» » পরিচ্ছেদ জ : পত্র চার

পরিচ্ছেদ জ : পত্র চার

বিডন স্টিট, কলিকাতা

প্রথম বৈশাখ (সকাল)

ভাই রেবা!

আজ যে নতুন বছরের প্রথম দিনের প্রথম সকালে তোর নামটিই সর্বপ্রথমে আমার মনের কোণে উঁকি মারল, আমার এ বিপুল আনন্দের নিবিড় মাধুরী তুই হয়ত বুঝবিনে; কেননা, তুই এখন ঘরের লক্ষ্মী, তোর ভালবাসা পাওয়ার আর দেওয়ার অনেক লোক আছে, কিন্তু আমাদের তো আর পোড়াকপালে সেসব কিছু জুটল না। আমার বন্ধু আছেন অনেক, কিন্তু সেসব মামুলি; তাঁদের সঙ্গে শুধু লৌকিকতার খাতিরটুকু মাত্র, প্রাণের সঙ্গে কারুর কোথাও এতটুকু মিল নেই। তোকে যেমন অসংকোচে একেবারে সেই ছেলেবেলাটির মতন সহজ হয়ে আমার অন্তরের বাইরের সবকিছু জানাতে পারব, এমনটি তো আর কাউকে পারব না ভাই! আমার ভেতরটা এই নীরস সামাজিকতার আর লোক-দেখানো প্রীতির চাপে যখন ক্রমেই শুকনো কাঠ হয়ে উঠছিল, তখন তোর এই হঠাৎ-পাওয়া ছোট্ট চিঠিখানি যে কত অন্তরতম বন্ধুর মতন সেই শুকনো হিয়ায় পরশ বুলিয়ে তাকে আবার ফুলের ফসলে ভরিয়ে তুললে, তা আমার এই ভাবাবেগময়ী লিপি-দূতীর চেহারা দেখেই বুঝতে পারবি।

এতদিন তোর ‘সাহসি’ সই ‘পুয়াল-চাপা’ ছিল, তার কাঠামোটা নিয়ে যিনি এতদিন এই কলকাতা শহরের মহিলাদের পর্দাপার্কে, মাঝে মাঝে রাস্তায়, বোর্ডিং-এ স্কুলে গম্ভীরা হয়ে বেড়িয়ে বেড়াতেন, তিনি হচ্ছেন মিস সাহসিকা বোস! বুঝলি? শুধু কী তাই! এক প্রখ্যাত ব্রাহ্মবালিকা বিদ্যালয়ের প্রধানা শিক্ষয়িত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হোমরা-চোমরা গ্রাজুয়েট, তদুপরি অনুপমা সুন্দরী, বিদূষী, কলা-সরস্বতী! আমার আরও অনেকগুলো বিশেষণ আছে, সেগুলো আর চিঠিতে লিখে জানাচ্ছিনে, তোকে একবার আমার এই কুঞ্জ-কুটিরে এনে হাতে-কলমেই দেখানো যাবে! তুই এতক্ষণ বোধ হয় তোর দুষ্টু হাড়-জ্বালানো ননদিনি সোফিকে ডেকে এনে খুব কুটি-কুটি হয়ে হাসছিস, নয়? সত্যি বলছি ভাই রেবা, এ আর আমি কী বললাম, আমার সব মহিলা বন্ধুরা আমাকে কোন নতুন-দেখা সুন্দরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এইরকম যে কত পাঁয়তারা কসরত করে যে অহম সুর-সুন্দরীর গুণ-ব্যাখ্যা ও কীর্তন করেন, তা শুনে শুনে আমারও অনেক সময় মনে হয়,–নাঃ, আমি আর এখন কেউকেটা নই! যেই ভাবা, আর যায় কোথা, অমনি সঙ্গে সঙ্গে প্রাবৃট-মেঘের মতন গুরু-গম্ভীর হয়ে পড়া! প্রথম প্রথম দিন কতক একটু অসোয়াস্তি বোধ হত, কিন্তু এখন দিব্যি সয়ে গিয়েছে; শুধু সয়ে গিয়েছে বললে ভুল হবে, এখন বরং কোন জায়গায় ঐরকম বিশেষণ-বিশেষিত অভ্যর্থনা না পেলে মনে একটু রীতিমতই লাগে! দেখেছিস এইসব মিথ্যা বাজে জিনিসের ওপরও আমাদের মায়া কত বেশি!

আজ যে আমি তবে হালকা বা খেলো হয়ে পড়েছি তোর কাছে, তার কারণ, আমি দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে যে দিকে যতই বাড়ি, তোর কাছে ঐ বাঁদরি ছুড়ি, লো, টে, খুব জোর ‘সাহসি’র বেশি বিশেষণে তো আর জীবনে কখনও বিশেষিত হলামও না, আর ভবিষ্যতে যে হবও না তার প্রমাণ তোর এই এতদিন পরের চিঠিটা‌! তাই আমার অতগুলো মর্দানি লেবাস সত্ত্বেও এবং এক মস্ত ধিঙ্গি আইবুড়ো মাগি হয়েও আজ শুধু মনে হচ্ছে আমাদের সেই বাঁকুড়ার ছেলেবেলাকার কথাটা! এখন আর আমাতে আমি নেই, এখন বাঁকুড়ার চুলবুলে সাহসী ছুঁড়ি এসে আমার মনের আসনে জোর জড় গেড়ে বসেছে! এখন আমার কী মনে হচ্ছে বুঝলি লো ‘খুকির-মা’? এখন বড্ড সাধ যাচ্ছে যে, সেই আমাদের কিশোরী জীবনের মতন দুই সই-এ পা ছড়িয়ে চুল এলিয়ে পাশাপাশি বসি আর খামচা-খামছি নুচোনুচি খুনসুড়ি মস্তানি করি এবং সঙ্গে সঙ্গে খুব পেট ভরে মা-দের গাল খাই! নয়ত তোর ঐ এক বোঝা চুল নিয়ে বেণি গাঁথতে তেমনি মশগুল হয়ে যত সব রাজ্যের ছিষ্টি-ছাড়া গপপো করি। এখন আমি এই চিঠি লিখছি তোকে আর আপনাতে আপনিই বিভোর হয়ে গিয়েছি! আঃ, কেমন করে মানুষের কত পরিবর্তন হয় বোন। আমার এত আনন্দের বাজার কে ভাঙলে, আর কেমন করেই বা ভাঙল তাই ভাবতে গিয়ে অনেক দিন পরে আমার চোখের পাতা ভিজে এল!

