গুমরাহীর অন্ধকারায়
বিশ্বনবীর নবুয়ত প্রাপ্তির পাঁচ-সাত বছর আগের কথা।
ওকাযের বৃহৎ প্রান্তর জুড়ে মেলা বসেছে। বাৎসরিক মেলা। প্রতি বছরেই হজের পূর্বে এ মেলা বসে, আর আরব দেশের সব অংশ থেকেই লোকেরা জমায়েত হয়। মক্কার বাসিন্দারাই ভীড় জমায় বেশি। সারি সারি তাঁবু বসে যায়। সারা মেলা জুড়ে বিক্রয়-সম্ভার থরে থরে সাজানো। এসব পণ্য হেজাযেরই নয়, শাম ও য়েমন দেশেরও পণ্য এসেছে অজস্র ভারে। মেয়ে-পুরুষ দল বেঁধে পণ্য দেখছে, কিনছে। মেয়েদের ভীড়ই এসব জায়গায় বেশি।
মেলার এক বিশেষ প্রান্তে জমেছে কুস্তিগীরদের আখড়া। সেখানে আরবী সব কবিলার সেরা কুস্তিগীরের বিচিত্র সমাবেশ। আর রয়েছে প্রত্যেক কবিলার নামজাদা কবি, যিনি নিজ কবিলার মহিমা ও কুস্তিগীরের বাহাদুরীর বয়ান শুনিয়ে যাচ্ছেন সোচ্চার কণ্ঠে।
একদিন এই আখড়ায় এক কবিলার কবিবর উচ্চ কণ্ঠে গেয়ে চলেছেন নিজ কবিলার মহিমা, প্রিয় কুস্তিগীরের শক্তির বড়াই। শ্রোতারা ঘন ঘন বাহবা দিয়ে পরিবেশটি মুখরিত করে তুলছে। কিন্তু কেউ জওয়াব দিতে সাহস পাচ্ছে না।
এক কোণে বসেছিল এক তরুণ যুবা। বয়স্যদের নিয়ে কবির কীর্তন উপভোগ করছিল রহস্যভরে। আর মাঝে মাঝে উচ্চহাসি তুলে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। সহসা উঠে দাঁড়ালো যুবক। তার দীর্ঘ শরীর, শালপ্রাংশু বাহু ও কঠোর মুখভঙ্গি সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যুবক সামনে অগ্রসর হয়ে কবির কীর্তিত কুস্তিগীরকে আহ্বান করলো শক্তির পরীক্ষায়। নির্ভয়ে, দাম্ভিক কণ্ঠে।
এক নিমেষে চিনলো সবাই যুবাকে। এ যে খাত্তাব-নন্দন ওমর। সকলেরই অতিচেনা।
বিদ্যুৎগতিতে খবর ছড়িয়ে গেল সারা মেলায়। যে যেখানে ছিল, ছুটে এসে ভীড় জমালো আখড়ার চারিদিকে। ছেলে, মেয়ে, যুবা, বুড়া সকলেই রুদ্ধ নিশ্বাসে লক্ষ্য করতে লাগলো, মল্লযুদ্ধের ফলাফল।
ওমর সুযোগ দিলেন প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রথমে আক্রমণ করতে। সে বুক ফুলিয়ে আস্ফালন করে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওমরের উপর। বেদুইন নওজওয়ানের আক্রমণ নীরবে প্রতিহত করে ওমর কৌশলে তার কাঁধের উপর সওয়ার হলেন এবং এক নিমেষে ভূপাতিত করে তার বুকের উপর বসে গেলেন কঠিন অনড় পাহাড়ের মতো। বেদুইন নওজওয়ান নিশ্বাস নিতে অক্ষম হয়ে ওমরের নিকট প্রাণ ভিক্ষা করলো। তিনি হাসিমুখে তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। জয়ধ্বনির উচ্চস্বরে চারিদিক ভরে গেল।
তার তিন দিন পরের ঘটনা।
