সাতদিনে পাঁচটা ঘটনা। তিনটে মারাত্মক, দুটো ভয়াবহ। এরপরই হেডস্যার নোটিশ দিলেন। নতুন নিয়মের নোটিশ। আমাদের স্কুলের নোটিশ বোর্ডে একটা মুশকিল আছে। বোর্ডটা একটা বাক্সের মতো। সামনে কাঁচের ঢাকনা। বোর্ডে নোটিশ লাগিয়ে সেই ঢাকনা আটকে দিতে হয়। তারপর টিপ তালা সিস্টেম। মাস তিনেক হল ঢাকনার কাঁচের নিচে লম্বা একটা দাগ পড়েছে। আঁচড়ের মতো দাগ। পিওন দিবাকরদা অনেক ঘষেও সেই দাগ তুলতে পারেনি। ফলে নোটিশের কোনও কোনও লেখা অনেক সময় সেই দাগের আড়ালে পড়ে যায়। আর তখনই মুশকিলটা হয়। আড়ালের লেখা পড়া যায় না। কোন লেখাটা দাগের আড়ালে পড়বে আগে থেকে বোঝা কঠিন। বড় বড় পিন দিয়ে নোটিশ আটকে, কাঁচের দরজা বন্ধ করার পর বোঝা যায়। যেমন হেডস্যারের এই নোটিশে ঢাকা পড়েছে শেষ লাইনটা। বেশিরভাগ সময়ই শেষ লাইনে গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকে না। এবারে কিন্তু আছে। নতুন নিয়ম লেখার পর, শেষ লাইনে হেডস্যার লিখেছেন, নিয়ম না মানলে কী শাস্তি হবে। আমরা, স্কুলের ছেলেরা, নিয়ম জানলাম, নিয়ম ভাঙার শাস্তি জানতে পারলাম না।

সে যাই হোক, হঠাৎ করে স্কুলে একটা নতুন নিয়ম কোন চালু করতে হল? সবকটা ঘটনা না বলে শুধু মারাত্মক তিনটে বললেই এর কারণ বোঝা যাবে।

প্ৰথম ঘটনা অপলককে নিয়ে। অপলক বিশ্বাস।

ক্লাস এইটের এই ছেলে শুধু নামে সুন্দর নয়, স্বভাবেও সুন্দর। সুন্দর আর শান্ত। নামের সঙ্গে মিলিয়ে চোখদুটো বড় বড়, চুল কোঁকড়ানো। মারপিট দুরের কথা, কারও সঙ্গে তার ঝগড়া পর্যন্ত নেই। যদি বা ছোটখাটো রাগারাগি হয়, নিজেই মিটিয়ে ফেলে। যার সঙ্গে গোলমাল, টিফিনের সময় তার কাঁধেই হাত দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ছুটির পর পোটাটো চিপস কিনে বলে, “এই নে, তুই আগে প্যাকেট খোল।”

সোমবার সেই ছেলেই মারাত্মক একটা কাণ্ড করে বসল!

থার্ড আর ফোর্থ পিরিয়ডের মাঝখানের সময়ে পিছনে বসা তূর্যকে লক্ষ্য করে ঘুসি ছুঁড়ল। একটা ঘুষি নয়, পরপর তিনটে ঘুষি! তবে একটাও তূর্যর গায়ে লাগেনি। লাগার কথাও নয়। অপলক ভূগোল, অঙ্ক, ইংরেজিতে যেমন পাকা, কিল চড় ঘুষিতে ঠিক ততটাই কাঁচা। ফলে ঘুষিগুলো খুব সহজে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এদিক ওদিক হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে গায়ে না লাগলেও অপলকের এই রণমূর্তি দেখে তূর্যর মুখ গেল শুকিয়ে। অপলকের সম্পর্কে অনেক কিছু ভাবা যায়, ঘুষি ভাবা যায় না। শুধু তূৰ্য নয়, গোটা ক্লাস হতবাক।

আমাদের স্কুলে যে কোনও খবরই খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে। প্ৰথমে করিডোর, বাথরুম এবং লাইব্রেরিতে ছাত্রদের মধ্যে কানাকানি হয়। তারপর সেই খবর একতলা, দোতলা, তিনতলা টপকে, অফিস হয়ে, টিচার্স রুম ছুঁয়ে একেবারে হেডস্যারের ঘরে গিয়ে পৌছোয়। সমস্যা একটাই। এতটা পথ পেরোতে গিয়ে ‘সত্যি খবর’ এর গায়ে অনেক ‘মিথ্যে খবর’ও লেগে যায়। এবারও তাই হল। টিফিনের আগেই গোটা স্কুল ঘুষির খবর জেনে ফেলল। শেষপর্যন্ত হেডস্যারের ঘরে খবর যখন পৌঁছোল তখন সেই খবরের অবস্থা ভয়ংকর!

