বৃন্দা
কখন আকাশ থেকে মেঘ, কখন মেঘের থেকে জল
কখন জলের মাঝে মেয়ে। মেয়ের দু’গালে টলোমল
স্বেদ, নাকি অশ্রু ছিল রাখা। জানি না, হয়নি বলে চাখা।
ধর্মতলাগামী বাসে চাকা, ফেটে গিয়ে এই গন্ডগোল।
স্বাদই অপূর্ণ না শুধু। নামটাও বাকি আছে জানা।
পদবি? তাতেও গরমিল। এ ছাড়াও জানি না ঠিকানা।
কিছুই জানি না বলে শোক, করার মতন কোনও লোক
নই আমি। তাই আজ থেকে, তার নাম বৃষ্টিদিন হোক।
এবং যে বহুতল জুড়ে, তার বাসা আটতলা জুড়ে,
ঠিকানা জানি না বলে তার, দিলাম ‘আকাশলীনা’ নাম।
এই চিঠি পোস্ট করলাম, মেঘপিওনের হাত দিয়ে।
ডাক-তার ব্যবস্থার কথা, এ বান্দার কিছু আছে জানা।
ফেরতা চিঠির জন্য তাই অপেক্ষা করব বিশদিন।
তার মধ্যে উত্তর না দিলে, মনোমতো উত্তর না পেলে…
তোমার দুয়ারে দিয়ে ঘা, (সমাজ টমাজ মানি না!)
চেঁচিয়ে গাইব, ‘ওলে ওলে!’
বাথরুমের আড়ালে বাথটাবের গায়ে হ্যালান দিয়ে বৃন্দা থম মেরে বসে রয়েছে। বুক ধড়াস ধড়াস করছে, দু’পায়ের ফাঁকে অন্যরকম ভালোলাগার শিরশিরানি হচ্ছে, একটু একটু হাসি পাচ্ছে। প্রথম দুটো লক্ষণ পরিচিত। কিন্তু হাসিটা কেন? নিজেকে নিয়ে কনফিউজড বৃন্দা। একটা ছেলেকে সে দীর্ঘদিন ধরে ছিপের গাঁথার চেষ্টা করেছে। ইশারা ইঙ্গিত করেছে, গোপন ও গূঢ় সিগন্যাল পাঠিয়েছে। ছেলেটা নিরীহ মুখ করে তাকে দেখেছে। বৃন্দার ধারণা ছিল, এইসব সিগনাল ছেলেটার মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। একদিন এলএলটি-র পিছনের সিটে বসে চকাম করে চুমু না খেলে কিছুই বুঝবে না।
কিন্তু ছোকরা তো ছুপা রুস্তম! অ্যানাটমি থিয়োরি পরীক্ষার মধ্যে এমন সুন্দর একটা প্রেমপত্তর লিখে ফেলল! জিও বস! নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ায় বৃন্দা। তার চয়েস আছে! এবং এতক্ষণে হাসির কারণ বুঝতে পারে সে। কবিতাটায় চমৎকার হিউমার আছে। অনেককাল আগে ‘ইয়ে দিল্লাগি’ নামে একটা হিন্দি সিনেমা রিলিজ করেছিল। তাতে কাজল, অক্ষয় কুমার আর সেফ আলি খান ছিল। তাতে একটা গানটা ছিল। ‘যব ভি কই লড়কি দেখে, মেরে দিল দিওয়ানা বোলে, ওলে ওলে ওলে।’
পুরোনো সেই গানের পাঞ্চ লাইন এই কবিতায় চমৎকার ঢুকিয়ে নিয়েছে অভি।
সিনেমার প্রসঙ্গ থেকে বাস্তবে ফেরে বৃন্দা। এতদিন কলেজের কেউ জানত না যে সে সার্জারির এইচওডি স্যামি ব্যানার্জির মেয়ে। অ্যানাটমি থিয়োরি পরীক্ষার দিন এমন ঝড়বৃষ্টি হল যে, স্যামি তাকে গাড়িতে পিক আপ করতে বাধ্য হন। থিয়োরি পরীক্ষার তিনঘণ্টা সকলের মোবাইল ফোন সাইলেন্ট মোডে, ব্যাকপ্যাকে রাখা ছিল। উত্তরপত্র জমা দিয়ে, ব্যাগ থেকে মোবাইল বার করে বৃন্দা দেখেছিল স্যামির মেসেজ, ‘ওয়েট অ্যাট দ্য ড্রাইভ ওয়ে। আই উইল বি দেয়ার।’
বৃন্দা না বলার সুযোগ পায়নি। অবশ্য না বললে স্যামি শুনতেন না!
