‘তোমরা সবাই’ ক্লাবঘরে আজ সকাল থেকে ভিড়।

বেলা যত বাড়ছে ভিড়ও তত বাড়ছে। দশটা নাগাদ বাইরে লম্বা লাইন পড়ে গেল। সেই লাইনে যেমন বড়োরা আছে, তেমন হাফপ্যান্ট, ফ্রক পরা ছোটোরাও আছে। তাদের সংখ্যাই বেশি। ক্লাবের পক্ষ থেকে খানিক আগে সেইসব ছোটো ছেলেমেয়েদের হাতে দুটো করে বিস্কুট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সময় যদি বেশি লাগে তা হলে আবার বিস্কুট আসবে। ছোটোরা চাইছে, সময় বেশি লাগুক এবং আবার বিস্কুট আসুক।

ভিড়ের কারণ যারা জানে না তারা অবাক হয়ে ভাবছে, ব্যাপারটা কী? এত মানুষ কেন? ‘তোমরা সবাই’ ক্লাব তো আর কোনও স্কুল নয় যে ছেলেমেয়ে ভর্তি নেবে, বাচ্চারা সেখানে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। তবে? ভেতরে কোনও প্রদর্শনী হচ্ছে না তো? তাক লাগানো ছবি বা কথা-বলা পুতুলের প্রদর্শনী? হতে পারে। একবার কারা যেন বাঘের ছবি, পোস্টার নিয়ে প্রদর্শনী করেছিল। তখনও খুব ভিড় হয়েছিল। ঘরের ভিতর ঢুকলেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডাক! ছবি, পোস্টার দেখার জন্য যত না ভিড় হয়েছিল, বাঘের ডাক শোনার জন্য ভিড় হয়েছিল তার থেকে অনেক বেশি। এবারও সেরকম কিছু হচ্ছে নাকি? হতে পারে। কিন্তু তা বলে এই সাতসকালে প্ৰদৰ্শনী! আচ্ছা, টিকা বা রক্ত পরীক্ষার ব্যাপার নেই তো? আজকাল ক্লাবগুলোতে নানা ধরনের স্বাস্থ্যশিবিরের আয়োজন হয়। আগের দিন রিকশাতে মাইক লাগিয়ে ক্লাবের ছেলেরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘোষণা করে যায়। সেইরকম কিছু?

যারা ভিড়ের কারণ জানে তারা অবশ্য অবাক হচ্ছে না। বছরের একটা দিন ‘তোমরা সবাই’ ক্লাবের সামনে এই কাণ্ড হয়। এবার থেকে ছোটোরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। যারা পারে বাবা-মাকে নিয়ে আসে, যারা পারে না একাই চলে আসে। তবে এবারের ঝাঁপানোটা বেশি। তারও কারণ আছে।

আজ ‘তোমরা সবাই’ ক্লাবে স্পোর্টসের জন্য নাম লেখানোর দিন। সামনের রবিবার এই এলাকার সব থেকে বড়ো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হবে। স্কুল মাঠে সারাদিন তুমুল হইচই। এলাহি ব্যাপার। কত রকমের যে প্রতিযোগিতা হবে তার ইয়ত্তা নেই। শুধু দৌড়ই আছে সাত রকমের। একশো মিটার, দুশো মিটার, চারশো মিটার ছাড়াও হবে রিলে দৌড়, বস্তা দৌড়, চামচ দৌড়, ক্যাঙ্গারু দৌড়, অঙ্ক দৌড়। আছে লাফালাফি। হাই জাম্প, লং জাম্প, ফ্রগ জাম্প, জিলিপি জাম্প। তা ছাড়া বল ছোড়া, হাঁড়ি ভাঙা, যেমন খুশি সাজো তো আছেই। সকালবেলা শুরু করে শেষ হতে সন্ধে গড়িয়ে যায়। সব থেকে বড়ো কথা হল, প্ৰাইজগুলো সব লোভনীয়। ‘তোমরা সবাই’ ক্লাব স্পোর্টসের সময় দামি প্রাইজ দিয়ে এলাকায় বিরাট নাম করেছে। প্ৰাইজের ব্যাপারে কেউ তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারে না। এ বছর তো আরও পারবে না। কারণ, এবার খুব বড়ো একটা কম্পিউটার কোম্পানিকে ধরা হয়েছিল। ক্লাবের প্রেসিডেন্ট নিজে এ ব্যাপারে খাটাখাটনি করেছেন। দিনের পর দিন কম্পিউটার কোম্পানির অফিসে গেছেন। ওরা প্ৰথমে রাজি হচ্ছিল না, পরে রাজি হয়েছে। বলেছে সবকটা ফার্স্ট প্রাইজ তারাই দেবে একটা করে কম্পিউটার।

