সালার
২৯শে জানুয়ারি
(প্রভাত,– চায়ের টেবিল সম্মুখে)
নূরু!
তোর চিঠিটা আমার ভোজপুরী দারোয়ান ম’শায়ের ‘থ্রু’ দিয়ে কাল সান্ধ্য-চায়ের টেবিলে ক্লান্ত করুণ বেশে এসে হাজির। দেখি, রিডাইরেক্টের ধস্তাধস্তিতে বেচারার অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। আমি ক্ষিপ্রহস্তে সেই চক্রলাঞ্ছিত, ওষ্ঠাগতপ্রাণ, প্রভুভক্ত লিপিবরের বক্ষ চিরে তার লিপিলীলার অবসান করে দিলাম।–বেজায় উষ্ণমস্তিষ্ক চায়ের কাপ তখন আমার পানে রোষকষায়িত লোচনে চেয়ে চেয়ে ধূম্র উদ্গিরণ করতে লাগল। খুব ধৈর্যের সঙ্গে তোর লিপিচাতুর্য–যাকে আমরা মোটা কথায় বাগাড়ম্বর বলি—দেখে খানিকটা ঠাণ্ডা দুধ ঢেলে আগে চায়ের ক্রোধ নিবারণ করলাম। তারপর দু-চামচ চিনির আমেজ দিতেই এমন বদরাগী চায়ের কাপটি দিব্যি দুধে-আলতায় রঙিন হয়ে শ্রান্ত-মধুর-রূপে আমার চুম্বনপ্রয়াসী হয়ে উঠল। তুই শুনে ভয়ানক আশ্চর্য হবি যে, তোর ‘কোঁদলে’ ‘চামুণ্ডা’ ‘রণরঙ্গিণী’ ভাবিসাহেবা ‘তত্রস্থানে’ সশরীরে বর্তমান থাকা সত্ত্বেও (অবিশ্যি, তখন গুম্ফশ্মশ্রুবহুল বিশাল লাঠিস্কন্ধে ভোজপুরী মশাই ছিলেন না সেখানে) এবং তাঁর মৌরসিস্বত্ব বেমালুম বেদখল হচ্ছে দেখেও তিনি কোন আপিল পেশ করেননি।
আহা হা! তাঁর মত স্বামীসুখাভিলাষিণী, ‘উদ্ভট ত্যাগিনী’ এ ঘোর কলিকালে মরজগতে নিতান্তই দুর্লভ রে, নিতান্তই দুর্লভ। আশা করি মৎকর্তৃক তোর শ্রদ্ধেয়া ভাবিসাহেবার এই গুণকীর্তন (কোঁদলে রণরঙ্গিণী আর চামুণ্ডা এই কথা ক’টি বাদ দিয়ে কিন্তু!) তোর পত্র মারফতে তাঁর গোচরীভূত হতে বাকি থাকবে না।
আমাদের খুকির বেশ দু-একটি করে কথা ফুটছে।–এই দ্যাখ, সে এসে তোর চিঠিটার হাঁ-করে থাকা ক্লান্ত খামের মুখে চামচা চামচা চা ঢেলে তার তৃষ্ণা নিবারণ করচে, আর বলচে ‘চা–পিয়াচ!’–সে তোর ঐ রণসাজ-পরা খেজুর গাছের মত ফটোটা দেখে চা—চা করে ছুটে যায়, আবার দু-এক সময় ভয়ে পিছিয়ে আসে। এই খুদে মেয়েটা সংসারের সঙ্গে আমায় পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলেছে। শুধু কি তাই? এ ‘আফলাতুন’ মেয়ের জুলুমে মায়েরও পরমার্থ-চিন্তা অনেক কমাতে হয়েছে। আর সোফিয়ার তো সে জান্! মাকে সেদিন এই নিয়ে ঠাট্টা করাতে, মা বললেন, ‘বাবা, মূলের চেয়ে সুদ পিয়ারা! এখন ঠাট্টা করছিস, পরে বুঝবি, যখন তোর নাতি-পুতি হবে।’–মা-র নমাজ পড়ার তো সে ঘোর বিরোধী। মা যখন নমাজ পড়বার সময় ‘সেজদা’ যান, সে তখন হয় মায়ের ঘাড়ে চড়ে বসে থাকে, নতুবা তাঁর ‘সেজদা’র জায়গায় বসে ‘দা-দা’ করে এমন করুণভাবে কাঁদতে থাকে যে, মায়ের আর তখনকার মত নমাজই হয় না! আবার মায়ের দেখাদেখি সেও খুব গম্ভীরভাবে নমাজ পড়ার মত মায়ের সঙ্গে ওঠে আর বসে! তা দেখে আমার তো আর হাসি থামে না! এই এক রত্তি মেয়েটা যেন একটা পাকা মুরুব্বি! ঝি-দের অনুকরণে সে আবার হাত-মুখ খিঁচিয়ে মায়ের সাথে ‘কেজিয়া’ করতে শিখেছে। দুষ্টু ঝিগুলোই বোধ হয় শিখিয়ে দিয়েছে,–খুকি কেজিয়ার সময় মাকে হাত নেড়ে নেড়ে বলে, ‘দুঃ! ছতিন!–ছালা–ছতিন!’
