দময়ন্তী
‘আমার নাম যদি বলিস, তা হলে লাশ ফেলে দেব। কোনও মাই কা লাল কিছু করতে পারবে না। কিপ ইট ইন মাইন্ড।’ ঝড়ের গতিতে কথাগুলো বলে ফোন কেটেছিল সুরজ। দময়ন্তীর মনে হয়েছিল, তার কান দিয়ে গলানো সিসে ঢুকছে। এনজির প্রশ্নের উত্তরে কোনও কথা বলেনি। ক্যাডাভার কে গায়েব করেছে জানা সত্ত্বেও চুপ করে ছিল।
সুরজ পড়াশুনায় ভালো। কিন্তু বড়লোকি চাল ষোল আনার ওপরে আঠেরো আনা। অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাতে সবাই একবার বডি দেখে, এই খবর শুনে কালুয়াকে বলেছিল, ‘আমিও দেখব। তবে চোরের মতো চুপিচুপি অ্যানাটমি বিল্ডিং-এ ঢুকতে পারব না। কালুয়া, তুই একটা ক্যাডাভার বয়েজ হোস্টেলে পাঠিয়ে দে।’
‘হোস্টেলে? পাগল নাকি?’ সুরজের কথা উড়িয়ে দিয়েছিল কালুয়া।
‘পাঁচ মিনিটের জন্য তোর রেট কত?’ মুচকি হেসে প্রশ্ন করেছিল সুরজ।
‘একশো টাকা।’
‘হোল নাইটের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেব। রাজি?’
‘রাজি।’ টাকার গন্ধে সঙ্গে সঙ্গে রাজি কালুয়া। রাত্তিরবেলা বডি কোন পথ দিয়ে হোস্টেলে সুরজের রুমে ঢুকবে, সকালে কীভাবে ডিসেকশানে রুমে ফেরত আসবে—এইসব প্ল্যানিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা সুবিধে এই যে, সুরজ এখন অ্যানেক্স ব্লকের গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকে। এদিকে সুইপার ঢোকার একটা ছোট গেট আছে। রাতের বেলা সুরজের রুমে ক্যাডাভার পৌঁছে দিলে কেউ খেয়াল করবে না। এখন সব রুম থেকেই কড়া ফর্মালডিহাইডের গন্ধ আসছে। গন্ধ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না।
প্ল্যানমাফিক রাত দশটার সময় কালুয়া তিনচাকার ভ্যানে ক্যাডাভার নিয়ে অ্যানেক্স ব্লকের সুইপার ঢোকার গেটের সামনে এসে সুরজকে ফোন করেছিল। সুরজের রুমমেট সঞ্জয় ত্রিপাঠি। সুইপার ঢোকার দরজা দিয়ে ক্যাডাভার কাঁধে নিয়ে কালুয়া যখন ঢুকল, সঞ্জয় বলল, ‘বিক্রম অওর বেতাল মনে পড়ে যাচ্ছে।’
‘চুপ বে!’ সঞ্জয়কে ধমকে দুটো কাঠের টেবিল জুড়ে ক্যাডাভার রাখার ব্যবস্থা করে সুরজ। নিজের টাকা পকেটে ভরে কালুয়া বলে, ‘এন্ট্রি ভালোয় ভালোয় হল। এক্সিটও তাই হলে ভালো হয়। হেডু হারামি আছে।’
‘শোন বে!’ কালুয়াকে বলে সুরজ, ‘সকাল ছ’টা নাগাদ অন্য একটা ভ্যানওয়ালাকে পাঠিয়ে দিবি। এক ভ্যানওয়ালাকে দিয়ে দুবার কাজ করালে লোকটা গেস করবে যে কিছু ঘাপলা আছে। নতুন ভ্যানওয়ালাকে বলবি সুইপার ঢোকার গেটের বাইরে ভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখতে। ওইখান দিয়ে তুই ঢুকে আমার ঘর থেকে বডি নিয়ে যাবি। আমি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করব না। রাতে বডি দেখা হয়ে গেলে কাগজ চাপা দিয়ে রাখব। অ্যানেক্স ব্লকের সবাই রাতজাগা পার্টি। সকাল ছ’টায় কেউ ঘুম থেকে উঠবে না।’
প্ল্যান ফুলপ্রূফ হলেও ঘেঁটে গেল তিনটে কারণে। এক নম্বর কারণ, হাতে কাঁচা টাকা পেয়ে কালুয়া বেশি মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে আটটায়। দু’নম্বর কারণ, হাতের কাছে নতুন বডি পেয়ে সুরজ আর সঞ্জয় মিলে উইনডো ডিসেকশান আর স্ট্রাকচার আইডেন্টিফিকেশান প্র্যাকটিস করল রাত দুটো পর্যন্ত। মোবাইলের অ্যালার্ম দুজনেরই ঘুম ভাঙাতে পারেনি। তাদেরও ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে আটটায়। তিন নম্বর কারণ, কালুয়ার মোবাইলের ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠে সুরজের পাগল পাগল অবস্থা। চান করবে, খাবে, জামাকাপড় পরবে? না কি ক্যাডাভার পরীক্ষা হলে পাঠাবে? কালুয়াকে ফোন করলে বলছে, ‘মোবাইল ইজ সুইচড অফ।’ নতুন ভ্যানওয়ালা সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে পিছনের গেটে দাঁড়িয়ে। সে রেগেমেগে চলে যাচ্ছিল। একশো টাকা দিয়ে সুরজ ম্যানেজ করল। লোকটা সুরজের অনুরোধে ক্যাডাভার ভ্যানে তুলে নিয়েছে। কিন্তু অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে বডি নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গাঁইগুঁই করছে। বলছে, ‘কোথায় যেতে হবে জানি না। ওখানে কেউ না থাকলে আমাকে মড়া নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে। আমার সঙ্গে একজন লোক দিন।’
এই সময়ে সুরজের মাথায় দময়ন্তীর নাম ঝিলিক দেয়। তাদের ব্যাচে এই একটাই মেয়ে আছে, যে তাকে দেখলে কুঁকড়ে যায়। প্যান্ট-শার্ট গলাতে গলাতে দময়ন্তীকে ফোন করে সুরজ।
‘বল।’ ওদিক থেকে বলে দময়ন্তী।
‘তুই এখন কোথায়?’