দ্যাখ, ভাই রেবা, নারীর নারীত্ব কিছুতেই মরবার নয়, এ কথাটা আজ আমি খুবই বুঝতে পাচ্ছি। তার কারণ বলছি তোকে, শোন।…  নানান দিক থেকে নানা রকমের ঘা আর আঘাত খেয়ে খেয়ে যখন আমার ভিতরে নারীর মাধুরী, সমস্ত পেলবতা–নমনীয়তা ক্রমেই হিম জমাট হয়ে আসতে লাগল, তার রাত-দিন মর্দানি কায়দা-কানুনের চাপে চাপে অন্তরের নারী আমার অহল্যার মতই পাষাণ হয়ে গেল, তখন আমি সব বুঝতে পারলাম মাত্র, কিন্তু না পারলাম কাঁদতে, না পারলাম তেমন কিছু বেদনা অনুভব করতে! হায় রে বোন, তখন যে আমি পাষাণী! আমার কি আর তখন কোন কোমল অনুভূতি জমে পাথর হতে বাকি আছে, যে তার সাড়া পেয়ে বাকি অনুভূতিগুলো একটু নড়া-চড়া করেও উঠবে! ঐ পাষাণ-বুক নিয়ে শুধু শুকনো অশ্রুহীন কাঁদন কেঁদেছি যে, হায়, আমার আর মুক্তি নেই–মুক্তি নেই! অহল্যারও মুক্তি হয়েছিল, আমার মুক্তি নেই–নেই। আমার মনে হল, ঐ অহল্যা নারী যখন পাষাণ হয়েছিল, তখন তার মাঝে যে আমিও ছিলাম! আজ আবার এই আমার মাঝে সেই অহল্যা তার পাষাণী মূর্তি নিয়ে এসেছে, কিন্তু এবার যেন মুক্তিটাকে বাদ দিয়ে। এই আমির মাঝে আমার সেই বহুযুগ আগের আমি তো নেই, তার যে মৃত্যু হয়েছে!…  এত দুঃখ আমার বোন, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারিনি! জীবনের যত দুর্ঘটনা যত রকম সম্ভব করুণ করে মনে করে কাঁদতে চেষ্টা করেছি; মার, বাবার ফটোগুলি, তাঁদের হাতের লেখা ইত্যাদি সামনে ধরে, আমার জীবন-ভরা হারানো প্রিয় মুখগুলি মনে করে করে যতই কাঁদতে গিয়েছি, ততই খালি কাপাস-হিম-হাসি ঠোঁটের কোণে এক রেখা ম্লানিমার মত মাত্র ফুটে উঠেছে! ভাব দেখি একবার এই দুর্বিষহ যাতনার বিড়ম্বনা! নারী, বিশ্বের সব কিছু কোমলতা আর মাধুর্য-সুষমা দিয়ে গড়া নারী, হাজার করেও তার বুকে কান্না জাগে না, বেদনাও আঘাত দিতে পারে না! এর যাতনা আর ছটফটানি বুঝিয়ে বলবার নয় রে বোন, এ–কষ্টে যার হৃদয় কখনও এমনি শুকিয়ে ঠনঠনে পাথর হয়ে গিয়েছে সেই বুঝবে!…  বৈশাখের কান্না দেখেছিস? তার ঐ হু-হু-হু-হু রোদ্দুরে, ধু-ধু-ধু-ধু গোবি-সাহারায় ধুলো-বালি, শন-শন-শন-শন শুকনো ঝড়-ঝঞ্ঝা, পাহাড়-ফাটা শুষ্কতার বিপুল চড়চড়ানি, দীর্ণ-বিদীর্ণ রুক্ষ খোঁচা খোঁচা উলঙ্গ মূর্তির রুদ্র বীভৎসতা আর খাঁ খাঁ নগ্নতার হাহাকার ক্রন্দন শুনেছিস? তার ঐ কঠোর কাঠচোটা অট্টহাসির খনখনে কাংস্য আওয়াজের মাঝে সারা বিশ্বের বিধবার অশ্রুহারা সকরুণ কান্নার নীরব ধ্বনি শুনেছিস? এ-বিষাক্ত তিক্ত কাঁদন বুঝিয়ে বলবার নয় রে বোন, এর লক্ষ ভাগের এক ভাগও বাইরে প্রকাশ করে দেখানোর ক্ষমতা আমার নেই! এ শাস্তি যেন অতি বড় দুশমনেরও না হয়! এই তো সবচেয়ে বড় নরক-যন্ত্রণা! এই তোদের ‘বাবিয়া দোজখ’। এতে মানুষ মরে না বটে, কিন্তু এই কূট হলাহল-যন্ত্রণা তাকে নিশিদিন জবাই-করা অসহায় প্রাণীর মতন ছট-ফটিয়ে কাতরিয়ে কাতরিয়ে মারে! শিব নাকি সমুদ্র-মন্থনের সমস্ত বিষ পান করে নীলকণ্ঠ নাম নিয়েছেন, কিন্তু তিনি যত বড় দেবতাই হন, তাঁর শক্তি যত বেশি অনির্বচনীয় হোক, আমি জোর করে বলতে পারি যে, এই অশ্রুহীন কান্নার তিক্ত বিষ এক ফোঁটা গলাধঃকরণ করলেই তাঁর কণ্ঠ ফেটে খান খান হয়ে যেত! তবে আমরা যে এখনও বেঁচে আছি? হায় রে বোন! আমরা যে মানুষ–রক্ত মাংসের মানুষ! আমাদের শরীরে যা সয়, তা যদি দেবতাদের শরীরেও সইত, তবে তাঁরা এতদিন দেবতা না থেকে মানুষ হয়ে জন্মে মুক্তিলাভ করতেন! কেননা দেবতাদের চেয়ে মানুষ ঢের ঢের, অনেক–অনেক উঁচু! তাঁদের যে একটা অমানুষিক শক্তিই রয়েছে সমস্ত সহ্য করবার। কিন্তু মানুষের এই ক্ষুদ্র বুকের ক্ষুদ্র শক্তির সহ্যগুণ ক্ষমতা যতটুকু তার চেয়ে অনেক বিপুল বহু বিরাট দুঃখ-কষ্ট ব্যথা-বেদনা আঘাত-ঘা যে সহ্য করতে হয়! এত কষ্টেও কিন্তু সে সহজে মরে না। মরণ এ-দুঃখীদের প্রতি বাম! তার রথ এসব আর্তদের পথ দিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, এ বিড়ম্বিত হতভাগাদের কর্ণে তার দূরাগত চাকার ধ্বনিও শ্রুত হয় না! বৃথাই সে হাঁক-ডাক মারে,–‘মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান। কিন্তু শ্যাম ততক্ষণে অন্ধকার পথ দিয়ে মরণ-ভীতুদের কানে গিয়ে তাঁর মৃত্যু-বাঁশির বেলাশেষের তান শুনান!…

হাঁ, কীজন্য তোকে এত কথা জানিয়ে বা বাজে বকে বিরক্ত করলাম তা পরে জানাচ্ছি। এখন, কী কথা থেকে এতসব প্রাণের কথা এসে পড়ল?… আমি বলছিলাম যে, নারীর নারীত্ব কিছুতেই মরবার নয়। সত্যি-সত্যিই বোধ হয় অহল্যা নারী চিরকাল পাষাণী থাকতে পারে না! নারীই যদি পাষাণী হয়ে যায়, তবে যে বিশ্ব-সংসার থেকে লক্ষ্মীর কল্যাণী মূর্তিই উবে যায়, আর বিশ্বও তখন কল্যাণ-হারা হয়ে তৈলহীন প্রদীপের মতই এক নিমিষে নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়ে যায়! এই কল্যাণী নারীই বিশ্বের প্রাণ! এ-‘নারী’ হিম হয়ে গেলে বিশ্ব-প্রাণের স্পন্দনও এক মুহূর্তে থেমে যাবে!…  আমি যখন নিজেকে নারীত্ব-বিবর্জিতা এক পাষাণী প্রতিমা মনে করে অমনি অশ্রুবিহীন মৌন ক্রন্দনে আমার মর্মর পাষাণ মর্ম-কন্দরের আকাশ-বাতাস নিয়ত বিষাক্ত তিক্ত আর অতিষ্ঠ ভারি করে তুলেছিলাম, তখন তোর ঐ চিঠির লেখার গোটা কয়েক মাত্র আঁচড় কী করে বুকের এক দিককার এত ভারি পাষাণ তুলে ফেলে অশ্রুর একটি ক্ষীণ ঝরনাধারা বইয়ে দিলে? কী করে আজ আমার অনেক দিনের বাঞ্ছিত কান্না তার মধুর গুঞ্জনে আমার মূক মন-সারীর মুখে বাক ফুটালে? তাই ভাবছি আর বড় প্রাণ ভরেই এই কান্নার মৃদুল মধুর বুদ্‌বুদ্-ভাষা প্রিয়তমের বাঁশির পাতলা গিটকিরির মতই আবেশ-বিহ্বল প্রাণে শুনছি! তোর চিঠিটা এতদিন পরে এমনি না-চাওয়ার পথ দিয়ে হঠাৎ আমার পাষাণ-দেউলের খিড়কিতে এসে আচমকা ঘা না দিলে তা এত সহজে খুলত না, তা আমি এখন বেশ বুঝতে পারছি। এ যেন দোর-বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে একেবারে অপ্রত্যাশিত প্রিয়জনের মুখে ডাকনাম ধরে আহ্বান শুনে চমকে দোর খুলে দিয়ে পুলক-লাজে অপ্রতিভ হওয়া! কিন্তু এখন আবার ভয় হচ্ছে বোন যে, এ-দোর অভিমানে আবার বন্ধ হতেও তো দেরি না হতে পারে। অনেক কালের পরে ফিরিয়ে-পাওয়া প্রিয়জনকে দেখে বুকে হরষণ যেমনই জাগে, তার পিছু পিছু অভিমান-ক্রন্দনও তেমনই জলভরা চোখ নিয়ে এসে সে দাঁড়ায়! তাই বলি কী, তুই এমনি অপ্রত্যাশিত পথ দিয়ে এমনি করে আচমকা কুক দিয়ে দিয়ে আমার মর্মর-মন্দিরের পাষাণ অর্গল খুলে ফেলিস! এখন আমার যা মনের অবস্থা, তাতে যদি তুই রোজ এসে এমনি করে দেখা দিস তাহলে হয়ত আবার আমার মনের খিড়কি বন্ধ হয়ে যাবে। কী বলিস ভাই? লক্ষ্মীটি, এতে যেন অভিমানে তোর পাতলা অধর ফুলে না ওঠে! তোর সেই হারিয়ে-যাওয়া ‘সাহসি’ সইটিকে আগে এই গম্ভীরা শিক্ষয়িত্রী মহাশয়ার মাঝে জাগিয়ে তোল, তাহলে আবার নয়ত শিং ভেঙে বকনা হওয়া যাবে!উপমাটা নেহাত ওঁচা হয়ে পড়ল, না লো? সে যেই হোক, তোমার সেই চির-কিশোরী সাহসিটা যে মরেছে, একদম মরেছে লো! তাকে বাঁচতে হলে কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় রস আনতে হবে! বুঝলি? পারবি তো? দেখিস বেহায়া ছুঁড়ি, তুই যেন এই অবসরে আমার জন্যে বরাদ্দ করা চোখে চালসে-লাগা বুড়ো-হাবড়া বলদ বরের দোহাই পাড়িস নে! হাঁ, লো! আমার এখনও বিয়েই হল না, আর এরই মধ্যে নিকের জন্যে কোন হাবড়া-বুড়োকে মোতায়েন করলি? তা ভাই, তোর যদি কোন নানাজি বা দাদাজি থাকেন তা হলে খবর দিস, এক দিন বর পসন্দ করতে নাহয় যাওয়া যাবে। তাঁকে এখন থেকে চুলে কলপ দাড়িতে খেজাব আর চোখে সুরমা লাগানো অভ্যেস করতে বলবি কিন্তু! কন্যা-পক্ষের কিন্তু একটা কথা ভাই, দেখিস, সে নানা-বরের যেন ঐ সেই বাঁকুড়ার শুকলাল বুড়োর মত (মনে আছে তাকে?) য়্যা এক-কুলো দাড়ি না থাকে! মা গো মা! সে যে আমার মাথার চুলের চেয়েও বড় রে! বুড়ো চলেছে তো চলেছে, যেন রাজসভার বন্দিনী চামর ঢুলোতে ঢুলোতে চলেছে! এত যে বলছি তার কারণ দাড়ির ঐ জটিল জটিলতার মধ্যে হাত-মুখ জড়িয়ে গেলে একেবারে জবর-জং আর কী, নড়ন-চড়ন নাস্তি।

