পরিচ্ছেদ ঘ : পত্র দুই
সালার
১৩ইফাল্গুন
সই মাহ্বুবা!
এলোকেশী দূতীর মারফত তোর চিঠিটা পেয়ে যেন আমার মস্ত একটা বুকের বোঝা নেমে গেল। বাস্রে বাস্! এত বড় দস্যি মেয়ে তুই! কী করে এতদিন চুপ করে ছিলি? জানটা যেন আমার রাত-দিন আই-ঢাই করত। এখন আমার মনে হচ্ছে যেন আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। যেদিন চিঠিটা পাই, সেদিনকার রগড়টা শোন আগে। তারপর সব কথা বলছি!–পরশু বিকেলে তোর ঐ বিন্দে দূতী মহাশয়া যখন আমাদের বাড়ির দোরে শুভ পদার্পণ করছেন, তখন দেখি, এক পাল দুষ্টু ছেলে তার পিছু নিয়েছে আর সুর-বেসুরের আওয়াজে চিৎকার করছে, ‘আকাশে সরষে ফোটে, গোদা ঠ্যাং লাফিয়ে ওঠে!’ আর বাস্তবিকই তাই–ছেলেদেরই বা দোষ কী! বুড়ির পায়ে যে সাংঘাতিক রকমের দু’টি গোদ, তা দেখে আমারই আর হাসি থামে না। আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল যে, আল্বোর্জ-পাহাড়-ধ্বংসী রুস্তমের গোর্জের মত এই মস্ত ঠ্যাং দুটো বয়ে এই মান্ধাতার আমলের পুরানো বুড়ি এত দূর এল কী করে! ভাগ্যিস বোন, ভাইজি তখন দলিজে বসে এসরাজটা নিয়ে ক্যাঁ কোঁ করছিলেন, নইলে এসব পাখোয়াজ ছেলেরা বুড়িকে নিশ্চয়ই সেদিন ‘কীচকবধ’ করে দিত। মাগি রাস্তা চলে যত না হয়রান হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পেরেশান হয়েছিল ঐ ছ্যাঁচড় ছেলে-মেয়ের দঙ্গলকে সপ্তস্বরে পূর্ণ বিক্রমে গালাগালি করাতে আর ধূলা-বালি ছুঁড়ে তাদের জব্দ করবার বৃথা চেষ্টায়। ঘরে এসে যখন সে বেচারি ঢুকল, তখন তার মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে, ভিজে ঢাকের মত গলা বসে গেছে! ভাবিজি তাড়াতাড়ি তাকে শরবত করে দেন, মাথায় ঠাণ্ডা পানি ঢেলে তেল দিয়ে পাখা করে দেন, তবে তখন বেচারির ধড়ে জান আসে! ওর সে সময়কার অবস্থা দেখে আমার এত মায়া হতে লাগল! কিন্তু কী করি, আমি তো আর বেরোতে পারিনে ভাই, কেউ আর আমায় অচেনা লোকের কাছে বের হতে দেয় না। ভাইজান বলেন বটে, কিন্তু তাঁর কথা কেউ মানে না। ও নিয়ে আমি কত কেঁদেছি, ঝগড়া করেছি ওঁদের কাছে। লোকে আমায় দেখলে বোধ হয় আমার ‘উচকপালি’ ‘চিরুনদাঁতি’র কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে! না? যাক,–আমি প্রথমে তো তাকে দেখে জানতে পারিনি যে, সে তোদের শাহপুর থেকে আসছে। পরে ভাবিজির কাছে শুনলাম যে, সে তোদের ওখান থেকে জবরদস্ত একখানা চিঠি নিয়ে এসেছে। ভাবিজি প্রথমে তো কিছুতেই চিঠি দিতে চান না, অনেক কাড়াকাড়ি করে না পেরে শেষে যখন জানলাটায় খুব জোরে জোরে মাথা ঠুকতে লাগলাম আর ভাইজান এসে ওঁকে খুব এক চোট বকুনি দিয়ে গেলেন, তখন উনি