‘পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। কেন?’
‘অ্যানাটমি বিল্ডিং-এর সামনে?’
‘হ্যাঁ। কেন?’
‘ভ্যানরিক্সায় চড়ে একটা ক্যাডাভার ডিসেকশান হলের দিকে যাচ্ছে। কালুয়াকে ডেকে বডিটা হলে ঢুকিয়ে নে।’ ভ্যানওয়ালার পিঠে চাপড় মেরে অ্যানাটমি বিল্ডিং-এর দিকে ইশারা করে সুরজ। ‘ভ্যানওয়ালাকে পঞ্চাশ টাকা বখশিস দিয়ে ফুটিয়ে দিস। ওকে কেউ যেন জিজ্ঞাসা করতে না পারে যে বডিটা কোথা থেকে নিয়ে এল।’
‘এই তো! আমাদের ক্যাডাভার এসে গেছে!’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে ফোন কেটে দেয় দময়ন্তী।
মহা হারামি মেয়েছেলে তো! এইরকম ভাইটাল টাইমে ফোন কাটছে। আবার ফোন করে সুরজ। ওপ্রান্তে এখন নানারকম চিৎকার চ্যাঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। ক্যাডাভার অলরেডি পৌছে গেছে কি? রিস্ক না নিয়ে সুরজ বলে, ‘আমার নাম যদি বলিস, তা হলে লাশ ফেলে দেব। কোনও মাই কা লাল কিছু করতে পারবে না। কিপ ইট ইন মাইন্ড।’
ভাইভা টেবিলে এনজির শক্ত শক্ত প্রশ্নের উত্তর না দিতে পেরে হতাশ লাগছিল দময়ন্তীর। সে বুঝতে পারছিল অ্যানাটমিতে সাপ্লি নাচছে। কিন্তু আশায় মরে চাষা। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিল, প্রিপারেশান ভালোই আছে। পরের টেবিলের উত্তর ঠিক দিলে ঝাড় নামাতে পারবে না। সো, চিন আপ! স্পাইন স্ট্রেট! গিভ ইট আ শট!
একের পর এক টেবিলে ভাইভা দিতে দিতে দময়ন্তী বুঝতে পারছিল, ভালো প্রিপারেশন বলে কিছু হয় না। পাস বা ফেল নির্ভর করে এক্সামিনারের ইচ্ছের ওপরে।
এনজি খুব রেলিশ করে পরীক্ষা নিলেন। ভিসেরাতে দিলেন ব্রেন। অস্টিওলজিতে ভার্টিব্রা বা কশেরুকা। দু’জায়গার থেকেই ব্রেনের অ্যানাটমিতে ঢুকে গেলেন। উইনডোতে দময়ন্তীর ভাগে পড়ল ‘কিডনি ফ্রম ব্যাক’। মোটামুটি উতরে দিল। স্ট্রাকচার আইডেন্টিফিকেশানে ‘অ্যান্টিরিয়ার ট্র্যাঙ্গেল অব দ্য নেক’ থেকে ক্যারডিট আর্টারি দিলেন এনজি। তারপর ব্রেনের ব্লাড সাপ্লাইতে চলে গেলেন।
সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম, ব্রেন, স্পাইনাল কর্ড—এই সব জায়গা এমন অতল সমুদ্র, যেখানে সাঁতার শিখে লাভ হয় না। সারফেস মার্কিং-এ যখন তার কপালে জুটল ট্রাইজেমিনাল নার্ভ, তখন দময়ন্তী ফেল করার ব্যাপারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর।
হোস্টেল ফিরে পড়তে বসেনি দময়ন্তী। স্নান করে গা থেকে ফর্মালডিহাইডের গন্ধ তুলেছে। যদিও সে জানে, তিনমাস বাদে সাপ্লি পরীক্ষার আগে আবার তাকে ক্যাডাভার আর বোন সেট, গ্রে আর ডক্টর মিত্র, কানিংহ্যাম আর গ্রে-জ অ্যানাটমি নিয়ে রাতের পর রাত জাগতে হবে।
কাপ্রি আর টি-শার্ট পরে, গায়ে গন্ধ ছড়িয়ে বৃন্দাকে দময়ন্তী বলল, ‘কী খাবি?’
