পরিচ্ছেদ ঙ

বাঁকুড়া

২রা ফেব্রুয়ারি

(নিশুত রাত্তির)

কবি-সৈনিক নূরু!

‘একচোখো’ ‘এক-রোখো’ প্রভৃতি তোর দেওয়া ঝুড়ি ঝুড়ি বিশেষণ আমি আমার আঁতুড়-ঘর থেকে এই বিশ বছরের ‘যৈবন বয়েস’ নাগাদ বরাবর কুইনাইন-মিক্সচারের মতন গলাঃধকরণ করতে প্রাণপণে আপত্তি জানিয়েছি, কারণ সেসময় এসব অপবাদে জোর ‘চটিতং’ হয়ে মনে করতাম তোর স্বভাবই হচ্ছে লোকের সঙ্গে কর্কশ বেয়াদবি করা আর মুখের ওপর নির্মম প্রত্যুত্তর করা। অনেক সময় তোর ঐ নির্ভীক সত্য ও স্পষ্টবাদিতা এবং ন্যায় ও আত্মসম্মানের গভীর অনুভূতিকে অহঙ্কার অহমিকা প্রভৃতি বলেও মনে করেছি। বন্ধুমহলেও তোর ঐ কথা নিয়ে অনেক সময় কুৎসা হয়েছে। কিন্তু আজ শোওয়ার আগে হঠাৎ তোর কথা মনে পড়ে গেল পাশের এক বালিকা-কণ্ঠে এই গানটা শুনে –

মনে রয়ে গেল মনের কথা,

শুধু চোখের জল প্রাণের ব্যথা।

আরও মনে পড়ল, এই গানটাই তোর মুখে হাজারবার শুনেছি এবং আজও কচি গলার সুরে তা শুনলাম, কিন্তু সেসময় তোর কণ্ঠে যে গভীর বেদনার আভাস ফুটে উঠত, জনম-জনম অতৃপ্ত থাকার ব্যথা-কান্না যে শিহরণ-ভরা মূর্ছনার সৃজন করত, তা এ বালিকার সরল কণ্ঠের সহজ সুরে পাই না। এই কথাটি মনে হতেই তোর সজল কাজল-আঁখির-আকুল-কামনা-ভরা চিঠিটা আর একবার পড়তে বড্ড ইচ্ছে হল। আজ এই নিশীথ রাতে তোর মেঘলা দিনের লেখা চিঠিটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, চিঠিটা প্রথম দিন পেয়ে কেন এমন অভিভূত হইনি। সেদিন বুঝি চারিদিককার কোলাহলে তোর প্রাণের গভীর কথা আমায় তলিয়ে বুঝতে দেয়নি, শুধু ওতে যে মুক্ত হাসির স্বচ্ছ ধারাটুকু আছে, সেই ধারার কলোচ্ছ্বাসই আমার মন ভুলিয়েছিল। আজ যেন কোন্ গুণীর পরশে সহসা আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গিয়েছে আর তোর মর্মের মর্মস্থলেরও নিষ্করুণ চিত্র দেখতে পেয়েছি। তাই আজ বুঝেছি ভাই, এ কী অকরুণ নিরেট হাসি তোর! কান্না সওয়া যায়, কিন্তু বেদনাতুরের মুখে এই যে কুলিশ-কঠোর হিম হাসি, এ যে জমাট শক্ত অশ্রু-তুহিন! এ যে পাথরও সইতে পারে না। যার প্রাণে আছে, বেদনার অনুভূতি আছে, যে এমনি নীরব রাতে একা বসে কোন স্নেহহারার এমনি নীরস শুষ্ক হাসি শুনেছে, সেই বোঝে এ হাসি কত দুর্বিষহ! তাই আজ তোর চিঠিটা পড়তে পড়তে বুকের ভেতর অনেক দূর পর্যন্ত তোলপাড় করে উঠতে লাগল!

