সেবার ঠিক হল, আমরা দেবুর ছোট পিসির বাড়িতে বেড়াতে যাব। বেশি দিনের জন্যে নয়, মাত্র দু’দিনের জন্যে। দুদিন ধরে খুব মজা হবে।

দেবুর ছোটপিসি থাকেন ফুলডুংরিতে। দেবু বলেছে, “ওরকম সুন্দর জায়গা খুব কমই আছে।” ওখানে একটা চমৎকার পাহাড় আছে। ছোটখাটো পাহাড়। ইচ্ছে করলেই সেই পাহাড়টা বেয়ে একদম ওপরে উঠে যাওয়া যায়। আর ওই পাহাড় থেকে নেমে আসছে ফুটফুটে সাদা একটা ঝরনা। খুব গরমের সময়েও নাকি সেই ঝরনার জল একটুও শুকোয় না। সব থেকে বড় কথা হল, ওই ঝরনার দু’পাশে রয়েছে গাছের ঠান্ডা ঠাণ্ডা জঙ্গল। ওখানে পিকনিক করাটা নাকি একটা দারুণ ব্যাপার!

এসব কথা অবশ্য আমরা দেবুর মুখেই শুনেছি, আমরা যারা পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ি তারা তো কেউ কখনও ফুলডুংরিতে যাইনি। আমরা তাই জানিও না যে ফুলডুংরি সত্যি কেমন দেখতে। তবে দেবুর মুখ থেকে আমরা মাঝে মাঝেই ফুলডুংরির লোভনীয় গল্প শুনি। তাই এবার আমরা ক্লাসের কয়েকজন ঠিক করেছি ফুলডুংরিতে যাবই যাব।

কিন্তু কে কে যাবে? এটা নিয়ে খুব গণ্ডগোল শুরু হল। আমরা তো এই ক্লাসে চল্লিশজন পড়ি, তার মধ্যে আটতিরিশজনই বলল, ‘আমি যাব।’

দেবু এই শুনে একেবারে বেঁকে বসল। “না ভাই, এভাবে তো যেতে পারব না। আমার পিসিমার বাড়িতে দুটো ঘর, একটা বারান্দা, একটা ছাদ। আটতিরিশ জন কোথায় থাকবে!”

মানস বলল, “তাহলে আমরা ছাদেই থাকব। বেশ মজা হবে।”

দেবু বলল, “ছাদে লাফালাফি করলে তোমাদের মজা হতে পারে, কিন্তু আমার পিসিমা তাে ছাদের তলায় থাকবেন, তাঁর মােটেই মজা হবে না। খুব বেশি হলে চারজন যেতে পারে।”

দেবুর এই কথা শুনে আমরা আঁতকে উঠলাম।

মোটে চারজন!

দেবু বলল, “হ্যাঁ, মোটে চারজনই। আমাকে নিয়ে পাঁচজন। এবার তোমরা নিজেরা ঠিক কর কে কে যাবে।”

এই কথা ঘোষণা করে দেবু গম্ভীর মুখে পাটিগণিতের বই খুলে বিড় বিড় করে কী সব পড়তে লাগল।

এবার যে ঘটনা ঘটবার সেটাই ঘটল। পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ক্লাস সেভেনের ছেলেদের মধ্যে ভীষণ রকম হট্টগোল বেধে গেল। সকলেই ফুলডুংরি যেতে চাইল। এমনকি প্রথমে যে দু’জন ‘যাব না’ বলেছিল তারাও বলল, “যাব’!

সত্যি কথা বলতে কী অমন সুন্দর জায়গায় বেড়াতে গেলে কাকে বাদ দিয়ে কাকে নেওয়া হবে? পাহাড়, ঝরনা, জঙ্গলে যেতে তো সবাই চাইবেই, সে আর আশ্চর্যের কী! তার ওপর আবার নাকি দুপুরবেলা ওই ঝরনা থেকে জলের কণা চারিদিকে উড়ে বেড়ায়। কেউ ওখানে গেলে তার চোখেমুখে এসে লাগে। এই গল্প দেবু আমাদের সকলকে করেছে। ওই তো যত নষ্টের গোড়া। ও আরও বলেছে যে, ওই সময়টা নাকি পাহাড়ের সারা গা কৃষ্ণচুড়া ফুলে লাল হয়ে থাকে। বিকেলের ঝোড়ো হাওয়ায় সেই ফুল উড়ে এসে ঝরনার জলে পড়ে। তখন মনে হয় ঐ ঝরনাটা জলের নয়, ফুলের ঝরণা। ঝরনাটার এমনি নাম তো ডুংরি, আর ওইরকম ফুল পড়ে বলে নাম হয়েছে ফুলডুংরি। আর এসব তো আমরা কোন বইতে পড়িনি, আমাদের দেবুই বলেছে। সেই কারণেই তো সবাই ওখানে যেতে চাইছে।

