» » হারলেও হাসে

বর্ণাকার

টিফিনের সময় মিটিং বসল।

এ ধরনের গোপন এবং জরুরি মিটিং আমরা সাধারণত করি স্কুলের পেছন দিকটায়। ঝাঁকড়া জামরুল গাছটার নীচে। সকলে গাছের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসি। পল্টু শুধু বসে গাছের ওপরে, ডালে পা ঝুলিয়ে। এই কারণে ওকে আমরা মাঝে মধ্যেই ‘হনুমান পল্টু’ বলে ডাকি। তাতে তার কিছু আসে যায় না। জরুরী সময়ে সে গাছের ডালে বসতেই পছন্দ করে।

আজ বসেছে। বলল, ‘বন্ধুগণ, সব জিনিস মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু এই জিনিস মেনে নেওয়া যায় না। অনেক হয়েছে আর নয়।’

তপন গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসেছে। দাঁত দিয়ে ঘাস কাটছে। সবসময়ই সে এরকম করে। মনে হয়, সুযোগ পেলে লুকিয়ে ঘাস খায়ও। বলল, ‘আমি পল্টুর কথা সমর্থন করি। শুধু সমর্থন করি না। একশো ভাগ সমর্থন করি। হার-জিতের থেকে অনেক বড়ো হল সম্মান। আমাদের সম্মান। ক্লাস সেভেনের সম্মান। সেই সম্মান রক্ষা করতে না পারলে ট্রফি, মেডেল জিতে লাভ কী?’

ফুচাইয়ের নামের মধ্যে একটা ফাজিল ফাজিল ব্যাপার আছে। কিন্তু সে যথেষ্ট গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে। আজ আরও গম্ভীর হয়ে গেছে। বলল, ‘প্রসূন, তোমাকে যে রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়েছিল সেটার কী হল?’

প্রসূন মন দিয়ে কেক খাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই বলল, ‘আমার রিপোর্ট রেডি।’

তমাল ওর হাত থেকে কেকের বাকি অংশটা কেড়ে টুক করে নিজের মুখে পুরে ফেলল। তারপর বলল, ‘আগে রিপোর্ট বল। তারপর খাবি।’

প্রসূন বেজার মুখে বলল, রিপোর্ট খুবই ভয়ঙ্কর এবং দুঃখজনক। শেষ এগারোটা ম্যাচে একই কাণ্ড হয়েছে। হেরে যাওয়ার পর বিশু হেসেছে। দুটো ম্যাচের ঘটনা তো মারাত্মক। সে যতবার গোল খেয়েছে, ততবার মুখে হাত চাপা দিয়ে ফিক ফিক করে হেসেছে। আশ্চর্যের কথা হল, ওই দুটো ম্যাচে আমাদের ফল, বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ হয়েছিল। এত খারাপ যে, খেলা শেষে আমাদের টিমের দুএকজনের চোখে জল পর্যন্ত এসে গিয়েছিল। নাম বলে আমি আর তাদের লজ্জায় ফেলতে চাইছি না। তাছাড়া এই রিপোর্ট কান্না নিয়ে নয়, হাসি নিয়ে। যাই হোক, হারবার পর বিশুর হাসবার রহস্য আমি বুঝতে পারছি না।”

মল্লিব্রত লাফিয়ে উঠে বলল, “আমি তোদের বলেছিলাম না? এবার বিশ্বাস হল তো?”

অজয় চোখ সরু করে বলল, “আচ্ছা প্রসূন, তোর কী মনে হয়? এসব সময় বিশু কি চাইছিল, আমরা হেরে যাই?”

