পরিচ্ছেদ জ : পত্র এক
সালার
১৩ই ফাল্গুন
বোন আয়েশা!
তুমি আমার হাজার ‘দোয়া’ জানবে। মা মাহ্বুবাকে আমার বুকভরা স্নেহাশিস দেবে। এখানে খোদার ফজলে সব ভাল। সোফিয়া আর বহুবিবি মা-জানের কাছে তোমাদের সব খবর জানতে পারলাম। আমায় চিঠি দেবে বলে গিয়েছিলে, তা বোধ হয় বাপের বাড়ি গিয়ে ভুলেই গিয়েছ।… আমি যেন আভাসে বুঝতে পারছি তোমাদের সেখানে অনেক অসুবিধা ভোগ করতে হচ্ছে। তোমার না হলেও আমার মাহ্বুবা মায়ের যে খুবই কষ্ট হচ্ছে, এ কথা কে যেন আমার পোড়া মনে সারাক্ষণই উসকে দিচ্ছে। আহা, খোদা তোমাদের সহি সালামতে রাখুন বোন! আমার মাহ্বুবা মায়ের আলাই-বালাই নিয়ে মরি! এই কদিন মেয়েটাকে না দেখে আমার জান যে কীরকম ছটফট করছে, তা তুমিও তো মেয়ের মা, সহজেই বুঝতে পার! মা-আমার সেই যে কাঁদতে-কাঁদতে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় নিলে অথচ একটা কথাও বলতে পারলে না, তাই আমার দিনে-রাতে হাজার বার করে মনে হচ্ছে! সোফি আর ও দুইজনে মিলে ঘরটাকে যেন মেছো-হাট করে রাখত, ওর যাওয়ার পর থেকে সোফিটা মন-মরা হয়ে শুধু নিজের ঘরটাতে পড়ে থাকে, আর কিছু শুধোলে আমার কোলের ভিতর মুখ গুঁজে কাঁদে। সে কী ডুকুরে ডুকুরে কান্না বোন ওর, দেখে চোখের পানি সামলানো দায়! মা আমার যেন দিন দিন শিকড়-কাটা লতার মতন নেতিয়ে পড়ছে। কী হল ওর, ঐ জানে আর ওর খোদাই জানে। হাজার শুধোলেও কোন কিছু বলছে না। এমন চাপা মন তো ওর কোন কালে ছিল না বোন। আমার এত ভয় হচ্ছে! কাল দিন বাদে ওর বিয়ে, আর এখন থেকেই কিনা এমন হয়ে শুকিয়ে পড়ছে। হায় আমি যে কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছিনে! মাহ্বুবাটা থাকলেও বোধ হয় ও এমন হত না। যাক, খোদা যা লিখেছেন অদৃষ্টে তাই হবে, আর ভেবে কী ফল!
তার ওপর আবার তোমাদের এই কাণ্ড! তোমাদের এতটুকু কষ্টের কথা ভাবতেও যে আমি মনে কত কষ্ট পাই, তা বলতে গেলে বলবে যে মায়াকান্না কাঁদছে। কেননা এখন সেদিন আর নেই। কোথা থেকে কী একটা গোলমাল মধ্যে থেকে বেধে গিয়ে আমার না হোক তোমার যে মন একেবারে ভেঙে গিয়েছে, এতে কোনই সন্দেহ নেই। এই মন-ভাঙা-ভাঙির আগে কিন্তু এরই পাশাপাশি বাড়িতে থেকে আমাদের অতকাল কেটে গেল, কিন্তু কোনদিন কোন মনান্তর তো দূরের কথা, তেমন কোন খুঁটিনাটিও হয়নি।… আজ যদি মাহ্বুবার বাপ (আল্লাহ্ তাকে জিন্নতে জায়গা দেন!) বেঁচে থাকত, তাহলে কী তোমরা তার বাপ-দাদার ভিটে এমন করে ছেড়ে যেতে সাহস করতে? এক দূরসম্পর্কের বোন না হয়ে তুমি যদি আমার মায়ের পেটের ‘সোদর’ বোন হতে, তাহলে হয়ত আমার এতদিনের এত বড় অধিকারকে ‘পা’মাড়িয়ে যেতে পারতে না। মাহ্বুবার বাপ বেচারা তো চিরটা কাল আমার আপন ছোট ভাইটির মতই আদর আবদার নিয়ে আসত, ওতে আমার যে কত আনন্দ হত, আমার বুক যে কীরকম ভরে উঠত, তা আমিই জানি আর আল্লাহ্ জানেন। তুমি হয়ত বলবে যে, সে অন্য সম্পর্কে আমার্ ছোট দেবরই ছিল, কিন্তু সত্যি বলতে গেলে শুধু তার জন্যে নয়, তোমার জন্যেও তার ওপর আমার স্নেহমায়াটা এত বেশি করে পড়েছিল। তোমার বিয়ের কথা আমিই উঠাই তার সঙ্গে, সে সময় সে হাসতে হাসতে বলেছিল,–‘ভাবিসাহেবা, আজকাল বউ পসন্দ করে নেওয়ার একটা হুজুগ পড়েছে, কিন্তু দেখছি আমার হয়ে আপনিই সমস্ত করে দিলেন! তবে আমি এই ভরসায় রাজি হচ্ছি যে, আপনার মত ঝুনো দালালের হাতে ঠকবার কোন ভয় নেই!’ আর সে কী হাসি! আজও আমার কানে ওর অমনি কত কথা কত হাসি মনে পড়ছে। তোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সে আমায় সালাম করতে এসে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলেছিল,–‘ভাবিসাহেবা, আজ থেকে কিন্তু আপনি আমার ‘জেড়শাস’ অর্থাৎ কিনা জ্যেষ্ঠা শ্যালিকা। আর আমাদের হিন্দুদের ঘরে জ্যেষ্ঠা শ্যালিকারা ছোট বোনের স্বামীর সাথে হাসি-ঠাট্টা করলেও আমাদের সমাজে কিন্তু উলটো নিয়ম, আর সে নিয়ম অনুসারে আপনার আমার সঙ্গে কথা কওয়া তো দূরের কথা, দেখা-শোনাও হতে পারে না!’ আজ সে নেই, তার সে হাসিও নেই! ও আর নূরুটা গিয়ে আমাদের পাড়াটা যেন দিন-দুপুরেই গোরস্থানের মত সুনসান হয়ে রয়েছে!
তারই একটি কণা স্মৃতি মরণ-কালে আমার হাতে সঁপে-দেওয়া মাহ্বুবা মা-জানকে যে তুমি এমন করে বেদিলের মতন আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, তা আমি কোনদিনই ভাবতে পারিনি। তোমার বোধ হয় মনে আছে, ছেলেবেলায় ও তোমার কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ত আমার কোলে এসে আমার দুধ খেতে, আর সে সময় সোফিতে আর ওতে কীরকম খামচা-খামচি চুলোচুলি হত! তুমি যদি বা ভোল, সে ভুলবে না; আমার বুকের রক্ত যে তার রক্তে মিশে রয়েছে!… আর তোমার কথাই বলি,–তুমি তো কোনদিনই আমার মুখের ওপর একটি কথা কইতে সাহস করনি,–কিন্তু সেই তুমি কিনা যেই তোমার ভাই তোমায় নিতে এলেন অমনি আমাদের সবারই ঘরগুষ্টির এত কাঁদন পায়ে-পড়া অনুরোধ উপেক্ষা করে উলটো আরও পাঁচ কথা শুনিয়ে চলে গেলে! কোনদিন তো তোমার কাছ থেকে এমন ব্যাভার পাইনি, তাই সেদিনকার কথাগুলো আমার বুকে যেন শেলের মতই গিয়ে বেজেছে। তুমি যে এমন করে মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিতে পারবে, তা জানতাম না। তাই আগে থেকে প্রস্তুতও ছিলাম না। তুমি নূরুর ব্যাভারের যে খোঁচা দিয়ে গেলে তা আমি অবশ্য স্বীকার করে নিলেও, ওতে যে আমাদের নিজের কতটা দোষ ছিল, তা নিয়ে তুমিও তো আর কিছু অ-জানা ছিলে না। আমার পেটের ছেলে না হলেও আমার রবুর চেয়েও সে বেশি, সুতরাং তার এই খ্যাপামো হঠকারিতায় কী তোমার চেয়ে আমি কম কষ্ট পেয়েছি, না, সে কি আমারও বুক ভেঙে দিয়ে যায়নি? তোমার চেয়ে যে সে আমারই অপমান করেছে বেশি। আর মাহ্বুবাকে কি আমি