কাল সন্ধেবোলা এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে। সেই কারণেই এবার ভিড় বেশি।

ঘরের ভেতরে ক্লাবের সবাই আছে। পটল, গুঞ্জন, বিধানদা, অশোক, ঋদ্ধি মাইতি, সন্তোষদা, আনিসুর। এমনকি ক্লাব প্রেসিডেন্ট পরিতোষবাবুও এসেছেন। চেয়ার টেনে বসে নজর রাখছেন। মোট ছটা টেবিলে নাম লেখার কাজ চলছে। বিধানের টেবিলে ঝগড়া হচ্ছে। বাবা-মায়েরা চাইছে, তাদের ছেলেমেয়েরা সব ইভেন্টেই নাম দিক। একটা যদি লেগে যায়। কম্পিউটার পাওয়া চাট্টিখানি কথা। বিধান তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে। যে ছেলে দৌড়ে ভালো সে ছেলে হাঁড়ি ভাঙাতে যে ভালো করবে তার কী মানে আছে? অথবা যে মেয়ে জিলিপি রেসে অংশ নিচ্ছে, তার বস্তা দৌড়ে ঢুকে লাভ কী? বড়োরা শুনছে না।

যেমন মালিনীদেবী। তিনি ঝগড়া শুরু করেছেন।

“আপনি জানেন, আমার ছেলে হাঁড়ি ভাঙায় “কত বড়ো চৌখস? জানেন আপনি!”

বিধান অবাক হয়ে বলল, “হাঁড়ি ভাঙায় আবার চৌখস হওয়ার কী আছে! আন্দাজ মিললে জিতবে, নইলে হবে না।”

মালিনীদেবী বললেন, “কে বলেছে আন্দাজ? হাঁড়ি ভাঙার জন্য বিল্টু কতদিন বাড়িতে প্র্যাকটিশ করছে আপনি খবর রাখেন?”

বিধানের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। “হাঁড়ি ভাঙার জন্য প্র্যাকটিস! বাড়িতে কী সে হাঁড়ি ভাঙছে?”

“বাড়িতে হাঁড়ি ভাঙবে কেন? চোখ বেঁধে হাঁটাহাঁটি করছে।”

বিধান আর্তনাদ করে উঠল, “সর্বনাশ! বলেন কী! চোখ বেঁধে হাঁটাহাঁটি তো ভয়ংকর। টেবিল, চেয়ারে ধাক্কা খাবে।”

“খেলে খাবে। জিততে গেলে অমন একটু-আধটু ধাক্কা খেতেই হয়। আমরা ফ্ল্যাটের একটা ঘর ছেলের প্র্যাকটিসের জন্য ফাঁকা করে দিয়েছি। নিন, আপনি বিল্টুর নাম লিখুন।”

ঝগড়া শুনে পরিতোষবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছেন। তিনি মুচকি হেসে বললেন, “বিধান, তুমি নামটা লিখে নাও। উনি যখন এত করে বলছেন।”

বিরক্ত বিধান গজগজ করতে করতে হাঁড়ি ভাঙার খাতা খুলে বলল, “নিন, নাম ঠিকানা বলুন।”

বিধানের রাগটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। খানিক আগে অধ্যাপক সৃঞ্জয় দেবনাথও একই কাজ করে গেছেন। তিনি তার সাত বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। ফুটফুটে সেই মেয়ের নাম রঞ্জাবতী। রঞ্জাবতী কিছুতেই অঙ্ক দৌড়ে নাম দেবে না। সে কাঁদো কঁদো গলায় বলল, “বাবা, আমি শুধু জিলিপি রেসে যাব। আমি অঙ্ক পারি না।”

