মাস্টার মশাইরা বলেন, “অঞ্জনকে দ্যাখ। দেখে শেখ।” সত্যিই শুধু আমরা ক্লাস সেভেনের ছেলেরা শুধু নই, অঞ্জনকে দেখে আমাদের এই পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সব ক্লাসের ছেলেরাই। তাকিয়ে দেখার মতই ছেলে বটে সে। ক্লাস সেভেনের একটা ছেলে যে এত পড়াশুনো করতে পারে তা কেউ দেখা তো দূরের কথা, কানেও কখন শোনেনি।

আমরা দু-একবার তমালকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘হ্যাঁরে তমাল তুই কখন পড়বি? তমাল বলেছে, “খেপেছিস। এত কাজ, পড়ার সময় কই।” সেই তমালই অঞ্জনের পড়ার যা হিসেব আমাদের দিয়েছে তা এইরকম—

ভোর সাড়ে চারটের সময় ঘুম থেকে ওঠা। সময় যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য বালিশের পাশেই বই থাকে। সঙ্গে সঙ্গে পড়তে বসে যাওয়া। দাঁত মাজতে মাজতে সেই পড়া মনে মনে আওড়ানো। ছাদে মর্নিং ওয়াক করতে করতে পড়া। জলখাবার খেতে খেতে পড়া। সাড়ে ছটার সময় ভূগোলের মাস্টারমশাই চলে আসবেন। সাড়ে সাতটায় ইতিহাসের, সাড়ে আটটায় ইংরেজির, সাড়ে নটায় অঙ্কের। মাস্টার মশাইরা চলে গেলে স্নান, খাওয়া। তখনই সকালের পড়াগুলো সব পরপর মুখস্থ বলে যাওয়া। এরপর চারটে পর্যন্ত স্কুল। তখনও টিফিনে পড়া। ছুটি হলেই দৌড়ে বাড়ি। সাড়ে চারটেয় বাংলার মাস্টারমশাই, পৌনে ছটায় বিজ্ঞানের, আটটা বেজে দশ মিনিটে কর্মশিক্ষার, সাড়ে ন’টার সময় সংস্কৃতর। এবং সবথেকে আশ্চর্যের বিষয়, তমাল আমাদের জানিয়েছে, অঞ্জনের জন্য একজন ড্রিলের মাস্টারমশাইও বাড়িতে আসেন। রাত সোয়া দশটা নাগাদ নাকি দেখা গেছে তিনি ছাদে অঞ্জনকে এক দুই, এক-দুই-তিন করে ড্রিল শেখাচ্ছেন!! এরকম ছেলেকে বাবা, মা, দাদা এবং মাস্টারমশাইরা যে “আদৰ্শ” হিসেবে বার বার আমাদের সামনে আনবেন এ আর আশ্চৰ্য্য কী?

এদিকে বাড়িতে স্কুলে শুধু ‘অঞ্জন-অঞ্জন’ শুনে আমরা তো একেবারে তিতিবিরক্ত। এ কেমন পড়ার ছিরি? আমরা অনেক ভেবেচিন্তে একটা ফন্দি করলাম। ঠিক হল এবার আমরা সরস্বতী পুজোটা করব একেবারে অঞ্জনদের বাড়ির উল্টোদিকের মাঠে। সেই মত সব ব্যবস্থা হল। রাত জেগে প্যান্ডেল বাঁধলাম। মনোজ খুব ভাল বাজনা বাজাতে পারে। সে কোথা থেকে জানি একটা ঢাক যোগাড় করে আনল। এবার হতে না হতেই সেই ঢাক বাজতে শুরু করল, ধাঁই না না, ধাঁই না না গিজ গিনিতা গিজ গিনিতা। সঙ্গে তাপসের কাঁসরঘণ্টা। আমরা বললাম, “দেখি ব্যাটা অঞ্জন এমন দিনেও কত পড়ে!” সরেজমিনে দেখে আসতে তমাল পিছনের দরজা দিয়ে সুড়ুৎ করে অঞ্জনদের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। মিনিট তিনেকের মধ্যেই তমাল ফিরে এসে জানাল, ঘরের সবকটা জানলায় দরজায় মোটা মোটা পর্দা টাঙিয়েছে অঞ্জন। ভেন্টিলেটারে সোয়েটার। এমনকি নিজের দুকানে তুলো পর্যন্ত গুঁজেছে! এত করেও ঘরে যেটুকু ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে তা চাপা দিতে অঞ্জন ইতিহাস বই খুলে বাবর, আকবর, শেরশাহ, লৰ্ডকার্জন, বলে পরিত্ৰাহি চেঁচাচ্ছে!

“যা বাবাঃ” বলে আমরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন বের হল, সেদিন দেখা গেল অঞ্জন ভূগোলে সাত, ইতিহাসে তের, অঙ্কে সতের, বিজ্ঞানে নয় পেয়েছে। অঞ্জনের এই রেজাল্ট দেখে আমরা সত্যিই একটু দুঃখ পেয়েছিলাম। বেচারি এত খাটাখাটনি করল! সব একেবারে জলে গেল। অঞ্জন কিন্তু একটুও মুষড়ে পড়ল না। বলল, “বাড়ি যাই। পড়তে বসতে হবে।”

Leave a Reply