» » পরিচ্ছেদ গ : পত্র এক

পরিচ্ছেদ গ : পত্র এক

বাঁকুড়া

২৬এ জানুয়ারি

(বিকেলবেলা)

অথ নরম গরম পত্রমিদম কার্যনঞ্চাগে বিশেষ! বাঙালি পল্টনের তালপাতার সিপাই শ্রীল শ্রীযুক্ত নূরুল হুদা বরাবরেষু।…

বুঝলি নূরু! তোর চিঠি নিয়ে কিন্তু আমাদের বোর্ডিং-এর কাব্যিরোগাক্রান্ত যাবতীয় ছোকরাদের মধ্যে একটা বিভ্রাট রকমের আলোচনা চলেছে। এঁদের সবাই ঠাউরেছেন, তুই একটা প্রকাণ্ড ‘হবু-কবি’ বা ‘কবি-কিশলয়’! তোর যে ভবিষ্যৎ দস্তুরমত ‘ফর্সা’ এবং ক্রমে তুই-ই যে রবিবাবুর ‘নোবেল প্রাইজ’ কেড়ে না নিস, অন্তত তাঁর নাম রাখতে পারবি, এ সিদ্ধান্তে সকলের একবাক্যে সম্মতিসূচক ভোট দিয়েছেন। তবে আমার ধারণা একটু বিভিন্ন রকমের। ভবিষ্যতে তুই কবিরূপে সাহিত্য-মাঠে গজিয়ে উঠবি কিনা, তার এখনও নিশ্চয়তা নেই,–কিন্তু ‘কপি’ হয়েই আছিস। কেননা কবির চেয়ে কপির উপাদানই তোর মধ্যে বেশি!–আর, ছোকরাদের ঐ হৈচৈ-এর সম্বন্ধে আমার বিশেষ তেমন বক্তব্য নেই, তবে এইমাত্র বললেই যথেষ্ট হবে যে, উপরে হৈহৈ ব্যাপার! রৈরৈ কাণ্ড!! জর্মানির পরাজয়!!! লেখা থাকলেও ভিতরে সেই–ফসিউল্লার গোলাব-নির্যাস, চারি আনা শিশি। নয়ত সিলেট চুন!

তাই বলে মনে করিসনে যেন যে, দেঁতো ‘ক্রিটিকে’র মত ছোবলে তোকে আমি জখম করে দিচ্ছি। আমিও আবার হুজুগে-সমালোচকদের হল্লায় সায় দিয়ে বলছি, কপালের দোষে নিতান্তই যদি তুই সাহিত্য-রথী না হোস, তবে অন্তত সাহিত্য-কোচোয়ান বা গাড়োয়ান হবিই হবি। আর ঐ আগেই বলেছি, কবিবর না হোস, কপিবর তো হবিই!

তুই কবি না হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু আমি যে একজন প্রতিভাসম্পন্ন জবরদস্ত কবি, তা’তে সন্দেহ নাস্তি! প্রমাণস্বরূপ,–আমি হলে তোর ঐ বর্ষাস্নাতা সাগরসৈকতবাসিনী করাচির বর্ণনাটা কীরকম কবিত্বপূর্ণ ভাষায় করতাম, অবধান কর (যদিও বর্ণনাটি ‘আন্দাজিক্যালি’ হবে।) :