সঞ্জয়বাবু সবার সামনেই মেয়েকে ধমক দিলেন, “চুপ কর। তোর মা যদি শোনে অঙ্কতে নাম দিসনি তোর পিঠ ভেঙে দেবে।”

ছোটোরা যারা একা এসেছে তাদের নিয়ে সমস্যা নেই। তারা নিজের পছন্দমতো প্ৰতিযোগিতাতেই নাম লেখাচ্ছে।

গুঞ্জন কাজ করছিল মাথা নামিয়ে। সে ‘তোমরা সবাই’ ক্লাবের ক্যাশিয়ার। চমৎকার ছেলে। তার কাজকর্মও খুবই গোছানো। আজও খাতায় পরপর লাইন টেনে নিয়েছে। প্রথমে প্রতিযোগিতার বিষয়, তারপর নাম, ঠিকানা, বয়স। সে বলে রেখেছে, “আমি বাবা-মায়েদের সামলাতে পারব না। যে সব ছেলেমেয়ে একা এসেছে, তাদের এই টেবিলে পাঠিয়ে দাও। আমি নাম লিখে নিচ্ছি।”

খাতার ওপর ছায়া দেখেই গুঞ্জন বুঝতে পারল, সামনে একটা ছোটো ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে।

মুখ না তুলেই গুঞ্জন বলল, “কীসে নাম দিবি?”

“লাফ।”

“কোন লাফ।”

“লম্বা লাফ।”

“লম্বা লাফ!”

লঙ জাম্পকে যে বাংলায় লম্বা লাফ বলা যেতে পারে এমনটা জানা ছিল না গুঞ্জনের। সে মুখ তুলল। তুলে অবাক হল। এগারো-বারো বছরের যে ছেলেটি টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার সাজপোশাকের অবস্থা একটু খারাপ বললে কম বলা হবে। খুবই খারাপ। এই শীতে গায়ে সোয়েটার নেই। রঙ-চটা জামার কলার ফাটা। নীচের দিকে দুটো বোতাম উধাও। ডান কাঁধের পাশটা ছেঁড়া। টেবিলের কারণে হাফ প্যান্টটা পুরো দেখা যাচ্ছে না, তবে কোমরের কাছে বেল্টের বদলে যে দড়ি বাঁধা সেটা বোঝা যাচ্ছে। মাথা ভর্তি এলোমেলো চুলে জট পাকিয়ে আছে। এই সকলেও গায়ে ধুলো-বালি। সুন্দর বলতে শুধু টানা টানা চোখদুটো আর মুখের হাসিটুকু। ঠোঁটের ফাঁকে বিস্কুটের গুড়ো লেগে থাকায় সেই হাসি আরও ঝলমল করছে।

গুঞ্জন ধাঁধায় পড়ল। ছেলেটা কে? যে-ই হোক ‘তোমরা সবাই’ ক্লাবের বার্ষিক ক্রীড়া প্ৰতিযোগিতায় যারা নাম দেয় তাদের সঙ্গে এই ছেলে মোটেই খাপ খায় না। এই এলাকায় সব ধোপদূরস্ত মানুষের বসবাস। সবাই যে বিরাট বড়োলোক এমন নয়, তবে একেবারে ফালতু নয়। ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েরা কেউ স্কুল কলেজের মাস্টারমশাই, কেউ সরকারি চাকুরে। বড়ো অফিসার, ইঞ্জিনিয়ারও আছে। দুজন নাম করা লেখক, একজন চিত্রকরও এখানে থাকেন। ক্লাবের নানা অনুষ্ঠানে তারা বিশেষ অতিথি হন। এই ছেলে কোথা থেকে এল! শুধু এলও না, একে ক্লাবের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কীভাবে নেওয়া যাবে?

“নাম কী তোর?”

টানা টানা চোখের ছলে তার হাসি চওড়া করে বলল, ‘ঘুলঘুলি।’

বলে কী ছেলেটা! ঠাট্টা করছে নাকি? গুঞ্জন ভুরু কুঁচকে বলল, “কী নাম বললি?”

