বর্ণাকার

চমৎকার পুকুর

ভুবনপুরের পুবদিকে বোসদের বাগান। বাগান না বলে ওটাকে এখন জঙ্গলই বলা উচিত। কতবছর যে ঐ বাগানে মালি ঢোকেনি তার কোনও ঠিক নেই। বছরের পর বছর ওখানকার আগাছাও পরিষ্কার করা হয় না, ঘাস ছাঁটাও হয় না। বাগানটার যারা মালিক সেই বোসদেরও ভুবনপুরের কেউ চোখে দেখেনি। একজন, দু’জন দেখে থাকতে পারেন, কিন্তু তাঁরা এত বুড়ো হয়ে গেছেন যে কানে কিছু শুনতে পান না। সুতরাং তাদের এসম্পর্কে প্রশ্ন করে কোনও লাভ নেই।

বাগান কিন্তু অনেক বড়। ভাঙাচোরা নোনা ধরা ইটের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। অবশ্য ভেতরকার গাছগুলো যে সব জংলি এমন নয়। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, আমলকির মত জিভে জল আনা সব ফলের গাছ আছে। আছে করবী, নয়নতারা, কৃষ্ণচুড়া, চাঁপা, টগরের মত সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। আর আছে চমৎকার একটা পুকুর। বাগানের একদম মাঝখানে। একদিকে কলাগাছের ঝাড়, অন্যদিকে তাল আর নারকেল গাছের সারি যেন পুকুরটাকে ঘিরে জায়গাটাকে ঠান্ডা ঠাণ্ডা করে রেখেছে। পুকুরের উত্তর আর দক্ষিণ দুদিকে দুটো লাল রঙের ঘাট। সেই ঘাটের বেশিরভাগ সিঁড়িই আজ ভেঙে পড়েছে। সিঁড়ির ফাটল থেকে বটগাছের চারা মাথা তুলেছে। তবে পুকুরের জলটা কিন্তু আজও খুব ভাল আছে। টলটলে, পরিষ্কার। কাঁচের মত। জলের একদিকে শালুক ফুল ফুটে ভাসছে, একদিকে পাতিহাঁস প্যাক প্যাক করে সাঁতরে বেড়াচ্ছে আর মন দিয়ে গুগলি খুঁজছে। কখনও সখনও তালগাছ থেকে পাকা তাল হয়ত ঝুপুং করে জলে পড়ল, কখনও বা ইয়া বড় কোনও কাতলা মাছ ঘাই দিল ঘুপুত করে।

বোসদের এই বাগানে কারোর ঢোকার সাধ্যি নেই। ঢুকবে কী করে? একবার বড়দিনের ছুটিতে ভুবনপুর তরুণ সংঘ ক্লাবের ছেলেরা এই বাগানে ঢুকে পিকনিক করছিল। মাইক বাজিয়ে তারা বেজায় শোরগোল পাকিয়েছিল। তারপর বীরত্ব দেখিয়ে যেই তারা একটা মৌচাক ভেঙে মধু নিতে গিয়েছিল অমনি কয়েক’শ মৌমাছি তাদের এমন কামড় দেয় যে, এক একজনের চোখ মুখ হাঁড়ির মত ফুলে ওঠে। শুধু তাই নয়, জ্বালার চোটে পিকনিক পার্টি এক হাঁড়িতেই মাংস, ডাল, চাটনি রান্না করে এবং সেই অদ্ভুত খিচুড়ি খেয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। এরপর আর কেউ ওখানে পিকনিক করতে যায়নি। তবে দত্তবাড়ির মেজ ছেলে একবার সিনেমার ভিলেনদের মত জুতোজামা পরে, কাঁধে এয়ারগান ঝুলিয়ে বোসবাগানে খরগোস শিকারে গিয়েছিল। সেবার গর্তে পড়ে, পা ভেঙে তাকে ফিরতে হল। অনেকেই তাকে গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করেছিল, শুনলাম বোসবাগানে শিকার করতে গিয়ে তুমি নাকি নিজেই জন্তুদের জন্য পাতা ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলে?

