ক্লাস এইটের পটল প্রামাণিক এবার পুজোর ছুটিতে দিল্লি বেড়াতে গিয়েছিল।

সেটা আসল কথা নয়, আসল কথা হল, সে গিয়েছিল এরোপ্লেনে চেপে। বেড়াতে যাওয়ার থেকে এরোপ্লেনে চাপাই পটলের কাছে অনেক বড় ব্যাপার। আর সত্যি কথা বলতে কি আমাদের এই পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ে কেউ কখনও এরোপ্লেনে চেপেছে এমনটা শোনা যায়নি। পটল সেই সুযোগ ছাড়ে?

কিন্তু ব্যাপারটা একটু অন্য দিকে মোড় নিল। এরোপ্লেনে একবার চেপেই পটলের যেন সত্যি সত্যি পা মাটিতে পড়ছে না। সে বাড়াবাড়ি শুরু করল। পুজোর ছুটি একমাস বাদে ফুরলো। আমরা সবাই হইহই করে স্কুলে এলাম। পটলও এল। স্কুলে ঢোকার পর থেকে সে এমন একটা ভান করতে লাগল যেন এইমাত্র এরোপ্লেন থেকে নেমেছে। বাচ্চু গিয়ে জিগ্যেস করল, “কী রে পটল কেমন বেড়ালি?” পটল আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল, ‘দাঁড়া, দাঁড়া হাত-পাগুলো একটু ছাড়িয়ে নেই। অতক্ষণ এরোপ্লেনে থাকলে হাতে পায়ে সব খিল ধরে যায়।” বাচ্চু তো অবাক। সে বলল, “সে কি রে! তুই তো পনেরো দিন হল ফিরেছিস। এখনও হাত পা ছাড়েনি?” পটল খেঁকিয়ে উঠল, “মেলা বকিস না তো। এরোপ্লেনে চড়িসনি তো কখনও। তুই পা খিল ধরার কী বুঝবি?”

বাচ্চু এতে যথেষ্ট অপমানিত হয় এবং চলে আসে। অপমানিত হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। অনেকক্ষণ একটানা বসে থাকবার পর বাচ্চুরও অনেকবার হাত পায়ে খিল ধরেছে। হতে পারে সে খিল হয় এরোপ্লেনের নয়, তবু খিল তো।

বাচ্চু গজ গজ করতে করতে এসে পিন্টুকে বলল, পটলার বড্ড বাড় বেড়েছে।”

এর কয়েকদিন বাদেই পটলদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় সুশান্তর জন্মদিন ছিল। সে একবাক্স টফি নিয়ে এসে সবাইকে দিচ্ছিল। প্রত্যেকেই হাসিমুখে সেই টফি খেয়ে টফি এবং সুশান্তর ভূয়সী প্রশংসা করছিল। শুধু পটল টফিটা মুখে দিয়ে এমন একটা মুখ করল যেন সে উচ্ছে সেদ্ধ খাচ্ছে। সুশাস্ত ব্যতিব্যস্ত হল, “কী হল পটল?” পটল মুখটা আরও বিকৃত করল, “না হয়নি কিছু। আসলে এরোপ্লেনের চমৎকার টফি খাওয়ার পর, এসব আর মুখে রোচে না।”

সুশান্তর কান লাল হয়ে গেল। একদিন টিফিনের সময় হঠাৎ দেখা গেল পটল দুকানে তুলো গুঁজে বসে আছে। অনুপম সরল মনে গিয়ে বলল, “কী ব্যাপার, কানে ব্যথা হয়েছে নাকি? তুলো গুঁজেছিস কেন?” গম্ভীর মুখে পটল বলল, “বোকার মত কথা বলিস না তো। এরোপ্লেনে চড়বার অভিজ্ঞতা থাকলে এমন কথা বলতিস না। শব্দ আটকাতে এরোপ্লেনের ভেতর আমরা কানে তুলো দিয়ে বসে থাকতাম। টিফিনের সময় এখানে এত হট্টগোল হয় যে ঠিক করেছি এখন থেকে এখানেও কানে তুলো দেব। এরোপ্লেনের শব্দ তাও সহ্য হয়। তোদের চিৎকার চেঁচামেচি তো একেবারে জংলির মত।”

অনুপমের মাথাটা রাগে গরম হয়ে যায়। এইসব পর্যন্ত তাও চলছিল। বন্ধুদের সঙ্গে এসব কথাবার্তায় পটলের কোন বিপদ ছিল না। কিন্তু হায়রে! পটল যে আরও বাড়ল!

ইংরেজিতে পটল বরাবরই দুর্বল। কিন্তু সম্প্রতি এরোপ্লেনে ভ্রমণের পর সম্ভবত সে সেকথা ভুলতে বসেছে। নিজের মধ্যে সে একটা ‘ইংরিজি ইংরিজি’ ভাব আনতে চেষ্টা করছে। যেমন মাঝে মধ্যেই সে কারণে অকারণে ‘নো থ্যাঙ্কস’ বা ‘ওকে ফাইন’ এর মত দুএকটা কথা বলছে। কেলেঙ্কারিটা হল সেদিন ফোর্থ পিরিয়ডে। মানে ইংরিজি ক্লাসে।

নিকুঞ্জবাবু এসে বললেন, ‘সবাই দশ লাইনে পুজোর অভিজ্ঞতা লিখে দেখা দিখিনি।’

আশ্চৰ্য; সবার আগে খাতা জমা পড়ল পটল প্রামাণিকের! এই প্রথম। শুধু তাই নয়, সেই খাতার ওপর চোখ বুলিয়ে নিকুঞ্জবাবু চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘সবাই শোন, পটল লিখেছে, চেক ইন। টেক অফ। ককপিট। এয়ার হস্টেস। রান ওয়ে। ল্যান্ডিং। লাগেজ। ব্যস। রচনার নাম দিয়েছে এরোপ্লেন। আর ‘চেক ইন’-এর ইন’ ছাড়া সব বানান ভুল। ‘হুম’, বলে বসে পড়লেন নিকুঞ্জবাবু। রাগ তার চোখে নাকে। ‘এদিকে আয় পটল।’ পটল হাসি হাসি মুখে উঠে গেল।

এরপর পটলের খাতায় নিকুঞ্জবাবু বড় বড় করে লিখে দিলেন, ‘এ ই আর ও পি এল এ এন ই’। বললেন, ‘যা এক হাজার বার লিখে নিয়ে আয়।’

এই ঘটনার পর পটল আমাদের কুতুবমিনার, লালকেল্লা নিয়ে অনেক গল্প বলেছে, কিন্তু এরোপ্লেন নিয়ে কখনও একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।

Leave a Reply