» » পরিচ্ছেদ ঘ : পত্র এক

পরিচ্ছেদ ঘ : পত্র এক

১০ই ফাল্গুন

(নিঝুম রাত্তির)

ভাই সোফি!

অভিমানিনী, তুমি হয়ত এতদিনে আমার ওপর রাগ করে ভুরু কুঁচকে, ঠোঁট ফুলিয়ে, গুম হয়ে বসে আছ! কারণ আমি আসবার দিনে তোমার মাথা ছুঁয়ে দিব্যি করেছিলাম যে গিয়েই চিঠি দেব। আমার এত বড় একটা চুক্তির কথা আমি ভুলিনি ভাই, কিন্তু নানান কারণে, বারো জঞ্জালে পড়ে আমায় এরকমভাবে খেলো হয়ে পড়তে হল তোমার কাছে। সোজাভাবেই সব কথা বলি–এখানে পৌঁছেই বোন, আমার যত কিছু যেন ওলট পালট হয়ে গেছে, কী এক-বুক অসোয়াস্তি যেন বেরোবার পথ না পেয়ে শুধু আমার বুক-জোড়া পাঁজরের প্রাচীরে ঘা দিয়ে বেড়াচ্ছে। কদিন থেকে মাথাটা বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে আর মনে হচ্ছে, সেই সঙ্গে যেন দুনিয়ার যতকিছু আমার দিকে তাকিয়ে কেমন এক রকম কান্না কাঁদছে, আর সেই অকরুণ কান্নার যতির মাঝে মাঝে একটা নির্মম জীনের কাঠ-চোটা বিকট হাসি উঠছে হো–হো–হো! সামনে তার নিঝুম গোরস্থানের মত ‘সুম-সাম’ হয়ে পড়ে রয়েছে আমাদের পোড়ো-বাড়িটা। তারই জীর্ণ দেয়ালে অন্ধকারের চেয়েও কালো একটা দাঁড়কাক বীভৎস গলাভাঙা স্বরে কাতরাচ্ছে, ‘খাঁ–আঃ!–আঃ!’ দুপুর রোদ্দুরকে ব্যথিয়ে ব্যথিয়ে তারই পাশের বাজ-পড়া অশথ গাছটায় একটা ঘুঘু করুণ-কণ্ঠে কূজন কান্না কাঁদছে, ‘এস খুকু–উ–উ- উঃ!’ বাদলের জুলুমে আমাদের অনেক দিনের অনেক স্মৃতি-বিজড়িত মাটির ঘরটা গলে গলে পড়ছে,–দেখতে দেখতে সেটা একটা নিবিড় জঙ্গলে পরিণত হয়ে গেল–চারিধারে তার তেশিরে কাঁটা, মাঝে চিড়চিড়ে, আকন্দ, বোয়ান এবং আরও কত কী কাঁটাগুল্মের ঝোপ-ঝাড়, তাদের আশ্রয় করে ঘর বেঁধেছে বিছে, কেউটে সাপ, শিয়াল, খটাস,–ওঃ, আমার মাথা ঘুরছে, আর ভাবতে পারছিনে!… যখন মাথাটা বড্ড দপদপ করতে থাকে আর তারই সঙ্গে এই বীরভূমের একচেটে করে-নেওয়া ‘মেলেরে’ জ্বর (ম্যালেরিয়ার আমি এই বাংলা নাম দিচ্ছি!) হু-হু করে আসে, তখন ঠিক এই রকমের সব হাজার এলোমেলো বিশ্রী চিন্তা ছায়াচিত্রের মত একটার পর একটা মনের ওপর দিয়ে চলে যায়! আজ তাই ভাই সোফিয়া রে! বড় দুঃখেই বাবাজিকে মনে করে শুধু কাঁদছি–আর কাঁদছি! খোদা যদি অমন করে, তাঁকে আমাদের মস্ত দুর্দিনের দিনে ওপারে ডেকে না নিতেন, তা হলে কি আজ আমাদের এমন করে বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে পরের গলগ্রহ হয়ে ‘অন্‌হেলা’র ভাত গিলতে হত বোন? আজ এই নিশীথ-রাতে স্তব্ধ মৌন-প্রকৃতির বুকে একা জেগে আমি তাই খোদাকে জিজ্ঞাসা করছি–নিঃসহায় বিহগ-শাবকের ছোট্ট নীড়খানি দুরন্ত বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে তাঁর কী লাভ? ‘পাক’ তিনি, তবে একী পৈশাচিক আনন্দ রয়েছে তাঁহাতে? হায় বোন, কে বলে দেবে সে কথা?

তুই হয়ত আমার এসব ‘পাকামো’ ‘বুড়োমি’ শুনে ঝঙ্কার দিয়ে উঠবি, “মাগো মা! এত কথাও আসে এই পনর ষোল বছরের ছুঁড়ির! যেন সাতকালের বুড়ি আর কী!” কিন্তু ভাই, যাদের ছেলেবেলা হতেই দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে মানুষ হতে হয়, যাদের জন্ম হতেই টাল খেয়ে খেয়ে, চোট খেয়ে খেয়ে বড় হতে হয়, তারা এই বয়সেই এতটা বেশি গম্ভীর আর ভাবপ্রবণ হয়ে ওঠে যে, অনেকের চোখে সেটা একটা অস্বাভাবিক রকমের বাড়াবাড়ি বলেই দেখায়। অতএব যে জিনিসটা জীবনের ভেতর দিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব করিসনি, সেটাকে সমালোচনা করতে যাস নে যেন। যাক ওসব কথা। …

