আমাদের এই পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের নানারকম মজার কম্পিটিশন হয়। আমাদের বাংলার মাস্টারমশাই বিমানবাবু এসব ব্যবস্থা করেন। ওঁর মাথা থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব আইডিয়া বের হয়। এসব কম্পিটিশনে আমাদের খুব উৎসাহ। পড়াশুনোর সঙ্গে বেশ একটা অন্যরকম দিন কাটাই। এরকম একটা কম্পিটিশনের গল্প বলি।
বিমান স্যার একদিন বললেন, “আগামীকাল তোমাদের একটা কম্পিটিশন হবে।” আমরা তো হৈ হৈ করে উঠলাম, কিসের কম্পিটিশন?”
স্যার বললেন, টিফিন কম্পিটিশন। টিফিনের সময় আমি ঘুরে ঘুরে দেখব কে কে টিফিন খাও। যার টিফিন আমার সব থেকে ভাল লাগবে সে ফার্স্ট হবে। মনে রাখবে বিচার কিন্তু সবদিক থেকে হবে। যে টিফিন আনবে সেটা খেতে ভাল কিনা, কুড়ি মিনিট টিফিন টাইমের মধ্যে সেই টিফিন তোমরা শেষ করতে পারছ কি না, টিফিন খেয়ে স্কুল নোংরা কর কিনা—এইরকম সবদিক দেখব কিন্তু। ক্লাস সেভেনের সবাই তো দারুণ খুশি। এমন প্রতিযোগিতার কথা আগে কেউ কখনও শোনেনি।
পরদিন আমাদের ক্লাসে সে একটা দেখবার মত দৃশ্য। পিন্টু এসেছে ইয়া বড় চারটে বাটিওলা একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে, সোমনাথ এল কাঁধে একটা ফ্লাস্ক ঝুলিয়ে, সুমনের হাতে একটা ঠোঙা, মানসের সঙ্গে ওয়াটার বটল, দেবুর সঙ্গে ওদের বাড়ির কাজের ছেলে নিমাই এল। নিমাইয়ের হাতে একটা ডাব। প্রণব নিয়ে এসেছে মিষ্টির বাক্স আর হাঁড়ি, কৃষ্ণেন্দুর জামার পকেট থেকে কাঁটাচামচ উকি মারছে। আরও সবাই কত কি যে নিয়ে এসেছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। তবে কেউ কিন্তু বলছে না যে কী টিফিন এনেছে। সবার মুখেই মিটমিটি হাসি। ‘আজ দেখে নেব’, এমন একটা ভাব সকলেরই।
টিফিনের ঘণ্টা পড়তেই শুরু হল সে এক দারুণ কাণ্ড! পিন্টু টিফিন ক্যারিয়ার খুলে সাজিয়ে বসল। নুন, লেবু, ভাত, ডাল, মাছের ঝোল, চাটনি। সোমনাথ ফ্লাস্ক থেকে গরম দুধ ঢালতে লাগল। সুমনের ঠোঙা থেকে বের হল ফুলুরি, বেগুনি, মোচার চাপ। মানসের ওয়াটার বটলে লেবুর সরবত। দেবু পেনসিল কাটার ছুরি দিয়ে ডাবের মুখ কাটতে শুরু করল। প্রণব সন্দেশ আর রাজভোগ এনেছে। কৃষ্ণেন্দু গলায় রুমাল বেঁধে কাটা চামচ দিয়ে চাউমিন খেতে শুরু করল। এছাড়া কেউ এনেছে, প্যাকেট ভর্তি বিস্কুট। এমনকি ক্যাডবেরি পর্যন্ত।
এদিকে স্কুলে তো কম্পিটিশনের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। অন্য ক্লাসের ছাত্ররা সব দরজা-জানলায় ভিড় করেছে। খুব হাসাহাসি করছে সবাই। আমাদের ক্লাস সেভেনের ঘরটা যেন নেমস্তন্ন বাড়ি! বিমান স্যার ঢুকলেন। তাঁর মুখেও হাসি। তিনি এক একটা বেঞ্চে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন আর কাগজের টুকরোতে কিসব লিখতে লাগলেন। এদিকে আমরা তো খুব জোর খাওয়া-দাওয়া সারছি। এমন সময় বিমান স্যার ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলেন আমাদের নিমাই সামন্তর সামনে। সে টিফিন খাচ্ছে না, কাঁদো কাঁদো মুখে বসে আছে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে তোর টিফিন খাওয়া হয়ে গেছে?” নিমাই প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি। সে বলল, “স্যার টিফিন কিনব বলে বাবার কাছ থেকে দুটো টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। সত্যি বলছি স্যার। একটা ভাল কেক কিনেছিলাম স্যার। বিশ্বাস করুন স্যার। কিন্তু স্কুলে ঢোকবার সময় বাহাদুরের (স্কুলের দারোয়ান) ছোট ছেলেটা এমন জুল জুল করে তাকাচ্ছিল-কেকটা স্যার ওকে দিয়ে দিলাম। আপনি স্যার বাহাদুরকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন—”
স্যার খুব বিরক্ত মুখে নিমাইকে বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। দুঃখ কর না। পরেরবার আবার যোগ দিও কম্পিটিশনে।’ তিনি আবার ঘুরতে লাগলেন। প্রণব একবার স্যারকে বলল, “একটা রাজভোগ খাবেন স্যার?” স্যার কঠিন চোখে প্ৰণবের দিকে তাকালেন। ঘণ্টা পড়তে কম্পিটিশন শেষ হল। পরের দিন ফলাফল জানানো হবে।
এরপর সারাটা দিন ধরে আমাদের খুব আলোচনা চলল। তপন বলল, “মনে হচ্ছে পিন্টুই ফার্স্ট হবে।” অজয়ের মতে ফার্স্ট হওয়া উচিত বাবলুর। কেননা ও হজমি আর আচার এনেছিল। অলক কিন্তু বলল, “ফার্স্ট প্রণবই হচ্ছে। ও কেমন স্যারকে রাজভোগ খাওয়াতে গেল।” তবে একটা বিষয়ে আমরা সবাই একমত হলাম যে নিমাইটা খুব বোকামি করেছে। বিমানস্যার ওর ওপর খুবই বিরক্ত হয়েছেন।
পরদিন স্কুলে গিয়েই আমরা নোটিস বোর্ডের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। যা দেখলাম তাতে কৃষ্ণেন্দুর মুখ চামচের মত, প্ৰণবের মুখ রাজভোগের মত, দেবুর মুখ ডাবের মত হয়ে গেল।
বিমান স্যার নোটিস বুলিয়েছেন: ক্লাস সেভেনের টিফিন কম্পিটিশনে ফাস্ট হয়েছে নিমাই সামন্ত।