দাঁড়া, আগে আমার নিজের রামপটের আরও একটু না বললে আর মনের উতপুতোনি মিটছে না। এইটে বলে বাকি দরকারি কথা কটা সেরে ফেলতে হবে। কেননা, এরই মধ্যে প্রায় নটা বেজে গেল। যদিও আমি গল্প-উপন্যাস লিখে থাকি, কিন্তু আমার এই প্রিয়জনদের চিঠি লেখবার সময় আর কিছুতেই সব কথা বেশ গোছালো করে লিখতে পারিনে। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু তা যেন অন্তত আমার কাছে ভাই বেশ মিষ্টি লাগে। এতে কেরদানি করে লেখবার চেয়ে যে আসল প্রাণটুকুর–সত্যের সত্য-মিথ্যা ধরা পড়ে যায়! এই জন্যে খুব বেশি ভাবাবেগ থাকা আমার বিবেচনায় খারাপের চেয়ে ভালই বেশি। তাছাড়া, এতে লাগাম-ছাড়া ঘোড়ার (যেমন তোদের নূরুল হুদা বাঁধন-হারা) মতন একটা বন্ধনহীন উচ্ছৃঙ্খল আনন্দ বেশ গাঢ় করে উপভোগ করা যায়। এ আনন্দ কিন্তু বন্ধন-দশাপ্রাপ্ত বেচারিদের কাছে একটা অনাসৃষ্টি চক্ষুশূলের মতই বাজবে। আহা, এ-বেচারাদের প্রাণে যে আনন্দই নেই, তা তারা আনন্দের মুক্তির মাধুর্য বুঝবে কী করে? একটু সাংসারিক সামান্য মামুলি সুখের মায়াতেই এরা মনে ভাবে, কেন এই তো আনন্দ! সেই দাড়িওয়ালা রাজার দাড়িতে তেঁতুল-গুড় লাগিয়ে সেই দাড়ি চুষে আম খাওয়ার স্বাদ বোঝা আর কী!…  যাক সে সব কথা, আমরা তো আর জোর করে মরা লোককে বাঁচাতে পারব না! যার প্রাণে আনন্দই নেই তাকে বুঝাব কী–দু চুলোর ছাই আর পাঁশ?

দেখলি? কী বলতে গিয়ে ছাই ভুলেই গেলাম! যাক গে!…

আমার পরম স্নেহের পাগল পথিক-ভাই নূরুকে নিয়ে যখন আমায় খোঁচাই দিয়েছিস রেবা, তখন তার দিক হয়ে আমায় রীতিমত ওকালতি বাক্‌যুদ্ধ (দরকার হলে মল্লযুদ্ধও অসম্ভব নয়!) করতে হবে দেখছি তোর সাথে। কেননা, আমিই এখন এ স্নেহ-হারার বড় বোন, আর সে হিসাবে তুই আমার ভাই-এর ভাবি অর্থাৎ কি-না আমার ভাজ! অতএব আমি তোর ননদিনি! তবে আয় একবার ননদ-ভাজে বেশ করে একটা কাজিয়া-কোঁদল পাকানো যাক, একেবারে কাহারবা বাজার মত জোর! আমি এই আমার আঁচলপ্রান্ত কোমরে জড়ালাম! তুইও তবে তোর মালসা-খ্যাংরা নিয়ে বস।