ঝরা থেমেছে। উলঙ্গ প্রকৃতির স্থানে স্থানে এখনও জলের রাশ থৈ থৈ করছে। দেখে বোধ হচ্ছে যেন একটি তরুণী সবেমাত্র স্নান করে উঠেছে, আর তার ভেজা পাতলা নীলাম্বরী শাড়ি ছাপিয়ে নিটোল উন্মুখ যৌবন ফুটে ফুটে বেরিয়েছে! এখনও ঘুনঘুনে মাছির চেয়েও ছোট মিহিন জলের কণা ফিনফিন করে ঝরছে। ঠিক যেন কোন সুন্দরী তার একরাশ কালো কশকশে কেশ তোয়ালে দিয়ে ঝাড়ছে, আর তারই সেই ভেজা চুলের ফিনকির ঝাপটা আমাদিগকে এমন ভিজিয়ে দিচ্ছে! এখনও রয়ে রয়ে ক্ষীণ বিজুলি চমকে চমকে উঠেছে, ও বুঝি ঐ সুন্দরের তড়িতাঙ্গ সঞ্চালনের ললিত-চঞ্চল গতিরেখা! আর ঐ যে ক্ষান্ত বর্ষণ-স্নিগ্ধ সন্ধ্যায় মুগ্ধ দু-চারটি গায়ক-পাখির ঈষৎ-ভেসে আসা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, ও বুঝি ঐ স্নাতা সুন্দরীর চারু নূপুরের রুনু-ঝুনু কিংবা বলয়-কাঁকনের শিঞ্জিনী! আর ঐ যে তার শেফালির বোঁটায়-ছোবানো ফিরোজা রঙের মলমলের মত মিহিন শাড়ি আর তাতে ঘন-সবুজ-পাড় দেওয়া, ওতে যেন কে ফাগ ছড়িয়ে দিয়েছে! ও বোধ হয় আবিরও নয় ফাগও নয়,–কোনও একজন বাদশাজাদা ঐ তরুণীর ভালবাসায় নিরাশ হয়ে ঐ দুটি রাতুল চরণতলে নিজেকে বলিদান দিয়েছে আর তারই কলিজার এক ঝলক খুন ফিং দিয়ে উঠে, সুন্দরীর বাসন্তী-বসন অমন করে রক্ত-রঞ্জিত করে তুলেছে,–ওগো, তাই এ সাঁঝ বেলাতে সুন্দরীর মন এত ভারি!–

কেমন লাগল? দেখলি তো, আমি তোর মত আর ছোট কবি নই। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় রে নূরু, যে, কেউ আমায় চিনতে পারলে না! পরে কিন্তু দেশের লোককে পস্তাতে হবে, বলে রাখছি। তুই হয়ত হাসছিস, কিন্তু আমি বলি কী, তার একটা মস্ত কারণ আছে। রবিবাবুকে ইউরোপ আর আমেরিকার লোক যে রকম বড় আর উঁচু করে দেখে, আমাদের দেশে সে রকম পারে কি? উল্টো, যাঁরা তাঁর লেখার এক কানা-কড়িও বোঝেন না, তাঁরাই আবার যত রকমে পারেন তাঁর নিন্দা করেন যেন এইসব সমালোচক রবি-কবির চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ, তবে তাঁরা সেটা দেখাতে চান না, আর দেখালেও নাকি দেশে কেউ সমঝদার নেই! এঁরাই কিন্তু মনে মনে রবিবাবুর পায়ে লক্ষ-হাজার বার সালাম না করে থাকতে পারেন না, তবু বাইরে নিন্দে করবেনই। কাজেই এসব লোককে সমালোচক না বলে আমি বলি পরশ্রীকাতর। এর একটা আবার কারণও আছে; আমরা দিন-রাত্তির ওঁকে চোখের সামনে দেখছি,–আর যাঁকে হরদম দেখতে পাওয়া যায়, এমন একটা ব্যক্তি যে সারা দুনিয়ার ‘মশহুর’ একজন লোক হবেন, এ আমরা সইতে পারিনে। তাই, অধিকাংশ কবিই জীবিতকালে শুধু লাঞ্ছনা আর বিড়ম্বনাই ভোগ করেছেন। ধর, আমার লেখা যদি ছাপার অক্ষরে বেরোয়, তবে অনেকেই ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে যাবে। কারণ, আমারও তাদেরই মত দুটো হাত দুটি পা। কোন একটা অতিরিক্ত অঙ্গ, অন্তত পেছনে একটা লেজুড়ও নেই,–যার থেকে আমি একটা এরকম অস্বাভাবিক জানোয়ারে পরিণত হতে পারি!–একদিনকার একটা মজা শোন! একটা উচ্চ মাসিক পত্রিকায় আমার লেখা একটা গল্প প্রকাশিত হতে দেখে আমার এক বন্ধু ভয়ানক অবাক হয়ে আর চটে বলেছিলেন—“আরে মিয়াঁ, হঃ! আমি না কইছিলাম যে, এসব কাগজ লইতাম না? এইসব ফাজিল চ্যাংরারা যাহাতে ল্যাহে, হেই কাগজ না আবার মান্‌ষে পড়ে? আমার চারড্যা ট্যাহা না এক্কেবারে জলে পর্‌লোনি?”

