চন্দন
সকাল থেকে এটা তেইশ নম্বর। সিগারেট ধরিয়ে সময় দেখল চন্দন। রাত দশটা বাজে। অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাত উপলক্ষ্যে চন্দন দুটো প্রতিজ্ঞা করেছিল। এক নম্বর, সারা দিনে কুড়িটার বেশি সিগারেট খাবে না। দু’নম্বর, রাত এগারোটার মধ্যে শুয়ে পড়বে। কোনও প্রতিজ্ঞাই রাখা যাচ্ছে না। ভিসেরা রিভিসন করা পুরো বাকি। আজ শুতে রাত দুটো বাজবে।
বায়োকেমিস্ট্রির রিটেন পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত শুক্রবার। ছাব্বিশে অগাস্ট। শনি-রবি ছুটির পরে, আগামিকাল সোমবার, ঊনত্রিশে অগাস্ট অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল।
থিয়োরি পরীক্ষা চন্দনের ভালো হয়েছে। সব সাবজেক্টেই অনেক নম্বর পাবে। গোল্ড মেডেল পাওয়াও অসম্ভব নয়।
এইসব হাই-ফাই চিন্তা শনিবার সন্ধে পর্যন্ত মাথায় ছিল। অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার জন্য পড়তে বসে সোনার মেডেলের ভাবনা মাথা থেকে জাস্ট উড়ে গেছে। পাগল হয়ে যাওয়ার আগের ধাপে দাঁড়িয়ে রয়েছে চন্দন সহ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কলেজের দেড়শোজন পরীক্ষার্থী।
অ্যানাটমি প্র্যাকটিকালের পাঁচটা ধাপ। প্রথম পর্ব অস্টিওলজি বা অস্থিবিদ্যা। এই পর্বে পরীক্ষক মানব শরীরের দুশো ছ’খানা হাড় টেবিল সাজিয়ে বসে থাকবেন। লম্বা একটা লাঠি টেবিলের ওপরে নাচাতে নাচাতে কোনও একটা অস্থি ছুঁইয়ে বলবেন, ‘এইটা নাও।’
সেই হাড় তুলে নিয়ে পরীক্ষার্থীকে ঠিকঠাক ভাবে ধরতে হবে। ঠিকঠাক ভাবে মানে, মানব শরীরে হাড়টি যেভাবে থাকে। ভুল ভাবে ধরলে একজামিনার বলবেন, ‘রেখে দাও।’ এবং আর কোনও প্রশ্ন না করে অস্টিওলজিতে শূন্য দেবেন। হাড় ঠিক ভাবে ধরলে শুরু হবে প্রশ্নবাণ।
ভিসেরা টেবিলে শরীরের সমস্ত আভ্যন্তরীন অঙ্গ সাজিয়ে বসে রয়েছেন পরের পরীক্ষক। একই কায়দায় ছড়ি ঘুরিয়ে তিনি বলবেন, ‘ওইটা ধরো।’ ব্রেন, হার্ট, লাং, লিভার, কিডনি, পুরুষ বা নারীর যৌনাঙ্গ—যা খুশি হতে পারে। ঠিক ভাবে ধরতে পারলে শুরু হবে প্রশ্নমালা। গোটা পনেরো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে পাস। না পারলে, সাপ্লিতে দেখা হবে!
এর পরে আসবে উইনডো ডিসেকশান, স্ট্রাকচার আইডেন্টিফিকেশান, সারফেস মার্কিং।
দেড়শোজনের পরীক্ষা শুরু হয়ে সকাল ন’টায়। শেষ হতে রাত ন’টা বেজে যায়। মধ্যেখানে টিফিন পর্বের জন্য আধঘণ্টার ছুটি। যদিও, পরীক্ষাপর্ব চোকানোর জন্য পরীক্ষার্থীরা এত উদগ্রীব থাকে যে খাওয়াদাওয়া ভুলে যায়।
তেইশ নম্বর সিগারেট থেকে চব্বিশ নম্বরটা ধরাল চন্দন। প্রবাল ফর্মালডিহাইড ভরতি বালতি থেকে হার্ট বার করে বলল, ‘এইটা দিয়ে শুরু করি?’