মা তাঁর বাপের বাড়ি বলে এখানে এসে এখন নতুন নতুন বেশ খুশিতেই আছেন। আমি জানি, তাঁর এ হাসি-খুশি বেশিদিন টিকবে না। তবুও কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না। আমার মনে সুখ নেই বলে অন্যকেও কেন তার ভাগী করব? তাছাড়া চির-দুঃখিনী মা আমার যদি তাঁর শোকসন্তপ্ত প্রাণে এই একটুখানি পাওয়া সান্ত্বনার স্নিগ্ধ প্রলেপ শুধু একটুক্ষণের জন্যেও পান, তবে তাঁর, মেয়ে হয়ে কোন্ প্রাণে তাঁকে সে আনন্দ হতে বঞ্চিত করব? এ-ভুল তো দু-দিন পরে ভাঙবেই আপনি হতে!–আর এক কথা, মায়ের খুশি হবার অধিকার আছে এখানে, কেননা এটা তাঁর বাপের বাড়ি। আর তারই উল্টো কারণে হয়েছে আমার মনে কষ্ট। অবশ্য আমিও নতুন জায়গায় (তাতে মামার বাড়ি) আসার ক্ষণিক আনন্দ প্রথম দু-একদিন অন্তরে অনুভব করেছিলাম, কিন্তু ক্রমেই এখন সে আনন্দের তীব্রতা কর্পূরের উবে যাওয়ার মত বড় সত্বরই উবে যাচ্ছে। হোক না মামার বাড়ি, তাই বলে যে সেখানে বাবার বাড়ির মত দাবি-দাওয়া চলবে, এ তো হতে পারে না। মানি, মামার বাড়ি ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয় আর লোভনীয় স্থান, কিন্তু যদি স্রেফ দু-চার দিনের মেহ্‌মান হয়ে শুভ পদার্পণ হয় সেখানে। যাঁরা মামার বাড়িতে স্থায়ী বন্দোবস্ত করে বা একটু বেশিদিনের জন্যে থেকেছেন, তাঁরাই একথার সারবত্তা বুঝতে পারবেন। অতিথিস্বরূপ দু-একদিন থেকে যাওয়াই সঙ্গত কুটুম বাড়িতে। আমি এখানে অতিথি মানে বুঝি যাঁদের স্থিতি বড় জোর এক তিথির বেশি হয় না। যিনি অতিথির এই বাক্যগত অর্থের প্রতি সম্মান না রেখে শার্দুলের লুব্ধা মাতৃষ্বসার মত আর নড়তেই চান না, তিনি তো স-তিথি। আর, তাঁর ভাগ্যে সম্মানও ঐ বাঘের মাসি বিড়ালের মত চাটু আর হাতার বাড়ি, চেলাকাঠের ধুমসুনী! এঁরাই আবার অর্ধচন্দ্র পেয়ে চৌকাঠের বাইরে এসে, আদর-আপ্যায়নের ত্রুটি দেখিয়ে বেইজ্জতির অজুহাতে চক্ষু দুটো উষ্ণ কটাহের মত গরম করে গৃহস্বামীর ছোটলোকত্বের কথা তারস্বরে যুক্তিপ্রমাণসহ দেখাতে থাকেন আর সঙ্গে সঙ্গে ইজ্জতের কান্নাও কাঁদেন। আহা! লজ্জা করে না এসব বেহায়াদের? এ যেন ‘চুরি কে চুরি উল্টো সিনাজুরি!’ থাক এসব পরের ‘গিল্লে’-চর্চা, এখন বুঝলি, মেয়েদের এই ‘ধান-ভানতে শিবের গীত’–এক কথা বলতে গিয়ে আরও সাত কথার অবতারণা করা আর গেল না। কথায় বলে ‘খস্‌লৎ যায় ম’লে।’–আমি বলছিলাম যে, আমার মত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কেউ যদি মামাদের ঘাড়ে ভর করে এসে বসে, তবে সেখানে সে বেচারির আবদার তো চলেই না, স্নেহ-আদরের ও দাবি-দাওয়ার একটা সপ্রতিভ অসংকোচ আর্জিও পেশ করা যায় না। একটা বিষম সংকোচ, অপ্রতিভ হওয়ার ভয়, সেখানে কালো মেঘের মত এসে দাঁড়াবেই দাঁড়াবে। যার ভেতরে এতটুকু আত্মসম্মান-জ্ঞান আছে, সে কখনই এরকমভাবে ছোট আর অপমানিত হতে যাবে না। ঐ কী বলে না, ‘আপনার ঢিপেয় কুকুর রাজা।’ কুকুরের স্বভাব হচ্ছে এই যে, যত বড়ই শত্রু হোক আর পেছন দিকে হাঁটবার সময় নেজুড় যতই কেন নিভৃততম স্থানে সংলগ্ন করুক, যদি একবার যো-সো করে নিজের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তবে আর যায় কোথা! আরে বাপরে বাপ! অমনি তখন তার বুক সাহসের চোটে দশ হাত ফুলে ওঠে। তাই তখন সে তার নেজুড় যতদূর সম্ভব খাড়া করে আমাদের মর্দ বাঙালি পুরুষ-পুঙ্গবদেরই মত তারস্বরে শত্রুকে যুদ্ধে আহ্বান করতে থাকে, কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও অবশ্যস্বীকার্য যে, এমন বীরত্ব দেখাবার সময়ও অন্তত অর্ধেক শরীর তার দোরের ভিতর দিকেই থাকে আর ঘনঘন দেখতে থাকে যে, তাড়া করলে ‘খেঁচে হাওয়া’ দেওয়ার মত লাইন ক্লিয়ার আছে কিনা। এই সারমেয় গোষ্ঠীর মত আমাদের দেশের পুরুষদেরও এখন দুটি মাত্র অস্ত্র আছে, সে হচ্ছে ষাঁড় বিনিন্দিত কণ্ঠের গগনভেদী চিৎকার আর মূল্য-বিনিন্দিত বড় বড় দন্তের পূর্ণ বিকাশ আর খিঁচুনি! তাই আমরা আজও মাত্র দুই জায়গায় বাঙালির বীরত্বের চরম বিকাশ দেখতে পাই; এক হচ্ছে, যখন এঁরা যাত্রার দলে ভীম সাজেন, আর দুই হচ্ছে, যখন এঁরা অন্দরমহলে এসে স্ত্রীকে ধুমসুনি দেন। হাঁ-হাঁ, আর এক জায়গায়,–যখন এঁরা মাইকেলি ছন্দ আওড়ান!… আর এঁরা এসব যে করতে পারেন, তার একমাত্র কারণ, তাঁদের সে সময় মস্ত একটা সান্ত্বনা থাকে যে, যতই করি না কেন, এ হচ্ছে ‘হামারা আপনা ঘর!’

