পরিচ্ছেদ জ : পত্র পাঁচ
শেঙান
১লা আষাঢ়
দুপুর রাত্তির
শ্রীচরণসরোজেষু!
সাহসিকাদি! বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে গেল। ঝড়-ঝঞ্ঝা যত বইবার, বয়ে গেল আমার জীবনের ওপর দিয়ে। কিন্তু বৃষ্টি আজও থামেনি। আজ পয়লা আষাঢ়। আমার জীবনের এ-আষাঢ় বুঝি আর ফুরোবে না। আশীর্বাদ করো দিদি, সত্যিই এ আষাঢ়ের যেন আর শেষ না হয়।
বিয়ের পর আর কাউকে চিঠি দিইনি। আমার এত শ্রদ্ধার মা, দাদাভাই রবিয়ল সাহেব, এত ভালবাসার ভাবিসাহেবা–সোফি–সকলের মাঝে যেন একটা মস্ত আড়াল পড়ে গেছে। আমি যেন কাউকেই আর ভাল করে দেখতে পাচ্ছিনে। সব মুখ যেন ঝাপসা হয়ে আসছে–আমার মনের মুকুরে দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়া লেগে! আজ আমার মনে হচ্ছে দিদি, যেন তুমি ছাড়া আর আমার আপনার বলতে কেউ নেই। শুধু তুমিই আমার মনে আজও ঝাপসা হয়ে ওঠনি। তাই আজ আমার মনের সকল দ্বন্দ্বগ্লানি কাটিয়ে উঠে তোমার পানে সহজ চোখে চাইতে পারছি। তাই আবার বলছি, সাহসিকাদি, আজ তুমিই,–একমাত্র তুমিই আমার গুরু, আমার বন্ধু, আমার সখী–সব আজ আমি মনের কথা যেন মন খুলে বলতে পারি তোমার কাছে। আজ যেন আমি আত্মপ্রবঞ্চনা না করি!
আর আপনাকে ফাঁকি দিতে পারিনি দিদি! আজ আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত মেঘের সাথে সাথে আমারও মন যেন ভেঙে পড়ছে! মনে হচ্ছে, মাটির মত করে আমায় কেউ চাক, আমিও আষাঢ় মেঘের মত নিঃশেষে নিজেকে ঝরিয়ে দিই তার বুকে। নিজেকে জমিয়ে জমিয়ে যে-ভার বিপুল করে তুলেছি নিজেরই জীবনে, আজ আমি মুক্তি চাই সে-ভার হতে। বিলিয়ে দেওযার সে-সাধনা কেমন করে আয়ত্ত করি বলে দিতে পার, দিদি?
এই তো দুটো চোখ, ক ফোঁটাই-বা জল ধরে ওতে! তবু মনে হচ্ছে আজ যেন আমি আষাঢ়ের মেঘকেও হার মানিয়ে দিতে পারি কেঁদে কেঁদে।
কত ঝঞ্ঝা, কত বজ্র, কত বিদ্যুতের পরিণতি এই বৃষ্টিধারা, এই চোখের জল!
তুমি হয়ত মনে করছ, আমি পাগল হয়েছি। তাও যদি হতে পারতাম তাহলে নিজেকে ভোলার একটু অবসর মিলত। অবসরের চেয়েও বড় কথা দিদি, এই স্ত্রী জাতির বড় কর্তব্যটা থেকে রেহাই মিলত একটু! তুমি হয়ত অসন্তুষ্ট হচ্ছ এইবার, কিন্তু দশ আঙুলের ক্ষুদ্র মুষ্টির চাপে এক মুঠো ফুলের দুর্দশা দেখেছ? শুকিয়ে মরতে আমি রাজি আছি দিদি, কিন্তু এমন করে কর্তব্যের মুঠিতলে পিষ্ট হয়ে মরে নাম কিনবার সাধ আমার নেই। নারীজীবনের ফুলহার নাকি বিধাতা প্রেমের গলায় দিবার জন্যই গেঁথেছিলেন, কবিরা তাই বলেন; কিন্তু তাকে মুঠি-তলে পিষবার আদেশ যে শাস্ত্রকার দিয়েছিলেন, তাঁকে যদি এই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মরবার সময় শ্রদ্ধা করতে না-ই পারি–সেটা কি এতই দোষের!
