» » ক্লাস নাইনের ভূত

আমাদের স্পোর্টসে এক একজন ছেলে এক একটা ইভেন্টে দুর্দান্ত। তাদের পারফরমেন্স নিয়ে আমরা সারা বছর আলোচনা, ঝগড়া এমনকি মারামারি পর্যন্ত করি।

কয়েকটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

ক্লাস নাইনে ছিপছিপে বাসুদেব একশো মিটার দৌড়ে একেবারে মারাত্মক। চোখের পলক পড়বার আগেই দৌড় শেষ। কালো হাফ প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি না পরে, ও যদি দৌড়ানোর সময় কালো হলুদ ডোরাকাটা কোনও পোশাক পরত তা হলে ঠিক মনে হত বাসুদেব নয়, একটা চিতাবাঘ ছুটছে। বাসুদেবের দৌড়ের কায়দা আমরা অনেকেই নকল করতে চেষ্টা করি। কিন্তু কখনই ঠিকমতো হয় না। ওর স্টার্ট আর ফিনিশিং নিয়ে একবার ক্লাস সেভেনের সঞ্জয় আর ক্লাস এইটের অমৃতর মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছিল।

বাসুদেবের দৌড় যদি চিতাবাঘের মতো হয়, তা হলে রাজার হাই জাম্প পাখির মতো। ক্লাস সিক্সের রাজাকে শুধু তার ক্লাসের ছেলেরা হিংসে করে বললে ভুল হবে। গোটা স্কুলের ছাত্ররাই হিংসে করে। হিংসে করে আবার ওকে নিয়ে গর্বও করে। আশেপাশে চার-পাঁচটা স্কুলে খবর নিয়ে দেখা গেছে, এমন হাই জাম্প দিতে কেউ পারে না। লাফাচ্ছে তো না, যেন ডানা মেলে উড়ছে!

অঙ্ক স্যার সুশীলবাবু হােমটাস্ক না করলে পরদিন ডবল হােমটাস্ক দেন। সেই সুশীলবাবু পর্যন্ত রাজাকে বলেন, “তোকে শুধু ছাড়। তুই বাড়িতে অঙ্ক প্র্যাকটিস না করে হাই জাম্প প্র্যাকটিস করবি। এতদিন জানতাম লাফিয়ে লাফিয়ে জীবনে উন্নতির ব্যাপারটা শুধুমাত্র কথার কথা। তোকে দেখে বুঝতে পারছি না, কথার কথা নয়। তুই সত্যি লাফিয়ে উন্নতি করবি। তুই বাবা মন দিয়ে লাফা, আরও বেশি বেশি লাফা।”

রাজা মন দিয়েই লাফায়। নইলে প্রতি বছর স্পোর্টসে কেউ নিজের রেকর্ড ভাঙতে পারে?

অনীশের হার্ডল রেস আমরা কখনও বসে দেখতে পারি না। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াতেই হবে। গত বছর শেষ দুটো বেড়া সে যেভাবে পা তুলে টপকে গেল যে আমরা ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিলাম। এই বুঝি বেড়া ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়বে। তবে ওর একটাই দুঃখ। স্পোর্টসের হার্ডল টপকালেও পরীক্ষার হার্ডল কিছুতেই টপকাতে পারে না। এই নিয়ে এইটে তার দু’বছর হয়ে গেল। ভূগোল আর ইতিহাসের বেড়ায় সে হােঁচট খেয়েছে। ইংরেজিতে তো একেবারে মুখ তোবড়ানো অবস্থা। তবে পরীক্ষায় ফেল করলেও হার্ডল রেসের জন্য স্কুলে অনীশের খুবই খাতির। সেও একটা ‘অহঙ্কারী অহঙ্কারী’ হাবভাব নিয়ে চলাফেরা করে। আমরা অবশ্য এই হাবভাবের জন্য কিছু মনে করি না। স্পোর্টসে যে এতগুলো কাপ আর মেডেল পেয়েছে, তার তো একটু অহঙ্কার হবেই। আমরা ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য ঘুরঘুর করি।