যাক, সৈনিক জীবন কেমন লাগছে? ও জীবন আমার মত নরম চামড়ার লোকের পোষায় না রে ভাই, তোর মত ভূতো মারহাট্টা ছেলেদেরই এসব কোস্তাকুস্তি সাজে!

তুই শুনে খুব খুশি হবি যে, যে-লোকগুলো তোর মত এমন ‘ধড়ফড়ে’ ইব্‌লিশ ছোকরাকে দু-চোখে দেখতে পারত না, তারাও এখন তোকে রীতিমত ভয়-ভক্তি করে। তবে তাঁরা এটাও বলতে কসুর করেন না যে, তোদের মত মাথা-খারাপ শয়তান ছোকরাদেরই জন্যে এ বঙ্গবাহিনীর সৃষ্টি।

তারপর একটু খুব গুপ্ত কথা।–বুবু সাহেবা আমায় ক্রমাগত জানাচ্ছেন যে, যদি আমার ওজর-আপত্তি না থাকে, তাহলে শ্রীমতী সোফিয়া খাতুনের (ওরফে তাঁর ননদের) পাণিপীড়ন ব্যাপারটা আমার সঙ্গেই সম্পন্ন করে দেন। ওরকম একটা খোশখবর শুনে আমার খুবই ‘খোশ’ হওয়া উচিত ছিল, কেননা তাহলে রবিয়ল মিয়াঁকে খুব জব্দ করা যেত। তিনি আমার ভগ্নিকে বিয়ে করে আইনমতে আমায় শালা বলবার ন্যায্য অধিকারী সন্দেহ নেই, কিন্তু রাত্তির দিন ভদ্র-অভদ্র লোকের মজলিসে মহ্‌ফিলে যদি ঐ একই তীব্র-মধুর সম্বন্ধটা বারবার শতেকবার জানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে নিতান্ত নিরীহ প্রাণীরও তাতে আপত্তি করবার কথা। খুব ঘনিষ্ঠ আর সত্যিকার মধুর সম্বন্ধ হলেও লোকে ‘শালা আর শ্বশুর’ এই দুটো সম্বন্ধ স্বীকার করতে স্বতই বিষম খায়, এ একটা ডাহা সত্যি কথা! অতএব আমিও জায়বদ্‌লি বা Exchange স্বরূপ তাঁর সহোদরার পানিপীড়ন করলে তাঁর বিষদাঁত ভাঙা যাবে নিশ্চয়ই, তবে কিনা সেই সঙ্গে আমারও ‘তিন পাঁচে পঁচাত্তর” দাঁত ভাঙা যাবে। কেননা বিশেষ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, আমার ভবিষ্যৎ অঙ্কলক্ষ্মীটি আদৌ গো-বেচারি প্রিয়ভাষিণী নন, বরং তাতে লক্ষ্মীমেয়ের কোন গুণই বর্তে নাই। সবচেয়ে বেশি ভয়, ইনি আবার ভয়ানক বেশি সুন্দরী, মানে এত বেশি সুন্দরী, যাদের ‘চরণতলে লুটিয়ে পড়িতে চাই’ বা ‘জীবনতলে ডুবিয়া মরিতে চাই’ আর কী! যাদের ঈষৎ আড়চোখো চাউনিতে আমাদের মাথা একেবারে বিগড়ে যায়। যাদের ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা দেখে আমরা আনন্দে অস্বাভাবিক রকমের বদন ব্যাদান করে ‘দেহি পদপল্লবমুদারম্’ বলে হুমড়ি খেয়ে পড়ি!–আজকাল ঐ ঘোড়া-রোগেই গরীব কাঁচা যুবকগুলো মরছে কিনা!–আর নূরু! লাজের মাথা খেয়ে সত্যি কথা বলতে কী ভাই, অহম্ গরীব নাবালকও ঐ রোগেই মরেছে রে ঐ রোগেই ম–রে–ছে! জানি না আমার কপালে শেষ পর্যন্ত কী আছে,–মুড়ো ঝ্যাঁটা, না মিষ্টি ঠোনা!

