পরিচ্ছেদ ঘ : পত্র তিন
করাচি সেনানিবাস
১৫ই ফেব্রুয়ারি (দুপুর)
ভাবি সাহেবা!
হাজার হাজার আদাব। আপনার চিঠি পেয়েছি। সব কথা বুঝে উত্তর দেওয়ার মত মনের অবস্থা নেই আর সময়ও নেই। পরে যদি সময় পাই আর ইচ্ছা হয়, তবে আপনার সব অনুযোগের একটা মোটামুটি কৈফিয়ত ভেবেচিন্তে দিলেও দিতে পারি। কিন্তু বলে রাখছি আমি,–আর আপনারা আমায় এরকম করে আঘাত করবেন না। মানুষ মাত্রেরই দুর্বলতা থাকে, কিন্তু সেটাকে প্রকাশ করাও যে একটা মস্ত বড় দুর্বলতা তা আজ আমি হাড়ে হাড়ে বুঝছি। তা নাহলে আজ আমি এত কষ্ট পেতাম না। আপনাদের এ আঘাত দেওয়ার অধিকার আছে বটে, আমারও সইবার অধিকার আছে, কিন্তু সইবার শক্তি নেই আমার। এটা তো বোঝা উচিত ছিল। আমার এই কথা কটি বুঝতে চেষ্টা করে আমার এই নির্দয় কঠোরতাকে ক্ষমা করবেন।
দেখুন, মানুষের যেখানে ব্যথা, সেইখানটা টিপেও যে আরাম পায়। অন্তরের বেদনাও ঠিক ঐ রকমের। তাই, জেনে হোক–না জেনে হোক, কেউ সেই বেদনায় ছোঁয়া দিলে এমন একটা মাদকতা-ভরা আরাম পাওয়া যায়, যেটার পাওয়া হতে হাজার চেষ্টাতেও নিজেকে বঞ্চিত করা যায় না, বা এড়িয়ে চলবারও শক্তি অসাড় হয়ে যায়, এমনই ভয়ানক এর প্রলোভন। তাই আমি মুক্তকণ্ঠে বলছি, আপনাদের দেওয়া এই আমার বেদনার আঘাত মধুর হলেও আমার কাছে অকরুণ–ভীষণ দুর্বিষহ। এ আমাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। এ প্রলোভনের মুখে একটু ঢিলে হয়ে পড়লেই পদ্মার ঢেউ-এ খড়-কুটাটির মত ভেসে যাব।–সে কী ভয়ানক! আমার অন্তর শিউরে উঠছে! পায়ে পড়ি আপনাদের, আর আমায় এমন করে খেপিয়ে তুলবেন না। আমার বেদনাভরা দুর্বলতার মূল কোথায় জেনে ঠিক সেইখানে কসাইয়ের মত ছুরি বসাবেন না। রক্ষা করুন–মুক্তি দেন আপনাদের এই স্নেহের অধিকার হতে। আমার প্রকাশ-করা দুর্বলতা আমারই ক্ষুব্ধ বুকে পল্টনের জল্লাদের হাতের কাঁটার চাবুকের আঘাতের মত বাজছে। তাই এ চিঠিটা লিখছি আর রাগে আমার অষ্টাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে! আমার মতন বোকাচন্দ্র বোধ হয় আর দুনিয়ায় দুটি নেই!
