এই বছর থেকে আর আমাদের পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে কোনও ‘প্রধান অতিথি’ থাকবে না। একথা শুনে অনেকেরই হয়ত মন খারাপ হয়ে যাবে, বিশেষ করে আমাদের এই এলাকায় যেসব মান্যিগণ্যি ব্যক্তিরা আছেন, আগামী দিনে ‘প্রধান অতিথি’ হওয়ার সুযোগ যাঁদের ছিল তারা যে যথেষ্ট কষ্ট পাবেন তা আমরা জানি। তবু এই সিদ্ধান্তের জন্য আমরা, পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র এবং মাস্টারমশাইরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। সত্যি কথা বলতে কী, অনেক দুঃখ কষ্ট, অনেক মাথার ঘাম পায়ে ঝরানোর পর আমাদের স্কুল এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল। আমরা বিশ্বাস করি, দুএকটা ঘটনার কথা খুলে বললেই পবনপুরের বেশিরভাগ মানুষই আমাদের স্কুলের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করবেন।

আর পাঁচটা স্কুলের মত, আমাদের স্কুলেও প্রতিবছর ‘বার্ষিক অনুষ্ঠান’ হয়। বেশ ধুমধাম করেই হয়। স্কুলের পিছনের দিকে প্যান্ডেল খাটানো হয়। স্টেজ তৈরি হয়। সারি দিয়ে চেয়ার পাতা হয়। বিকেল চারটে বাজতে না বাজতে ভূগোল স্যার আদিত্যবাবু গলা কাঁপিয়ে মাইকে বলতে থাকেন, নমস্কার, অদ্য বৈকাল পাঁচ ঘটিকায়–।

পরীক্ষায় যেসব ছাত্র ফার্স্ট, সেকেণ্ড হয় তাদের প্রাইজ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য। এছাড়া নাটক, গান, আবৃত্তি, হাস্যকৌতুক, ম্যাজিক—এইসব হয়। সব মিলিয়ে আমাদের দারুণ মজা। সব ছাত্রই কম বেশি জড়িয়ে পড়ি। যারা প্রাইজ পাই না, নাটক, গানেও চান্স পাই না তারা সব ভলান্টিয়ার হই। বুকে নীল ব্যাজ আটকাই। অনুষ্ঠান শেষে ব্রাউন পেপারের ঠোঙায় একটা নিমকি, একটা অমৃতি, একটা করে দানাদার পাই। প্রতি বছরই এইসব ঠিক থাকে। শুধু গণ্ডগোল হত ‘প্রধান অতিথি’ নিয়ে। আসলে ‘প্রধান অতিথি’ করে কাকে আনা হবে, তার জন্য স্কুলে একটা কমিটি ছিল। ‘প্রধান অতিথি’ কমিটি। এই কমিটিতে পবনপুরের কয়েকজন বড় বড় লোক আর কয়েকজন মাস্টারমশাই ছিলেন। অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে এই কমিটির মিটিং হত। সেখানে প্ৰচণ্ড ঝগড়া হওয়ার পর প্রধান অতিথির নাম ঠিক হত। সেই কমিটিতে একবার এমন ঝগড়া হয়েছিল যে, দু’জনকে প্রধান অতিথি করতে হয়েছিল। সেবার অনুষ্ঠানের কয়েকদিন পরেই পবনপুর মিউনিসিপ্যালিটির ভোট ছিল। মাধব গড়গড়ি, বলাই পাল দুজনে সেই ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাদের কমিটিতে দুই দলেরই সমর্থক ছিলেন। একদল বললেন, “মাধববাবুকে চাই।” একদল বললেন, “বলাইবাবুকে আনতে হবে।”

