» » পানাপুকুরের রত্ন

ভূতোর লজ্জা করছে। খুবই লজ্জা করছে।

ফোঁস ফোঁস করে দম ফেলে বিশাল চেহারার ট্রেন ঢুকছে পানাপুকুর রেলস্টেশনে। ভূতো দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। দুটো হাত দিয়ে শক্ত করে হাতল ধরা। মুখে লাজুক হাসি।

পানাপুকুরের মতো অজ পাড়াগাঁয়ের রেলস্টেশনে এত বড় গাড়ি আগে কখনও দাঁড়ায়নি। সারাদিনে দুটো মাত্র লোকাল ট্রেন আসে-যায়। একটা সকালে, একটা সন্ধের পর। কর্ড লাইনে গোলমাল থাকলে সন্ধেরটা কোনও কোনওদিন বাতিল হয়ে যায়। পানাপুকুরের মানুষ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বড় বড় মেল, এক্সপ্রেস, সুপারফাস্ট পানাপুকুরকে হরদম তাচ্ছিল্য করে চলে যায়। যাওয়ার সময় বিদ্রূপ করে হুইশলও দেয়। সেই হুইশলের আওয়াজ শোনা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। ঠিকই করে। তাচ্ছিল্য করার জিনিসকে তাচ্ছিল্য করবে না তো কী করবে?

কিন্তু, আজ এই ট্রেন এসেছে। এর কারণ, আজ একটা বিশেষ দিন। এই ট্রেনও একটা বিশেষ ট্রেন। রেল কর্তৃপক্ষ নিজে এই ট্রেনের ব্যবস্থা করেছেন। প্ৰথমে ঠিক হয়েছিল গাড়ির কনভয় হবে। সাতাশটা গাড়ির কনভয় ছাড়বে কলকাতা থেকে। দু-একটা বাড়তেও পারে। পরে সেই সিদ্ধান্ত বদল হল। রাস্তা মোটে ভাল নয়। দুদিনের মধ্যে অতটা রাস্তা সারানো অসম্ভব। তার ওপর পানাপুকুর পর্যন্ত যেতে সময় নেবে অনেকটা। তাই, ট্রেনের ব্যবস্থা। শুধু ব্যবস্থা হয়নি, গোটা ট্রেনটাই সাজানো হয়েছে। গাঁদা ফুলের মালা দুলছে। বড় বড় রঙিন রাংতার বল উড়ছে।

শুধু ট্রেন নয়, পানাপুকুর স্টেশনও সাজানো হয়েছে। সরস্বতীর পুজোর মতো রঙিন কাগজের চেন, কাগজের পতাকা পতপত করে উড়ছে। আলোর স্টাণ্ডগুলোতে ফুলের রিং। জীৰ্ণ টিকিট কাউন্টারের গায়ে লাল, নীল, হলুদ কাপড়। বড় বড় কাপড়ের ব্যানার স্টেশন ভর্তি। কোনওটায় লেখা— “শ্ৰীমান ভূতোকে স্বাগতম।” কোনওটায় লেখা— “পানাপুকুরে প্রাণের ছেলে ভুতো। জিন্দাবাদ।” কোনওটায় লেখা— “ভূতোকে গ্রামের বড়দের আশীর্বাদ, ছোটদের ভালবাসা।” কোনটায় লেখা— ‘‘ভূতো তোমারে সেলাম।”

প্ল্যাটফর্মের এক পাশে ব্যাণ্ডপার্টির দল। ঝলমলে পোশাকে বুড়ো লোকগুলো গায়ের সব জোর দিয়ে স্যাক্সোফোন, ক্ল্যারিওনেট আর ড্রাম বাজাচ্ছে।

ভূতো অবাক হল। ব্যাণ্ডপার্টি এল কোথা থেকে! কলকাতা থেকে নাকি? পানাপুকুরে মাঠ আছে, খেত আছে, পুকুর আছে। ব্যাণ্ডপার্টি নেই!