কোনদিন সোফির চেয়ে কম করে দেখেছি? সে যে এইরকমই কিছু একটা পাগলামি করে বসবে, বিয়ের কথা আরম্ভ হতেই কী-জানি-কেন আমার মনে কেবলই ঐ শঙ্কা জাগছিল। কেন না এই পাগলা ছেলে কতবার বিয়ের কথা শুনেই এক-দু মাস করে এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়িয়েছে। শুধু রবুর আর বৌমার জিদের আর উৎসাহের জন্যে আমি কিছু বলে উঠতে পারিনি, পাছে তারা মনে করে যে আমার মনটা শুধু অলুক্ষুণে কথাই ভাবে। মা ছেলেকে যেমন বোঝে তেমন আর কেউ বোঝে না। আমি ওকে খুব ভাল করেই চিনেছিলাম যে, ও আমার বাউল উদাসীন ছেলে। তাই আমি কোনদিনই তার বিয়ের জন্যে এতটুকু চিন্তিত হইনি বা আশাও করিনি। মনে করতাম, আহা থাক আমার ও কোল-মুছা খ্যাপা ছেলে হয়ে! দু-দিন বাদে সোফিয়া শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। রবু সংসারী হয়ে ছেলে-মেয়েদের পেয়ে হয়ত বুড়ো মাকে আর মনে করবে না, কিন্তু চিরদিন থাকবে আমার কোল ঠাণ্ডা করে, এই চিরশিশু নূরু–এই ঘর-ছাড়া উদাস ছেলে আমার! হায়, মানুষ ভাবে এক, আর খোদা করেন আর এক! একটা হুজুগের মাতামাতিতেই ছেলে আমার এমন করে মালিক-উল-মউতের হাতে গিয়ে জানটা সঁপে দিল–এই রাক্ষসী লড়াইয়ে চলে গেল। আর আমি কিছু চাইনে বোন এখন, খোদার রহমে আর তোমাদের পাঁচ জনের দোয়াতে ছেলে আমার বেঁচে বাড়ি ফিরে আসুক–সে না হয় চিরটা দিন থুবড়ই থাকবে। বউমার যেমন অনাসিষ্টি ঝোঁক, কী করতে গিয়ে শেষে কী হয়ে গেল। কেন, আমার মাহ্বুবার মায়েরই কি বিয়ে হত না, যে এমন আকাল-হুড়োর মতন কাড়াকাড়ি? আমি বি.এ-এম.এ পাশ করা সোনার চাঁদ ছেলে এনে তার বিয়ে দিতাম। তাতে যত টাকাই খরচ হোক। জমি-জায়গা টাকা-কড়ি কাদের জন্যে? ছেলে-মেয়েদের সুখী করে তাদের মুখে হাসি দেখে তা আমরা চোখ মুদি, তারপর খোদা তাদের নসিবে যা লিখেছেন হবে! তখন তো আমরা আর কবর থেকে উঠে, তা দেখতে আসবো না। কথায় বলে–‘চোখ মুদলে কেবা কার!’… যাক, যা হয়ে গেছে, তা গিয়েছে; নসিবের উপর চারা নাই। তা নিয়ে অনুতাপ করেও কোন ফল হবে না। কী করি, মন বালাই–কোন মানা মানে না, তাই দুটো কথা না বলেও পারি না! দু-একবার মনে হয়, দূর ছাই। পরের ছেলেকে আপনার করতে গিয়েও যখন আর হল না, তখন আর কেঁদেই কী হবে–মন খারাপ করেই বা কী পাব? হায় বোন, কিন্তু মন সে কথা বুঝতে চায় না! রাত্তি-দিন রোজা নামাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি, আল্লার নাম নিয়ে দুনিয়ার মায়া কাটাতে চাচ্ছি, কিন্তু মেয়েদের বিশেষ করে মাদের মনে যে খোদা কি দুর্বলতা দিয়ে দিয়েছেন যার জন্যে বেহেশ্তে গিয়েও আমাদের জান চায়েন হয় না। শুধু বাচ্চা-হারা বাঘিনীর মত অশান্ত মন কেঁদে কোঁকিয়ে মরে! আমারই হয়েছে তাই মুশকিল। জিন্দেগির বাকি কালটা যে আল্লার নাম নিয়ে কাটিয়ে দেব, তাও বুঝি তিনি কপালে লেখেননি!