‘কর শালা!’ এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল চন্দন।
ভিসেরা রিভাইস করা শেষ হল রাত সাড়ে বারোটায়। দরজার বাইরে রিপু সুর করে আওয়াজ ছাড়ছে, ‘টেনশান চাই? টেনশান? তিন টাকা কিলো!’ একটু থেমে থেমে, হোস্টেল কাঁপিয়ে। যেভাবে চৌকিদাররা আগেকার দিনে হাঁফ পাড়ত, ‘হুঁশিয়ার!’ বার তিনেক চেঁচানোর পরে হোস্টেলের সমস্ত রুমের দরজা খুলে গেল। প্রতিটি তলার প্রতিটি ঘর থেকে টেনশান-বিক্রেতার উদ্দেশে বাছাবাছা খিস্তি বর্ষিত হল। বাপ, মা, মাসি, বোন, ঊর্ধ্ব ও অধস্তন চোদ্দগুষ্টিকে লক্ষ্য করে বলা গালাগাল শুনে একলাফে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রিপু বলল, ‘নাঃ! সবাই ঠিকঠাক পড়াশুনা করছে। না হলে এত কুইক রেসপন্ড করত না।’
প্রবাল ভিসেরার বালতি খাটের তলায় ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘সারা হোস্টেলের খিস্তি না শুনলে তোমার চলছিল না?’
রিপু মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘ভিসেরা পর্ব শেষ? তাহলে বালতিটা করিডোরে রেখে আয়। আর ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দে। চোখ জ্বালা করছে। এই শালা চন্দন! খেয়েছিস?’
‘না! সারফেস মার্কিং শেষ করে খেতে যাব।’ ডক্টর মিত্রর বই ওল্টাতে ওল্টাতে বলে চন্দন।
‘মারব পিছনে তিন লাথ!’ চন্দনের হাত থেকে বই কেড়ে নিয়ে রিপু বলে, ‘রাত সাড়ে বারোটার সময়েও না খেলে আর কখন খেতে যাবি? মেসের লোকগুলোও তো মানুষ, না কি?’
‘হ্যাঁ। ঠিক। কিন্তু…’ আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে চন্দন বলে।
‘এটা আজকের কত নম্বর?’ উপচানো অ্যাশট্রের দিকে তাকিয়ে রিপু প্রশ্ন করে।
‘একত্রিশ,’ টেবিলে রাখা তিনটে শূন্য ও একটি সদ্য খোলা সিগারেটের প্যাকেট দেখিয়ে বলে চন্দন।
‘ফোট শালা।’ টেবিল থেকে চারটে সিগারেটের প্যাকেট জানলা দিয়ে ফেলে দেয় রিপু। খাট জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অ্যানাটমির সমস্ত বই বন্ধ করে বলে, ‘সোজা খেতে যা। পনেরো মিনিটের মধ্যে খেয়ে এসে একটা অ্যালোপাম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। কাল আটটার সময় ঘুম থেকে উঠে পৌনে নটা পর্যন্ত সারফেস মার্কিং পড়বি। ইটস অ্যান অর্ডার।’
‘শেষ হবে না। ঝাড় খেয়ে যাব।’ থমথমে গলায় বলে চন্দন।
‘অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাতে জাগলে এমনিই ঝাড় খাবি। তার জন্য পরিশ্রম করতে হবে না। যা বলেছি শোন,’ চন্দনকে আবার ধমকায় রিপু। প্রবালকে বলে, ‘তুই আজ এ ঘরে শুয়ে যা। আমি একশো চব্বিশে শুচ্ছি। দেখি, অভি একা ও ঘরে কোন ড্রামা করছে।’
‘শালা! ফার্স্ট ইয়ারের স্নেহময় বাবা এলেন রে!’ রিপুকে আওয়াজ দেয় চন্দন।
‘আমাদের ব্যাচের একটা ছেলে অ্যানাটমি প্র্যাকটিকালের আগের রাতে গলায় দড়ি দিয়ে সুইসাইড করেছিল। আজ রাতে বাবা হওয়া ছাড়া উপায় নেই। শুধু আমি নই। সব সিনিয়ররাই আজ ফার্স্ট ইয়ারের বাবা। তাড়াতাড়ি খেয়ে আয়।’ নরম গলায় বলে রিপু। চন্দন বিছানা থেকে উঠে প্রবালকে বলে, ‘চল। খেয়ে আসি।’
প্রবাল বলল, ‘গা গুলোচ্ছে,’ তারপর বিকট জোরে ওয়াক তুলল। চন্দন অবাক হয়ে বলল, ‘কী হল রে?’ তারপর নিজে আরও জোরে ওয়াক তুলে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোরের পাঁচিলে হড়হড় করে বমি করল। রিপু একশো চব্বিশে ঢুকতে যাচ্ছিল। থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘একত্রিশটা সিগারেটের ধোঁয়া এবার পেছন দিয়ে বেরোবে। যা, তাড়াতাড়ি খেয়ে আয়।’
‘বমি করে শরীরটা ঠান্ডা হল,’ ভিজে চোখে বলল চন্দন, ‘অ্যালোপাম কোথায় রেখেছ?’
ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও ঘুম ভেঙে গেল সকাল সাতটায়। মাথা ভার। পেট ব্যথা। গা গুলোচ্ছে। টেনশানের চোটে জ্বর এসে গেছে। এই অবস্থায় পরীক্ষা দেবে কী করে? বিছানায় শুয়ে ঠিক আধমিনিট ভাবল চন্দন। তারপর তড়াক করে উঠে পড়ল। শরীর খারাপ তাড়ানোর উপায় সে ছকে ফেলেছে।
দাঁত মাজা, দাড়ি কামানো, বড় বাইরে এবং স্নান মিলিটারি দ্রুততায় শেষ করল। ভিজে গামছা পরে রুমে ঢুকে প্রবালকে ঘুম থেকে তুলল। সে ব্যাটা কিছুক্ষণ উঁ-আঁ করতে করতে আড়মোড়া ভালো। তারপর স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে বিছানা থেকে উঠে বলল, ‘সারফেস মার্কিং?’
প্রবালকে পাত্তা দিল না চন্দন। জামা-প্যান্ট-জুতো পরে রেডি হয়ে মেসে গেল। সকালে উৎপলদা লুচি আর আলুর তরকারি করেছে। দুর্ভাবনা মাথা থেকে তাড়িয়ে পনেরোটা লুচি খেল। তার ব্যাচের অন্যরা দুটো লুচিও খাচ্ছে না। সকলেই ওয়াক তুলছে। পেট ভরতি জলখাবার খেয়ে চারটে রসগোল্লা নিল চন্দন। টপাটপ মুখে পুরে এক বোতল জল খেল। আহঃ! শান্তি।
সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় উঠতে উঠতে সে খেয়াল করল, পেট ব্যথা আর গা গুলানো ভাব একদম চলে গেছে। জ্বোরো ভাব আর মাথাব্যথা অল্প হলেও আছে। একশো পঁচিশে ঢুকে নিজের ব্যাগ হাঁটকে একটা অ্যান্টাসিড আর একটা ব্যথার বড়ি বার করে টপাং করে মুখে ভরল। প্রবাল এর মধ্যে স্নান করে রেডি। সে বলল, ‘চল, শুরু করি।’ চন্দন বলল, ‘আগে খেয়ে আয়।’
পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রবাল ব্রেকফাস্ট করে ফিরে এল। পঁচিশটা সারফেস মার্কিং-এর মধ্যে দশটা চন্দন বেছে রেখেছে। এই দশটা প্র্যাকটিস করতে ন’টা বেজে যাবে। বাকি পনেরোটা রিভাইস করা হবে না। কিছু করার নেই। আড়চোখে ঘড়ি দেখল সে। সাতটা পঁয়তাল্লিশ।
দশটা সারফেস মার্কিং রিভিশন করে আবার ঘড়ি দেখল চন্দন। আটটা পঁয়তাল্লিশ। পনেরো মিনিট সময় আছে। আরও পাঁচটা বেছে নিল। ঝড়ের গতিতে শুরু হল রিভিশন। চারটে শেষ হয়েছে, এমন সময় দরজায় ঠকঠক। বাইরে থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় অভি বলছে, ‘পৌনে ন’টা বাজে।’
দড়াম করে চৌরাসিয়ার বই বন্ধ করল চন্দন। প্রবালকে বলল, ‘আমি চললাম।’
‘আর পড়বি না? হোম সেন্টারে পরীক্ষা। পনেরো মিনিট আগে বেরোনোর কী আছে?’ অবাক হয়ে বলে প্রবাল।
‘আর পড়ব না। সাপ্লি না পেলে বাকি জীবনে অ্যানাটমি বইও ছোঁব না।’ বইয়ের বান্ডিল টেবিলে সাজিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায় চন্দন।
ব্যাগে পরীক্ষা সংক্রান্ত হাবিজাবির পাশাপাশি এক লিটারি বোতলে ওআরএস আর গ্লুকোজ গোলা এনার্জি ড্রিঙ্ক রাখা রয়েছে। সেটায় চুমুক দিতে দিতে চন্দন দেখল, বৃন্দা আর দময়ন্তী আসছে। পরীক্ষা হোক বা সুনামি, মেয়েদের সাজগোজে কখনওই ভাঁটা পড়ে না। আজ দু’জনে বরং একটু বেশিই সেজেছে। চন্দন দময়ন্তীকে প্রশ্ন করল, ‘এত সাজগোজ? ফ্যাশান শো আছে নাকি?’
