আমাদের ক্লাসের মনোজের মামার একটা অদ্ভুত নেশা আছে। এমন নেশার কথা কেউ কখনও শোনেনি। নেশাটা হল, লোককে বেজায় খাওয়ানো। দিনে অন্তত একজনকে মনের মত খাওয়াতে না পারলে ওঁর রাতে ঘুম হয় না। বিছানায় শুয়ে ছটফট করেন। সারারাত ছাদে পায়চারি করতে হয়। ভোররাতে মাথায় জল ঢালতে হয়। সে এক বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটে।
আর খাওয়ানো মানে, যেরকম সেরকম ভাবে নাম নাম করে খাওয়ানো নয় মোটেই। রীতিমত খাওয়ানো। গলা পর্যন্ত খাওয়ানো, জোর করে খাওয়ানো, দম বন্ধ করে খাওয়ানো। মোট কথা হল, খাওয়াতে খাওয়াতে যতক্ষণ না মামার তৃপ্তি হচ্ছে, যতক্ষণ না মনে হচ্ছে যে যাকে তিনি খাওয়াচ্ছেন, তার খাওয়ার মত খাওয়া হচ্ছে ততক্ষণ তিনি থামতে চান না মোটেও।
খাওয়াতে অনেকেই ভালবাসে। আমার কাঁকুড়গাছির মাসি, প্ৰণবের উল্টোডাঙার কাকা, দেবুর বারুইপুরের পিসিও কি কম কিছু খাওয়াতে ভালবাসে? মোটেই না। আমাদের একবার হাতে পেলেই হল। পেট পুরে খাইয়ে তবে ছাড়বে। এদের কাছে খাওয়ার পর মনটা কেমন ফুরফুর করে। মনে হয়, আহা দিনটা কত ভাল। কিন্তু মনোজের মামার খাওয়ানো তো একপেশে খাওয়ানো! আর সে কথাটা বেশ ভালভাবেই জানাজানি হয়ে গেছে। খেতে কে না ভালবাসে? ভালমন্দ খাবার দাবার পেলে কার না ভাল লাগে? আর যদি কেউ নিজে থেকে ডেকে, আদর যত্ন করে খাওয়ায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু মনোজের মামার এই ঠেসেঠুসে, পারলে গলায় বাঁশ ঢুকিয়ে, চেপেচুপে খাওয়ানোকে সবাই ভয় পায়।
আর ভয় পাবেই না বা কেন? একবার মনোজকেই তো উনি পঁয়তাল্লিশটা রসগোল্লা খাইয়ে প্রায় মেরে ফেলেছিলেন আর কী! সেবার মনোজের কোন দূর সম্পর্কের দাদাকে এক হাঁড়ি রাবড়ি খাইয়ে দিয়েছিলেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। মামার নজরে একবার পড়ে গেলেই হল। না খেয়ে পালাবার কোনও পথ নেই। ষণ্ডামার্কা ছটা দারোয়ান মামার হুকুম ছাড়া দরজা খুলবে না মোটেও। সুতরাং নিজের ইচ্ছেমত খেয়ে নিয়ে যে কেউ চম্পট দেবে সে গুড়ে বালি!
প্রথম প্রথম যখন মামার এই ভয়ঙ্কর নেশার কথা তেমন করে ছড়ায়নি, তখন অনেকেই ভাল ভাল খাওয়ার লোভে ওখানে যেত। এখন আর তা হয় না। বেশিরভাগ লোকই জানে, মনোজের মামার বাড়ির খাওয়া মানে ফাঁসির খাওয়া। খেতে বসে যতই কেউ বলুক, ঠিক আছে মামা, আর নয়। পেট একেবারে আইঢাই হয়ে গেছে। ততই মামা বলবেন, দূর! এ আবার খাওয়া নাকি? মামার বাড়ির খাওয়া কী একে বলে? এ তো সবে শুরু।
আজকাল তাই মামার খাওয়ার লোক পেতে ভারি মুশকিল। হচ্ছে। বড় বড় খাইয়েরাও ওঁর বাড়ির ধারে কাছে যাচ্ছে না।
একদিন মনোজ স্কুলে এল। কাঁচুমাচু মুখে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল?”