এইখানে আর একটা কথা বলে রাখি ভাই! আমার চিঠিতে এই যে কর্কশ নির্মম রসিকতা নীরসতা আর হৃদয়হীন শ্লেষের ছাপ রয়েছে, এর জন্যে আমায় গালাগালি করিসনে যেন। আমার মন এখন বড় তিক্ত–বড় নীরস–শুষ্ক। সেই সঙ্গে অব্যক্ত একটা ব্যথায় জান শুধু ছটফট করছে। আর কাজেই আমার অন্তরের সেই নীরস তিক্ত ভাবটার ও হৃদয়হীন ব্যথার ছটফটানির ছোপ আমার লেখাতে ফুটে উঠবেই উঠবে।–যতই চেষ্টা করি না কেন, সেটাকে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারব না। এরকম সকলের পক্ষেই স্বাভাবিক। এই দ্যাখ না, আমার মনে যখন যে ভাব আসছে বিনা দ্বিধায় অনবরত লিখে চলেছি,–কোথাও সংযম নেই, বাঁধন নেই, শৃঙ্খলা–‘সিজিল’ কিচ্ছু নেই,–মন এতই অস্থির, মন এখন আমার এতই গোলমেলে!

হাঁ, মামার বাড়ির সকলে যেই জানতে পেরেছে যে, আমরা খাস-দখল নিয়ে তাঁদের বাড়ি উড়ে এসে জুড়ে বসার মত জড় গেদে বসেছি, অমনি তাঁদের আদর আপ্যায়নের তোড় দস্তুরমত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে! এটাও স্বাভাবিক। নতুন পাওয়ার আনন্দটা, নতুন পাওয়ার জিনিসের আদর তত বেশি নিবিড় হয়, সেটা যত কম সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। কারণ, নতুন ও হঠাৎ-পাওয়া আনন্দেরও একটা পরিমাণ আছে, আর সেই পরিমাণের তীব্রতাটা জিনিসের স্থিতির কালানুযায়ী কম-বেশি হয়ে থাকে। যেটার স্থিতিকাল মাত্র একদিন, সে ঐ আনন্দের সমগ্র তীব্রতা ও উষ্ণতা একদিনেই পায়। যেটা দশদিন স্থায়ী, সে ঐ সমগ্র আনন্দটা দশদিনে একটু একটু করে পায়। আমি এখন এই কথাটার সত্যতা হাড়ে হাড়ে বুঝছি। কারণ, অন্য সময় যখন এখানে এসেছি, তখন এই বাড়ির সকলে উন্মুক্ত হয়ে থাকত কিসে আমাদের খুশি রাখবে, দিন-রাত ধরে এত বেশি আদর-সোহাগ ঠেসে দিত যে, তার কোথাও এতটুকু ফাঁক থাকবার জো ছিল না। তাই তখন মামার বাড়ির নাম শুনলে আনন্দে নেছে উঠতাম। এখানে এসে দু’দিন পরে এখানটা ছেড়ে যেতেও কত কষ্ট হত! মামানি, নানি, মামু, খালাদের কোল থেকে নামতে পেতাম না। গায়ে একটু আঁচড় লাগলে অন্তত বিশ গণ্ডা মুখে জোর সহানুভূতির ‘আহারে! ছেলে খুন হয়ে গেল!’ ইত্যাদি কথা উচ্চারণ হত! তাই বলে মনে করিসনে যেন যে, আজও আমি তেমনি করে কোলে চড়ে বেড়াবার জন্যে উসখুস করছি, এখন আমি আর সে কচি খুকি নই। এখানকার মেয়েমহলের মতে–একটা মস্ত থুবড় ধাড়ি মেয়ে! এই রকম কত যে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয় দিনের মাথায়, তার আর সংখ্যা নেই। আর, যেখানকার পৌনে ষোল আনা লোকের মুখে-চোখে একটা স্পষ্ট চাপা বিরক্তির ছাপ নানান কথায় কাজের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়, সেখানে নিজেকে কতটুকু ছোট করে রাখতে হয়, জানটা কী রকম হাঁপিয়ে ওঠে সেখানে, ভাব দেখি! এই উপেক্ষার রাজভোগের চেয়ে যে ঘরের মাড়ভাত ভাল বোন! মামুজিরা আমায় খুবই স্নেহ করেন, কিন্তু তাঁরা তো দিন-রাত্তির ঘরের কোণে বসে থাকেন না যে সব কথা শুনবেন। আমার তিনটি মামানি তিন কেসেমের! তার ওপর আবার এক এক জনের চাল এক এক রকমের। কেউ যান ছার্তকে, কেউ যান কদমে, কেউ যান দুলকি চালে। কথায় কথায় টিপ্পনী, কিন্তু মামুজিদের ঘরে দেখলেই আমাদের প্রতি তাঁদের নাড়ির টান ভয়ানক রকমের বেড়ে