গত দু’বছর ধরে শ্ৰীধরের নাম হয়েছে ‘ক্যাঙারু’। প্রথম প্রথম শুধু ক্লাস সেভেনের ছেলেরাই ওকে এই নামে ডাকত। এখন স্কুলের সব ছেলেরাই ‘ক্যাঙারু’, ‘ক্যাঙারু’ করে। শুধু ছেলেরা নয়, মাস্টারমশাইদের কেউ কেউ ক্লাসে ঢুকে বলেন, “ক্যাঙারু, যাও তো লাফাতে লাফাতে টিচার্স রুমে গিয়ে চট করে চক আর ডাস্টারটা নিয়ে এসো তো। আনতে ভুলে গেছি।”

নিজের নাম বদলে দিলে সবাই রেগে যায়। শ্ৰীধর কিন্তু রাগে না। বরং তার বেশ আনন্দই হয়। সুকৃত সেদিন বলল, “আর কটা দিন যাক, দেখবি স্কুলের খাতাতেও শ্ৰীধরের নাম পাল্টে গেছে। লেখা হয়েছে ক্যাঙারু মজুমদার। হিহি।”

পরে স্কুলের খাতায় কী হবে সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে শ্ৰীধরের নাম এমনি এমনি ‘ক্যাঙারু’ হয়নি। সে স্পোর্টসের বস্তা দৌড়ে প্রতিবার এক নম্বর। মেডেল বাঁধা। দৌড় শুরুর বাঁশি একবার বাজলেই হল। দুহাতে বস্তা তুলে তার লাফ তখন দেখার মতো। ক্যাঙারুর পেটে থলি থাকে। আর শ্ৰীধর হল থলির ভেতর ক্যাঙারু! আমাদের গেম টিচার অলকনন্দনবাবু ওকে দুঃখ করে বলেন, “ইস, অলিম্পিকে স্যাক রেস ইভেন্টটা নেই রে শ্ৰীধর। থাকলে একদিন ঠিক তোর চান্স হত। তুই সোনা জিতে আসতিস। আমরা তোকে সংবর্ধনা দিতাম। বস্তা দিয়ে স্টেজ সাজানো হত।”

সে কী আর করা যাবে? শুধু বস্তা দৌড় কেন, জিলিপি দৌড় আর হাঁড়ি ভাঙাও তো অলিম্পিকেও নেই। কিন্তু ক্লাস ফাইভের জয় আর ক্লাস টেনের বিক্রম এই দুই খেলায় যে কত বড় ওস্তাদ সে কথা আর বাইরের কটা লোক জানতে পারল? জিলিপি দৌড় দিয়ে যে কেউ নাম করতে পারে, এমন কথা কেউ কখনও ভাবতে পেরেছে? জয় পেরেছে। শুধু পেরেছে নয়, একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় সে যখন সবার আগে দৌড় শেষ করে তখন তার মুখে ঠিক আধখানা জিলিপির প্যাঁচ ধরা। সেই প্যাঁচ থেকে টপ টপ করে রস পড়ছে! বাকিদের অনেকে তখনও সুতো থেকে ঝোলানো সারি সারি জিলিপির সামনে নাচছে। মাঠের পাশে রাখা বক্সে চলছে বাজনা। মনে হচ্ছে, প্ৰতিযোগীরা যেন বাজনার তালে তালে নাচছে! সেই জিলিপি নাচ দেখে সকলে হাসতে হাসতে একেবারে গড়িয়ে পড়ে।

সেবার অবশ্য কেলেঙ্কারি হল। জিলিপির ইভেন্ট দেখে আমরা হাসছি, হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কান্নার আওয়াজ। চমকে উঠলাম। স্পোর্টসের মাঠে কে কাঁদে? তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি, ক্লাস সিক্সের তমাল কাঁদছে। বেচারির হাত পিছনে বাঁধা বলে চোখের জল মুছতে পারছে না। মাঠের ধারে নিয়ে গিয়ে শান্ত করার পর চোখের জল মুছে সে জানাল, সেও এই দৌড়ে ছিল। সুতো থেকে জিলিপি ছিড়ে সবার আগে দৌড় শেষও করেছে। কিন্তু এসে দেখে মুখে ধরা জিলিপি নেই! দৌড়তে দৌড়তে ভুল করে খেয়ে ফেলেছে।

এরপর না কেঁদে আর উপায় কী? অধীরের হাঁড়ি ভাঙা নিয়ে গত বছর স্পোর্টসে খুব গোলমাল হয়েছিল। ক্লাস নাইনের ছেলেরা গেম টিচারের কাছে গিয়ে আপত্তি জানাল–