দিবাকর প্রায় ছুটতে ছুটতে হেডস্যারের ঘরে ঢুকল। সে হাঁপাচ্ছে। উত্তেজনায় গলা কাঁপছে তার।

“স্যার, কেলেঙ্কারি কাণ্ড। ভয়ংকর ব্যাপার। অপলক মেরেছে।”

“মেরেছে! কাকে মেরেছে?”

হেডস্যার তখন মন দিয়ে স্যারেদের রুটিন তৈরি করছিলেন। রুটিন তৈরি একটা জটিল কাজ। এই কাজে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ সবরকম অঙ্ক লাগে। টেবিল জুড়ে একটা সাদা কাগজ পাতা। এত বড় কাগজ পাওয়া যায় না। বেশ কয়েকটা কাগজ আঠা দিয়ে জুড়ে জুড়ে তৈরি করতে হয়েছে। দিবাকরদাই তৈরি করে দিয়েছে। হেডস্যার একটা স্কেল দিয়ে সেই কাগজে রুল টানছেন। কাগজ বড় হওয়ার কারণে একেবারে রুল শেষ হচ্ছে না। টেবিলের চারপাশে ঘুরে ঘুরে টানতে হচ্ছে। তিনি ঘোরা বন্ধ করে মুখ তুলে দিবাকরের দিকে তাকালেন। দিবাকরদা বলল, “স্যার অপলক মেরেছে তূর্যকে। তূর্য ঠিক ওর পিছনেই বসে।”

হেডস্যার ভুরু কেঁচকালেন। বললেন, “তুমি কোন অপলকের কথা বলছে। ক্লাস এইটের অপলক?”

“হ্যাঁ, স্যার। স্কুলে তো ওই একটিই অপলক। অমন ভাল নাম আর কটা আছে?”

হেডস্যার একটু হাসলেন। বললেন, “তুমি নিশ্চয় ভুল করছো দিবাকর। শুধু নাম নয়, ওই অপলক নিজেও অতি চমৎকার ছেলে। তুমি বোধহয় জানো না এবছর সে গুড কন্ডাক্টের জন্য প্রাইজ পাচ্ছে। তার জন্য দুটো বই পর্যন্ত কিনে রাখা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের শিশু এবং মার্ক টয়েনের হাকলবেরি ফিন।”

দিবাকর জোর গলায় বলল, “স্যার, খবর পেলাম অপলকের ঘুষিতে তূর্যর নাক ফেটেছে। রক্তপাত হচ্ছে। রক্ত দেখে ইতিমধ্যে ক্লাসের আর দুটি ছেলে জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়েছে স্যার।”

এরপর আর দেরি করা যায় না। হাতে স্কেল নিয়েই তিনতলায় দৌড়োলেন হেডস্যার। চাপা না দেওয়ার কারণে স্যারেদের রুটিন পাখার হাওয়ায় ঘরময় উড়তে লাগল মহানন্দে।

দ্বিতীয় মারাত্মক ঘটনা একটু অন্যরকম। তাতে ঝগড়া বা মারপিট নেই। ফুটবল আছে।

সেদিন ছিল ক্লাস সেভেন আর এইটের ফুটবল ম্যাচ। এমনি ম্যাচ নয়, প্রেস্টিজ ম্যাচ। এর আগে দুটো ম্যাচেই হার হয়েছে সেভেনের। এটাতে জিততেই হবে। গেম টিচার ক্লাস সেভেনের জন্য নতুন গোলকিপার ঠিক করছেন। ঋষভ। ঋষভকে নেওয়ার পরামর্শটা প্রান্তিকের। প্রান্তিক সেভেনের ফুটবল টিমের ক্যাপটেন। ঋষভ শুধু প্রান্তিকের ক্লাসের বন্ধু নয়, পাড়ারও বন্ধু। পাশাপাশি বাড়ি। পাড়ার মাঠে এক সঙ্গে খেলাধুলোও হয়। গেম টিচার ক্যাপটেনের কথায় রাজি হয়ে গেলেন। রাজি হয়ে ঠিকই করেছেন। নতুন গোলকিপারের পারফরমেনস হাফ টাইম পর্যন্ত দুৰ্দান্ত। তিনটে অবধারিত গোল বাঁচিয়ে দিল। সেভেন এক গোলে এগিয়ে। জিতব জিতব করছে। গোটা টিম উত্তেজনায় ফুটছে টগবগ করে। আর এমন সময়ই মারাত্মক ঘটনা!