যাক বোন, এখন আসল কথা হচ্ছে তোমরা ফিরে এস। বেশ হল, বুকে এত বড় ‘দেরেগে’ শোক পাওয়ার পর দু-দিন বাপ-মায়ের বাড়িতে বেরিয়ে মন বাহালিয়ে নিলে, এখন আবার ঘরের বউ ঘরে ফিরে এস। বাপ-মায়ের বাড়িতে বেশি দিন থাকা ‘আয়েব’ ও বটে, আর তাতে মান-ইজ্জতও থাকে না। এখন তোমাকে শ্বশুরকুলের আর মৃত স্বামীরই সম্মান রক্ষা করে চলতে হবে। যে ঘরের বউ তুমি, সে ঘরের মাথা উঁচু রাখতে তুমি সব দিক দিয়ে বাধ্য। রবুকে পাঠিয়ে দেব পালকি নিয়ে তোমাদের আনবার জন্যে। আমি নিজেই যেতাম, কিন্তু তাহলে ঘর দেখবে কে? বউ-বেটি ছেড়ে কি আমার কোথাও যাওয়ার জো আছে! আর রাগ অভিমান করিসনে বোন। তোরা সবাই মিলে যদি আমার মনে এমন করে কষ্ট দিস তা হলে দেখছি কোন দিন বিষ খেয়ে আমাকে হারামি মউত মরতে হয়। আর তা নইলে তো তোমাদের এই হাড়-জ্বালানো স্বভাব থামবে না। আমার মাহ্বুবা মাকে নিয়ে আর বেশি দিন সেখানে থাকা মস্ত বড় দোষের কথা। আইবুড়ো মেয়ে–হোক না মামার বাড়ি, লোকে তো দশটা কথা বলতে কসুর করবে না; আর তা শুনে শুনে তুমিও অতিষ্ঠ, তেতো-বেরক্ত হয়ে উঠবে। তোমরা যেদিন আসতে চাও, সেই দিনই শ্রীমান রবিয়ল বাবাজীবন সেখানে পালকি নিয়ে গিয়ে হাজির হবে। তোমরা এর মধ্যে প্রস্তুত হয়ে থেকো। পত্রপাঠ উত্তর দিতে ভুলো না যেন, একথা আমি তোমার কান কামড়ে বলে দিচ্ছি।
খুকি যে তোর জন্যে “থোত দাদি দাবো–থোত দাদি দাবো’ বলে মাথা খুঁড়ছে এখানে! মাবুর জন্যেও কত কাঁদে। হায় রে কপাল, এমন বে-দরদ ছোট দাদি যে একটা চিঠি দিয়েও পুতিনের খবর নেয় না! আর সেই পুতিনের আবার ছোট দাদির জন্যে এমন মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে কান্না!
হাঁ, আর একটা মস্ত বড় জরুরি কথা,–ছাই ভুলেও যাচ্ছিলাম। আমার কি কিছু মনের ঠিক-ঠাক আছে বোন! এখন মরণ হলেই বাঁচি!… বলছিলাম কী আমাদের সোফিয়ার বিয়ে বউমার ছোট ভাই মনুয়রের সঙ্গেই ঠিক করেছি। রবু বোধ হয় চিঠি দিয়ে আগেই সেকথা জানিয়েছে। তুই একবার এসে সব কাজ দেখে শুনে গুছো এসে; সোফি তোরই তো মেয়ে। আর, মাহ্বুবা মা না এলে সোফি বোধ হয় বিয়েই করবে না। আমি বোন এ-সব ঝামেলা সইতে পারব না এ মন নিয়ে।
সেখানকার সকলকে দর্জামত সালাম দোয়া দেবে। হাঁ, আর একবার তোর হাত ধরে বলছি বোন আমার, দেখিস নূরুকে কোন আহা-দিল বদ-দোয়া দিসনে যেন, বাছা আমার কোথায় কোন দেশে পড়ে রয়েছে, হয়ত এতে তার অকল্যাণ হবে। ইতি –
তোমার বড় বোন
রকিয়া