বাঁচবার সাধ আমার ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু এমন করে জাঁতা-পেষা হয়ে মরবার প্রবৃত্তিও নেই আমার। মরতেই যদি হয় দিদি, তাহলে সে-সময় কাছে আমার চাওয়ার ধনকে না-ই পাই, অন্তত আমার চারপাশের দুয়ার-জানালাগুলো যেন খোলা থাকে। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়ার মত বায়ুর যেন সেদিন অভাব না হয়, এই ধরণি-মা-র মুখের পানে চেয়ে প্রাণ ভরে কেঁদে নেওয়ার মত অবকাশ যেন সেদিন পাই দিদি, এইটুকু প্রার্থনা করো–শুধু আমার জন্যে নয়–আমারই মত বাংলার সকল কুলবধূর জন্য!
দেখেছ, নিজের দুঃখটাকে ফেনাচ্ছি এতক্ষণ ধরে; সুখের তলানিটার পরিমাপ করতে যেন ভুলেই গেছি। আমার জীবনের পাত্র উপচে যেটা পড়ছে নিরন্তর–সেইটাই দেখলাম শুধু নীচে জমা হয়ে রইল যা তা দেখবার সৌভাগ্য আমার হল না–এ যে শুধু তুমিই ভাবছ তা নয়–আমিও ভেবেছি বহুদিন, আজও ভাবি। কিন্তু দিদি, তলানিটাকে যখন দেখি একটা চোখে যতটুকু জল ধরে তার চেয়েও কম, তখন সেটার ক্ষতিপূরণ করতে এই পোড়া চোখের জল ছাড়া আর কী থাকতে পারে–বলতে পারো?
আমার স্বামী দেবতা মানুষ। অর্থাৎ দেবতার যেমন ঐশ্বর্যের অভাব নাই আবার লোভেরও ঘাটতি দেখিনে তেমনই। তাঁর সম্বন্ধে অপবাদ আমি দেব না, দিলে তোমরা ক্ষমা করবে না। ঐশ্বর্যে তাঁর আকর্ষণ যত বেশিই থাক, অমৃতে তাঁর অরুচি নেই এবং ওটার জন্য আবদার হয়ত একটু অতিরিক্ত রকমেরই করেন। আহা বেচারা! দেখে দয়া হয়! ছেলেবেলায় পড়েছিলাম,–সমুদ্র মন্থন চলেছে, ভাল ভাল জিনিস সব দেবতারা ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছেন, বেচারা দানব-দৈত্যের দল বানরের পিঠে ভাগ করার সময় বেড়ালের মুখ যেমন হয়েছিল তেমনই মুখ করে দাঁড়িয়ে,–ক্রমে উঠলেন লক্ষ্মী, সুধার ভাঁড় হাতে নিয়ে এবং তাঁকে অধিকার করে বসলেন বৈকুণ্ঠের ঠাকুরটি। এতক্ষণ যদিই বা সয়েছিল–এই বার দেবতা দানব কারুরই সইল না! লাগল একটা গণ্ডগোল–এবং এই গন্ডগোলের অবকাশে বৈকুণ্ঠের চতুর ঠাকুরটি লক্ষ্মীঠাকুরণকে নিয়ে একবারে পগার পার! দ্বন্দ্ব যখন মিটল তখন সুধার অংশ হয়ত সব দেবতাই পেলেন, কিন্তু জিতে গেলেন যে ঠাকুরটি তিনি যে সুধাসমেত সুধাময়ীকে পেলেন–এ ব্যথা আমরা ভুললেও দেবতারা ভুললে না। তা আমার স্বামী দেবতাকে দেখেই অনুভব করছি। উনি যা বলেন, তার মানে ঐ রকমেরই কতকটা। ওঁর মাঝে আবার একটা দুষ্ট দানবও প্রবেশ করেছে–জানিনে কোন পথ দিয়ে। ওঁর মাঝের দেবতা যখন অমৃতের জন্য অভিযোগ করেন নিরুদ্দেশ ঠাকুরটির উদ্দেশে, তখন দৈত্যটাও মুষ্টি পাকায় ক্রুদ্ধ রোষে, বোধ হয় বলে, পেতাম একবার এই হাতের কাছে! আমার স্বামী রসিক মানুষ, এই কথাটা তিনিও একদিন আমায় বলেছিলেন–আফিমের নেশার ঝোঁকে। অবশ্য, তাঁর বলার ধরনটা ছিল অন্য ধরনের, মোদ্দা মানে তার ঐ এক যে, সুধায় তিনি বঞ্চিত হলেন, তাঁর সুধাময়ীকে চোরে নিয়ে গেল!