খেলা শেষের বাঁশি বাজার মিনিট দুয়েক আগে সেভেন একটা গোল খেয়ে বসল। তুখোড় গোলকিপার ঋষভ লাফিয়ে ঝাঁপিয়েও বল আটকাতে পারেনি। পারবে কী করে? গোল যে সেমসাইড। বল এসেছে নিজের দলেরই খেলোয়াড়ের পা থেকে। সেই খেলোয়াড়ের নাম প্রান্তিক। দলের ক্যাপটেন। ক্লাসের সহপাঠী। পাড়ার বন্ধু!

ম্যাচ শেষ হওয়া মাত্র কাদামাখা অবস্থাতেই ঋষভ ছুটল গেম টিচারের কাছে। নালিশ জানাতে। গেম টিচার প্রান্তিককেও ডেকে পাঠালেন। বিচার তো আর এক তরফা হয় না। তবে বিচার কিছু করা গেল না। দু’পক্ষের কথা শুনে গেম টিচার গম্ভীর হয়ে গেলেন।

তিন নম্বর মারাত্মক ঘটনা মারাত্মকের থেকেও বেশি। ডবল মারাত্মক।

অন্যদুটো তো তাও স্কুলের মধ্যে আটকে ছিল। এই ঘটনা স্কুলের গণ্ডি টপকে গেল। টপকে চলে গেল বাড়ি পর্যন্ত। আর যাবে নাই বা কেন? এতদিন ছিল দুজনে দুজনে। এবার হল সিঞ্জন বনাম গোটা ক্লাস টেন। দুদিন সহ্য করার পর সিঞ্জন সেদিন পেট ব্যথা বলে স্কুল থেকে হাফ ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেল। পরদিন ফিরে এল বটে, তবে একা নয়, বাবা, মা দুজনকেই সঙ্গে নিয়ে এল। তিনজনেরই মুখ থমথমে। কোনদিকে না তাকিয়ে তারা সোজা ক্লাস টিচারের সঙ্গে দেখা করল।

এরপরই নোটিশ বোর্ডে নিষেধের নোটিশ পড়ল—এখন থেকে স্কুলে ডাকনাম নিষিদ্ধ!

এই নোটিশ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। কারণ ভয়ংকর সবকটা ঘটনার পিছনের কারণ একটাই। ডাকনাম।

শান্তশিষ্ট অপলক। সেদিন অশান্ত হয়েছিল এই ডাকনামের জন্যই। সুন্দর নামের এই ছেলেকে বাড়িতে নাকি সবাই ডাকে ‘পেঁপে’ বলে। এই নামের পিছনে ইতিহাসও আছে। ছেলেবেলায় কেউ সন্দেশ, রসগোল্লার ভক্ত হয়, কারও নজর থাকে চকোলেট, ক্যাডবেরিতে। কেউ পছন্দ করে কেক, পেস্ট্রি, পিৎসা। ফুচকা, বাদাম, চিপসের জন্য পাগল তো সকলে। কিন্তু কোনও রহস্যময় কারণে অপলক ছেলেবেলায় ছিল পেঁপের ভক্ত। এমনি ভক্ত নয় বাড়াবাড়ি রকমের ভক্ত। পেঁপের ডালনা থেকে পাকা পেঁপে কিছুই খেতে বাদ দিত না। সেই থেকে বাড়িতে সবাই তাকে ‘পেঁপে’ বলে ডাকতে শুরু করে। একটু বড় হতেই অপলক বুঝতে পারে, এই নাম আগে ঝেড়ে ফেলতে হবে। সে পেঁপে ত্যাগ করল। কিন্তু নাম ত্যাগ করতে পারল না। ডাকনামের এই সমস্যা। ভাল নাম তাও বদলানো যায়। কিন্তু ডাকনাম বদলানো যায় না। মেনে নিতে হয়। অপলকও মেনে নিল। তবে একটা কাজ করল। নামটাকে গোপন করে রাখল। কিছুতেই বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে বেরোতে দিল না।

আর সেটাই সেদিন ফাঁস করেছে তূর্য কোনভাবে সে অপলকের এই ‘অতি চমৎকার’ ডাকনামটি জানতে পারে এবং পিছনে বসে ফিসফিস করে ডাকতে থাকে।

“পেঁপে, অ্যাই পেঁপে। কী শুনতে পাচ্ছিস না? এবার দেখবি মজা? পেঁপে বলে ক্লাসের মধ্যে চেঁচাব নাকি?”