গাড়ি বারান্দায় গাড়ি এসে দাঁড়ানোমাত্র এক লাফে গাড়িতে উঠেছিল বৃন্দা। সবাই দেখেছিল, গাড়ি কে চালাচ্ছেন। দুই আর দুইয়ে চার করতে কারও অসুবিধে হবে না।
এনিওয়ে! শ্রাগ করে বৃন্দা। কলেজে এক বছর হয়ে গেল। আজ আর এ সবে কিছু আসে যায় না। মুশকিল হল, অভি যে তাকে একটা কাগজ ধরাচ্ছে, এটা স্যামি দেখেছিলেন। গাড়ির কাচ তোলার পরে পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘দেখি!’
ওই সামান্য সময়ের মধ্যে বৃন্দা দেখে নিয়েছিল যে, আনসার সিটে বাংলা হরফে কিছু একটা লেখা রয়েছে। তার ইনস্টিংক্ট বলেছিল, এটা স্যামিকে পড়তে দেওয়া যাবে না। কাগজটা হাতের ফাঁকে লুকিয়ে কোয়েশ্চেন পেপার স্যামির দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে স্যামি বলেছিলেন, ‘এত ছোট কাগজ?’
‘ন্যাকামি কোরো না। তিনটে লং কোয়েশ্চেন আর পাঁচটা শর্ট নোটের জন্য কত বড় কাগজ লাগে? কোনও ”অথবা”-ও তো নেই। তুমি কোয়েশ্চেন সেট করো, আর তুমি জানো না?’
‘জানি। আমার মনে হয়েছিল ওই ছেলেটা তোকে বড় কোনও কাগজ দিচ্ছিল।’
‘কোন ছেলেটা?’ নিষ্পাপ বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল বৃন্দা।
‘গাড়িতে ওঠার আগে যে তোকে কাগজটা দিল!’
‘অভি?’ মনে মনে বাবার দৃষ্টিশক্তির তারিফ করতে করতে বৃন্দা বলেছিল, ‘আমার ঠিক পাশে ওর সিট পড়েছে। একদম ফ্রন্ট বেঞ্চ। একটাও কথা বলার স্কোপ পাচ্ছি না। আজ কোনও প্রবলেম হয়নি। ফিজিওলজির দিন আনকমন প্রশ্ন পড়লে কী যে হবে…’
লেখাপড়ার অলোচনা শুরু হয়ে যাওয়ায় স্যামি কাগজ প্রসঙ্গ ভুলে গিয়েছিলেন। শান্তিধামে ফিরে, বাথরুমে ঢুকে জিনসের পকেট থেকে আনসার শিট বার করেছিল বৃন্দা। পড়েছিল কবিতাটা।
তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র! একবার পড়েই মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। থেকে থেকেই আওড়াচ্ছে, ‘কখন আকাশ থেকে মেঘ, কখন মেঘের থেকে জল…’
অ্যানাটমি থিয়োরি পরীক্ষার রাত বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন সকালে হোস্টেলে চলে এসেছে বৃন্দা। আনলাকি তেরো নম্বর ঘরে দময়ন্তীর সঙ্গে একটানা পড়ে ফেলেছে ফিজিয়োলজির সব কটা চ্যাপ্টার। দময়ন্তীর সঙ্গে গ্রুপ স্টাডির ব্যাপারে বৃন্দার চমৎকার তালমিল হয়েছে। দুজনের পড়ার ধরন হুবহু এক। একজন একটা চ্যাপ্টার ধরছে আর সেই চ্যাপ্টারের লং কোয়েশ্চেন আর শর্ট নোটগুলো অন্যজনকে হোয়াইট বোর্ডে এঁকে এঁকে বোঝাচ্ছে। মুখস্থ বিদ্যার দৌড় আর ডায়াগ্রাম প্র্যাকটিস—দুটোই হয়ে যাচ্ছে। চ্যাপ্টার শেষ হলে বক্তা বদল হচ্ছে। দু’জনে মিলে পুরো ফিজিওলজি শেষ করতে দ্বিগুণ সময় লাগছে ঠিকই কিন্তু রিভিশন হচ্ছে সলিড। দু’দিনের ছুটি পুরোপুরি উশুল করছে বৃন্দা। শুধু মাঝেমধ্যে মাথার মধ্যে গুনগুনোচ্ছে, ‘কখন জলের থেকে মেয়ে, মেয়ের দু’গালে টলোমল…’
ফিজিওলজি থিয়োরি পরীক্ষার দিন সকালে ফুরফুরে মেজাজে ঘুম ভাঙল বৃন্দার। মোবাইলে সময় দেখল। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। গতকাল রাতে ফিজিওলজি কোর্স শেষ করে সে আর দময়ন্তী শুতে গিয়েছিল রাত দেড়টায়। আজ সকালে পড়ার জন্য কোনও টপিক রাখা নেই। খুশি মনে দময়ন্তীকে ঠেলা মারল বৃন্দা। মেয়েটা নড়ল না।