মনোজ বলল, “মামী গতকাল আমাদের বাড়িতে এসে খুব কান্নাকাটি করছেন। মামার এই নেশা যেমন করে হোক কাটাতে হবে। মামার সর্বনেশে খাওয়ানোর দুর্নাম এত হয়েছে যে ফেরিওয়ালারা পর্যন্ত মামার বাড়ি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর মামার জমানো টাকাও সব ফতুর হয়ে যেতে বসেছে। তোরা কোনও একটা উপায় কর ভাই। নাহলে আর রক্ষে নেই।” এই কথা বলে মনোজ আমাদের হাত জড়িয়ে ধরল।
আমরা ভাবতে বসলাম। টিফিন টাইমে খুব আলোচনা হল। এক একজন এক-একটা প্ল্যান দিতে থাকল। একজন বলল, মামী যদি সিন্দুকের চাবি লুকিয়ে রাখেন? একজন বলল, আমরা যদি মিষ্টির দোকানগুলোকে বলে দিই মামাকে মিষ্টি বিক্রি না করতে। একজন বলল, মামাকে যদি একদিন জোর করে একশোটা রাজভোগ খাইয়ে দিই। এমন সময় আমাদের মধ্যে সবথেকে চালাক মানস বলল, “না, এভাবে হবে না। মামার নেশা কাটাতে হবে অন্যভাবে। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। তবে তার জন্য মামীমাকে কয়েকদিন মনোজের বাড়ি এসে থাকতে হবে।”
মনোজ বলল, “সে আর এমন কী? কাল থেকেই হবে।”
মানস তখন মনোজকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তোর মামা রাতের খাবার কখন খেয়ে নেন?”
মনোজ বলল, “লোককে ওরকম খাওয়ালে কী হবে, মামা নিজে তো সামান্য খান। উনি ঠিক রাত দশটায় খেতে বসেন।”
মানস বলল, “ঠিক আছে। এখানে রাত দশটার আগেই দোকান বাজার সব বন্ধ হয়ে যায়।” সুতরাং মামা যে তখন দোকান থেকে খাবার কিনবে তারও উপায় নেই। তাই তো? কিছুই বুঝতে পারলাম না। মানস বলল, “দেখ না মজা। মামার খাওয়ানোর নেশা কেমন দৌড়ে পালায়। আমি যা বলব, তাই তোদের করতে হবে।”
পরদিন ঠিক রাত দশটার সময় আমরা পাঁচজন ছেলে মনোজের মামার বাড়ি হাজির হলাম। দরজা খুলে মামা আমাদের দেখে তো অবাক। মানস বলল, “মামা, অনেকদিন আপনার বাড়িতে আসা হয়নি। তাই এলাম। বড় খিদেও পেয়েছিল। যদি-”
খাওয়ার কথা শুনে প্রথমে মামার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
পরের মুহূর্তেই কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, “কিন্তু এত রাতে তোদের কী খাওয়াব? ইস, তোরা যদি একটু খবর দিয়ে আসতিস। আমার যে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে।”
আমরা বললাম, “কোনও চিন্তা নেই মামা। আপনার বাড়িতে এখন যা আছে, তাই খাব। মামা বললেন, “এখন রুটি, এক বাটি আলু-কুমড়োর তরকারি আছে।”
আমরা সমস্বরে বললাম, “ওতেই হবে।” এরপর আমরা পাঁচজন একটুও দেরি না করে রান্নাঘরে ঢুকে মামার রাতের খাবারটা নিমেষে সাবাড় করে দিলাম। বিস্কুটের কৌটো, চানাচুরের শিশি ফাঁকা করে ফেললাম। তারপর ভালমানুষের মত বাড়ি চলে এলাম। মামা ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পরদিন আবার একই ঘটনা। মামা তো তখন রাতের খাবার খেতে শুরু করে ফেলেছিলেন আর কী! তারপরের দিনও এক কাজ। তারপরের দিনও, তারপরের দিনও। এরকম টানা সাতদিন আমরা বলতে গেলে লুটেপুটে মামার রাতের খাবার খেয়ে এলাম।
আটদিনের দিনও যখন পাঁচজনে মিলে মামার বাড়ির সামনে হাজির হলাম, আমরা দেখলাম দরজায় ইয়া বড় একটা তালা ঝুলছে।
জুলজুল করে বসে থাকা দারোয়ান দুটো বলল,”বাবু মনোজদার বাড়ি চলে গেছেন।”
আমরা লাফিয়ে উঠলাম, “হুররে!”
সাতরাত উপবাসে কাটিয়ে মামার নেশা ছুটে গেল। খেতে না পাওয়ার কষ্ট থেকে তিনি বুঝলেন, বেশি খাওয়ালে কষ্ট কত হয়।