এরপরেও কী অপলক ঘুষি ছুঁড়বে না? ফুটবল ম্যাচে সেমসাইডের ঘটনার পিছনেও সেই ডাকনাম। প্ৰান্তিকের ডাকনাম। এমন মনকাড়া নামের একটা ছেলের ডাকনাম যে কেন ‘গোল’ হয়েছিল কে বলতে পারে? প্ৰান্তিক মোটেও গোলগাল দেখতে নয়। ড্রইং ক্লাসে যে ভাল সার্কেল আঁকে তাও নয়। তবে? তবে আর কী। ডাকনাম যে কোনটা হবে কে বলতে পারে। বেচারি প্রান্তিকের কপালেও তাই ঘটেছে। আর সেটাই গোলমাল পাকালো ম্যাচের সময়।

মুহূর্তটা ছিল চরম টেনশনের। হঠাৎ একটা ঝটিকা দিয়ে ক্লাস এইটের সৌর্য বল নিয়ে ক্লাস সেভেনের গোল পোস্টে পৌঁছে যায়। গোল কী হবে? গোটা মাঠ তাকিয়ে আছে। প্রান্তিক ছুটে আসে। লাফিয়ে বল কেড়ে নেয় সৌর্যর পা থেকে। ছোট দুটো ট্যাকেলে টপকে যায় এইটের অধিরাজ আর স্পন্দনকে। হাততালি আর চিৎকারে ফেটে পড়ে মাঠের পাশে দাঁড়ানো ছেলেরা। প্রান্তিক এগিয়ে আসে নিজেদের গোলপোস্টের দিকে। গোলপোস্টে দাঁড়ানো ঋষভ হাত পেতে চিৎকার করে ওঠে—

“গোল দে। গোল দে। তাড়াতাড়ি দে। দেরি করিস না। গোল, গোল….”

আর এখানেই হয় ভুল। যে ভুল হওয়ার নয়। যে ভুল কখনও হয় না। চরম উত্তেজনায় সেই ভুলটাই করে বসে প্রাত্তিক। ‘গোল” যে তার ডাকনাম এটাই ভুলে গেল সেই মুহূর্তের জন্য! পাড়ার বন্ধু ঋষভ তাকে সেই নামে ডেকে নিজের হাতে বল চাইছে সেইটাই মাথা থেকে উবে যায় যেন! অবধারিত গোল বাঁচানোর আনন্দে সব গোলমাল হয়ে যায়। প্ৰান্তিক শরীরের সব শক্তি দিয়ে বলে শট মারে। ওস্তাদ গোলকিপার ঋষভকে খুব সহজেই পরাস্ত করে নিজেদের গোলে বল ঢুকে যায় হাসতে হাসতে। বন্ধুর ‘গোল দে’ শুনে সে ‘গোল দিয়ে’ বসে!

তারপর? তারপর আর কী? দুজনেই নালিশ জানাতে ছোটে গেম টিচারের কাছে।

পেঁপে, গোল তাও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ‘চুপ’? ‘চুপ’ কখনও কারও ডাকনাম হতে পারে? হলে যা ঘটতে পারে সেটাই ঘটল ক্লাস টেনের সিঞ্চনের। আর সেটাই তিন নম্বর মারাত্মক ঘটনা।

সিঞ্চন তার ‘সিঞ্চন’ নাম নিয়ে খুবই গর্বিত। কেনই বা হবে না? সত্যি তো এমন সুন্দর নাম হয় কজনের? সে ‘চুপ’ এর কথা ঘূণাক্ষরেও বলে না কাউকে। অপলকের মতোই ডাকনাম লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেদিন হল দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনা নিজেই ঘটাল সিঞ্চন। এটাও অনেকটা ফুটবল ম্যাচের সেমসাইডের মতো।

সোমবার অঙ্কের স্যার ভূপতিবাবু বোর্ডে অঙ্ক কসছিলেন। ক্লাসে চলছিল চাপা গুঞ্জন। স্যার পিছনে ফিরে ধমক দিলেন–

‘চুপ!’

সিঞ্চন ছিল অন্যমনস্ক। নিজের ‘নাম’ শুনে উঠে দাঁড়িয়ে বলল “কী স্যার?”

“কী স্যার মানে?” ভূপতি স্যারের ভুরু গেল কুঁচকে। বললেন, “তুমি উঠে দাঁড়িয়েছে কেন সিঞ্চন?”

“ওই যে আমায় ডাকলেন।”

“ডাকলাম মানে। ফাজলামি হচ্ছে ছেলে? চুপ তোমার নাম নাকি?”