‘স্যার এ কখনও হতে পারে না। অধীরের রুমালে নিশ্চয় ফুটো আছে। সেবারও অধীর চোখে রুমাল বাঁধা অবস্থায় হাঁড়ি ফাটিয়েছিল, এবারও ফাটিয়ে দিল। পরপর দু’বার একই ঘটনা কী করে ঘটে স্যার? তাও কোনওরকমে হাঁড়ির গায়ে লাঠিটা লাগালে একটা কথা ছিল। একেবারে এক চান্সেই ফটাস! আপনি স্যার ওই রুমাল পরীক্ষার ব্যবস্থা করুন।” ক্লাস টেনের ছেলেরা এ কথা শুনে রে রে করে উঠল। উঠবেই তো। অধীর তাদের ক্লাসের ছেলে। হাঁড়ি ভাঙা ইভেন্টের চ্যাম্পিয়ন। রুমালে ফুটো থাকার অভিযোগ তারা মানবে কেন? বলল—

“স্যার, ওদের কথা একদম শুনবেন না। হিংসেতে এই সব বলছে। আমরা সবাই দেখলাম, প্রতিটা রুমাল খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে চোখ বাঁধা হয়েছে। অধীর এমনি এমনি চোখ বাঁধা অবস্থায় হাঁড়ি ভাঙেনি। ও তিন সপ্তাহ ধরে প্র্যাকটিস করেছে। প্র্যাকটিসের কোনও দাম নেই?”

ক্লাস নাইনের ছেলেরা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, “হাঁড়ি ভাঙা প্র্যাকটিস করছে মানে! হাঁড়ি ভাঙা কি থ্রি হানড্রেড মিটার রেস? নাকি লং জাম্প যে প্র্যাকটিস করলে হয়। স্যার, এদের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, ঘটনার পিছনে কোনও রহস্য আছে।”

অলকনন্দনবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন,”কীরকম রহস্য বলে তোমরা মনে করছ?”

ক্লাস নাইনের ছেলেরা হইহই করে বলল, “রুমালের রহস্য স্যার। ওই রুমাল পরীক্ষা করলেই সব ধরা পড়বে।”

অলকনন্দনবাবু অধীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “রুমালটা কী রকম ছিল অধীর?”

অধীর মিটিমিটি হেসে বলল, “নতুন রুমাল স্যার। সাদার পাশে নীল বর্ডার।”

ক্লাস টেনের ছেলেরা বলল, “অধীর ঘাবড়াসনি। তুই পকেট থেকে রুমালটা বের করে দেখিয়ে দে। আমরা তোর পাশে আছি।”

অধীর এখনও মিটিমিটি হাসছে। বলল, “আমার কাছে রুমাল নেই।”

ক্লাস নাইনের ছেলেরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। বলল, “দেখলেন তো স্যার? ফুটো রুমাল চোখে বেঁধে হাঁড়ি ভেঙেছে, তারপর সেই রুমাল কোথায় সরিয়ে ফেলে এখন বলছে রুমাল নেই। স্যার অধীরের গতবারের হাঁড়ি ভাঙার মেডেলও কেড়ে নেওয়া হোক।”

এ বার ‘হো হো’ করে হেসে উঠলেন অলকনন্দনবাবু। হাসতে হাসতেই ক্লাস নাইনের ছেলেদের দিলেন জোর ধমক । বললেন, “অ্যাই চোপ। একদম চুপ করো তোমরা। আজ যারা হাঁড়ি ভাঙা ইভেন্টে অংশ নিয়েছে তাদের সবার চোখ বাঁধা হয়েছিল স্কুলের মাস্টারমশাইদের রুমাল দিয়ে। এক একজন প্রতিযোগীর জন্য এক একজন মাস্টারমশাইয়ের রুমাল। আর অধীরের রুমালটা ছিল আমার। এই দেখ।”

কথা শেষ করে অলকনন্দনবাবু পকেট থেকে একটা নীল বর্ডার দেওয়া নতুন সাদা রুমাল বের করলেন।

ক্লাস টেনের ছেলেরা চিৎকার করে উঠল, “হাঁড়ি ভাঙার হিরো অধীর হিপ হিপ হুররে…।”

