» » পরিচ্ছেদ ক : পত্র এক

বর্ণাকার

পরিচ্ছেদ ক : পত্র এক

করাচি সেনানিবাস,

২০এ জানুয়ারি (সন্ধ্যা)

ভাই রবু!

আমি নাকি মনের কথা খুলে বলিনে বলে তুমি খুব অভিমান করেছ? আর তাই এতদিন চিঠি-পত্তর লেখনি? মনে থাকে যেন, আমি এই সুদূর সিন্ধুদেশে আরব-সিন্ধুর তীরে পড়ে থাকলেও আমার কোনও কথা জানতে বাকি থাকে না! সম্‌ঝে চোলো, তারহীন বার্তাবহ আমার হাতে!

আমি মনে করেছিলাম,–সংসারী লোক, কাজের ঠেলায় বেচারির চিঠি-পত্তর দেবার অবসর জোটেনি এবং কাজেই আর উচ্চবাচ্য করবার আবশ্যক মনে করিনি; কিন্তু এর মধ্যে তলে-তলে যে এই কাণ্ড বেধে বসে আছে, তা এ বান্দার ফেরেশ্‌তাকেও খবর ছিল না! –শ্রাদ্ধ এত দূর গড়াবে জানলে আমি যে উঠোন পর্যন্ত নিকিয়ে রাখতাম!

আমি পল্টনের ‘গোঁয়ার গোবিন্দ’ লোক কিনা, তাই অত-শত আর বুঝতে পারিনি, কিন্তু এখন দেখছি তুমিও ডুবে ডুবে জল খেতে আরম্ভ করেছ! আমার আজ কেবলই গাইতে ইচ্ছে করছে সেই গানটা, যেটা তুমি কেবলই ভাবি-সাহেবাকে (ওরফে ভবদীয় অর্ধাঙ্গিনীকে) শুনিয়ে শুনিয়ে গাইতে –

মান করে থাকা আজ কি সাজে?

মান-অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে

চলো চলো কুঞ্জ মাঝে।

হাঁ,–ভাবিসাহেবাও আমায় আজ এই পনর দিন ধরে একেবারেই চিঠি দেননি। স্বামীর অর্ধাঙ্গিনী কিনা!

তোমার একখানা ছোট্ট চিঠি সেই এক মাস পূর্বে–হাঁ, তা প্রায় একমাস হবে বই কি!–পেয়ে তার পরের দিনই ‘প্যারেডে’ যাওয়ার আগে এলোমেলো ভাবের কী কতকগুলো ছাই-ভস্ম যে লিখে পাঠিয়েছিলাম, তা আমার এখন মনে নেই। সেদিন মেজাজটা বড় খাট্টা ছিল, কারণ সবেমাত্র ‘ডিউটি’ হতে ‘রিলিভ’ হয়ে মুক্তি পেয়ে এসেছিলাম কিনা! তারপরেই আবার কয়েকজন পলাতক সৈনিককে ধরে আনতে ‘ডেরাগাজি খাঁ’ বলে একটা জায়গায় যেতে হয়েছিল। এসব হ-য-ব-র-ল-র মাঝে কি আর চিঠি লেখা হয় ভাই? তুমিও বা আর কিসে কম? এই একটা ছোট্ট ছুতো ধরে মৌনব্রত অবলম্বন করলে! এ মন্দ নয় দেখছি।

তুমি যে মনুকে লিখে জানিয়েছ যে, আমি ‘মিলিটারি লাইনে’ এসে গোরাদেরই মত কাঠখোট্টা হয়ে গেছি তাও আজ আমার জানতে বাকি নেই। আগেই বলেছি, তারহীন বার্তাবহ হে, ওসব তারহীন বার্তাবহের সন্দেশ!

যখন আমায় কাঠখোট্টা বলেই সাব্যস্ত করেছ, তখন আমার হৃদয় যে নিতান্তই সজনে কাঠের ঠ্যাঙার মত শক্ত বা ভাঙা বাঁশের চোঙার মত খনখনে নয়, তা রীতিমতভাবে প্রমাণ করতে হবে। বিলক্ষণ দূর না হলে আমি অবিশ্যি এতক্ষণ ‘যুদ্ধং দেহি’ বলে আস্তিন গুটিয়ে দাঁড়াতাম; কিন্তু এত দূর থেকে তোমায় পাকড়াও করে একটা ‘ধোবি আছাড়’ দিবার যখন কোনোই সম্ভাবনা নেই, তখন মসিযুদ্ধই সমীচীন। অতএব আমি দশ হাত বুক ফুলিয়ে অসিমুক্ত মসিলিপ্ত হস্তে সদর্পে তোমায় যুদ্ধে আহ্বান করছি–‘যুদ্ধং দেহি!’