এই অপমানের পর দত্তবাড়ির মেজ ছেলে আর কোনওদিন এয়ারগান ধরেনি।

ঘনাই কাণ্ড

ছ’ফুট তিন ইঞ্চি উচু পাঁচিলটা টপকে টুপ করে বোসবাগানে এসে পড়ল ঘনাই। তার কাঁধে একটা ভারী থলে। সে হাঁপাচ্ছে।

মাকড়সার জাল আর শেয়ালকাঁটা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল ঘনাই। গতরাতে খানিকটা বেশি হয়েছে। পরপর পাঁচটা বাড়িতে চুরি তো কম কথা নয়। কোনটাতে সিঁদ কেটে, কোনটাতে গরাদ ভেঙে, কোনটাতে আবার পাইপ বেয়ে। শেষের বাড়িটায় তো ধরা পড়ে যাচ্ছিল বলে। দারোয়ান ব্যাটা কাঁধটা খামচেও ধরেছিল। খুব বাঁচোয়া ভাল করে তেল মাখা ছিল। তাই হড়াৎ করে ফসকে আসতে পেরেছে। অবশ্য ধরা পড়লেও ঘনাইয়ের খুব কিছু এসে যেত না। আশেপাশের চৌদ্দটা পুলিশথানার সঙ্গে তার খুবই চেনা জানা। অনেক থানার বড়বাবুর বাড়িতেই সে বিজয়ার দিন সন্দেশের বাক্স নিয়ে প্ৰণাম করতে যায়। সে চোর হলে কী হবে, পুলিশ মহলে সবাই তাকে বিশ্বাস করে। সে যখনই ধরা পড়ে কোনও থানায় গেছে, তখনই সে ঘরের ছেলের মতই খাতির পেয়েছে।

পুব আকাশে একটু একটু করে আলো ফুটছে। ঘনাই ভাবল, এখন যদি ভাল মত একটা স্নান করা যেত। আর পেটটা পুরে খাবার পাওয়া যেত তাহলে ক্লান্তিটা একদম দূর হত! এই কথা ভাবতে ভাবতে ঘনাই এসে পৌঁছালে বোসপুকুরের ঘাটে।

ভোরের নরম আলোয় পুকুরটা যেন হাসছে। শিশির ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ তুলেছে। একমিনিটও দেরি করল না ঘনাই। থলেটাকে ফেলে রেখে গুনে গুনে ঠিক বারো পা দূর থেকে ছুটে এসে ঝাঁপ দিল ঝপাং।

বাগান জুড়ে ডেকে উঠল পাখি। পাতিহাঁসদুটো ল্যাগব্যাগ করে ছুটল। এমন কাণ্ড তারা দেখেনি কখনও! বোসপুকুরে মানুষ নেমেছে! ঘনাইও হড়াশ ফড়াশ করে উল্টো সাঁতার, চিত সাঁতার আর ডুব সাঁতার কাটল টানা আধঘণ্টা। এমন আরামের স্নান বহুদিন করেনি সে। তারপর জল থেকে উঠে মাথা মুছে গাছ থেকে একটা বড় কাঁঠাল পেড়ে, সেটা ভেঙে পা ছড়িয়ে বসল ছায়ায়।

গুড়ের থেকেও মিষ্টি এক একটা কোয়া মুখে ফেলতে লাগল আর চোখ বুজে ভাবতে লাগল, সামনের সাতদিন কোথায় কোথায় যেতে হবে।

মিত্তিরদের সিন্দুকটা আছে শোবার ঘরে। পরশুই একবার ঢু মারতে হবে সেখানে। জগদীশের গুদাম থেকে এক বস্তা আলু সরাতে হবে কালই। হরিহর পাড়ায় সতেরো আর উনিশ নম্বর বাড়িতে নতুন বাসন কোসন কেনা হয়েছে বলে খবর এসেছে। দু’একদিনের মধ্যেই যেতে হবে।

ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে এল ঘনাইয়ের। ঢুলুনি এল। এমন সময় হঠাৎ তার মাথার মধ্যে একটা কী যেন হল! যেন একসঙ্গে জ্বলে উঠল একশ তুবড়ি! ফেটে উঠল পাঁচশ কালীপটকা!