“ঘুলঘুলি। মায়ে বলেছে, আমি যে ঘরে জন্মেছি, সেখানে নাকি জানলা-টানলা কিছু ছিল না। শুধু একটা ঘুলঘুলি ছিল। সেই জন্য আমার নাম ঘুলঘুলি। হিহি।”

কথা শেষ করে ছেলেটা এমন বুক টান করে দাঁড়াল যেন নামের ব্যাখ্যা করতে পেরে খুবই খুশি! গুঞ্জনের মজা লাগল, আবার চিন্তাতেও পড়ল। ঘুলঘুলি নামের কোনও বালককে কি ক্লাবের স্পোর্টসে নামানো উচিত হবে? ‘তোমরা সবাই’ ক্লাবের একটা মানমর্যাদা বলে ব্যাপার আছে। মাইকে কী ঘোষণা করা হবে?

“শ্রীমান ঘুলঘুলি তুমি যেখানেই থাক মাঠের ভেতর চলে এসো, তোমার ইভেন্ট এখনই শুরু হবে।”

মাঠ জুড়ে তো হাসির তুফান উঠবে। তার ওপর এই ছেলের পোশাকের অবস্থা শোচনীয়অ এর নাম লেখাটা কি ঠিক হবে?

গুঞ্জন বলল, “ঘুলঘুলি, তুই থাকিস কোথায়?”

ছেলেটা হাত তুলে বলল, “উই যে ব্রিজ হচ্ছে, ওর নীচে।”

গুঞ্জনের দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল। ঠিকই আন্দাজ করেছে সে। একেবারেই রাস্তার ছেলে।

“বাবা-মা’র সঙ্গে থাকিস?”

“বাবা থাকে না, মায়ে থাকে।”

গুঞ্জন পথ খুঁজছে। যা কিছু করতে হবে ভেবেচিন্তে করতে হবে।

“মা কী করে তোর?”

“তিন মাস হল এয়েচি। এর আগে ছিলাম ডানকুনি। ডানকুনিতে তখন রাস্তায় পিচ হচ্ছিল।”

“রাস্তায় পিচ হচ্ছিল তো তোর কী?”

ঘুলঘুলি ফিক করে হাসল।

“ওমা! আমার কী মানে! মায়ে রাস্তা তৈরির সময় পিচ ঢালে না? সারাদিন আগুন আগুন পিচ ঢালে আর আমি লম্বা লম্বা লাফ মেরে পার হই। হিহি। একটু ভুল হলেই! ঝপাস-একেবারে আগুনের মধ্যি পড়বে। আমি পড়ি না। হিহি। সেই কারণেই তো তোমাদের লম্বা লাফে নাম দিব।”

গুঞ্জন এবার নড়েচড়ে বসল। ভয়ংকর! এই ছেলে বলে কী! আগুন গরম পিচ টপকাতে টপকাতে লঙ জাম্পে এক্সপার্ট হয়ে গেছে। কেমন এক্সপার্ট? কতটা লাফাতে পারে? ছেলেটাকে একবার চান্স দিলে কেমন হয়? ঝকঝকেদের মাঝখানে একটা ভিখিরি ধরনের ছেলে ঢুকে পড়লে কে বুঝতে পারবে? কেউ পারবে না। খেলার মাঠে ধুলোকাদা তো সবার গায়েই থাকবে। একটা নতুন প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি দরকার। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সে নিজে যখন ক্যাশিয়ার, ক্লাবের ফাণ্ড থেকে ওই কটা টাকা বের করে নেওয়া কোনও ব্যাপারই নয়। সব মিলিয়ে ঘটনাটা কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং হত। তবে এত বড়ো ঝুঁকি নিজে নেওয়া যাবে না। কথা বলে নিতে হবে। ক্লাব তার একার নয়। ক্লাবের মানমর্যাদাও তার একার নয়। তবে এইটুকু সে এক-একাই বুঝতে পারছে, এই ছেলেকে নেওয়া উচিত। গরম পিচ টপকে যে ছেলে লাফাতে শেখে সে চাট্টিখানি ছেলে নয়।

গুঞ্জন হেসে বলল, “একটু দাঁড়া ঘুলঘুলি। ভেবেছিলাম ছোটোদের নাম লেখায় ঝামেলা হবে না। কিন্তু তুই আমাকে ঝামেলায় ফেললি।”

এরপর গুঞ্জন ক্লাব প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে ঘটনা জানাল। মুচকি হেসে গলা নামিয়ে বলল, “কী করব দাদা? নিয়ে নেব? থাকুক না, অসুবিধে কী?”

