» » পরিচ্ছেদ জ : পত্র ছয়

পরিচ্ছেদ জ : পত্র ছয়

বোগদাদ

২৩শে চৈত্র

শ্রীচরণারবিন্দেসু!

সাহসিকাদি! এই হয়ত আমার শেষ চিঠি। কিন্তু এই শেষ চিঠিটা লিখতেই একটা বছর পেরিয়ে গেল। ফুল জমে পাথর হয়ে গেছে, দেখেছ? আমি কিন্তু দেখেছি।…  যাক, ওসব কথা বলতে আসিনি আমি। কয়েকটা খবর আছে দেওয়ার, তাই দিই। অবসর যে নেই, তা নয়–এখন বরং অবসরটা চাওয়ার চেয়ে বেশিই হয়ে উঠেছে। আর সেটা এত বেশি হাতে জমেছে বলেই হয়ত খরচ করতে এত কার্পণ্য। এখন আমার মনে হয়, চিঠি লিখে সময় নষ্ট করার চেয়ে বসে বসে আমার অতীতকে–আপনাদের সকলকে নিয়ে চিন্তার অতলতায় ডুব দেওয়ায় ঢের শান্তি। আমার জীবনে যারা ছিল মানুষ, ধ্যানের মন্দিরে তারা আজ দেবতা। তারা আজ শুধু পূজা গ্রহণ করে, কথা কয় না, নির্বাক নিশ্চুপ! পাছে কথা কয়ে আমার ধ্যান ভঙ্গ করে, তাই দেবতাকে করেছি পাথর–জমানো অশ্রুর শ্বেতমর্মরের দেবতা!

এই একটা বৎসরে কত অঘটনই না ঘটল। শুধু আমার জীবনেই নয়, সারা সৃষ্টিটা জুড়ে। মন্থন শেষে সৃষ্টি আজ নিষ্পন্দ–সাড়া-শব্দহীন। সে যেন আজ তার লাভক্ষতির হিসাব খতিয়ে দেখছে অন্ধকার নির্জনে বসে প্রকৃতির খাতা খুলে। খরচের লাল কালি আজ তার জমার সবুজ কালিকে লজ্জা দিচ্ছে।

যুদ্ধ থেমে গেছে! আর্মিসটিস! শান্তি! মহাপ্লাবনের পর পিতা নুহ্ যেন ধ্যানে বসেছেন। সারা সৃষ্টি উন্মুখ প্রতীক্ষায় তাঁর কুটির দ্বারে দাঁড়িয়ে। তার সকল অনুশোচনা, সকল গ্লানি এই মহামৌনীর আঁখির প্রসাদে ফুল হয়ে ফুটে উঠুক এই আশিস আজ সে চাইতে এসেছে। ঐশ্বর্য-মদমত্ত দাম্ভিক আজ ভিখারির কুটিরদ্বারে ভিক্ষার্থী। এ দৃশ্য অভিনব, অদ্ভুত, না দিদি?

এই একটা বৎসর ধরে আমার কেটেছে ইরাকের মরু প্রান্তরে, ফোরাতের কূলে কূলে, শুকনো পর্বতের অস্থিশ্মশানে। ইচ্ছা করলে যে চিঠি লিখতে পারতাম না, তা নয়। ইচ্ছা করেই লিখিনি। এই একটা বৎসর ধরে আমার কেবলই ভয় হয়েছে, এই বুঝি কারুর চিঠি এসে পড়ল! একেবারে যে আসেনি, তা নয়। এবং সে সব চিঠি আপনাদেরই। তার অনেকগুলো আজও পড়িনি–কেন যে এ দুর্বলতা আমার তা নিজেই জানিনে। ভয় হয়, ওগুলোতে কত যেন দুঃসংবাদ, কত যেন অভিশাপ লুকিয়ে আছে। অথচ ফেলেও দিইনি। মনে করেছি যেদিন আমি ধ্যান-শান্ত হতে পারব–বাইরের কোন দুঃসংবাদই আমার মনে দোলা দিতে পারবে না–এইরূপ বিশ্বাস হবে আমার নিজের উপর, সেই দিন খুলব ওগুলো।

যেগুলো খুলে পড়েছি, তাতে যা সব জেনেছি তার বেশি জানবার আমার বর্তমান জীবনে প্রয়োজন দেখিনে। মনে হয় আমার জানাশোনার হিসাব-নিকাশ চুকে গিয়ে এবারের মত কৈফিয়ত কাটা হয়ে গেছে। এবারের মত আমার বেচাকেনা বন্ধ।

আচ্ছা সাহসিকাদি, পুরুষগুলো মেয়েদের চেয়ে একটু চোখে খাটো না? অন্তত, ওদের প্রত্যকেরই শর্ট-সাইট–কাছের দৃষ্টিটা খারাপ। কাছের জিনিসকে ওরা উপচক্ষু ছাড়া দেখতে পায় না। কিন্তু দূরের জিনিস দিব্যি সাদা চোখে দেখতে পায়। সোফিটাকে দেখেছি–মাহ্‌বুবার চেয়েও কাছে করে, কিন্তু পাতার আড়ালে যে বেদনার কুঁড়ি ধরেছিল–তা আমার এই হাজার মাইল দূরে চলে আসার আগে আর চোখে পড়েনি, কিন্তু দূরের এ-দৃষ্টিটা হয়ে উঠেছে আমার বরে শাপ।