তবে আমাদের স্পোর্টসের আসল হিরোর নাম বাদল। ক্লাস নাইনের রোগাভোগা, খোঁচা খোঁচা চুলের বাদল। তাকে নিয়ে আমাদের সারা বছর ধরে কৌতুহল। স্পোর্টসের দিন যত এগিয়ে আসে সেই কৌতুহল বাড়তে থাকে। ক্লাসে ক্লাসে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়। এমনকি মাস্টারমশাইরা পর্যন্ত আমাদের জিজ্ঞেস করেন, “কীরে, এ বছর বাদলের প্ল্যান কী?” বাদলের প্ল্যানের খবর আমরা বলতে পারি না। কারণ, এই সময়টা সে একেবারে তালা বন্ধ করে ফেলে। এমনি তালা নয়। ডবল তালা। তারপর যেন দুটো চাবিই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করলে গম্ভীর মুখে বলে, “এখনও কিছু ঠিক করিনি। দেখি এখনও তো সময় আছে।”

অথচ প্রতি বছর সে এমন এক একটা কাণ্ড করে যে স্পোর্টসের শেষ ইভেন্ট ‘যেমন খুশি সাজো’ সবথেকে মজার হয়ে যায়। বাদলকে কেউ হারাতে পারে না। তার সাজ দেখে চমকে উঠতে হয়। শুধু সাজপোশাকে নয়, ভাবনাতেও সে হয় এক নম্বর। একবার গুপি গাইনের বাঘা সেজে এমন ঢোল বাজাল যে মাঠে হাততালি আর থামতেই চাইছিল না। দু’বছর আগে সেজেছিল ফেলুদা। হাতে খেলনা রিভলভার নিয়ে স্কুলের পাঁচিল টপকে এল! সবথেকে মজা হয়েছিল যেবার হেডস্যারের সাজে ধুতি-পাঞ্জাবি আর কালো পাম্পসু পরে মস মস আওয়াজ তুলে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরপাক খেল। হাসিতে আমাদের পেট ফেটে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু হাসতে পারছি না। হাসব কী করে? একটু দূরেই চাঁদোয়ার নিচে খোদ হেডস্যার নিজে বসে আছেন। শুধু বসে আছেন না, তিনি তো বিচারকদের একজন। আমাদের মনে হল, বাদলের কপালে দুঃখ আছে। আশ্চর্যের বিষয়, সেবার হেডস্যার বাদলকে সবথেকে বেশি নম্বর দিয়েছিলেন!

তবে এবারের ঘটনা আগের সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেল।

আমি, তন্ময়, অৰ্চি আর ঋজু ঠিক করলাম, এ বছর বাদল কী সাজবে আগে থেকে জানতেই হবে। যে করেই হোক জানতে হবে। তন্ময় বলল, “দাঁড়া, আগে খোঁজ নিয়ে দেখি বাদল কী খেতে ভালবাসে।”

অৰ্চি অবাক হয়ে বলল, “খাওয়ার সঙ্গে সাজের কী সম্পর্ক?”

তন্ময় মুচকি হেসে বলল, “আরে বাবা, আছে। ফেবারিট জিনিস খাবার সময় সকলের মনই একটু দুর্বল হয়। বাদলেরও হবে। আর তখনই গল্প করতে করতে ওর সাজের পরিকল্পনা জেনে নেব।”

সত্যি সত্যি তন্ময় খোঁজ নিয়ে এসে জানাল, বাদলের দারুণ ফেবারিট হল এগ রোল। তন্ময় বলল, “দে, সবাই চাঁদা দে। বেশি করে দিস। দুটো রোলের দাম লাগবে। এর নাম হল এগ রোল অপারেশন।”

ঋজু বলল, “এগ রোল অপারেশনে দুটো রোল লাগবে কেন? বাদলকে কি তুই রোল খাওয়াবি।”

তন্ময় রেগে গিয়ে বলল, “বোকার মতো কথা বলিস না ঋজু। বাদল দুটো খাবে কেন? আমাকে একটা খেতে হবে না? দুজনে রোল খেতে খেতে গল্প করব। নইলে ও সন্দেহ করে সতর্ক হয়ে যাবে।”

দুটো রোলের চাঁদা তোলা হল এবং শনিবার স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে তন্ময় সত্যি সত্যি বাদলকে রোল কিনে দিল। মন দিয়ে খাওয়া শেষ করে বাদল বলল, “খুব ঝাল লেগেছে রে, উপস। মনে হচ্ছে লঙ্কায় কামড় দিয়েছি, উপস। একটা আইসক্রিম খাওয়া রে, উপস।”

তন্ময়ের খুব রাগ হল। কিন্তু কিছু করার নেই। আইসক্রিম না দিলে বাদল রেগে চলে যাবে। কিছুই বলবে না। তখন এগ রোলের টাকাটাও জলে যাবে। বাধ্য হয়ে নিজের পকেট থেকেই টাকা বের করে আইসক্রিম কিনল। তন্ময়। সস্তার আইসক্রিম নয়, একেবারে দামি চকোবার। বাদল আইসক্রিমে আলতো কামড় দিয়ে বলল, “নে এবার বল।”

তন্ময় ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কী বলব?”