বৃন্দা ফিজিওলজির বই নামিয়ে ফেলেছে। অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল, ‘খিদে নেই।’
একটা অ্যালোপাম জিভের তলায় রেখে দময়ন্তী বলল, ‘আমারও নেই।’
ফিজিওলজি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা চমৎকার উতরে দিল দময়ন্তী। ভাইভায় পিএম-এর শক্ত প্রশ্নের হেলায় উত্তর দিল। এবারে বায়োকেমেস্ট্রি প্র্যাকটিকাল। তা হলেই দিন কয়েকের জন্য ছুটি।
বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের দিন সন্ধেবেলা দাঁড়ে বসে একা একা চা খাচ্ছিল দময়ন্তী। রিভিশন মোটামুটি শেষ। কঠিন দুটো চ্যাপ্টারে একবার চোখ বোলাবে। এ ছাড়া কিছু পড়ার নেই। বৃন্দাকে ডেকেছিল চা খেতে। সে আসেনি। মোবাইলে মায়ের সঙ্গে গপপো করছে।
‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম!’ দময়ন্তীর পাশে বসে ঘোষণা করল বিলু। ‘পরের লাইন বল।’
‘দেরে দেরে দেরে।’ জবাব দেয় দময়ন্তী।
চা-ওয়ালা বলে, ‘এত তাড়া দিলে হবে না। দুমিনিট ওয়েট করতে হবে। আরও খদ্দের আছে।’
বিলু হ্যাহ্যা করে হাসতে হাসতে বলল, ‘সুকুমার রায় আজও কত প্রাসঙ্গিক দেখেছিস?’
‘আগামিকাল বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল। তুমি এখন পাগলা দাশুর মতো বিহ্যাভ কোরো না তো!’
‘বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষায় পাস করাটা কোনও ব্যাপার না। আরতী ম্যাডামকে খুশি রাখিস। তাহলেই পাস।’
‘এএমকে খুশি রাখা কি চাট্টিখানি কথা? তার তো কথায় কথায় মুড সুইং হয়।’
‘ও সব বাদ দে। অ্যানাটমি পরীক্ষার দিন কী একটা বাওয়াল হয়েছে শুনলাম।’
‘তোমায় কে বলল?’ চমকে উঠে দময়ন্তী।
‘বেফালতু চাপ নিস না তো!’ বিরক্ত হয়ে বিলু বলে, ‘তোদের ব্যাচের সুরজ হারামিটাকে দেখলেই তুই ট্যান খাস। ঠিক কি না?’
‘হ্যাঁ।’ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় দময়ন্তী, ‘আমি হয়তো এনজিকে নামটা বলে দিতাম। কিন্তু অন্য একটা কথা ভেবে বললাম না। বিগার পিকচারটা দেখতে পাচ্ছ?’
‘খুব ভালো পাচ্ছি। সুরজ ন্যাবাপার্টির সেক্রেটারি। মোচাপার্টির গাম্বাটগুলো ছাড়া বাকি সবাই বুঝতে পারছে, যে আগামী বিধানসভা ইলেকশানে জনমোর্চার সরকার পড়বে। সন্দীপ সামন্তর বদলে মৃন্ময় চ্যাটার্জি মুখ্যমন্ত্রী হবেন। কলেজে মোচাপার্টির ছাত্র সংগঠন থাকবে কি না সন্দেহ। ফিউচার লিডারকে তুই চটাতে চাইছিস না।’
‘জলের মতো এক্সপ্লেন করলে। তুমিই বলো, এই পরিস্থিতিতে আমি অন্য কী করতে পারতাম?’
