রেণি ঘৃণার মতো পবিত্র। যে ভয় পায় সে ওঁর দিকে আর এক কদম এগিয়ে যায়। যেমন আমি যাচ্ছি। নেভার ফরগেট, ফিয়ার ইজ দ্য কি।’ কাঠ কাঠ গলায় বলে রাধা পাগলি।

‘ধুর বাবা! আজ এর তার কেটেছে।’ তড়বড়িয়ে নীচে চলে যায় মানদা পিসি। অভি আবার অরুণাকে বলে, ‘এক কাপ চা হবে?’

‘দিচ্ছি।’ সোফা থেকে উঠে অরুণা বলেন, ‘কটা বাজল রে?’

‘সাড়ে সাতটা। তোমার বরের ফিরতে আজও সাড়ে এগারোটা বাজবে।’ সবজান্তা, প্রফেটিক টোনে বলে রাধা।

‘তুমি কী করে জানলে?’ বিরক্ত হয়ে বলেন অরুণা, ‘চালপড়া, কলাপড়া শিখেছ নাকি?’

‘নাঃ! ওসব শিখিনি। তবে মানব চরিত্র সম্পর্কে এত নিখুঁত ও নির্দিষ্ট ধারণা আছে, যে এসব বলতে কোনও অসুবিধে হয় না।’

‘আমার বরকে নিয়ে কী ধারণা হল শুনি? সারাদিন আপিসে গাধার খাটনি খাটে। তারপর ইউনিয়নের কাজ, নাটকের রিহার্সাল, কল শো। বাড়িতে যখন ফেরে তখন শরীরে একবিন্দু এনার্জি থাকে না। লোকটাকে তুমি কিছু বোলো না তো!’

‘এনার্জি কোথা থেকে থাকবে?’ ফুট কাটে রাধা। অরুণা চা করতে করতে ছাঁকনি নিয়ে তেড়ে যান, ‘পাগলির মরণ, তুই আমার বরকে নিয়ে আর একটা ভুলভাল কথা বললে দেব গায়ে গরম জল ঢেলে…’

‘তুমি আমাকে এমন কথা বলতে পারলে?’ অবাক হয়ে অরুণার দিকে তাকিয়ে থাকে রাধা। ‘ছুঁড়ে দেওয়া তির আর বলে ফেলা কথা কখনও ফেরানো যায় না। কিন্তু না-বলা কথা বুকের মধ্যে জমে গাছ হয়। সেই গাছের শেকড় নীচে নামে। পা থেকে ছড়িয়ে যায় মাটির গভীরে। আর ডালপালা মেলতে থাকে ওপর দিকে। সবুজ পাতায় শরীর ঝলমল করে। তোমারও করবে। আজ না হোক কাল। তুমি সবুজে ঝলমলিয়ে উঠবেই। তবে কিনা ঈর্ষার রংও সবুজ হয়। তুমি যেন হিংসে-গাছ হয়ে যেও না! আগে থেকে সাবধান করে দিলাম!’

সাদা থান শরীরে জড়িয়ে ধীর পদক্ষেপে নীচে চলে যায় রাধা। অভিকে এককাপ চা ধরিয়ে অরুণা বললেন, ‘কী বলল কিছু বুঝলি? জ্ঞানের ভড়ং আওড়াল না আমাকে অভিশাপ দিল?’

‘বুঝলাম না।’ সুড়ুত করে চায়ে চুমুক দিয়ে অভি বলে, ‘বাবার কোনও শো আছে?’

‘জগদ্দলে একটা পথনাটক আছে। ‘নতুন দিনের গল্প’ না কী যেন একটা নাম। তোর বাবার এইসব পাগলামো কবে বন্ধ হবে বল তো?’

