» » রিহার্সাল ছাড়া

বর্ণাকার

সে বছর আমাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানে এক বিপত্তি ঘটেছিল। ঘটনাটা বলি–

অন্য বছরের মত সেবারও ঠিক হল যে, বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সঙ্গে আবৃত্তি, গান, হাস্যকৌতুক আর নাটক হবে। একমাস আগে নোটিস বোর্ডে ভুগোলের স্যার বিকাশবাবু আর ইংরেজির স্যার শম্ভুবাবুর সই করা নোটিস লাগিয়ে দেওয়া হল–’যারা যারা বার্ষিক অনুষ্ঠানে নাটক, গান, আবৃত্তি ইত্যাদি করতে চাও তারা আমাদের কাছে নাম জমা দাও।”

প্রতি বছরের মত এবারও নাম জমা দেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এক একটা ক্লাস থেকে যে কত নাম জমা পড়ল তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই।

বিকাশবাবু আর শম্ভুবাবু বললেন, যত নাম জমা পড়েছে সবাইকে যদি অনুষ্ঠানে নিতে হয়, তাহলে সেদিন আমাদের নাকি পাঁচশো সাতান্নটা গান, সাতশো দশটা আবৃত্তি, বিয়াল্লিশটা নাটকের ব্যবস্থা করতে হবে। আর সে তো একদিন হবে না, টানা পনেরো দিন ধরে করতে হবে। কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়। তাই ঠিক হল পরীক্ষা হবে। সেখানে গোনাগুনতি যে ক’জন পাস করবে তারাই অনুষ্ঠানে অংশ নেবে।

সেই পরীক্ষার দিনও এক এলাহি কাণ্ড হল। টিফিনের পর স্কুল ছুটি হয়ে গেল। অনেকের বাবা-মা পর্যন্ত চলে এলেন। স্কুলের সামনে ডাব বিক্রি হতে লাগল। স্কুলের বাইরে গাছের ছায়ায় মাঠের এক কোণে দেখা গেল কেউ হাত-পা নেড়ে ‘সোনার তরী” আওড়াচ্ছে, কেউ বা ‘অবাক জলপান’-এর পার্ট মুখস্থ করছে। ক্লাস সিক্সের প্রতুল তো। কপালে দইয়ের ফোঁটা লাগিয়ে চলে এসেছে!

যাই হোক, উৎকণ্ঠা একসময় শেষ হল। পরীক্ষা হয়ে গেল। অত আবৃত্তি, গান আর নাটকের পার্ট শুনে বিকাশবাবু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে দুদিন ছুটি পর্যন্ত নিতে হল। তবে দুদিন পরেই নোটিস বোর্ডে ফাইনাল তালিকা ঝুলিয়ে দেওয়া হল। সেই ভাগ্যবানদের নিয়ে বিকাশবাবু আর শম্ভুবাবু জোরকদমে রিহার্সাল শুরু করে দিলেন। আর যারা চান্স পেল না তাদের সব ভলেন্টিয়ার করে দেওয়া হল। বলা হল, অনুষ্ঠানের দিন তোমরা তাড়াতাড়ি এসে বুকে ব্যাজ আটকে তৈরি থাকবে।

দেখতে দেখতে দিন চলে এল। আগের দিন, সব কিছু রেডি। সন্ধেবেলা স্টেজ রিহার্সাল হল। সেই সঙ্গে সঙ্গে হল প্রচুর খাওয়া-দাওয়া।

এই খাওয়াই যে ভয়ানক বিপদ ডেকে আনবে কে বুঝেছিল?

অনুষ্ঠান শুরুর দশ মিনিট বাকি। বিকাশবাবু আর শম্ভুবাবু ছুটোছুটি করছেন। কী ব্যাপার? কেউ আসেনি। উদ্বোধনী সঙ্গীতের বিকাশ, বাবলু, অজয় আসেনি। আসেনি আবৃত্তির মলয় হলধর, সুব্রত। গানের দ্বিজু, ব্ৰতীশ, অমিয় নেই। নেই নাটকের তাপস, বিনয়, দেবু, সুপ্রিয়রা। কী হল! কারোর পেট ব্যথা, কারোর হজমের গণ্ডগোল, কারোর বমি, কারোর চোঁয়া ঢেকুর, কারোর মাথা ঝিমঝিম।

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন বিকাশবাবু। শম্ভুবাবু কিন্তু ঘুরে ঘুরে ছাত্রদের ডেকেডেকে সব কী জানি বলতে লাগলেন। ছাত্ররা জটলা করে তাঁর কথা শুনতে লাগল আর খুব মাথা নাড়তে লাগল।

আশ্চর্য ঘটনা হল ঠিক সময়তে স্টেজের পর্দা সরে গোল শম্ভুবাবুর নির্দেশে!

শুধু হল অনুষ্ঠান! কথা ছিল উদ্বোধনী সঙ্গীত হবে কোরাসে। গাইবে ক্লাস এইটের ছেলেরা। বদলে ক্লাস সিক্সের তপন একাই গাইল, “এই লভিনু সঙ্গ তব।’ তালে একটু গণ্ডগোল হল বটে। কিন্তু সে কিছু নয়। এরপর আবৃত্তি। ক্লাস সেভেনের হলধর গলা কাঁপিয়ে ‘আফ্রিকা’ করবে বলে ঠিক ছিল। বদলে ক্লাস সেভেনেরই তমাল বলল, “শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে।” একটু ভুলে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু শেষে হাততালি পেল অনেক। ঠিক এরকমভাবেই আরও বেশ কয়েকটা আবৃত্তি, গান হল। দুজন তো দু লাইন করে গান গেয়ে বাকিটা ভুলেই গেল। তাতে অনুষ্ঠান আরও জমে উঠল। সবথেকে বড় আশ্চর্যের ঘটনা ঘটাল ক্লাস এইটের ছেলেরা। তারা ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল” নাটকটাও করে ফেলল। মেকআপ ছাড়াই। বিকাশবাবু আর শম্ভুবাবু আড়াল থেকে প্রম্পট করলেন আর ওরা তা শুনে শুনে দুর্দান্ত অভিনয় করল। কখনও হয়ত জাম্বুবানের পার্ট হনুমান বলে ফেলল, কখনও হয়ত রাম পার্ট ভুলে জিভ কাটল। কিন্তু এতে মজা একটুও কমল না, উল্টে বাড়ল।

সেদিন রিহার্সাল ছাড়া অনুষ্ঠান এত হাততালি পেয়েছিল যে সেই আওয়াজ অনেক দূর পর্যন্ত শোনা গিয়েছিল।

Leave a Reply