আমাদের ক্লাস, অর্থাৎ ক্লাস সেভেনের ঘরটাই স্কুলের সব থেকে বড় ঘর। পবনপুর শ্ৰীমতী কালিদাসী স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ে এত বড় ক্লাসঘর আর একটাও নেই। আমাদের স্কুল শুরু হয় বেলা এগারোটায়। শুরু হয় বলা ঠিক হবে না, বরং বলা ভাল প্রথম ঘণ্টা পড়ে। আমরা তখন যে যেখানে থাকি হুড়োহুড়ি করে ক্লাসঘরে চলে যাই। অন্যসব ক্লাসের ছেলেরাও তখন আমাদের ঘরে চলে আসে। ঘরের চারপাশে সবাই লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়ে। এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিটে দু নম্বর ঘণ্টাটা বাজে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রেয়ার শুরু হয়ে যায়।

আমাদের প্রেয়ার হল “বন্দেমাতরম সুজলাং সুফলাং…”। বেশি নয়। প্রথম প্যারাগ্রাফটুকু। এরকমই চলছিল। এমন সময় হঠাৎ একদিন কী জানি কী হল, আমাদের ইতিহাসের স্যার কুঞ্জবিহারী গাঙ্গুলি ঘোষণা করলেন, না। আর নয়। রোজ রোজ একই গান কেন? এবার থেকে ছেলেরা প্ৰেয়ারের সময় একেকদিন একেকটা গান গাইবে। কিন্তু মুশকিল হল, ছেলেরা তো গান জানে না। কুঞ্জবিহারী স্যার বললেন, ‘কই বাৎ নেহি। ডরো মৎ। আমি গান শেখাব। দু-একদিন রপ্ত করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আসছে সোমবার থেকে শুরু হবে।’ আমাদের তো খুব উৎসাহ। বেশ নতুন একটা কিছু হবে।

সোমবার আমরা সব তাড়াতাড়ি স্কুলে চলে এলাম। অনেকেই অবশ্য ভাল করে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা কী। ফাংশন টাংশন কিছু একটা হতে চলেছে ভেবে কেউ কেউ ইস্তিরি করা জামা-প্যান্ট পরে এল। হয়ত অনেকক্ষণ থাকতে হবে ভেবে কারও বাড়ি থেকে বেশি করে টিফিন দিয়ে দিল। সব থেকে ভয়ঙ্কর ঘটনা হল, ক্লাস নাইনের নেপু বগলদাবা করে বাঁয়া তবলা নিয়ে এসে হাজির হল হাসি হাসি মুখে। কুঞ্জবিহারী স্যার যথাসময়ে আমাদের ঘরে এলেন। পেছনে পেছনে অখিল বেয়ারা বয়ে নিয়ে এল একটা হারমোনিয়াম। টেবিলে হারমোনিয়াম, তবলা। একদিকে আমরা অন্যদিকে কুঞ্জবিহারী স্যার আর নেপু। ঘরে টুঁ শব্দ নেই। থম থম করছে। কী হয়, কী হয় ভাব। স্যার বললেন, “শোন আমি প্রথমে এক লাইন গাইব। শুনে শুনে তোমরা গাইবে।” একথা বলে তিনি হারমোনিয়াম টেনে টুনে দেখে নিলেন। নেপুর কানে কানে কী বললেন। নেপু খুব ঘাড় নাড়ল। এমন সময় দু-নম্বর ঘণ্টা বাজল।

স্যার শুরু করলেন, “আমাদের যাত্রা হল শুরু, এখন ওগো কর্ণধার–।”

বেজে উঠল হারমোনিয়াম। শুরু হল তবলার বোল। আমরা হতবাক। কোথায় গান? কোথায় হারমোনিয়াম? কোথায় তবলা? তিনটে যেন তিনদিকে ছুটছে! মনে হচ্ছে যেন একশো লোক মিলে ছাদ পেটাচ্ছে। ওরকম রোগা রোগা ইতিহাস স্যারের গলা যে এমন আশ্চর্য রকম হাঁড়ির মত হতে পারে কে ভেবেছিল? চোখ বুজে, আবেগ নিয়ে তিনি গেয়ে চলেছেন, “এখন বাতাস ছুটুক তুফান উঠুক, ফিরব না গো আর—।” তারপর হঠাৎ চোখ খুলে খেঁকিয়ে উঠলেন, “কিরে তোরা গা।’

নেপুও টেরি নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ গা গা।”

অগত্যা আর উপায় কী? আমরা প্রায় শ-দুয়েক ছেলে মিলে উচ্চৈস্বরে শুরু করলাম। দুশো জন মিলে ভুল সুরে, গলা ফাটিয়ে যদি “আমাদের যাত্রা হল শুরু-” গাইতে থাকে তাহলে যে কী ঘটতে পারে তা এক মিনিটের মধ্যে বোঝা গেল। গাইতে গাইতে শুনতে পেলাম হারমোনিয়াম আর তবলাকে ছাপিয়ে একটা গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। গান থামিয়ে সকলে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের ক্লাসের মুকুন্দরাম ঘটকের মুখ দিয়ে গ্যাজলা বের হচ্ছে। আর সে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে। ওই দৃশ্য দেখে ক্লাস ফাইভের একটা ছেলে ‘ওরে বাবা রে, আমি আর গাইব না রে’ বলে কাঁদতে শুরু করল। হেডসার ছুটে এলেন।

তারপর? তারপর আর কী। আমরা আবার প্ৰেয়ারের সময় ‘বন্দেমাতরম’ গাই। তবে মুকুন্দ নাকি এখনও রাতে ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে গোঁ-গোঁ শব্দ করে!

Leave a Reply