রেগে চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আমার দিকে। আমার তখন খুশি দেখে কে! রাগলেনই বা, ওঃ উনি রাগলে আমার বয়েই গেল আর কী! তাই বলে আমার চিঠি ঐসব বেহায়া ধাড়িকে পড়তে দিই,–আবদার! এইসব কলহ-কেজিয়া করতেই সাঁঝ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালিয়ে দোর বন্ধ করে তোর চিঠিটা পড়তে লাগলাম। প্রথম খানিকটা পড়ে আর পড়তে পারলাম না। আমারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আসছিল। আচ্ছা ভাই ‘কলমিলতা’! তুই মনে ভাবছিস হয়ত যে, আমি এখানে খুবই সুখে আছি। তা নয় সই, তা নয়। তোকে ছেড়ে আমার দিনগুলো যে কীরকম করে কাটছে, তা যদি তুই জানতিস, তাহলে এত দুঃখেও তোর আমার জন্যে কষ্ট হত। আমি যে তোদের ঐ শূন্যপুরী ঘরটার দিকে তাকালেই কেঁদে ফেলি বোন! আমাদের ঘরের সব কিছুতেই যে তোর ছোঁয়া এখনও লেগে রয়েছে। তাই মনে হয়, এখানের সকল জিনিসই তোকে হারিয়ে একটা মস্ত শূন্যতা বুকে নিয়ে হা-হা করে কাঁদছে। সেই সঙ্গে আমারও যে বুক ফেটে যাওয়ার জো হয়েছে!–পোড়া কপাল তোর! মামার বাড়িতেও এই হেনস্থা, অবহেলা! যখন যার কপাল পোড়ে, তখন এমনই হয়। তোর পোড়ারমুখি আবাগি মামানিদের কথা শুনে রাগে আমার গা গিসগিস করছে! ইচ্ছে হয়, এই জাতের হিংসুটে মেয়েগুলোর চুল ধরে খুব কষে শ-খানিক দুমাদ্দম কিল বসিয়ে দিই পিঠে, তবে মনের ঝাল মেটে! জানি, ও দেশের মেয়েরা ঐরকম কোঁদুলে হয়। দেখেছিস তো, ও পাড়ার শেখদের বউ দুটো? বাপরে বাপ, ওরা যেন চিলের সঙ্গে উড়ে ঝগড়া করে! মেয়ে তো নয়, যেন কাহারবা! তোদের কথা শুনে মা, ভাবিজি, ভাইজান কত আপশোশ করতে লাগলেন। তোদের উঠে যাওয়ার সময় মা এত করে বুঝালেন তোর মাকে, তা খালাজি কিছুতেই বুঝলেন না। কেন বোন, এও তো তাঁরই বাড়ি! মা-জান সেদিন তোদের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন, আর কত আর্মান করতে লাগলেন যে, আমি তো তাদের নিজের করতে চাইলাম, আর জানতামও চিরদিন নিজের বলেই, তা তারা আমাদের এ দাবির তো খাতির রাখলে না। মাহ্বুবাকে তো নিজের বেটিই মনে করতাম, তা ওর মা ওকেও আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল! কী করি, জোর তো নেই!…এই রকম আরও কত আক্ষেপের কথা! এখানে ফিরে আসবার জন্যে মাও ফের চিঠি দেবেন খালাজিকে, আজ ঐ নিয়ে ভাইজানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তোর পায়ে পড়ি ভাই, তুই যেন কোন ল্যাঠা লাগাসনে আর ওরই সাথে। বরং খালাজিকে বুঝিয়ে বলিস, যাতে তিনি থির হয়ে সব কথা ভাল করে বুঝে দেখেন। সত্যি করে বলছি ভাই, তোকে ছেড়ে থাকলে আমি একদম মরে যাব। এই কদিনেই আমার