‘জানি না…’ পরপর তিনটে ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলে বিলু, ‘কোন পরিস্থিতিতে কে কী করবে, সেটা ডিপেন্ড করে তার ব্যক্তিত্বের ওপরে। ব্যক্তিত্ব শব্দটা ভেগু-ভেগু। তোর আপ বিংগ্রিং, তোর মরাল ফাইবার, তোর কনসায়েন্স-সব মিলিয়ে ওটা তৈরি হয়। আমি এই পরিস্থিতিতে পড়লে এনজিকে বলে দিতাম যে সুরজ আমাকে থ্রেট করছে।’
‘ভেগু-ভেগু কথা তুমি বললে। সুরজ তোমাকে মলেস্ট করেনি, তাই তুমি কখনও আমার অবস্থান বুঝতে পারবে না। ফিজিকালি এবং মেন্টালি অ্যাসল্টেড হওয়া কাকে বলে তুমি কোনওদিনও জানতে পারবে না। অন্তত এই জন্মে না।’
‘ঠিক।’ পোড়া ফিল্টার টুসকি মেরে ফেলে বিলু বলে, ‘মোচাপার্টি দেখলি, ন্যাবাপার্টিও দেখলি। একবার আমাদের দলের অন্দরটা দেখবি না কি?’
‘প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম? পিএমএফ?’ চায়ের ভাঁড় ফেলে দিয়ে দময়ন্তী বলে, ‘পলিটিক্স ইজ দ্য লাস্ট রেসর্ট অব স্কাউন্ড্রেলস। আমি আর যাই হোই না কেন, স্কাউন্ড্রেল নই। সরি বিলুদা, রাজনীতি আমার জন্য নয়।’
‘আমাকে তোর স্কাউন্ড্রেল মনে হয়?’ চায়ের দাম মিটিয়ে জানতে চায় বিলু।
‘অন্য সময়ে হয় না। যখন রাজনীতির কথা বলো তখন মনে হয়।’
‘ঠিক হ্যায়।’ শ্রাগ করে বিলু, ‘কাল পরীক্ষার পরে কী প্রোগ্রাম?’
‘বাড়ি যাব। এখান থেকে দশ পা দূরে বাড়ি। পরীক্ষার চক্করে এক হপ্তা যাওয়া হয়নি।’
‘আমি তোর জন্য ওয়েট করব। রোম্যানো স্যান্টোসে পেটপুজো করে তোকে ছেড়ে দেব।’
‘তুমি খাওয়াবে না আমি?’
‘লেটস গো ডাচ।’
‘ওলন্দাজগিরি ফলিও না। তুমি নেমন্তন্ন করেছ, তুমি খাওয়াবে। তা না হলে আমি জাস্ট নেই।’
‘আচ্ছা। তাই হবে।’ হতাশ হয়ে আবার শ্রাগ করে বিলু।
‘কী ব্যাপার বলো তো? যা বলছি তাতেই রাজি হয়ে যাচ্ছ? প্রোপোজ করবে নাকি?’ রহস্যময় গলায় জানতে চায় দময়ন্তী। ‘তা হলে কিন্তু লাল গোলাপ, হার্ট শেপেড বেলুন, চকোলেট, টেডি বিয়ার—এইসবও চাই।’
‘ফোট শালা!’ দময়ন্তীকে চাঁটি মারে বিলু। ‘হোস্টেলে গিয়ে পড়াশুনা কর। কাল পাঁচটা নাগাদ ফোন করব।’
বায়োকেমেস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল নিয়ে কারো কোনও টেনশান নেই। হোস্টেলে ফিরে দময়ন্তী দেখল জেমসি, সাবিনা আর শ্রীপর্ণা মিলে সিঁড়িতে বসে অন্ত্যাক্ষরী খেলছে। তাদের পাশ কাটিয়ে দোতলায় উঠল দময়ন্তী। তেরো নম্বর রুমে ঢুকে দেখল, বৃন্দা এখনও মোবাইলে গুজগুজ করছে।
‘ওরে, এতক্ষণ মোবাইলে কথা বলার বদলে মাথাটা পরমাণু চুল্লিতে ঢুকিয়ে বসে থাক। আরও সহজে ব্রেন ক্যানসার হবে।’
‘ব্রেন টিউমারের সঙ্গে মোবাইলের বিকিরণের সম্পর্কটা বিজ্ঞানীদের অনুমান। এস্ট্যাব্লিশড কোনও ফ্যাক্ট নয়।’ ফোন কেটে বলে বৃন্দা। ‘কার্বোহাইড্রেট পড়া কমপ্লিট? কাল আরতী ম্যাডাম কিন্তু ক্রেবস সাইকল ধরবেনই।’
‘কথা ঘোরাস না। এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলি?’ বৃন্দাকে চেপে ধরে দময়ন্তী।
‘অভি।’ ফোন রেখে বলে বৃন্দা।
‘অভি? এত ছেলে থাকতে অভিজ্ঞান?’ মুখ ব্যাঁকায় দময়ন্তী। ‘টিপিক্যাল বয় নেক্সট ডোর চেহারা। কোনও হট হাংক পেলি না? টল, ডার্ক, হ্যান্ডসাম…’
‘পেয়েছিলাম। সুরজ। তবে শুনেছি ছোকরা সুবিধের নয়।’ টিপ্পনি কাটে বৃন্দা।
দময়ন্তী এই বিষয়ে আর একটাও কথা না বলে বায়োকেমিস্ট্রি বই খুলে পড়তে বসে যায়। বৃন্দা দময়ন্তীর বই বন্ধ করে বলে, ‘বই পড়ে কোনও লাভ নেই। আয়, আমরা হোয়াইট বোর্ডে ফেল্ট পেন দিয়ে বিভিন্ন সাইকলগুলো আঁকা প্র্যাকটিস করি।’