দময়ন্তী শুতে যাওয়ার আগে অ্যালোপাম খায়। বৃন্দা ক্যাজুয়ালি বুঝিয়েছে, এটা খেলে অ্যাডিকশান হয়। মেয়ে শোনার পাত্রীই নয়। রাতে শোওয়ার আগে ওষুধ না পেলে সদ্য হাঁটতে শেখা ছাগলছানার মতো তুড়ুক নাচন দেয়। গতকালও জিভের নীচে ওষুধ নিয়ে শুয়েছিল। এখন গাছের গুঁড়ির মতো পড়ে রয়েছে নিশ্চিন্ত, সিন্থেটিক ঘুমে। আবার খোঁচা মারে বৃন্দা, ‘ওরে! এবার ওঠ! পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে নেই নাকি?’
বৃন্দার দ্বিতীয় খোঁচার ফল হল উদ্ভট। দময়ন্তী ধড়মড়িয়ে খাট থেকে উঠে বসল। তার দু’চোখ বন্ধ, গুঙিয়ে উঠে দু’হাঁটুর মাঝখানে মুখ গুঁজে দিল সে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। ঘামে ভিজে গেছে রাতপোশাক।
ঘাবড়ে গিয়ে বৃন্দা বলল, ‘এ বাবা! তোর হলটা কী? পাগল হয়ে গেলি নাকি?’
‘কিছু না!’ নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলে দময়ন্তী, ‘ওষুধের ঘুম তো! হঠাৎ ভেঙে গেলে ড্রামাটিক এফেক্ট হয়। তাছাড়া আমি একটা নাইট মেয়ার দেখছিলাম…’
‘দুঃস্বপ্ন? পরীক্ষার দিন সকালবেলা? কী দেখলি? সব কোয়েশ্চেন আনকমন?’
‘নাঃহ! এই স্বপ্নটা রেকারিং। খুব বৃষ্টি পড়ছে। আমি একটা বাজারের মধ্যে দিয়ে দৌড়োচ্ছি। আমাকে ধাওয়া করে আসছে সুরজ! আমি পালাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু পালাতে পারছি না…’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলে দময়ন্তী। বৃন্দা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘কাঁদিস না। ওসব কথা ভুলে যা। স্নান করে নে।’
‘আমি ভুলতেই চাই। আমার ব্রেনের গভীরে ঘটনাটা এনক্রিপটেড হয়ে আছে। আমার সাবকনশাসে ঘটনাটার কোডিং করা আছে। অ্যালোপাম খেয়েও ডিলিট করতে পারছি না।’ দুঃখের হাসি হাসে দময়ন্তী। চোখের জল মুছে বলে, ‘বাথরুমে যাই। নাইটড্রেসটা কাচতে হবে। স্বপ্নের মধ্যে হিসি হয়ে গেছে।’
দময়ন্তী ঘর থেকে বেরোনো পর্যন্ত থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল বৃন্দা। বন্ধুর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। পাঁচ মিনিটের একটা ঘটনা দময়ন্তীর শরীরে এবং মনে কী সাংঘাতিক প্রভাব ফেলেছে! অ্যাংজাইটি কমানোর ওষুধ খেতে হচ্ছে, রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে হচ্ছে, বিছানায় ছোট বাইরে করে ফেলতে হচ্ছে। ঘুম ভাঙার সময় যে ফুরফুরে মেজাজ ছিল, সেটা ঘেঁটে গেল। ভুরু কুঁচকে ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে, টাওয়েল কাঁধে নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোল।
স্নানঘর ও বাথরুমের অপ্রতুলতা লেডি আর্চার্স হোস্টেলের বনেদি সমস্যা হলেও পরীক্ষার্থী ব্যাচ অগ্রাধিকার পায়। স্নান বা পটি করার ক্ষেত্রে অন্যরা লাইন ছেড়ে দেয়। পটির লাইনে দাঁড়িয়ে বৃন্দা দেখল তার সামনে জেমসি। বৃন্দাকে দেখে চোখ মেরে বলল, ‘সকাল বেলা ডেলিভারি ঠিকঠাক হলে পরীক্ষাও ঠিকঠাক হয়।’ বৃন্দা উত্তর না দিয়ে হাসল। পিছন থেকে শ্রীপর্ণা বলল, ‘বাবার মুখে শুনেছি, আর্মি ব্যারাকেও এই সমস্যা হয়। তবে জওয়ানদের লজ্জা নেই। তারা মাঠে বা জঙ্গলের মধ্যেই বসে পড়ে।’
