আমরা দুই ভাই বোন পর্দার আড়ালে যেন বরফের মতো জমে গেছি! নড়তে পারছি না। এসব কী কথা! মতিলালকে দেখে কারা পালায়? কেন পালায়? কীসের মন্ত্র জানার কথা বলছেন বড় মামা? চোরডাকাত আবার তাড়াতে মন্ত্র লাগে নাকি?

লোকটার চেহারা চিমসে প্যাটার্নের। গায়ের রঙ কালো। হাঁটু পর্যন্ত ধুতি আর ফতুয়া। দুটোই ফ্যাটফ্যাটে সাদা। যেন আসল সাদার ওপর আরও এক পোঁচ সাদা রঙ বোলানো হয়েছে। ফলে গায়ের রঙ হয়ে গেছে আরও কালো। একেবারে মিশমিশে। ঝাঁকড়া চুলে কষে তেল মেখেছে। যে কোনও সময় সেই তেল কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে পারে। বারান্দার সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে হাতদুটো জড়ো করে। প্ৰণামের ভঙ্গি। মানুষটার চেহারায় আরও কোনও গোলমাল রয়েছে। সেটা চোখের সামনেই আছে, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না। চোখের সামনে কিছু থাকা সত্ত্বেও ধরতে না পারলে অস্বস্তি হয়।

আমাদেরও হচ্ছে।

বড় মামা দু’বার গলা খাঁকারি দিলেন। বললেন, “মতিলাল, ভবানী যো বোলা কেয়া ও সাচ্ হ্যায়? সত্যি কথা বলছে?” লোকটা চুপ করে রইল। ভবানীদা এবার ধমক দিল, “বোল, চুপ কিঁউ হো? ও সাচ্ হায় না?” মতিলাল দুটো হাত কচলাতে কচলাতে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, “সাচ্ হ্যায়।” লোকটার গলাটা কেমন যেন। পরিষ্কার নয়, আবার জড়ানোও নয়। ফ্যাস ফ্যাসে। বড় মামা চমকে দিয়ে ‘হো হো’ আওয়াজ করে হেসে উঠলেন। তারপর চেয়ার থেকে ঝুঁকে পরে বললেন, ‘সত্যি, তুমি তাড়াতে জান?” মতিলাল ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, “নেহি বাবু হাম কুছ নেহি জানি। ওরাই হামাকে দেখে ভাগে।”

“ভাগে! তোমাকে দেখে পালায়? কিউ? ওদের ভাগানোর জন্য তুমহারা পাস কুছ তন্ত্র মন্ত্র হ্যায়?”

বড় মামার মুখে হাসি। বোঝাই যাচ্ছে তিনি মজা পেয়েছেন। মতিলাল ফিসফিস করে বলল, “নেহি, কুছু নেহি। ফিরভি ও ভাগতা হ্যায়। লেকিন কিউ ইয়ে হাম নেহি জানতা বাবু! ও ভাগতা হ্যায়।”

টক টক টক।

কোথাও একটা তক্ষক ডেকে উঠল। বিকেলবেলা তক্ষক ডাকে? কে জানে ডাকে হয়তো। এটা তো কলকাতা নয় যে সবকিছু নিয়ম এমন চলবে। জায়গাটা অনেকটা একটা পাড়াগাঁয়ের মতো। তাও আবার আমাদের চেনাজােনা পাড়াগাঁ নয়, বিহারের পাড়াগাঁ। মধুপুর থেকে কিছুটা দূরে। রেল স্টেশনে নামার পর টাঙায় আধঘণ্টার পথ। আমাদের অবশ্য আরও বেশি সময় লেগেছে। কারণ যে ঘোড়াটা টাঙা টানছিল তার অবস্থা একেবারেই ভাল ছিল না। মনে হয়, বেচারির রাতে ঠিক মতো ঘুম হয়নি। ছোটার মাঝখানেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছিল। ঘোড়ার ওপর ভবানীদা বেজায় খাপ্পা হয়ে গেল। দেহাতি হিন্দিতে টাঙাওলাকে এই মারেতো সেই মারে। আর বিড়বিড় করে নিজের মনে খালি বলতে লাগল, “ইস দেরি হয়ে গেল। ইস দেরি হয়ে গেল।”

আমি বললাম, “কীসের দেরি ভবানীদা?”