‘বন্ধ হবে না। এটাই বাবার জীবন। লোকে কিছু না কিছু নিয়ে বাঁচে। বাবা নাটক নিয়ে বাঁচছে।’

অরুণা আবার ফিরে গেছেন টিভির সামনে। ‘যদিদং হৃদয়ং মম’ শেষ হতে চলেছে। মাটি এখনও পারফর্ম করছে। টিটো গান গাইছে, ‘মাটিতেই জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে।’ শঙ্করনাথ বলছেন যে তাঁর দ্বিতীয় কোনও স্ত্রী নেই। ছেলে, ছেলের বউ, নাতনি তো অনেক দূরের কথা। দুই ছেলে অমরনাথ ও কমলনাথ বাবাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। দুই মেয়ে অন্তরা আর বিজয়া বাচ্চা মেয়েটাকে জেরা করছে। সবার আড়ালে মেয়ে শালিনী আর জামাই অলোকেন্দুর চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল। এই মেয়েটাকে তারাই ভাড়া করে এনেছে। ঝ্যাং ঝ্যাং শব্দ করতে করতে সিরিয়ালের মেগা এপিসোড শেষ হচ্ছে। পর্দায় সবার মুখের ক্লোজ শট।

অরুণার সিরিয়ালে আর মন নেই। তিনি বাংলা খবরের চ্যানেলে ঢুকে পড়েছেন। এই চ্যানেল ওই চ্যানেল করতে করতে আটকে গেলেন স্কুপ চ্যানেলে। নবযুগ পার্টির একটা বিশাল মিছিল যাচ্ছে আলপথ দিয়ে। চাষের জমির ফনফনে সবুজ ফসল আর হলুদ পতাকার রং মিশে গেছে। মৃন্ময় চ্যাটার্জি স্লোগান দিচ্ছেন, ‘দালাল দিয়ে, পুলিশ দিয়ে, লাঠি দিয়ে, বারুদ দিয়ে, আন্দোলন দমন করা যায়নি…’

হাজার হাজার লোক চেঁচাচ্ছে, ‘যাবে না!’

ক্যামেরায় স্কুপ চ্যানেলের সাংবাদিক বলছে, ‘হেলথ হাব তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ করার লক্ষ্যে একদিকে যখন সরকার নোটিস দিয়েছে, অন্যদিকে তখন বিরোধী নেতা মৃন্ময় চ্যাটার্জির নেতৃত্বে নতুনগ্রাম এবং বাঁজাপলাশ গ্রামে গড়ে উঠেছে অভূতপূর্ব গণ আন্দোলন। শিবির তৈরি করে রাত পাহারার কাজ শুরু হয়েছে নতুনগ্রাম এবং পার্শবর্তী বাঁজাপলাশ গ্রামে। রাতের অন্ধকারে পুলিশবাহিনী এসে যাতে জমি দখল করতে না পারে তার জন্য পালা করে রাত জাগছে বাচ্চা থেকে বুড়ো, ছেলে থেকে মেয়ে—সবাই। মুখ্যমন্ত্রী সন্দীপ সামন্ত জানিয়েছেন, তাঁর কাছে নির্দিষ্ট তথ্য আছে যে এইসব শিবির গুলিতে অস্ত্র আসছে পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে, রেড করিডোর ধরে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকেও বিপুল অস্ত্রের সম্ভার ঢুকছে জলপথে। এই শিবিরগুলিতে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি বা আইপিপির মদতে বসছে স্বাস্থ্যশিবির। কলকাতার অতিবাম মনোভাবাপন্ন চিকিৎসকরা শিবির পরিচালনা করছেন। এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্টরা স্থানীয় মানুষদের শেখাচ্ছেন, কীভাবে রোজকার গেরস্থালির জিনিসপত্র দিয়ে বোমা বানানো যায়। শেখাচ্ছেন অস্ত্র চালাতে। সব মিলিয়ে নতুনগ্রামের পরিস্থিতি এখন অগ্নিগর্ভ। ক্যামেরায় রাজ্যের সঙ্গে স্কুপ চ্যানেলের পক্ষে আমি, পরিমল।’

নতুনগ্রামের খবর শেষ হতে না হতেই চ্যানেল বদলে গেল। অন্য খবরের চ্যানেল দেখাচ্ছে শেয়ালদহ শাখায় রেল দুর্ভোগের কাহিনি। জগদ্দল স্টেশনে টিকিট না কেটে ট্রেনে ওঠা এক যুবকের কাছে টিকিট দেখতে চাওয়ায় যুবক চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ মেরেছে। স্থানীয় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ায় পরে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর নিত্যযাত্রী ও সাধারণ মানুষ মিলে রেল লাইনে অবরোধ করেছেন। ওভারহেড তারে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে কলাপাতা। শেয়ালদহের মেন লাইনে ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ।

অরুণার ভুরু কুঁচকে গেছে। আঙুল মটকাচ্ছেন ঘন ঘন। একবার বাথরুম থেকে ঘুরে এলেন। মনোজের মোবাইলে ফোন করলেন বারচারেক। আপন মনে বিড়বিড় করলেন, ‘মোবাইল সুইচড অফ!’