প্রসূন জিভ কেটে বলল, “ছি, ছি এ কী কথা বলছিস! একথা আমাদের মনে আনাও অন্যায়। বিশু না খেললে আমাদের হাঁড়ির হাল হত। তাছাড়া ও তো শুধু দল হারলে হাসে না, নিজে গোল খেলে, আউট হয়ে গেলেও হাসে। স্পোর্টসের সময় যখন দু-একটা ইভেন্টে জিততে পারেনি তখনও খুব হাসাহাসি করেছে বলে খবর পেয়েছি। সুশান্ত বলছিল, হান্ড্রেড মিটারস্ আর হার্ডল রেসে পিছিয়ে পড়ে ও নাকি সব থেকে মজা পেয়েছিল।’

সুশান্ত চিন্তিত গলায় বলল, “এটাই তো মুশকিল হয়েছে। হাসির মানে বোঝা যাচ্ছে না।”

সুকল্যাণ চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিল। শেষ দুটো ম্যাচে ক্লাস সেভেনের ভয়ঙ্কর পরাজয়ের পেছনে সুকল্যাণের অবদান খুবই বড়ো। সে দুটো সেমসাইড করেছে। একটা আবার হাতে লেগে। সুকল্যাণ উদাসীন গলায় বলল “তোরা কিন্তু একটু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিস। দুম করে কিছু করে বসিস না।”

অরূপ দুঃখী মুখ করে বলল, “কোন ভাবনা চিন্তার আর সুযোগ নেই। আমরা যা ঠিক করেছি সেটাই আমাদের করতে হবে। কাজটা খুবই দুঃখের। আমাদের অসুবিধেও হবে খুব। কিন্তু উপায় নেই।”

তাপস ক্লাসের ফার্স্ট বয়। যে কোনও বিষয়ে মত দেওয়াটা তার স্বভাব। তার বেশিরভাগ মতই অবশ্য শোনা হয় না। সে বলল, ‘বিশুকে ডেকে একবার জিগ্যেস করলে হত না? ওরাও তো একটা বক্তব্য থাকতে পারে।”

অরূপ বলল, “থাকতে পারে। কিন্তু যে এরকম উদ্ভট আচরণ করছে তার মতামত জেনে কী হবে? তাছাড়া বিশুর জ্বর হয়েছে। আজ আসেনি। এটাই সুযোগ। বেচারি এখানে থাকলে আমরা এই কষ্টদায়ক সিদ্ধান্তটা কিছুতেই ওর সামনে নিতে পারতাম না। সুতরাং আর দেরি করাটা ঠিক হবে না।”

গাছের ওপর থেকে পল্টু বলল, অরূপ ঠিকই বলেছে। খুবই দুঃখের সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হচ্ছে। কারোর আপত্তি থাকলে হাত তোল।”

সকলে মাথা নামিয়ে বসে রইল। কেউ হাত তুলল না। এর মানে হচ্ছে, সিদ্ধান্তে সকলেই একমত।

খেলায় হারবার পরও হাসবার অপরাধে ক্লাস সেভেনের বিশ্বনাথ পাল ওরফে বিশুকে যাবতীয় টিম থেকে বাদ দেওয়া হল।

বিশুর মধ্যে একটা পাগল পাগল ব্যাপার আছে। চেহারায় কোন ছিরিছাঁদ নেই। চুলগুলো খোঁচা খোঁচা। হাঁটাচলাটা ল্যাগব্যাগে ধরনের। প্যান্টে ঠিকমত গুঁজতে জানে না। জুতোর ফিতে সবসময়ই খোলা। পাগলাটে ধরনের মানুষের মজা হল, সাধারণ ক্ষমতা না থাকলেও তাদের কিছু না কিছু অ-সাধারণ ক্ষমতা থাকে। বিশুরও সেরকম রয়েছে। তার অসাধারণ ক্ষমতা খেলাধুলোতে। সবধরনের খেলাতেই এই ছেলে দারুণ ওস্তাদ। ক্রিকেটে ওর ফিল্ডিং দেখলে চমকে উঠতে হয়। ঝপাং ঝপাং করে শুয়ে পড়ে এমন সব ক্যাচ ধরে যে নিজের দলের বোলার পর্যন্ত ঘাবড়ে যায়। এত ঘাবড়ে যায় যে আউট করার আনন্দে লাফাতে পর্যন্ত ভুলে যায়।