চেহারা কীরকম শুকিয়ে গেছে, তা যদি আসিস, তখন নিজে দেখবি। ভাইজান বলছিলেন, তিনি নিজেই যাবেন পালকি নিয়ে তোদের আনতে। তাই আমার কাল থেকে এত আনন্দ হচ্ছে, সে আর কী বলব! এখন, এ-কদিন ধরে যে তোর জন্যে খুবই কান্নাকাটি করেছিলাম, তা মনে হয়ে আমার বড্ড লজ্জা পাচ্ছে। সত্যি সত্যিই, ভাবিজি যে বলেন, আমার মত ধাড়ি মেয়ের এত ছেলেমানুষি আর কাঁদাকাটা বেজায় বাড়াবাড়ি, তাতে কোনও ভুল নেই। এখন তুই ফিরে আয় তো, তারপর দেখব। তোর ঐ এক পিঠ চুলগুলো ধরে এবার আর রোজ রোজ বেঁধে দিচ্ছিনে, মনে থাকে যেন। থাকবি রাত্তির দিন ঐ সেই বই-এ পড়া কপালকুণ্ডলার মত এলো চুলে। তুই যাওয়ার পর থেকে গল্প করতে না পেয়ে জানটা যেন হাঁপিয়ে উঠছে আমার। মর পোড়াকপালিরা, কেউ যদি গল্প করতে চায়! সারাক্ষণই ছাই-পাঁশ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। মাগো মা! এই রকম গুম হয়ে বসে থাকলে তো আমার মতন লোকের আর বাঁচাই হয় না দুনিয়ার। মা তো আর ওসব ছেলেমানুষি ভালবাসেন না! ভাবিজিও যত সব ছাই-ভস্ম রাজ্যের বই আর মাসিক পত্রিকার গাদায় ডুবে থাকেন। নিজে তো মরেছেন, আবার আমাকেও ঐরকম হতে বলেন। কথা শুনে আমার গা পিতপিতিয়ে ওঠে! পড়বি বাপু তো এক আধ সময় পড়, দিনের একটু আধটু কাজের ফাঁকে, তা না হয়ে রাত্তির জেগে বই পড়া! অমন বই-পড়ার মুখে নুড়োর আগুন জ্বালিয়ে দিই আমি। আমার তো ভাই দুটো গল্প পড়বার পরই যেন ছটফটানি আসে, মাথা ধরবার জোগাড় হয়। তার চেয়ে বসে বসে দু-ঘণ্টা গল্প করব যে কাজে আসবে! এই কথাটি বললেই আমাদের মুরুব্বি ভাবিটি হেসেই উড়িয়ে দেন। তারপর, বুঝেছিস রে, আমাদের এই ভাবিজি আবার কবিতা গল্প লিখতে শুরু করে দিয়েছেন রাত্রি জেগে। আমি সেদিন হঠাৎ তাঁর একটা ঐরকম খাতা আবিষ্কার করেছি। ওসব ছাই-ভস্ম কিছুই বুঝতে পারা যায় না, শুধু হেঁয়ালি। তবে, আমাদের খুকিকে নিয়ে যেসব কবিতাগুলো লেখা, সেগুলো আমার খুব ভাল লেগেছে। এখন দেখছি, এই লোকটিকে রীতিমত আদব করে চলতে হবে।
তারপর ‘আনারকলি’র কথা বলি শোন! আমার এই ক্ষুদে ভাইঝিটিই হয়েছে আমার একমাত্র সাথী। তাছাড়া বাড়ির আর কারুর সঙ্গে বনে না আমার। গল্প করায় কিন্তু খুকি আমাকেও হার মানিয়েছে। এই কচি খুকিটি যেন একটা চঞ্চল ঝরনা। অনবরত ঝরঝর ঝরঝর বকেই চলেছে। আর, সে বকার না আছে মাথা, না আছে মুণ্ডু। এখন দায়ে পড়ে, ওর ঐসব হিজিবিজি কথাবার্তাই আমাকে অবলম্বন করতে হয়েছে আর ক্রমে ভালও লাগছে। তুই চলে যাওয়ার পর সে ‘ফুপুদি দাবো, ফুপুদি দাবো’ বলে দিনকতক যেন মাথা খুঁড়ে মরেছিল, এখনও সময় সময় জিদ ধরে বসে। যখন ‘না,–ফুপুদি দাবো’ বলে এ খামখেয়ালি মেয়ে জিদ ধরে, তখন কার সাধ্যি যে থামায়। যত চুপ করতে বলব, তত সে চেঁচিয়ে-চিল্লিয়ে গড়াগড়ি দিয়ে ধুলো-কাদা মেখে একাকার করবে। বাড়িসুদ্ধ লোক মিলে তাকে থামাতে পারে না। কোনদিন গল্প করতে করতে বা আবোল-তাবোল বকতে বকতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে ঘাড়টি কাত করে বলে, ‘লাল ফুপু নেই–মলে দেছে!’ সঙ্গে সঙ্গে মুখটি তার এতটুকু, চুন হয়ে যায় আর একটি ছোট্ট নিশ্বাসও পড়ে, আমার জানটা তখন সাত পাক মোচড় দিয়ে ওঠে বোন! ভাবিজির চোখ দিয়ে তো টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি তাকে সেদিন যখন জানিয়ে দিলাম যে, তাঁর লাল ফুফু সাহেবা মামুবাড়ি সফর করতে গেছেন, তখন থেকে লাল ফুফুর আল্লাদি দরদি এই ভাইঝিটি হাততালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচে আর বলে,–‘তাই তাই তাই, মামা-বালি দাই, মামি মাজি ভাত দিলে না দোরে হেদে পালাই!’ তোর চিঠিতে এই যে পেনসিলের দাগগুলো দেখছিস, এগুলো এই দুষ্টু মেয়েরই কাটা। আমি যখন চিঠি লিখতে বসি, তখন সে আমার ঘাড়ে চড়ে পিঠে কিল মেরে জোর আপত্তি করতে শুরু করে দিল, সে কিছুতেই আমায় চিঠি লিখতে দেবে না, এখন তাকে ছবি দেখাও। তারপর যেই বলা যে, এ চিঠি তাঁরই প্রিয় মাননীয়া লাল ফুফু সাহেবার, তখন সে ঝোঁক নিলে, ‘আমি তিথি লিথ্বো ফুপুদিকে!’ ভাল জ্বালা বুন, সে কী আর থামে! কী করি, নাচার হয়ে একটা ভোঁতা পেন্সিল তার হাতে দিয়ে দুলালির মান রক্ষে করা গেল, না দিলে সে চিঠিটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিত, যা মেয়ের রাগ! এই মেয়েটা কী পাকাবুড়ি বুন, তোর চিঠিটা হাতে করে সে মুখকে মালসার মত গম্ভীর করে আধঘণ্টাখানিক ধরে যা তা বকতে লাগল আর পেন্সিলটা যেখানে সেখানে বুলিয়ে প্রমাণ করতে লাগল যে, সেও লেখা জানে! আমার তো আর হাসি থামে না। হাসলে আবার তিনি অপমান মনে করেন কিনা, কারণ তাঁর আত্মসম্মানবোধ এই বয়সেই ভয়ানক রকম চাগিয়ে উঠেছে, তাই তাঁর কাণ্ড দেখে হাসলে তিনি একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। ঠোঁট ফুলিয়ে, কেঁদে কেটে খামচিয়ে কামড়িয়ে একেবারে তস-নস করে ফেলবেন! এই চিঠি লেখবার সময়ও ঠিক ঐরকম জোগাড় হয়েছিল, হয়ত আজকে আর এটা লেখাই হত না–ভাগ্যি সেই সময় আমাদের সেই বেঁড়ে বেড়ালিটা তার নাদুস-নুদুস বাচ্চা চারটে নিয়ে সপরিবারে আমার কামরায় দুর্গতিনাশিনীর মত এসে হাজির হল, তাই রক্ষে। নইলে হয়েছিল আর কী! বেড়াল-ছানাগুলো দেখে খুকি একেবারে আত্মহারা হয়ে সব ছেড়ে তার পেছন পেছন দে ছুট। শ্রীমতী বিড়াল-গিন্নি সে সময়ের মত সে স্থান থেকে অন্তর্ধান হওয়াই