অরুণার এই খ্যাপামো অভির চেনা। ওসবে পাত্তা না দিয়ে সে ভাবল, কবিতাটা নিয়ে কী করবে? কলেজ ম্যাগাজিনে দিয়ে দেবে? নাঃ! ওখানে এই কবিতার মর্ম কেউ বুঝবে না। অন্য কোথাও? কোনও লিটল ম্যাগাজিনে?

তাদের পাড়া থেকে একটা লিটল ম্যাগাজিন বেরোয়। নাম ‘চয়ন’। তলায় লেখা থাকে, ‘অতি অনিয়মিত ত্রৈমাসিক’। এ সব নিজেকে ‘লিটল’ প্রমাণ করার ছক। ম্যাগাজিনটির সম্পাদক এই এলাকার জনমোর্চার এমএলএ। সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে ম্যাগাজিনটি শাঁসেজলে আছে। ভুলভাল লেখা ছাপা হয়।

মনে মনে চয়নের পাশে ঢ্যাঁড়া দেয় অভি। মনোজের দফতর থেকে একটা ম্যাগাজিন বেরোয়। সেটার নাম জীবন সংগ্রাম। চয়নের সঙ্গে চরিত্রগতভাবে কোনও তফাত নেই। সরকারি বিজ্ঞাপনে ঠাসা, সরকারের স্তাবকতায় ভরা। প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চরিত্র বজায় রাখতে নিয়ম করে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ ও পত্রিকাকে গালাগালি দেয়। জীবন সংগ্রামের পাশেও ঢ্যাঁড়া দেয় অভি।

হঠাৎই মনে পড়ে অন্তহীন পত্রিকার কথা। কবি সুদিন চক্রবর্তীর সম্পাদনায় এই দ্বি-মাসিক কাব্যপত্রটি অনেকদিন ধরে চলছে। সুদিন আজ সকাল সংবাদপত্রের রবিবারের পাতার সম্পাদক। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পুরোদস্তুর যুক্ত। তা সত্ত্বেও নতুন কবিদের জন্য তৈরি করেছে প্ল্যাটফর্ম, অন্তহীন। বাংলাভাষার নবীন ও প্রবীন এমন কোনও কবি নেই যিনি অন্তহীনে লেখেননি। অভিও ট্রাই করবে নাকি?

মাথায় ভূত যখন চেপেছে, তখন একটাই উপায়। কাজটা করে ফেলা। চায়ের কাপ সিঙ্কে রেখে তিনতলায় ওঠে অভি। কবিতার খাতা বার করে, সাদা কাগজে কবিতাটা কপি করে। আর একটা সাদা কাগজ নিয়ে বসে। একটা ফরওয়ার্ডিং লেটার থাকা উচিত, যাতে তার নাম, ঠিকানা, ফোন-নম্বর বা মেল আইডি থাকবে। সামান্য ভেবে সে লেখে,

‘শ্রী সুদিন চক্রবর্তী,

সম্পাদক,

অন্তহীন,

মান্যবরেষু,’

আচ্ছা মান্যবরেষু বানানে মূর্ধণ্য ষ, না দন্ত স? কবিতার খাতা টেনে নিয়ে দু’রকম বানানই লেখে অভি। চোখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ‘মান্যবরেসু’ ভুল বানান। তা হলে ‘মাননীয়াষু’ বানান কী? এখানে দন্ত স না মূর্ধণ্য ষ? কনফিউজড হয়ে অভিধান পেড়ে বানান দেখে নেয় অভি। ও হরি, মেয়েদের ক্ষেত্রে দন্ত স আর ছেলেদের ক্ষেত্রে মূর্ধণ্য ষ। তাহলে সে ঠিকই লিখেছে। খসখস করে আবার কলম চালায়।