ভবানীদা বিরক্ত গলায় বলল, “তোমাদের বড়মামা বাড়ি পাহারার জন্য নতুন দারোয়ান খুঁজছেন। আজ বিকেলে একজনকে আসতে বলেছি। তার ইন্টারভিউ হবে। তারপর ফাইনাল করব।”

আমি বললাম, আজই বললে?” ভবানীদা রাগী গলায় বলল, “আমি কি ছাই জানতাম যে ট্রেন লেট হবে? তারওপর এই হতচ্ছাড়া ঘোড়াটা…।”

কথা শেষ করে ভবানীদা আবার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। নিজেই ঝিমিয়ে পড়া ঘোড়াকে বলতে লাগলেন, “হ্যাট হ্যাট্। জলদি চল!” ঘোড়া ‘চিঁহি’ ধরনের একটা ডাক দিয়ে আরও স্পিড কমিয়ে দিল। মধুপুর, দেওঘর, জসিডিতে একটা সময় অনেক বাঙালি থাকত। এখনও কম কিছু নেই। তারওপর আসা যাওয়া তো লেগেই আছে। তাই এখানকার স্থানীয় মানুষরাও সুন্দর বাংলা বলতে পারে। যেমন এই ভবানীদা। তার কথা শুনলে কে বলবে মানুষটা বাঙালি নয়? দেহাতি টাঙাওলাও তেমনি। হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে গড়গড় করে বলল, “ঘোড়াকে আপনি কিছু বলেন না কত্তা। রাগ করে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন মাঝপথে সমস্যা আছে। আপনি অত চিন্তা করবেন না। আমি ঠিক নিয়ে যাব।”

গুঞ্জা মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে উঠল। ভবানীদা টাঙাওলাকে ধমক দিল, “চোপ। একদম চোপ। আমি কী এমনি চিন্তা করি? শুধু দারোয়ান হলে ভাবতাম থোড়াই। অন্য ব্যাপার আছে। লোকটা হাতছাড়া হয়ে গেলে বিরাট ক্ষতি। অনেক কষ্টে এর খোঁজ পেয়েছি। তুমি বকবক না করে তাড়াতাড়ি চল দেখি।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “আর কী ব্যাপার?”

ভবানীদা মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। চোখ দুটো চকচকে করে বলল, “শুধু বাড়ি পাহারা নয়, শুনেছি এ লোকের আরও ক্ষমতা আছে। তোমাদের বড় মামাকে সেই ক্ষমতার কথা বলেছি। উনি তো বিশ্বাসই করেন না। বললেন, দূর যতসব বানানো কথা। আমি অনেক জোরজার করলাম। বললাম, একবার দেখতে ক্ষতি কী? তখন রাজি হলেন।”

গুঞ্জা তার গলায় ঝোলানো দূরবীন চোখে লাগিয়ে চারপাশ দেখছে। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই এই কাণ্ড শুরু করছে। চোখ থেকে দূরবীন সরাচ্ছে না। দূরবীন চোখেই ভবানীদার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী ক্ষমতা?”

ভবানীদা একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “অত বলা যাবে না।”

সেই লোকেরই এখন ইন্টারভিউ চলছে। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে আমরা শুনছি।

বছর দুই হল বড়মামা এখানে একটা দারুণ রেস্ট হাউস কিনেছেন। বিরাট বাগানের মাঝখানে ব্রিটিশ আমলের ছোট্ট একটা বাংলো। বাংলোর রঙ পোড়া ইঁটের মতো। ভারি চমৎকার। সারিয়ে সুরিয়ে নিয়ে সেটাকে আরও চমৎকার করা হয়েছে। মনে হয় সত্যি নয়, আঁকা ছবি। সামনে ফুলের বাগান। পাশে সবজি। যাকে বলে কিচেন গার্ডেন। পিছনে আম, জারুল, সিলভার ওকের মতো বড় বড় সব গাছ ভিড় করে আছে দেওয়ালের মতো। একদিকে পুকুর। সেখানে বাঁধানো ঘাট। দক্ষিণের কাঁচের আউট হাউসটাও কম যায় না। রঙিন কাঁচগুলো ছিল ভাঙা, বড়মামা কলকাতা থেকে অনেক খুঁজে নিয়ে এসে সেসব বদলেছেন। কত মানুষ যে এখন এই বাড়িটা কেনার জন্য বড়মামাকে ধরে তার ঠিক নেই। মোটা টাকার কথাও বলে। বড়মামা পাত্তা দেন না।