‘আচ্ছা।’ অনিচ্ছের সঙ্গে খাট থেকে উঠল দময়ন্তী।
বায়োকেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে দিতে দময়ন্তীর মনে হচ্ছে, গতকাল বৃন্দার ডিসিশান ঠিক ছিল। নানান শক্ত কেমিকাল রিঅ্যাকশান, ক্যাটাবলিজম, অ্যানাবলিজম, মেটাবলিজম, এনজাইম, ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাটের স্ট্রাকচার মনে রাখার একমাত্র উপায় প্র্যাকটিস। আঁকো এবং বলো। বলো এবং আঁকো।
প্রথমে প্র্যাকটিকাল, পরে ভাইভা। প্র্যাকটিকালে দময়ন্তীর পড়েছে প্রস্রাবের প্রোটিন নির্ণয়। সেটা করা খুব সোজা। অসুবিধে হবে ভাইভা নিয়ে। প্রোটিন থেকে অ্যামাইনো অ্যাসিডের ঠিকুজি-কুলুজিতে ঢুকে যাবেন পরীক্ষক। এএম-কে আসতে দেখে অ্যাপ্রনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়ায় দময়ন্তী।
‘কী ছিল তোমার?’
‘ডিটেকশান অব প্রোটিন ইন ইউরিন। এই যে!’ র্যাকে রাখা টেস্ট টিউব দেখায় দময়ন্তী।
‘ডিম সেদ্ধ!’ মুখ ব্যাঁকান এএম। ‘তুমি বরং আমাকে এসেনশিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিডের নামগুলো টপাটপ বলে ফেলো।’
চোখ বন্ধ করে দময়ন্তী উগরোতে থাকে।
পরবর্তী আধঘণ্টা দময়ন্তীর ওপরে অত্যাচার চালালেন এএম। প্রোটিন থেকে ডিএনএ এবং আরএনএ। তার থেকে জেনেটিকস। তার থেকে জেনেটিক ডিজিজ— সব জিজ্ঞাসা করলেন। ওয়াটসন ক্রিক মডেল পর্যন্ত দময়ন্তী উতরে দিয়েছিল। ডাউনস সিনড্রোম নিয়ে প্রশ্ন শুরু হতে তোতলাতে শুরু করল। তবে বুঝে গেল, পাস করে যাবে।
প্র্যাকটিকাল চুকল সাড়ে তিনটের সময়। লাফাতে লাফাতে হোস্টেলে ঢুকল দময়ন্তী। বাড়ি ফিরতে হবে।
পুরো লেডিজ হোস্টেল জুড়ে সাজো সাজো রব। ফার্স্ট ইয়ারের সমস্ত মেয়ে আজ বাড়ি ফিরবে। জেমসির দিল্লির ফ্লাইট সন্ধে সাড়ে সাতটায়। সে এর মধ্যে একটা ট্যাক্সি ডেকে ফেলেছে। সাবিনার নেপালের ফ্লাইট আটটার সময়। সে জেমসির সঙ্গে যাবে। শ্রীপর্ণার বাবা আর্মির লোক। তিনি ব্যারাকপুর থেকে জিপ নিয়ে চলে এসেছেন। বৃন্দার সুইফট ডিজায়ারও সুলতান সহ রেডি। লেডি আর্চার্স হোস্টেলের সামনে এখন অটোমোবাইল একজিবিশান চলছে।
দময়ন্তীর তাড়াহুড়ো নেই। তেরো নম্বর রুমে ঢুকে সে প্রথমে বিছানা পরিষ্কার করল। ফিজিওলজি আর বায়োকেমিস্ট্রি বইগুলো ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে ন্যাপথালিন ছড়িয়ে বন্ধ করল। অ্যানাটমি বইগুলো টেবিলেই রাখল। নিজেকে ধোঁকা দিয়ে কী লাভ? এক মাস পরেই আবার এদের নিয়ে বসতে হবে। ফর্মআলডিহাইডে চোবানো ভিসেরার বালতি আগেই কালুয়াকে ফেরত দেওয়া হয়ে গেছে। ঘরে তাও হালকা ফর্মআলডিহাইডের গন্ধ। ফুলমতিয়াকে ডেকে ফিনাইল দিয়ে ঘর মোছাল দময়ন্তী। ঝুল ঝাড়াল। সারা ঘরে হাড়গোড় ছড়িয়েছিল। সেগুলো প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঢুকিয়ে আলমারি বন্দী করল। নিজের আর বৃন্দার বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় বদলে ফ্রেশনার ছড়াল। জানলার পর্দা খুলে ফুলমতিয়াকে কাচতে দিল।
বৃন্দা স্নান করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে ঘরের চেহারা দেখে থ। অবাক হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার রে? এ যে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি! হঠাৎ ‘মার ঝাড়ু মার’ মোডে চলে গেলি কেন?’