তোকে অনেক কথাই জানাতে হবে। কাজেই চিঠিটা হয় তোরই মত ‘বক্তিমে’য় ভরা বলে বোধ হবে। অতএব একটু মাথা ঠাণ্ডা করে পড়িস। আমরা হচ্ছি সংসারী লোক, সবসময় সময় পাই না। আবার সময় পেলেও চিঠি লেখার মত একটা শক্ত কাজে হাত দিতে ইচ্ছে হয় না। তাতে আমার ধাত তো তোর জানা আছে,–যখন লিখি তখন খুবই লিখি, আবার যখন লিখিনে তখন একেবারে গুম। তুই আমার অভিমানের কথা লিখেছিস, কিন্তু ঐ মেয়েলি জিনিসটার সঙ্গে আমার বিলকুল পরিচয় নেই। আর তারহীন বার্তাবহের সন্দেশ বলে বেশি লাফালাফি করতে হবে না তোকে, ও সন্দেশওয়ালার নাম আমি চোখ বুঁজেই বলে দিতে পারি। তিনি হচ্ছেন, আমার সহধর্মিণী-সহোদর শ্রীমান মনুয়র! দেখেছিস আমার দরবেশি কেরামতি! তুই হচ্ছিস একটি নিরেট আহাম্মক, তা না হলে ওর কথায় বিশ্বাস করিস? হাঁ, তবে একদিন কথায় কথায় তোকে কাঠখোট্টা বলে ফেলেছিলাম বটে! কিন্তু তোর এখনকার লেখার তোড় দেখে আমার বাস্তবিকই অনুশোচনা হচ্ছে যে, তোকে ওরকম বলা ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেছে। এখন আমার ইচ্ছে হচ্ছে, তোর ঘাড়ে কিছু ভয়ানক রকমের উপাধিব্যাধি চড়িয়ে দি’, কিন্তু নানান ঝঞ্ঝাটে আমার বুদ্ধিটা আজ মগজে এমন সাংঘাতিক রকমে দৌড়ে বেড়াচ্ছে যে, তার লাগামটি কষে ধরবারও জো-টি নেই!…
এই হয়েছে রে,–হ–য়ে–ছে!–ইতিমধ্যে পাশের ঘরে মুড়ো ঝাটাহস্তে দুটো ঝি-এর মধ্যে কোঁদল ‘ফুল ফোর্সে’ আরম্ভ হয়ে গেছে।–বুঝেছিস, এই মেয়েদের মত খারাব জানোয়ার আর দুনিয়ায় নেই। এরা হচ্ছে পাতিহাঁসের জাত। যেখানেই দু-চারটে জুটবে, সেখানেই ‘কচর কচর বকর বকর’ লাগিয়ে দেবে। এদের জ্বালায় ভাবুকের ভাবুকতা, কবির কল্পনা এমন করুণভাবে কর্পূরের মত উবে যায় যে, বেচারিকে বাধ্য হয়ে তখন শান্তশিষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট একটি বিশেষ লম্বকর্ণ ভারবাহীর মতই নিশ্চেষ্ট ভ্যাবাকান্ত হয়ে পড়তে হয়। গেরো–গেরো! দুত্তোর মেয়েমানুয়ের কপালে আগুন! এরা এ ঘর হতে আমায় উঠাবে তবে ছাড়বে দেখছি। অতএব আপাতত চিঠি লেখা মুলতবি রাখতে হল ভাই। আমার ইচ্ছে হয়, এই মেয়েগুলোকে গরু-খেদা করে খেদিয়ে তেপান্তরের মাঠে ঠেলে উঠাই গিয়ে। ওঃ, সব গুলিয়ে দিলে আমার!