সর্বপ্রথম পাগল নূরুর-কাণ্ড-কারখানা নিয়ে তোর এত রাগ হওয়া ভয়ানক অন্যায়। যে বাঁধন নেবে না, তাকে জোর করে বাঁধতে গিয়েছিলি, সে কখনও সম্ভব হয় রে বোন? পাগলা হাতি আর উদমো ষাঁড়কে জিঞ্জির বা দড়াদড়ি দিয়ে বাঁধলে হয় তারা বাঁধন ছিঁড়বে, নয় আছাড় খেয়ে খেয়ে মরে বন্ধনমুক্ত হবেই হবে। আর যদিই ব্যতিক্রম স্বরূপ বেঁচে যায়, তবে সে বাঁচা নয়, সে হচ্ছে জীয়ন্তে-মরা! মুক্ত আকাশের পাখিকে সোনার শিকল, মণি-মাণিক্যের দাঁড়, দুধ-ছোলা দেখিয়ে হয়ত প্রলুব্ধ করা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু তাকে কেউ বেঁধে রাখতে তো পারবে না। সেও অমনি করে বন্ধনমুক্ত হবেই! যার রক্তে-রক্তে বাঁধন-হারার ব্যাকুল ছায়ানটের নৃত্য-চপলতা নাচছে, শিরায়-শিরায় পূর্ণ তেজে নট-নারায়ণ রাগের ছন্দ-মাতন হিন্দোল-দোল দিচ্ছে, তাকে থামাতে যাওয়া মানেই হচ্ছে, তার ঐ নৃত্য-চপলতা আর হিন্দোল দোলে আরও আকুল চঞ্চলতা জাগিয়ে দেওয়া, আরও বিপুল দোল-উন্মাদনা দুলিয়ে দেওয়া! তুই ওকে ঘুম পাড়িয়ে শান্ত করতিস? হাসি পায় তোর ছেলে-মানুষি কথা শুনে! আগ্নেয় পর্বত দু-চার দিন শান্ত থাকলেও তার বুকের আগুন-দরিয়া যাবে কোথায়? আমরা বাইরে থেকে তাকে শান্ত ভেবে খুব চাল চালতে পারি তার ওপরে,কিন্তু এটা যে আমরা ভুলে যাই যে, তার বুকের অগ্নি-সিন্ধুতে অনবরত ঊর্মি-লীলার তাণ্ডব-নাচ চলেছে; ঐ তুঙ্গ তরঙ্গ-গতির সমস্ত শক্তি জমে জমে এক এক বার যখন হু-হু করে আগুনের প্রতাপ-ফোয়ারা ছোটে, তখন আমরা গালে হাত দিয়ে ভাবি,–ইস্ হল কী!…  নয়? আমি তো তোকে হাজার বার মানা করেছিলাম যে, মিছে বোন এ খ্যাপাকে গারদে পুরবার চেষ্টা, এ হচ্ছে বিশ্ব-মাঠে ছেড়ে-দেওয়া চিরমুক্তের দাগ। উদ্‌মো ষাঁড়! গরিবের কথা বাসি হলে ফলে!…  আমার বুক-ভরা বেদনা-ঝঞ্ঝা এনে এই বাঁধন-হারার ব্যথার প্রশান্ত মহাসাগরে দুরন্ত তরঙ্গ-সংঘাত আর কল-কল্লোল জাগিয়ে দেওয়ার যে বদনাম তুই আমার ওপর দিয়েছিস, তাতে সত্য হলে আমি সগৌরবেই সায় দিতাম। কিন্তু আদতে যে সেটা ভুল বোন। এ ঘর-ছাড়া পাগলের দলকে কে যে কোন্ চিরব্যথার বন থেকে ঘর-ছাড়া ডাক ডাকছে, তা আমিও বলতে পারব না, তুইও পারবিনে, এমনকি ঐ ঘর-ছাড়া পাগল নিজেই বলতে পারবে না!সে তো আজকের গৃহ-হারা নয় রে রেবা, সে যে চির উদাসী, চিরবৈরাগী! সৃষ্টির আদিম দিনে এরা সেই যে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে, আর তারা ঘর বাঁধল না। ঘর দেখলেই এরা বন্ধন-ভীতু চখা হরিণের মতন চমকে ওঠে। এদের চপল চাওয়ায় সদাই তাই ধরা পড়বার বিজুলি-গতিতে ভীতি নেচে বেড়াচ্ছে! এরা সবাই কান খাড়া করে আছে, কোথায় কোন্ গহন-পারের বাঁশি যেন এরা শুনছে আর শুনছে! যখন সবাই শোনে মিলনের আনন্দ-রাগ, এরা তখন শোনে বিদায়ী-বাঁশির করুণ গুঞ্জরন! এরা ঘরে বারেবারে কাঁদন নিয়ে আসছে, আবার বারেবারে বাঁধন কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে! ঘরের ব্যাকুল বাহু এদের বুকে ধরেও রাখতে পারে না। এরা এমনি করে চিরদিনই ঘর পেয়ে ঘরকে হারাবে আর যত পরকে ঘর করে নেবে! এরা বিশ্ব-মাতার বড় স্নেহের দুলাল, তাঁর বিকালের মাঠের বাউল-গায়ক চারণ-কবি যে এরা! এদের যাকে আমরা ব্যথা বলে ভাবি, হয়ত তা ভুল! এ খ্যাপার কোনটা্ যে আনন্দ, কোনটান যে ব্যথা তাই যে চেনা দায়! এরা সারা বিশ্বকে ভালবাসছে, কিন্তু হায়, তবু ভালবেসে আর তৃপ্ত হচ্ছে না! এদের ভালবাসার ক্ষুধা বেড়েই চলেছে, তাই এরা অতি সহজেই স্নেহের ডাকে গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু স্নেহকে আজও বিশ্বাস করতে পারল না এরা। তার কারণ ঐ বন্ধন-ভয়। এদের ভালবাসা এত বিপুল আর এত বিরাট যে, হয়ত তোমরা তাকে উন্মাদের লক্ষণ বলেই ভাব।…  আর অগ্নির কথা? আগুন যদি না থাকবে, তবে এদের চলায় এমন দুর্বার গতি এল কী করে? এরাই পতঙ্গ, এরাই আগুন। এরাই আগুন জ্বালে, এরাই পুড়ে মরে। আগুন তো এদের খেলার জিনিস।

আগুনে এ যে কত বার ঝাঁপ দেবে, কত বার পুড়বে, কত বার বেরিয়ে আসবে, তা তুই তো জানিসনে, আমিও জানিনে!

তোর সহজ বুদ্ধি দিয়ে তুই সহজভাবে নূরুকে যেরকমভাবে বুঝে আমায় চিঠিতে লিখেছিস, তা দু-এক জায়গা ছাড়া সবই সত্যি। হয়ত আমার ভুল হতে পারে বুঝবার, তবে কিনা, তোদের সংসারী লোকের চেয়ে সংসারের বাইরে থেকে নানান ব্যথা-বেদনার মধ্যে দিয়ে আমরা মানব-চরিত্র বা মানুষের মন বেশি করে বুঝি আর সেই হিসাবেই আমি এই বাঁধন-হারাদের সম্বন্ধে এত কিছু মনস্তত্ত্ব বা দর্শন লিখে জানালেম তোকে।

নূরুকে স্রষ্টার বিদ্রোহী বলে তোর ভয় হয়েছে বা দুঃখ হয়েছে দেখে আমি তো আর হেসে বাঁচিনে লো! নূরুটাও স্রষ্টার বিদ্রোহী হল, আর অমনি স্রষ্টার সৃষ্টিটাও তার হাতে এসে পড়ল আর কী!…  এখন ওর কাঁচা বয়েসে, গায়ের আর মনের দুই-এরই শক্তিও যথেষ্ট, তার শরীরে উদ্দাম উন্মাদ যৌবনের রক্ত হিল্লোল বা খুন-জোশি তীব্র উষ্ণ গতিতে ছোটাছুটি করছে, তার ওপর আবার এই স্বেচ্ছাচারী উচ্ছৃঙ্খল বাঁধন-হারা সে,–অতএব এখন রক্তের তেজে আর গরমে সে কত আরও অসম্ভব সৃষ্টি-ছাড়া কথাই বলবে! এখন সে হয়ত অনেক কথা বুঝেই বলে, আবার অনেক কথা না বুঝেই শুধু ভাবের উচ্ছ্বাসেই বলে ফেলে! একটা বলবান জোয়ান ষাঁড় যখন রাস্তা দিয়ে চলে, তখন খামখাই সে কত দেওয়ালকে কত গাছকে ঢুঁস দিয়ে বেড়ায় দেখেছিস তো? এটা ভুলিসনে যেন রেবা যে, এ-ছেলে বাংলাতে জন্ম নিলেও বেদুইনদের দুরন্ত মুক্ত-পাগলামি, আরবিদের মস্ত গোর্দা, আর তুর্কিদের রক্ত-তৃষ্ণা ভীম শ্রোতাবেগের মত ছুটছে এর ধমনিতে-ধমনিতে। অতএব এসব ছেলেকে বুঝতে হলে এদের আদত সত্য কোন্খানে, সেইটেই সকলের আগে খুঁজে বের করতে হবে। এত বড় যে ধর্ম, তারও তো সামাজিক সত্য, লৌকিক সত্য, সাময়িক সত্য ইত্যাদি-ইত্যাদি কত রকমের না বাইরের খোলস-মুখোশ রয়েছে, তাই বলে কি এই সব অনিত্য সত্যকে ধর্মের চিরন্তন সত্য বলে ধরতে হবে? অবিশ্যি সত্য কখনও অনিত্য বা নৈমিত্তিক হতে পারে না, শুধু কথাটা বোঝাবার জন্যে আমাকে ওরকম করে বলতে হল। প্রত্যেক ধর্মই সত্য–শাশ্বত সত্যের ওপরই প্রতিষ্ঠিত এবং কোন ধর্মকে বিচার করতে গেলে তার এই মানুষের গড়া বাইরের বিধান শৃঙ্খলা দিয়ে কখনও বিচার করব না; আর তা করতে গেলে কানার হাতি দেখার মতই ঠকতে হবে; তেমনি মানুষকে–তার চির-অমর আত্মাকে–তার সত্যকে বুঝতে হলে তার অন্তর-দেউলে প্রবেশ করতে হবে ভাই! তার বাইরের মিথ্যা আচার-ব্যবহারকে সত্য বলে ধরব কেন?