ওঠে, আমাদের পোড়া কপালের সমবেদনায় পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বা উনুনে কাঁচা কাঠ দিয়ে অঝোর নয়নে কাঁদেন! মামুজিরা বাইরে গেলেই আবার মনের ঝাল ঝেড়ে পূর্বের ব্যবহারের সুদসুদ্ধ আদায় করে নেন। আমি তো ভাই ভয়েই শশব্যস্ত। তাঁদের এক একটা চাউনিতে যেন আমার এক এক চুম্বন রক্ত শুকিয়ে যায়। দু-এক সময় মনে হয়, আর বরদাস্ত করতে পারিনে, সকল কথা খুলে বলি মামুজিদের, তারপর আমাদের সেই ভাঙা কুঁড়েতেই ফিরে যাই। কিন্তু এতটুকু টুঁ শব্দ করলেই অমনি রং-বেরঙের গলায় মিঠেকড়া প্রতিবাদ ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। ঘরের আণ্ডাবাচ্চা মায় বাড়ির ঝি পুঁটি বাগদি পর্যন্ত তখন আমার ওপর টীকা-টিপ্পনীর বাণ বর্ষণ করতে আরম্ভ করেন। এঁদের সর্ববাদীসম্মত মত এই যে, থুবড় আইবুড়ো মেয়ের সাত চড়ে রা বেরোবে না, কায়াটি তো নয়ই, ছায়াটি পর্যন্ত কেউ দেখতে পাবে না, গলার আওয়াজ টেলিফোন যন্ত্রের মত হবে, কেবল যাকে বলবে সেই শুনতে পাবে,–বাস্! খুব একটা বুড়োটে ধরনের মিচকেমারা গম্ভীর হয়ে পড়তে হবে, থুবড় মেয়ে দাঁত বের করে হাসলে নাকি কাপাস মহার্ঘ হয়! কোন অলঙ্কার তো নয়ই, কোন ভাল জিনিসও ব্যবহার করতে বা ছুঁতেও পাবে না, তাহলে যে বিয়ের সময় একদম ‘ছিরি’ (শ্রী) উঠবে না। ঘরের নিভৃততম কোণে ন্যাড়া বোঁচা জড়-পুঁটুলি ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে চুপসে বসে থাক!–এই রকম সে কত কথা ভাই, ওসব বার ‘ভজকট’ আমার ছাই মনেও থাকে না আর শুনতে শুনতে কানও ভোঁতা হয়ে গেছে। ‘কান করেছি ঢোল, কত বলবি বোল!’ তাছাড়া একথা অন্যকে বলেই বা কী হবে? কেই বা শুনবে আর কারই বা মাথা ব্যথা হয়েছে আমাদের পোড়াকপালিদের কথা শুনতে! খোদা আমাদের মেয়ে জাতটাকে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতেই পাঠিয়েছেন, আমাদের হাত-পা যেন পিঠমোড়া করে বাঁধা, নিজে কিছু বলবার বা কইবার হুকুম নেই। খোদা-না-খাস্তা একটু ঠোঁট নড়লেই মহাভারত অশুদ্ধ আর কী! কাজেই, আছে আমাদের শুধু অদৃষ্টবাদ, সব দোষ চাপাই নন্দ-ঘোষস্বরূপ অদৃষ্টেরই ওপর! সেই মান্ধাতার আমলের পুরোনো মামুলি কথা, কিন্তু অদৃষ্ট বেচারা নিজেই আজতক অ-দৃষ্ট! … আমাদের কর্ণধার মর্দরা কর্ণ ধরে যা করান তাই করি, যা বলান তাই বলি! আমাদের নিজের ইচ্ছায় করবার বা ভাববার মত কিছুই যেন পয়দা হয়নি দুনিয়ায় এখনও–কারণ আমরা যে খালি রক্ত-মাংসের পিণ্ড! ভাত রেঁধে, ছেলে মানুষ করে আর পুরুষ দেবতাদের শ্রীচরণ সেবা করেই আমাদের কর্তব্যের দৌড় খতম! বাবা আদমের কাল থেকে ইস্তকনাগাদ নাকি আমরা ঐ দাসীবৃত্তিই করে আসছি, কারণ হজরত আদমের বাম পায়ের হাড্ডি হতে প্রথম মেয়ের উৎপত্তি। বাপরে বাপ! আজ সেই কথা টলবে? এসব কথা মুখে আনলেও নাকি জিভ খসে পড়ে। কোন্ কেতাবে নাকি লেখা আছে, পুরুষদের পায়ের নীচে বেহেশ্‌ত, আর সেসব কেতাব ও আইন-কানুনের রচয়িতা পুরুষ!…দুনিয়ার কোন ধর্মই আমাদের মত নারীজাতিকে এতটা শ্রদ্ধা দেখায়নি, এত উচ্চ আসনও দেয়নি, কিন্তু এদেশের দেখাদেখি আমাদের রীতি-নীতিও ভয়ানক সংকীর্ণতা আর গোঁড়ামি ভণ্ডামিতে ভরে উঠেছে। হাতে কলমে না করে শুধু শাস্ত্রের দোহাই পাড়লেই কি সব হয়ে গেল?