‘আছে,’ দময়ন্তীর হয়ে বৃন্দা জবাব দেয়। ‘ভাইভায় কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে, মেঝেতে রুমাল ফেলে দিয়ে রুমাল তোলার অজুহাতে বুক দেখাতে হবে না? আমরা দুজনেই পুশআপ ব্রা পরে এসেছি।’
‘ভ্যাট!’ লজ্জা লজ্জা মুখে পরীক্ষা হলে ঢোকে চন্দন।
ডিসেকশানে রুমে শ্রাদ্ধবাড়ির পরিবেশ। একদিকে পরপর পাতা বেঞ্চিতে ছেলেমেয়েরা বসে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে প্রত্যেকের বাবা-মা মারা গেছেন। ডিসেকশান রুম জুড়ে, দূরে দূরে তিনটে টেবিল পাতা আছে। শ্রাদ্ধবাড়ির কায়দায় টেবিলের ওপরে সাদা কাপড় পাতা। প্রথম টেবিলে একগাদা হাড় রাখা। দ্বিতীয় টেবিলের পাশে বালতিতে রাখা ফর্মালডিহাইডে চোবানো ভিসেরা। তৃতীয় টেবিলে একগাদা কার্ড রাখা। রুমের অন্য প্রান্তে পাঁচটা ডিসেকশান টেবিল। তার ওপরে চারটি সদ্য ব্যবচ্ছেদ করা মৃতদেহ রাখা। দুটি পুরুষ ও দুটি মহিলা। পঞ্চম টেবিলটি খালি। খালি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে এনজি কালুয়াকে নিচু গলায় ধমক দিচ্ছেন। পরীক্ষার টেনশান ভুলে চন্দন কান পাতল।
‘ক্যাডাভার কোথায় গেল?’ গলা না তুলে কালুয়াকে প্রশ্ন করছেন এনজি।
‘জানি না স্যার।’
‘আবার মিথ্যে কথা? গতকাল রাতে কতজন স্টুডেন্ট ক্যাডাভার দেখতে এসেছিল?’
‘কেউ আসেনি স্যার।’
‘মারব গালে তিন থাপ্পড়। উইনডো কার্ড আর বডি দেখানোর জন্য স্টুডেন্ট পিছু কত টাকা নিয়েছিস? এক কথায় উত্তর দে। না হলে আমি এন্টালি থানায় খবর দেব।’
‘থানার ভয় দেখাবেন না স্যার। পুলিশরা ডোমেদেরও ভয় পায়। বেশি ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই করলে দু-চারটে পচা লাশ থানার সামনে রেখে আসব। বদবু-র চোটে পুলিশের বাচ্চারা আবার মায়ের পেটে ঢুকে যাবে।’
‘ঠিক আছে। পুলিশের ভয় দেখাচ্ছি না। কাঁটাপুকুর মর্গে কতগুলো নতুন ছেলে ক্যাডাভার নিয়ে কাজ করছে। অ্যানাটমিও ভালো শিখেছে। কম্পিউটার চালাতে জানে। সুপারইনটেনডেন্ট ডক্টর রেবতী পট্টনায়েককে বলে ওদের এই কলেজের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে নিয়ে আসি?’