আমরা এসে পৌঁছেছি বেশিক্ষণ হয়নি। কিন্তু তার মধ্যেই এক চক্কর ঘোরা হয়ে গেছে। বাংলোর চারপাশে জঙ্গল না থাকলেও বেশ জঙ্গল জঙ্গল একটা ভাবও রয়েছে। এটা একটা বাড়তি মজা। বড়মামা বিয়ে থা করেননি। ঝাড়া হাত পা’র মানুষ। ব্যবসাপাতি থেকে ছুটি নিয়ে বছরে দুতিন বার বিশ্রাম নিতে এখানে পালিয়ে আসেন। এবার ঠিক হয়েছিল বাবা, মা আর আমরা দুভাই বোনও আসব। গোছগাছ শেষ এমন সময় বাবার অফিসে হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ল। বেড়ানো পণ্ড। গুঞ্জা তো কেঁদেই ফেলল। মা বড় মামাকে খবর দিল, যাওয়া ক্যানসেল। তখন বড় মামাই ব্যবস্থা করেছেন। ভবানীদাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই আমাদের দুই ভাই বোনকে নিয়ে আজ সকালে ট্রেনে উঠেছে।

কথা ছিল দুপুর গড়াতে না গড়াতে মধুপুরে নামৰ। ট্রেন লেট করল। পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেছে। বেলা বারোটায় হটকেস খুলে মার দেওয়া লুচি, আলুর দম আর দরবেশ দিয়ে লাঞ্চ করেছি। লুচি গরম ছিল। তারপর আর কিছু খাওয়া হয়নি। তবে বেড়ানোর আনন্দে খিদে ভুলে গেছি। ঠিক হয়েছে, বাবার অফিসের কাজ শেষ হলে তিনদিন পর বাবা মাও চলে আসবে। ততদিন আবার দুই ভাই বোন একেবারে স্বাধীন।

কিন্তু প্রথম দিনই যে এরকম একটা কাণ্ড হবে কে ভাবতে পেরেছিল?

বারান্দার ওপাশের ঝোপঝাড় দিয়ে কিছু চলে গেল। আওয়াজ হল, সরসর সর…। গুঞ্জা ফিসফিস করে বলল, “দাদা, ভয় করছে।” গুঞ্জা খুবই ভীতু প্রকৃতির একটা মেয়ে, হুটহাট ভয় পাওয়া তার অভ্যেস। ভেবেছিলাম, ক্লাস সিক্সে উঠলে মেয়েটার ভয় কমবে। কমেনি, বরং বেড়েছে। অথচ আমি ওর থেকে মোটে দু’বছরের বড় হলে কী হবে যথেষ্ট সাহসী। কিন্তু এখন যেন কেমন হচ্ছে! মতিলাল নামের লোকটার সঙ্গে বড় মামার কথা শোনার পর থেকে এটা হচ্ছে। কী হচ্ছে?

আমি হাত বাড়িয়ে গুঞ্জাকে একটা চিমটি দিলাম। বড় মামা আমাদের কথা শুনতে পেলে কেলেঙ্কারি। একটু আগেই তিনি বলেছেন, “অর্ঘ, গুঞ্জা তোমরা ট্রেনে এতটা পথ এসেছে, এখন আর ঘর থেকে একদম বেরোবে না। খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নাও। সেই ফাঁকে আমি একটা জরুরি কাজ সেরে ফেলি। সন্ধেবেলা তোমাদের সঙ্গে আবার জমিয়ে গল্প হবে।” আমরা ভাই বোনে হাত পা ধুয়ে খাওয়া দাওয়া করেছি, কিন্তু বড়মামার বিশ্রাম নেওয়ার কথা শুনিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে চলে এসেছি বারান্দায়। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ‘দারোয়ান’ চাকরির ইন্টারভিউ শুনছি।

বেতের চেয়ারে বড়মামা বসে আছেন। তার ভুরুদুটো কোঁচকানো। ভবানীদা দাঁড়িয়ে আছে পাশে। তারও ভুরুদুটো কোঁচকানো। লক্ষ্য করছি ভবানীদার এই এক স্বভাব। বড়মামার কাছে থাকলে তার মতো আচরণ করবে। এখনও তাই করছে। বড়মামার দেখাদেখি ভুরু কুঁচকে আছে।

বড়মামা ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, “ভবানী এই সেই লোক? এর কথাই তুমি বলছিলে?”