তোমার কথামত আমি কাঠখোট্টা হয়ে যেতে পারি, কিন্তু এটা তো জান ভায়া যে, খোট্টাকাঠের উপরও চোট পড়লে সেটা এমন আর্তনাদপূর্ণ খং শব্দ করে ওঠে, যেন ঠিক বুকের শুকনো হাড়ে কেউ একটা হাতুড়ির ঘা কশিয়ে দিলে আর কী। তোমার মত ‘নবনীতকোমল মাংসপিণ্ডসমষ্টি’র পক্ষে সেটার অনুভব একেবারে অসম্ভব না হলেও অনেকটা অসম্ভব বই কি!

তা ছাড়া যেটা জানবার জন্যে তোমার এত জেদ, এত অভিমান, তার তো অনেক কথাই জান। তার উপরেও আমার অন্তরের গভীরতর প্রদেশের অন্তরতম কথাটি জানতে চাও, পাকে-প্রকারে সেইটেই তুমি কেবলই জানাচ্ছ।–আচ্ছা ভাই রবু, আমি এখানে একটা কথা বলি, রেগো না যেন!

তোমার অভিমানের খাতির বেশি, না, আমার বুকের পাঁজর দিয়ে-ঘেরা হৃদয়ের গভীরতম তলে নিহিত এক পবিত্র স্মৃতিকণার বাহিরে প্রকাশ করে ফেলার অবমাননার ভয় বেশি, তা আমি এখনও ঠিক করে বুঝে উঠতে পারিনি। তুমিই আমায় জানিয়ে দাও ভাই, কী করা উচিত!

আচ্ছা ভাই, যে শুক্তি আর কিচ্ছু চায় না, কেবল ছোট্ট একটি মুক্তা হৃদয়ের গোপন কোণে লুকিয়ে থুয়ে অতল সমুদ্রের তলে নিজকে তলিয়ে দিতে চায়, তাকে তুলে এনে তার বক্ষ চিরে সেই গোপন মুক্তাটা দেখবার এ কী মূঢ় অন্ধ আকাঙ্ক্ষা তোমাদের! এ কী নির্দয় কৌতূহল তোমাদের!

যাক, শিগ্‌গির উত্তর দিও। ভাবিসাহেবাকে চিঠি দিতে হুকুম কোরো, নতুবা ভাবিসাহেবাকে লিখব তোমায় চিঠি দিতে হুকুম করবার জন্যে।

খুকির কথা ফুটেছে কি? তাকে দেখবার বড় সাধ হয়। … সোফিয়ার বিয়ে সম্বন্ধে এখনও এমন উদাসীন থাকা কি উচিত? তুমি যেমন ভোলানাথ, মা-ও তথৈবচ! আমার এমন রাগ হয়!

আমার জন্যে চিন্তা কোরো নো। আমি দিব্যি কিষ্কিন্ধ্যার লবাবের মত আরামে আছি। আজকাল খুব বেশি প্যারেড করতে হচ্ছে। দু-দিন পরেই আহুতি দিতে হবে কিনা! আমি পুনা থেকে বেয়নেট যুদ্ধ পাশ করে এসেছি। এখন যদি তোমায় আমার এই শক্ত শক্ত মাংসপেশীগুলো দেখাতে পারতাম!

দেখেছ, সামরিক বিভাগের কী সুন্দর চটক কাজ? এখানে কথায় কথায় প্রত্যেক কাজে হাবিলদারজিরা হাঁক পাড়ছেন, ‘বিজলি কা মাফিক চটক হও।–সাবাস জোয়ান!’

এখন আসি। ‘রোল-কলের’ অর্থাৎ কিনা হাজিরা দেবার সময় হল। হাজিরা দিয়ে এসে বেল্ট, ব্যাণ্ডোলিয়র, বুট, পট্টি (এসব হচ্ছে আমাদের রণসাজের নাম) দস্তুরমত সাফ-সুতরো করে রাখতে হবে। কাল প্রাতে দশ মাইল ‘রুট্ মার্চ’ বা পায়ে হণ্টন। – ইতি

তোমার ‘কাটখোট্টা লড়ুয়ে’ দোস্ত

নূরুল হুদা