ট্রেন পুরোপুরি থামার আগেই স্টেশনে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ভূতোকে দেখতে পেয়ে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ পড়িমড়ি করে গাড়ির পাশে পাশে ছুটছে। বেশ কয়েকজন আছাড় খেয়ে পড়ল। ওই তো মনাদা, সেনকাকু, বলাই… ওই তো বিশ্বম্ভর, হানিফ, কল্যাণ-মাস্টার। আরে জগাই, পটল, পল্টুও ছুটছে যে। ছুটছে আর তার দিকে হাত নাড়ছে। গাড়ি থামার তর সইছে না যেন।

ভূতো শুনতে পেল স্টেশন জুড়ে গর্জন উঠেছে—

“ওই তো ভূতো, আমাদের ভূতো।” লজ্জায় আরও খানিকটা লাল হয়ে উঠল। ভূতো। ছিছি। কী কাণ্ড! কোন মানে হয়? তাকে নিতে গোটা গ্রাম যে স্টেশনে ভেঙে পড়েছে!

মনে পড়ল, যাওয়ার দিনটা ছিল অন্যরকম। সন্ধেবেলার গাড়ি ছিল। সারাদিন ধরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। ঠিক সন্ধেতেই ঝেঁপে নামল। কাঁধে ঝুলিয়ে একাই এসেছিল ভূতো। ফুটোফাটা ছাতা খুলে কোনও লাভ না। ভিজে একসা হতে হল। নির্জন, প্ৰায় অন্ধকার স্টেশনে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছিল ভূতো।

মনাদা ক’দিন আগেও তাকে কত ধমক-ধামক দিল।

“কাজকর্ম কিছু নেই? দিনরাত শুধু মাঠেঘাটে ছোটাছুটি করলেই হবে?” রেগে গেলে মনাদার ‘ঠ”গুলো সব ‘ট’ হয়ে যায়। বকুনি খেয়ে ভূতো গলা নামিয়ে বলল, “একটু প্র্যাকটিস করছিলাম মনাদা।”

“প্র্যাকটিস! কীসের প্র্যাকটিস?”

“দৌড়ের প্র্যাকটিস। কদিন পরে…।” মনাদা হুঙ্কার দিলেন। চোখ পাকিয়ে বললেন, “চোপ। দৌড়ের আবার প্র্যাকটিস কীসের? অ্যা! কী হবে প্র্যাকটিস করে? তুমি কি ঘোড়া রেসের মাঠে কাজ পাবে?”

ভূতো আমতা আমতা করে বলে, “সে-দৌড় নয় মনাদা, এ দৌড় হল….।”

“বাজে বোকো না ছোকরা। দৌড়ের আবার এ-দৌড়, সে-দৌড় কী হে? অ্যা! যাও যাও কথা না-বাড়িয়ে বাড়ি গিয়ে চাকরির পরীক্ষার জন্য প্র্যাকটিস কর। আজকাল কত সব পরীক্ষা হয়েছে। রেল, পোস্টাপিস। বয়স বাড়ছে। এরপর পা ধরে সাধাসাধি করলেও আর কেউ সরকারি চাকরি দেবে?”

সেই মনাদাও ট্রেনের পাশে আজ দৌড়োচ্ছে!

সেনকাকু হোঁচটও খেলেন। ভূতো হাত বাড়িয়ে কিছু একটা বলতে গেল, স্টেশন ভরা মানুষের উচ্ছাস আর গর্জনে কিছুই শোনা গেল না। সেনকাকু পায়ের চটি ফেলেই ছুটছেন। খুবই লজ্জার বিষয় এটা। গুরুজন মানুষ, তিনি কেন খালি পায়ে ছুটবেন? এটা ঠিক নয়। মানুষটা আবার বেদম রাগীও। তবে, মনাদার মতো ভূতোকে অমন ধমক-ধামক দেননি কখনও। যেটুকু রাগারাগি করার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ঢঙেই করেছেন।

মাস তিনেক আগে সেনকাকার সঙ্গে ভূতোর দেখা হল বাজারে। ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, “এই যে ছেলে, শুনছি তুমি নাকি ছোটাছুটি নিয়ে অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছ? তোমার কাকা সেদিন বলছিল।”

“খেলাধুলো! ছোটাছুটির আবার খেলাধুলো আছে নাকি! সে তো শুনেছি ক্যাঙারুরা করে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারু। তুমি তো বাছা ক্যাঙারু নয়, পানাপুকুরও অষ্ট্রেলিয়া বলে মনে হচ্ছে না।”

বাজার ভর্তি লোকের সামনে এই অপমান গায়ে লাগার মতো। ভূতো অবশ্য গায়ে নিল না। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ।

সেনকাকা হেসে বললেন, “না না চিন্তা নেই। ছোটাছুটির খেলা চালিয়ে যাও ভূতো। জোরকদমে চালিয়ে যাও। তবে, কাঁধে একটা ভারী ব্যাগ আর হাতে একটা লাঠি নিও।”

“লাঠি?”