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল ঘনাই। দরদর করে ঘামছে। চোখ দুটো বড় বড় আর লাল। মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে গেছে। এ তার কী হল!

ফিসফিস করে আপন মনে বলল, “ছি ছি, এ আমি কী করছি? চুরি করা তো পাপ। আমি কিনা সে কাজটাই করছি? কী লজ্জা! কী লজ্জা! আজ থেকেই ওসব ছাড়লাম।”

এই বলে চুরি করা মাল ভর্তি থলেটাকে কঁধে ফেলে ঘনাই হনহন করে থানার দিকে হাঁটতে লাগল। হাঁসদুটো আবার হেলতে দুলতে এসে বোসপুকুরে নেমে পড়ল।

বড়বাবুর দুঃখ

ভুবনপুর পুলিস থানার বড়বাবুর মনটা আজ সকাল থেকে বিগড়ে আছে। আসলে হয়েছে কী, গিন্নি আজ ধরে ফেলেছে যে তিনি থলে ভর্তি করে বাজার করে আনেন বটে। কিন্তু একটা কানাকড়িও খরচ করেন না। অথচ রোজ গিন্নির কাছ থেকে গুনে গুনে সাঁইত্রিশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা হাত পেতে নেন বাজার খরচ বাবদ। মুশকিলটা হল আলুওলা, বেগুনওলা, মাছওলা, ফুলকপিওয়ালা, কাঁচালঙ্কাওলা প্রত্যেকেই তাদের থানার বড়বাবুকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে। কিছুতেই পয়সা নিতে চায় না। এখন গিন্নি কড়া হুকুম দিয়েছে, এক বছরের বাজার খরচ ফেরত দিতে হবে। সাঁইতিরিশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা ইনটু, তিনশো পয়ষট্টি! কত টাকা! বাপরে! কে তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে এই টাকা এখন দেবে? এরপরেও কারোর মন ভাল থাকে? এইরকম একটা সময় ঘনাই এসে ঘরে ঢুকল। পিঠের থলেটাকে টেবিলের ওপর রাখল।

বলল, “স্যার, আমাকে গ্রেপ্তার করুন।”

বড়বাবু মুখটাকে এমন করেছিলেন যেন এখুনি তিনি রসগোল্লার বদলে ভুল করে গোটা কতক উচ্ছে সেদ্ধ খেয়ে ফেলেছেন। সেই ব্যাজার মুখেই বললেন, “ঘনাই ইয়ার্কি মারিসনি। মন মেজাজ আজ একেবারেই ভাল নেই। ঐ থলেতে নতুন শাড়ি টাড়ি কিছু থাকলে বউদির জন্য রেখে কেটে পড়।”

ঘনাই এবার চেয়ারে গ্যাট হয়ে বসে বলল, “ছি ছি স্যার, ওকথা মুখে আনবেন না। আপনি পুলিশ। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আপনি কেন চুরির মালের ভাগ নেবেন? নাঃ আপনাকেও দেখছি একবার পুকুরে ডুব দিয়ে আনতে হবে।”

“কী বলছিস যা-তা? সকালেই সিদ্ধি গিলেছিস নাকি! যত্তসব অ্যান্টিসোশাল এলিমেন্ট কোথাকার।”