হয়ত আমি কথাগুলো বেশ গুছিয়ে বলতে পারছিনে, আর পারবও না, কেননা, আমার মনের সে-শান্ত স্থৈর্য নেই। মন শুধু বাইরে বাইরে ছুটে বেড়াচ্ছে। তবে এরই মধ্যে আমার বলবার আদত সত্যটুকু খুঁজে বের করে নিয়ো।…  হাঁ, আদত মানুষটাকে বুঝতে হলে অবিশ্যি তার এই আচার-ব্যবহারগুলোকেই প্রথমে ঘেঁটে দেখতে হবে। কিন্তু এ ঘেঁটে সব সময় মুক্তি পাওয়া যায় না, অনেক সময় কাদা-ঘাঁটাই সার হয়। যাক, তাহলেও মানুষ মাত্রেরই নানান ভুল-ভ্রান্তি আছে দোষ-গুণ নিয়েই মানুষ। যারা এই সব ‘স্রষ্টার বিদ্রোহী’ তরুণদের গালি দেয়, তারাই বা ‘স্রষ্টার রাজভক্ত’ প্রজা হয়ে সে স্রষ্টা-রাজা সম্বন্ধে কোন খবরাখবর রাখে কি? আর পাঁচ জনের মতন শুধু চোখ বুঁজে অন্ধবিশ্বাসে অন্ধের মতন হাতড়িয়ে বেড়ানোতেই কি সে অনাদি অনন্ত সত্যকে তারা পাবে? যারা এইরকম বিদ্রোহীদের নাস্তিক ইত্যাদি বলে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তাড়া করে, তারা আস্তিক হয়েই সে পরম পুরুষের কতটুকু খবর রাখে? তাঁর খবর রাখা, তাঁকে ভাবা তো অন্য কথা, তাঁকে–সত্যকে যে অহরহ এই আস্তিকের দল প্রতারণা করছে, এ ভণ্ডামি কি তারা নিজেও বোঝে না? মন্দিরে গিয়ে পূজা করা আর মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়াটাই কি ধর্মের সার সত্য? এগুলো তো বাইরের বিধি। কিন্তু এগুলোকেই কি তারা ভাল করে মেনে চলতে পারে? মন্দিরে গিয়ে দেবতার মুখস্ত মন্ত্র আওড়ায়, কিন্তু মন থাকে তার লোকের সর্বনাশের দিকে! মসজিদে গিয়ে নামাজের ‘নিয়ত’ করেই ভাবে যত সব সংসারের পাপ দুশ্চিন্তা! এই ভণ্ডামি এই প্রতারণাই তো এদের সত্য! অতএব এদের মত এমনই করে আত্মাকে বিনাশ না করে তাদেরই একজন যদি সত্যকে পাওয়ার জন্যে নিজের নতুন পথ কেটে নেয়, তবে এরা লাটি-সোঁটা নিয়ে যে তাকে তাড়া করবেই–কিন্তু নিবীর্যের মত! একজন সত্যান্বেষী বিদ্রোহীকে তাড়া করবার মত শক্তি এ-মিথ্যুক ভণ্ডদের যে বিলকুল নাস্তি! ও কেবল ভীত সারমেয়ের দাঁত-খিঁচুনি মাত্র। এরা যে মিথ্যাকে, প্রতারণাকে কেন্দ্র করেই আত্মাকে ক্রমেই নীচের দিকে ঠেলছে, তা এটা বুঝলেও কিছুতেই স্বীকার করবে না। সত্যকে স্বীকার করবার মত সাহসই যদি থাকবে, তবে এদের এমন দুর্দশাই বা হবে কেন? মনসুর যখন বিশ্বের ভণ্ড-মিথ্যুকদের মাথায় পা রেখে বলেছিল,–‘আনাল হক’–আমিই সত্য–সোহহম, তখন যেসব বক-ধার্মিক তাঁকে মারবার জন্যে হই-হই রই-রই করে ছুটেছিল, এ লোকগুলো যে তাদেরই বংশধর! এ মিথ্যা ধার্মিকের দলই তো সে দিনে ঐ মহর্ষি মনসুরের কথা, তাঁর সত্য বুঝতে পারেনি, আজও পারছে না, আর পরেও পারবে না; এদের এই রকম একটা দল থাকবেই! কিন্তু যারা সত্যকে পেতে চলেছে, যাদের লক্ষ্য সত্য, যারা সত্যের হাতছানি দেখছে তাদের এই সব শক্তিহীন হীনবীর্য লোক কি থামাতে পারে? সত্য যে চির-বিজয়ের মন্দারমালা গলায় পরে শান্ত-সুন্দর হাসি হাসবে।…  তাছাড়া, বিদ্রোহী হওয়াও তো একটা মস্ত শক্তির কথা। লক্ষ লক্ষ লোক যে জিনিসটাকে সত্য বলে ধরে রেখে দিয়েছে, চিরদিন তারা যেপথ ধরে চলেছে তাকে মিথ্যা বলে ভুল বলে তাদের মুখের সামনে বুক ফুলিয়ে যে দাঁড়াতে পারে, তার সত্য নিশ্চয়ই এই গতানুগতিক পথের পথিকদের চেয়ে বড়। এই বিদ্রোহীর মনে এমন কোন শক্তি মাথা তুলে প্রদীপ্ত চাওয়া চাইছে যার সংকেতে সে যুগ-যুগান্তরের সমাজ, ধর্ম, শৃঙ্খলা, সব-কিছুকে গা-ধাক্কা দিয়ে নিজের জন্যে আলাদা পথ তৈরি করে নিচ্ছে! কই, হাজারের মধ্যে আর নয়শো নিরানব্বই জন তো এমন করে দাঁড়াতে পারে না? তুমি কী বল, এই নয়শো’ নিরানব্বই জনই তা হলে সত্যকে পেয়ে বসে আছে? যে মরণকে ধ্বংসকে পরোয়া না করে না-চলার পথ দিয়ে চলে, কত বড় দুর্জয় সাহস তার? আর সত্যের শক্তি অন্তরে না থাকলে তো সাহস আসে না।… তাছাড়া, প্রত্যেকের আত্মারও তো এক-একটা স্বতন্ত্র গতি আছে। আর সকলের মত একজন গড্ডলিকা-প্রবাহে যদি না চলে, তা বলে কি তার পথ ভুল? বিশেষ করে বিদ্রোহী হওয়ার যেমন শক্তি থাকা চাই, তেমনই অধিকারও থাকা চাই। কই, আমি তো বিদ্রোহী হতে পারিনে, তুমি তো হতে পার না; আমাদের মাঝে যে সে বিপুল সহ্য-শক্তি নেই।… বিদ্রোহটা তো অভিমান আর ক্রোধেরই রূপান্তর। ছেলে যদি রেগে বাপকে বাপ না বলে, বা মা-কে মা না বলে, কিংবা বলে যে এরা তার বাপ-মা নয়, তাহলে কি সত্যি-সত্যিই তার পিতার পিতৃত্ব, মাতার মাতৃত্ব মিথ্যা হয়ে যায়? যে ক্ষুব্ধ অভিমান তার বুকে জাগে, তার শেষ হলেই মায়ের খ্যাপা ছেলে ফের মায়ের কোলেই কেঁদে লুটিয়ে পড়ে! কিন্তু এই যে অভিমান, এই যে আক্রোশের অস্বীকার, তা দিয়ে হয় কী?–না, সে তার বাপ-মাকে আরও বড় করে চেনে, বড় করে পায়। এই রকম করে হঠাৎ একদিন চিরন্তনী মাকেও হয়ত তার পক্ষে পাওয়া বিচিত্র নয়। তাছাড়া তার যে অধিকার আছে এই অভিমান করবার, এই বিদ্রোহী হওয়ার, কেননা, সে তার মায়ের স্নেহটাকে এত নিবিড় করে পেয়েছে যা দিয়ে সে জানে যে, তার সমস্ত বিদ্রোহ সমস্ত অপরাধ মা ক্ষমা করবেনই। যে স্নেহে যে ভালবাসায় অভিমান জাগতে পারে, রাগ জন্মাতে পারে, সে স্নেহ-ভালবাসা কত বড় কত উচ্চ একবার ভাব দেখি‌ ! এতে মা-র অপমান না হয়ে তাঁকে যে আরও বড় করে দেওয়া হয় রে! তাই মা ঝোঁক-নেওয়া খ্যাপা ছেলের ঝোঁক নেওয়া দেখে ছেলের হাতের মার খেয়েও গভীর স্নেহে চেয়ে চেয়ে হাসেন! এ-দৃশ্য বলে বোঝাবার নয়! ছেলের হাতের এ-মার খাওয়াতে যে মায়ের কত আনন্দ কত মাধুরী তা তো বাইরের লোকে বুঝতে পারে না। তারা মনে করে, কী বদমায়েশ দুরন্ত ছেলে বাবা! কিন্তু যে ছেলে মায়ের এত স্নেহ পায়নি, এমন অধিকার পায়নি, সে মাকে মারা তো দূরের কথা, তাঁর কাছে ভাল করে কাছ ঘেঁসে একটা আবদারও করতে পারে না!… তাই প্রথমেই বলেছিলাম যে, এই বাঁধন-হারা নূরু যেন বিশ্ব-মাতার বড় স্নেহের দুলাল–ঠিক ‘কোল-পোঁছা’ ছেলের মতন আবদেরে একজিদ্দে একরোখা–আর তোদের কথায় বিদ্রোহী! অনেক ছেলে মরে মরে যাওয়ার পর যে এই খ্যাপাই মায়ের মড়াছে ঝোঁকদার ছেলে! দেখবি, এ-শিশু আবার হাসতে-হাসতে মায়ের স্তন্য-ক্ষীর পান করছে আর আপন মনেই খেলছে!…  মা যখন তাঁর দুষ্টু ছেলেকে স্নান করবার সময় সাবান দিয়ে তোয়ালে দিয়ে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করেন, তখন তার কান্না আর রাগ দেখেছিস তো? সে তখন হাতে-দাঁতে মায়ের চুল ছিঁড়তে থাকে, কিল-চাপড় বর্ষণ করতে থাকে আর চেঁচিয়া আকাশ ফাটিয়ে ফেলে। মা কিন্তু হাসতে হাসতে তাঁর কাজ করে যান। তাকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে নীলাম্বরী ধুতিটি পরিয়ে দিয়ে চোখে কাজল টিপটি দিয়ে যখন মুখে ঘন ঘন চুমো খান তখন আবার সেই দুরন্ত ছেলের প্রাণ-ভরা হাসি দেখেছিস?–নূরুটারও এখন হয়েছে তাই। বিশ্ব-মাতা এখন তাকে ধুয়ে-মুছে রগড়ে সাফ করে নিচ্ছেন, আর সেও তাই এই হাত-পা ছুঁড়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে। মা যেদিন কোলে নিয়ে চুমো খাবেন, সেদিন কোথায় থাকবে এর এই ভূতোমি আর কোথায় থাকবে এই কান্না আর লাফালাফি। তখন সব সুন্দর–সুন্দর! সুন্দর! এ শুভ দিন তার জীবনে জাগবেই ভাই, দেখে নিস তুই। তবে তার হয়ত এখন অনেক দেরি। তার জীবনে হৃত্য রয়েছে, তবে রুদ্র মূর্তিতে! এর পরেই যখন কল্যাণ জাগবে জীবনে, তখন দেখবি সব সুন্দর হয়ে গিয়েছে। ছেড়ে দে বোন, ওকে ছেড়ে দে! চলুক ও নিজের একরোখা পথ দিয়ে–কল্যাণকে আপনিই ও খুঁজে নিবে। কল্যাণ নিজেই ওর পিছু পিছু মালা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সময় বুঝলেই সে এই পাগলার গলায় মালা দিয়ে ওকে ভুজ-বন্ধনে বেঁধে ফেলবে। তুই লাল কালিতে ডগডগে করে লিখে রেখে দে এই কথা। আমি জানি, আমার এ ভবিষ্যদ্‌বাণী ফলবেই ফলবে, যদিও আমি পয়গম্বর নই।