সমীচীন বোধ করলেন। খুকি বেড়াল বাচ্চাগুলোর কানে ধরে ধরে বুঝাতে চেষ্টা করে যে সে ঐ বাচ্চা চতুষ্টয়ের মাসি-মা বা খালাজি। অবশ্য, বাচ্চাগুলো বা তাদের মা প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে কিছু মত প্রকাশ করতে সাহস করেনি! উলটে, খুকি যখন তাদের কান ধরে ঝুলিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘পুছু, আমি–আমি তোল কালাজি! না? বেচারি বেড়াল বাচ্চা তখন করুণ সুরে বলে ওঠে, ‘মিউ!’ অর্থাৎ না স্বীকার করে করি কী? এই গরীব বাচ্চাগুলির ওপর খুকির আমাদের যে মাসির মতই নাড়ির টান টনটনে সে বিষয়ে আমার আর এই গরীব বেচারিদেরও ঘোর সন্দেহ আছে। মার্জার-পত্নী মহাশয়া তো সেটা স্বীকার করতে একদম নারাজ,–তবু সন্তান-বাৎসল্য অপেক্ষা যে লাঠির বাড়ির গুরুত্ব অনেক বেশি, তা বিড়ালির বিলক্ষণ জানা আছে, তাই তার বুবু সাহেবা অর্থাৎ কিনা আমাদের খুকুমণি সেখানে এলেই সে ভয়ে হোক নির্ভয়ে হোক–সে স্থান সত্বরই ত্যাগ করে! খুকুও তখন বাচ্চাগুলোকে টেনে হিঁচড়ে চাপড়িয়ে লেজ দুমড়ে, কান টেনে যেরকম নব নব আদর-আপ্যায়ন দেখায়, তা দেখে ‘মা মরে মাসি ঝুরে’ কথাটা একদম ভুয়ো বলে মনে হয়।… আমি বুন কিন্তু এসব দেখতে পারিনে। এইসব অনাছিষ্টি, বেড়ালছানা নিয়ে রাত্তির-দিন ঘাঁটাঘাঁটি, হতভাগা ছেলেপিলের যেন একটা উৎকট ব্যামো। এই বেড়ালছানাগুলোর গায়ে এত পোকা যে ছুঁতেই ঘেন্না করে, তাকে নিয়ে এই দুলালি মেয়ে সারাক্ষণই ঘাঁটবে নয়ত কোলে করে এনে বিছানায় তুলবে। সেদিন দেখি,–ছি, গাটা ঝাঁকরে উঠছে!–ওর গা বেয়ে বেয়ে ঝাঁকড়া চুলের ভিতর ঢুকছে কত বেড়াল-পোকা! ওর মা তো রাগের চোটে ওকে ধুমসিয়ে একাকার করে ফেললে! আমি শেষে সে কত কষ্টে গা ধুইয়ে চুল আঁচড়িয়ে পোকাগুলো বের করে দিলাম। আর এই হারামজাদা বেড়ালছানাগুলোও তেমনি, খুকিকে দেখলেই ওদের ঝুনঝির নাড়িতে টনক দিয়ে ওঠে, আর তাই লেজুড় খাড়া করে সকুরণ মিউ মিউ সুরে ওদের এই মানুষ খালাটির কাছে গিয়ে হাজির হবে। রাগে আর ঘেন্নায় আমার গা হেলফেলিয়ে ওঠে এইসব জুলুম দেখে! অন্য কেউ এসে এই বাচ্চাগুলোকে ছুঁতে গেলেই তখন গায়ের রোঁয়া খাড়া করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, সামনের একটি পা চাটুর মত করে তুলে এমন একটা ফোঁৎ ফোঁৎ শব্দ করতে থাকে যে, আমি তো হেসে লুটিয়ে পড়ি। বাচ্চাগুলোর চেহারা দেখেই তো একে হাসি পায়, তার ওপর এক মুঠো প্রাণীর এই এতবড় কেরদারি দেখে আরও হাসতে ইচ্ছা করে। দাঁড়া, আর দু-দিন দেখি, তারপর ঝাঁটা মেরে বিদেয় করব এসব আপদগুলোকে! … তোর শেখানো মত খুকি এখন তার নাম বলতে শিখেছে, ‘আনান্কলি’!