* * *
(দুপুরবেলা)
বাপ রে বাপ! বাঁচা গেছে!–ঝি দু’টোর মুখে ফেনা উঠে এইমাত্র তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। অতএব কিছুক্ষণের জন্য মাত্র সে ঝগড়াটা ধামাচাপা আছে। এই অবসরে আমিও চিঠিটা শেষ করে ফেলি। নইলে, ফের জেগে উঠে ওরা যদি ধামাচাপা ঝগড়াটার জের চালায় তা হলেই গেছি আর কী!
অনেক সময় হয়ত আমার কাজে কথায় একটু মুরুব্বি ধরনের চাল অলক্ষিতেই এসে পড়ে। আর তোর মত চিরশিশু মনের তাতেই ঠেকে হোঁচট খেয়ে ভ্যাবা-চ্যাকা লেগে যায়, নয়? কিন্তু আমার এদিন ছিল না, আমার মনে তোরই মত একটি চিরশিশু জাগ্রত ছিল রে, সে আজ বাঁধা পড়ে তার সে সরল চঞ্চলতা আর আকুলতা ভুলে গিয়েছে। তাই বড় দুঃখে আমার সেই মনের বনের হরিণশিশু জলভরা চোখে আকাশের মুক্ত নীলিমায় চেয়ে দেখে, আর তার এই সোনার শিকলটায় করুণভাবে ঝঙ্কার দেয়।… যাক ওসব কথা। তোকে একটা নীরস তত্ত্বকথা শুনাতে চাই এখানে, সেইটাই মন দিয়ে শোন।–
মানুষ যতদিন বিয়ে না করে, ততদিন তার থাকে দুটো পা। সে তখন স্বচ্ছন্দে যে কোন দ্বিপদ প্রাণীর মত হেঁটে বেড়াতে পারে, মুক্ত আকাশের মুক্ত পাখির মত স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াতেও পারে;–কিন্তু যেই সে বিয়ে করলে, অমনি হয়ে গেল তার দু’জোড়া বা এক গণ্ডা পা। কাজেই সে তখন হয়ে গেল একটি চতুষ্পদ জন্তু। বেচারার তখন স্বাধীনভাবে বিচরণ করবার ক্ষমতা তো গেলই (কারণ চার-চারটে পা নিয়ে তো কোন জন্তুকে উড়তে দেখলাম না!) অধিকন্তু সে হয়ে পড়ল একটা স্থাবর জমি-জমারই মত। একেবারে মাটির সঙ্গে ‘জয়েন’! তারপর দৈবক্রমে যদি একটি সন্তান এসে জুটল, তাহলে হল সে একটি ষট্পদ মক্ষিকা–সর্বদাই আহরণে ব্যস্ত। আর একটি বংশবৃদ্ধি হইলেই–অষ্টপদ পিপীলিকা; দিন নেই, রাত নেই–ছোটো শুধু আহারের চেষ্টায়। তারপর, এই বংশবৃদ্ধি যখন বংশ-ঝাড়েরই মত চরম উন্নতি লাভ করল, অর্থাৎ কিনা নিতান্ত অর্বাচীনের মত গিন্নি যখন এক বস্তা সন্তান প্রসব করে ফেললেন, বেচারা পুরুষ তখন হয়ে গেল একেবারে বহুপদবিশিষ্ট একটি অলস কেন্নো! বেশ একটা হতাশ–নির্বিকার ভাব! কোন বস্তু নেই–ছুঁইলেই জড়সড়।
আমার এত দূর উন্নতি না হলেও যখন আল্লার নাম নিয়ে শুরু হয়েছে রে ভাই, তখন কি আর একে আগড় দিয়েও ঠেকানো যাবে! এ রকম অবস্থায় পড়লে সে সত্যি সত্যিই ‘সবারই মত বদলায়!’…
তারপর, ওরে ছ্যাঁচা ঝিনুক! তুই যে অত করে নিজকে লুকিয়ে রাখতে চাস সমুদ্দুর, না ডোবার ভিতরে, কিন্তু পারবি কি! আমি যে এঁটেল ‘লটে-ছ্যাঁচড়’ ডুবুরি! তুই পারস্যোপকূলের সমুদ্রের পাঁকে গিয়ে লুকোলেও এ ডুবুরির হাত এড়াতে পারিবি নে, জেনে রাখিস। মানিক কি কখনও লুকানো যায় রে আহাম্মক? খোশবুকে কি রুমাল চাপা রাখা যায়?… হায় কপাল, এই কুড়ি-একুশ বছর বয়সে তোর মত উদাসীনরা আবার সংসারের কী বুঝবে? শুধু কবির কল্পনায় তোরা সংসারকে ভালবাসিস, এখানের যা কিছু ভাল, যা কিছু সুন্দর কেবল তাই তোদের স্বচ্ছ প্রাণে প্রতিফলিত হয়, তাই তোদের সঙ্গে আমাদের দুনিয়াদার লোকের কিছুতেই পুরোমাত্রায় খাপ খায় না। এক জায়গাতে একটু ফাঁক থাকবেই থাকবে, তা আমরা যতই মিশ খাওয়াতে চেষ্টা করি না! কারণ, বড় কঠিনভাবে দুনিয়ার–বাস্তব জগতের নিষ্ঠুর সত্যগুলো আমাদের হাড়ে হাড়ে ভোগ করতে হয়! তোরা কল্পনারাজ্যের দেবশিশু, বনের চখা-হরিণ, আর আমরা, বাস্তব জগতের রক্ত-মাংসে-গড়া মানব, খাঁচার পাখি!–এইখানেই যে ভাই মস্ত আর আদত বৈষম্য!