হাঁ, ধর্ম সম্বন্ধে আমার আর একটু বলবার আছে। আমি তো পূর্বেই বলেছি যে, সব ধর্মেরই ভিত্তি চিরন্তন সত্যের পর–যে সত্য সৃষ্টির আদিতে ছিল, এখনও রয়েছে এবং অন্ততেও থাকবে। এই সত্যটাকে যখন মানি, তখন আমাকে যে ধর্মে ইচ্ছা ফেলতে পারিস। আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিষ্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম। আমি তো কোন ধর্মের বাইরের (সাময়িক সত্যরূপ) খোলসটাকে ধরে নেই। গোঁড়া ধার্মিকদের ভুল তো ঐখানেই। ধর্মের আদত সত্যটা না ধরে এঁরা ধরে আছেন যত সব নৈমিত্তিক বিধি-বিধান। এঁরা নিজের ধর্মের উপর এমনই অন্ধ অনুরক্ত যে, কেউ এতটুকু নাড়াচাড়া করতে গেলেও ফোঁস করে ছোবল মারতে ছোটেন। কিন্তু এটুকু বোঝেন না তাঁরা যে, তাঁদের ‘ইমান’ বা বিশ্বাস, তাঁদের ধর্ম কত ছোট কত নীচ কত হীন যে, তা একটা সামান্য লোকের এতটুকু আঁচড়ের ঘা সইতে পারে না। ধর্ম কি কাচের ঠুনকো গ্লাস যে, একটুতেই ভেঙে যাবে? ধর্ম যে বর্মেরই মতন সহ্যশীল, কিন্তু এ-সব বিড়াল তপস্বীদের কাণ্ড দেখে তো তা কিছুতেই মনে করতে পারিনে। তাঁদের বিশ্বাস তো ঐ এতটুকু বা সত্যের জোরও অমনই ক্ষুদ্র, যে, তার সত্যাসত্য নিরূপণের জন্যে তোমায় আলাদা পথে যেতে দেওয়া তো দূরের কথা, তা নিয়ে একটা প্রশ্নও করতে দেবেন না।… এই সব কারণেই, ভাই, আমি এই রকম ভণ্ড আস্তিকদের চেয়ে নাস্তিকদের বেশি ভক্ত, বেশি পক্ষপাতী। তারা সত্যকে পায়নি বলে সোজা সেটা স্বীকার করে ফেলে বলে বেচারাদের হয়েছে ঘাট! অথচ তারা এই সত্যের স্বরূপ বুঝতে, এই সত্যকে চিনতে এবং সত্যকে পেতে দিবা-রাত্তির প্রাণপণ চেষ্টা করছে–এই তো সাধনা–এই তো পূজা, এই তো আরতি। এই জ্ঞান-পুষ্পের নৈবেদ্য চন্দন দিয়ে এরা পূজা করবে আর করছে, তবু দেবতাকে অন্তরে পায়নি বলে মুক্তকণ্ঠে আবার স্বীকারও করছে যে, কই দেবতা? কাকে পূজা করছি? আহা! কী সুন্দর সরল সহজ সত্য! এদের ওপর ভক্তিতে আপনিই যে মাথা নুয়ে পড়ে। এরা যাই হোক, এরা তো মিথ্যুক নয়, এরা বিবেকের বিরুদ্ধে কথা বলে না–এরা যে সত্যবাদী। অতএব এরা সত্যকে পাবেই পাবে; আজ না হয় কাল পাবে! আর এই বেচারারা অন্ধ বিশ্বাসীর দল? বেচারারা কিছু না পেয়েই পাওয়ার ভান করে চোখ বুঁজে বসে আছে। অথচ এদের শুধোও দেখবে দিব্যি নাকি-কান্না কেঁদে লোকে-দেখানো ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বলবে,–‘আঁ হাঁ হাঁ!–মঁরিঁ মঁরিঁ। ওঁই ওঁই ওঁই দেঁখোঁ তিঁনিঁ!’ মিথ্যার কী জঘন্য অভিনয় ধর্মের নামে–সত্যের নামে! ঘৃণায় আপনিই আমার নাক কুঁচকে আসে। তাই তো আমি বলি যে, এই পথ-হারানোটা পথ খুঁজে পাওয়ারই রূপান্তর। তবে যা-কিছু বুঝবার ভুল। গুরুদেব সত্যি-সত্যিই গেয়েছেন, –

‘ভাগ্যে আমি পথ হারালেম পথের মধ্যখানে!’