“না স্যার, যা-তা বলছি না। আমি কি কখনও ভুল খবর দিয়েছি? ঐ বোসবাগানের পুকুরে একবার ডুব দিয়ে দেখুন না, আপনার ভেতরকার সব খারাপ জিনিসগুলো একেবারে ধুয়ে মুছে যাবে। আমি আজই একেবারে হাতেনাতে টের পেয়েছি।”

বড়বাবুর এবার যেন কেমন সন্দেহ হল। সত্যি তো, ঘনাই তো কখনও ভুল খবর দেয় না! অন্তত এতদিন ধরে দুজনে কাছাকাছি আছে কখনও তো ঠকায়নি। তবে? সত্যি বোসবাগানের পুকুর খারাপকে ভাল করে দিচ্ছে নাকি! “স্যার, অত ভাববেন না। নিজে পরীক্ষা করে। দেখে আসুন কথাটা সত্যি কি মিথ্যে। তার আগে সেপাইকে ডেকে আমাকে হাজতে পুরুন। আমি আত্মসমর্পণ করতে এসেছি। আমি পাপের শাস্তি পেতে চাই” বলল ঘনাই।

বড়বাবু বললেন, “যা যা, মেলা ফ্যাচফাচ করিসনি। আমি এখনই বোসবাগানে তদন্তে যাব। গিয়ে যদি দেখি তোর কথা মিথ্যে, তাহলে তো বুঝতেই পারছিস—।”

তিনি সেপাই শিউচরণকে ডেকে বললেন, “ঘনাইকে হাজতে পুরে দে।”

নির্বাচিত কমিশনার

বড়বাবুর জিপ গাড়িটা যে বাড়িটার সামনে এসে নিরাপদে দাঁড়াল সেই বাড়ির মালিক হলেন প্রিয়নাথ রায়। ভুবনপুর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার। খুবই নামডাক আছে। গতবারের ইলেকশনে তিনি পাঁচশ সতেরো ভোটে জেতেন। তারপরই তিনি আস্তে আস্তে এই বাড়িটা তৈরি করে ফেলেছেন। বাড়ির নাম ‘কষ্ট করে’। সত্যি, বাইরে থেকে ‘কষ্ট করে’কে একেবারে কুঁড়েঘরের মতই দেখতে। ভাঙা টালির ছাদ, ঘুনধরা জানলা-দরজা, মাটির দাওয়া, বাঁশের খুঁটি। কেউ দেখা করতে এলে প্রিয়নাথবাবু এই মাটির দাওয়া বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসেন।

‘কষ্ট করে’র ভেতরটা কিন্তু অন্যরকম। দামি সোফা, কার্পেট, পর্দা, এয়ারকন্ডিশন মেশিন। তবে ভেতরের কথা তো সবাই জানে না। বিশেষ বিশেষ দু-একজনেরই শুধু ভেতরে ঢোকার অনুমতি আছে। বড়বাবু গাড়ি থেকে নেবে, এদিক ওদিক দেখে টুপিটা দিয়ে মুখটা ঢেকে টুক করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।

প্রিয়নাথবাবু তখন বাড়ির দোতলার প্ল্যান বানাচ্ছিলেন আর মনে মনে ভাবছিলেন, “আর কতদিনই বা কমিশনার রয়েছি। পরের বারের ইলেকশনে ভোটাররা হারিয়ে দিলেই তো হয়েছে। তাই এখনই বাড়ির দোতলাটা বানিয়ে ফেলতে হবে। আর নিজের পকেটের পয়সা তো খরচ হচ্ছে না। ভুবনপুরের রাস্তা তৈরি, হাসপাতাল বানানো, দু’তলা বাড়ি মেরামতের জন্য মিউনিসিপালিটির কতই না ইঁট, বালি, চুন, সুরকি, সিমেন্ট আছে। সেখান থেকেই কিছু কিছু সরিয়ে নিতে হবে।” এই কথা ভেবে প্রিয়নাথবাবু একটা লম্বা কাগজে লিখতে শুরু করলেন: ইঁট—রাস্তার। সুরকি-স্কুলবাড়ির। সিমেন্ট— হাসপাতালের। এমন সময় বড়বাবু ঘরে ঢুকে সোফায় বসে পড়ে হাঁপাতে শুরু করলেন। কাগজটা তাড়াতাড়ি গোল্লা পাকিয়ে মুখের মধ্যে ফেলে দিয়ে পানের মত চিবোতে চিবোতে প্রিয়নাথবাবু বললেন, “পান খাবেন বড়বাবু? মিঠে পান। চুন, খয়ের, সুপুরি, দোক্তা, এলাচ, জর্দা চারশ বিশ। দেব একটা বানিয়ে?”