আর শুধু পুরুষদেরই বা বলি কেন, আমাদের মেয়েজাতটাও নেহাত ছোট হয়ে গেছে, এদের মন আবার আরও হাজার কেসেমের বেখাপ্পা বেয়াড়া আচার-বিচারে ভরা, যার কোন মাথাও নেই, মুণ্ডুও নেই! এই ধর না এই বাড়িরই কথা। ভয়ানক অন্যায় আর অত্যাচার যেটা, চির-অভ্যাস মত সেটার বিরুদ্ধে একটু উচ্চবাচ্য করতে গেলেই অমনি গুষ্টিসুদ্ধ মেয়ে দঙ্গল আমার ওপর ‘মারমূর্তি’ হয়ে উঠবে আর গলা ফেড়ে চেঁচিয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলবে,–“মাগো মা, মেয়ে নয় যেন সিঙ্গিচড়া ধিঙ্গি! এ যে জাঁদরেল জাহাঁবাজ মরদের কাঁধে চড়ে যায় মা! আমরা তো দেখে আসছি, সাত চড়ে থুবড় মেয়ের রা বেরোয় না, আর আজকালকার এই কলিকালের কচি ছুঁড়িগুলো–যাদের মুখ টিপলে এখনও দুধ বেরোয়, তাদের কিনা সবতাতেই মোড়লি সাওকুড়ি আবার মুখের ওপর চোপা! মুখ ধরে পুঁয়ে মাছের মত রগড়ে দিতে হয়, তবে না থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যায়! আমাদেরও বয়েস ছিল গো, আজ নয়ত বুড়ি হয়েছি, কই বলুক তো, কে বাপের বেটি আছে,–ছায়াটি পর্যন্ত দেখতে পেয়েছে! তাতে আর কাজ নেই! একটু জোরে কাশলেও যেন শরমে শরমে মরে যেতাম, আর এখনকার ‘খলিফা’ মেয়েদের কথায় কথায় ফোঁপরদালালি,–যেন, অজবুড়ি!‌ যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!”…সময় কাটবে বলে ভাবিজির কাছ হতে দু’চারটে বই আর মাসিকপত্র সঙ্গে এনেছি, এই না দেখে এরা তো আর বাঁচে না! গালে হাত দিয়ে কতরকমেরই না অঙ্গভঙ্গি করে জানায় যে, রোজকেয়ামত এইবারে একদম নিকটে! একটু পড়তে বসলে চারিদিক থেকে ছেলেমেয়ে বুড়িরা সব উঁকি মেরে দেখবে আর ফিসফিস করে কত কী যে বলবে তার ইয়ত্তা নেই। আমি নাকি আমার বিদ্যে জাহির করতে তাদের দেখিয়ে বই পড়ি, তাই তারা রটনা করেছে যে, আমি দু’দিন বাদে মাথায় পাগড়ি বেঁধে কাছা মেরে জজ ম্যাজিস্টর হয়ে য়্যা চেয়ারে বসব গিয়ে! আমি তো এদের বলবার ধরন দেখে আর হেসে বাঁচিনে! মেয়েদের চিঠি লেখা শুনলে তো এরা যেন আকাশ থেকে পড়ে! মাত্র নাকি এই কলিকাল, এরা বেঁচে থাকলে কালে আরও কত কী তাজ্জব ব্যাপার চাক্ষুষ দেখবেন! তবে এঁরা যে আর বেশিদিন বাঁচবেন না, এই একটা মস্ত সান্ত্বনার কথা! আমাদের এই ধিঙ্গি মেমগুলোই নাকি এদের জাতের ওপর ঘেন্না ধরিয়ে দিলে; এইসব ভেবে ভেবে ওদের রাত্তির বেলায় ভাল করে নিদ হয় না, আর তারই জন্যে তাদের অনেকেরই চোখে ‘গোগাল’ পড়ে গেছে!…এই রকম সব অফুরন্ত মজার কথা–যেসব লিখতে গেলে আর একটা ‘গাজি মিয়াঁর বস্তানি’ না মধু মিয়াঁর দফতর হয়ে যাবে! তবু এতগুলো কথা তোকে জানিয়ে আমি আমার মনটা অনেক হালকা করে নিলাম। আমার শুধু ইচ্ছে করছে, তোর সঙ্গে বসে তিনদিন ধরে এদের আরও কত কী মজার গল্প নিয়ে আলোচনা করি, তবে আমার সাধ মেটে! তাই যা মনে আসছে, যতক্ষণ পারি লিখে যাই তো! কেননা, জানি না আবার কখন কতদিন পরে এঁদের চক্ষু এড়িয়ে তোকে চিঠি লিখতে পারব। এখনও মনের মাঝে আমার লাখো কথা জমে রইল। ডাকে চিঠি দিলাম না, তাহলে তো লঙ্কাকাণ্ড বেধে যেত! তাই এই পত্রবাহিকা এলোকেশী বাগদির মারফতেই খুব চুপি চুপি চিঠিটা পাঠালাম। আমাদের গাঁয়ের ও পাড়ার মালকা বিবিকে মনে আছে তোর? ইনি সেই ‘পাড়া-কুঁদুলি মালকা’ যিনি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মেয়েদের সাথে ছেলেবেলায় কোঁদল করে বেড়াতেন। আমার এক মামাতো ভাইয়ের সাথে এঁর বিয়ে হয়েছে, তুই তো সব জানিস। এঁর ভাইয়ের নাকি বড্ড ব্যামো, তাই এলোকেশী ঝিকে খবর নিতে পাঠাচ্ছেন। তাঁকে বলেই এই চিঠিটা এমন লুকিয়ে পাঠাতে পারলাম! মালকা প্রায়ই আমার কাছে এসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে, আমিও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। বেচারি এখন বড্ড শায়েস্তা হয়ে গেছে। তার মস্ত বড় সংসারের মস্ত ভার ঐ বেচারির একা ঘাড়ে। …চিঠিটা যত বড়ই হোক না কেন, আমি আজ আমার জমানো সব কথা জানিয়ে তবে ছাড়ব। দশ ফর্দ চিঠি দেখে হাসিসনে, বা ফেলে দিসনে যেন। এই চিঠি লিখতে বসে আর লিখে কী যে আরাম পাচ্ছি, সে আর কী বলব! আমার মনের চক্ষে এখন তোর মূর্তিটি ঠিক ঠিক ভেসে উঠছে।

