এই অঞ্চলে একটাই বড় স্কুল। এই পবনপুরে। এদিকে দু’স্টেশনের মধ্যে এত বড় স্কুল আর নেই। এ হল যাকে বলে সেই হাই স্কুল। একেবারে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত। আমরা যারা পবনপুরে থাকি তারা তো এই স্কুলে পড়িই, এমনকি আশপাশে অনেক দূর দূর জায়গা থেকেও ছেলেরা সব আসে। স্কুল নিয়ে আমাদের খুবই গর্ব। আমাদের যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, “কি খোকা, কোন স্কুলে পড়?” তখন আমরা যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, হাতদুটো পেছনে নিয়ে, বুক টান টান করে বলি, “পবনপুর স্বাধীনতাসংগ্রামী শহিদ শ্ৰীমতী চারুবালা দাসী স্মৃতি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় ব্র্যাকেটে সরকার অনুমোদিত।” অনেকেই বলেছেন, ‘স্কুলের নাম বলছি তো ওরকম অঙ্গভঙ্গি করছ কেন? আমাদের তাতে কিছু এসে যায় না। আমাদের ড্রিল স্যার এ রকমই শিখিয়ে দিয়েছেন।”

স্কুল আমাদের একেবারে নতুন। বছর তিনেক আর এমন কী? তবু এর মধ্যেই একদম জমজমাট। কোন ক্লাসে আর একটি সিটও ফাঁকা নেই। তাও রোজ যে কত ছেলে ভর্তির জন্য আসে তার কোন ঠিক নেই। বড় পরীক্ষায় স্কুলের রেজাল্টও খুব ভাল হয়। এই তো এবার মাধ্যমিক পরীক্ষায় আটানব্বইজন ছাত্রের মধ্যে দশজন ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে, দুজন পেয়েছে স্টার নম্বর। এইজন্য স্কুল একদিন টুনিবাল্ব দিয়ে সাজানো পর্যন্ত হয়েছিল। আমাদের স্কুলে খেলাধুলো হয়, অ্যানুয়াল ফাংশন হয়, হাতে লেখা ম্যাগাজিন বের হয়। এইরকম স্কুল নিয়ে পবনপুরের মানুষ গর্ব করবে না তো কী করবে? অথচ স্কুলটা হবে কি না তা নিয়ে কতই না সংশয় ছিল। চিস্তায় কত রাত আমাদের ঘুম হয়নি। আজ যারা এই স্কুল নিয়ে গর্ব করে তাদের কতজনই না সেদিন চেষ্টা করেছিল স্কুলটা যাতে না হয়। আমরা ছোটরা, মানে পিন্টু, সুমন, শুভাশিস, মানস, রথীন, পার্থ, দেবু, কৃষ্ণেন্দু, প্রতীম, অর্ণব, পিনাকী, অনুপমরা যদি তখন একজোট না হতাম তাহলে কি পবনপুরে এতবড় স্কুলটা হত? মোটেই না।

তাহলে বলি—।

শিবপদ ভট্টাচার্য যখন পবনপুর কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন তখনই বলেছিলেন, “হবে, একটা কিছু হবেই। জিতে নিই। পবনপুরের জন্য ঠিক কিছু একটা করে দেব।” ভোটে জিতে এম এল এ হয়ে শিবপদবাবু সে কথা মনে রেখেছেন দেখে দাদা, বাবা, কাকারা অবাক হল। পাড়ার বড়রা বলাবলি করতে লাগল, “অবাক কাণ্ড! শিবুটার হল কী? জিতে গেছে। তাই কিনা বলছে কথা রাখব? প্রতিশ্রুতি রাখব? মাথা খারাপ হল নাকি? যে যাই বলুক না কেন, এক রোববার সন্ধেবেলা বাজারের মোড়ে এম এল এ সাহেব মিটিং ডাকলেন। বড়রা গেল, আমরাও পেছন পেছন গেলাম। মাইকে ধরা ধরা গলায় শিবপদবাবু বললেন, “পবনপুর কথা রেখেছে। আমাকে জিতিয়েছে। আমিও কথা রাখব। এবার আপনারা বলুন, পবনপুরের জন্য কী চান? একটা সিনেমাহল না একটা বিরাট ক্লাবঘর, না একটা সুইমিং পুল? আপনারা নিজেরা ঠিক করে সাতদিনের মধ্যে জানান।”

ব্যস, এরপর যা হওয়ার তাই হল। ঘরে ঘরে ঝগড়া লেগে গেল। মা, মাসি, পিসি, জেঠি, দিদিরা বলতে লাগল সিনেমাহলই চাই। কাছাকাছি ভাল কোন হল নেই। বাবা কাকারা চায় ক্লাবঘরটাই হোক। সন্ধের পর তাস, দাবা খেলা যাবে। দাদার বয়সী যারা তারা ঝুঁকছে সুইমিং পুলের দিকে। এই নিয়ে আলোচনা ঝগড়া এমনকি ছোটখাট মারপিট পর্যন্ত হল। সাতদিন কেটে গেল, দশদিন কেটে গেল কোন সিদ্ধান্তই হল না। এইরকম সময় একদিন বিকেলে ফুটবল খেলার মাঠে পিন্টু বলল, “দেখ, ব্যাপারটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। আমরা কি পবনপুরের কেউ নই?” দেবু বলল, “ঠিকই। পবনপুরে আমাদের জন্য কি কিছু হতে নেই? বড়রাই কি সব?”

কৃষ্ণেন্দু বলল, “চল আমরাও এম এল এ-র কাছে যাই। কিন্তু কী চাইবি?’

মানস বলল, “সবথেকে ভাল হয় আমরা যদি একটা স্কুল চাই। তাহলে আর আমাদের কষ্ট করে দূরে যেতে হবে না।”

অনুপম বলল, “সেটাই ভাল। এক স্কুলে আমরা বেশ সবাই মিলে পড়তে পারব। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে হবে না।”

‘হুররে’ বলে। লাফিয়ে উঠলাম সকলে। পরদিন ভোর না হতেই আমরা একেবারে শিবপদ ভট্টাচার্যের বাড়ির দরজায়। আমরা সবাই চাই একটা স্কুল। আমরা, ছোটরা সবাই একমত। এরপর সত্যি সত্যিই একদিন পবনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হল। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে বড় মন নিয়ে দলে দলে ছোটরা এসেছিল। আর অনেক ছোট মনের বড়রা সিনেমা হল, ক্লাব আর সুইমিং পুল হল না বলে রাগ করে এলই না।

Leave a Reply