সেদিন আমার মনটা হয়ত ভাল ছিল না, আমি বলেছিলাম কী, দিদি জান? বলেছিলাম,সেই চোরটি যদি বৈকুণ্ঠের ঠাকুরটির কাছে একটু চতুরালি শিখতই, তাহলে তাকে আজ জীবনে এত বড় ঠকতে হত না। সে তাহলে সুধাময়ীকেও চাইতো সুধার সাথে। স্বামী আফিমের নেশায় ঝিমোচ্ছিলেন, বোধ হয় বুঝতে পারেননি ভাল করে আমার হেঁয়ালি। বুঝলে আমার ভাগ্যে হয়ত এ দেব-লোক অক্ষয় না হতেও পারত।
স্বামী আফিম খেয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে বেঁচে গেছেন, আমারও এক একবার লোভ হয় দিদি, যে, ঐ আফিমের অংশ নিয়ে আমিও চিরজনমের মত বেঁচে যাই? যে লোভটা ঐ উৎকট দিকটায় এত করে আকর্ষণ করে আমায়–সেই লোভটাই আবার মিষ্টি কোন ভবিষ্যতের পানে ইশারা হেনে বলে–ওরে হতভাগি বেঁচে থাক, বেঁচে থাক তুই, সারা জীবনের ক্ষতি তোর এক মুহূর্তের কল্যাণে পুষ্পিত হয়ে উঠবে। তোর প্রতীক্ষার ধন ফিরে পাবি! তোর মৃত্যুক্ষণ হাসির রঙে রেঙে উঠবে!–আমিও তার সাথে সাথে বলি, আমি বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই।–যাকে আমি বাম হস্তের বারণ দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছি, দক্ষিণ হস্তের বরণমালা দিয়ে যদি তার প্রায়শ্চিত্ত না করি, তাহলে আমার আর মুক্তি নেই ইহকালে।
আমার স্বামী আমার রূপকে চেয়েছিলেন রুপার দরে যাচাই করতে। শুনে খুশি হবে যে, এ সওদায় তিনি ঠকেননি। কিন্তু এর জন্য স্বামীকে খোঁচা দিয়ে লাভ নেই। এই তো আমাদের বাংলার–অন্তত শরিফ মুসলমান মেয়েদের–চিরকেলে–একঘেয়ে কাহিনি। আমাদের সমাজের স্ত্রী-শিকারি অর্থাৎ স্বামীরা শব্দভেদী বাণ ছুঁড়ে শিকার করেন আমাদের। তাঁরা আমাদের দেখতে পান না বটে, কিন্তু শুনতে পান। রূপের একটা অভিশাপ আছে, হেরেমের দেয়াল ডিঙাতে তার বিশেষ বেগ পেতে হয় না। প্রভাত-আলোর মত, ফুলের গন্ধের মত তার খ্যাতি ঘরে-ঘরে দেশে-দেশে পুরুষের কানে গিয়ে পৌঁছে। কোথাও ভাল শিকার আছে শুনলেই পুরুষ ছোটেন সেখানে, সেই শব্দভেদী বাণের কল্যাণে তাঁদের হয়ে যায় শাপে-বর–কিন্তু এই হতভাগিনিদের বরই হয়ে ওঠে শাপ।
আমার স্বামী শিকার করে করে প্রধান হয়েছেন, হাত তাঁর পাকা, লক্ষ্যও অব্যর্থ। কাজেই আমার রূপের খ্যাতি তাঁর কাছে পৌঁছবার পরেও তিনি চুপ করে বসে থাকবেন–তাঁর বীর চরিত্রে এত বড় অপবাদ দিবার সুযোগ তিনি দেননি। ছুঁড়লেন শব্দ লক্ষ করে বাণ, বাণের রৌপ্যফলকে বিঁধে আমার বক্ষের অবস্থা যা-ই হোক, তাঁর মুখে হাসি যে ফুটল তা খাঁটি সোনার। এইখানে শুনে খুশি হবে দিদি, তাঁর দাঁত সব সোনার। খোদার দেওয়া হাড়ের দাঁতের লজ্জা তিনি দূর করেছেন ও-দাঁত খসে পড়তেই। এখন তিনি সোনায় দাঁত বাঁধিয়ে নিয়েছেন। তাঁর গোশত খাওয়া এবং বিবাহ করা দুই শখই অক্ষয় হয়ে গেল! বিজ্ঞানের জয়জয়কার হোক, আমাদের মত বহু হতভাগিনির স্বামীর যৌবন এই বিজ্ঞানের কৃপায় অটুট হয়ে রইল!