সত্যি বলতে কী ভাই,–রাত্তির-দিন এই দাঁত-খিঁচুনি আর চিবিয়ে চিবিয়ে গঞ্জনা দেখে শুনে এই সোজা লোকগুলোর ওপর বিরক্তি আসে বটে, তবে ঘেন্না ধরেনি। এদের দেখে মানুষের দয়া হওয়াই উচিত! এর জন্য দায়ী কে?–পুরুষরাই তো আমাদের মধ্যে এইসব সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এমন কেউ কি নেই আমাদের ভেতর যিনি এইসব পুরুষদের বুঝিয়ে দেবেন যে, আমরা অসূর্যম্পশ্যা বা হেরেম-জেলের বন্দিনী হলেও নিতান্ত চোর-দায়ে ধরা পড়িনি। অন্তত পর্দার ভিতরেও একটু নড়ে চড়ে বেড়াবার দখল হতে খারিজ হয়ে যাইনি। আমাদেরও শরীর-রক্ত-মাংসে গড়া; আমাদের অনুভবশক্তি, প্রাণ, আত্মা সব আছে। আর তা বিলকুল ভোঁতা হয়ে যায়নি। আজকাল অনেক যুবকই নাকি উচ্চশিক্ষা পাচ্ছেন, কিন্তু আমি একে উচ্চশিক্ষা না বলে লেখাপড়া শিখছেন বলাই বেশি সঙ্গত মনে করি। কেননা, এঁরা যত শিক্ষিত হচ্ছেন, ততই যেন আমাদের দিকে অবজ্ঞার হেকারতের দৃষ্টিতে দেখছেন, আমাদের মেয়ে জাতের ওপর দিন দিন তাঁদের রোখ চড়েই যাচ্ছে। তাঁরা মহিষের মত গোঙানি আরম্ভ করে দিলেও কোন কসুর হয় না, কিন্তু দৈবাৎ যদি আমাদের আওয়াজটা একটু বেমোলায়েম হয়ে অন্তঃপুরের প্রাচীন ডিঙিয়ে পড়ে, তাহলে তাঁরা প্রচণ্ড হুঙ্কারে আমাদের চৌদ্দ পুরুষের উদ্ধার করেন। ওঁদের যে সাত খুন মাফ! হায়! কে বলে দেবে এঁদের যে, আমাদেরও স্বাধীনভাবে দুটো কথা বলবার ইচ্ছে হয় আর অধিকারও আছে, আমরাও ভালমন্দ বিচার করতে পারি। অবশ্য, অন্যান্য দেশের মেয়ে বা মেমসাহেবদের মত মর্দানা লেবাস পরে ঘোড়ার সওয়ার হয়ে বেড়াতে চাই নে বা হাজার হাজার লোকের মাঝে দাঁড়িয়ে গলাবাজিও করতে রাজি নই, আমরা চাই আমাদের এই তোমাদের গড়া খাঁচার মধ্যেই একটু সোয়াস্তির সঙ্গে বেড়াতে চেড়াতে; যা নিতান্ত অন্যায়, যা তোমরা শুধু খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে করে থাক সেইগুলো থেকে রেহাই পেতে! এতে তোমাদের দাড়ি হাসবে না বা মান-ইজ্জতও খোওয়া যাবে না, আর সেই সঙ্গে আমরাও একটু মুক্ত নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচব, রাত্তির দিন নানান আগুনে সিদ্ধ আমাদের হাড়ে একটু বাতাস লাগবে! তোমরা যে খাঁচায় পুরেও সন্তুষ্ট নও, তার ওপর আবার পায়ে হাতে গলায় শৃঙ্খল বেঁধে রেখেছ, টুঁটি টিপে ধরেছ,–থামাও, এ সব জুলুম থামাও! তোমরা একটু উদার হও, একটু মহত্ত্ব দেখাও,–এতদিনকার এইসব একচোখা অত্যাচারের, সঙ্কীর্ণতার খেসারতে এই এক বিন্দু স্বাধীনতা দাও,–দেখবে আমরাই আবার তোমাদের নতুন শক্তি দেব, নতুন করে গড়ে তুলব। দেশ-কাল-পাত্রভেদে, যেটুকু দরকার, আমরা কেবল তাই-ই চাইছি, তার অধিক আমরা চাইবই বা কেন আর চাইলেই তোমরা দেবে কেন?…যাক বোন, আমাদের এসব কথা নিয়ে, অধিকার নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে শেষে কি ‘আয়রে বাঘ–না গলায় লাগ’-এর মত কোন সমাজপতির এজলাসে পেশ হব গিয়ে, অতএব এইখানেই এসব অবান্তর কথায় ধামাচাপা দিলাম।