পরিতোষবাবু চমকে উঠলেন। চোখ কপালে তুলে বলল “খেপেছ নাকি? ক্লাবের একটা প্রেস্টিজ আছে-না? রাস্তার ছেলেরাও ‘তোমরা সবাই ক্লাবের স্পোর্টসে যোগ দিচ্ছে শুনলে কী হবে বুঝতে পারছ না? ভদ্রলোকের ছেলেরা সব থাকবে. তার ওপর অত বড় একটা কম্পিউটার কোম্পানি এবার আমাদের প্রাইজ স্পনসর করছে। তারা কী মনে করবে? ওরা আর কোনওদিন আমাদের কোনও অনুষ্ঠানে টাকা দেবে ভেবেছ?”

গুঞ্জন অবাক হয়ে বলল, “কেন? দেবে না কেন? প্ৰাইজের সঙ্গে ভদ্রলোক, গরিবলোকের কী আছে? যে জিতবে সে-ই পাবে।”

পরিতোষবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, “আঃ আস্তে বলো, গুঞ্জন। সবাই শুনতে পাবে। তোমার ওই ঘুলঘুলি না দরজার খিল যদি ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে যায়?”

গুঞ্জন হেসে ফেলল। বলল, “পেলে পাবে।”

প্রেসিডেন্ট ধুতির কোঁচা ঠিক করতে করতে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “পাবে! তারপর? তারপর কী হবে? কম্পিউটার কোম্পানির মালিক ওর হাতে একটা লাল ফিতে বাঁধা বাক্স তুলে দেবে? বলবে, যাও বাছা, ওটা ব্রিজের তলায় রেখে এস? অসম্ভব। ইমপসিবল।”

গুঞ্জন এবার মনে মনে রেগে গেল। এ কেমন যুক্তি!

“আর একবার ভেবে দেখুন দাদা। একটা ছোটো ছেলেকে ছেঁড়া জামার জন্য স্পোর্টস থেকে বাদ দিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হবে?”

পরিতোষবাবু স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, “দরদ দেখাচ্ছ?”

গুঞ্জন দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলল, “দরদ দেখাচ্ছি না, একজনকে বাকিদের মতো সুযোগ দিতে চাইছি।”

“সেটা সম্ভব নয়। এটা আমার ডিসিশন।” রোখ চেপে গেল গুঞ্জনের। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “শুধু আপনার ডিসিশনে হবে না। আজ সন্ধেতে মিটিং ডাকুন। ক্লাবের মেম্বাররা কী বলছে সেটাও শুনুন।”

রাগে কাঁপতে কাঁপতে পরিতোষবাবু বললেন, “তাই হোক।”

গুঞ্জন ফিরে এসে ঘুলঘুলিকে বলল, “আজ পালা। কাল সকালে একবার আসিস। তোর নাম লিখে নেব।”

ধুলো মাখা মুখ আর টানা টানা চোখে হেসে ঘুলঘুলি পালাল।

নাম কিন্তু লিখতে পারল না গুঞ্জন। এমন হবে সে ভাবতেও পারেনি। বিকেলের মিটিং-এ সকলেই আপত্তি করল। কেউ বলল, ব্রিজের তলায়-থাকা ছেলেকে সঙ্গে নিলে অন্য বাবা-মায়েরা রেগে যাবে। কেউ বলল, রেগে না গেলেও ক্লাবের দুর্নাম। কেউ বলল, দুর্নাম ছড়ালে পরের বার থেকে আর কম্পিউটার, পোটাটো চিপস, কোল্ড ড্রিংক্স, টাকা দেবে না। স্পোর্টস বন্ধ করে দিতে হবে। সেটা একরকম আত্মহত্যা। সামান্য একটা দশ-বারোর বছরের ছেলের জন্য ক্লাবের এত উৎসব বন্ধ করে দেওয়া যায় না। গুঞ্জন অবাক হয়ে বলল, “তাহলে ক্লাবের নাম আর মিছিমিছি, ‘তোমরা সবাই’ রাখা কেন? এই নাম বদলে করে দেওয়া হোক ‘তোমরা ক’জন’।”