আমার স্বামী জমিদার এ শুনে আমারই জাতের অনেক হতভাগিরই বুক চচ্চড় করবে–সতিনের মত। কিন্তু আমার কপাল এমনই মন্দ দিদি, যে এই জমিদারির পঙ্খিরাজে চড়েও আমার দিগ্বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা আর জাগল না কোনও দিন।
স্বামী নব নব অলংকারে আমার বন্দনা করেন। কিন্তু প্রসন্ন যে হতে পারি না–এর ওষুধ কি!
অলংকারে কাব্যদেবীর সুষমালক্ষ্মীর দাম বাড়ে, কিন্তু মাটির মানুষের দাম ওতে বাড়ে না কমে–বলে দিতে পার দিদি? হাটে যে বিকাল মাটির দরে, তাকে নিয়ে এ বিদ্রুপ কেন? হায় রে হতভাগিনি নারী, প্রাণের ডালা তার শূন্য রইল বলে দেহের ডালা সাজিয়ে সে হেসে বেড়ায়! অলংকার সুন্দর, কিন্তু ও কঠিন বস্তু দিয়ে প্রাণের পিপাসা মেটে না। তাছাড়া পাষাণের বেদির বুকে থাকতে হয় যাকে পড়ে–তার গায়ে অলংকার বড় বাজে দিদি। অলংকার দিয়ে রূপ আমার খুলল কিন্তু মন কিছুতেই খুলল না, তাই বলেন আমার স্বামী।
অদ্ভুত এই মানুষের মন। যে মানুষ, মানুষ খেয়ে খেয়ে এতটা মোটা হল, আজ সেই মানুষই মানুষের একটুখানি করুণার জন্য কত কাঙাল হয়ে উঠেছে! দেখলে দুঃখ হয়! আমার স্বামী জমিদার, এটা আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। জমিদার নামের পেছনে একটা কৌতূহল আছে। রাজার ওঁরা পাড়াগেঁয়ে সংস্করণ, তাই লোকের বিশ্বাস–কত না জানি রূপকথার সৃষ্টি হচ্ছে ওখানে। হয়ত বা হচ্ছেও! আমার স্বামী জমিদার একথা স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি ভুলেন না। তাঁর প্রতাপে দেশে যে ইংরেজ বলে এখনও কোন শাসনকর্তা আছে, একথা ভুলে গেছে তাঁর জমিদারির লোক! আর, টাকাকড়ি? ইচ্ছা করলে আমায় বনবাস দিয়ে স্বর্ণসীতা গড়ে পাশে বসাতে পারেন! কত নারী তাঁকে অত্মদান করে ধন্য হয়ে বেহেশ্তে চলে গেছে হাসতে হাসতে! যাওয়ার বেলায় তাদের এই সালংকার জমিদার-স্বামীর জন্য কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছে এই ভেবে, যে, কোন মুখপুড়ি আবার তাঁর ঐশ্বর্যের ওপর বসে তার প্রভুত্ব চালাবে! গয়না ও টাকা ছাড়া যে মেয়েলোক আরও কিছু চায়, এই নতুন জিনিসটের সঙ্গে যখন পরিচয় হল তাঁর আমার কৃপায়, তখণ এই হতভাগ্যের দুঃখ দেখে আমার মত পাষাণীরও চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। বলতে সে পারে না ঠিক প্রকাশ করে কিন্তু তার মুখ দেখে আমার বুঝতে বাকি থাকে না–কী যন্ত্রণাই তার আজ হচ্ছে! আজ সে যেন বুঝেছে, জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া