একটি ছোট্ট প্রদীপ জ্বালিয়ে এই আঁধার বিভাবরীতে আমার সামনের বাতায়ন দিয়ে যতদূর দেখা যায় দেখতে চেষ্টা করছি আর ভাবছি–হায় তোর জীবনের রহস্যটা এই অন্ধকার-নিপীড়িত নিশীথের চেয়েও নিবিড় কৃষ্ণ পর্দায় আবৃত! সে বধির-যবনিকা চিরে তোর অন্তরের অনন্ত দিগ্‌মণ্ডলের সন্ধান নিতে যাচ্ছি আমার এই ঘরের প্রদীপটির মতই ক্ষীণ কালো শিখা নিয়ে। তাই বুঝি অন্তরঙ্গ সখা হয়েও তোর ঐ অথৈ মনের থৈ পেলাম না, অসীম হিয়ার সীমারেখা ধরি-ধরি করেও ধরতে পারলাম না। ও মন কেবলই আমাকে আকাশের মত প্রতারিত করেছে; যখনই মনে করেছি–ঐ ঐখানেই গাঙের পারে আকুল আকাশ আর উদাস মাঠে চুমোচুমি হয়েছে, তখনই আমি প্রতারিত হয়েছি। সেই মিলন-সীমায় পদাঙ্ক আঁকতে যতই ছুটে গিয়েচি, ততই সে দিকের শেষ দূরে–আরও দূরে সরে গিয়েছে। কোথায় এ বাঁধন-হারা দিগ্‌বলয় কার অসীম আকাশের মোহানা, তা কে জানে! আমরা নিয়তই বাঁধন-বাঁধার ডোর সৃজন করে ঐ অসীমতাকে ধরবার চেষ্টা করছি, আর দুষ্ট চপল শশক-শিশুর মত সে ততই এক অজানা বনের গহন-পথের পানে ছুটে চলেছে! সে দুরন্ত-শিশু নেমে আসে কখনও মাঠের ধারে গাঁয়ের পাশে, কখনও গাঙ পারিয়ে আমলকি-ছায়া-শীতল ঝরনা-তীরে, আবার কখনও শাল-পিয়াল আর পলাশবনের আলো-ছায়ায়। একটি পাতাঝরার শব্দ শুনেই সে চমকে উঠে অনেক দূরে গিয়ে তার চটুল চোখের নীল চাউনি ইশারায় ভ্রান্ত পথিককে ডাকতে থাকে। তোর নিরুদ্দিষ্ট উদাসীন মন অমনই সে-কোন্ এক আবছায়া ভরা অচিন অসীমের পানে যে ছুটেছে, তা তুইই জানিস; তোর এই কাণ্ডারীহীন হিয়ার তরী যে কোন্ অকূলের কূল লক্ষ্য করে এমন খাপছাড়া পথে পাড়ি দিয়েছে, তা কোন মাঝিই জানে না। আমি ভাবছি, হয়ত এ নিরুদ্দেশ যাত্রীর দুঃসাহসী ডিঙাখানি ঐ দুই অসীমের মোহানাতেই গিয়ে জয়ধ্বনি করবে, না হয়, কোথাও ঘূর্ণি-আবর্তে পড়ে হঠাৎ ডুবে যাবে, নয়ত কোন্ চোরা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ডিঙার বাঁধন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাবে! ভবিষ্যৎটা আমি নির্দয়ভাবেই কল্পনা করলাম, কারণ আমি জানি নির্মম সত্য তোর কাছে কোনদিন অপ্রিয় লাগেনি, এবারেও আমার এসব বেহুদা কথায় রাগবিনে বা দুঃখ পাবিনে আশা করি।