ভবানীদা ঘাড় নিচু করে বলল, “হ্যাঁ বড়বাবু, এই সেই লোক।” বড়মামা গলা তুলে বললেন, “তুমহারা নাম কেয়া হ্যায়? নাম কী?

ভবানীদাও গলা তুলে বলল, “কেয়া হ্যায়?”

ভবানীদা বেশ কয়েক বছর ধরে এ বাড়িতে আছে। সে এই বাড়ির কেয়ারটেকার। আগে কেয়ারটেকার আর দারোয়ান দুটো পোস্টেই কাজ করত। এখন শুধু কেয়ারটেকার। এর পিছনে একটা মজার গল্প আছে। ট্রেনে আসতে আসতে ভবানীদা নিজেই আমাদের সেই গল্প বলেছে। গত বর্ষায় তার নাকি জ্বর হয়েছিল। ছোটখাটো জ্বর নয়, একেবারে তেড়েফুড়ে জ্বর। গোটা শরীর থেকে যেন ধোঁয়া বের হতো! মাথায় পুকুরের ঠাণ্ডা জল বালতি বালতি ঢেলেও টেম্পারেচার কমছিল না। গুনে গুনে সাত দিন বাদে জ্বর গেল কিন্তু এখানে শুরু হল বিচ্ছিরি এক ঝামেলা। দিনের বেলা সব ঠিক থাকে, কিন্তু রাত হলে কেন জানি দুটো কানেই তালা পরে যায়! কিছুই শুনতে পায় না ভবানীদা। অনেক ডাক্তার বদ্যি হল, দেওঘরের কাছে কোন গ্রামে গিয়ে ওঝা পর্যন্ত দেখিয়ে এলো ভবানীদা। ওঝা বলল, “কোন ব্যাপার নয়। এক ধুনুচি ধোঁয়া দিলেই রোগ পালাবে। তবে খরচাপাতি আছে।” বেচারি ভবানীদার উপায় কী? খরচায় রাজি হয়ে গেল। ওঝা কানে ধোঁয়া দিল। এক ধুনুচির বদলে তিন ধুনুচি। খরচও হল তিনগুণ। কিন্তু তাতেও কোনও লাভ হল না। কানের গোলমাল রয়েই গেল। যে মানুষ রাতে কানে শুনতে পায় না তাকে আর যাই হোক বাড়ি পাহারার কাজে রাখা যায় না। এই কারণেই ভবানীদার দারোয়ান পোস্ট চলে গেছে। তবে আমরা মাত্র কয়েক ঘণ্টাতেই বুঝেছি, পোস্ট চলে গেলেও ভবানীদা মানুষটা ভাল। আমাদের সঙ্গে অনেক গল্প করেছে। বলেছে একদিন সাইকেলে চাপিয়ে ডুংরা পাহাড়েও নিয়ে যাবে। আমি কেরিয়ারে বসব, গুঞ্জা বসবে সামনের রডে। বড়মামার রেস্ট হাউসের পাশে ডুংরা একটা ছোট পাহাড়। টিলার থেকে খানিকটা বড়। পাহাড়টায় একটা মজা আছে। ওখানে একটা ঝরনা রয়েছে। সেটার নামও ডুংরা। পাহাড়ের নামে ঝরনা না ঝরনার নামে পাহাড় সেটা কেউ জানে না। রাতে এই নিয়ে পাহাড় আর ঝরনার মধ্যে নাকি ঝগড়া হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে হাওয়ায় কান পাতলে সেই ঝগড়া শোনা যাবে। তবে সবদিন শোনা যায় না। যেদিন যেদিন খুব চাঁদের আলো ফোটে সেদিন শোনা যায়।

গুঞ্জা হাততালি দিয়ে বলল, “না, শুনবে না। রাতে ঘর থেকে বেরনোয় সমস্যা আছে।”

আমি বললাম, “কী সমস্যা?”