কোন ফরাসি লেখক বলেছেন যে, খোদা মানুষকে বাক্শক্তি দিয়েছেন শুধু মনকে গোপন করবার জন্যে। আর এ একেবারে নিরেট সত্য কথা। তাই আমার কেন মনে হচ্ছে যে, তুই বাইরে এত সরল, এত উদার, এমন শিশু হয়েও যেন কোন্ এক বিপুল ঝঞ্ঝা, কী একটা প্রগাঢ় বেদনার প্রচ্ছন্ন বেগ অন্তরে নিয়তই চেপে রাখছিস!–মানুষকে বোঝা যে বড্ড শক্ত ব্যাপার, তা জানি, কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের চোখে ধুলো দেওয়াও নেহাত সহজ নয়। তোদের মত লোককে চিনতে পারেন এক তিনিই, যিনি নিজের বুকে বেদনা পেয়েছেন; আর সেই বেদনা দিয়ে যদি তিনি তোর বেদনা বুঝতে পারেন তবেই, তা না হলে যত বড়ই মনস্তত্ত্ববিদ হন, এরকম শক্ত জায়গায় তাঁরা ভয়ানকভাবে ঠকবেন! একটি প্রস্ফুটিত ফুলের হাসিতে যে কত কান্নাই লুকানো থাকে, তা কে বুঝবে? ফুলের ঐ শুভ্র বুকে যে ব্যথার কীটে কত দাগ কেটেছে, কে তা জানতে চায়?–আমরা উপভোগ করতে চাই ফুলের ঐ হাসিটি, ঐ উপরের সুরভিটুকু!
সত্য বলতে গেলে, আমি যতই বড়াই করি ভাই, কিন্তু তোকে বুঝে উঠতে পারলাম না। যখনই মনে করেছি, এই তোর মনের নাগাল পেয়েছি, অমনি তোর গতি এমন উল্টো দিকে ফিরে যায় যে, আমি নিজের বোকামিতে নিজেই না হেসে থাকতে পারি নে। এই তোর যুদ্ধে যাবার আগের ঘটনাটাই ভেবে দেখ না!–আমার যেন একদিন মনে হল যে, সোফিয়ার সই মাহ্বুবাকে দেখে তুই মুগ্ধ হয়েছিস। তাই বড় আনন্দে সেদিন গেয়েছিলাম, ‘এবার সখী সোনার মৃগ দেয় বুঝি ধরা!’ এবং আমার মোটা বুদ্ধিতে সব বুঝেছি মনে করে তার সঙ্গে তোর বিয়ের সব ঠিক-ঠাক করলাম, এমন সময় হঠাৎ একদিন তুই যুদ্ধে চলে গেলি। আমার ভুল ভাঙল, অনেকের বুক ভাঙল! সোনার শিকল দেখে পাখি মুগ্ধ হয়ে যেন কাছিয়ে এসেছিল, কিন্তু যেই জানলে ওতে বাঁধনের ভয় আছে, অমনি সে সীমাহীন আকাশে উড়ে গেল।
এইখানে আর একটা কথা বলি, কিন্তু তুই মনে করিস না যেন যে আমি নিজের সাফাই গাইছি। প্রথমে সত্য সত্যই তোর এ বিয়েতে আমার উৎসাহ ছিল না, যদিও কেউ ক্ষুণ্ণ হবে বলে আমি এ কথাটা কাউকে তেমন জানাইনি। তার প্রধান কারণ, তুই কোথাও কোন ধরা-ছোঁওয়া দিসনি। আবার যেখানে ইচ্ছা করে ধরা দিতে গিয়েছিস, সেইখানেই কার নিষ্ঠুর হাত এসে তোকে আলাদা করে দিয়েছে, মুক্ত করে দিয়েছে! সে-কোন্ চপল যেন তোর খেলার সাথী! সে-কোন্ চঞ্চলের যেন তুই ছাড়া-হরিণ! তাই কোন বাঁধন তোকে বাঁধতে পারে না। কিন্তু এ সব জেনেও এমন কিছু ঘটল, যাতে আমারও মনটা কেমন গোলমাল হয়ে গেল।