“রাখুন আপনার পান।” ধমকে উঠলেন বড়বাবু। “এদিকে আমাদের প্রাণ যাওয়ার জোগাড়, আর আপনি সাতসকালে উঠে পান চিবোচ্ছেন।”

“কেন স্যার, কী হল?”

“ঘনাই যে খবরটা বলল, তা যদি সত্যি হয় তাহলে আমার আপনার সকলেরই প্ৰাণ নিয়ে টানাটানি হবে।”

“এ আবার কী অলুক্ষুণে কথা বলছেন বড়বাবু? দাঁড়ান, সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি, তারপর সবটা শুনতে হবে।” দরজা বন্ধ করে এলেন প্রিয়নাথবাবু।

প্রিয়নাথবাবু বড়বাবুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। দুচোখ ফেটে জল! বড়বাবু বললেন, “আরে মশাই, আপনার তো চোখে জল আসছে। আর আমি ইতিমধ্যেই একদফা কেঁদে নিয়েছি। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর। তবে আমার মনে হয়, এখনই আমাদের একবার গিয়ে বোসবাগানের পুকুরটা সরেজমিনে পরীক্ষা করা উচিত। ঘনাইয়ের কথা সত্যি কি না, নিজেদের দেখতে হবে। তবে এর জন্য দরকার ভালরকমের খারাপ লোক, যাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমরা বোসবাগানের পুকুরে ফেলে দেব। তারপর দেখব সত্যি সে ভাল হয়ে যায় কি না। এরকম কাউকে আপনি চেনেন নাকি?”

প্রিয়নাথ রায় দু’মিনিট ভাবলেন। তারপর লাফ দিয়ে উঠলেন, “ইউরেকা! পাওয়া গেছে। ব্যাটার ওপর আমার অনেক দিনের রাগ।

এবার বদলা নেব। চলুন বড়বাবু।”

অটলেশ্বর বাবা

ভুবনপুর চৌমাথায় বিরাট দোকান। দোকানের মাথায় আরও বড় সাইনবোর্ড কীর্তনিয়া শ্ৰীশ্ৰীঅটলেশ্বর বাবার দোকান। পিওর জিনিস সুলভে পাওয়া যায়। শনি, রবি ফ্রি’তে কীর্তন শোনানো হয়।

ক্যাশব্যাক্সের ঠিক পাশটিতে অটলেশ্বর বাবা বসে আছেন। কপালে চন্দনের তিলক। খালি গা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। পরনে গেরুয়া ধুতি। চোখদুটো বোঁজা।

মানুষটা গুণী। যেমন ভাল কীর্তন গাইতে পারেন, তেমনি ভাল জিনিসে ভেজাল মেশাতে পারেন। ধরবার উপায় নেই। ভাল কীর্তন বা কৃষ্ণ কীৰ্তন গাইতে গাইতে তিনি এক কেজি ময়দাকে ভেজাল মিশিয়ে দু’কেজি করে দেন। এক শিশি ঘি তিন শিশি হয়ে যায় স্রেফ তার হাতগুণে। ঐ শনি, রবিবার সেদিন ফ্রি’তে খদ্দেরদের কীর্তন শোনানো হয়, সেই দিনদুটোই হল ভেজাল মেশানোর দিন। এসব কথা পুলিশও জানে না। অটলেশ্বর বাবার আরও একটা শখ আছে, শখ না বলে স্বপ্ন বলাই ভাল। সেটা হল ইলেকশনে দাঁড়িয়ে প্রিয়নাথ রায়কে হারিয়ে ভুবনপুর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার হওয়া। গতবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু হেরে গেলেন। ইচ্ছে আছে সামনের বারে আবার দাঁড়াবেন। নুড়ি-পাথর মেশানো এক ঠোঙা চিনি দাঁড়িপাল্লায় তুলতে তুলতে অটলেশ্বর গান গাইছিলেন।