অগত্যা দু’জনেই এলেন। অনুষ্ঠান শুরুতে মাধববাবু বললেন, “আমি যদি ভোটে জিতি তাহলে এই স্কুলের প্রতি ক্লাসে যাতে ২০ জন ২৫ জন করে ফার্স্ট হয় তার ব্যবস্থা করব।” অনুষ্ঠানের শেষে বলাইবাবু বললেন, “আমি যদি একবার ভোটে জিতে পারি তাহলে শুধু ফার্স্ট সেকেণ্ড হওয়া ছাত্র নয়, ফেল করা ছাত্ররাও যাতে প্রাইজ পায় তার ব্যবস্থা করে ছাড়ব।” এক বছর ‘প্রধান অতিথি’ করে নিয়ে আসা হল ব্যায়ামবীর তপেশরঞ্জন মল্লিককে। তিনি ভাষণ দেওয়ার বদলে মঞ্চে উঠে বাইসেপ আর ট্রাইসেপের খেলা দেখালেন। পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জবি পরা, গলায় মালা ঝোলানো প্রধান অতিথি ব্যায়াম দেখাচ্ছেন-একটা দৃশ্য হয়েছিল বটে। গেলবারের আগেরবার কমিটির মিটিংয়ে জগদীশ নস্কর খুব কান্নাকাটি করে বললেন, “আমার মামাতো ভাই ভুটু মল্লিককে আপনারা এবার চান্স দিন। সে বেচারি কখনও ‘প্রধান অতিথি’ হয়নি।” জগদীশবাবু এ অঞ্চলে বিশেষ নামকরা মানুষ। তার দুটো পুকুর, তিনটে লরি আছে। সুতরাং তঁর কথা ফেলা যায় না। কমিটির অন্যরা বললেন, “আপনার মামাতো ভাইয়ের বায়োডাটা কী? আমন্ত্রণপত্রে কী লেখা হবে?” জগদীশবাবু চোখের জল মুছে একগাল হেসে বললেন, “ভুটু রেডিওতে হারমোনিয়াম বাজায়।”

তাই হল। আর আমরা সেবছর নিমকি, দানাদারের সঙ্গে ঠোঙায় একটা করে সন্দেশ পেলাম জগদীশবাবুর আয়োজনে। তবে ব্যায়ামবীরের মত ইনিও যদি ভাষণের বদলে হারমোনিয়াম বাজিয়ে শোনান এই ভয়ে স্টেজের ধারে কাছে সেবার কোনও হারমোনিয়াম রাখা হয়নি।

বিচ্ছিরি কাণ্ড হল গতবছর। ‘প্রধান অতিথি’ কমিটির সকলে একমত হলেন, এবার আনা হবে কবি নিমাইচাঁদ গুপ্তকে। দুজনে কলকাতায় ছুটে গিয়ে অনেক কষ্টে কবিকে রাজি করালেন। অনুষ্ঠানের দিন সকালে খুব বিরক্ত মুখে তিনি পবনপুরে এসে হাজির হলেন। অত বড় কবি বলে কথা! আমাদের সামান্য স্কুলের অনুষ্ঠানে তাঁকে ডেকে আনাটা যে খুব অন্যায় হয়েছে, সেকথা তিনি বারবার হাবেভাবে বোঝাতে লাগলেন। বিমান স্যারের বাড়িতে তাঁকে রাখা হল। সবাই তো খুব ভয়ে ভয়ে আছে। পাছে যত্নে কোনও ত্রুটি হয়। স্কুলের নাম ডুববে তাহলে। দুপুরে কবি মাছের মাথা দিয়ে ডাল, মাংস, চাটনি খেয়ে বললেন, “এবার আমি একটু চোখ বুজে কবিতা ভাবব। সেই ব্যবস্থাই হল।”

সন্ধেবেলা প্ৰধান অতিথিকে দেখবার জন্য আমাদের প্যান্ডেল একেবারে উপচে পড়ল। গিলে করা পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি পরে কবি বসে আছেন মঞ্চে। ভুরভুর করছে সেন্টের গন্ধ। এত নামকরা কাউকে পবনপুরের লোক আগে কখনও দেখেনি। সবাই কান পেতে আছে। উনি কী বলেন তা শোনার জন্য। ভাষণ দিতে উঠে কবি বললেন, “আমি আপনাদের সামনে কী বলব? আমার কথা আপনারা বুঝতে পারবেন না। তার থেকে আমার লেখা একটা কবিতা বলছি।

শুনুন। দেখুন যদি বুঝতে পারেন।”

চোখ বুজে তিনি আবৃত্তি শুরু করলেন, “আজি এ প্ৰভাতে রবির কর, কেমন পশিল প্ৰাণের পর—”

ক্লাস সিক্সের নন্টে বসেছিল স্টেজের সামনে মাটিতে। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে চেঁচাতে লাগল, “এ মা, স্যার, টুকলিফাই, টুকলিফাই। রবি ঠাকুরের কবিতা টুকলিফাই করেছে স্যার।” সেবছরই ছিল আমাদের শেষ “প্রধান অতিথি” আনা।

Leave a Reply