আমার এইসব যা-তা বাজে বকুনির মধ্যে বোধ হয় আমার বক্তব্যের মূল সূত্রটা ধরতে পেরেছিস। দিন-রাত্তির মনটা আমার খালি উড়ু উড়ু করছে, অথচ মনের এ ভাব-গতিকের রীতিমত কারণও খুঁজে পাচ্ছিনে। এমন একটা সময় আসে, যখন মনটা ভয়ানক অস্থির হয়ে ওঠে–অথচ কেন যে অমন হয়, কিসের জন্যে তার সে ব্যথিত ছটফটানি, তা প্রকাশ করা তো দূরের কথা, নিজেই ভাল করে বুঝে উঠা যায় না! সে বেদনার কোথায় যেন তল, কোথায় যেন তার সীমা! অবশ্য রেশ কাঁপছে তার মনে, কিন্তু সে কোন্ চিরব্যথার অচিন-বন পারিয়ে আসছে এ রেশ, আর কোন্ অনন্ত আদিম বিরহীর বীণের বেদনে ঝঙ্কার পেয়ে? হায়, তা কেউ জানে না! অনুভব করবে কিন্তু প্রকাশ করতে পারবে না!…আমার এরকম মন খারাপ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলবে তুমি, কিন্তু ভাই, আমি যে কোন লোকের মাথায় হাত দিয়ে বলতে পারি যে, সেসব মামুলি ব্যথা-বেদনার জন্যে অন্তরে এমন দরদ আসতেই পারে না। এ যেন কেমন একটা মিশ্র বেদনা গোছের; জানের আনচান ভাব, মরমের নিজস্ব মর্মব্যথা যা মনেরও অনেকটা অগোচর। একটা কথা আমি বলতে পারি;–যিনি যতই মানব চরিত্রের ঘুণ হন, তিনি নিশ্চয়ই নিজের মনকে পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারেন না। স্রষ্টার এইখানেই মস্ত সৃজন-রহস্য ছাপানো রয়েছে। আর এ আমাদের মনের চিরন্তন দুর্বলতা,–একে এড়িয়ে চলা যায় না!…আহ্! আহ্!! দাঁড়া বোন,–আবার আমার বুকে সে-কোন্ আমার চির-পরিচিত সাথীর তাড়িয়ে দেওয়া চপল-চরণের ছেঁড়া-স্মৃতি মনের বনে খাপছাড়া মেঘের মত ভেসে উঠছে! সে কোন্ অজানার কান্না আমার মরমে আর্ত প্রতিধ্বনি তুলছে! দাঁড়া ভাই, একটু পানি খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে তবে লিখব! কেন হয় ভাই এমন? কেন বুকভরা অতৃপ্তির বিপুল কান্না আমার মাঝে এমন করে গুমরে ওঠে? কেন?–আঃ, খোদা!

* * *

বাহা রে! চিঠিটা শেষ না করেই দেখছি দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! …

হাঁ,–এখন, ভাবিজিকে বলিস, যেন ওমাসের আর এমাসের সমস্ত মাসিক পত্রিকাগুলো এরই হাতে পাঠিয়ে দেন। ভুললে চলবে না। আর, তাঁকে বলবি, যেন আমায় মনে করে চিঠি দেন। সকলকে চিঠি লিখবার সময় কই, আর সুবিধাই বা কোথা। নইলে সকলকে আলাদা আলাদা চিঠি দিতাম। তুই ওঁদের সব কথা বুঝিয়ে বলবি, যেন কেউ অভিমান না করেন। আমি কাউকে ভুলিনি। সবাই যেন আমায় চিঠি দেন কিন্তু–হেঁ! আমার মতন তাঁদের তো এরকম জিন্দান-কুঁয়ায় পড়ে থাকতে হয়নি! কাজেই কারুর আর কোন ওজর শুনছিনে। ভাবিজি, ভাইজি, মা, সবাই আমায় আর মনে করেন কি?–তারপর, এসব তো হল, এখনও যে আদত মানুষটিই বাকি! আমার পিয়ারের খুকুমণি ‘আনারকলি’ কেমন আছে? এখানে কোন ছেলেমেয়ে দেখলেই আমার খুকুরানির কথা মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে চোখও ছলছল করে ওঠে! আমার এই দুর্বলতায় আমার নিজের কত লজ্জা পায়। কারণ তোরা হয়ত মনে করবি এ একটা বাড়াবাড়ি। ঐ এক টুকরো ছোট্ট মেয়েটাকে আমি যে কত ভালবেসেছি, তা তোরা বুঝবি কী ছাই-পাঁশ? কথায় বলে, ‘বাঁজায় জানে ছেলের বেদন!’ অবিশ্যি আমিও যদিচ এখনও তোদেরই মত ন্যাড়া বোঁচা, কিন্তু আমার মন তো আর বাঁজা নয়! এরই মধ্যে তোর গোলাবি গাল হয়ত শরমে লাল হয়ে গেছে! কিন্তু রোসো, আরও শোন! মনে কর, আমি যদি বলি যে, আমার নিজের একটা মেয়ে থাকলে আমি ভাবিজির সঙ্গে অদল-বদল করতাম, তাহলে তুই বিশ্বাস করিস? দাঁড়া, এখনই ধেই ধেই করে খেমটাওয়ালিদের মত নেচে দিসনে যেন রাগের মাথায়; আরও একটু শুনে যা–সত্যি বলতে কি সোফি, আমারও একটি ঐরকম ছোট্ট আনারকলির মা হতে বড্ড সাধ হয়! কথাটি নিশ্চয়ই তোর মতন চুলবুলে ‘লাজের মামুদ’-এর কাছে কাঁচা ছুঁড়ির মুখে পাকা বুড়ির কথার মত বেজায় বেখাপ্পা শুনাল, না? বুঝবি লো, তুইও বুঝবি দু’দিন বাদে আমার এই কথাটি! এখন শরমে তোর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠছে, গোস্বায় তোর পাতলা রাঙা ঠোঁট ফুলে ফুলে কাঁপছে (আহা, ঠিক আমের কচি কিশলয়ের মত!) কিন্তু এই গায়েবি খবর দিয়ে রাখলাম, এ গরিবের কথা বাসি হলে ফলবেই ফলবে! মেয়েদের যে মা হওয়ার কত বেশি শখ আর সাধ, তা মিথ্যা না বললে কেউ অস্বীকার করবে না! কী একটা ভাল বইয়ে পড়েছিলাম যে, আমাদেরই মা আমাদের মধ্যে বেঁচে রয়েছেন! তলিয়ে বুঝে দেখলে কথাটা সুন্দর সত্যি আর স্বাভাবিক বোধ হয়।–হাঁ, কিন্তু দেখিস ভাই লক্ষ্মীটি, তোর পায়ে পড়ছি, ভাবিজিকে এসব কথা জানতে দিসনে যেন। শ্রীমতী রাবেয়া যার নাম, তিনি যে এসব কথা শুনলে আমায় সহজে ছেড়ে দেবেন, তা জিবরাইল এসে বললেও আমি বিশ্বাস করব না। একে তো দুষ্টু বুদ্ধিতে তিনি অজেয়, তার ওপর একাধারে তিনি আমার গুরু বা ওস্তাদ আর ভাবিজি সাহেবা! (সেই সঙ্গে রামের সুগ্রীব সহায়ের মত তুমিও পিছনে ঠেলা দিতে কি কসুর করবে?) নানাদিক দিয়ে দেখে আমি চাই যে, আমার সবকিছু যেন চিচিং-ফাঁক না হয়ে যায়! কেননা এ হচ্ছে স্রেফ তোতে-আমাতে দু’সই-এ গোপন কথা। এখানে বাজে লোকের প্রবেশ নিষেধ।