এমন সময় দোকানের সামনে এসে পুলিশের জিপটা থামল। একদিক থেকে নামলেন বড়বাবু, অন্যদিক থেকে নামলেন প্রিয়নাথবাবু। হাতজোড় করে, একগাল হাসি নিয়ে ছুটে গেলেন অটলেশ্বর বাবা। গদগদ কণ্ঠে বললেন, “দীন কুটিরে আজ কার চরণ স্পর্শ পড়ল? এ দেখছি ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনের রথের সারথি হয়েছেন! আসুন আসুন। মরম আমার আকুল হল!”

প্রিয়নাথবাবু বললেন, “তা ভাল কথা। কিন্তু আপনি তো এটা জানেন না যে, আমাদের বড়বাবু খুব কীর্তনের ভক্ত। উনি আপনার নাম শুনেছেন। কিন্তু গান শোনেননি। তাই ওনার অনুরোধ আপনি ওঁকে একদিন মন ভরিয়ে কীর্তন শুনিয়ে দিন।”

অটলেশ্বর মহা ব্যস্ত হয়ে বললেন, “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আজই আসুন না। এখনই না হয় দু’কলি শুনিয়ে দিতাম।” এবার মুখ খুললেন বড়বাবু। বললেন, “না না। এখন নয়। আমি একা নিরিবিলিতে বসে শুনতে চাই। এই ধরুন আজ সন্ধের পরে যদি হয়? আমার গাড়ি এসে আপনাকে নিয়ে যাবে। তারপর কোথাও বসে, চাঁদের আলোয় আপনার কীর্তন শুনব। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে।”

একটু ভাবলেন অটলেশ্বর। প্রস্তাবটা মন্দ নয়। এইভাবে যদি থানার বড়বাবুটাকে হাতে আনা যায়, তাহলে সামনের বারের ইলেকশনে জিততে সুবিধেই হবে। প্রিয়নাথটা দেখেছি ওকে খুব কব্জা করেছে। দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি।

রাজি হয়ে গেলেন। অটলেশ্বর বাবা।

তারপর যা ঘটল

পুকুরের দক্ষিণ দিকের ঘাটে সাদা ফরাস পাতা হয়েছে। সাজানো রয়েছে তিনটে তাকিয়া। খঞ্জনি, হারমোনিয়াম, তানপুরা সব রয়েছে। যে কীর্তনের সঙ্গে যেটা লাগবে। ফরাসের এককোণে ধূপধানিতে ধূপ জুলছে। বিকেল বিকেল থানা থেকে এসে সেপাই শিউচরণ সব সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে গেছে।

চাঁদের আলোয় আর ধূপের গন্ধে বোসবাগান জুড়ে বেশ একটা ভক্তি ভক্তি ব্যাপার এসে গেছে। অন্ধকার আর একটু গাঢ় হতেই বনবাদাড় ঠেলে খটর মটর শব্দ তুলে বড়বাবু প্রিয়নাথ রায় আর অটলেশ্বর বাবা এসে পৌঁছলেন। তিনজনে এসে ফরাসের ওপর বসলেন। অটলেশ্বর বাবা বললেন, ‘সত্যিই সুন্দর! কীর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ! শান্ত নির্জন। সম্মুখে সরোবর। তথায় শালুক প্রস্ফুটিত! চন্দ্ৰকিরণ যেন তাঁরই মহিমা!”