প্রেসিডেন্ট হাসি মুখে সবটা শুনলেন। তারপর ধুতির কোঁচা ঠিক করতে করতে বললেন, “আহ্, রাগ করো কেন, গুঞ্জন? এরপরে না হয় আমরা আলাদা করে পথশিশুদের জন্য একটা কিছু করব। এই ধরো, বসে আঁকো বা ফুটবল ধরনের কিছু একটা।”

পরদিন আবার ঘুলঘুলি এল। ফাঁকা ক্লাবঘরের এক কোনায় বসে কী যেন লিখছিল গুঞ্জন।

“কী হল কাকু? আমার নাম লিখবে না?” গুঞ্জন শুকনো হেসে ঘুলঘুলির এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “লেখা হয়ে গেছে রে ঘুলঘুলি। তবে খাতায় নয়, আমি তোর নাম লিখেছি অন্য জায়গায়।”

ঘুলঘুলি হেসে ঘাড় কাত করল। বলল, “তা হলেই হবে।”

ঘুলঘুলি চলে যাওয়ার পর দ্রুত হাতে ক্লাবের সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়ার চিঠিটা শেষ করল গুঞ্জন।

‘পরিতোষদা, আমাকে ক্ষমা করবেন। সকলের যেমন আপত্তি আছে, তেমন আমারও একটা প্ৰতিবাদ আছে…।”

রবিবার সকাল থেকেই স্কুলমাঠ জমজমাট। গোটা এলাকার মানুষ ভেঙে পড়েছে ‘তোমরা সবাই’ ক্লাবের স্পোর্টস দেখতে। রঙিন পতাকা, কাগজের চেন, সাদা চুনের দাগে মাঠ সেজেছে। সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েরা সাদা জামা, প্যান্ট, ফ্রকে ফুরফুর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুকে পিঠে নম্বর লেখা কাগজ। একদিকে সামিয়ানা। লম্বা টেবিলে থরেথরে সাজানো প্ৰাইজ। পাশেই ঝকঝকে কম্পিউটারের বাক্স। মাইকে একটার পর একটা ঘোষণা চলেছে। সেই অনুযায়ী চলছে প্রতিযোগিতা। মাঠের পাশেই চেয়ারে বসেছে বাবা-মায়েরা। তাদের টেনশন দেখার মতো। কেউ ঘাম মুছছে, কেউ ঘনঘন জল খাচ্ছে। এই টেনশন চলবে সারাদিন।

খানিকটা দূরে ব্রিজের ওপর আজও নতুন রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। বিছানো হচ্ছে পাথরকুচি। বড়ো বড়ো কালো ড্রামে আগুন জ্বেলে গলানো হচ্ছে পিচ। পুরুষ মহিলারা দল বেঁধে সেই পিচ ঢেলে দিচ্ছে পথে। গরগর আওয়াজ তুলে দৈত্যের মতো চলে যাচ্ছে রোলার। জমাট লাল গলন্ত পিচ যেন আগ্নেয়গিরির লাভার মতো!

বড় ভয়ঙ্কর কাজ করছে একটা ছোটো ছেলে। সেই আগুন লাফ দিয়ে দিয়ে টপকে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে! এগিয়ে যাচ্ছে! সবাই বারণ করছে, বকছে। মলিন পোশাকের ছেলেটা কিন্তু শুনছে না। হাসছে খিলখিল করে।

হাসবে না? তার আগুনলাফের খেলা দেখতে আজ কে এসেছে দেখতে হবে তো।

মুগ্ধ গুঞ্জন দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। ঘুলঘুলির প্রতিটা লাফের সঙ্গে সঙ্গে হাততালি দিচ্ছে। ফিসফিস করে বলছে, “আরও জোরে, আরও জোরে লাফ দে বেটা।”

বড়ো কিছু নয়, এই ছেলের জন্য ছোট্ট একটা প্রাইজ এনেছে গুঞ্জন।

Leave a Reply