ফুটবলের সময় বিশু গোলকিপার। গোলপোস্টের দিকে আসা বল যখন সে ধরে তখন মনে হয় সে বুঝি কোনও মানুষ নয়। একটা পাখি। তার হাত দুটো আসলে দুটো ডানা। গোলপোস্টের দিকে আসা বল পাখির মতো উড়ে উড়ে সে ধরতে পারে।

একবার আমাদের গেম টিচার বিজয়বাবুর মাথায় ভূত চাপল।

তিনি বললেন, ফুটবল, ক্রিকেট একঘেয়ে হয়ে গেছে। এবার অন্যকিছু করতে হবে। তিনি হকি খেলার ব্যবস্থা করলেন। আমরা সবাই ভেবেছিলাম এ খেলায় বিশু তেমন কেরামতি দেখাতে পারবে না। পারবেই বা কী করে? হকি তো আর সে কখনও খেলেনি। ওরে বাবা! দশমিনিট পরে দেখা গেল সেখানেও বিশু মারাত্মক। হকি স্টিকে যেন আঠা লাগিয়ে মাঠে নেমেছে। বল তাকে ছেড়ে অন্যদিকে যেতেই চায় না যে়!

এখানেই বিশুর খেলা-প্রতিভার শেষ নয়। ক্রিকেট, ফুটবল, হকির মতো বড়ো বড়ো খেলার পাশাপাশি কবাডি, পিট্টু, বল চোরের মতো, ছোটখাটো খেলাতেও বিশুর পারদর্শিতা দেখবার মতো। স্পোর্টসের সময় দৌড়, লং জাম্প, হাই-জাম্পে তার ধারে কাছে কারোর আসা শক্ত। অত প্ৰাইজ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য বেচারিকে রিকশা ডাকতে হয়।

বিশু অবশ্য লেখাপড়াতেও ভয়ঙ্কর। যে কোনও পরীক্ষায় দুটো তিনটে বিষয়ে ফেল করা তার কাছে কোন ঘটনা নয়। তবে তাকে কখনও ক্লাসে রেখে দেওয়া হয় না। কারণ, তাহলে আমাদের ক্লাস টিমের কেলেঙ্কারি হত। বিশুর মতো তুখোড় খেলোয়াড় আমাদের ক্লাসে থাকলে কী হবে, দল হিসেবে ক্লাস সেভেন খুবই দুর্বল। এতই দুর্বল যে প্রায় সব খেলাতেই আমরা হেরে যাই। বিশু চেষ্টা করে খুব। যেখানে বারো গোলের হার অবশ্যম্ভাবী সেখানে বিশুর জন্য আমরা সাত গোলে হেরে ফিরি। যেখানে পঞ্চাশ রান আমাদের হার কেউ আটকাতে পারবে না, সেখানে কুড়ি রানে বিপক্ষ দল জিতে যায়। বিশু এর থেকে বেশি আর কী করতে পারে? ম্যাচ শেষ হলে অন্য ক্লাসের ছেলেরা ঠাট্টা করে বলে, ‘এবার থেকে অতজনে মাঠে না নেমে তোরা বরং বিশুকে একা মাঠে নামা। দেখবি রেজাল্ট ভালো হবে।”

এই তো গত বছর আন্তক্লাস ফুটবল টুর্নামেন্টে সব মিলিয়ে বাহান্নটা গোল খেয়ে ক্লাস সেভেন রেকর্ড করল। তবে সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফিটা কিন্তু পেয়েছিল বিশুই। সে ট্রফি পেল আটচল্লিশটা গোল বাঁচানোর জন্য। বিশু না থাকলে আমরা বাহান্নর বদলে ঠিক একশোটা গোল খেতাম।

অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় মাস্টারমশাইরা এই জিনিসটা মাথায় রাখেন। বিশুকে ক্লাসে উঠতে না দিলে আমাদের অবস্থা যে ভয়াবহ হবে সেটা ওঁরা বুঝতে পারেন। হেডস্যারের সঙ্গে অনেক আলোচনা-টালোচনা করে শেষপর্যন্ত স্পোর্টস গ্রাউন্ডে বিশুকে ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়।

তবে গত ফুটবল টুর্নামেন্টের পর থেকে গেম টিচার বিজয়বাবু খুব রেগে আছেন। বলছেন, ‘এতদিন জানতাম, চাঁদের মধ্যে কলঙ্ক থাকে। কিন্তু তোদের ক্লাসে দেখছি, একগাদা কলঙ্কের মধ্যে একটা চাঁদ পড়ে রয়েছে। এ আর মেনে নেওয়া হবে না। বিশুকে হয় ফেল করিয়ে আটকে দেব, নয়তো ডবল প্রমোশন দিয়ে উঁচু ক্লাসে তুলে নেব। না তোদের সঙ্গে আর ওকে রাখা যাবে না।”

বিজয়বাবুর এই হুমকি শুনে আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল। হারবারও একটা প্রেস্টিজ থাকবে না। এখনই তো আমাদের ক্লাসের নাম হয়ে গেছে, “হেরো ক্লাস সেভেন’, এরপরে হয়তো হবে সুপার হেরো ক্লাস সেভেন।’ সে বড়ো লজ্জার হবে।

এতকিছুর পরও আমাদের কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হল। ক্লাস টিম থেকে বিশুকে বাদ দিতে হল।

খবরের নিয়ম হল যে খবর যত বেশি গোপন রাখার চেষ্টা হবে সে খবর তত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে। এটার ক্ষেত্রেও তাই হল। টিফিনে আমরা যে সিদ্ধান্ত নিলাম, ছুটির আগে সবাই সেটা জেনে গেল। অন্য ক্লাসের ছেলেরা এসে আমাদের ধরে ধরে জানতে চাইল, এরকম ভয়ঙ্কর ঘটনা আমরা কোন সাহসে ঘটালাম? আমরা চুপ করে থাকলাম। বেশি চাপাচাপি করলে বললাম, “এটা ক্লাস সেভেনের নিজস্ব ব্যাপার। বলা যাবে না।”

আমাদের মন খুব খারাপ। খেলায় ক্লাস সেভেনের ভবিষ্যতের কথা ভেবেও খুব দুশ্চিন্তা হতে লাগল।

পরদিন স্কুলে যেতেই পল্টু, প্রসূন, সুকল্যাণকে বিজয় স্যার ডেকে পাঠালেন। চোখে মুখে টেনশন। টিচারস রুমের এক কোণে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, যা শুনছি সেটা সত্যি নাকি?”

সুকল্যাণ মাথা নামিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ স্যার সত্যি।’

স্যার আঁতকে উঠে বললেন, ‘বলিস কী! সত্যি! ক্লাস শুদ্ধ তোদের সকলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”

প্রসূন বলল, “কিছু করার নেই স্যার। আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন।”

স্যার চাপা ধমকের গলায় বললেন, “ক্ষমা করব মানে? বিশু না খেললে কী অবস্থাটা হবে একবার বুঝতে পেরেছিস? হেডমাস্টারমশাইকে আমি কী কৈফিয়ত দেব? না কিছুতেই তোমাদের একথা শোনা যাবে না। বিশুকে তোমরা আজই দলে ফিরিয়ে নাও। পরশু ক্লাস এইটের সঙ্গে তোমাদের ম্যাচ। আমি দেখতে চাই তখন বিশুও খেলছে।”

পল্টু মাথা নামিয়ে বলল, “সেটা হয় না স্যার। বিশু খেললে আমরা কেউ খেলব না।”

স্যার রেগে গিয়ে চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘খেলবে না মানে। তোমাদের তো খুব সাহস বেড়েছে দেখছি।” কিছুক্ষণের মধ্যে গলা নামিয়ে বললেন, কী হয়েছে রে তোদের? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বিশুর সঙ্গে সকলের ঝগড়া হয়েছে নাকি? খুলে বল তো।”