“অবশ্যই লাঠি। শুনেছি আমাদের দেশে এখনও কোথাও কোথাও ডাকহরকরা সিস্টেম চালু আছে। মনে হচ্ছে সেই কাজ তোমার কপালে ঝুলছে বাছা। রানার চলেছে তাই ঝুম ঝুম, ঘণ্টা বাজছে রাতে…হা হা। নিজের জীবনে তো ইতিমধ্যেই ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছ দেখছি।”

বেচারি মানুষটার এখন কী বিচ্ছিরি অবস্থা! খালি পায়ে ছুটছেন। কল্যাণমাস্টারই বা কম কীসের? তবে, অল্পবয়সীদের সঙ্গে তিনি ছোটাছুটিতে পাল্লা দিতে পারছেন না। সম্ভবত সেই কারণে ব্যাণ্ডপার্টি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। দু’হাত মাথার ওপর তুলে, নামিয়ে বাজনদারদের হুকুম দিচ্ছেন। সেই মতো গলার শিরা ফুলিয়ে, হাতের পেশি নাড়িয়ে তারা কেলেঙ্কারি কাণ্ড করছে। ভুতো একটু মজাই পেল। কল্যাণ-মাস্টারের সঙ্গে গান-বাজনার কোনও সম্পর্ক নেই। পানাপুকুরের বয়েজ স্কুলের তিনি অঙ্কের শিক্ষক। যেমন-তেমন শিক্ষক নয়। কড়া ধরনের শিক্ষক। ওঠবোস আর নীলডাউনে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পাটীগণিতে গোলমাল করার জন্য ছেলেবেলায় ভুতো এই মাস্টারের কাছে কতবার যে কানমলা খেয়েছে তার ঠিক নেই।

অঙ্ক ভুল হলে কল্যাণ-মাস্টার সাধু-চলিত গুলিয়ে ফেলতেন।

“গর্দভ ভুতো তোমার জীবনে কিছুই হইবে না। পানাপুকুরের ঘাটে তুমি কচুরি পানার ন্যায় পড়িয়া থাকিবে।”

আজ যে-মানুষটা ভূতোর কারণে ব্যাণ্ডপার্টির বাজনা নিয়ে চরম মাতামাতি করছেন, সেই মানুষটাই এক বার ক্লাস নাইনে ‘ব্যাঙ কটকটি’ বাজানোর অপরাধে ভূতোকে রোদে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন পাক্কা কুড়ি মিনিট। ভূতো মুখ লুকিয়ে হাসল।

কিছু বোঝার আগেই চলন্ত ট্রেনে গাদাখানেক লোক লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠে পড়ল। গলায় মণখানেক ওজনের গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে দিল চটপট। ভূতোর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ভিড়ের মধ্যে সবাইকে চিনতেও পারছে না। তবে, বলাইকে দেখতে পেল। ঘোষ পাড়ার গুণ্ডা বলাই। গুণ্ডা বলাই তার মুখে খানিকটা সন্দেশ গুঁজে দিতে দিতে বলল, “ভাই ভুতো আমার হাতেই আজ তোর প্রথম মিষ্টিমুখ হোক। কিছুতেই না শুনব না, মুখ খোল, মুখ খোল ভাই আমার।”

নিমেষে পুরনো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল ভূতোর।

তখন প্রতি বছর শীতের সময় গাঁয়ে মেলা বসত। মেলার মাঠেই খেলাধুলোর আসর। বস্তারেস, দড়িটানাটানি, যেমন-খুশি-সাজো। সেবছর ছিল ম্যারাথন দৌড়ের কম্পিটিশন। গোটা মাঠ ঘিরে দশ পাক দৌড়। দৌড় শেষ করলে একশো এক টাকা প্ৰাইজ। দশ পাক দৌড় ভূতোর কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। দশ কেন, ইচ্ছে করলে পঁচিশ পাকও মেরে দিতে পারে সে। নিশ্চিন্ত মনে দৌড় শুরু করল। কিন্তু, তিন পাকের মাথায় বিশাল চেহারার বলাই তাকে ল্যাং মেরে ছিটকে ফেলল বিচ্ছিরিভাবে। মুখ থুবড়ে পড়ল ভূতো। থুতনি ফেটে রক্তারক্তি। দৌড় শেষে ভুতো বলল, “এটা কী হল বলাই?”