এতটা বেহায়াপনা করে সাত কালের বুড়ি মাগির মত এত কথা এমন করে খুলে কী করে লিখতে পারলাম দেখে হয়ত তুই ‘আই–আই–গালে কালি মা!’ ইত্যাদি অবাক-বিস্ময়ের বাণী উচ্চারণ করছিস; কিন্তু লিখতে বসে দেখবি যে, মেয়েতে-মেয়েতে (তার ওপর আবার তারা তোর আমার মত সই হলে আর দূর দেশে থাকলে তো কথাই নেই!) যত মন খুলে সব কথা অসঙ্কোচে বলতে বা লিখতে পারে, অমনটি কেউ আর পারে না। পুরুষরা মনে করে, তাদের বন্ধুতে-বন্ধুতে বসে যত খোলা কথা হয়, অমন বোধ হয় আমাদের মধ্যে হয় না; কিন্তু তারা যদি একদিন লুকিয়ে মেয়েদের মজলিসে হাজিরা দিতে পারে, তাহলে তারা হয়ত সেইখানেই মেয়েদের পায়ে গড় করে আসবে। ওসব কথা এখন যেতে দে, কিন্তু আমি ভাই সত্যি সত্যি মনের চোখে দেখছি, তুই এতক্ষণ লাফিয়ে-চিল্লিয়ে তোর সেই বাঁধা বুলিটা আওড়াচ্ছিস, ‘মাহ্‌বুবাকে বই পড়িয়ে পড়িয়ে ভাবিজি একদম লজঝড় করে তুলেছেন!’ আর সেই সঙ্গে আমার দুঃখও হচ্ছে এই ভেবে যে, তুই এখন আর কাকে আঁচড়াবি কামড়াবি? পোড়াকপাল, বরও জুটল না এখনও যে, বেশ এক হাত হাতাহাতি খামচা-খামচি লড়াইটা দেখেও একটু আমোদ পাই! আল্লারে আল্লাহ্! আমাদের এই তথাকথিত শরিফের ঘরে শুধু ঝুড়ি-ঝুড়ি থুবড় ধাড়ি মেয়ে! বর যে কোথা থেকে আসবে তার কিন্তু ঠিক-ঠিকানা নেই!…

তারপর, আমি চলে আসবার পর খুকি আমায় খুঁজেছিল কি? আমার কেবলই মনে হচ্ছে, যেন খুকি খুব বায়না ধরেছে, মাথা কুটে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে, আর তোরা কেউ এই দুলালি আবদেরে প্রাণীটির জিদ থামাতে পারছিসনে। আমায় দেখলেই কিন্তু কান্নার মুখে পূর্ণ এক ঝলক হাসি ফুটে উঠত এই মেয়ের মুখে, ঠিক ছিন্ন মেঘের ফাঁকে রোদ্দুরের মত! কেন অমন হত জানিস? আমি মানুষ বশ করার ওষুধ জানি লো, ওষুধ জানি। বশ করতে জানলে অবাধ্য জানোয়ারকে বশ করাই সবচেয়ে সহজ!

আরও কত কথা মনে হচ্ছে, কিন্তু লিখে শেষ করতে পারছিনে। তাছাড়া, একটা কথা লিখবার সময় আর একটা কথার খেই হারিয়ে ফেলছি। মনের স্থৈর্যের দরকার এখানে। কিন্তু হায়, মন যে আমার ছটফটিয়ে মরছে! ঘুমুই গিয়ে এখন, ভোর হয়ে এল। কেউ কোথাও জাগেনি, কিন্তু একটা পাপিয়া ‘চোখ গেল, উহু চোখ গেল’, করে চেঁচিয়ে মরছে। কে তার এই কান্না শুনছে তার সে খবরও রাখে না।

খুব বড় চিঠি না দিস যদি, তাহলে আমার মাথা খাস! বুঝলি?

তোর ‘কলমিলতা’-

মাহ্‌বুবা

পুনশ্চ–

নুরুল হুদা ভাইজির কোন খবর পেয়েছিস কী? তিনি চিঠিতে কী সব কথা লেখেন?–মাহ্‌বুবা।