‘আমরা সিনিয়ার হয়ে গেলাম। গ্র্যাভিটি বলে একটা কথা আছে তো!’ গম্ভীর গলায় বলে দময়ন্তী।
‘ফেল করি আর পাস করি, সিনিয়ার বলে কথা।’ দ্বিগুণ গম্ভীর গলায় দময়ন্তীকে নকল করে বৃন্দা। তার কথায় ধ্বস খেয়ে দময়ন্তী বলে, ‘অ্যানাটমিতে ঝাড়টা সিওর হয়ে গেল। আবার ওইসব পড়তে হবে ভেবেই কান্না পাচ্ছে।’
‘রেজাল্ট না বেরোনো পর্যন্ত তুই ফেল করিসনি।’ নিজের বইপত্র আর হাড়গোড় ট্রাঙ্কে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে বৃন্দা, ‘বাড়ি গেলে কাকু-কাকিমা যখন জিজ্ঞাসা করবেন, ”পরীক্ষা কেমন হয়েছে?” বলবি, ”ভালো হয়েছে।” কেন বল তো?’
‘কেন?’ জানতে চায় দময়ন্তী।
ন্যাপস্যাক কাঁধে তুলে বৃন্দা বলে, ‘আমির খান কোন একটা সিনেমায় ডায়ালগ দিয়েছিল, ‘এক্সাম আচ্ছা ইয়া বুরা নহি হোতা হ্যায়। রেজাল্ট আচ্ছা ইয়া বুরা হোতা হ্যায়।’ আমি কাটছি। তোকে ড্রপ করে দেব নাকি?’
বৃন্দার রসিকতায় মুচকি হাসল দময়ন্তী। বলল, ‘নাঃ! আমি একটু পরে বেরোব। তুই যা।’
‘ওকে বেবি! বাই!’ হাত নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বৃন্দা। দময়ন্তী মোবাইলে সময় দেখে। পৌনে পাঁচটা বাজে। পাঁচটায় বিলুর ফোন করার কথা। কী বলবে কে জানে!
বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে দময়ন্তী। ফার্স্ট ইয়ারের সবাই হোস্টেলে থেকে চলে গেছে। বিকেলবেলা স্নান করার জন্য কোনও লাইন নেই। দীর্ঘক্ষণ স্নানের বিলাসিতা দেখানো যেতেই পারে। স্নান সেরে রুমে ফিরে আবার মোবাইলে সময় দেখল দময়ন্তী। পাঁচটা দশ। বিলুর দুটো মিসড কল রয়েছে। ওয়েট করুক!
ভেবেচিন্তে পোশাক বাছল দময়ন্তী। কালো জিনস। গোলাপি টি-শার্ট। টি-শার্টে চে গেভারার মুখ আঁকা। চুলে পনিটেল করে, পায়ে গোলাপি-কালো রঙা কনভার্স শু গলিয়ে, গায়ে ডিও ছড়িয়ে ব্যাকপ্যাক তুলে নিল। ব্যাকপ্যাক বেশ ভারী। এতে একগাদা নোংরা কাপড়জামা আছে। বাড়ি গিয়ে কাচতে হবে।
লেডি আর্চার্স হোস্টেল থেকে বেরোতে না বেরোতে আবার বিলুর ফোন। ‘তুই কোথায়? আমরা রোম্যানো স্যান্টোসে অপেক্ষা করছি।’
‘আমরা?’ বিরক্ত হল দময়ন্তী। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রতিপ্রশ্ন করল, ‘আমরা মানে কারা? তোমার প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরামের লোকজন?’
‘হ্যাঁ।’ অম্লানবদনে বলে বিলু, ‘সব্যসাচীদা আছে। আর একজন আছেন। তুই চিনিস না। তাড়াতাড়ি আয়। ওঁকে দূরে ফিরতে হবে।’
‘না এলে?’ বিরক্ত হয়ে বলে দময়ন্তী। পলিটিক্স করা ছেলেগুলো সত্যিই খুব ঘাগু হয়।’
‘না এলে অ্যানাটমিতে ঝাড় খাওয়াটা সিওর।’
‘আর এলে?’