গুণ্ডা বলাই চোখ পাকিয়ে বলল, “যা হল ঠিক হল। এর পর কোনওদিন যদি আমার সঙ্গে কম্পিটিশনে নেমেছিস তা হলে দাঁতগুলোও ভেঙে দেব। তার পর জুতোর মালা পরিয়ে গাঁয়ে ঘোরাবা।”

সেই বলাই তাকে আজ ফুলের মালা পরাচ্ছে!

উঁচু গাড়ি বলে প্ল্যাটফর্ম অনেকটা নিচু। সাবধানে নামতে হয়। তবে, ভূতোকে সাবধানে নামতে হল না। অনেকে মিলে তাকে কোলে লুফে নিল। তারপর মাথার ওপর তুলে শুরু হল লাফালাফি।

ভূতো তো ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। কী বিপদ রে বাবা! পড়ে যাবে যে। বাড়ির কেউ আসেনি? এলেও এই ভিড়ে খুঁজে বের করা অসম্ভব। শুধু মানুষের মাথা আর মাথা।

ওই তো ছোটকা? ওই তো গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। ভূতো গলা তুলে ডাকল। হইচইতে সেই ডাক মিলিয়ে গেল। ছোটকার টাকাটা আজই শোধ করে দিতে হবে। নিজে করার দরকার নেই। ককিমাকে দিয়ে করাতে হবে। “এই নাও কাকিমা ছোটকার টাকাটা রাখ।”

“কোন টাকা?”

“বাঃ, সেবার একটা স্টপ ওয়াচ কেনার জন্য নিয়েছিলাম, মনে নেই?”

কাকিমা বলবে, “থাক না, এত তাড়া কীসের।”

“না কাকিমা তুমি আজই দিয়ে দেবে। অনেক কষ্ট করে ছোটকা জোগাড় করেছিল।”

ওই সামান্য ক’টা টাকা জোগাড় করতে মোটেও কষ্ট করতে হয়নি ছোটকাকে। কিন্তু, ভাইপোকে দেওয়ার সময় অনেক কষ্ট হয়েছিল। কাকিমাকে কথাও শুনিয়েছিল এক গাদা।

“অনেক হয়েছে ওই ছেলেকে এবার থামাও। এইভাবে টাকা খরচ করার মতো অবস্থা তার নয়। মা-বাবা মরা ছেলে। কাকা-কাকিমার ঘাড়ে বসে খাচ্ছে। এবার নিজের হাল নিজেকে ধরতে বল।” কাকিমা মুখ নামিয়ে বলেছিল, “বলি তো, শোনে না। ছোট থেকেই ছেলেটার খেলাধুলোর শখ।”

ছোটকা গলা তুলে বলেছিল, “শখ! এটা কোনও শখ হল? তাও ক্রিকেট, ফুটবল হলে বুঝতাম। ও-সবে চাকরি-বাকরির সুযোগও থাকে। দৌড় একটা খেলাধুলো হল! ব্যাঙের মাথা হল। ফ্রগস হেড। কী হবে দৌড়ে? দৌড়তে যদি হয় কেরিয়ারের পেছনে দৌড়তে বল।” কাকিমা বলল, “এতবড় ছেলে যদি নিজের ভালমন্দ না বোঝে…..।”

“না-বুঝলে বকে বোঝাতে হবে। দেখ, কথাটা কঠিন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ভূতো যা শুরু করেছে তাতে কঠিন কথা শোনানোর সময় এসেছে। অনেকদিন হল আমি ওকে টানছি সেই দাদা মারা যাওয়ার পর থেকেই। তার পর বউদিও চলে গেল। খাওয়া, পরা, লেখাপড়া সবই তো করালাম। কিন্তু, আর কতদিন? আর যখন-তখন টাকা-পয়সা চাইতে বারণ কর।”