ভবানীদা উত্তর না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। যেন কথাটা শুনতেই পায়নি।

ভবানীদার কান বন্ধ হওয়ার পর বড়মামা এই প্রথম এখানে এলেন। তাই এখন পাহারার জন্য নতুন লোকের খোঁজ চলছে। এর মধ্যে পাঁচ জনের ইন্টারভিউ হয়ে গেছে। একজনকেও পছন্দ হয়নি। এই মানুষটাকে নাকি ভবানীদা নিজে অনেক খুঁজে টুজে জোগাড় করেছে।

বাগানের ডুমুর গাছটা থেকে ঝটপটানি দিয়ে একটা পাখি উড়ে গেল। পেঁচা নয়তো? হতে পারে। এখানে দিনের আলোতেও হয়তো পেঁচা ওড়ে। চমকে উঠে গুঞ্জা আরও খানিকটা সরে এলো এদিকে। আমার ডান হাতের কনুইটা চেপে ধরল।

শুরু থেকেই দেখছি, লোকটা হাসছে। মুখে খয়েরি দাঁতের সারি। এটা কোন আশ্চর্য ব্যাপার নয়। অনেকেই পান দোক্তা বেশি খেয়ে দাঁত খয়েরি করে ফেলে। এরও হয়তো সেটা হয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার হল, লোকটার হাসি যেন মুখের থেকেও বড়! দুটো গাল ছাড়িয়ে চলে এসেছে অনেকটা বাইরে! দেখলে কেমন যেন লাগে। গা ছমছমে একটা অস্বস্তি। আমি পর্দার আরও আড়ালে সরে এলাম।

লোকটা ফ্যাস ফ্যাসে গলায় নিজের নাম বলল, “মতি বাবু। হামারা নাম মতি। মতিলাল।”

এরপরই বড় মামা মতিলালকে মন্ত্রর কথা জিগ্যেস করেন। আমরাও ঘাবড়ে যাই। মন্ত্র! কীসের মন্ত্র? কাদের তাড়ানোর কথা বলছে ও? গুঞ্জা কোনও রকমে হাত বাড়িয়ে আমার কব্জিটা ধরল। ছাড়াতে গিয়েও আমি পারলাম না। বরফের মতো জমে গেছি যেন!

আমরা ঘাবড়ে গেলে কী হবে, বড়মামা কিন্তু হাসলেন। হাসতে হাসতেই উঠে দাঁড়ালেন। ভবানীদার দিকে ফিরে বললেন, “ঠিক আছে ভবানী, তুই মতিলালের সঙ্গে ফাইনাল কথা বলে নে। আজ থেকেই ও কাজে নেমে পড়ুক। কদিন ওর কাজকর্ম দেখে মাইনে পত্তর ঠিক করব না হয়। আর ওকে বলে দে ওসব আজগুবি কাণ্ডকারবারে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। শুধু চোর ডাকাত তাড়ালেই চলবে। আর কাউকে এখান থেকে তাড়াতে হবে না। ও বরং আজ রাত থেকে ডিউটি শুরু করে দিক। দেখ বাপু, রাতে আবার পুকুর ঘাটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড় না।”

“বাবু, হাম রাত মে সোনে নেহি।”

বড়মামা বললেন, “ওরকম সবাই বলে। পরে দেখা যাবে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছ। আর চোরে এসে আমার বাগানের সবজি, পুকুরের মাছ সব নিয়ে পালিয়েছে।”

“নেহি বাবু হাম ঝুট নেহি বোলতে।”

রাত দশটার পর এখানে প্ৰায় কোনদিনই আলো থাকে না। অন্য সময়ও না থাকার মতো। ভোল্টেজ কম। টিউব লাইটের তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না, বাল্বগুলো জ্বলে টিমটিম করে। এখনও সেই অবস্থা। দারুণ লাগছে। বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো। সন্ধের পর বসার ঘরে ক্যারম খেলছি। আমরা আসব বলে বড়মামা ক্যারম বোর্ডের ব্যবস্থা করেছেন। খুব জমিয়ে খেলা চলছে। শুধু মনের মধ্যে কেমন একটা খচ খচে ভাব। মতিলালের ঘটনাটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। সুযোগ পেয়ে ভবানীদাকে দু-একবার জিগ্যেস করেছিলাম, উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেছে।

বড় মামাকে প্রথমে চেপে ধরল গুঞ্জা। তারপর আমি। বড় মামা প্রথমটায় চুপ করে রইলেন। তারপর স্ট্রাইকারের আলতো ছোঁয়ায় ‘রেড’ ফেলে বললেন, “দূর ও কিছু নয়। ভীতুর কাণ্ড। তোরা ছাড় তো এসব। ইস্ কতবছর যে ক্যারম খেলিনি। কত বছর হবে? তিরিশ? চল্লিশ? বেশিও হতে পারে। ভাগ্যিস তোরা এলি। চল্লিশ বছর পরেও হাতে কেমন টিপ দেখেছিস? দেখ এবার ওই গুটিটা ফেলব।”

আমি বললাম, “খুব ভাল টিপ। এবার বল কে ভীতু?”