যে কালুয়া পুলিশকে ভয় পায় না, সে অন্য ডোমের কথা শুনে হাতজোড় করে এনজিকে বলল, ‘পেটে লাথি মারবেন না স্যার। যা জিজ্ঞেস করবেন বলে দেব।’
‘কাল আর পরশু রাত মিলিয়ে কজনকে বডি দেখিয়েছিস?’
‘একশো তিরিশ জন।’
‘প্রত্যেকের কাছে কত করে নিয়েছিস?’
‘পার হেড একশো স্যার।’
চন্দন শুনে চমকে উঠল। অ্যানাটমি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের রাতে ক্যাডাভার দেখা খুব পুরনো প্র্যাকটিস। পড়াশুনোয় ভালো ছেলেমেয়েরাও এই চক্কর থেকে বেরোতে পারে না। সাপ্লি পাবে নিশ্চিত, অথবা পাস করার ব্যাপারে সুপার কনফিডেন্ট—দুই দলই একবার মড়া ছুঁয়ে যায়। গত দু’দিনে কালুয়ার নিট ইনকাম তেরো হাজার টাকা। চন্দন অবশ্য আসেনি। রিপু বারণ করেছিল। বলেছিল, ‘ফালতু লফড়ায় যাসনি। সময় নষ্ট। ঘরে বসে গাঁতিয়ে মুখস্থ কর।’
‘বডি দেখতে দেওয়া এক জিনিস আর আস্ত বডি বাইরে পাঠানো অন্য জিনিস। এই ক্যাডাভারটা কে নিয়ে গেছে?’
‘কেউ নেয়নি স্যার।’
‘আস্ত একটা মড়া হাঁটতে হাঁটতে ডিসেকশান রুম থেকে বেরিয়ে গেল? ইয়ার্কি হচ্ছে?’ এনজির গর্জনের মধ্যে ডিসেকশান হলের বাইরে দময়ন্তীর চিৎকার শোনা গেল, ‘এই তো! আমাদের ক্যাডাভার এসে গেছে!’
এনজি আর কালুয়া দৌড়ে ডিসেকশান হল থেকে বেরোল। দেখল দরজার সামনে একটা তিনচাকার ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার ওপরে খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া একটা লাশ। ভ্যানওয়ালা বলছে, ‘কে তুলবে গো? আমাকে আবার যেতে হবে। শেয়ালদা স্টেশানে ট্রেনে কাটা পড়া দুটো বডি আছে।’
কালুয়া একলাফে এসে ক্যাডাভারটা চ্যাংদোলা করে তুলে ডিসেকশান হলে ঢুকে গেল। এনজি এতক্ষণ এইসব কারবার দেখছিলেন। এইবার দময়ন্তীকে প্রশ্ন করলেন, ‘এটা কোথা থেকে এল?’
উত্তর দেওয়ার আগে দময়ন্তীর মোবাইল বেজে উঠল। এনজির পিছনে দাঁড়িয়ে চন্দন খেয়াল করল, ফোনকর্তার নাম দেখে দময়ন্তীর মুখচোখ কুঁচকে গেছে। অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে ফোন ধরল সে। ওদিক থেকে কী কথা দময়ন্তীর কানে ঢুকছে, চন্দন শুনতে পেল না। তবে দময়ন্তীর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তার কানে গরম সিসে ঢালা হচ্ছে। এনজিকে টপকে দময়ন্তীর কাছে এসে চন্দন বলল, ‘কী হয়েছে রে? কে ফোন করেছে?’
‘তুমি ভেতরে যাও। তোমাকে পাকামো করতে হবে না।’ চন্দনকে ধমক দিলেন এনজি। চন্দন দময়ন্তীর পাশ থেকে নড়ল না। মেয়েটা ভয়ংকর আপসেট হয়ে পড়েছে। চোখমুখ থেকে আতঙ্ক ঠিকরে বেরোচ্ছে।
এনজি দময়ন্তীকে প্রশ্ন করলেন, ‘বডিটা কাগজচাপা দেওয়া ছিল। তা সত্ত্বেও তুমি কী করে জানলে, ওটা বেওয়ারিশ লাশ নয়, পরীক্ষার ক্যাডাভার?’
দময়ন্তী চুপ।
‘তুমিই কি ক্যাডাভারটা গত সন্ধ্যায় ডিসেকশান রুম থেকে হোস্টেলে নিয়ে গিয়েছিলে? কালুয়া এর জন্য কত টাকা নিয়েছে?’
