রঘুনাথের মত হিংসুটে ক্লাস সেভেনে কেন, গোটা ইস্কুলেই আর কেউ নেই। বন্ধুরা তার নাম রেখেছে হিংসুটে নাথ।

সব কিছু নিয়ে রঘুনাথ হিংসে করে। পিন্টু কেন ক্লাসে ফার্স্ট হয়, আমি কেন হই না? তপন কেন ফুটবল টিমে চান্স পেল, আমি কেন পেলাম না? বিশ্বরূপ কেন ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকে লক্ষ্মণের পার্ট পেল, আমি কেন পেলাম না? অমিয় কেন ভূগোলে বিরাশি পেল, আমি কেন পেলাম না? অজয় কেন গান গাইতে পারে, আমি কেন পারি না? এইরকম সব।

হিংসে করতে করতে রঘুনাথের এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে ক্লাসে কেউ মাস্টারমশাইয়ের কাছে মার খেলে পর্যন্ত সে হিংসে করে বসে। আসলে হিংসে করতে গিয়ে যেসব গুলিয়ে ফেলে। এরকম ছেলেকে কেইবা পছন্দ করবে? তাই রঘুনাথকেও তার বন্ধুরা এড়িয়ে চলে। নইলে ছোটখাটো সব ব্যাপার নিয়েই তো তার সঙ্গে ঝগড়া নয়, হাতাহাতি পর্যন্ত হয়। এই তো সেদিন বিদ্যুৎ ওর স্ট্যাম্পের অ্যালবাম নিয়ে এসেছিল। ক্লাসে একেবারে হৈ হৈ পড়ে গেল। টিফিনের সময় সবাই হুমড়ি খেয়ে সেই অ্যালবাম দেখছিল আর পঞ্চমুখে বিদ্যুতের প্রশংসা করছিল। বিদ্যুৎ নেতার মত মুখ করে গর্বের হাসি হাসছিল।

রঘুনাথের তো এই কাণ্ড দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে। সে আর সহ্য করতে না পেরে দুম করে বলে বসল, “ওসব জাল স্ট্যাম্প।” ব্যস, যা হবার তাই হল। বিদ্যুৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। কুস্তি, বক্সিং, ক্যারাটে কিছুই বাকি রইল না। অন্যরা কোনক্রমে দুজনকে সরিয়ে দেয়।

আর একদিন মধু এসে বলল, “আমার সেজমামা আফ্রিকা ঘুরে আজ ফিরলেন।”

অমনি সবাই মধুকে ঘিরে বসল। মধু তখন তার মামার গা ছমছমে আফ্রিকা ভ্রমণের গল্প বলতে শুরু করল বন্ধুদের। পরদিন রঘুনাথ ক্লাসে এসেই ঘোষণা করল, “আফ্রিকা না ছাই, মধুর সেজমামা সুন্দরবনের গোসাবা থেকে বদলি হয়ে কলকাতায় এসেছেন। আমার ছোট কাকার এক বন্ধু তো ওই অপিসেই কাজ করেন।” এরপর কি আর মধুর পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব? তবে সেদিন শুধু চুলের ওপর দিয়ে মারপিট শেষ হয়েছিল। এই হল রঘুনাথ। রঘুনাথকে তার বন্ধুরা হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছে। কিন্তু পরশু দিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।

সেদিন রঘুনাথ ছুটির পর লাইব্রেরিতে বসে টিনটিনের নতুন বইটা পড়ছিল। নতুন বই অন্য কেউ আগে পড়ে নেবে একথা সে কল্পনাও করতে পারে না। যখন সে ইস্কুল ছেড়ে বের হচ্ছে, তখন সব ফাঁকা। সন্ধে হয় হয়। ঠাণ্ডা বাড়ছে। হনহনিয়ে ইস্কুল গেটের মুখে এসে দেখে দারোয়ানের বেঞ্চিতে জবুথবু হয়ে বসে আছে তাদেরই ক্লাসের কল্যাণ। আরে, এখনও কল্যাণ কেন? থমকে দাঁড়ায় রঘুনাথ। তার হিংসুটে মন খচখচ করে ওঠে। ব্যাপারটা কী? “কি রে কল্যাণ? কী হয়েছে?” জিগ্যেস করে সে।

কল্যাণ প্ৰায় কাঁপতে কাঁপতেই বলে “জ্বর এসেছে রে। উঠতে পারছি না।” হিংসে করবার মত কিছু ঘটেনি দেখে যেন নিশ্চিন্ত হল রঘুনাথ। বলল, “তা বসে আছিস কেন? গায়ে তো দেখছি সোয়েটারও নেই। একটা রিকশা ডেকে বাড়ি চলে যা।”

কল্যাণ কাঁচুমাচু মুখে জানাল, “রিকশ ভাড়া নেই।” কথা শেষ হলে রঘুনাথ চলেই যাচ্ছিল। হঠাৎ কী ভেবে ফিরে এল সে। নিজের পকেট থেকে বের করল দুটো টাকা। চারপাশ ভাল করে দেখে জোর করে সেগুলো ধরিয়ে দিল কল্যাণের হাতে। তারপর ফিসফিস করে বলল, “কাউকে বলিস না যেন। সব যা হিংসুটে। তোকে সাহায্য করে বাহাদুরিটা নিতে পারল না বলে হিংসে করবে।” কল্যাণ অবাক।

Leave a Reply