…আমার মস্ত বিশ্বাস ছিল যে, পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাই মানুষের মন বুঝতে বেশি ওস্তাদ! কিন্তু এখন দেখছি, সব ভুয়ো। কারণ তোর মাননীয়া ভাবিসাহেবাই আমায় কান-ভাঙানি দিয়েছিলেন এবং সাফ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তুই নাকি মাহ্বুবাকে দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলি, এমনকি তুই নাকি আর তোর মধ্যে ছিলি নে এবং মাহ্বুবাও নাকি তোর পায়ে একেবারে মনঃপ্রাণ ‘ডারি’ দিয়েছিল। এমন দু’তরফা ভালবাসাকে মাঝ-মাঠে শুকোতে দেওয়া আমাদের মত নব্যশিক্ষিতদের পক্ষে একরকম পাপ কিনা, তাই বড় খুশি হয়েই তোদের এ বুকের ভালবাসাকে সোনার সুতোয় গেঁথে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কাজের বেলায় হয়ে গেল যখন সব উল্টো, তখন যত দোষ এই নন্দ ঘোষের ঘাড়েই হুড়মুড় করে পড়ল! অবশ্য আমার একটু সব দিক ভেবে কাজ করা উচিত ছিল, কিন্তু যুবতীদের–আবার তিনি যদি ভার্যা হন, তবে তো কথাই নেই–এমন একটা মোহিনী শক্তি আছে, যাহা মহা জাহাঁবাজ পুরুষেরও মন একেবারে গলে মোম হয়ে যায়! তখনকার মত বেচারার আর আপত্তি করবার মত কোন শক্তিই থাকে না। সাধে কী আর জ্ঞানীরা বলেছেন যে, মেয়েরা আগুন, আর পুরুষ সব মোম,–কাছাকাছি হয়েছে কী গলেছে। আমি আমার ধৈর্যশীলতার জন্যে চির-প্রসিদ্ধ কি-না, তাই এখন যত মিথ্যা অপরাধের বোঝাগুলোও নির্বিকার চিত্তে বইতে হচ্ছে। এক কথায়,–ঐ যে কী বলে,–আমি হচ্ছি ‘সাহেবের দাগা পাঁঠা!’
তারপর, আমি এখন ভাবছি যে, যে-যুদ্ধের মানুষ কাটাকাটির বিরুদ্ধে ‘বক্তিমের’ তোড়ে তুই সুরেনবাবুর রুটি মারবার জোগাড় করেছিলি, মাঝে আবার জীবহত্যা মহাপাপ বলে স্রেফ শাকান্নভোজী নিরামিষ-প্রাণী বা পরমহংস হয়ে পড়েছিলি, সেই তুই জানি নে কোন্ অনুপ্রেরণায় এই ভীম নরহত্যার যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লি! জানি নে, সে কোন্ বজ্রবাঁশি তোকে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল, তোর এই বাঁধনহারা প্রাণটিকে জননী জন্মভূমির পায়ে ফুলের মত উৎসর্গ করে দিতে! তবে কি এটা তোর সেই বিপরীত স্বভাবটা, যেটা অন্যায়ের খোঁচা না খেলে জেগে উঠত না? অন্যায়কে রুখতে গিয়ে এক একদিন তুই যেরকম খুনোখুনি ব্যাপার বাধিয়ে তুলতিস, তা তো আর কারুর অবিদিত নেই! আমি এখনও ভাবি, সে সময় কীরকম প্রদীপ্ত হয়ে উঠত একটা অমানুষিক শক্তিতে তোর ঐ অসুরের মত শক্ত শরীরটা। আসানসোলে ম্যাচ খেলতে গিয়ে যেদিন একা এক প্রচণ্ড বংশদণ্ড দিয়ে প্রায় এক শত ইংরেজকে খেদিয়ে নিয়ে গিয়েছিলি, সেই দিন বুঝেছিলাম তোর ঐ কোমল প্রাণের আড়ালে কত বড় একটা আগ্নেয় পর্বত লুকিয়ে আছে, যেটা নিতান্ত উত্তেজিত না হলে অগ্ন্যুদ্গিরণ করে না।
বড় কৌতূহল হয়, আর জানাও দরকার, তাই তোর সমস্ত কথা জানতে চেয়েছিলাম। তাতে যদি তোর কোন পবিত্র স্মৃতির অবমাননা হয় মনে করিস, তবে আমি তা জানতে চাই নে। আমি সেরকম নরাধম নই। কিন্তু এ কোন্ ভাগ্যবতী রে যে তোর এমন হাওয়ার প্রাণেও রেখা কেটে দিয়েছে? সে কোন্ সুন্দরীর বীণের বেদন তোর মত চপল হরিণকে মুগ্ধ করেছে? কেন তুই তবে এসব কথা কাউকে জানাসনি? তুই সত্য সত্যই একটা মস্ত প্রহেলিকা!