প্রিয়নাথবাবুর সঙ্গে বড়বাবুর চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। প্রিয়নাথবাবু বললেন, “ঠিকই বলেছেন বাবাজী, তবে আজ বড় গরম। এখন যদি একটু স্নান করতে পারতাম, তাহলে বোধহয় কীর্তনের আসরটা আরও মধুর হত। কী বলেন বড়বাবু?”

বড়বাবুর মুখে যেন উত্তরটা ঝুলছিল। বললেন, “ঠিক কথা। তা সে আর অসুবিধের কী আছে? আসুন না, সবাই মিলে পুকুরে একটা করে ডুব দিয়ে নিই? জলটা তো দেখে মনে হচ্ছে চমৎকার। কী বাবাজী, আপনি কী বলেন?”

এতক্ষণ খঞ্জনিতে টুংটুং আওয়াজ তুলছিলেন আর চোখ বুজে ঘাড় নাড়াচ্ছিলেন অটলেশ্বর। বড়বাবুর পুকুরে ডুব দেওয়ার প্রস্তাব শুনে খঞ্জনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এবার তিনি দাঁড়িয়ে উঠলেন। কোথায় গেল সেই একগাল হাসি আর গদগদ ভাব? রাগে যেন চোখ দুটো জ্বলছে! কোমরে হাত দিয়ে বললেন, “‘বলি ব্যাপারটা কী? আমি কী কিছু জানি না? আপনার শিউচরণ কীৰ্তন শুনতে এসে আমাকে সব বলে দিয়েছে। ঘনাই চোরের আজ কতটা দুৰ্দশা হয়েছে আমার জানা নেই ভেবেছেন? আমি ভাল হয়ে গেলে আমার ব্যবসা যে লাটে উঠবে। সেকথা আপনারা জানেন? বুঝেছি, কীর্তন শুনব বলে নিয়ে এসে আমাকে ‘ভাল’ বানানোর ফাঁদ পাতা হয়েছে?”

বড়বাবু খপ করে বেল্ট থেকে রিভলবারটা খুলে বাবাজীর দিকে তাক করে বললেন, “অতশত জানি না, আপনাকে পুকুরে ডুব দিতেই হবে। আমি পুলিশ। আমার হুকুম আপনাকে মানতে হবে। আমি দেখতে চাই ঘনাইয়ের কথা সত্যি না মিথ্যে।”

এদিকে রিভলবার দেখে প্রিয়নাথবাবু বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। তিনি তানপুরাটা বন্দুকের নলের মত অটলেশ্বর বাবার দিকে বাগিয়ে ধরে একটা গাছের আড়ালে সরে যেতে লাগলেন, “ঠিক কথা। পুকুরে নামতে হবে। খারাপ থাকা বের করে দেব। আমার বিরুদ্ধে যখন ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিলেন তখন মনে ছিল না? অ্যান্টিসোশ্যাল এলিমেন্ট কোথাকার।”

অটলেশ্বর বাবারও এখন করার কিছু নেই। সামনে রিভলবারের নল, পেছনে তানপুরা। পালাবার পথ নেই। তার ধুতির কোঁচা খুলে গেছে। রাগে মাথার চুলগুলোও খাড়া হয়ে গেছে। “ইস! ব্যাটা প্রিয়নাথের কাছে কিনা শেষপর্যন্ত এতটাই ঠকতে হল?” ভাবতে ভাবতে দু’হাত তুলে গুটি গুটি পায়ে পুকুরের দিকে এগোতে লাগলেন তিনি।

হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বললেন, “বড়বাবু, ভাল যখন হতেই হচ্ছে, তখন শেষ একটা ইচ্ছেপূরণ করতে দেবেন?”