ওকাযের মেলা শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু শেষ পর্বের আর একটি প্রধান ঘটনা ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা। প্রত্যেক কবিলার সেরা ঘোড়সওয়াররা আপন আপন দ্রুতগামী তাজীর পিঠে প্রতিযোগিতার মাঠে প্রস্তুত। খাত্তাবনন্দন ওমরও প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। তাঁর কালোবরণ সুন্দর তাজীই সবচেয়ে প্রধান আকর্ষণ। সঙ্কেত মাত্রেই প্রতিযোগীরা বায়ুবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। অসংখ্য ঘোড়ার মধ্যেও ওমরের তাজী ছুটে চলেছে সকলের শিরোভাগে। ওমরকে অশ্বপৃষ্ঠে বিন্দুবৎ দেখা যাচ্ছে। সকলে জয়ধ্বনি তুলে উঠলো ওমরের নামে। তিনি সব প্রতিযোগীকে বহু বহু দূরে ফেলে জয়ী হয়েছেন। আবার খাত্তাব-নন্দন জয়ের শিরোপা লাভ করে ধন্য হলেন।
এই ছিল খাত্তাব-নন্দন ওমরের প্রাক্-ইসলাম যুগের পরিচয়।
ওমরের জন্ম-সন নিয়ে বহু মতভেদ আছে। তবে একটি প্রামাণ্য হাদিস মোতাবেক ওমরের জন্ম হয় ক্রান্তিকালীন ঘটনা রসূলে-আকরমের হিজরতের চল্লিশ বছর পূর্বে। হিজরত অনুষ্ঠিত হয় ৬২২ খ্রিস্টাব্দে এবং এ হিসেবে ওমরের জন্ম-সন হয় ৫৮১-৫৮২ খ্রিস্টাব্দে। আর এ হিসেবে ওমর রসূলে আকরমের চেয়ে বারো বছরের ছোট। আমর-বিন-আসের একটি উক্তি-মতে একদিন তিনি কয়েকজন বন্ধুসহ খাত্তাবের গৃহে আনন্দ-উৎসবে মত্ত ছিলেন, এমন সময় আনন্দধ্বনি উঠে। খবর হয় যে, খাত্তাবের একটি পুত্র-সন্তান জন্ম লাভ করেছে। এ থেকে অনুমিত হয়, ওমরের জন্মকালে মহোৎসব হয়েছিল।
ওমরের পিতামহের নাম নুফায়েল-ইবনে-আবদুল-উজ্জা। আদি হলো তাঁর আদিপুরুষ এবং আদির অন্য ভাই মরাহ্ ছিলেন রসূলে আকরমের পূর্বপুরুষ। এ-হিসেবে অষ্টম পুরুষে রসূলে-আকরম ও ওমরের পূর্বপুরুষ এক হয়ে যান।
নুফায়েল ছিলেন কুলপঞ্জী-বিশারদ। তাঁর কুলজী-প্রজ্ঞা ও তীক্ষ্ণ বিচারশক্তি ছিল সর্বজনবিদিত। এজন্যে কোরায়েশ-কুলের শ্রেষ্ঠ বিচারকের মর্যাদায় নুফায়েল ছিলেন অভিষিক্ত। একবার রসূলে আকরমের পিতামহ আবদুল মোত্তালিব ও হারাব-ইবনে-ওমাইয়ার মধ্যে গোত্রের নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধ উপস্থিত হলে নুফায়েল আবদুল মোত্তালিবের পক্ষে রায় দিয়ে হারাবকে উপদেশ দিয়েছিলেন: কেন তুমি এমন লোকের সঙ্গে কলহ করছো, যে তোমার চেয়ে দীর্ঘদেহী, ব্যক্তিত্বশালী, তোমার চেয়েও মার্জিতরুচি ও জ্ঞানী এবং যার বংশধর তোমার চেয়েও সংখ্যায় অধিক ও যার মহানুভবতা তোমার সর্বজনবিদিত? এসব বলে আমি অবশ্য তোমার উচ্চ গুণাবলীর অবজ্ঞা করছি না, কারণ আমিও তোমার গুণগ্রাহী। তুমি মেষের ন্যায় নিরীহ, সারা আরবে তুমি উচ্চ কণ্ঠের জন্য সুবিদিত এবং নিজ গোত্রের একটি শক্তিস্তম্ভ।
ওমরের মাতার নাম খাতামাহ্ ও মাতামহের নাম হিশাম। হিশামের পিতা মুগিরাহ্ ছিলেন বিরাট ব্যক্তিত্বশালী পুরুষ এবং যখনই কোরায়েশকুল অন্য গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতো, তখনই সেনানায়কের পদ (সাহিব-উল-আইননাহ্) ছিল মুগিরা জন্যে অবিসংবাদিত অবধারিত।