‘ফিফটি—ফিফটি। তোর হয়ে মুভ করার জন্য কাউকে পাশে পাচ্ছিস। ভেবে দেখ।’
‘আমি আসছি।’ ফোন কাটে দময়ন্তী। অ্যানাটমি বই না ছোঁওয়ার জন্য সে নরকে যেতেও প্রস্তুত। আর এ তো সামান্য পলিটিকস।
রোম্যানো স্যান্টোস ঢুকে দময়ন্তী দেখল, কোণের টেবিলে বসে বিলু, সব্যসাচী আর মাঝবয়সি একটা লোক দুটো স্যুপ নিয়ে তিনজনে মিলে ভাগ করে খাচ্ছে। লোকটার পোশাক-আসাক, হাবভাব বলে দিচ্ছে এ কলকাতা শহরের বাসিন্দা নয়। দময়ন্তী ফাঁকা চেয়ারে বসতে বিলু বলল, ‘আলাপ করিয়ে দিই, ইনি গোপাল নস্কর। আমাদের পার্টির স্টেট কমিটির সেক্রেটারি। অনেক দূর থেকে এসেছেন। গোপালদা, এ হল দময়ন্তী সেনগুপ্ত আর্চার। আমাদের কলেজের মেয়ে। সদ্য ফার্স্ট এমবি দিল। ওকে নিয়েই ঘটনাটা ঘটেছিল।’
গোপালকে নমষ্কার করে দময়ন্তী বিলুকে বলল, ‘তোমাদের পার্টি মানে কী? তোমরা তো পিএমএফ-এর সদস্য।’
‘ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি,’ কথা বলার দায়িত্ব নিয়েছে সব্যসাচী, ‘গণ সংগঠন এবং পার্টি সংগঠন—দুটো আলাদা জিনিস। রাজনৈতিক দলের নাম ”নবযুগ পার্টি”। তাদের ছাত্র সংগঠনের নাম ”নবযুগ ছাত্র সংগঠন”। যাদের তোরা ”ন্যাবা” বলিস। পার্টির নাম ”জনমোর্চা”। ছাত্র সংগঠনের নাম ”ছাত্রমোর্চা”। যাদের তোরা ”মোচা” বলিস। জাতীয়তাবাদী পার্টির ছাত্র সংগঠনের নাম ”ছাত্রদল”। যাদের ”ছেঁদো” বলা হয়। ঠিক তেমনই মেডিক্যাল ফ্রন্টে আমাদের গণসংগঠনের নাম ‘প্রোগ্রেসিভ মেডিক্যাল ফোরাম’ বা ”পিএমএফ”। কিন্তু মাদার পার্টির নাম ‘ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি’ বা ”আইপিপি”।’
ওয়েটার স্যুপের বোল দিয়ে গেছে। তাতে নুন ঢালতে ঢালতে দময়ন্তী বলল, ‘আমাকে এইসব বলে হেজিও না। আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। অ্যানাটমিতে পাস করা নিয়ে কী বলছিলে বলো।’
দময়ন্তীর হাত থেকে নুনদানি নিয়ে বিলু বলে, ‘ওরেব্বাস! নুনদানিটা হেবি দেখতে! স্ট্যাচু অব লিবার্টির মিনি সংস্করণ! মশাল থেকে নুন পড়ছে।’
সব্যসাচী বলল, ‘ইউএসএ। হোয়্যার লিবার্টি ইজ আ স্ট্যাচু।’
‘নিকোনার পাররার কবিতা,’ স্যুপে চুমুক দিয়ে বলে দময়ন্তী। বিলু আর গোপাল মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। সব্যসাচী বলে, ‘তোর কী মনে হয়, ইন্ডিয়া একটা লিবারাল দেশ?’
‘ওয়েল…’ ভুরু কুঁচকে ভাবে দময়ন্তী, ‘লিবারাল’ শব্দটা এসেছে ল্যাটিন ”লিবার” থেকে। যার মানে ”ফ্রি”। আমরা প্রায়ই বলি, ভারতবর্ষ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। অ্যাতো বড় গণতন্ত্রে ফ্রি স্পেসের জায়গা আছে কিনা, এই নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
”কেন? শুরুটা তো ভালোই হয়েছিল।’ দময়ন্তীকে উশকে দেয় সব্যসাচী, ‘সংবিধানের প্রণেতা বি আর আম্বেদকার লিবারাল ছিলেন, স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল সি রাজা গোপালাচারি লিবারাল ছিলেন, প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু লিবারাল ছিলেন। এইসব এলিটিস্ট নেতারা ফ্রি ইন্ডিয়া নিয়ে ভাবেননি?’