তোর মত কী? কী বলিস–দেবো নাকি চোখ-মুখ বন্ধ করে বিয়েটা…? (আঃ একটু ঢোক গিলে নিলুম রে!)

বাড়িতে বাস্তবিকই সকলে বড্ড মুষড়ে পড়েছেন তোর এই চলে যাওয়াতে। আমাদের গ্রামটায় প্রবাদের মত হয়ে গিয়েছিল যে, তোর আর আমার মত এমন সোনার চাঁদ ছেলে আর এমন অকৃত্রিম বন্ধুত্ব লোকে নাকি আর কখনও দেখেনি। এক সঙ্গে খাওয়া, এক সঙ্গে পড়তে যাওয়া, এক সঙ্গে বাড়ি আসা, ওঃ, সে কথাগুলো জানাতে হলে এমন ভাষায় জানাতে হয়, যে ভাষা আমার আদৌ আয়ত্ত নয়। ওরকম ‘সতত সঞ্চরমান নবজলধরপটলসংযোগে’ বা ‘ক্ষিত্যপ্‌তেজো পটাক দুম্’ ভাষা আমার একেবারেই মনঃপূত নয়। পড়তে যেন হাঁপানি আসে আর কাছে অভিধান খুলে রাখতে হয়! অবিশ্যি, আমার এ মতে যে অন্য সকলের সায় দিতে হবে, তারও কোন মানে নেই। আমারও এ বিকট রচনাভঙ্গি নিশ্চয়ই অনেকেরই বিরক্তিজনক, এমনকী অনেকে একে ‘ফাজলামি’ বা ‘বাঁদরামি’ বলেও অভিহিত করতে পারেন, কিন্তু আমার এ হালকা ভাবের কথা–হালকা ভাষাতেই বলা আমি উচিত বিবেচনা করি। তার ওপর, চিঠির ভাষা এর চেয়ে গুরুগম্ভীর করলে সেও একটা হাসির বিষয় হবে বৈ তো নয়!–যাক, কী বলছিলাম? এখন যখন আমি একা তাঁদের বাড়ি যাই, তখন বুবু সাহেবা আর কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারেন না। তাঁর যে শুধু ঐ কথাটাই মনে পড়ে, এমনি ছুটিতে আমরা দুজনে বরাবর একসঙ্গে বাড়ি এসেছি। তারপর যত দিন থাকতাম, ততদিন বাড়িটাকে কী রকম মাথায় করেই না রাখতাম?…

হাঁ, আমাদিগকে যে লোক ‘মোল্লা, দোপেঁয়াজা’ বলে ঠাট্টা করত, তুই চলে যাওয়ার পর কিন্তু সব আমায় স্রেফ ‘একপেঁয়াজা মোল্লা’ বলছে।

যাক্ ওসব ছাইপাঁশ কথা–নূরু, কত কথাই না মনে হয় ভাই, কিন্তু বড় কষ্টে হাসি দিয়ে তোরই মত তা ঢাকতে চেষ্টা করি!…আবার কি আমাদের দেখা হবে?

পড়াশুনায় আমার আর তেমন উৎকট ঝোঁক নেই। আর কিছুতে মন বসে না। যাই, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ইতি–

কলেজ-ক্লান্ত

মনুয়র