বড় মামা মুচকি হেসে বললেন, “কে আবার? ওই ভবানীটা।”

ভবানীদা ভীতু শুনে গুঞ্জা আর আমি মুখের দিকে তাকালাম।

গুঞ্জা বলল, “মানে!”

বড়মামা তখন গুছিয়ে সবটা বললেন। “এবার এখানে এসে থেকেই দেখছি ভবানী কেমন যেন হয়ে গেছে। একেই তো গত বর্ষার জ্বরে শরীরটা ভেঙে গেছে, তারওপর দেখলাম মনটাও ভেঙেছে। প্রথমদিনই বলল, বাবু, দিনের সব কাজ পারব। কিন্তু রাতে আমায় ছেড়ে দিন। রাতে এখানে থাকতে পারব না। আমার তো মাথায় হাত। কী মুশকিলের কথা। এত বড় বাড়ি, এত জিনিস। রাতে পাহারা না দিলে চলে? ভবানীর মতো বিশ্বাসী মানুষ পাওয়াটাও তো সহজ কথা নয়। আমি ওকে বললাম, তোমার আবার কী হল? ঠিক আছে মাইনে না হয় কিছুটা বাড়িয়ে দিচ্ছি। ও বলল না, মাইনে নয়, অন্য সমস্যা আছে। আমি বললাম, অন্য সমস্যা! সেটা আবার কী!” কথা থামিয়ে বড় মামা ঝুঁকে পরে একটা গুটি ফেললেন। আমি আড় চোখে তাকিয়ে দেখি গুঞ্জার চোখ বড় হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তারপর?” ভীতুদের নিয়ে এই এক মুশকিল। ভয়ও পাবে আবার ভয়ের গল্প শুনতেও চাইবে। বড় মামা বলতে লাগলেন—

“ভবানী তখন বলল, সে নাকি আজকাল রাতে এই বাড়ির আশেপাশে নানা রকম আওয়াজ পায়। আমি বললাম, কী রকম আওয়াজ? বলল, কারা যেন কথা বলছে, কে যেন হাঁটছে—এই সব আওয়াজ। বুঝলাম ডাহা মিথ্যে কথা। বেটা কোনও কারণে ভয় পেয়েছে।”

এবার আমি নড়ে চড়ে বসলাম। ভবানীদা রাতে আওয়াজ পায়! তাহলে যে আমাদের বলেছিল, জ্বরের পর রাতে কানে শুনতে পায় না! কোনটা সত্যি? কথাটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেলাম।

বড় মামা বললেন, “বুঝলি অর্ঘ অনিচ্ছুক মানুষকে দিয়ে সব কাজ করানো যায়, কিন্তু পাহারার কাজ করানো যায় না। বাধ্য হয়ে একজন দারোয়ান খুঁজতে শুরু করলাম। দু-একজনকে দেখলাম, মনোমত হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত এই লোকটাকে ভবানীই এনে দিল।

এই যে ভবলাল না মতিলাল কী নাম যেন।” এরপর বড় মামা মুখ তুলে তাকালেন। হেসে বললেন, “বাড়ি পাহারা ছাড়াও এই মতিলালবাবুর নাকি আরও একটা ক্ষমতা আছে। মিস্টিরিয়াস পাওয়ার। রহস্যময় ক্ষমতা।”

“মিস্টিরিয়াস পাওয়ার!”

আমরা দুজনেই একসঙ্গে বললাম।

বড় মামা প্ৰথমে একচোট হেসে নিলেন। তারপর হাসতে হাসতেই বলতে লাগলেন।

“ভবানী বলছিল, লোকটা নাকি বাড়ি ঘর থেকে ভূত তাড়াতে পারে। হা হা। গ্রামের দিকে অনেকেই নাকি ভূত তাড়াবার জন্য মতিকে ডেকে নিয়ে যায়। দু’চার রাত সেই বাড়িতে থাকলেই ব্যস, তাতেই কেল্লা ফতে। আর কিছু লাগে না। ভূত বাবাজী এমনই বাপ বাপ বলে পালায়। বোঝ কাণ্ড। হা হা। আজ বিকেলে মতিলালকে মজা করে কথাটা আমি জিগ্যেস করলাম। ঘটনা সত্যি কিনা জানতে চাই। লোকটা কী বলল জানিস? বলল, ঘটনা সত্যি! ভূত নাকি ওকে দেখলে পালায়! কোন মন্ত্র টন্ত্র লাগে না, এমনিই চম্পট দেয়। হা হা। প্ৰথমে ভেবেছিলাম, লোকটাকে রাখব না। একটা মিথ্যেবাদীকে বাড়িতে ঢোকানো ঠিক হবে না। তারপর ভেবে দেখলাম, অসুবিধে কী? মিথ্যেটা তো ক্ষতির কিছু নয়, বরং মজার। কটা দিন দেখি না। তাছাড়া…।” এতটা পর্যন্ত বলে বড় মামা থামলেন।