বাদল অবাক হয়ে বলল, “বাঃ, বলবি না? কেন এগ রোল খাওয়ালি সেটা বল।”

তন্ময় লজ্জা পেয়ে বলল, “বাঃ, বন্ধুকে একটা রোল খাওয়াতে পারি না?”

বাদল নির্লিপ্ত মুখে বলল, “পারবি না কেন? তবে স্পোর্টস এসে গেছে তো, তাই সন্দেহ সন্দেহ হচ্ছে।”

তন্ময় দেখল বাদল ধরে ফেলেছে। আর ধরেই যখন ফেলেছে। তখন সরাসরি কথাটা বলে ফেলাই বুদ্ধিমানের। সে আমতা আমতা করে বলল, “আসলে কী জানিস, ‘যেমন খুশি সাজো’তে তুই যা করিস না..একেবারে ফাটাফাটি। হ্যাঁরে বাদল, এবার কী সাজবি? ভেবেছিস কিছু?”

বাদল আইসক্রিমের তলায় একটা হাত রেখে বলল, “দেখ, তন্ময়, সাজের কথা আমি আগাম বলি না। কিন্তু এবার তুই এগ রোল খাইয়ে আমার মনটা দুর্বল করে দিয়েছিস। শুধু এগ রোল নয়, সঙ্গে আবার আইসক্রিমও। তোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করাটা ঠিক হবে না। তাই ভাবছি, তোকে বলেই ফেলব।”

তন্ময় রাস্তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়ল। বাদলের হাত ধরে বলল, “বলবি, বল তাহলে।”

বাদল আইসক্রিম শেষ করে কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলল। তারপর সে বলল, “ভূত। এবার আমি ভূত সাজছি। যা, এবার বাড়ি যা।”

পরের দিন তন্ময় স্কুলে এল মুখ কালো করে। আমরা ঘিরে ধরলাম। আমরা বললাম, “কীরে, তোর এগ রোল অপারেশন কী হল? কিছু জানতে পারলি?”

তন্ময় মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “অপারেশন ফেল করেছে। বাদল কিছুই বলল না। উল্টে এগ রোলের সঙ্গে একটা আইসক্রিমও খেল। শেষে রসিকতা করে চলে গেল।”

ঋজু বলল, “রসিকতা! কী রসিকতা?” তন্ময় গজগজ করতে করতে বলল, “কী আবার বলবে? বলল, এবার নাকি ও ভূত সাজছে!”

আমরা হাল ছেড়ে দিলাম। না, এবারও জানা হল না।

স্পোর্টসের দিন ‘যেমন খুশি সাজো’ ইভেন্ট শুরু হতে সবাই নড়েচড়ে বসল। এক এক করে প্রতিযোগীদের নাম ডাকা হচ্ছে। হাততালি, হাসি আর চিৎকারের মধ্যে দিয়ে তারা মাঠে ঢুকছে। কেউ সেজেছে বাউল। কারও সাজ প্রফেসর শঙ্কুর মতো। কেউ আবার কোট-প্যান্ট আর টাই পরে হাতে বাবার ল্যাপটপ নিয়ে এসেছে! ক্লাস টেনের অনির্বাণ মাথায় গামছা বেঁধে ফুচকাওলা হয়েছে। ফুচকা ভর্তি একটা ঝুড়িও সঙ্গে এনেছে! তিনজন সেজেছে হ্যারি পটার। গোল গোল চশমা। এলোমেলো চুল। তিন সাইজের হ্যারি পটার দেখে সবাই হইহই করে উঠল। কিন্তু বাদল কোথায়? প্রথমে দু-একজনের মধ্যে ফিসফাস শুরু হল। সেই ফিসফাস খুব দ্রুত গোটা মাঠে ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি মাস্টারমশাইরা পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমাদের ডেকে মুকুন্দবাবু বললেন, “কী হল রে? তোদের বাদল কোথায়? এতবার নাম ডাকা হল…।”