কিশোরকালে ওমর উটের রাখালী করেছেন। চারণবৃত্তি আরবে হেয় ছিল না, জাতীয় বৃত্তি হিসেবে মর্যাদাসিক্ত ছিল। স্বয়ং রসূলে-আকরমও কিশোর বয়সে মেষচারণ করেছিলেন। জীবনের কঠোর ও মহান শিক্ষা লাভ হতো চারণভূমিতে। উষর মরুপ্রান্তরে অবাধ্য উটশ্রেণীর দীর্ঘদিন রাখালী করে ওমরের স্বভাবও হয়ে গিয়েছিল অনেকখানি রুক্ষ ও কঠোর। তার উপর খাত্তাব ছিলেন বেশ উগ্র ও নির্দয় প্রকৃতির। দাজনানের বিশাল প্রান্তরে খররৌদ্রে দীর্ঘদিন উট চারণকালে কিশোর ওমর ক্লান্ত হয়ে যদি একটু বিশ্রাম সুখ ভোগ করতেন, তখন খাত্তাব তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করতেন। দাজনান প্রান্তরে তিক্ত স্মৃতি ওমরের মনে বরাবর জাগরুক ছিল। পরবর্তী জীবনে খলিফা পদাভিষিক্ত হয়ে ওমর একবার দাজনান অতিক্রম করছিলেন। তখন পূর্বস্মৃতিতে সহসা উদ্বেলিত হয়ে তিনি বলেছিলেন: ‘আল্লাহর অশেষ করুণা। এমন একদিন ছিল, যখন একটা সামান্য পশমী জামা গায়ে আমি এই মাঠে উটের রাখালী করতাম, আর যখনই শ্রান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতাম, তখনই পিতা নির্দয়ভাবে প্রহার করতেন। এখন এমন দিন এসেছে, যখন আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ আমার উপরওয়ালা নেই।’
বাল্যে ওমর নিজের চেষ্টায় ও ঐকান্তিক আগ্রহে কিছু লেখাপড়াও শিখেছিলেন। বলা বাহুল্য, সে আমলে আরবে বিদ্যাশিক্ষার চর্চা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ এবং উচ্চ বংশজদের মধ্যেও বিদ্যাশিক্ষার চেয়ে শরীরচর্চা ও কুস্তিগিরী ছিল বেশি সম্মানার্হ। বালাজুরীর উক্তি-মতে নবী-করীমের সমকালীন মাত্র সতেরোজন সাক্ষর ছিলেন এবং ওমর তাঁদের অন্যতম। ওমরের অত্যন্ত ঝোঁক ছিল কবিতার দিকে এবং প্রায় সকল প্রতিষ্ঠাবান কবির বাছাই বাছাই কবিতা তাঁর কন্ঠস্থ ছিল। কবিতা মুখস্থ করায় তাঁর এমনই কৃতিত্ব ছিল যে, কোনও কবিতা একবার মাত্র পাঠেই বা শ্রবণেই সেটি কণ্ঠস্থ হয়ে যেত নির্ভুলভাবে। ওমরের হস্তলিপি ছিল সুন্দর এবং তার ভাষাজ্ঞানও ছিল উচ্চস্তরের। তাঁর বাক্শক্তি ছিলো প্রশংসনীয় ও চিত্তহারী এবং তার দরুন বহুবার তাঁকে মধ্য-যৌবনেই কোরায়েশকুলের পক্ষে দৌত্যকার্য করতে হয়েছে।
ওমর প্রথম যৌবনকালেই জীবিকার্থে ব্যবসায় শুরু করেন। সেকালে ব্যবসায় ছিল একটি লাভজনক ও সম্মানার্হ জীবিকা। স্বয়ং রসূলে আকরম কিছুকাল তেজারতীতে লিপ্ত ছিলেন। তেজারতীর কারণে ওমর সিরিয়া ও ইরাক-আযমে সফর করেছেন। সে সময় ওমর বহু গুণীজ্ঞানীর সাহচর্য লাভ করেছেন এবং বহু আরবী ও ইরানী শাসকের দরবারেও হাজির হয়েছেন। তার ফলে মানব-চরিত্রে ওমরের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে প্রচুরভাবে। পরবর্তী কর্মমুখর জীবনে এসব অভিজ্ঞতা ও ভূয়োদর্শিতার ফলশ্রুতি ছিল প্রচুরভাবেই। যথাস্থানে তার পরিচয় উন্মোচিত হবে।
একথা অনস্বীকার্য যে, ওমরের প্রাক্-ইসলাম যুগের জীবন ততো বিস্তৃত, ততো দীপ্তিময় ছিল না। এজন্যে তাঁর জীবনের প্রথমার্ধের বহুলাংশই অজ্ঞাত রয়ে গেছে। সমসাময়িক অন্যান্য কৃতী ও মহিমাসিক্ত ব্যক্তির উক্তির বা স্মৃতিচারণের বিন্দু বিন্দু আলোকপাতেই এই অনালোকিত অধ্যায়ের কিছু কিছু অংশ ভাস্বর হয়ে উঠেছে।