‘না স্যার। আমি এসব করিনি। আমি সন্ধেবেলা ক্যাডাভার দেখতেও আসিনি। কালুয়াকে কোনও টাকাও দিইনি।’ আঁতকে উঠে বলে দময়ন্তী।
‘তাহলে তুমি কী করে জানলে যে এটা ক্যাডাভার? কে তোমাকে ফোন করেছিল?’ এনজি চিৎকার করে উঠলেন।
এনজির জেরার সামনে দময়ন্তী থরথর করে কাঁপছে। এনজি পিছন ফিরে কালুয়াকে বললেন, ‘তুই বলবি না? কাকে বডি সাপ্লাই করেছিলি?’
‘না স্যার।’ সোজা উত্তর কালুয়ার। ‘পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে, এটা বলে দিলাম। কিন্তু স্টুডেন্টের নাম বলতে পারব না। বাওয়াল হয়ে যাবে।’
‘তুমিও বলবে না?’ সামনের দিকে ফিরে দময়ন্তীকে প্রশ্ন করলেন এনজি।
‘না স্যার,’ দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে দময়ন্তী বলে, ‘অসুবিধে আছে।’
‘ওকে! পরীক্ষা শুরু হোক।’ শ্রাগ করে ভিতরে ঢুকে গেলেন এনজি। চন্দনের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে হেসে দময়ন্তী বলল, ‘অ্যানাটমির সাপ্লিটা কনফার্মড হল।’
‘চল। ভিতরে চল।’ দময়ন্তীর হাত ধরে ডিসেকশান হলে ঢোকে চন্দন। এতক্ষণের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে সে ভুলে গিয়েছিল যে আগামী দশ-বারো ঘণ্টা প্রবল টেনশানের মধ্যে কাটবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে হানড্রেড পার্সেন্ট পারদর্শীতা দেখাতে হবে। মনে মনে নিজেকে বিচার করে চন্দন। জ্বরজ্বর ভাব, মাথা ভার, পেট ব্যথা, গা গুলানো—কিছুই আর নেই। এক চুমুকে হাফ বোতল এনার্জি ড্রিংক শেষ করে সে বেঞ্চিতে বসল। এনজি এবার নাম ডাকবেন।
পরীক্ষা শুরু হতেই টেনশান কমে গেল। এনজি যখন ডাকলেন, ‘চন্দন সরকার অ্যান্ড বৃন্দা ব্যানার্জি,’ তখন কোনও অনুভূতি হল না। কোনওরকমে পা টানতে টানতে প্রথম টেবিলে পৌঁছল।
সময় সংক্ষিপ্ত করার জন্য একজামিনাররা দু’জনের পরীক্ষা একসঙ্গে নিচ্ছেন। তা বলে প্রশ্ন কমন পড়ার কোনও আশা নেই। বরং বিপদ অনেক বেশি। যেমন শুরুতেই হল। অস্টিওলজির টেবিলে এনজি বললেন, ‘হাড় তোমরা বেছে নাও।’
বৃন্দা চন্দনের দিকে তাকাল। চন্দন বৃন্দার দিকে। কে কোনটা ভালো পড়েছে, কে কোনটায় দুর্বল—ধারণা নেই। বৃন্দা হালকা হেসে পেলভিক গার্ডল তুলে নিল।
পেলভিক গার্ডল অর্থাৎ শ্রোণীচক্র। খুবই কঠিন এবং দুরূহ এলাকা। চন্দন মনে মনে বৃন্দার চয়েসের প্রশংসা করল। এটা কোনওরকমে উতরে দিতে পারলে বাকি পরীক্ষায় এই এলাকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকবে না।
পেলভিক গার্ডল বৃন্দা অ্যানাটমিকাল পোজিশানে ধরে আছে। এনজি চন্দনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঠিক ধরেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আইলিয়াক ক্রেস্ট কোনটা?’