যেটা, সেইটে থেকেই সে বঞ্চিত রয়ে গেল! অন্যের ভালবাসার যে কত দাম, তা বুঝেছে বেচারা–যখন তার জীবন-প্রদীপের তৈল ফুরিয়ে এসেছে। সে আবার চায় যৌবন-ভিক্ষা–হয়ত সমস্ত ঐশ্বর্যের বিনিময়েও, সে তার সারা জীবনের ক্ষতিকে একদিনে আত্মদানে ভুলতে চায়, কিন্তু সবচেয়ে বেশি সে-ই জানে, যে তা আর হয় না! তবু সে আমার পায়ে-পায়ে ঘুরে মরে! আমার রূপ তার গায়ে যে কখন কঠিন হয়ে বাজল জানি না, কিন্তু এ আমার বেশ স্মরণ আছে যে, সে এর জন্য প্রস্তুত ছিল না–এমনই একটা ভাব নিয়ে আমার দিকে পাগলের মত করে সে একদিন চেয়েই ছিল। মনের জাদুস্পর্শে কোমল না হলে রূপ যে স্ত্রী-শিকারের বাণের রৌপ্য-ফলকের চেয়েও কঠিন হয়ে বাজে এ-শিক্ষা তার সেদিন নতুন হল। রূপা দিয়ে মানুষ যাচাই করেও যে সবচেয়ে বড় ঠকা ঠকতে হয়, এ-শিক্ষা হল তার আমায় দিয়ে প্রথম। অলংকার দিয়ে আমার ওজন করতে পারল না বলে–তার ঐশ্বর্যের স্বল্পতা ধরা পড়ল তার চোখে!
এখন সে ঐশ্বর্যকে পিছনে ফেলে নিজেকে অঞ্জলি করে এনেছে আমার চরণতলে অর্পণ করতে, এটাই আমার মনকে মাধুর্যে-বেদনায় অভিভূত করে ফেলেছে। একটা দুর্দান্ত পশুকে জয় করার গৌরব কি কম! আমার যদি দেওয়ার থাকত রূপ, দেহ ছাড়া আর কিছু পুঁজি, সব দিতাম–এ বেচারার মৃত্যুপাণ্ডুর অধরে নিঙড়ে! কিন্তু এ যা চায় তা আমি পাই কোথা দিদি? রাবণ রামের সীতাকে হরণ করেছিল এইটেই লোকে শিখে রেখেছে, কিন্তু সীতা রামকে নিয়ে দেশান্তরী হয়েছে এমনই একটা মহাকাব্য লিখবার বাল্মীকি কেউ নেই?
থাক, সোজা কথায় খেয়ে-দেয়ে আমি দিব্বি মোটা হচ্ছি। দুটো বাঘে খেয়ে উঠতে পারে না–এমনই গতর হয়ে উঠেছে আমার। আমার কপাল ভাল, স্বামীর আমার কোন পক্ষের কোন ছেলেপিলে নেই। অতএব আমি মুক্তপক্ষ। সেবা, আদর যা-কিছু স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে দেওয়ার নেই।
তোমাদের খবর জানবার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছি, এই বুঝে যা হয় একটা বিহিত করো।
আমার বোধ হয় আর বেশি চিঠি দেওয়া হবে না দিদি। মন একটা বিস্বাদ ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়ছে দিন দিন, আর কিছু করতে–এমনকি চিঠি লিখতেও মন চায় না। রাতদিন রাজ্যের বই আনিয়ে পড়ি। খবরের কাগজে যুদ্ধের খবর পড়ি, মন আমার আরব-সাগরের উপকূলে তরঙ্গের মত মাথা খুঁড়ে মরতে চায়।
আশীর্বাদ করো দিদি, এই মাথাটা যেন কল্যাণের চরণতলে এইবার নোয়াতে পারি।
ইতি –
হতভাগিনি
মাহ্বুবা