তোর সজল কাজল-আঁখি প্রেয়সী যে কোন্ কোকাফ মুল্লুকের পরীজাদি, তাই ভেবে আমি আকুল হচ্ছি। শ্রীমতী মাহ্‌বুবা খাতুনই সে সৌভাগ্যবতী কিনা, সে সম্বন্ধে এখনও আমি সন্দেহ-দোলায় দুলচি। তাহলে তুই আগে মত দিয়ে পরে বিয়ের ক’দিন আগে তাকে কেন এমন করে এড়িয়ে ত্যাগ করে গেলি? তোর এ এড়িয়ে-যাওয়ার দু’ রকম মানে হতে পারে; প্রথম, হয়ত তাকে ভালবাসিসনি,–দ্বিতীয়, হয়ত তাকে মন দিয়ে ফেলেছিলি বলেই নিজের এই দুর্বলতা ধরা পড়ার ভয়ে এমন করে ভেসে গেলি। কোনটাতো সত্য? আমার বোধ হয়, দ্বিতীয় ঘটনাটাই ঘটা খুব সম্ভব আর স্বাভাবিক। তুই আমার এইসব মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ দেখে আমায় ঔপন্যাসিক ঠাউরাসনে যেন। সকলের পক্ষে যেটার অন্তরে উদয় হওয়া স্বাভাবিক, আমি কেবল সেইটাই যতটা প্রকাশ করা যায়, ভাষার বাঁধন দিয়ে আগলাবার চেষ্টা করছি। মাহ্‌বুবার অবস্থা আমি নিজে কিছু না দেখলেও বুবুজান যেরকম করে বলছিলেন, তাতে মর্মর দেউলেরও বুক ফেটে যাওয়ার কথা। অবশ্য তিনি সব কথা খুলে বলতে পারছিলেন না আমার কাছে; কিন্তু ঐ বাধো-বাধোভাবে কথাটা চাপতে গিয়েই সেটার গোপন তত্ত্ব যতটা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল, তাতে আমি হলফ করে বলতে পারি যে, সে বেচারির নরম বুকে তোর ভালবাসার ‘খেদং তীর’ বড় গভীর করে বিঁধেছে! এ নিদারুণ শায়কের বিষ তার রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে! বুঝি সে অভাগীর আর রক্ষে নেই। বুবুজানও এই ভেবে একরকম অস্থির হয়েই পড়েছেন। তাঁর ভয়ের আদত কারণ বোধ হয়, তিনি মনে করেন যে, মৌন বুকের এই বধির চাপা ভালবাসার গভীরতা যেমন বেশি, মারাত্মকও তেমনই। এই গভীর বেদনাই তাকে হত্যা করে ছাড়বে।… এইসব নানান দিক দেখে আমার আর ইচ্ছে হয় না ভাই যে বিয়ে করি। আমার অন্তরঙ্গ সখার বুভুক্ষু আঁখির আগে আমি নিজের ভালবাসার ক্ষুধা মেটাব, আর সে শুধু গোবিসাহারার তপ্ত বালুকায় দাঁড়িয়ে ছাতি-ফাটা পিয়াস নিয়ে তেষ্টায় বুক ফেটে মরবে, এমন স্বার্থপরের মত ছোট কথা ভাবতেও যে আমার জানটা ওলট-পালট করে ওঠে ভাই! তাই আমি আজ গোলাবি শরবতের পেয়ালা ওষ্ঠের কাছে ধরে ভাবছি,–তিয়াসা মিটাই, না এ পেয়ালা চূর্ণ করে তোর মত অজানার পথে বেরিয়ে পড়ি। তুই এ পথা-হারা অন্ধকে পথ দেখিয়ে দিতে পারিস? ভেসে পড়ি তাহলে আল্লা বলে! কিন্তু বলে রাখি, জটিল জটাজূটধারী লোটা-কম্বল-সম্বল ‘কম্‌লিওয়ালে’ সাজতে আমি পারব না। নাগা সন্ন্যাসীর মত স্বার্থের বৈরাগ্য আমার মুক্তিপথ নয়। আমার মত গো-মুখ্যুর কথা যদি শুনিস তাহলে আমি বলি কী, তোর গুরুদেবের উদাত্ত নির্ভীক বাণীতে তুইও যোগ দিয়ে প্রদীপ্ত কণ্ঠে বুক ফুলিয়ে বল; –

বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়,

অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়

লভিব মুক্তির স্বাদ!