‘কাঁহা গয়ে জওয়ান লোগ?’ সাবিনা বাথরুমের ভিতর থেকে চ্যাঁচায়। ‘ভেজ দেনা দো চারকো।’
‘অ্যাই! তুই বেরো তো!’ বিরক্ত হয়ে বৃন্দা বলে, ‘সকালবেলায় ব্যাটাছেলে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল।’
‘তাহলে কখন করব ডার্লিং? পরীক্ষা দিতে দিতে?’ ঝ্যাড়াং করে টয়লেটের দরজা খুলে বেরোয় সাবিনা। এক দৌড়ে স্নানঘরে ঢুকে যায়।
প্রাতঃকৃত্য সেরে, রুমে ঢুকে বৃন্দা দেখল, দময়ন্তী রেডি হয়ে গাইটনের মোটকা ফিজিওলজি বই খুলে হর্মোনের চ্যাপ্টার খুলে বসেছে। পোশাক বদলাতে বদলাতে বৃন্দা বলল, ‘কাল তো পড়লি। আবার কেন?’
‘মেনস্ট্রুয়াল সাইকলের সময় হর্মোনাল চেঞ্জটা একটু দেখছি।’
‘আর দেখতে হবে না।’ পোশাক পরে বৃন্দা রেডি। পরীক্ষার্থীদের তুলনায় সামান্য বেশি সাজগোজ হয়ে গেল আজ। চোখের কাজল একটু গাঢ়, ঠোঁটের রং হাফ শেড বেশি গোলাপি, চুলে একটু গর্জাস ক্লিপ, হিলটা এক ইঞ্চি বেশি উঁচু। আড়চোখে সাজগোছ দেখে দময়ন্তী বলল, ‘কী ব্যাপার?’
‘কীসের কী ব্যাপার?’ টেনসান টেনসান মুখ করে বলে বৃন্দা।
‘সাজগোজ কেন?’ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন দময়ন্তীর।
‘সাজগোজ? আর ইউ ম্যাড?’ প্রতিপ্রশ্ন বৃন্দার। দময়ন্তী শ্রাগ করে রুম থেকে বেরোল। পিছন পিছন বৃন্দা। এবার খাওয়াদাওয়া করতে হবে। একতলায় মেস চালায় ‘সঞ্জীবন’ নামের এনজিও। প্রতিবন্ধী মহিলাদের জন্য তৈরি সংস্থাটি সেন্টিনারি বিল্ডিং-এর একতলার কফিশপটাও চালায়। সুপার রিনা দত্ত সঞ্জীবনকে গত পাঁচবছর ধরে গার্লস হোস্টেলের মেস চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। দশজন মেয়ে মিলে চমৎকার চালায়।
পরীক্ষার সময় সাত্ত্বিক আহারের আয়োজন করা হয়েছে। ভাত, সোনামুগের ডাল, ঝিরিঝিরি করে আলুভাজা, ট্যাংরা মাছের ঝাল। যে সব মেয়ে নিরামিষাশী, তাদের জন্য ছানার ডালনা। দ্রুত খাওয়া শেষ করে হোস্টেলে থেকে বেরোয় বৃন্দা। আজ যদিও আকাশ পরিষ্কার, কিন্তু স্যামি ব্যানার্জির হুকুম যে গাড়ি করে মেডিক্যাল কলেজ যেতে হবে। পরীক্ষার সময় নো রিস্ক।
গাইনি বিল্ডিং-এর সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক দেখে গাড়িতে ওঠে বৃন্দা। সঙ্গে দময়ন্তী। চারপাশ দেখার কারণ, তার ব্যাচের যদি কেউ এখন পাশ দিয়ে যায়, তাহলে বৃন্দা লিফট দেবে। যদিও এ বিষয়ে স্যামির কঠোর আপত্তি আছে। রুমমেট দময়ন্তী ছাড়া আর কাউকে গাড়িতে তোলা যাবে না, সুলতানকে এই অর্ডার দিয়ে পাঠিয়েছেন। সুলতান স্টিয়ারিং ধরে ন’মাসে-ছ’মাসে। মন্দিরার সুইফট ডিজায়ার চালায়। পরীক্ষার সময় সেই গাড়ি বৃন্দার জন্য সুলতান সমেত বরাদ্দ হয়েছে।
গাড়ি শেয়ালদা ফ্লাইওভারে উঠতে জানলার কাচ নামিয়ে দিল দময়ন্তী। বৃন্দাকে বলল, ‘কবিকোকিল বিদ্যাপতি সেতু কলকাতার কোথায় আছে বল তো?’