ভাবিজিও তোকে চিঠি দিলেন। দেখছি, এই দু-দিন ধরে তিনি আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে লিখছেন। আমি তাঁকে তোর চিঠিটা দেখতে দিইনি কিনা এই হয়েছে তাঁর রাগ। কিছুতেই আমাকে তাঁর চিঠিটা দেখালেন না। না-ই দেখালেন,–আমার বয়েই গেল! আমার সঙ্গে ভাবিজির আড়ি! দেখি এইবার কে সেধে ভাব করতে আসে! আচ্ছা মাহ্বুবা, তুই আমায় ওঁর সব কথা লুকিয়ে জানিয়ে দিতে পারিস? তাহলে ওঁর সব গুমোর ফাঁক করে দিই আমি।
মাল্কার কথা লিখেছিস। ওকে আবার চিনতে পারব না। ক-বছরই বা আর সে আসেনি, এই বোধ হয় বছর পাঁচেক হল, না? আচ্ছা, মেয়েদের ওপর একী জুলুম? পাঁচ পাঁচটা বছর ধরে বাপের বাড়ি আসতে দেবে না, সামান্য একটু ঝগড়ার ছুতো নিয়ে।…যদি পারিস, তবে মাল্কাকে বলে এই মাগিকে দিয়ে আর একখানা চিঠি পাঠিয়ে দিস। তাহলে খুব ভাল হয়, কেননা ঐ সঙ্গে ভাবিজির চিঠিটাও পাব।… আচ্ছা ভাই, এ মাগির নাম এলোকেশী রাখলে কে? এর যে আদতেই চুল নেই, তার আবার এলোকেশ হবে কী করে? যা দু-চারিটা আছে ঝাঁটিগাছের মত এখনও মাথায় গজিয়ে, তাও আবার এলো জরা নয়, মাথার ওপর একটি ক্ষুদ্রাদপিক্ষুদ্র বড়ির মত করে বাঁধা। আমার এত হাসি পাচ্ছে! এ যেন যার ঘরে একটা ম্যাচ বাক্স নাই, তার নাম দেদার বাক্স্যা। দিনকানা ছেলের নাম নজর আলি!
তারপর, তোর ভয় নেই লো ভয় নেই! তোর কুলের কথা কাউকে বলে দিইনি। তবে, আমার খুব রাগ হয়েছিল প্রথমে, আর এত লজ্জাও হচ্ছে তোর এইসব ছিষ্টিছাড়া কথা শুনে।–ছিঃ মা! তোমার গলায় দড়িও জোটে না? এক ঢাকুন জলে ডুবে মরতে পার না ধিঙ্গি বেহায়া ছুঁড়ি? আমি কাছে থাকলে তোর মুখ ঠেসে ধরতাম। থুবড় মেয়ের আবার মা হওয়ার সাধ! তাতে আবার যে সে মেয়ের নয়, ভাই-এর মেয়ের মা! আ-তোর গালে কালি! আয় তুই একবার পোড়ারমুখি হতভাগি, তার মজাটা ভাল করেই টের পাবি আমার কাছে!
পুরুষদের বিরুদ্ধে তোর যে মত, তাতে আমারও মতদ্বৈধ নেই। আমিও তোর বক্তিমেয় সায় দিচ্ছি। উকিল-‘মুখ-তৈয়ার’-এর মত তুই যেসব যুক্তিতর্ক এনেছিস তাতে আমার হাসিও পায় দুঃখও হয়, আবার রাগও হয়। কারণ, আমি নির্ভয়ে বলতে পারি, তোর এই মর্দানা হম্বিতম্বিতে কোন পুরুষপুঙ্গবের কিছুমাত্র আসে যায় না,–এরকম কলিকালের মেয়েদের তারা থোড়াই কেয়ার করে। এর বিহিত ব্যবস্থা করতেও পারেন তাঁরা, তবে কিনা তাঁরা পৌরুষসম্পন্ন পুরুষ, তাই ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে চান না। যার গোঁফ আছে, তিনি তাতে চাড়া দিয়ে বলবেন, ‘কত কত গেল রতি, ইনি এলেন আবার চক্রবতী!’ আর, আমিও বলি, দু’দিন পরে যে পুরুষসোপর্দ হবি তা বুঝি মনে নেই! পড়িস, খোদা করে, আচ্ছা এক কড়া হাকিমের হাতে, তাহলে দেখব লো তাঁর এজলাসে তুই কত নথনাড়া আর বক্তিমে দিতে পারিস। তখন উলটো এই অনধিকার চর্চার জন্যে তোর যা কিছু আছে, তার সব না বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, দেখিস!