চন্দন দেখাল।
‘গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাসের অরিজিন, ইনসারশান, নার্ভ সাপ্লাই এবং ফাংশান বলো।’
চন্দন বলল। এনজি বললেন, ‘এবার তুমি ধরো।’ চন্দন বৃন্দার হাত থেকে পেলভিক গার্ডল নিজের হাতে নিল। এনজি বৃন্দাকে বললেন, ‘পুডেনডাল নার্ভের ব্রাঞ্চ এবং সাপ্লাই বলো।’ বৃন্দা নিখুঁত উত্তর দিল। প্রশ্নোত্তরের খেলায় আলোচনাটা পেনিসে এসে পৌঁছেছে। এনজি বৃন্দাকে প্রশ্ন করলেন, ‘পেনিসের লেংথ বলো।’
‘ফ্ল্যাসিড অবস্থায় দশ ইঞ্চি আর ইরেকটেড অবস্থায় পনেরো ইঞ্চি।’ হাসি মুখে উত্তর দিল বৃন্দা।
টেবিলের তলা দিয়ে চন্দন বৃন্দার থাইয়ে চিমটি কাটার চেষ্টা করল। মেয়েটা সেন্টিমিটার আর ইঞ্চি গুলিয়ে ফেলে কেলেঙ্কারিয়াস জবাব দিয়েছে!
বৃন্দার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে এনজি বললেন, ‘আমি ঘোড়ার পেনিসের লেংথ জিজ্ঞাসা করিনি। মানুষের পেনিসের লেংথ জিজ্ঞাসা করেছি।’
বৃন্দা অবাক হয়ে চন্দনের দিকে তাকাল। সে এখনও নিজের ভুল বুঝতে পারেনি। চন্দনের পেট ফেটে হাসি আসছে। হাসি চেপে কোনওরকমে বলল, ‘তুই মেজারিং ইউনিট ভুল বলেছিস। ওটা ইঞ্চি নয়। সেন্টিমিটার হবে।’
‘ও মাই গড!’ লজ্জায় দু’হাতের মধ্যে মুখ লুকোয় বৃন্দা। এনজি বলেন, ‘নেক্সট টেবিলে যাও।’ চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে চন্দন বুঝতে পারে, বৃন্দার লালচে গাল দেখে তার লিঙ্গোত্থান হচ্ছে! সেন্টিমিটার বদলে যাচ্ছে ইঞ্চিতে!
পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা ঘোরের মধ্যে কাটল। একের পর এক টেবিল, নতুন একজামিনার, নতুন প্রশ্নের সেট, নতুন উত্তরমালা… মেশিনের মতো পরীক্ষা দিল চন্দন।
শেষতম টেবিল সারফেস মার্কিং। আবার চন্দন আর বৃন্দার কম্বিনেশান। বৃন্দা চন্দনকে বলল, ‘ঝাড় খাওয়াবে না তো?’ চন্দন বলল, ‘পেনিসের লেংথ সেন্টিমিটারের বদলে ইঞ্চিতে বলার জন্য যদি এনজি যদি তোকে ঝাড় দেয়, তাহলে ঘোড়ার পেনিস এনজির পিছনে ঢোকাব!’
‘চুপ কর! এনজি আসছে। আমাদের শেষ পরীক্ষাটাও এনজিই নেবেন।’
এনজি ফিরে এসে টেবিলে বিছানো কার্ডের দিকে দেখিয়ে চন্দনকে বললেন, ‘তোলো।’ চন্দন ভয়ে ভয়ে কার্ড তুলল। আজ সকালে রিভিশন না করা কোনও স্ট্রাকচার যদি আঁকতে দেয়? দম আটকে কার্ড ওল্টাল সে। আর্টারিয়া ডরসালিস পিডিস। যাক! কমন পড়েছে। অ্যানাটমি পরীক্ষাটা ভালোয় ভালোয় উতরে গেল তাহলে।
‘কে আঁকবে?’ প্রশ্ন করলেন এনজি।
‘আমি।’ জবাব দিল বৃন্দা।
‘আঁকো। আমি ততক্ষণে চন্দনের ভাইভা নিয়ে নিই।’ পড়া ধরা শুরু করলেন এনজি।
কাঁটায় কাঁটায় সন্ধে সাড়ে সাতটায়, পাঁচ মিনিটের ওরাল পরীক্ষার পরে চন্দন বুঝতে পারল, সে পরীক্ষায় পাস করে গেছে। শুধু তাই নয়, হয়তো ভালো নম্বরও পেয়েছে। ডিসেকশান হল থেকে বৃন্দাকে নিয়ে বেরোতে বেরোতে খেয়াল করল, এখনও পনেরো জনের পরীক্ষা চলছে। তাদের মধ্যে দময়ন্তী আছে। ভিসেরা টেবিলে দময়ন্তীকে ব্রেন ধরিয়ে এনজি শক্ত শক্ত প্রশ্ন করছেন।
আপাতত ওসবে মন দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বৃন্দাকে চন্দন বলল, ‘তুই হোস্টেলে থাকবি না বাড়ি যাবি?’