আছে তোর এ সাহস? বল তাহলে আমিও বিস্‌মিল্লাহ্ বলে কাছা এঁটে একবার লেগে পড়ি।…

হাঁ, তারপর–ঝড়-বৃষ্টির মাতামাতিতে তোর কোন্ জাঁদরেল-তন্বীর বা জাহাঁবাজ-কিশোরীর দাপাদাপি মনে পড়েছিল রে? আমি তো ভেবেই পাচ্ছিনে। শুনি, কবিকুল নাকি কল্পলোকের জীব; তারা স্রেফ কল্পনা নিয়েই মশগুল, তাঁদের কথায় বাস্তবতা একরকম ‘নদারদ’ বললেই হয়। আর, এই যদি হয় কবির সংজ্ঞা, তাহলে তুইও কবি (এবং সেই জন্যেই তোকে প্রথমেই কবিসৈনিক বলে সম্বোধন করেছি)। আচ্ছা, এই যে তোর খেলার সাথী দুষ্ট চপল প্রিয়া, ইনি তোর মানসী-বধূ, না কোন রক্ত-মাংসের শরীরধারিণী সত্যিকার মানবী? রাজকন্যা, স্বপ্নরাণী, পরীস্থানের বাদশাজাদি, ঘুমের দেশের আলোক-কুমারী বা ঐ কেসেমেরই যত সব উদ্ভট সুন্দরীদের রাঙা চরণের আশা যদি থাকে তোর, তবে দ্বিতীয় ভাগের সুবোধ বালকের মতন ওসব খামখেয়ালি এক্ষুণি ছেড়ে দে, ছেড়ে দে! গোলে-বকাওলিতেই লেখা থাক, বা আরব্য উপন্যাসের উজিরজাদিই বলুন,–কিন্তু কই কাউকে তো সত্যি সত্যিই কোন পাখনাওয়ালি পরী এসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে বলে শুনলাম না। পালঙ্কসুদ্ধ উড়িয়ে না নিয়ে যাক রে ভাই, অন্তত বিছানার চাদরটা জড়িয়েও তো আমাকে ঐ পরী-বানুরা এক-আধ দিন তাঁদের আজব দেশে নিয়ে যেতে পারতেন। কত দিন শরৎ, হেমন্ত, গ্রীষ্ম, বসন্তের চাঁদিনী-চর্চিত যামিনীতে ছাদে শুয়ে শুয়ে সর্দি-কাশি ধরিয়েছি, কিন্তু এ পোড়াকপালে ঐ গগনমার্গের দিকে চক্ষু তেড়ে তাকানো ছাড়া আর ওড়া হল না। বাদুড় চামচিকে উড়ে যেতে অনেক দেখেছি, কিন্তু কোন পরীর আসমানি চাদর বা হেনায়-রাঙা পদপল্লব বা ডাঁশা আঙুরের মতন ঢলঢলে মুখ দেখা তো দূরের কথা, তাদের পাখা-পাখনারও একটি থর বা কোন পাত্তা পাওয়া গেল না।… সেসব যাক, এখন তোর নামে মস্ত একটা অভিযোগ দেব, যে অভিযোগ কখনও দেব বলে আমার আজকের রাতের আগে আর মনে হয়নি। আজ যেন দিনের মতন সাফ বুঝতে পাচ্ছি, কখনও তোর মনের কথা পাইনি বা তোকে বুঝতেও পারিনি। শুধু তোর ঐ ওপরকার হাসির ছটাতেই ভুলে ছিলাম। আজ যখন তুই অনেক দূরে মরণের বুকে দাঁড়িয়ে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে উদ্‌বুদ্ধ করছিস, যখন মনে পড়ছে যে হয়ত তোর সাথে আমাদের আর দেখা নাও হতে পারে, তখনই বুকের ভেতর এক অশান্ত অসোয়াস্তি তোলপাড় করে উঠছে–হায়, কেন এতদিন তোকে কাছে পেয়েও আরও কাছে পাইনি; কেন তোকে বুঝতে পারিনি!