অৰ্চি কাঁচুমাচু গলায় বলল, “বুঝতে পারছি না স্যার। খানিকক্ষণ আগেই দেখলাম মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।” আমি বললাম, “কোথায় চললি? বলল, সাজতে যাচ্ছি।”

মুকুন্দবাবু বললেন, “তা হলে তো ব্যাপারটা সিরিয়াস মনে হচ্ছে। হঠাৎ কিছু হয়ে গেল নাকি? একবার খোঁজ নিতে হয়। তোরা কেউ চট করে বাড়ি থেকে ঘুরে আয়।”

তন্ময় একটা সাইকেল জোগাড় করে রওনা দিল। বাদলের বাড়ি দূরে নয়। সাইকেলে যেতে-আসতে মিনিট পনেরো। তন্ময় ফিরে এল তেরো মিনিটের মাথায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “না, বাড়িতেও নেই।”

মুকুন্দস্যার গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, “স্পোর্টস শেষ হয়ে গেল। কিছু একটা করতে হবে। সেরকম হলে থানায় খবর দেব। আমি হেডস্যারকে জানাচ্ছি। তোরা এখন চুপচাপ থাক।”

আমরা চুপচাপ থাকলাম। কিন্তু তাতে লাভ হল না। খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। বাদল ভ্যানিস! এর সঙ্গে আবার নানারকম গল্পও জুড়ল। কেউ বলছে, অপহরণ। কেউ বলছে, মনে হয় ডাকাত সেজে আসছিল। সত্যি ডাকাত ভেবে রাস্তাতেই পুলিস অ্যারেস্ট করেছে।

স্পোর্টস শেষ হলে চাপা টেনশনের মধ্যেই শুরু হল পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। ‘যেমন খুশি সাজো’ ইভেন্টের পুরস্কারের সময় হেডস্যার উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “প্রতিবার যে ছেলেটি এতে প্রথম হয় সেই বাদল এবার আসেনি। অথচ আমরা জানতে পেরেছি সে ‘আসছি’ বলে খানিক আগে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, তার কোনও সমস্যা হয়েছে। স্পোর্টস শেষ হয়ে গেলেই আমরা তার খোঁজখবর শুরু করব। যাই হোক, এবার ‘যেমন খুশি সাজো’-তে ফার্স্ট হয়েছে… ”

ঠিক এমন সময় বাদলের গলা! “এই তো আমি স্যার। এই তো আমি এসে গেছি।” সবাই চমকে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, মাঠের একপাশ থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে সে! কোনও সাজগোজ নেই। একেবারে সাদামাঠা স্কুলের পোশাক। এমনকি পায়ে কালো বুটটা পর্যন্ত রয়েছে!

ছেলেদের ভিড় ঠেলে চাঁদোয়ার তলায় এসে দাঁড়াল বাদল। সে একই সঙ্গে হাঁপাচ্ছে এবং হাসছে!

মুকুন্দবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, “কোথায় ছিলি তুই? অ্যা, ছিলি কোথায়?

বাদল হাসিমুখে বলল, “স্কুলে ঢুকে ফাঁকা ক্লাসরুমে লুকিয়ে বসে ছিলাম।”

মুকুন্দবাবু ধমকে উঠলেন, “ফাঁকা ক্লাসরুমে লুকিয়ে ছিলি মানে! রসিকতা হচ্ছে? কান টেনে ছিঁড়ে দেব। এতবার নাম ডাকা হল, শুনতে পাসনি?”

বাদল কাঁচুমাচু মুখে বলল, “হ্যাঁ শুনতে পাব না কেন স্যার? খুব শুনতে পেয়েছি।”

এবার হেডস্যার কটমট করে তাকিয়ে বললেন, “শুনতে পেয়েছ তো আসনি কেন?”

বাদল মাথা নামিয়ে বলল, “কী করে আসব স্যার? এবার যে আমি ভূত সেজেছি। ভূত কি দেখা যায়? ভূত তো অদৃশ্য। সেই জন্যই তো লুকিয়ে ছিলাম।”

“যেমন খুশি সাজো’ এখন খেলাধুলোর মধ্যে পড়ে না, কিন্তু তখন পড়ত। খুব বেশি মাত্রাতেই পড়ত। আর সেবারও এই খেলায় প্রথম হল ক্লাস নাইনের বাদল।

Leave a Reply