‘ওইটাই তো বিপদ। ওই এলিটিজিম। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ, স্বাধীন চিন্তার আসল মানেটা ওপর থেকে নিচুতলায় আসেনি। এলিট থেকে আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে যায়নি। তুমি আমাকে ‘বুর্জোয়া লিবারাল’ বললে আমি তোমাকে ‘আর্মচেয়ার মার্কসিস্ট’ বলতে পারি। তুমি আমাকে ‘সিউডো সেকুলার’ বললে আমি তোমাকে ‘রিলিজিয়াস ফ্যানাটিক’ বলতে পারি। শব্দের বিরুদ্ধে শব্দ চলুক। কিন্তু গায়ের জোর নয়। লিগাল রাইটস কেড়ে নেওয়া নয়। জেলে ঢোকানো নয়। রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা নয়। তাহলে আর লিবার্টি থাকে না।’
‘আমাদের ‘ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি’ একটি নিষিদ্ধ দল। বর্তমান সরকার একে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করেছে।’ শান্তভাবে বলেন গোপাল। ‘আমরা কোনও লোককে খুন করিনি, রাষ্ট্রবিরোধী কোনও কথা বলি না। তাও।’
‘কেন?’ অবাক হয়ে বলে দময়ন্তী।
‘জনমোর্চা সরকার হেলথ হাব তৈরির জন্য এক হাজার একর জমি এক সাহেবকে বিনি পয়সায় দান করছে। ওই জমিতে আটশোটি পরিবারের দু’হাজার বাসিন্দা থাকে। কোনও পুনর্বাসন ছাড়া সব জমি সরকার নিয়ে নিয়েছে। আমি নিজে ওই এলাকায় থাকি। আমিও বাস্তুচ্যুত হতে চলেছি। ইন্ডিয়ান পিপলস পার্টি এর বিরোধিতা করেছে। অর্থাৎ আমরা সরকারের বিরোধিতা করেছি। তাই আমরা রাষ্ট্রদ্রোহী।’
ওয়েটার চিকেন ড্রামস্টিক দিয়ে গেছে। সেদিকে হাত না বাড়িয়ে দময়ন্তী বলল, ‘আপনারা মিডিয়ার কাছে যাচ্ছেন না কেন?’
‘গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা সাহেবের তৈরি হেলথ হাবের খবরে বেশি ইন্টারেস্টেড। গরিব মানুষরা হেডলাইন হলে কাগজের বিক্রি কমে যাবে।’
গোপাল নস্করকে এতক্ষণ মূর্খ এবং গ্রাম্য বলে মনে হচ্ছিল দময়ন্তীর। ধারণা বদলাল। স্যুপ শেষ করে সে বলল, ‘আমাকে এখানে ডেকে এনে মগজ ধোলাই করার কারণ কী? আমি আদ্যন্ত অ্যাপলিটিক্যাল পার্সন। কলেজে ঢুকেছি ডাক্তারি পড়তে। রাজনীতি আমার কাপ অফ টি নয়।’
‘তোর টি-শার্টে যে লোকটার ছবি আঁকা আছে, সেও ডাক্তার ছিল। স্টেথোস্কোপ না বন্দুক—কোনটা হাতে নেবে, এইরকম একটা ক্রুশিয়াল মোমেন্ট তার জীবনে এসেছিল। লোকটা বন্দুক তুলে নিয়েছিল।’ সব্যসাচী কঠিন মুখে দময়ন্তীকে বলে।
‘কথায় কথায় চে-কে টেনে আনা আমার পছন্দ নয়।’ সব্যসাচীকে দাবড়ে দেয় দময়ন্তী, ‘প্রত্যেকটা মানুষের জীবন আলাদা। বাই দ্য ওয়ে, অ্যানাটমিতে আমাকে কীভাবে পাস করাবে?’
‘তোমাকে চে হতে বলছি না,’ সব্যসাচীকে থামিয়ে গোপাল বলেন, ‘আমাদের গ্রামে প্রতি রোববার একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প হয়। তোমার তো পরীক্ষা শেষ। পরশু আসতে পারবে?’
‘যেতে পারি। তবে বিলুদা আগে বলুক, আমাকে অ্যানাটমিতে পাস করানোর জন্য ও কী করছে।’ দময়ন্তী নাছোড়বান্দা। সে বিলুর দিকে একবারও তাকায়নি।
‘আমি এনজিকে অলরেডি বলে দিয়েছি, তোকে কে ফাঁসিয়েছিল। এবং ক্যাডাভার কে হোস্টেলে নিয়ে গিয়েছিল। এনজি সিমপ্যাথেটিক।’ মিনমিন করে বিলু।
দময়ন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এর ফলে তার কলেজের বাকি দিনগুলো ঝামেলাদার হয়ে উঠল। এটা কেন বিলু বুঝল না? সত্যি, স্কাউন্ড্রেলরাই রাজনীতি করে। টেবিল ছেড়ে ওঠার আগে সে গোপালকে বলল, ‘আপনার ফোন নাম্বার দিন। আগামিকাল বলে দেব, রোববার যাব কি না।’
গোপাল ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, ‘এলে রাত্তিরে আমার বাড়ি থেকে যেয়ো। গ্রামে কখনও থেকেছ?’
‘না।’ ঘাড় নাড়ে দময়ন্তী, ‘আপনার গ্রামের নাম কী?’
‘বাঁজাপলাশ। এই গ্রামটা নতুনগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের আন্ডারে।’
গ্রামের নামটা দময়ন্তীর মাথায় ছোটছোট বৃত্ত তুলে হারিয়ে গেল। দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগোল সে।