–কার করুণা-মাখা অধর, কার বিদায়-ক্ষণের চেয়ে থাকা তোকে মেঘলা-দিনে এমন উতলা করে তোলে? সজলমেঘ কার কাজল-নয়ন মনে করিয়ে দেয়? আমি তাই এ নিশীথ রাতে একলা বসে ভাবছি আর ভাবছি। সে কে? কোন্ কিশোরীর ভালবাসার হীরা তোর মনের কাচকে দু’ফাঁক করে কেটে দিয়েছে? কোন্ খাতুনের মুখ-সরোজ তোর হিয়ার সরসীতে এমন চিরন্তনী হয়ে ফুটেছে? তা তুই আর হয়ত তোর মানসী দেবী ছাড়া কেউ জানে না। তোর জীবনের পথে আচমকা আসা অনেকগুলি কচি-কিশোর মুখ মনের মাঝে ভেসে উঠছে, কিন্তু কোনটাকেই মনে লাগছে না যে এ তোর মর্মর মর্মে স্থায়ী নিবিড় দাগ কাটতে পারে। এ সবারই মাধুরী শুধু সৌদামিনীর মত একটুখানিক চমকে হেসে আঁধার পথের যাত্রীর চোখ ঝলসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। একটা কথা কিন্তু এইখানে মনে হচ্ছে আমার।–যদি কোন এক কিশোরী কুমারীর মাঝে থাকত আমার ভবিষ্যৎ গৃহলক্ষ্মী শ্রীযুক্ত সোফিয়া খাতুনের গভীর অভিমান-ভরা মিষ্টি দুষ্টুমি আর অবাধ্য চপলতা, এবং সেই সাথে শ্রীমতী মাহ্‌বুবা খাতুনের নিবিড় ভালবাসা-মাখা করুণা ও বিদ্রোহ-মাধুর্যের আমেজ,–আর সেই সুন্দরী যদি নিঃসংকোচে সহজ সরলভাবে তোকে তার পথে জোর করে টেনে নিয়ে যেতে পারত, তবে একমাত্র সেই তোর বাঁধন-হারা জীবনটাকে এমন করে মরুর মাঝে শুকিয়ে মরতে না দিয়ে সফলতার পুষ্পমঞ্জরিতে মুঞ্জরিত করে তুলত।–তুই বাইরে যত বড়ই বেহায়া বেল্লিকপনা কর না কেন, অন্তরে তোর মতন লাজুক আর কেউ নেই; তোর ভিতরের লজ্জাশীলতার কাছে আমাদের নব-বধূদেরও হার মানতে হবে। আমি বরাবর দেখে এসেছি, যেখানে বেশ সোজাভাবে মিশতে না পারার দরুণ তোর গোপন দুর্বলতার শক্ত বাঁধন একটু শিথিল হয়ে এসেছে, সেইখানেই তুই মন্ত্রবশীভূত গোখরো সাপের মতন ফণা গুটিয়ে বসে পড়েছিস। বিশেষত, কোন অচেনা সুন্দরী তরুণীর মুখোমুখি হলেই তুই দু’একদিন যেরকম ব্যতিব্যস্ত খাপছাড়া ভাব দেখাতিস কথায় কাজে, তার সত্যিকার গূঢ় হেতুটা কী বল দেখি? সেটা সুষমা-পিপাসু মনের সৌন্দর্য-তৃষা, না ঐ রূপের ফাঁদে ধরা পড়বার ভীতি-কম্পন? তোর আরও একটা দুর্বলতা ও শক্ত শক্তির কথা মনে পড়ছে আমার–তুই যেমন শিগ্‌গির কোন কিছুতে অভিভূত হয়ে পড়তিস, সেই রকম শীঘ্রই আবার সেটার কবল থেকে নিজেকে জোর করে ছিনিয়ে নিতে পারতিস। অবশ্য শেষের গুণটা