আমি বললাম, “তাছাড়া কী?”

“তাছাড়া ভবানীটাও কদিন ধরে খুব চাইছিল লোকটাকে যেন রাখি।”

“কেন? ভবানীদা চাইছিল কেন?” গুঞ্জা জিগ্যেস করল।

বড় মামা আবার হাসলেন। বললেন, “কেন আবার, একটা কাউকে না রাখলে ভবানীরই তো সব থেকে মুশকিল। ওকেই রাতে পাহারা দিতে হবে। আরও একটা কারণ হতে পারে। হয়তো লোকটা ভবানীর পরিচিত। গরিব মানুষ। বেচারি কাজকর্ম পাচ্ছে না, এই সব বানানো কথা বলে চাকরিটা করিয়ে দিতে চাইছে ভবানী। তবে ভবানী এ বাড়ির ভালই চাইবে। সে আমার অনেকদিনের পরিচিত। এই সব ভেবে মতিলালকে রেখেই দিলাম। দেখি না কটা দিন। অনেক বাড়িতে তো কাকতাড়ুয়া থাকে, আমার এখানে না হয় একটা ভূততাড়ু়য়া রইল। হা হা। তোরা ফিরে গিয়ে বন্ধুদের বলবি, বড় মামার রেস্টহাউসে একটা ভূত তাড়ুয়া আছে। তার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো আর জামাকাপড় ফট্ফট সাদা। হা হা।”

বড়মামা একেবারে গলা খুলে হাসতে লাগলেন। ‘ভূত তাডুয়া” কথাটা শুনে আমাদেরও খুব মজা লাগল। সব ভয় টয় পালালো। আমরাও হাসতে শুরু করলাম। ভীতু গুঞ্জাটা পর্যন্ত এতো হাসল যে ওরা হেঁচকি ওঠার মতো অবস্থা। বড় মামা মাথায় চাপড় দিয়ে সামলালেন।

রাতে বোধহয় বৃষ্টি হয়েছিল। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ঘুম হল চমৎকার। একেবারে একঘুমে রাত কাবার। শুরুতে আউটহাউসের দিক থেকে শুধু একবার তীক্ষ একটা হুইশলের আওয়াজ পেলাম। পাহারাদারের হুইশল। ভূত তাড়ু়য়া কি মাথায় ছাতা নিয়ে পাহারা দিচ্ছে? নাকি রেনকোট গায়ে দিয়েছে? ভূত কি রেনকোট দেখলে ভয় পালায়? এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরলাম আবার। সকালে উঠে দেখি, চারপাশ একেবারে আলোয় ঝলমলে। ঘর থেকে বেরিয়ে শুনি হইচই হচ্ছে। বড় মামা অর্ডার দিয়েছেন বাড়ির পিছনে সিলভার ওক গাছটায় দড়ির দোলনা টাঙাতে হবে। আমি আর গুঞ্জা নাকি আজ সেই দোলনায় বসে ব্রেকফাস্ট করব। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, ভবানীদা দোলনা নিয়ে ছোটাছুটি করছে।

ইস কী মজা!

মজা চলল পরের কটা দিন। অনেকরকম মজা। শুধু ঘরে বসে ক্যারম নয়, মাছ ধরা, গাছে ওঠা, পিকনিক, ক্যাম্প ফায়ার অনেক কিছু। সব থেকে মজা হল, বাবা তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলায় তিন দিনের বদলে দেড়দিনের মাথায় মাকে নিয়ে চলে এল সোজা গাড়ি নিয়ে। তারপর থেকে আমরা গাড়িতেই বেড়াতে লাগলাম। দেওঘর গেলাম। ডুংরা পাহাড়েও গেলাম। হইচইতে এতো মেতে উঠলাম যে ভবানীদা আসছে না সেটাও খেয়াল করলাম না। ভূত তাডুয়া মতিলালের সঙ্গেও আর দেখা হয়নি। সে রাত করে আসে। পাহারা সেরে ফিরে যায় ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে। বাবা-মাকে গল্পটা বলেছি। বাবা বলেছে, একদিন রাতে ডেকে কথা বলবে। মা বলল, “না, বাবা ওসব ভুত টুতের ব্যাপার। খবরদার রাতে আমার সামনে ডাকবে না। বড়দা যে কী কাণ্ড করে। কাদের সব ধরে আনে।”