…তোর মোকদ্দমা যে হঠাৎ একতরফা ডিগ্রী হয়ে গেল অর্থাৎ কিনা বিয়েটা মুলতুবি রয়ে গেল, তজ্জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত। ওঃ, তোর তরফের উকিল ভাবিজি সাহেবা কি তজ্জন্য কম লজ্জিত আর মর্মাহত? তাই তিনি এখন তাঁর জবর জবর কেতাব ঘেঁটে, মস্ত মস্ত আইন সংগ্রহ করে, অকাট্য যুক্তি-তর্ক প্রয়োগে পুনরায় আপিল রজু করেছেন (তোর বরের নামে!) আসামির নামে জোর তলব ওয়ারেণ্ট বেরিয়েছে। তবে এখন দিন বাড়বে কিছুদিন, এই যা। তা হোক, মায় খরচা তুই ডিক্রি পাবি, এ আমার যথেষ্ট ভরসা আছে। তুই ইত্যবসরে একটা ক্ষতি-খেসারতের লিস্টি করে রাখিস, আমি না হয় পেশকার হয়ে সেটা পেশ করে দেব হুজুরে। তাই বলে ঘুষ নেওয়া ছাড়ছিনে। কিছু উপুড়হাত না করলে, বুঝেছিস তো একেবারে মুলতুবি! ভালই হল, এ মোকদ্দমাটা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়ে একটু বৈচিত্র্য, একটা রগড়ও দেখা গেল!–তুই হয়ত অবাক হচ্ছিস, আমি এত কথা শিখলাম কী করে। কী করি, না শিখলে যে নয়;–না-রে কাল সন্ধ্যেবেলায় ভাইজিতে আর ভাবিজিতে এই কথাগুলো হচ্ছিল, আমি আড়াল থেকে শুনে সেগুলো খুব মনে করে রেখেছিলাম। এখন তোর চিঠিতে সেই কথাগুলোই মজা দেখতে লাগিয়ে দিলাম। কী মজা!…সে যাক, তুই এখন তৈরি হয়ে থাকিস। বুঝেছিস আমার এই ‘বীণা-পঞ্চমে বোল’?–দাঁড়া তো আসুক সে মজার দিন, তবে না তোর এ ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার গুড়ে বালি পড়বে? দেখব তখন, খালাজিও তোকে কী করে ধরে রাখেন। তখন হবি আমাদের ঘরের বউ, বুঝেছিস? আমার ঐ বদরাগি খালাজিটিকে একবার খুব দু’কথা শুনিয়ে দেব তখন। হেঁ, আমি ছাড়বার পাত্তর নই, যতই কেন মুখরা বলুন তিনি। তারপর, তোর গুপ্ত খবর–যা শেষ ছত্রে পুনশ্চে লিখেছিস, তার অনেকটা বোধ হয় আমার লেখায় জানতে পেরেছিস। নূরু ভাইজান নাকি বসরা যাবেন শিগগির, লিখেছেন। বাঙালি পল্টন নাকি এইবার যুদ্ধে নামবে। তিনি লিখেছেন, কোন ভয় নেই, তবু আমাদের প্রাণ মানবে কেন বোন? মা তো কেঁদে সারা। ভাইজান মন-মরা হয়ে পড়েছেন। ভাবিজি তো শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছেন এ ক’দিন ধরে। আমার মনও কেমন এক রকম করে এক আধ সময়। তবু আমি বলতে চাই কী, আমার কিন্তু ওতে এতটুকু ভয় হয় না। পুরুষের তো কাজই ঐ। আজকালকার পুরুষরা যা হয়েছেন তাতে ওদের জাতের ওপর ঘেন্না ধরিয়ে দিলে। ওদের হুবহু মেয়ে হওয়ার সাধ,–সাজ-সজ্জা ধরন-ধারণ সবেতেই! কাজেই শরীরটা হচ্ছে আমাদেরই মত ননীর ঢেলা, যাকে শুধু বিলাস-ব্যসনেই