পৌরুষ না হয়ে নির্মম নির্দয়তারই বেশি পরিচয় দেয়। তোকে যে ধরতে যাবে, তাকে আগে নিজেকে ধরা দিতে হবে। অনবরত স্নেহের সুরধুনী বইয়ে প্রীতির মরূদ্যান রচনা করে, তোর মরুযাত্রী পিয়াসী আত্মাকে যদি কোন নারী প্রলুব্ধ আকৃষ্ট করতে পারত, তাহলে বোধ হয় এই তরুণ বয়সেই তোর বেদনার বোঝা এত অসহ্য হয়ে উঠত না! তোর মতন বিপুল অভিমানী যে কারুর স্নেহ যাচ্ঞা করে না, তা আমি জানি। আমি আরও জানি, তোদের মত অভিমানীদের আত্মসম্মান-জ্ঞান আর দুর্বলতা ধরা পড়বার ভয় ভয়ানক তীক্ষ্ণ সজাগ। কিন্তু এ আমি বলবই যে, এটা তোদের অনেকটা যেন একগুঁয়েমি; তোদের মনের অতৃপ্ত কামনা একটা তরুণ বুকের স্নেহ-ভালবাসা পাওয়ার আশায়, দুটি টানা চোখের মদিরাভরা শিথিল চাউনির আবেশের ক্ষুধায়, একটি কম্পিত পাতলা ঠোঁটের উষ্ণ পরশের তৃষায় হা হা করে ছাতি ফেটে মরছে–বোশেখ-মধ্যাহ্নের আতপ তপ্ত ভুখারি ভিক্ষুকের মত! কিন্তু এত আকণ্ঠ পিপাসা নিয়েই সে তৃষাতুর কামনা শুধু তীব্র অভিমানের রোষে আত্মহত্যা করছে! নরঘাতকের মত তোরা বাসনার গর্দানে খড়্গের ওপর খড়্গ হেনে তাকে কাটতে তো পারছিসইনে, শুধু কচলিয়ে কচলিয়ে মর্মন্তুদ যন্ত্রণা দিচ্ছিস! তবু পাষাণ–তোদের বিক্ষুব্ধ ক্ষোভ মিটল না, মিটল না! এর ফল বড্ড ভয়ানক, অতি নিষ্করুণ! তাই বলি ভাই নূরু, তোর পায়ে পড়ে বলি, ফিরিয়ে আন তোর এ গোঁয়ার মনকে এই গোবির তপ্ত উষার ধুধু শুষ্কতা হতে! এতে অন্ধ হবি, শক্তি হারাবি, অথচ কিছুই হবে না জীবনের। তোর মধ্যে যে বিরাট শক্তি সিংহ সুপ্ত রয়েছে, কেন তাকে এমন করে এক অজানার ওপর অন্ধ অভিমানের ক্ষিপ্ততায় হত্যা করবি? সংসারে থেকে সংসারের বাঁধনকে উপেক্ষা করে এ স্পর্ধার অট্টহাসি হেসে প্রকৃতির ওপর প্রতিশোধ নেওয়া অসম্ভব রে অসম্ভব! ফিরে আয় ভাই, ফিরে আয় এ ধ্বংসের বন্ধুর পথ হতে!… তোর প্রাণের অগ্নিবীণার এই যে আগুন-ভরা দীপক-রাগ আলাপ, এ যে তোকে পুড়িয়ে খাক করে ছাড়বে ভাই! মেঘমল্লারের স্নেহ-স্নিগ্ধস্পর্শ ছাড়া এ আগুন শান্ত করবে কে? যদি ধরা না দেওয়া, বাঁধন এড়ানোতেই তোর আনন্দ, তবে তো এ জীবন-ভরা চঞ্চলতা দিয়ে পথের ভ্রান্ত পথিকগুলোকে মুগ্ধ করিস কেন? লুব্ধা মৃগীকে মায়া-তানে বনের বাহির করে তাকে মৃগ-তৃষ্ণিকায় ফেলে যাওয়াটাই কি খুব বড় পৌরুষের কথা? এ কী পাণ্ডুর-পাংশু আনন্দ! জানি, তুই বলবি, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ!’ কিন্তু এতদিন ভুলেছি, আজ আর ও-ফাঁকির কথায় ভুলছিনে। আজ তোর এই বাদলের কান্না-ভরা চিঠিটা পড়ছি, সেই সঙ্গে তোর অনেকদিনের অনেক কথা আমার মনের দিঘিতে বুদ্‌বুদ কাটছে, আর তারই সাথে মনে হচ্ছে তোর মনের মানুষের এতদিনে যেন অনেকটা নাগাল পেয়েছি। পল্লিমাঠের ‘ভুলনে ভূত’-এর মত আর এ চতুর মনকে পথ ভুলোতে পারছিসনে, বলে রাখলাম। এইবার যেন বুঝতে পারছি, তোর পাষাণ বুকের ভেতর জ্বলছে লক্ষ আগ্নেয়গিরির অনন্ত বহ্নিশিখা ধুধুধু!‌ তাকে আটকে রাখতে প্রয়াস পাচ্ছে তোর ঐ শক্তি অমানুষিক ধৈর্যের আবরণ। তোর হৃদয়-ভরা বেদনার রক্ত-ঢেউ পাঁজরের বাঁধ ভেঙে কণ্ঠের সীমা ছাপিয়ে উঠতে দিনের পর দিন উত্তাল বিদ্রোহ-তরঙ্গের সৃষ্টি করছে। তারই রুদ্র-কান্না হাসি হয়ে তোর রুক্ষ অধর-ওষ্ঠে আছাড় খাচ্ছে, হাঃ হাঃ হাঃ! শুধু হাসি–কাঠচোটা হাসি! আর প্রতারণা করতে পারবিনে রে আমায়, আর তুই মিথ্যা দিয়ে আমায় বারে বারে ঠকাতে পারবিনে; আজ আমার আপন বেদনা দিয়ে তোর হাসি-কান্নার সত্য উৎস আবিষ্কার করেছি। তোর ব্যথার এ অফুরন্ত উৎস চেনা-পথিকদের ছেয়ে ডুবিয়ে ফেলেছে; তোর ঐ বেদনা-রাগ-রঞ্জিত পরশমণির ছোঁয়া আমারও লৌহ-মর্মকে ব্যথা-কাঞ্চনের অরুণিমায় রাঙিয়ে তুলেছে! ওরে, তাই এ নিস্তব্ধ রাতে বিহ্বল-আমি একা-আমার আজ অন্তরের সত্য–মানবাত্মার সকল ভাবগুলি তোকে জানিয়ে বাঁচলাম। জানি এ চিঠিটা আমার হাত পেরিয়ে গেলেই হয়ত আমার সঙ্কোচ আর অনুশোচনা জাগবে যে, তোকে এমন করে তোর দুর্বলতা সম্বন্ধে সজাগ করে দেওয়া বা চোরা-ব্যথায় অস্ত্র করা একেবারেই উচিত হয়নি। এ জেনেও আমার পত্র লেখার বলবতী ইচ্ছাকে রুখতে পারলাম না। কে জানে, আবার আমাদের নব মিলনের আনন্দ-ভৈরবী আর প্রভাতির কলমুখর রাগিণী কোন প্রভাতে রণে উঠবে কিনা! আঃ, তার চিন্তাটাও কত ব্যথা-কাতর কান্নায় কান্নাময়। হায় ভাই, সেদিন কি আর আসবে?

বাড়ির সব খবর ভাল। মাহ্‌বুবা বিবি বর্তমানে মাতুলালয়-বাসিনী। সোফিয়া বিবি তেপসে-যাওয়া মালসার মতন নাকি আজকাল মুখ ভার করে থাকেন। রবিয়ল সাহেবের এসরাজ-সারেঙ্গির কোঁকানি একটু মন্দা পড়েছে। আমার এখন লেখাপড়ার চিন্তার চেয়ে বোঝাপড়ার চিন্তাটাই বেশি।–ঐ যাঃ, একটা হুতুম-প্যাঁচা ডেকে উঠল রে–বড্ড অলুক্ষণে ডাক! শুয়ে পড়ি ভাই, মাথা নুয়ে আসছে!

তোর বিয়োগ-কাতর

মনুয়র