বড়বাবু রিভলবার নাচাতে নাচাতে বললেন, “এটা পুলিশের এথিক্স। ফাঁসি দেওয়ার আগে আমরা অপরাধীর শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে দিই। আপনার কী ইচ্ছে চটপট বলে ফেলুন।”

“আমি হারমোনিয়াম বাজিয়ে কীৰ্তন গাইতে গাইতে পুকুরে ডুব দিতে চাই।”

“ঠিক আছে, রাজি।”

অটলেশ্বর গদগদ মুখে হারমোনিয়ামটা গলায় ঝুলিয়ে গান গাইতে গাইতে ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন। ঠিক শেষ সিঁড়িতে পৌঁছেই সটান ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। দু’হাত দিয়ে হারমোনিয়ামটা ছুড়ে মারলেন বড়বাবুর দিকে। বড়বাবু কিছু বুঝতে না পেরে রিভলবারের নলটা আকাশের দিকে করে ট্রিগারটা দিলেন টিপে। গুড়ুম! তারপরই হারমোনিয়ামের আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে দিলেন এক লাফ। গিয়ে পড়লেন অটলেশ্বরের কাঁধে! দু’জনেই ঝপাং করে পড়লেন একদম পুকুরে।

মজা দেখবেন বলে আগে থেকেই প্রিয়নাথবাবু গাছের ডালে উঠে বসেছিলেন। গুলির শব্দে তিনিও চমকে গিয়ে ডাল ভেঙে পাতাটাতা নিয়ে একদম পুকুরের জলে এসে পড়লেন। হাঁচোর প্যাচোর করতে করতে তিনজন যখন পুকুর থেকে উঠে এলেন, তখন সে এক দেখবার মত দৃশ্য। বড়বাবুর মাথার টুপি অটলেশ্বর বাবার মাথায়, অটলেশ্বর বাবার রুদ্রাক্ষের মালা প্রিয়নাথ রায়ের কপালে। তিনজনেরই গা থেকে জল করছে।

একদম শেষে

ভুবনপুর পুলিশ থানার বড়বাবুর দাপটের কথা তখন আশেপাশের এলাকার মানুষও জানেন। বড়বাবুর ভয়ে ভুবনপুরে চুরি ডাকাতি একদম বন্ধ। এখন কেউ আর ভয় দেখিয়ে বাজারে মাছওলার কাছ থেকে মাছটা, আলুওলার কাছ থেকে আলুটা জোর জবরদস্তি নিতে পারে না। তেমনি কাজ করছেন বটে ভুবনপুর মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচিত কমিশনার প্ৰিয়নাথ রায়। রাস্তা তৈরির কাজ শেষ, হাসপাতাল বানানোর কাজ চলছে, স্কুল বাড়িটারও মেরামত হয়ে গেছে। আর প্রিয়নাথবাবু নিজের বাড়িটা মিউনিসিপ্যালিটির নামে লিখে দিয়েছেন। সেখানে একটা লাইব্রেরি হচ্ছে। ওহো! ‘কীৰ্তনিয়া শ্ৰীশ্ৰীঅটলেশ্বর বাবার দোকান’-এর কথা তো বলাই হল না। ভূবনপুরে খাঁটি জিনিস কম দামে পেতে হলে, ঐ দোকানেই এখন যেতে হবে। গরিব মানুষকে উনি ধারেও জিনিস দেন। আর হ্যা, গত কয়েকদিন হল শনি রবিবার বিকেলে উনি ফ্রি’তে কীর্তন শেখাচ্ছেন। প্রথম মাসে কালী কীর্তন, পরের মাসে শ্ৰীকৃষ্ণ কীৰ্তন।

আর বোসবাগানের আশ্চর্য পুকুর? সেই একইরকম আছে। টলটলে চমৎকার জল। শান্ত। নির্জন। বোসবাগানে যেতে কোনও ঝামেলা নেই। এই তো সকালবেলার ট্রেনে উঠে–।

⌘ সমাপ্ত ⌘

Leave a Reply