‘কোকিলের নামে ব্রিজ? যাঃ! ইয়ারকি দিচ্ছিস!’
‘শুধু কোকিল না ইডিয়েট! কবিকোকিল। আচ্ছা বল, বিদ্যাপতি সেতু কোথায় আছে?’
‘জানি না বাবা! বড়বাজার টড়বাজার হবে। ওখানে বহুত নন বেঙ্গলি থাকে।’
‘দূর গাধা! তুই যে ফ্লাইওভারটার ওপর দিয়ে যাচ্ছিস, তার নাম কবিকোকিল বিদ্যাপতি সেতু।’
‘শেয়ালদা ফ্লাইওভারের ভালো নাম কোকিল সেতু? দিঠি, আমি হাসতে হাসতে মরে যাব। কারা এইসব নাম দেয়? মাস্ট বি মিনিস্টার্স।’
‘না। এর জন্য একটা কমিটি আছে।’
‘কমিটি?’ হাসতে হাসতে ঢলে পড়ে বৃন্দা, ‘নাম দেওয়ার জন্য কমিটি? তুই একবার ভেবে দেখ! মিটিঙে বসে একটা লোক বলছে, ”নিমতলা শ্মশান ঘাটের নাম আজ থেকে ড্রাকুলা সরনি হল। যাঁরা সমর্থন করেন, তাঁরা হাত তুলুন।” উফ! মাগো!’
দু’জনের হাসাহাসির মধ্যে গাড়ি বাঁদিকে ঘুরেছে। ছবিঘর সিনেমা হল পেরিয়ে মহাত্মা গাঁধী রোড ধরে খানিকটা এগিয়ে সুলতান বলল, ‘কলেজ স্ট্রিট থেকে গাড়ি বাঁদিকে যাবে না কিন্তু।’
‘তুমি পূরবী সিনেমা হল থেকে বাঁদিকে নাও। পরের মোড়ে গিয়ে আবার বাঁদিকে টার্ন নাও। বউবাজারের মোড় থেকে বিবি গাঙ্গুলি স্টিট ধরো।’ বৃন্দা সুলতানকে রাস্তা বলে দেয়। সুলতান কিছুক্ষণ চুপচাপ গাড়ি চালায়। বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে পড়ে, দুপাশের গয়নার দোকান দেখতে দেঝতে বলে, ‘তুমি এত রাস্তা চিনলে কী করে? কলেজের পরে তোমার সোজা বাড়ি যাওয়ার কথা না?’