এখন যখন একান্ত চিত্তে মনের তলা হাতড়িয়ে দেখি, তখন ভয়ে বিস্ময়ে চমকে উঠি। মনে হয়, কে যেন আমায় দেখে ফেললে! চিরকাল এ মনে শুধু একটি মুখেরই প্রতিচ্ছবি পড়েছে–এই ছিল আমার ধ্রুব বিশ্বাস। চিত্ত যেদিন আর একজন দেখিয়ে দিলে মনটাকে নাড়া দিয়ে যে, পিছনে হলেও সেও আছে সেখানে–তখন স্তব্ধ হয়ে গেলাম ভয়ে বিস্ময়ে-বেদনায়। আমার কেবল মনে হতে লাগল, এইবার একটা প্রলয় না হয়ে যায় না। আকাশে যদি কোনদিন দুটো সূর্য ওঠে, তাহলে সেদিন ভীষণ কিছু একটা হবে, একথা পাঁজিতে না লিখলেও আমি বিশ্বাস করি।

সেই প্রলয় হয়ত ঘনিয়ে এসেছে সাহসিকাদি আমার জীবনে। এক সূর্য আলো দেয়, কিন্তু দুটো সূর্য দগ্ধ করে। আমার মন পুড়ে যাচ্ছে–তাই বিষের ওষুধ বিষ মনে করে এই দগ্ধীভূত মরুভূমিতে এসে পড়েছি। মনে করেছি, এই পোড়া দেশের মরুভূমি দেখে সান্ত্বনা খুঁজব। আমি আজ এই মনের অগ্নিকুণ্ডে আত্মস্থ হয়ে তপস্যা করবার চেষ্টা করছি। প্রার্থনা করো যেন বিফল না হই।

আমি আর কোথাও চিঠি দেব না, কাউকে না তোমায়ও না। আর আমার খোঁজ করবার চেষ্টা কোরো না। মনে কোরো ধূমকেতু দেখার মত দু-দিন একটা অমঙ্গলকে দেখে স্নেহ করেছিলে, ভালবেসেছিলে। আজ সে অকস্মাৎ এসে আবার অকস্মাৎ হারিয়ে গেল, তখন ওকে আবার দেখতে চাওয়া পণ্ডশ্রম। ধূমকেতুর একটা নিয়ম আছে–সেই নিয়মাধীন যদি হই, তবে আবার দেখা দিব, আপনারা দেখতে না চাইলেও।

খবর পেয়েছি সোফির বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ের পরই তার ভীষণ অসুখ, হয়ত বা বাঁচবে না। আমার চেয়ে সে খবর আপনিই বেশি জানেন। আর একটা ভীষণ খবর পেয়েছি, মাহ্‌বুবা হতভাগি বিধবা হয়েছে, তার বৃদ্ধ স্বামী মারা গেছেন। মাহ্‌বুবা নিজে লিখেছে চিঠি। সে লিখেছে, সে-ই এখন সমস্ত জমিদারির মালিক। সংসারে আর তার মন নাই; সে নাকি শিগগিরই পবিত্র স্থানসমূহ পর্যটন করতে বেরোবে, মক্কা-মদিনাও আসবে এবং আরও লিখেছে বোগদাদ শরিফও আসতে পারে। আমি বারণ করিনি। আর আমার ভয় নেই তাকে।

যে মাহ্‌বুবা একদিন স্বেচ্ছায় আমাকে পাওয়ার লোভ দুহাতে ঠেলে দিয়েছিল; আমার মহৎ জীবন পাছে বিবাহের জন্য নিষ্ফল হয়ে যায়, তাই আমাকে নিজে হাতে মরণের মুখে পাঠিয়ে দিলে–তাকে যদি আজ অযথা সন্দেহ করি, তাহলে আমার ইহকালে পরকালে কোথাও মুক্তি হবে না, সাহসিকাদি।

আমাদের পল্টন শিগগির ফিরে যাচ্ছে। শিগগির সব ভাইরা আমার দেশে ফিরবে। আমিই আর ফিরব না।

আমি আবার তিন বছরের জন্য অঙ্গীকারপত্র লিখে দিয়ে যুদ্ধ অফিসে নতুন কাজ নিয়েছি। ইচ্ছা করলেও আর যেতে পারব না এ তিন বছরের মধ্যে।

আমার বাঁধনহারা জীবন-নাট্যের একটা অঙ্ক অভিনীত হয়ে গেল। এর পর কী আছে, তা আমার জীবনের পাগলা নটরাজই জানেন।

আশীর্বাদ করো তোমরা সকলে, আবার যখন আসব রঙ্গমঞ্চে–তখন যেন আমার চোখের জলে আমার সকল গ্লানি, সকল দ্বন্দ্ব কেটে যায়–আমি যেন পরিপূর্ণ শান্তি নিয়ে তোমাদের সকলের চোখে চোখে তাকাতে পারি। ইতি –

অভিশপ্ত

নূরুল হুদা

(সমাপ্ত)