মাথা থেকে নামানো হয়েছে ভূতোকে। হাতে পেন, নোটবই, ক্যামেরা বাগিয়ে চারদিক থেকে ছুটে এল সাংবাদিক আর ফোটোগ্রাফাররা। এরা সব কোথা থেকে এল! নিশ্চয় কলকাতা থেকে এই ট্রেনেই এসেছে। পানাপুকুরের মানুষ অনেক কিছু দেখেনি। অভাব, অনটন, গা-ছিমছমে অন্ধকার রাত। কিন্তু, সাংবাদিক বিশেষ দেখেনি। শুধু ভোটের সময় কালেভদ্রে এক-আধজন আসে। বাজারের কাছে চায়ের দোকানে বসে চা খায়, সিগারেট ফোঁকে। ফের গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায়। তা-ও প্রতি ভোটে আসে না। আজ একেবারে প্ল্যাটফর্ম ছেয়ে গেছে। হাতে টেপ রেকর্ডার, টিভির বুম। সবাইকে ঠেলে, কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে তারা ভূতোর জামা-প্যান্ট ধরে ঝুলোঝুলি শুরু করল।

“স্যার নিজের গ্রামে এসে আপনার কেমন লাগছে?”

“আপনার এই সাফল্যের পেছন পানাপুকুরের অবদান কতখানি?”

“ভূতোবাবু, গ্রামের কোন জায়গা আপনার সব থেকে প্রিয়?”

“ভূতো, তুমি নিজের গ্রামের জন্য কি কিছু করার কথা ভাবছ?”

“তুমি গায়ের কোন মানুষটাকে সব থেকে বেশি ভালবাস?”

“পানাপুকুরের জন্য তুমি কি গর্বিত?” “গ্রামের কোন খাবার তোমার প্রিয়?” ভুতো কোনও কথারই উত্তর দিতে পারল না। হানিফ, পল্টু, বিমলরা তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল। স্টেশনের বাইরে ছোট একফালি মঞ্চ। মঞ্চের পেছনে কাপড়ে বড় বড় করে লেখা—

“পানাপুকুরের রত্ন শ্ৰীমান ভূতোর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।”

সবাই মিলে ঠেলে ভূতোকে মঞ্চে তুলল। মঞ্চে ওঠবার সময় ভূতো একঝলক দেখতে পেল মেয়েরা লাল পাড় শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে সারি দিয়ে। তারা শাঁখ বাজাচ্ছে। ভূতোর গায়ে ছুড়ছে ফুলের পাপড়ি। গাল দুটো নিজের অজান্তেই লাল হয়ে গেল ভূতোর। লাল হয়ে যাওয়ারই কথা। এই ফুটফুটে মেয়েরা সব পানাপুকুর গার্লস হাইস্কুলের মেয়ে।

মঞ্চে ভূতোর চেয়ারটা যেন বিয়েবাড়ির বরের চেয়ার। সিংহাসনের মতো। সেখানে বসতে ভূতোর যে কী অস্বস্তি হল তা বলার নয়। বাপ রে, সামনে কত মানুষ! গোটা পানাপুকুরের সব মানুষ কি আজ এখানে? তারা লাফাচ্ছে, হাসছে। হাত তুলে নাড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে—”ভূতো, ভূতো, ভূতো।”

মাইকে গান হচ্ছে। আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন, ওগো কৰ্ণধার তোমারে করি নমস্কার…..।

মাঝপথে গান থামিয়ে রেখে কে যেন জলদগম্ভীর গলায় ঘোষণা করে উঠল,“এবারে আমাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন পানাপুকুরের সবার প্রিয়, সবার আপন, আমাদের নেতা শ্ৰীশ্ৰী কালীপদ সামন্ত।”

ভূতো সামান্য চমকে উঠল। সেই কালীপদ! সবাই বলেছিল, “একবার কালীপদ সামন্তর কাছে যা না। খেলাধুলো করলে তো কতরকম চাকরি-বাকরি পাওয়া যায়। যা না একবার চেষ্টা করে দেখ।”

ভূতো আড়চোখ তাকাল। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পানাপুকুরের নেতা। পাটভঙা ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে সৌম্যদর্শন মানুষটাকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। সুন্দর মানুষকে সুন্দরই তো দেখাবে।

“আজ আমাদের আনন্দের দিন। আজ আমাদের গর্বের দিন। শ্ৰীমান ভুতো আজ আমাদের পানাপুকুরের নাম গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছে। তাকে আমার স্নেহ, ভালোবাসা, আশীর্বাদ।”

এক রবিবারের সকালে কালীপদ সামন্তর কাছে ভূতো গিয়েছিল। না গিয়ে উপায় ছিল না। সংসারের অভাব তখন ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে ছোটকা হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। ঘরে দশটা টাকাও থাকে কি না সন্দেহ। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা। এক সকালে ভয়ে ভয়ে গিয়ে হাজির হল সে।

“কী খেলাধুলো করা হয় বাছার?”