কোটি কোটি নমস্কার করছি এই মহাঋষির শ্রীচরণারবিন্দে এইখানে! যাক, এসব আলোচনা আপাতত এইখানেই ধামা-চাপা দিলাম। এই কেঁচো উস্‌কাতে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়ার ভয়েই বোন আমি মনে করি এসব আলোচনা আর করব না; কিন্তু স্বভাব যায় না মলে! বাপ-মায়ে বুঝেই যে আমার সাহসিকা নাম দিয়েছিলেন, তা আমিও আজ যেন বুঝতে পারছি। তোর চিঠি পেয়ে আমার মনে যে ভাবের উচ্ছ্বাস বা সৃষ্টির বেদনা জেগেছিল, তার দরুণই হয়ত এত কথা লিখে ফেললাম। যতক্ষণ এই ভাবাবেগ আছে ততক্ষণই লিখতে পারব, তারপর আর নয়। তাই ‘এই বেলা নে ঘরে ছেয়ে’ কথাটার উপদেশ স্মরণ করেই যত পারছি লিখে চলেছি।

আমার বাচ্চা-সই মাহ্‌বুবা সম্বন্ধে যে ভয় করেছিস তুই, তার কোন কারণ নেই। আমি তাকে খুব ভাল করেই বুঝেছিলাম যে-কয়দিন ছিলাম তার সঙ্গে। সে সহজিয়া। সেহজেই ঐ খ্যাপাটাকে ভালবেসেছিল, আর এমনই সহজ হয়েই সে তাকে চির-জনম ভালবাসবে। তার বুকে যদি কখনও যৌবনের জল-তরঙ্গ ওঠে, তবে সে খুব ক্ষণস্থায়ী। যে সহজিয়া অতি সহজেই তার প্রিয়তমকে ভালবাসতে পারে, তার মত সুখী দুনিয়ায় আর কেউ নেই রে বোন। তার শান্তি তার আনন্দ অনাবিল, পূত, অনবদ্য,–একেবারে শিশির-ধোয়া শিউলির মত! সে তার সমস্ত কিছু নৈবেদ্যের ডালি সাজিয়ে সেই যে এক মুহূর্তেই তার পীতমের পায়ে শেষ একরেখা দীর্ঘশ্বাস আর আধ-ফোঁটা নয়ন-জলের অঞ্জলি অঞ্জলি করে ঢেলে দিয়েছে তার পরে তার আর কোন দুঃখই নেই! সে জেনেছে যে, সে সব পেয়েছে। সে জেনেছে যে, সে প্রাণ ভরে দিয়েছে আর সে দান দেবতাও বুক পেতে নিয়েছেন। সে জানে–খুব সহজভাবেই জানে–তার এত বুক-ভরা পবিত্র ফুলের দান, তার এমন সহজ পূজা ব্যর্থ হওয়ার নয়। সহজভাবে দিতে জানলে যে অতি-বড় পাষাণ-দেবতাও সেখানে গলে যান, নিজেকে রিক্ত করে সমস্ত কিছু ঐ সহজ পূজারিকে দান করে ফেলেন। গুরুদেবের ‘কে নিবি গো কিনে আমায় কে নিবি গো কিনে’ শীর্ষক কবিতাটা পড়েছিস তো? তাতে তিনি দিন-রাত তাঁর পসরা হেঁকে হেঁকে বেড়াচ্ছেন,–ওগো আমায় কে কিনে নেবে? কত লোকই এল,–রাজা এল, বীর এল, সুন্দরী এল, কিন্তু হায়, সকলেই ‘ধীরে ধীরে ফিরে গেল বন-ছায়ার দেশে।’ সকলেরই ‘মুখের হাসি ফুরিয়ে গেল নয়ন জলে শেষে!’ কিন্তু ধুলো নিয়ে খেলা-নিরত একটি ছোট্ট ন্যাংটা শিশু যখন তুড়ুং করে লাফিয়ে উঠে তার কচি ছোট্ট দুটি হাত ভরিয়ে ধুলো-বালি নিয়ে বললে–‘আমি তোমায় অমনি নেব কিনে!’ তখন কবিও তাঁর পসরা ঐখানে ঐ সহজিয়ার সহজ চাওয়ার কাছে বিনামূল্যে বিকিয়ে দিয়ে মুক্তি পেলেন। আমাদেরও নয়নপাতা তখন এই সহজের আনন্দে আপনিই ভিজে ওঠে! এমনি সহজ করে চাওয়া চাই, এমনি সহজ হয়ে দেওয়া চাই রে বোন, আর তবেই যে পায় সেও বুক ভরে নেয়, যে দেয় তারও বুক ভরে যায়!…  এই সহজ আনন্দে তার সমস্ত কিছু দিতে পেরেছে বলেই তো মাহ্‌বুবা আজ ছোট্ট মেয়ে হয়েও নিখিল সন্ন্যাসিনীর চেয়েও বড়। তাই সে বৈরাগিনীও হল না, সন্ন্যাসিনীও হল না; ক্রুদ্ধা জননি যখন তাকে এক বুড়ো বরের হাতে সঁপে দিলে, তখনও সে সহজেই তাতে সম্মতি দিল। এই সহজিয়ার কিন্তু এতে কোন দুঃখই নেই, সে যে জানে যে, তার যা দেওয়ার তা অনেক আগেই যে নিবেদিত হয়ে গিয়েছে । অর্ঘ্য নিবেদিত হয়ে যাওয়ার পর শূন্য সাজি বা থালাটা যে ইচ্ছা নিয়ে যাক, তাতে আর আসে যায় না।… এই সহজিয়া পূজারিনির দল যে আমাদের ঘরে-ঘরে রয়েছে বোন, তবে আমাদের চোখ নেই,–আমরা দেখেও দেখি না এই নীরব পূজারিনিদের। এই সহজিয়া তপস্বিনীদের পায়ে আমি তাই হাজার হাজার সালাম করছি এইখানে! আমাদের বুকে কিন্তু এই মূক মৌন সহজিয়াদের ব্যথাটাই চোখে পড়ে, আর বুকে বেদনার মতই এসে বাজে। বাস্তবিক বোন, কী করে এই হতভাগিনি (না, ভাগ্যবতী?)-দের বুক এমন সহজ সুখের নেশায় ভরে যায়? এমন সর্বস্বহারা হয়েও কী করে এত জান-ঠাণ্ডা –করা তৃপ্তির হাসি হাসে? আমরা তা হাজার চেষ্টা করেও বুঝতে পারব না; কেননা, আগে যে অমনি সহজ হতে হবে ও বুঝতে হবে।… সেই জন্যেই বলেছিলাম যে, মাহ্‌বুবার জন্যে কোন চিন্তা করিসনে। সে আনন্দকে পেয়েছে, সে কল্যাণকে পেয়েছে,–সে মুক্তিও পেয়েছে এইখানে। কিন্তু সে এত বড় বড় কথা হয়ত বুঝবেও না। আমরা যেটা বুঝি চেষ্টা-চরিত্তির করে সে সেটা সহজেই বুঝে নিয়েছে, এইখানেই তো সহজিয়ারা সহজ আনন্দে মুক্ত।

এই সহজিয়া মাহ্বুাবা হয়ত সহজেই বন্ধনের মাঝে মুক্তি দিতে পারত। কিন্তু কেন যে তা হল না, সে একটা মস্ত প্রহেলিকা। আমি এখনও এর কিছুই বুঝতে পারছিনে। এইখানটাতেই নূরুটাতে আজ মাহ্‌বুবাটাতে যে একটা কোন গুপ্ত জটিলতা আছে, যেটার খেই আমি আজও পাচ্ছিনে। আর, আমার মতন ওস্তাদ যেখানে হার মানলে সেখানে তোর মতন চুনো-পুঁটির তো কর্মই নয়! তবে এর নিগূঢ় মর্ম আমি বের করবই করব, এই বলে রখলাম তোকে!

আমার বিশ্বাস, মাহ্‌বুবাটা এই বাঁধন-হারাকে সইতে পারবে না বলে মিথ্যা ভয়ে তাকে মুক্তির নামে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে। অবশ্য এটা আমার আন্দাজ মাত্র। এটা না হওয়াই সম্ভব, কারণ সে মেয়ে যে সহজিয়া, তার তো এ ভয় হওয়ার কারণ নেই!… দেখি, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!

একা মাহ্‌বুবার মা বেচারিই রাক্ষুসি হবে কেন, রেবা? এ-রকম রাক্ষুসি মা–যারা জেনে-শুনে মেয়ের সর্বনাশ করে–তোদের সমাজে, হিন্দুর সমাজে এমনকি, আমাদের স্বাধীন সমাজেও তো কিছু আশ্চর্য নয় আর কমও নয়। এই তো সতীত্বনাশ! অবিশ্যি, সতীত্ব বলতে মনের না দেহের বোঝেন এঁরা, তা জানিনে; কিন্তু আমার কথায় সতীত্ব তো মনে। মনে মনে যাকে স্বামিত্বে বরণ করলে মেয়ে, তা জেনে শুনেও তার কাছ থেকে ছিনিয়ে দুটো মন্ত্র আউড়িয়ে জোর করে এই বোবা মেয়েদের যে কসাই মা-বাপ হত্যা করে! তাহলে প্রকারান্তরে মা-বাপেই মায়ের সর্বনাশ করলে না কি? উলটো আবার সম্প্রদানের সময় মেয়েকে সীতা সাবিত্রী হতে বলা হয়? কী ভণ্ডামি দেখছিস!