‘অন্তহীন’ পত্রিকার জন্য একটি কবিতা পাঠালাম।

আশা করি মনোনীত হবে।

নমস্কারান্তে,

অভিজ্ঞান লাহিড়ী।

৫/৯/২০১১

ওপরে চিঠি ও তলায় কবিতার কাগজ রেখে স্টেপল করে অভি। খয়েরি খাম পাড়ে বইয়ের তাক থেকে। তিনভাঁজ করে চিঠি খামে ঢোকায়। আঠা দিয়ে খামের মুখ আটকে খামের ওপরে বড়বড় করে অন্তহীন পত্রিকার ঠিকানা লেখে। প্রেরক হিসেবে নিজের নাম-ঠিকানা লেখে। তারপর দোতলায় নেমে আসে। এখনই কুরিয়ার করে দেওয়া যাক।

মনোজ অফিস থেকে চলে এসেছেন। মনোজকে দেখে অবাক হল অভি। সাড়ে নটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে গেছেন? তা হলে নিশ্চয় গাড়িতে ফিরেছেন। অরুণা রান্নাঘরে আবার চা করছেন। অভি বলল, ‘মা, আর এক কাপ চা হবে নাকি?’

অরুণা উত্তর দিলেন না। অভি সোফায় বসে রিমোটের দিকে হাত বাড়াল। অরুণা টিভি বন্ধ করে দিয়েছেন।

টিভি চালানো মাত্র রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এলেন অরুণা। অভির হাত থেকে রিমোট কেড়ে, মাথায় চাঁটি মেরে বললেন, ‘দিনরাত টিভি আর টিভি। তোর পড়াশুনা নেই?’

‘যাব্বাবা! আমি আবার কখন টিভি দেখি। তুমিই তো দিনরাত মেগাগুলো গেল। আজ দেখছিলে ”যদিদং ডিংডং”, কাল দেখবে ”হৃদয়ং পিংপং”!’ প্রতিবাদ করে অভি।

‘তুই চুপ কর।’ অভিকে থামিয়ে অরুণা বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো, তারপর কী হল?’

এদের ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। বিরক্ত হয়ে অভি ভাবে, নিচ থেকে ঘুরে আসা যাক। রাধা আর মানদার এতক্ষণে নিশ্চয় গলায়-গলায় বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সিঁড়ির দিকে এগোয় সে।

‘আর বোলো না!’ খুশিয়াল গলায় বলছেন মনোজ, ‘যত বোঝাই যে আমরা স্টার নই, আমরা পলিটিকাল অ্যাকটিভিস্ট, কিছুতেই কথা শোনে না। অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। দু-একটা টিভি চ্যানেলের লোকাল করেসপন্ডেন্ট তো ইন্টারভিউও নিল। এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়েও জনমোর্চার কথা বলার মতো চ্যালেঞ্জিং জব কী করে সামলাচ্ছি, আগেকার সেই ডেডিকেশান কী করে মেনটেন করছি… যত্তো সব বোরিং ব্যাপার। লাকিলি ঠিক সময় ট্রেনটা পেয়ে গেলাম তাই। তা না হলে সেই সাড়ে এগারোটা বাজত। আর তোমার মুখটা তেলো হাঁড়ির মতো হয়ে থাকত।’

একতলায় নামতে গিয়ে অভি থমকে গেল। স্লো মোশানে পিছন ফিরে দেখল অরুণা রান্নাঘর থেকে আবার বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর চোখেমুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। ঠান্ডা গলায় তিনি বললেন, ‘তুমি স্নান করে নাও। আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব।’

‘আচ্ছা।’ আধখাওয়া চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বাথরুমে ঢোকে মনোজ। অরুণা ধীরপায়ে হেঁটে এসে টিভি চালান। সাউন্ড একদম কমিয়ে দেন। অভি শুনতে পায়, স্কুপ চ্যানেল এখন রেল বিভ্রাটের কাহিনি দেখাচ্ছে। সঞ্চালক পরিমল বলছে, ‘শেয়ালদা লাইনের ট্রেন চলাচল এখনও পর্যন্ত বন্ধ। সকাল সাড়ে নটায় রেল অবরোধ শুরু হয়েছে। এখন রাত সাড়ে নটা বাজে। বারো ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। রেল দফতর এখনও এই অবরোধ তুলতে পারছেন না। এই বিষয়ে কথা বলার জন্য আমরা চলে যাচ্ছি…’

অভি অরুণার হাত থেকে টিভির রিমোট কেড়ে নিয়ে টিভি অফ করে দেয়। সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নামতে নামতে শুনতে পায় অরুণা বিড়বিড় করছেন, ‘পাগলের অভিশাপ! ঠিক ফলে গেল।’