আমাদের ক্লাস সেভেনে নতুন ক্লাস টিচার এলেন অনিল মহান্তি। চুলগুলো খাড়াখাড়া, এক গাল খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটো লাল আর বন-বন করে ঘুরছে। ভয়ঙ্কর রাগী। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকেই বললেন, “কোনওরকম বেয়াদপি করেছিস তো পিঠের ছাল তুলে দেব”
শুধু এই হুঙ্কারেই তিনি থামলেন না। প্রথমদিনই তিনি প্রত্যেককে এক ঘা, দু’ঘা করে দিয়ে জানালেন, “প্রথম রাতেই বেড়াল মেরে রাখলাম। আশা করি তোরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলি তোদের নতুন ক্লাস টিচার কেমন।”
বুঝব আর কী? আমরা তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলাম আর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। মহান্তিবাবুর রাগের খবর দাবানলের মত স্কুলে ছড়িয়ে পড়ল। শুরু হয়ে গেল ফিসফিস করে আলোচনা, পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ে এমন রাগী মাস্টারমশাই আগে কখনও আসেননি।
সেই থেকে প্রথম পিরিয়ডটা আমাদের কাটতে লাগল ভয়, উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায়। কারণে, অকারণে, যখন-তখন, যে কোনও সময়, যে কারোর ওপর মহান্তিবাবু রেগে যেতেন। আর তার কপালে জুটত অশেষ লাঞ্ছনা। তিনি স্কুলের একেবারে কাছেই বাড়ি ভাড়া নিলেন। একা মানুষ। সকাল সকাল চলে আসেন স্কুলে। বাড়ি ফেরেন সবার শেষে। কামাই বলে কোনও ব্যাপারই নেই। ঝড়-বৃষ্টিতে তাঁর কোনও অসুবিধাই হয় না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’পা হাঁটলেই তো স্কুল। সবকিছুই যেন আমাদের বিরুদ্ধে গেছে।
এরকমভাবেই চলছিল। হঠাৎ মহান্তিবাবু একটা কাণ্ড করলেন। একদিন ক্লাসে এসে বললেন, “দ্যাখ, বেশ কয়েকদিন তোদের সঙ্গে থাকলাম। দেখলাম তোরা সবাই বদ আর পাজি। তবে তোদের মধ্যে কয়েকজন আছে যারা বেশি পাজি। আমি অনেক ভেবেচিন্তে এরকম পাঁচজনের একটা লিস্টি তৈরি করেছি। এরা হল বাবলু, রাতুল, অঞ্জন, কৌশিক আর সুব্রত। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় এরা সবার থেকে কম নম্বর পেয়েছে। এদের দ্বারা কিস্যুু হবে না। ছাত্র তো নয়, এক একটা গাধা। শুধু তাই নয়, এরা হল পচা ফলের মত। ঝুড়িতে থাকলে অন্যগুলোও পচে যাবে। তাই আমি ঠিক করেছি, এই পাঁচজন পাজির সঙ্গে কেউ মিশবি না। ওদের একঘরে করা হল। যদি দেখি ওদের কারোর সঙ্গে কেউ কথা বলেছিস, তাহলে কপালে খুব দুঃখ আছে।”
মহান্তিবাবুর কথার প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, তার মুখের ওপর কথা বলার সাহসই আমাদের কারোর নেই। হতে পারে বাবলুরা পড়াশোনাতে তেমন ভাল নয়, হতে পারে মাথায় নানারকম দুষ্টুবুদ্ধি খেলে, তা বলে ওদের বয়কট করতে হবে? এ যে লঘু পাপে গুরু দণ্ড। ক্লাস সেভেনের কেউ এতে খুশি নই। কিন্তু উপায় কী?