রবীন বলল, “তাহলে আমরা হেডস্যারকে বলি যে আপনি বেছে দিন কোন চারজন দেবুর সঙ্গে যাবে।”

বিষ্ণু বলল, “তার থেকে আমাদের ক্লাসটিচার বিমানবাবুকে বলি।”

শুভাশিসের মত হল, “দেবুই ঠিক করুক কাকে ও সঙ্গে নেবে।”

শেষ পর্যন্ত কিন্তু কোন কথাই শোনা হল না।

দুদিন কেটে গেল। তার মধ্যে দেবু আমাদের ক্লাসের অনেকের কাছে অনেকরকম উপহার পেল। এই যেমন ভুটানের তিনকোনা স্ট্যাম্প, এক বছরের বাঁধানো অরণ্যদেব, শচীন তেণ্ডুলকরের ছবি—এইসব।

দেবু এই দুদিন ফুলডুংরি সম্পর্কে আরও দুটো তথ্য ক্লাসের সবাইকে জানিয়েছে। এক নম্বর হল, ফুলডুংরি ঝরনার ভেতর এমন চমৎকার করে পাথর সাজানো আছে যে, যেখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্নান করা যায়। আর, দু নম্বর তথ্যটা হল, ওর ছোটপিসির বাড়িতে একটা নীল রঙের দুর্দান্ত তাঁবু আছে, ইচ্ছে করলে সেটাকে জঙ্গলের মধ্যে টাঙিয়ে সারা দিন থাকা যায়।

এই তথ্য দুটো জানানোর পর দেবুকে কেউ হজমির প্যাকেট দিল, কেউ ওর অ্যাকোরিয়ামের জন্য রঙিন মাছ এনে দিল শিশি করে, কেউ ঘুড়ি এনে দিল।

সবই দেবু গম্ভীর মুখে নিল। কিন্তু চারজনের বেশিতে কিছুতেই রাজি হল না। শুধু বলল, “তোমরা এবার ঠিক করে নাও কে কে যাবে। আমরা রবিবার ভোরে রওনা হচ্ছি। ছোট পিসিকে সেইমত চিঠি লিখে দিয়েছি।”

একথা শুনে তো ক্লাসে লাফালাফি শুরু হয়ে গেল। হাতে মাত্র কটা দিন। এর মধ্যে পঁয়ত্ৰিশ জনকে বাদ দিতে হবে!

ফুলডুংরি যাওয়া নিয়ে ক্লাস সেভেনের ছেলেদের মধ্যে যে খুব ঝগড়া লেগেছে সে কথা পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সকলে জেনে ফেলল। কোন কোন ক্লাসের ছেলেরা ঠাট্টা করতেও শুরু করল।

এই নিয়ে আমাদের অনুপমের সঙ্গে এইটের সুপ্রিয়র একদিন হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে গেল। শুক্রবার দেবু স্কুলে এসে বলল, “কাল আমি স্কুলে আসব না। গোছগাছ করতে হবে। তোমরা যে চারজন আমার সঙ্গে যাবে রবিবার ভোরে স্টেশন চলে যাবে। ট্রেনে করে আমরা চলে যাব রসুইনগর, সেখান থেকে বাসে পটাসের হাট, পটাসের হাট থেকে ভ্যানরিকশায় আধঘণ্টা ফুলডুংরি। বিকেলের আগেই পৌঁছে যাব। সেদিন কেউ যেন দেরি কোরো না। চারজনই ঠিক সময়ে চলে এসো। ছটা পঞ্চান্নর ট্রেন ধরতে না পারলে দেরি হয়ে যাবে। পিসিমা আবার লুচি-আলুর দম তৈরি করে বসে থাকবেন কিনা।”

দেবুর এই কথাগুলো আমাদের কানে যেন বিষ ঢেলে দিল, গায়ে যেন কাঁটা বিঁধিয়ে দিল। শনিবার দিন হাফ ছুটির পর আমরা ক্লাসের উনচল্লিশ জন মিটিঙে বসলাম।

প্রণব বলল, “কোন চারজন যাবে ঠিক করতে হবে এখনই। আর সময় নেই।”