‘সুলতান চাচু, প্লিজ!’ বিরক্ত হয়ে বৃন্দা বলে, ‘আমি এখন কলেজে পড়ি।’
‘ভালো। সেটাই তোমার বাবাকে বলব তাহলে।’ ডানদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে মেডিক্যাল কলেজের সামনে এসে বলে সুলতান।
‘ধ্যাত্তেরিকা! খুব খারাপ হবে বলে দিলাম!’ গাড়ি থেকে নেমে, দময়ন্তীর হাত ধরে হলের দিকে এগোয় বৃন্দা। পরীক্ষা শুরু হতে আর আধঘণ্টা বাকি।
প্রথম বেঞ্চির বাঁদিকে নিজের আসনে বসে রয়েছে অভি। বৃন্দা এখন মোটেই অভির দিকে তাকাবে না। একটু ‘ভাও’ খাওয়া ইম্পর্ট্যান্ট। পরে মনে হল, পরীক্ষার ঠিক আগে ছেলেটাকে টেনশান খাওয়ানোটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। ফ্রাস্টু খেয়ে বাজে পরীক্ষা দিয়ে ঝাড় খেলে বিপদ! ক্লিপবোর্ড বেঞ্চিতে রেখে অভির দিকে নিউট্রাল দৃষ্টি বিছিয়ে বৃন্দা বলল, ‘প্রিপারেশন কেমন?’
‘খারাপ না। ফিজিওলজি পড়তে আমার ভালো লাগে।’
‘দ্যাটস গুড। অ্যানাটমিতে প্রবলেম হয়েছিল নাকি?’
‘হ্যাঁ। একটা লং কোয়াশ্চেন আনকমন পড়েছিল। বাথরুমে গিয়ে চোথা দেখতে হল।’
‘বাববাঃ! তোর সাহস আছে।’
‘আরে! ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। রিস্ক না নিলে ঝাড় খেয়ে যেতাম,’ পাতলা হাসে অভি। বেঞ্চির দিকে তাকিয়ে একপর্দা গলা নামিয়ে বলে, ‘তোকে একটা কাগজ দিয়েছিলাম…’
ওফ! ছেলেগুলোর সবসময় ওয়ান ট্র্যাক মাইন্ড! কড়া গলায় বৃন্দা বলে, ‘পরে! ম্যাডামরা আসছেন।’
বৃন্দার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঢং করে ঘণ্টা পড়ল। চারজন ম্যাডাম লাইন দিয়ে হলঘরে ঢুকলেন। সবার বয়স চল্লিশের আশেপাশে। এঁরা পরস্পরের বন্ধু। আজ সন্ধেবেলা অ্যাকাডেমিতে কোনও একটা নাটক দেখতে যাবেন। তাই নিয়ে আলোচনা করছেন আর হাসছেন। ক্যাজুয়াল আবহাওয়ার মধ্যে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র বিতরণ শেষ হল। চারজনের মধ্যে দু’জন হলঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দু’জন চেয়ারে বসে গল্প করতে লাগলেন।
প্রশ্নপত্রের দিকে তাকাল বৃন্দা। মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের সময় হরমোনাল চেঞ্জ নিয়ে প্রথম লং কোয়েশ্চেন। দেখেই মাথা খারাপ হয়ে গেল। এটা শেষ করতে কমপক্ষে একঘণ্টা লাগবে। বাকি প্রশ্নগুলোয় দ্রুত চোখ বোলাল সে। হার্ট আর লাং নিয়ে লং কোয়েশ্চেন। শর্ট নোটে এসেছে ব্রেন, কিডনি, লিভার, প্যানক্রিয়াস আর ভিটামিন থেকে।
বাপ রে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃন্দা। আজকের পরীক্ষার মূল সমস্যা সময়। সে যা জানে, তার সবটা লিখতে গেলে ছ’ঘণ্টা সময় লাগবে। মনে মনে ছক কষে বৃন্দা। একশো নম্বরের জন্য বরাদ্দ একশো আশি মিনিট। অর্থাৎ পাঁচ নম্বরের শর্ট নোটের জন্য বরাদ্দ নমিনিট। আর পঁচিশ নম্বরের লং কোয়েশ্চেনের জন্য বরাদ্দ পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তাহলে কাঁটায় কাঁটায় তিনঘণ্টায় পরীক্ষা শেষ হবে। রিভিসনের জন্য কোনও সময় থাকবে না। লং কোয়েশ্চেনগুলো চল্লিশ মিনিটে নামালে হাতে পনেরো মিনিট সময় থাকবে।