নার্ভাস সিঞ্চন নিজেকে সামলাতে পারল না। বলে ফেলল, “হাঁ, স্যার। চুপ আমার ডাকনাম। তবে বাড়ির নয়, শুধু মামাবাড়ির।”

ব্যস। হাত থেকে তীর বেরিয়ে গেল। পরের কটা দিন ছেলেরা সিঞ্চনকে ‘চুপ’ নামে ডেকে ডেকে কান একেবারে ঝালাপালা করে দিল। তিনদিনের মাথায় অতিষ্ঠ সিঞ্চন “পেট ব্যথা’ বলে পালালো। ফিরল একেবারে বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে নালিশ জানাতে।

এরপরই বোর্ডে হেডস্যারের নোটিশ। তাতে তিনি যা লিখেছেন তার মোদ্দা কথা হল-আমাদের স্কুলে ছেলেদের নাম অতি চমৎকার। সেই নাম উচ্চারণে আনন্দ, শুনতে আরাম, বলতে গর্ব। সুতরাং সেইসব নাম বাদ দিয়ে বিচ্ছিরি ডাকনামে ডাকাডাকি আর চলবে না। এতে আইন শৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে। তাই এখন থেকে স্কুলের ভেতর ডাকনাম নিষিদ্ধ। যদি কেউ এই নিষেধ না মানে… (শেষ লাইন পড়া যাচ্ছে না। কাঁচের দাগে ঢাকা পড়েছে।

কথাটা ভুল নয়। আমাদের স্কুলের ছেলেদের নাম সত্যি ভাল। অপলক, ঋষভ, সিঞ্চন, তুর্য, প্রান্তিক, সৌর্য, স্পন্দন। কী নেই? এসব বাদ দিয়ে পেঁপে, গোল, চুপ! ছিঃ। স্কুলের সব ছাত্রই হেডস্যারের নোটিশের সঙ্গে একমত। নিষেধাজ্ঞা জারি করে উনি ঠিক কাজই করেছেন।

কিন্তু নোটিশ লাগানোর দুদিন পর থেকেই উল্টো কাণ্ড শুরু হয়ে গেল!

নিষেধের একটা মজা আছে। যেটা নিষেধ করা হয় সেটাই যেন বেশি বেশি করে টানে। বিশেষ করে অল্প বয়সে তো বটেই। আমাদের স্কুলের ছেলেদেরও সেটাই হয়েছে। তারা মহা উৎসাহে ডাকনাম সংগ্রহে নেমে পড়েছে! সংগ্রহের কাজ চলছে খুব গোপনে। ক্লাসে ক্লাসে ডাকটিকিটের খাতার মতো ডাকনামের খাতা তৈরি হয়েছে। আশ্চর্যের কথা হল, অনেকে নিজে এসে সেই খাতায় নিজের ডাকনাম জমা করে যাচ্ছে! সেই সব খাতা অদল বদলও চলে। ক্লাস সিক্সের খাতা আসে সেভেনে। সেভেনের খাতা চলে যায় নাইনে। এতদিন যা লুকোনোর জন্য সবাই চেষ্টা করত, নিষেধের পর এখন সেটাই সবাইকে জানাতে চাইছে!

বাপরে, ডাকনাম যে এতরকম হতে পারে কে জানত? আপেল, টুথপেস্ট, পাটিগণিত তো আছেই। এমনকি মাউস, ফ্লপি, সিডি, রিংটোন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে! ক্লাস সিক্সের সবথেকে হাসিখুশি শাকম্ভরের ডাকনাম যে ‘কাঁদুনে’ সেটা যদি সে নিজে এসে না বলত, কে বিশ্বাস করত? কে জানে হয়তো এই কারণেই ডাকনাম এত মজার। নোটিশের পর আরও কাণ্ড হয়েছে। ডাকনাম নিয়ে কেউ আর রাগারাগি করছে না! বরং বিচ্ছিরি নামটা হেডস্যারের নিষেধে সত্যি সত্যি মুছে না গিয়ে খাতায় লেখা হয়ে থাকছে তাতে তারা বেজায় খুশি।

কেন এরকম হল কে জানে? ডাকনামের পিছন কি ভালবাসা বেশি থাকে?

হেডস্যার জানলে শাস্তি যে মারাত্মক কোন সন্দেহ নেই। তবে শোনা যাচ্ছে, স্যারেরাও নাকি ডাকনাম সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছেন! তবে সেটা খাতা নয়, ছোট্ট নোটবুক। টিচার রুমে সেই নোটবুক লুকোনো আছে। খবর ঠিক কিনা বলতে পারব না। স্যারেদের একথা জিগ্যেস করার সাহস কারও নেই।

Leave a Reply