মায়ের কথা শুনে আমরা খুব হাসলাম। বড়মামা বলল, “আমি কী করেছি। করেছে তো ভবানী। সেই তো লোকটাকে এনেছে। এনে এখন কামাই করছে। মনে হয় বেচারি আবার জ্বরে পড়েছে। ভাবছি এবার কলকাতায় ফেরবার আগে একবার ওর গ্রামের বাড়িতে যাব। গতবার অসুখের সময় আমি এখানে ছিলাম না। এবার না গেলে খুবই খারাপ হবে। সমস্যা হল, গ্রামের নামটা বলেছিল, কিন্তু এখন ঠিক মনে পড়ছে না। যাই হোক খুঁজে নিতে হবে। ওই আজগুবি মতিলাল নিশ্চয় ঠিকানা বলতে পারবে।”

আমি আর গুঞ্জা দুজনেই একসঙ্গে বললাম, “আমরাও তোমার সঙ্গে যাব বড়মামা। বেশ আর একটা আউটিং হবে। ভবানীদাও খুশি হবে।”

বড়মামা বলেন, “না, আমি একাই যাব। আজ বিকেলেই চট করে একবার ঘুরে আসব।”

সাতদিনের বদলে পাঁচদিনের মাথায় আমরা কলকাতায় ফিরে এসেছি। বড় মামাও তার চমৎকার রেস্টহাউসে বড় একটা তালা ঝুলিয়ে চলে এসেছেন আমাদের সঙ্গে। উনি বাড়ি বিক্রি করে দেবেন। ইতিমধ্যেই ওখানে যারা একসময় বাড়ি কিনব বলে উৎসাহ দেখিয়েছিল তাদের দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন।

এ ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে তাতে ওখানে আর থাকা যায় না।

ঘটনা এরকম—

সেদিন বড়মামা যখন ঠিকানা খুঁজে ভবানীদার গ্রামে পৌঁছোলেন তখন কড়া দুপুর। সূর্য একেবারে মাথার ওপর। গ্রামের মুখে বন্ধ চায়ের দোকানে বসে কটা লোক তাস খেলছিল। বড়মামা গাড়ি থেকে নামতে নিজেরাই এগিয়ে এল। তারপর ভবানীদার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ল! গতবর্ষায় সাতদিনের জ্বরে যে মানুষটা মারা গেছে তার আবার খোঁজ কীসের! সে তো অনেকদিন হয়ে গেছে। এরপর আর এই বাড়ি রেখে দেওয়া যায়?

এই ঘটনার বেশ কয়েকমাস পরে গুঞ্জা একদিন আমাকে জিগ্যোস করল, “আচ্ছা দাদা, ভবানীদা যখন নিজেই ভূত তখন একজন ভূত তাড়ুয়াকে ডেকে আনতে গেল কেন?”

আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। কারণ ঠিক উত্তর আমি জানি না। হতে পারে, মারা যাওয়ার পরও ভবানীদা দায়িত্ব ছেড়ে চলে যেতে পারছিল না। বড়মামা আর ওই বাড়ির মায়া কাটাতে পারছিল না কিছুতেই। হয়তো তাই ভূত তাড়ু়য়া মতিলালকে এনে চলে যাওয়ার একটা উপায় বের করেছিল। আবার এগুলো সব মিথ্যেও হতে পারে। চমৎকার রেস্টহাউসটা যাতে বড়মামা বিক্রি করে দেন তার জন্য ফন্দি। বর্ষায় জ্বর, রাতে কানে শুনতে না পাওয়া থেকে শুরু করে, ভূত তাড়ুুয়া মতিলালকে নিয়ে আসা, গ্রামের কটা লোককে দিয়ে মৃত্যু সংবাদ দেওয়া—সবকিছু বানানো।

কোনটা সত্যি কে জানে?

Leave a Reply