“দৌড়।’ ঢোঁক গিলে বলল ভূতো।

নাক-মুখ কুঁচকে কালীপদ সামন্ত বললেন, “কী? কী বললে?”

দৌড়ই স্যার। রেস।

কালীপদ সামন্তর তখন সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে শম্ভু মদন, বেচা, বিমলবাবু, সুধীর পালিত। তাদের দিকে তাকিয়ে কালীপদ ভুরু তুলে বললেন, “ছোকরা কী বলে শুনলি? শুনলি তোরা? কানে গেছে? বলে কিনা দৌড় দৌড় খেলি! হা হা।”

সবাই ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠল। লজ্জায়, দুঃখে মাথা নামাল ভূতো।

“বাছা, শুধু দৌড় দেখিয়ে চাকরি চাইতে এসেছ! তোমার জন্য রেকমেণ্ডশনের চিঠিতে কী লিখব বাপু? এই ছেলেটি খুব জোর দৌড়তে পারে, দয়া করে একে একটি কাজকর্মের ব্যবস্থা করে দিন। তবে, এর জন্য অফিসে কোনও চেয়ার-টেবিলের প্রয়োজন নেই পানাপুকুরের ভূতোবাবু ছুটে ছুটে ফাইল দেখবেন, ছুটে ছুটে চিঠি লিখবেন, ছুটে ছুটে হিসেব কষবেন। ইনি হবেন আপনার অফিসে একজন ছুটন্ত কর্মী। হা হা।”

দম বন্ধ করে হাসতে লাগলেন নেতা। বাকিরা গড়িয়ে পড়ল। শম্ভু আর বেচা তো চিত হয়ে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ে হাসতে লাগল।

সেদিন মুখ কালো করে কোনওরকমে পালিয়ে বেঁচেছিল ভূতো।

মাইকে গদগদ গলায় কালীপদ সামন্ত বলে চলেছেন, “এই ছেলেকে আমি অনেকদিন আগেই চিনেছিলাম। অনেক আগেই বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম ভূতোর মধ্যে ক্ষমতা আছে। দৌড়তে দৌড়তে সে একদিন পৌঁছে যাবে অনেকদূর। সবাইকে ছাড়িয়ে, সবাইকে হারিয়ে লক্ষ্য ছোঁবে। আজ তাই আমি পঁচিশ হাজার টাকার একটা চেক প্রদান করব। অ্যাই ভুতো মুখ নামিয়ে বসে আছিস কেন? মুখ তোল, তোল মুখ। সবাই তোর উজ্জ্বল খুশি মুখ দেখতে চায় রে বেটা।”

ভুতো মুখ তুলল। জনসমুদ্র থেকে আওয়াজ উঠল আবার।

“ভূতো, ভূতো, ভূতো…”

সবাই ভাবছে ভূতো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তা কিন্তু মোটেও না, ভিড়ের মাঝে ভূতো অন্য একটা মানুষকে খুঁজছে। মৃত মানুষ। এই মানুষটি বছরের পর বছর তাকে কাকভোরে ঘুম থেকে তুলছে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ভূতোর গলায় বলছে, “নে এবার ওঠ, ওঠ ভূতো।” ভূতো পাশ ফিরে বলত, আঃ, আর একটু ঘুমোই, আর একটু পরে উঠব।”

“না, আর একটু পরে না। এখনই উঠে পড় রোদ উঠে গেলে আর দৌড় পারবি না সোনা।”

“প্লিজ, আর দশ মিনিট ঘুমোই।”

“না, এক মিনিটও নয়। তোকে কত প্র্যাকটিস করতে হবে না? তুই নিজে তো বলেছিলি। বলিসনি? লক্ষ্মী বাছা আমার। গরিবের ঘরে দৌড় চাট্টিখানি জিনিস?”

আজ ভুতো তার সেই মৃত মাকে খুঁজছে।

Leave a Reply