স্যারকে সব বলা হল। কীভাবে বিশু খেলায় হেরে যাওয়ার পরও হাসে, কীভাবে ক্লাস হারলে হাসে, হাসতে হাসতে বাড়ি যায়, কীভাবে নিজে গোল খেয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, কীভাবে আউট হয়ে যাওয়ার পর দাঁত বের করে মাঠের বাইরে ফিরে আসে, কীভাবে দৌড়ে পিছিয়ে পড়লে মজা পায়-সবই।

সব শুনে বিজয়স্যার অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। মনে মনে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করলেন। ছাদের দিকে পিটপিট করে তাকালেন। তারপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “না, বিষয়টা সত্যি খুব জটিল। জিতলে হাসে আমি জানি, কিন্তু হারলে কেন হাসবে? হারার মধ্যে হাসির কোন এলিমেন্ট আছে? হারলে তো কাঁদার কথা? এতদিন ধরে গেম টিচারের কাজ করছি। কত খেলা করলাম, কত খেলা দেখলাম। এরকম তো শুনিনি কখনও! বিশু ছেলেটার মাথায় একটু গোলমাল আছে সেটা আমরা সব মাস্টারমশাই জানি। কিন্তু এখন দেখছি গোলমাল একটু নয়, গোলমাল খুব বেশি।”

সুকল্যাণ বলল, “তাহলেই বলুন স্যার, এরপর ওকে দল থেকে বাদ দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল? কাজটা করে আমাদের খুবই দুঃখ হয়েছে। আমরা ওকে প্রত্যেকে খুব ভালবাসি। খেলাধুলোয় ও আমাদের ক্লাসের গর্ব, স্কুলের গর্ব। কিন্তু এই ঘটনার পর ওকে বাদ না দিয়ে আমাদের কী উপায় ছিল?”

প্রসূন বলল, ‘ক্লাস সেভেন সব খেলায় হারতে পারে স্যার, কিন্তু প্রেস্টিজ বলে তো একটা জিনিস থাকবে। সেটায় তো হার মেনে নেওয়া যায় না।’

বিজয়স্যার বললেন, “কখনই নয়। তোদের মুখে যা শুনলাম তাতে মনে হচ্ছে বিশু হার জিতের ব্যাপারটাতেই একটা গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছে। এই পাগলামি যদি সংক্রামিত হয় তাহলে কেলেঙ্কারি। এবার থেকে হেরে গিয়েও সবাই ধেই ধেই করে নাচবে। নিজে গেম টিচার হয়ে আমি এই বেনিয়ম কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। না, নো নেভার।” এতদূর বলে বিজয়স্যার হাঁপ নিলেন। নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, “কিন্তু পরশুদিনের খেলাটার কী হবে? এরকম সময় যদি তোরা দু-তিন ডজন গোলে হারিস আমি তো মুখ দেখাতে পারব না। আচ্ছা, এবারটা কী বিশুকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না? বিশুকে নিলেও তোরা যে হারবি তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বিচ্ছিরি ভাবে হারাটা তো ঠেকানো যেত আর এবারকার মত আমার মুখ কিছুটা রক্ষা পেত।’

সুকল্যাণ, প্রসূন, পল্টু মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এর জন্য ওরা তৈরি ছিল না। স্যারের বকাঝকা ঠিক আছে, কিন্তু তা’বলে এভাবে অনুরোধ? তিনজনই খুব লজ্জা পেয়ে গেল। পল্টু আমতা আমতা করে বলল, ‘পরশুর খেলাতেও আমরা যে হারব…। আর তারপর যদি বিশু আবার হাসে?”

