» » পরিচ্ছেদ জ : পত্র তিন

পরিচ্ছেদ জ : পত্র তিন

সালার

২৭শে চৈত্র, রাত্রির

দুষ্টু সাহসিকা!

তোর সাথে এবার দেখছি সত্যিকার আড়ি দিতে হবে। বাহা রে, দুষ্টু ছুঁড়ি। আমি না হয় সংসারের ঝঞ্ঝাটে পড়ে তোকে কিছুদিন চিঠি দিতে পারিনি, তাই বলে তুইও যে গুমোট মেঘের মত অভিমানে মুখ ভারি করে বসে থাকবি–হায় রে কপাল তা কি আর জানতাম?…  আজ আমাদের সেই ছেলেবেলা, সে অভিমানে অভিমানে ‘কান্না-হাসির পৌষ-ফাগুনের পালা’ সেই মা-দের সোহাগ,–সব কথা মনে পড়ছে রে বোন, সব কথা আজ যেন চোখের জলে ভিজে বেরিয়ে আসতে চাইছে! দুনিয়ায় কেমন করে কার সাথে সহসা যে চেনা-শুনা হয়ে যায়, দুইটি হিয়াই কেমন করে কপোত-কপোতীর মত সারাক্ষণ অন্তরের নিভৃততম কোণে মুখোমুখি বসে গোপন কূজনে হিয়ার গগন ভরিয়ে তোলে, তা সবচেয়ে সেই সময় চোখের জলে লেখা হয়ে দেখা দেয়, যখন তাদের এক ব্যথিত অজানা দিনের জন্য ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

দ্যাখ সই, আজ যখন আমার বড় কষ্ট বড় দুঃখ, সেই সময় একটি ব্যথা-পাওয়া সখীকে কাছে পেতে যেন আমার আশা দিকে দিকে ঘুরে মরছে। আমার বুকে যে আজ কথার ব্যথা জমে পাহাড়-পারা হয়ে উঠেছে বোন, কেননা, আমার খেলার সাথীটিও মূক হয়ে গিয়েছে। পরের বেদনায় নিজের বুক ভরে আমরা দুটি চিরপরিচিত জনও কেমন যেন পরস্পরকে হারিয়ে ফেলেছি। এই হঠাৎ-পাওয়া বেদনার বিপুলত্ব আমাদের দুজনকেই কেমন স্তম্ভিত করে ফেলেছে, যাতে করে এ নিবিড় বেদনার অতলতা আর কিছুতেই আমাদের সহজ হতে দিচ্ছে না। কী হয়েছে, সব কথা বলি শোন।

তোর পথিক-ভাই নূরুটার সব কাণ্ড-কারখানা তো জানিস।–আজ কিন্তু তোর ওপরেও আমার কম রাগটা হচ্ছে না রে ‘সাহসী’! তুই তাকে রাতদিন ‘পাগল-ভাই আমার’ ‘পথিক-ভাই আমার’ বলে বলে যেন আরও খেপিয়ে তুলেছিলি, দোলা দিয়ে দিয়ে তার জীবন-স্রোতকে আর চল-চঞ্চল করে তাতে হিন্দোলের উদ্দাম দোল এনে দিয়েছিলি। আমি তার বেদনায় এতটুকু নাড়াছোঁয়া না দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে শান্ত করবার মতলব আঁটছি, এমন সময় তুই তোর বুক-ভরা বেদনা-ঝঞ্ঝা এনে তার ব্যথার প্রশান্ত মহাসাগরে দুরন্ত কল্লোল জাগিয়ে গেলি। সেই ঝঞ্ঝার ঝাঁকানি আর ঢেউ-এর হিন্দোল উচ্ছ্বাসই তাকে ঘর-ছাড়া ডাক ডেকে শেষে আগুনের মাঝে গলা জড়াজড়ি করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই চির-বঞ্চিতের জীবন-যাত্রা, বড় দুর্বিষহ রে ৱোন, বড় দুর্বিষহ! এই বিড়ম্বিত হতভাগ্যেরা যেমন রাক্ষসের মত স্নেহ-বুভুক্ষু, তেমনই অস্বাভাবিক অভিমানী।