আমাদের ‘মোবিলিজেশন অর্ডার’ বা যুদ্ধ-সজ্জার হুকুম হয়েছে। তাই চারিদিকে ‘সাজ সাজ’ রব পড়ে গেছে। খুব শীঘ্রই আরব সাগর পেরিয়ে মেসোপটেমিয়ার আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে গিয়ে, তাই আমার আনন্দ আর আমাতে ধরছে না। আমি চাচ্ছিলাম আগুন–শুধু আগুন–সারা বিশ্বের আকাশে-বাতাসে, বাইরে-ভিতরে আগুন, আর তার মাঝে আমি দাঁড়াই আমারও বিশ্বগ্রাসী অন্তরের আগুন নিয়ে, আর দেখি কোন্ আগুন কোন্ আগুনকে গ্রাস করে নিতে পারে, আরও চাচ্ছিলাম মানুষের খুন! ইচ্ছা হয়, সারা দুনিয়ার মানুষগুলোর ঘাড় মুচড়ে চোঁ চোঁ করে তাদের সমস্ত রক্ত শুষে নিই, তবে আমার কতক তৃষ্ণা মেটে! কেন মানুষের ওপর আমার এত শত্রুতা? কী দুশমনি করেছে তারা আমার? তা আমি বলতে পারব না। তবে, তারা আমার দুশমন নয়, তবুও আমার তাদের রক্তপানে আকুল আকাঙ্ক্ষা। সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে এখানে যে, এই মানুষেরই এতটুকু দুঃখ দেখে সময় সময় আমার সারা বুক সাহারার মত হা হা করে আর্তনাদ করে ওঠে! হৃদয়ের এই যে দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত দুশমনিভাব, এর সূত্র কোথায়,–হায়, কেউ জানে না। অনেক অনধিকারী আমার এ জ্বালা, এ বেদনা বুঝবে না ভাবিসাহেবা, বুঝবে না। বড্ড ব্যস্ত, খালি ছুটোছুটি,–তারই মধ্যে তাড়াতাড়ি যা পারলাম, লিখে দিলাম। চিঠিটা দু-তিনবার পড়ে আমার বক্তব্য বুঝবার চেষ্টা করবেন।
তারপর আপনি মাহ্বুবার কথা লিখেছেন। সে অনেক কথা। এর সব কথা খুলে বলবার এখনও সময় আসেনি। তবে এখন এইটুকু বলে রাখছি আপনায় যে, মানুষকে আঘাত করে হত্যা করেই আমার আনন্দ! আমার এ নিষ্ঠুর পাশবিক দুশমনি মানুষের ওপর নয়, মানুষের স্রষ্টার ওপর। এই সৃষ্টিকর্তা যিনিই হন, তাঁকে আমি কখনই ক্ষমা করতে পারব না,–পারব না! আমাকে লক্ষ জীবন জাহান্নামে পুড়িয়েও আমায় কবজায় আনবার শক্তি ঐ অনন্ত অসীম শক্তিধারীর নেই। তাঁর সূর্য, তাঁর বিশ্ব গ্রাস করবার মত ক্ষুদ্র শক্তি আমারও অন্তরে আছে। আমি তাঁকে তবে ভয় করব কেন?… আপনি আমায় শয়তান বলবেন, আমার এ ঔদ্ধত্য দেখে কানে আঙুল দেবেন জানি,–ওহ, তাই হোক! বিশ্বের সবকিছু মিলে আমায় ‘শয়তান পিশাচ’ বলে অভিহিত করুক, তবে না আমার খেদ মেটে, একটু সত্যিকার আনন্দ পাই। আঃ!… যে মানুষের স্রষ্টাকে ভয় করিনে আমি, সেই মানুষকে ভয় করে আমার অন্তরের সত্যকে গোপন করব কেন? আমি কি এতই ছোট, এতই নীচ? আমার অন্তর মিথ্যা হতে দেব না!… হাঁ, কী বলছিলাম? আমি বিশ্বাসঘাতক–জল্লাদ! বাঁশির সুরে হরিণীকে ডেকে এনে তার বুকে বিষমাখা তলওয়ার চালিয়ে আর ‘জহর-আলুদা’ তীর হেনেই আমার সুখ। সে কী আনন্দ ভাবিসাহেবা, সে কী আনন্দ এই হত্যায়! আমার হাত-পা-বুক বজ্রের মত শক্ত হয়ে উঠছে!
কী আমায় মাতাল করে তুলছে আর সঙ্গে সঙ্গে যে কোন্ অনন্ত যুগের অফুরন্ত কান্না কণ্ঠ পর্যন্ত ফেনিয়ে উঠছে বিষের মত–তীব্র হলাহলের মত!–আর লেখার শক্তি নেই আমার!–ইতি।
নরপিশাচ–
নূরুল হুদা