তোর শাশুড়ি সম্বন্ধে অভিমান করে যে অভিযোগ করেছিস, তা নেহাত অন্যায় হয়নি তোর পক্ষে। কেননা, সংসারের গিন্নির এরকম ঝাল ছাড়তে হয় মাঝে মাঝে। তবে যখন ঘরের গিন্নিও হয়েছিস লো, তখন ঘর-গেরস্থালির একটু ঝাঁঝ সইতে হবে বই কি! এখনও তোর ‘যৌবন’ বয়েস কিনা (অর্থাৎ ভোগের সময়!) তাই মাঝে মাঝে বিরক্তি আসে। তবে এও সয়ে যাবে। জানিস তো, কাঁচা লঙ্কা গিন্নিদের বড্ড প্রিয়! এ ঝাল না থাকলে সংসার মিষ্টিও লাগে না আর তাতে রুচিও হয় না।

তোর শাশুড়ি বেচারির একেবারে সাদা সরল মন। সারা-মন-প্রাণ তাঁর মায়ের স্নেহে ভেজা। এসব লোক সংসারে থেকেও চিরদিন একটু উদাসীন গোছের। সংসারের বাজে ঝক্কি এঁরা নিমের রস গেলা করেই গেলেন। যেই দেখেন, আর একজনের হাতে সঁপে দিয়ে নিজে একটু আরামে নিশ্বাস ফেলতে পারবেন অমনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁছেন। তাইতো তোর হাতে সব কিছুর ভার সঁপে দিয়ে তিনি নিরিবিলির অত্যন্ত শান্তিতে ডুবতে চাইছেন। ওঁর খেলার সাথী এখন তোর কচি মেয়ে আনারকলি, কেননা, উনিও যে এখন তোর আর একটি নেহাত ঠাণ্ডা মেজাজের লক্ষ্মী মেয়ে আর সেইজন্যই তো তুই তাঁর লক্ষ্মী-মা। আহা, ওঁর এ-শান্তিতে বাধা দিসনে বোন! এ তপশ্চারিণীর নীরব পূত তপোবনে গিয়ে গোলমাল করে আর তাঁর শান্তি ভাঙিসনে। জানি ওঁর দুঃখ অনেক, আর তাইতেই তো তিনি এখন শান্তির ছায়া খুঁজছেন। বাড়িতে থেকেও এসব লোকের অস্তিত্ব বোঝা যায় না, কিন্তু বাড়ির সমস্ত শান্তিটুকুকে ঘিরে রয়েছেন এঁরাই, বিহগ-মাতার ডানার মত করে।

এঁরা যখন চলে যান, তখনই বুঝতে পারি যে, কী এক শূন্যতায় সারা সংসার ভরে উঠেছে।

হাঁরে, ভাল কথা! তুই এ চিঠিতে খুকির কথা লিখিসনি যে বড্ড? প্রথমে এটা আমার চোখে পড়েনি, কিন্তু শেষে জানতে পেরে হাজারবার তন্ন-তন্ন করে তোর চিঠি খুঁজেও আমার ‘আনারকলি’ মা-র নাম-গন্ধও পেলাম না, আমার এতে কান্না পেয়ে গেল রাগে! আচ্ছা ভোলা মেয়ে তুই যা হোক লো! বোধ হয় মেয়েটাকে চিরদিন এমনই অনহেলাই করবি, না? জানি, তুই তোর হাজার কাজের ওজর করবি! চুলোয় যাক তোর কাজ, এমন আনারকলির মতই এতটুকু ফুটফুটে মেয়ে,–হায়, তাকে কখনও তোকে বুক ভরে সোহাগ করতে দেখলাম না। এ আমাদের বুকে বড় লাগে বোন! অমন মা হতে গিয়েছিলি কেন লো তবে মুখপুড়ি? ‘মা’ আসবার আগেই হয়ত এই মা-কাঙালি ‘মেয়ে’ এসে পৌঁছেছে। কিন্তু এখনও কি তোর মাঝে ‘মা’ জাগল না? না, হাতের কাছে পেয়েই এত অনহেলা? দেখ, তোর নাড়ির মাঝে যে মা এখনও সুপ্ত। খুকির বাবা রবিয়ল সাহের পুরুষ হলেও তাঁর মাঝে সেই মা কী স্নেহময়ী মূর্তিতে জাগ্রত! কিন্তু এই ছেলের জাত কী নিমকহারাম, সে যা পায় তাকে ছেড়ে দিয়ে যেটা পায় না সেইটাকেই পাবার জন্যে হাঁকুচ-পাঁকুচ করে। বাপের এত স্নেহ পেয়েও তাই সে যে বেশি করেই তোর কোলের–মায়ের কোলের কাঙাল, তা তো আমি নিজেই দেখেছি।

সত্যি ভাই, এ কচি মেয়েটাকে পেলে আমি যেন এখন বেঁচে যাই। আমি ওকে এখনই চাইতাম, কিন্তু দুষ্টু তুই হয়ত একটা বদমায়েশি বিদ্রুপ করে বসবি বলে থেমে গেলাম। খুকি বড় হলে কিন্তু আমার কাছে এসে থাকবে আর লেখাপড়া শিখবে বলে কথা দিয়েছিস, মনে থাকে যেন।

সোফিটার অত্যাচারে তুই নাজেহাল হয়ে গিয়েছিস শুনে আমি আর হেসে বাঁচিনে। আচ্ছা, জব্দ, না? ও জন্ম হতেই বড্ড বেশি আদর-সোহাগ পেয়ে মানুষ হয়েছে কিনা, তাই এত দুরন্ত! তা নাহলে তোদের হারেমের আইবুড়ো থুবড় মেয়ে কি বলতে পারত ‘আমি বিয়ে করব না, থুবড় থাকব’? ও এখনও একেবারে ছেলেমানুষ। তবে বিয়ে হওয়ার পর বরের হাতে পড়ে হয়ত বাগ মানলেও মানতে পারে। ওর আদত ইচ্ছে কী জানিস? ও নূরুটাকে বিয়ে করতে চায়। আমায় একদিন কানে কানে বলে ফেলে আমার হাসি দেখে সে কী ভাই রাগ আর লজ্জা তার! কেঁদে-কেটে তো একাকার–অথচ খামখাই! আমি আর হেসে বাঁচিনে।

তারপর তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছি যে, এ কথাটা কী আমি আর সবাইকে বলতে পারি রে, যে, আমার ছোট বোন ভালবাসায় পড়েছে! যতই হোক, আমি তো তার সাহসী দিদি, তবে তখন সে চুপ করে। দেখিস ভাই, তোর পায়ে পড়ি, তুই যেন এ-কথা আবার বলে দিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দিসনে! এ-পাগলি ছুঁড়িটার যৌবন কিন্তু বয়সের অনেক পেছনে পড়ে; হয়ত বিশ বছর বয়সে গিয়ে তবে কখনও ওর যুবতির লজ্জা আসবে। তবে বিয়ে হয়ে গেলে আলাদা কথা। কেননা, তখন কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো হবে কিনা।

তোর খেলার সাথী বেচারার দুঃখে আমি এতটুকুও সহানুভূতি দেখাতে পাচ্ছিনে, কেননা তিনি এমন মূক না হয়ে গেলে কি আর তোর আমায় এখন মনে পড়ত রে ছুঁড়ি!

হাঁ, সোফির বিয়েতে যাব বই কি! তা নাহলে ওকে বাগ মানাবে কে? হয়ত বিয়ের সময়ই রেগে দোর দিয়েই বসে থাকবে! ওকে বলে দিস বোন যে, সে বিয়ে যদি নেহাতই না করে, তবে আমার স্কুলের মেয়ে দফতরি করে দেওয়া যাবে। দেখিস সে যেন ঠাট্টা মনে না করে। তা হলেই আমি হাবাৎ আর কি?

আমার বরের ভাবনা নিয়ে তোকে আর ভাবতে হবে না লো, তুই নিজের চরকায় তেল দে! ‘যার বিয়ে তার ধুম নেই পাড়া-পড়শির ঘুম নেই!’ যত দিন না আমার সন্ন্যাসীঠাকুর আসবেন ততদিন আমায় সন্ন্যাসিনীই থাকতে হবে বই কি! সংসার না ডাকলে তো আর সংসারী হতে পারিনে নিজে সেধে! থাক, আরও অনেক বলবার রইল! খুকিকে চুমু দিস। ইতি

তোর সাহসী সই

সাহসিকা