লাগানো যেতে পারে, কোন শক্ত কাজে নয়; আর বাক্যবাগীশ এত হয়ে পড়েছেন যে, মেয়ের জাত মুখ গুটোতে বাধ্য হয়েছে। ছিঃ, বোন, এই কি পুরুষের কাজ? যে পুরুষের পৌরুষ নেই, তারা সত্যি সত্যিই গোঁফ কামিয়ে দেয় দেখে আর দুঃখ হয় না। আমাদের বাড়ির দারোয়ানটাকে গোঁফ কামানোর কথা বললে সে রাগে একেবারে দশ হাত লাফিয়ে ওঠে, কেননা ওদের আর কিছু নাই থাক, গায়ে পুরুষের শক্তি আছে; উল্টো আমাদের দেশে গোঁফ রাখতে বললেই অনেকে ঐরকম লাফিয়ে উঠবেন, কেননা তাঁদের গায়ে মেয়েদের ঝাল আছে! এঁরাই আবার বাড়ির চৌহদ্দির ভিতরে মেয়েদের অন্দরমহলে সেঁধিয়ে যাত্রার দলের ভীমের চেয়েও জোরে লাফ-ঝাঁপ জুড়ে দেন! একেই বলে, ‘নির্গুণো সাপের কুলোপানা ফণা’। আমার কেন মনে হচ্ছে, নূরু ভাইজি আবার বেঁচে ফিরে আসবেন, আর তুই হবি তাঁর–আমার এই পুরুষ ভাই-এর–অঙ্কলক্ষ্মী। তুই হবি এক মহাপ্রাণ বিরাট পুরুষের সহধর্মিণী! আমার মনে এ জোর যে কে দিচ্ছে তা বলতে পারিনে, তবে কথা কী, আমার মন তোদের মত শুধু অলক্ষুণে কথাই ভাবে না।…এইখানে কিন্তু তোর সঙ্গে একটা মস্ত ঝগড়া আছে। বলি, হ্যাঁ লো মুখপুড়ি বাঁদরি! তোর আর বুদ্ধি হবে কখন? সে কী কবরে গিয়ে? দু’দিন বাদে যে নূরু ভাইজির সাথে তোর বিয়ে হবে, কোন্ লজ্জায় তুই তাঁর নাম নিস, আবার ভাইজি বলে লিখিস? ওরে আমার ভাই-এর দরদি বোনরে! দূর আবাগি হতচ্ছাড়ি, তুই একদম বেহায়া বেল্লিক হয়ে পড়েছিস!
আচ্ছা ভাই ‘কলমিলতা’! তুই আমার নূরু ভাইজানকে খুব জান থেকে ভালবাসিস, না? সত্যি করে লিখিস ভাই,–নইলে আমার মাথা খাস! যদি ঝুট বলিস তাহলে তোর সাথে (এই আঙুল ফুটিয়ে বলছি) আড়ি–আড়ি–আড়ি! তিন সত্যি করলাম একেবারে। আর, বাস্তবিক সই, আমার এ ভাইটির কাউকে শত্রু হতে দেখলাম না। কেইবা ওঁকে ভালবাসে না?–যাকে খোদায় মারে, তাকে বুঝি সবাই এমনই একটা স্নেহের, বেদনাভরা দৃষ্টি দিয়ে দেখে! মনে হয়, আহা রে, হতভাগা, কী করে তুই এত দুঃখ হাসিমুখে বইছিস। অথচ সবচেয়ে মজা এই যে, যার জন্যে আমরা এত বেদনা, ব্যথা অনুভব করি, সে ভুলেও সেকথার উল্লেখ করে না, নিজের ভাবে নিজেই মশগুল। উল্টো তার দুঃখে কেউ এই সহানুভূতির কথা জানাতে গেলে তার সঙ্গে সে মারামারি করে বসে। এ মানুষ বড় সাবধান, যেই বুঝতে পারে যে, অন্যে তার বেদনা বুঝতে পেরেছে অমনি সে ছটফটিয়ে ওঠে; তার ওপর তার ঐ অত বড় দুর্বলতাটা ধরে আহাম্মকের মত তাতে হাত দিতে গেলে তো আর কথাই নাই, সে একেবারে ক্ষিপ্ত সিংহের মত তার ওপর লাফিয়ে পড়ে।–আমার তো এই রকমই মনে হয়। নূরু ভাইজিকে যেন আমি অনেকটা এই রকমই বুঝি, অবশ্য এক আধটু গরমিলও দেখা যায়। তুই কী বলিস? …
থাকগে, এসব বার কথা। শিগগির উত্তর দিস। ইতি –
তোর ‘সজনে ফুল’
সোফিয়া