বিজয়স্যার এবার রেগে গেলেন। গলা তুলে বললেন, “গাধাটার হাসি আমি বের করছি। ফের যদি হেরে গিয়ে হাসে তাহলে ওকে স্কুল থেকে দূর করে দেব। তাছাড়া এটাই তো ওর শেষ ম্যাচ।”

টিফিনের সময় গাছতলায় আবার জরুরি মিটিং। বিশু স্কুলে এসেছে, কিন্তু মিটিঙে ডাকা হয়নি। গাছের ডালে বসে পল্টু বিজয় স্যারের কথা সবাইকে বিস্তারিত জানাল। তারপর ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলে বলল, “বন্ধুগণ, কোন উপায় নেই। স্যারের মুখরক্ষার জন্যই আমরা এবারের মতো বিশুকে ফিরিয়ে নিচ্ছি। আবার আমরা হারব এবং বিশু আবার হাসবে। কিন্তু সেটাই ওর শেষ হাসি হবে।”

কার শেষ হাসি, কে হাসে?

সেদিন খেলায় যা ঘটল তা আমরা কল্পনা করতেও পারিনি। গোটা স্কুলের কেউ-ই পারেনি। বাবা, মায়েদের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে থাকা মাস্টার মশাইরা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলেন। বিজয় স্যার ঘন ঘন নস্যি নিয়ে হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘাড়ের কাছে গিয়ে হাঁচতে লাগলেন। এতে হেডমাস্টার মশাইয়ের খুব রেগে যাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি রেগে না গিয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, “বিজয় তোমার নস্যির কৌটোটা একটু দাও তো। এক টিপ নিয়ে ফেলি। এই সময় মাথা পরিষ্কার রাখাটা জরুরি।”

আজকের খেলায় আমরা তিন-এক গোলে ক্লাস এইটকে হারিয়ে দিলাম!

সবাই চলে গেছে। আমরা ক্লাস সেভেনের ছেলেরা মাঠের এককোনায় গোল হয়ে বসে আছি চুপ করে। জিতে এত ঘাবড়ে গেছি যে কথা বলতে পর্যন্ত ভুলে গেছি। সন্ধে হতে আর দেরি নেই। অল্প অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে।

জেতার বিকেল বুঝি এত সুন্দর হয়! হঠাৎ শুনি ফোঁপানির আওয়াজ। মুখ ফিরিয়ে দেখি, একটু দূরে বিশু হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বসে আছে। কাঁদছে নাকি! হ্যাঁ, কাঁদছেই তো! আরে, কাঁদছে কেন? জেতার পর কেউ কাঁদে নাকি! ছেলেটা সত্যি পাগল। হাফটাইমের পরে ও চার চারটি গোল না বাঁচালে আমরা আজ আবার হারতাম।

পল্টু উঠে গিয়ে বিশুর পিঠে হাত রাখল। বলল, “অ্যাই বিশু, কাঁদছিস কেন? অ্যাই মুখ তোল। মুখ তোল বলছি। কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”

বিশু মুখ তুলল। চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “কাঁদছি তো তোদের কী? আনন্দ হচ্ছে তাই কাঁদছি। প্লিজ, তোরা আমাকে কাঁদতে দে।”

আমরা ওকে কাঁদতে দিলাম।

এরপর বহু খেলায় আমরা জিতেছি, তেমনি অনেক খেলায় হেরেছিও। বিশু কিন্তু তার স্বভাব বদলায়নি। হেরে গেলে সে একইরকম ভাবে হাসে। তবে আমরা আর রাগ করি না। কারণ, আমরা বুঝতে পেরেছি, হারবার পর হাসা খুব কঠিন কাজ। এই কাজ সবাই পারে না। বিশুর মতো পাগলাটে ধরনের ছেলেরাই কেবল পারে। হারবার পর তারা মোটেও ভেঙে পড়ে না। বরং হাসতে হাসতে তারা নিজের জেদটাকে বাড়িয়ে নেয়। যাতে কোনও না কোনদিন জিতে খুব আনন্দ হয়। এত আনন্দ যে কান্না পেয়ে যায়।

Leave a Reply