এই খ্যাপার শিরায় শিরায় রক্ত যেমন টগবগ করে ফুটছে, স্পর্শালুতাও তেমনই তীব্র তীক্ষ্মতা নিয়ে ওত পেতে রয়েছে। সকল দুঃখ-বেদনা-আঘাতকে হাসি-মুখে সহ্য করবার বিপুল শক্তি এদের আছে, এদের নাই শুধু স্নেহ সহ্য করবার ক্ষমতা। স্নেহ-সোহাগের একটু ছোঁয়ার আবছায়াতেই এদের অভিমান-মথিত বুকে বিরাট ক্রন্দন জাগে। এইখানেই এরা সাধারণ মানুষের চেয়েও দুর্বল।

নূরুর ব্যথার সরসীতে যেই শৈবালের সর পড়ে আসছিল, অমনি তুই এসে একেবারে তার বেদন-ঘায়ে পরশ বুলিয়ে তাকে ক্ষিপ্ত করে তুললি। তার ঘুম-পাড়ানো চিতাকে সজাগ করে দিলি। নিজে তো গৃহবাসিনী হলিনে সাথে সাথে আর এক মুগ্ধ হরিণকে তার মনের কথা মনে করিয়ে দিলি।…  তোর ও দুরন্তপনা দেখে দেখে তাই আমার ভয় পাচ্ছে, পাছে তুইও না মাথায় পাগড়ি বেঁধে যুদ্ধে চলে যাস। যেমন দুষ্ট সরস্বতী মেয়ে, তেমনই নামও হয়েছে–সাহসিকা।

কিন্তু বিয়ের বেলায় তো সাহস হয় না লো! ইস! গা-টা হেলফেলিয়ে উঠছে,–না?

হাঁ, কী হয়েছে শোন।

নূরুর সাথে মাহ্‌বুবার সেই বিয়ের সমস্ত বন্দোবস্তের পর তো নূরুটা যুদ্ধে চলে গেল–বনের চিড়িয়া বনে উড়ে গেল , কিন্তু তার শূন্য পিঞ্জরটি বুকে নিয়ে একটি বালিকা নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগল। এ হতভাগি আর কেউ নয় বোন, এ হচ্ছে তোর বাচ্চা-সই মাহ্‌বুবা।

মাহ্‌বুবার বাবাজান হঠাৎ মারা পড়লেন দেখে তার মামারা এসে তাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন, অনেক কাঁদা-কাটি করে পায়ে ধরেও রাখতে পারলাম না। মাহ্‌বুবার মাজান যে এমন বে-রহম তা আগে জানতাম না ভাই।

এই রাক্ষুসি মায়ের পরের কাণ্ডটা শোন। এখান থেকে নিয়ে গিয়ে মাহ্‌বুবাকে ধরে-বেঁধে এক চল্লিশ বছরের বুড়ো জমিদারের সাথে তিনি বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। খবর পেয়ে আমরা সকলে সেখানে গিয়ে কেঁদে পড়ি, তাঁর পায়ে আমরা ঘর-গুষ্টি মিলে মাথা কুটে-কুটেও তাঁর মত ফেরাতে পারিনি। জোর করে বিয়ে থামাতে গিয়েছিলাম কিন্তু তাতেও কোন কিছু হয়নি! মারামারি করতে গিয়ে তোর সয়া হাতে খুব জখম হয়েছেন। তবে একেবারে ঘায়েল নয়। ঘায়েল হয়েছে ঐ মন্দভাগি মাহ্‌বুবাটা। সে এখন শ্বশুরবাড়িতে–শেঙানে। আহ্–আহ্, বিয়ের দিনে সে কী ডুকরে ডুকরে তার কান্না রে ‘সাহসি’, তা দেখে পাষাণও ফেটে যায়! তবু ঐ বে-দিল-মায়ের জানে একটু রহম হল না। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আবার কান্না কত!…  এই গোলমালে সোফির আর মনুর চার হাত এক হতে দেরি হয়ে গেল।

এ বিয়েতে তোকে আমরা ধরে আনব গিয়ে। আসতেই হবে কিন্তু। কোন মানা শুনছিনে, বুঝলেন শিক্ষয়িত্রী মহাশয়া!

তোর পথিক-ভাই পাগলা নূরুটাও আসতে পারে এই বিয়েতে। তুই এলে এবার বনবে ভাল। জানিনে হতভাগা এ-আঘাত সইতে পারবে কিনা!…  আচ্ছা হয়েছে–খুব হয়েছে, যেমন অনহেলা, তেমনই মজা! এখন মতির মালা বানরে নিয়ে গেল। কথায় বলে,–‘কপালে নেই ঘি, ঠক-ঠকালে হবে কী?’