‘হোস্টেলে থাকব। পরশু ফিজিওলজি প্র্যাকটিকাল। এখন কেউ বাড়ি যায়?’
‘তা ঠিক। চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’ প্রস্তাব দেয় চন্দন। শুনে হালকা হেসে বৃন্দা বলে, ‘তার কোনও দরকার নেই। তুই ড্যাম টায়ার্ড। হোস্টেলে গিয়ে রেস্ট নে।’
মাথা চুলকোয় চন্দন। সিগারেট ধরায়। স্যামি ব্যানার্জির মেয়েকে এত সহজে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। নতুনগ্রাম থেকে অনেক লড়াই করে কলকাতা শহরে এসেছে। বনগ্রামের শেয়ালরাজা কলকাতা শহরে আপাতত চুনোপুঁটি। চুনোপুঁটি স্ট্যাটাসকে রাঘব বোয়ালে বদলাতে গেলে শুধু পড়াশুনো দিয়ে হবে না। একটু ঠেকনা চাই। একটু ব্যাকিং। স্যামি ব্যানার্জির মেয়ে সোশ্যাল ক্লাইম্বিং-এর জন্য আইডিয়াল। মইয়ের প্রথম ধাপ।
শাহরুখ খানের কায়দায় বাঁহাত দিয়ে চুল ঠিক করে চন্দন বলে, ‘তোর কোনও দরকার না থাকতে পারে। কিন্তু আমার আছে।’
‘রিয়্যালি?’ খিলখিলিয়ে হাসছে বৃন্দা। ‘তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে প্রোপোজ করবি। সেইরকম কোনও ছক নেই তো?’
হুশহুশ করে ধোঁয়া ছেড়ে চন্দন বলে, ‘যদি থাকে?’
‘থাকলে সেটা কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে দে।’
চন্দন আর পারল না। বৃন্দার হাত চেপে ধরে বলল, ‘ক্যান্টিনে আপ্পুদির র্যাগিং-এর হাত থেকে যেদিন তুই আমায় বাঁচিয়েছিলি…’
‘কর্ন জোহরের সিনেমার ডায়ালগ দিস না চন্দন। হোস্টেলে যা। হাত ছাড়।’
‘ছাড়ব না। আজ একটা হেস্তনেস্ত জবাব চাই। না হলে হোস্টেলে গিয়ে পড়ায় মন বসবে না।’ বৃন্দার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে চন্দন।
বৃন্দা ঘুরে দাঁড়ায়। তার চোখে ধকধক করছে রাগ। ঠোঁটের কোণে ঝিকমিক করছে হাসি। ক্যাজুয়ালি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলল, ‘অনেকরকম জবাব হয়। যেমন, ”আমায় ভুলে যা চন্দন। আমি তোর যোগ্য নই। তোর জন্যে অনেক ভালো ভালো মেয়ে অপেক্ষা করে আছে।” অথবা, ”আমি তোকে ঠিক ওইভাবে দেখি না রে চন্দন! উই আর জাস্ট গুড ফ্রেন্ডস।” অথবা, ”আমার একটা শারীরিক সমস্যা আছে। আমাকে ভালোবেসে তুই কোনওদিন সুখী হবি না”। অথবা, ”আমি একজনকে ভালোবাসি রে!” কোন উত্তরটা শুনতে চাস বল।’
‘সত্যিটা।’
‘বেশ। শোন তাহলে।’ গভীর শ্বাস ছেড়ে বৃন্দা বলে, ‘আমি অভিকে ভালোবাসি।’
চন্দন কিছুক্ষণ বৃন্দার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠোঁটের ফাঁক থেকে পোড়া ফিল্টার নিয়ে রাস্তায় ফেলে বুট দিয়ে মাড়ায়। অবশেষে বলে, ‘বুঝলাম। চল তোকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। এটাতে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবি না?’
‘নাঃ!’ শ্রাগ করে এগোয় বৃন্দা। তার পাশে চন্দন।