পিন্টু বলল, “তা হবে না। গেলে আমরা সবাই যাব।”

অশোক বলল, “ঠিক কথা। কেউ বাদ যাবে না। ফুলডুংরির মত সুন্দর জায়গায় আমরা সবাই বেড়াতে যেতে চাই।”

বিষ্ণু বলল, “একশো ভাগ ঠিক। হয় সবাই যাবে, নয় কেউ যাবে না।”

মানস বলল, “সবাইকে তো দেবু নিয়ে যাবে না।”

রথীন বলল, “ফুলডুংরি কি দেবুর জায়গা যে ও ঠিক করবে ক’জন যাবে?”

শুভাশিস বলল, “আমরা তো ফুলডুংরি চিনি না। আর চিনে যদিবা পৌঁছেই, সেখানে গিয়ে এতজন থাকবে কোথায়? এতজন মিলে তো আর গাছতলায় থাকা যায় না? তাছাড়া বাড়ি থেকে ওরকমভাবে ছাড়বেই বা কেন?”

এমন সময় সোমনাথের মাথায় কী যেন পরিকল্পনা এল। সে লাফিয়ে উঠল। বলল, “হুররে! আইডিয়া পাওয়া গেছে। আমরা সবাই যাব। সক্কলে কাল চলে আয় স্টেশনে। দেবুর আগেই আমরা ট্রেন ধরব।”

সোমনাথের কথা শুনে আমরা জোর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিন্তু ও আর একটা কথাও না বলে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।

এরপরের ঘটনাটা একেবারে রোমাঞ্চকর। সেটা এরকম–

রবিবার সকালে সোমনাথের নেতৃত্বে একদল ছেলে ঝপাং করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। এক একটা করে স্টেশন আসে আর সোমনাথ জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকায়। এরকম করে ঘণ্টা দুই পরে হঠাৎ সোমনাথ একটা স্টেশনে বলল, “এই নেমে আয়, নেমে আয়, এসে গেছি।”

আমরা তো অবাক! এত তাড়াতাড়ি এসে গেল! তবু নেমে পড়লাম হই হই করে।

স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। দুএকটা দোকান-বাজার। পেরিয়ে গেলাম তাও। তার পরই মাটির রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে আমরা বেসুরো গলায় গান গাইতে গাইতে গেলাম। কিছুটা দূরে যেতেই একেবারে খোলা একটা ধু-ধু মাঠ। উঁচু একটা টিবি। যতদূর চোখ যায় বাড়ি-ঘর কিছু নেই। শুধু এখানে ওখানে বড় বড় কতকগুলো গাছ, ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা একছুটে ঐ টিবির ওপরে উঠলাম। ওমা! টিবির পিছনে একটা পুকুর লুকিয়ে আছে! আর সেটার টলমলে জলে একদল হাঁস এমনভাবে সাঁতার কাটছে যেন ওরা সবাই ওই পুকুরটার রাজা!

প্ৰণব ‘ফ্যানটাসটিক!’ বলে ওই পুকুর পাড়েই একটা ডিগবাজি খেল। রথীন ‘দুর্দান্ত!’ বলে এক চক্কর দৌড় দিয়ে এল মাঠে। মানস “বাঃ! বাঃ! বলে তরতরিয়ে উঠে গেল গাছ বেয়ে।”

সোমনাথ টিবির মাথায় উঠে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়ার কায়দায় বলল, “বন্ধুগণ, এই হল আমাদের ফুলডুংরি। দেবুর একার ফুলডুংড়িতে ঝরনা পাহাড়, জঙ্গল আছে, আর আমাদের সকলের ফুলডুংরিতে মাঠ, পুকুর গাছ আর আকাশ আছে। এই ফুলডুংরিটা কম কিসের?”

আমরা সবাই মিলে বলে উঠলাম ‘একটুও না।’

এরপর সারাদিন আমরা ফুলডুংরির মাঠে খেললাম, পুকুরে সাঁতার কাটলাম, গাছে চড়লাম, চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখলাম, পাখির ডাক শুনলাম, টিফিনবক্স খুলে ভাল করে খেলাম। তারপর সন্ধেবেলায় ট্রেন ধরে পবনপুর ফিরে এলাম।

আমরা ট্রেনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঠিক করেছি যে পরেরবার আমরা অন্য আর একটা ফুলডুংরিতে যাব। আর দেবুকে জোর করে নিয়ে যাব।

Leave a Reply