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গণ্ডগোল শুরু হল। মহান্তিবাবু তো হুকুম দিয়েই খালাস। কিন্তু ঝামেলা পোয়াতে হচ্ছে আমাদের। কৌশিককে বাদ দিয়ে টিম করতে হল। ক্লাস নাইনের কাছে চারটে গোল খেতে হল। সুব্রত ছাড়া ক্যারাম কম্পিটিশনে নামলে যা হওয়ার তাই হল। ক্লাস সেভেন ফার্স্ট রাউন্ডেই বাতিল। রাতুল পরপর দু’বার আন্তঃজেলা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় মেডেল এনেছিল। এবার রাতুল বাদ, মেডেলও বাদ গেল। অঞ্জন ছিল বলে এঁকে দেয়—, আমরা দেওয়াল পত্রিকায় ফার্স্ট হয়ে আসছিলাম এতদিন। এবছর অঞ্জনকে দিয়ে আঁকানো গেল না, দেওয়াল পত্রিকায় আমরা লাস্ট হলাম। বাবলু আমাদের ক্লাসে সবথেকে ভাল অভিনয় করে। স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশনে সেই আমাদের ক্লাস থেকে প্রতিনিধিত্ব করে। এবার আর কেউ চান্স পেল না।
পরপর এইসব ঘটনায় আমাদের ক্লাস সেভেনের মনোবল একেবারে ভেঙে পড়ল। যে ‘পাজি ছেলে’দের জন্য আমরা গর্ব অনুভব করতাম, তাদের একঘরে করে দিয়ে আমরাই সবকিছুতে পিছিয়ে যেতে থাকলাম। তবু আমাদের কিছু করার নেই। ক্লাস টিচারের হুকুমে আমরা ঐ পাঁচবন্ধুর সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি।
এরকম সময় একটা ঘটনা ঘটল। টানা তিনদিন মহান্তিবাবু এলেন না। আমরা খুশি। চারদিন হল, পাঁচদিন হল, ছ’দিন হল। মহান্তিবাবু এলেন না। আমরা দারুণ খুশি। সাতদিন হল, আটদিন হল তাও মহান্তিবাবুর দেখা নেই। আমাদের মধ্যে খুশির একেবারে বাঁধ ভেঙে পড়ল। আমরা ঠিক করলাম আরও দুদিন যদি উনি না আসেন তাহলে আমরা পিকনিক করতে যাব।
পরদিন আমরা যখন ক্লাসে জটলা করে পিকনিকের মেনু তৈরি করছি তখন বাবলু হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “মহান্তিবাবুর খুব অসুখ করেছে। প্রচণ্ড জ্বর। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন।”
বলা বাহুল্য মহান্তিবাবুর অসুখ নিয়ে আমাদের কারোরই কোনও মাথাব্যথা নেই। পিন্টু বলল, “এ তো ভাল খবর। ভাল করে খোঁজ নিয়ে এসে বল তো দিন পনের আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারব কিনা?” তাপস বলল, “রোজ থাপ্পড় খেয়ে খেয়ে আমার ফোলা গালদুটো কেমন বসে গেছে। বয়ে গেছে আমার ওকে দেখতে যেতে।”
বাকিরাও একমত হয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে পিকনিকের আলোচনায় মন দিল। আমরা ঠিক করলাম, বাবলু, কৌশিক, অঞ্জন, রাতুল, সুব্রতদেরও সঙ্গে নেব।
পিকনিক খুব ভাল হল। খুব হৈচৈ হল। আলুর দমটা পুড়ে যাওয়াতে সবাই চেয়ে চেয়ে ওটাই খেতে লাগল। সবাই এসেছিল, আসেনি শুধু ঐ পাঁচজন। আমরা ভাবলাম, ওদের অভিমান হয়েছে।
আরও সাতদিন বাদে মহান্তিবাবু এলেন। চুলগুলো আর খাড়া খাড়া নেই। তেল দিয়ে পাট করে আঁচড়ানো। খোঁচা খোঁচা দাড়ি নেই। পরিষ্কার করে কামানো। এমনকি চোখ দুটোও আর অত লাল নয়। ক্লাসে ঢুকে তিনি শান্তভাবে একগাল হেসে বললেন, “তোদের পিকনিকের খবরটা আমি জেনে ফেলেছি। কিন্তু তোরা তো জানতে পারিসনি, তোদের ক্লাসের ঐ পাঁচজন পাজি সাতদিন ধরে আমার সেবা করে আমাকে ভাল করে তুলেছে। মাস্টারমশাইয়ের অসুখ করেছে বলে পিকনিক করে তোরা নিজেদেরই লজ্জায় ফেলেছিস। আর ঐ পাঁচ পাজি লজ্জায় ফেলেছে আমাকে। তোদের লজ্জাটা দুঃখের। আমারটা আনন্দের।”