নূরুটা ক্রমেই স্রষ্টার প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠছে দেখছি, আবার এ-খবর শুনলে তো সে বিধাতা পুরুষের হপ্তা-পুরুষ উদ্ধার করবে। আমাদের বুক কাঁপে রে ভাই ভয়ে দুরু দুরু করে পাছে কোন অমঙ্গল হয়। তার চিঠির যদি ঝাঁজ দেখতিস। উঃ, যেন একটা বিপুল ঘূর্ণিবায়ু হু-হু-হু-হু করে ধুলো উড়িয়ে সারা দুনিয়াটাকে আঁধার করে তুলতে চাইছে।… আমি তার চিঠির এক বর্ণও বুঝে উঠতে পারিনে বোন, এক বর্ণও না। শুধু বুঝি, একটা তিক্ত কান্নার তীব্রতা যেন তাকে ক্রমেই শুষ্ক তীক্ষ্ণ করে ফেলছে।…  খোদা ওকে শান্তি দিন।

চারিদিককার এই গোলমালে আমার মনে শান্তি একেবারে উবে গিয়েছে। আমার এই সাজানো ঘর যেন আজ আমাকেই মুখ ভ্যাংচাচ্ছে।

মা আর সোফিও আলাদা জীব হয়ে উঠেছেন আজকাল। মায়ের দুঃখ অনেক, কিন্তু এই কচি মেয়ে সোফিটা–? তুই এলে তবে একবার ওর গুমোর ভাঙে। মাগো মা, রাত-দিন মুখ যেন ভার হয়েই আছে। ছুঁতে গেলেই নাকে-কান্না। এমন ছিঁচকাঁদুনে ছুঁড়ি তো আমি আর জন্মে দেখিনি, যেন রাংতার টেকো আর কী!

আর লজ্জার কথা শুনেছিস রে ‘সাহসি’? আজকাল সে তোর ভয়ানক ভক্ত হয়ে উঠেছে। এখন কথায় কথায় তোর নজির দেওয়া হয়–‘সাহসিদিই তো ভাল কাজ করেছেন–বিয়ে করা একবারে বিশ্রী কাজ, আমিও চিরকুমারী থাকব’ ইত্যাদি ইত্যাদি! আমার তো চক্ষুস্থির! ওরে বাপরে,–এখন তুই এসে একে তোর কাছে নিয়ে গিয়ে এক-আধটা শিক্ষয়িত্রীর পদ-টদ খালি থাকে তো দিয়ে দে! বেশ চেলা জোটাচ্ছিস কিন্তু ভাই। আমি বলি কী, তোরা যত সব চিরকুমারী আর চিরকুমারের দল মিলে একটা নেড়া-নেড়ির দল বের কর। কেমন লো,–কী বলিস?

তোর বর না হয় তোর রূপ-গুণের জৌলুস দেখে ভয়েই পিঠটান দিল, কিন্তু আমাদের এই শ্রীমতী সোফিয়া খাতুনের ঝগড়া-করা আর নাকে-কাঁদা ছাড়া অন্য কী গুণ আছে, যাতে করে তাঁর ‘অচিন-প্রিয়তম’ তাঁকে ত্যাগ করে গেলেন? কিন্তু এইখানে কথা হচ্ছে যে, এই ঝগড়াটে ছুড়ির আবার ‘প্রিয়তম’ই বা কে? সে কি কোন পরিস্থানের শাহজাদা উজিরজাদাকে খোয়াবে-টোয়াবে দেখেছে নাকি? এসব কথা তুই-ই এসে জিজ্ঞেস করবি ভাই, আমি বলতে গেলে এখন আমায় সে লাঠি নিয়ে তাড়া করে আসে। জানি না, ওঁর ‘পীতম’ কোন্ গোকুলে বাড়ছে। কিন্তু দেখিস ভাই, এসে ওকে যেন আবার চেলা বানিয়ে নিসনে।

আর, তুই নিজে কি এমনই সন্ন্যাসিনীই রইবি? হায় রে শ্বেতবসনা সুন্দরী, তোর বসন্ত বৃথাই গেল! চোরের সঙ্গে ঝগড়া করে ভুঁই-এ ভাত খাবি নাকি? আয় তো এখানে একবার, তারপর মনে করেছি কী, তোকেও একটা বুড়ো হাবড়া বর জুটিয়ে দিয়ে ‘নেকা’ দিয়ে দেব! কী বলিস, বিবি হতে পারবি তো? তবে আজ এখন আসি। ইতি–

তোর ভুলে-যাওয়া সই

রাবেয়া