এবার দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। লং কোয়েশ্চেন, না শর্ট নোট? কোনটা আগে লিখবে? বৃন্দা ঠিক করে, সব থেকে বড় উত্তর দিয়ে লেখা শুরু করবে। সেটা চল্লিশ মিনিটে শেষ করলে অনেকটা কনফিডেন্স পাওয়া যাবে। অতএব, মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের হর্মোনাল চেঞ্জ দিয়েই ফিজিওলজি পরীক্ষার উত্তর লেখা শুরু হোক।
প্রথম প্রশ্নের উত্তর লেখা শেষ করে ঘড়ি দেখল বৃন্দা। পঞ্চাশ মিনিট লেগেছে। সে দশ মিনিট লেটে রান করছে। এবার ফুসফুসের বায়োমেকানিক্সে হাত দেওয়া যাক। এটায় লেখা কম। ডায়াগ্রাম বেশি। আশা করা যায় ঠিক সময়ে শেষ হবে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর লেখা শেষ করে ঘড়ি দেখল বৃন্দা। চল্লিশ মিনিটে শেষ হয়েছে। এখনও সে দশ মিনিট লেটে রান করছে। তৃতীয় ও শেষ লং কোয়েশ্চেনে হাত দেওয়ার আগে সে এক পলক হলঘরটা দেখে নিল। সবাই ঘাড় গুঁজে খসখস করে লিখে যাচ্ছে। চারজন ম্যাডাম লুজ শিট বিতরণ করছেন। অভি মন দিয়ে হার্টের ছবি আঁকছে। ঠিক হ্যায়। বৃন্দাও এবার আঁকবে। ফিজিওলজি অব হার্ট লিখতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে।
তিনটে লং কোয়েশ্চেন লেখা শেষ করে আবার ঘড়ি দেখল বৃন্দা। এটা শেষ করতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল। অর্থাৎ সে পনেরো মিনিট পিছিয়ে আছে। এই গতিতে চললে রিভিশান তো হবেই না, একটা শর্ট নোট বাদও পড়তে পারে।
মৃদু টেনশানের মধ্যেই ভিটামিনের শর্ট নোট লিখতে শুরু করে। এটা ন’মিনিটে নামাতেই হবে…
পাঁচটা শর্ট নোট পঁয়তাল্লিশ মিনিটে শেষ হওয়ার কথা। বৃন্দা শেষ করল চল্লিশ মিনিটে। পরীক্ষা শেষ হতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। পাঁচ মিনিটে এই মহাভারত রিভিশন দেওয়া সম্ভব নয়। বৃন্দা তাই ডায়াগ্রাম আর চার্টগুলোয় চোখ বুলোল। বড় কোনও ভুল যেন না থাকে।
ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ম্যাডাম এসে অভি আর বৃন্দার হাত থেকে খাতা নিয়ে নিলেন। বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বৃন্দা বলল, ‘বাপরে! একশো মিটারের স্পিডে ম্যারাথন দৌড়োলাম। তোর পরীক্ষা কেমন হল?’
বিষণ্ণ চোখ তুলে অভি বলল, ‘মোটামুটি।’
অভির মুখচোখ দেখে সন্দেহ হল বৃন্দার। প্রশ্ন করল, ‘সব কোশ্চেনের উত্তর লিখেছিস তো?’
লাজুক মুখে অভি বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘এই নিয়ে আর ভাবিস না।’ অভির চুল ঘেঁটে দেয় বৃন্দা, ‘বাই দ্য ওয়ে, তোর কবিতাটা ভালো হয়েছে।’
বৃন্দার হাত সরিয়ে অভি বলল, ‘সমীরণ ব্যানার্জি তোর বাবা? আমি জানতাম না।’
‘জানলে কী হতো?’ বিরক্ত মুখে বলে বৃন্দা, ‘কবিতাটা আমায় দিতিস না?’
সুইফট ডিজায়ার সামনে দাঁড়িয়ে। দময়ন্তী অলরেডি পিছনের আসনে বসে। সুলতান কঠিন চোখে বৃন্দাকে দেখছে। দৃষ্টি উপেক্ষা করে বৃন্দা অভির হাত চেপে ধরে। হাত ছাড়িয়ে অভি বলে, ‘আর একটু বড় কবিতা লিখতাম।’
আগামী পরশু বায়োকেমিস্ট্রি থিয়োরি পরীক্ষার টেনশান মাথা থেকে উড়ে যায়। বৃন্দার পদক্ষেপ এখন হরিণীর ছন্দ। এক ছুট্টে গাড়িতে উঠে সে বলে, ‘চলো সুলতানচাচু।’ তারপর জানলা দিয়ে হাত বার করে চেঁচায়, ‘বাই! পরশু দেখা হচ্ছে।’
‘বাই!’ বিষণ্ণ মুখে হাত নাড়ছে অভি।