সোফিয়ার বিয়ে নিয়ে তোকে আর মাথা ঘামাতে হবে না। তুই নিজের চরকায় তেল দে। তোর মত বিবাহ-বিদ্বেষী লোকের আবার পরের বিয়ের এত ভাবনা কেন? আমরা মনে করেছি, আর তোর ভাবিরও নিতান্ত ইচ্ছা যে, মনুয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দিই। তোর কী মত? তবে আরও দু-চার মাস দেরি করতে হবে। কেননা মনুর বি. এ. পরীক্ষা দেবার সময় খুব নিকট। ওর পরীক্ষার ফল বেরিয়ে গেলেই শুভকার্যটা শেষ করে ফেলব মনে করছি। তুই সেই সময় ছুটি নিয়ে বাড়ি আসতে পারবি নাকি? তুই না এলে যে ঘরের সবকিছু কাঁদবে!
তোর সামনে সোফিয়া তোর খুব বদনাম করত আর তোর সঙ্গে কথায় কথায় ঝগড়া করত বটে, কিন্তু তুই যাবার পর হতেই তার মত আশ্চর্য রকমে বদলে গিয়েছে। সে এখন তোর এত বেশি প্রশংসা করতে আরম্ভ করেছে যে, আমি হিংসে না করে থাকতে পারছি নে। তোর এই যুদ্ধে যাওয়াটাকে সে একটা মস্ত কাজের মত কাজ বলে ডঙ্কা পিটুচ্ছে। তুই চলে যাবার পর ওর যদি কান্না দেখতিস! সাত দিন সাত রাত না খেয়ে না দেয়ে সে শুধু কেঁদেছিল। এখনও তোর কথা উঠলেই তার চোখ ছলছল করে ওঠে।… সে তার হাতের বোনা কয়েকটা ‘কম্ফর্টার’ আর ফুল তোলা রুমাল পাঠিয়েছে তোকে, বোধ হয় পেয়েছিস। তোকে তোদের এই যুদ্ধের পোশাকে দেখবার জন্যে সে বড্ড সাধ করেছে। এখনকার ফটো থাকে তো পাঠাস। যখন যা টাকাকড়ির দরকার হবে জানাস। এখন আর কোন কষ্ট হয় না তো? এখানে সব একরকম ভাল।
উপসংহারে বক্তব্য এই যে, তুই আমায় নবনীতকোমল মাংসপিণ্ড-সমষ্টি বলে ঠাট্টা করেছিস, কিন্তু এখন এলে দেখতে পাবি, এই দু-বছরেই সংসার আর বিবি-সাহেবার চাপে আমি সজনে কাঠের চেয়েও নীরস হয়ে পড়েছি। তোর উপরটা লোহার মত শক্ত হলেও ভিতরটা ফুলের চেয়েই নরম! তুই বাস্তবিকও শুক্তি, উপরটা ঝিনুকের শক্ত খোসায় ঢাকা আর ভিতরে মাণিক। আর আমি হচ্চি ঐ–সজনে কাঠের শুকনো ঠ্যাঙা,–না উপরটা মোলায়েম, না ভিতরে আছে কিছু রস-কষ। একেবারে ভুয়ো–ভুয়ো! ইতি
শুভাকাঙ্ক্ষী
হাড়গোড়-ভাঙা ‘দ’
রবিয়ল